অতঃপর প্রণয় পর্ব-২০

0
78

#অতঃপর_প্রণয়
#পর্বঃ ২০
#জেসমিন_জেমি

তালুকদার বাড়ীর তিন গিন্নী আজ ভীষণ ব্যস্ত। বাড়ীর বড় মেয়েকে দেখতে পাত্র পক্ষ আসবে। এজন্য ব্যস্ত হাতে আছমা বেগম আর হিমি বেগম সবটা করছেন। ইলমি তাদের হাতে হাতে সাহায্য করছে বাড়ীর একমাত্র বউ বলে কথা তাকে তো সবদিকে খেয়াল রাখতেই হবে। এই কয়েক মাসে হিমি বেগম আর আছমা বেগমের থেকে কয়েক পদের রান্নাও সে শিখে নিয়েছে ইলমি তবে কখনো রান্না করা হয়ে উঠেনি । ইলমি ব্যস্ত পায়ে রান্না ঘর থেকে বের হলো পুরো বাড়ী সাফ-সাফাইয়ের দায়িত্ব গিয়ে পড়েছে সুফিয়ার উপর ইলমি সেটাই দেখতে গেলো সুফিয়া কতদূর পর্যন্ত করতে পেরেছে। ইমরুল তালুকদার ড্রয়িংরুম জুড়ে পায়চারি করছেন। উনি এখনি, এতো তারাতারি নিজের মেয়েকে বিয়ে দিতে চায় না, কিন্তু বন্ধুর মুখের উপর না ও করতে পারেন নি। মাহিদ ছেলে ভালো, এডুকেটেড, ভালো জব সব মিলিয়ে ইমরুল তালুকদার যেমন ছেলে চান মাহিদ ঠিক তেমনই।
——
হিমি বেগমের আর আছমা বেগমের হাতে হাতে কাজ এগিয়ে দিচ্ছে ইলমি। এই কয়েক মাসে ইলমির সাথে হিমি বেগমের বেশ ভাব হয়েছে। হিমি বেগম ইলমির হাস্যজ্জ্বল মুখ পানে চেয়ে মনে মনে বলে উঠলেন,,

– কি নিষ্পাপ চেহারা। এই মেয়েটার যদি কিছু হয়ে যেতো? আমি নিজেকে কিভাবে ক্ষমা করতাম? কিভাবে কিভাবে আমি এতো নিকৃষ্ট হয়ে উঠেছিলাম? ছিহ ধিক্কার জানাই নিজেকে।
রাগে, ক্ষোভে, ঘৃণায় একজন রাক্ষসী হয়ে উঠেছিলাম।
মিলি বেগমের ভাবনার মাঝেই ইলমি ডেকে উঠলো,

– ও ছোট মা দেখো না হয়েছে কি না?

হিমি বেগম – হ্যাঁ হয়েছে এখন তুই যা আমি আর আপা দেখে নিবো।

-কয়েকমাস আগে-
হিমি বেগম নিজের ভূল বুঝতে পেরেছেন। সেদিন আবরার সবটা যেনে শুনেই বাড়ীতে এসেছিলো। মিলিকে ড্রয়িংরুমে সবার সামনে কষিয়ে একটা ধাপ্পর দিতেই হিমি বেগম ছুটে আসেন। আবরার সবটা খুলে বলতেই সবাই যেনো আঁকাশ থেকে পড়লো সাথে হিমি বেগম ও আবরার সময় মতো সেদিন না থাকলে মেয়েটার সাথে কি হতো এটা ভেবেই আছমা বেগমের গা কেঁপে উঠলো। পুরো তালুকদার বাড়ী আবরারের হুংকারে কেঁপে উঠলো। ইমরুল তালুকদার তীব্রকন্ঠে বললেন,,

এসব কি?কেনো করেছো তুমি?

মিলির ফর্সা গালে আবরারের হাতের ছাপ বসে গেছে। চোখ দুটো জলে ভরে উঠেছে গালে হাত চেঁপে কেঁদে উঠলো,,

-ভালোবাসি, আমি আবরারকে ভালোবাসি। তুমি আমায় ঠঁকিয়েছো আবরার। আপনারা সবাই আমাকে ঠঁকিয়েছেন।

আবরার রাগীকন্ঠে বললো,
ঠঁকিয়েছি? তুই আমার ভালো বন্ধু ছিলি মিলি। জাস্ট এ ফ্রেন্ড।

মিলি- হ্যাঁ, হ্যাঁ ঠঁকিয়েছো। কি আছে ওই ইলমির মাঝে যার জন্য তুমি আমাকে ভালোবাসলে না?
আমরা শুধু ভালো বন্ধু ছিলাম না আবরার। আমি তোমায় ভালোবাসতাম। আর এই ইলমি, এই ইলমি আমার থেকে আমার আবরারকে কেড়ে নিয়েছে ওকে আমি ছাড়বো না। বলেই ইলমির দিকে তেড়ে যেতে নিলেই আবরার ইলমিকে নিজের দিকে টেনে নিলো। ইলমি অবাক হয়ে সবটা শুনছে। ইলমি জানতো আবরার আর মিলি আপু ভালো বন্ধু। এটাও শুনেছিলো আবরার আর মিলি একে অপরকে ভালোবেসে বিয়ে করতে যাচ্ছে। আর এই কথাটা মিলি আগ বাঁড়িয়ে নিজে তাকে বলেছিলো।
মিলি জানতো আবরারের মনে ইলমির জন্য ভালোবাসা আছে। আবরার ইলমিকে ভালোবাসে এটা মিলি অনেক আগেই টের পেয়েছিলো। আবরারের জীবন থেকে ইলমিকে সড়িয়ে দিতে সে সবটা করতে রাজি ছিলো। এমনকি ফুপু হিমি বেগমকে ভুলভাল বুঝিয়ে বিয়ের জন্য রাজি করায় সাথে মিলির বাবা সৈকত সাহেব ও।

হিমি বেগমের মনে এ বাড়ীর জন্য রাগ মূলত সৃষ্টি হয়েছে সৈকত সাহেবের জন্য। সৈকত সাহেব দিনের পর দিন, মাসের পর মাস হিমি বেগমকে এ বাড়ীর সম্পর্কে ভূলভাল বুঝিয়েছেন আর বোকা হিমি বেগম সবটা শুনে নিজের মনে বছরের পর বছর রাগ ক্ষোভ জমিয়ে রেখেছেন। হিমি বেগমের রাগ থাকলেও সে কখনোই চায়না একজন মেয়ে হয়ে, একজন মা হয়ে অন্য একজন মেয়ে, নিজের মেয়ের বয়সী মেয়ের এতো বড় সর্বনাশ করতে। ওখানে যদি ইলমির বদলে তার দুই মেয়ের একজন থাকতো? তাহলে? সয়তান গুলো তার মেয়েকেও ছিঁড়ে ছিঁড়ে নাহ আর ভাবতে পারলেন না হিমি বেগম ছুটে গিয়ে মিলির গালে কষে লাগালেন এক থাপ্পড়। রাগীকন্ঠে বললেন,

– অসভ্য! মেয়ে হয়ে অন্য একজন মেয়ের এতো বড় সর্বনাশ করার চিন্তা করতে তোর বিবেকে বাঁধলো না? ছিহ ভাবতেই লজ্জা লাগছে তুই আমার ভাইঝিঁ।

মিলি বেশ অবাক হলো, পরপর শব্দ করে হেঁসে উঠলো,

– বাহ তুমিও পল্টি নিলে? ভূলে যেয়ো না এসবের সাথে তুমিও ছিলে ফুপি?

মুহুর্তেই তালুকদার বাড়ী থমথমে পরিবেশ। সবাই অবাক চোখে হিমি বেগমের দিকে তাকিয়ে রইলো। ইমরুল তালুকদার ছুটে এসে হিমি বেগমের বাহু চেঁপে বলে উঠলেন,
– তুমি? তুমিও এসবের সাথে ছিলে হিমি?

হিমি বেগম কিছু বললেন না শুধু মেয়ে দুটোর মুখের দিকে করুন চোখে চেয়ে রইলেন। তূর্ণা তূর্ফার চোখ উপচে পড়ছে জলে। মুহুর্তেই মায়ের জন্য ঘৃণা সৃষ্টি হলো তাদের মনে। ইমরুল তালুকদার রাগে কাঁপতে থাকলেন, রেগে গিয়ে এই প্রথম হিমি বেগমের গায়ে হাত তুললেন। নিজের সর্ব শক্তি দিয়ে একটা ধাপ্পড় দিতেই শুকনো, পাতলা হিমি বেগম ছিটকে পড়লো দূরে ঠোঁটের কোনায় ফিনকে দিয়ে রক্ত বের হতে লাগলো। হিমি বেগম চোখ ভর্তি পানি নিয়ে একে একে সবার মুখ পানে চাইতেই দেখলো সবাই মুখ ফিরিয়ে নিলো। আবরার অবাক চোখ তার ছোট মাকে দেখছে এই কি তার ছোট মা যে তাকে ছোট বেলা থেকে এতো এতো ভালোবাসা দিয়ে বড় করেছে? তূর্ণা তূর্ফাও সেখান থেকে ছুটে চলে গেলো। মহিমি বেগম পরিহাসের হাসি হাসলেন। সে অন্যায় করেছে এর শাস্তি তাকে পেতেই হবে।

ইলমি ছুটে গিয়ে হিমি বেগমকে সোফায় বসাতেই আছমা বেগম হিমি বেগমের পাঁশে গিয়ে দাঁড়ালেন করুন কন্ঠে বললেন,

আমার এই বাচ্চা মেয়েটা তোর কি ক্ষতি করেছিলো হিমি? তুই কেনো এসব করলি? তুই তো এমন ছিলি না? এ আমি কাকে দেখছি? এতো আমাদের মিলি নয় তুই তো আমাদের হিমি নয়।

হিমি বেগম এবার হউমাউ করে কেঁদে উঠলেন,

– বিশ্বাস করো ভাবি আমি চাইনি, আমি কখনো চাইনি ইলমির এতো বড় সর্বনাশ করতে আমি তো শুধু চেয়েছিলাম মিলি এ বাড়ীর বউ হোক।

এসবের সাথে একান্ত ভাবে মিলি আর সৈকত সাহেব জড়িত। হিমি বেগমকে ব্যবহার করে এই নোংরা খেলায় মেতে উঠেছিলো আর হিমি বেগম না জেনে নিজেকে এই নোংরা ঘটনায় জড়িয়ে ফেলেছিলেন৷ মিলি আর সৈকত সাহেবকে আবরার পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে।

হিমি বেগম দুদিন তালুকদার বাড়ীর গেস্টরুমে পরে রইলো। ইমরুল তালুকদার এ দুদিনে প্রিয়তমা স্ত্রীর দিকে ফিরেও চাইলেন না। তূর্ণা তূর্ফা একবারের জন্যও মায়ের সাথে দেখা করতে আসলো না । আবিরা আর ইলমি পরপর খাবার খাইয়ে দিয়েছে হিমি বেগমকে। ইমরুল তালুকদার ও তার প্রাণ প্রিয় স্ত্রীর বিন্দু মাত্র খোঁজ নেন নি বরং সে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন হিমি বেগম যেনো এ বাড়ী ছেড়ে চলে যায়। দুদিনে হিমি বেগমকে একদম অন্য রকম লাগছে। চোখের নিচে কালো দাগ পরে গেছে। মুখটা কেমন শুকনো শুকনো লাগছে। ইলমির খুব মায়া হলো হিমি বেগমের জন্য আবরারের কাছে হিমি বেগমের হয়ে ক্ষমা চাইলো আর যতক্ষণ না আবরার হিমি বেগমের সাথে কথা না বলবে ততক্ষণ ইলমিও আবরারের সাথে কথা বলবে না৷ তিনদিন পর হিমি বেগম বাড়ী ছেড়ে চলে যেতে নিলেই আবরার তাকে আঁটকে দেয়। তূর্ণা তূর্ফা দৌড়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে নেয়। ইলমি তৃপ্তির হাসি হাসে হিমি বেগম মেয়েদের সাথে ইলমি আবিরাকেও জড়িয়ে নেন৷ হিমি বেগম নিজের ভূল বুঝতে পেরেছে এরজন্য বাড়ী সবাই তাকে ক্ষনা করে দিয়েছে কেননা যারা ভূল করে নিজেদের ভূল বুঝতে পারে তাদেরকে মহান আল্লাহ তায়ালাও ক্ষমা করে দেন ।

————

ইলমি ফ্রেশ হয়ে হিমি বেগমের থেকে শাড়ী পরে এসেছে৷ শাড়ীর কুচি গুলো ঠিক করার জন্য দরজা হালকা চাঁপিয়ে ড্রেসিংয়ের সামনে কুচি গুলো একটা একটা করে ভাঁজ করে নিচ্ছিলো। প্রায় অনেকক্ষণ পর কুচি গুলো ঠিকঠাক মতো গুঁজে হাফ ছেড়ে বাঁচলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আয়নায় তাকাতেই দেখলো আবরার চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে ইলমি আবরারকে দেখে চমকালো পরপর আবরারের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাতেই দেখলো তার উন্মুক্ত ফর্সা কোমড়ের ভাঁজে আবরারের চোখ আঁটকে আছে ইলমি ছিটকে সরে গেলো ওখান থেকে তারাহুরো করে শাড়ীর আঁচল নামিয়ে দিলো। এক আকাশ পরিমান বিরক্তি ভরা কন্ঠে বললো,
অসভ্য ! নির্লজ্জ কোথাকার?

আবরাররের কানে অসভ্য শব্দটা পৌঁছাতেই ঠোঁট কামড়ে হাঁসলো। ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে পান্জাবির বোতাম খুলতে খুলতে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো। যেতে যেতে ইলমির দিকে আড়চোখে চেয়ে গানের সূরে বললো,,
অসভ্য হয়েছি আমি তোমারি কারণে……….

চলবে,,,,,,,,,

।ভূলক্রুটি মার্জনীয়।