অতীত দেয়ালে লেখা গল্প পর্ব-১২

0
190

#অতীত_দেয়ালে_লেখা_গল্প
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_১২

বয়স আর কত তখন? সতেরো পেরিয়ে আঠারোতে পা দিবে দিবে ভাব। কলেজে উঠেছে সবে। বড় ভাই পড়ে ঢাকায়। মস্ত বড় এক প্রতিষ্ঠানে। সেকালে মেয়েদের এত পড়াশোনা করতে দিত না কেউ। ভাইয়ের কল্যাণে সে পেল পড়ালেখার সুযোগ। বাবার তখন অনেক স্বপ্ন। ছেলে, মেয়ে অনেক বড় হবে। তার নিজের স্বপ্নও ছিল তাই। কিন্তু কে জানতো ভাগ্য তার মোর নিবে অন্য পথে। মন দিয়ে বসবে সে! সাধে কি আর গুণীজনেরা বলে, ‘কপালের লিখন যায় না খন্ডন।’
মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হলো সখীপুর সরকারি মুজিব কলেজে। কলেজের পড়ালেখার পাশাপাশি এক নতুন রূপ দেখতে পেলো সে নিজের মাঝে নিজেই। আবেগি কিশোরীর মনে উড়ে বেড়ায় রঙ বেরঙের প্রজাপতি। মনের আকাশে উড়ে বেড়ানো প্রজাপতি গুলো মন থেকে বের হয়ে মুক্ত আকাশে উড়লো একদিন। কি বলে একে? প্রেমে পড়া? তবে তাই সই!চৌধুরী বাড়ির ছেলেটা মন কাড়লো তার। তাদের কলেজেয় সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। দেখতে যেমন সুন্দর ব্যবহারও নজরকাড়ে। স্যারদের প্রিয় ছাত্র। চৌধুরী বাড়ির ছেলে হওয়াতে সকলের মধ্যমণি তো ছিলয়। কলেজ থেকে যাওয়া-আসার পথে মোরের চায়ের দোকানটায় তাকে দেখলে অকারণে লজ্জা লাগতো তার। আবার না দেখেও থাকা যেত না। যেদিন দেখা মিলতো না সেদিন অস্থির লাগতো। দম ফুরিয়ে যেত। স্বস্তি মিলতো না কিছুতেই। অনুভূতি গাঢ় হলো আরও। চোখ দুটো হলো র্নিলজ্জ। বে*হায়ার মতো তাকিয়ে দেখতে লাগলো এক তরুণকে। দিন যেতে না যেতেয় হাত হলো তার শত্রু বুঝি? সেদিন বাংলা খাতার শেষ পাতা জুড়ে শুধু ইংরেজি প্রথম বর্ণ লিখে ফরিয়ে ফেলল। বান্ধবী জিজ্ঞেস করলো,
-কিরে? তোর নাম তো এই অক্ষর দিয়ে শুরু হয় না। তবে কার নাম? হু?
বান্ধবীর দুষ্ট কথায় ফর্সা গাল লাল হলো। কিন্তু জবাব দিতে পারলো না। যার জন্য এতো পাগলামি তাকে না বলে অন্য কাউকে আগে বলবে? কখনো না। কিন্তু তাকে বলবে কি করে? তার সাথে যে সারাদিন লেপ্টে থাকে ছেলেপেলেরা।

আষাঢ়ের শুরু। দিন নেই রাত নেই ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি সারাদিন। টিনের চালে যেন বিভিন্ন মুদ্রায় নৃত্য পরিবেশন করে কেউ। তখন আষাঢ়ের মাঝামাঝি। সেদিন সকালে বৃষ্টি ছিল। তবে মুষলধারে নয়। ইলশেগুঁড়ি। দুপুরের দিকে বৃষ্টি কমে গেলো অনেকটা। কলেজ থেকে ফিরার পথে তাকে মোরের সামনে দেখলাম। কিছু পথ যাওয়া পর পিছে পদশব্দ পেয়ে ঘাঁড় বাকিয়ে তাকালাম। প্রিয় পুরুষকে দেখে ঠোঁটে আপনাআপনি ফুটে উঠে হাসি। হাঁটার গতি কমে গেলো। খুব সহজেই সে সামনে এগিয়ে গেলো আমার। আজ সে একা। যে করেই হোক আজ বলতেয় হবে মনে কথা। আর কতদিন চাপা রাখা যায়। বহু সাহস সঞ্চয় করে ডাকলাম,
-শুনুন
পিছে ফিরে তাকালো সে। আশেপাশে একবার তাকিয়ে মৃদু বলল,
-আমায় ডেকেছো?
উপর নিচ মাথা নারলাম। যতটুকু সাহস যোগাড় করছিলাম তা ডাকতে গিয়েই ফুস। এখন আর কথা বের হচ্ছে না মুখ দিয়ে। সে আবার বলে উঠলো,
-কিছু বলবে?
পুনরায় মাথা নাড়লাম। ভবালাম বিরক্ত হচ্ছে বোধহয়। নিজে ডেকে আবার কথা বলছিনা। বিরক্ত হওয়ার ই তো কথা। সে আবার বলল,
-হ্যাঁ বলো কি বলবে?
কথা বললাম না তবে তার হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিলাম। তারপর হাওয়া। আমাকে আর পায় কে। সে প্রশ্ন করতে চেয়েছিল। কিন্তু জান নিয়ে আমার ছুটে যাওয়া দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল। পাগল ভাবলো বোধহয় আমাকে। তাতে কি? আমার মিশন সাকসেসফুল।

-স্যার, স্যার! অর্কের জ্ঞান ফিরেছে।
কুঞ্জ ছুটে বের হয়ে গেলো কেবিন থেকে। কুঞ্জের কথায় অতীত ভাবনা থেকে বের হলেন মিসেস তানহা। ছেলের দিকে তাকিয়ে দেখলেন অর্ক হাত নাড়ছে একটু। চোখ দুটো পিটপিট করছে। ডাক্তার ইমরুলকে নিয়ে কেবিনে প্রবেশ করলো কুঞ্জ। তিনি অর্কের হার্টবিট চেক করলেন। আরো কিছু চেকআপ করে বললেন,
-হি ইজ অলরাইট। হাতের আর পায়ের ক্ষতটা একটু গভীর। আজকে রাতটা হসপিটালে থাক। কাল বাসায় নিও যেও। আর ড্রেসিং তুমি নিজেই করতে পারবে।
-ইয়েস স্যার।
-তাহলে আমি যাই। সমস্যা হলে আমাকে বলো।
-স্যার!
-কিছু বলবে কুঞ্জ?
-সপ্তাহ খানেক ক্লাস মিস হলে…
-নো পরবলেম মাই গার্ল। আই উইল ম্যানেজ।
-থ্যাংকিউ সো মাচ স্যার।
ডাক্তার ইমরুল হাসলেন। এরপর বের হয়ে গেলেন কেবিন থেকে।
অর্ক চুপচাপ শুয়ে আছে। কুঞ্জ ওর পাশে বসে মাথায় হাত রাখলো। অর্ক আবার চোখ বুজে ফেললো। কুঞ্জ আলম সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল,
-অর্ক এখন ঠিক আছে বাবা। আপনি মা আর অদিতিকে নিয়ে চলে যান। কাল সকালে আমি ওকে নিয়ে ফিরবো।
মানতে চাইলেন না তিনি। জোড় করে সবাইকে পাঠিয়ে দিলো কুঞ্জ। সবায় চলে যাওয়ার পর অর্ককে খাবার আর মেডিসিন খাওয়ালো। এরপর ঘুম পাড়িয়ে দিলো। একা একা বসে অর্ককে আপন মনে দেখতে লাগলো কুঞ্জ। ছেলেটা এত মায়াবী! কে বলেছে শুধু মেয়েরা মায়াবী হয়? ছেলেরাও হয়। কতশত বার যে মাশাআল্লাহ পড়লো কুঞ্জ। তার হিসেব নেই।

রাত আটটার দিকে মায়ের নাম্বার থেকে কল এলো। কুঞ্জ রিসিভ করতেয় ওপাশ থেকে বলে উঠলেন রাইমা চৌধুরী,
-কেমন আছো কুঞ্জ?
-ভালো আছি আম্মু। তুমি কেমন আছো?
-আমি ভালো নেই। কারণ তুমি ভালো নেই!
কুঞ্জ মৃদু হাসলো। আলতো স্বরে বলল,
-আমি ভালো না থাকলে তুমি ভালো থাকো না আম্মু?
-তুমি ভালো না থাকলে আমি ভালো থাকি না কুঞ্জ। আমার ভালো থাকার কারণ শুধু তুমি।
-আর কুহু?
রাইমা চৌধুরী হাসলেন। মৃদুস্বরে বললেন,
-চৌধুরী পরিবারে জন্ম তার। বউ হবে চৌধুরী বাড়ির। পুরো পরিবার ওর সাথে। সবচেয়ে বড় কথা যার আস্ত একটা নুহাস আছে সে কখনো খারাপ থাকে?
-আমারও তো আস্ত একটা অর্ক আছে আম্মু। আমি কেন খারাপ থাকবো?
রাইমা জবাব দিলেন না। কথা ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
-অর্ক কেমন আছে এখন?
রাইমার ধারণা ছিল মেয়ে এই প্রশ্নে একটু চমকাবে। প্রশ্ন করবে তুমি কিভাবে জানলে আম্মু। কিন্তু মেয়ে তার একটুও চমকায়নি। সাবলীল ভাবে উত্তর দিলো,
-আলহামদুলিল্লাহ। অর্কের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
– এখন ঠিক আছে।
-আমাকে জিজ্ঞেস করবে না আমি কিভাবে অর্কের কথা জানি?
-নাহ!
-কেন?
-তুমি জানাটায় স্বাভাবিক আম্মু বরং না জানলে অবাক হতাম!
-তুমি ভীষণ চালাক কুঞ্জ!
-আর আমার এই গুণটা তোমার খুব পছন্দ।
রাইমা চৌধুরী হাসলেন। তৃপ্তির হাসি। আলতো স্বরে বললেন,
-আমি তোমার মতো চালাক হলে খুব ভালো হতো।
-হয়তো। আম্মু!
-বলো
-সুখী মানুষ কারা?
-হঠাৎ এই প্রশ্ন?
-উত্তর দিবেনা?
-যাদের জীবনে ভালোবাসা আছে তারা সুখী মানুষ।
-তুমি কি সুখী মানুষ আম্মু?
-অবশ্যই!
-কিভাবে?
-আই হ্যাভ আ বিউটিফুল প্রিন্সেস। আমি তাকে জীবনের মতো ভালোবাসি। আর সে আমাকে জীবন থেকেও বেশি ভালোবাসে। এতো ভালোবাসা থাকার পরেও তুমি বলবে আমি অসুখী?
-তোমার আফসোস হয় না আম্মু?
-তুমি আসার আগ অবধি হতো। তুমি আসার পর থেকে আর হয়না।
-তোমার কার উপর সবচেয়ে বেশি রাগ হয় আম্মু?
-নিজের উপর!
-কেন?
-যার মনে আমার জন্য জায়গা নেই তাকে ভালোবাসি বলে।
-আম্মু আই মিস ইউ।
-আম্মু মিস ইউ টু প্রিন্সেস।
কলটা কেটে গেলো। কুঞ্জ জানে আম্মু কেটে দিয়েছে। তবুও ফোনটা কানে ধরে রাখলো। আম্মুর কান্নাগুলো একটু শোনা যাবে? আম্মুকে একটু স্বান্তনা দেওয়া যাবে?

বহুদিন হলো রাইমা এই ঘরে ঘুমাতে আসে না। দোতালায় কুঞ্জের পাশের ঘরটায় থাকে। রাত বিরাতে মেয়ের ঘরে বসে থাকে। মেয়ের জিনিস ছুঁয়ে দেখে। আফজাল চৌধুরীর রাতে খুব একা লাগে নিজেকে। ঘরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। মনে হয় কোথাও যেন কেও নেই। অথচ রাইমাকে তিনি ভালোবাসেন না। কোনদিন সুন্দর করে কথাও বোধহয় বলেননি। তবে কেন একা লাগে? অভ্যাস বলে? হবে মনে হয়। আজ বহুদিন পর সে আলমারির একটা ড্রয়ার খুললেন তিনি। তালা লাগানো থাকে সম সময়। ভিতরে ভ্যাপসা গন্ধ। ড্রয়ার ভর্তি বহু পুরোনো কিছু কাগজ। ফিতা, ভাঙা চুড়ি, কাজল আরও কত কি। সব ছুঁয়ে দেখলেন তিনি। কাগজ গুলো মেলো মেলে দেখলেন। অনেক কাগজের ভিতর থেকে একটা খাম হাতে নিলেন। তার তারুণ্যে পাওয়া প্রথম চিঠি। তাও আবার প্রিয় রমনী থেকে। খামটি খুলে চিঠিটা বের করলেন তিনি। চোখ বুলালেন শুরুতে,

‘তুমি,
প্রিয় বলার অধিকার পাইনি। পাইনি নাম ধরে ডাকার অধিকার। বয়সে বড়। সম্মান দিতে হবে। ভাই বলে সম্মান দিব? তা সম্ভব নয়। তাই সম্বোধন করার মতো কিছু না পেয়ে এমন অদ্ভুত সম্বোধনে চিঠি পাঠাতে বাধ্য হলাম। ভাবছো ভাই বলা যাবে না কেন? তবে শোন। সেটা বলার জন্যেয় তো ঘটা করে এতো আয়োজন।
কিশোরী বসয় নাকি আবেগের বয়স। ভালোলাগে যাকে তাকে। প্রথম ভালোলাগাকে তাই পাত্তা দিলাম না। তখন সবে ক্লাস নাইনে পড়ি। ভুলতে চাইলাম তোমাকে। দূরে দূরে থাকালম। ভাবলাম ভুলে যাব। কিন্তু হায়! ভুলে যাওয়া থাকলো দূরের কথা শয়নে স্বপনে শুধু তুমি আর তুমি!
সে যাক। তবুও দূরে থাকার চেষ্টায় সফল হলাম কিছুটা। কিন্তু কলেজে ভর্তি হয়ে তো আমার সর্বনাশ হলো। ভালোলাগা রূপ নিলো ভালাবাসায়। দূরে থাকতে আর পারলাম। তাই মনে কথা জানালাম।
‘আপনি আমার জীবনে ঘনকালো মেঘে ঢাকা আকাশ নন, আপনি আমার জীবনে ঝলমলে রোদ্দুর।’
শুনুন চৌধুরী বাড়ির বড়পুত্র, আমি আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি।

ইতি,
যা বলে আপনি ডাকবেন

মুখস্থ চিঠিটা পড়া শেষ করে আফজাল চৌধুরী আনমনে উচ্চারণ করলেন,
-তনুশ্রী!
নয়ন বেয়ে গড়িয়ে পড়ল এক ফোঁটা জল!

দরজার আড়াল থেকে আফজাল চৌধুরীকে পর্যবেক্ষণ করা রাইমা চৌধুরীর ঠোঁটে ফুটে উঠলো তাচ্ছিল্যের হাসি। নিজেকে করলো উপহাস!

ঠিক তখন ঢাকার পলাশীর অভিজাত এক ফ্লাটের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা এক রমনীর বুকটা ধক করে উঠলো। কেউ বুঝি ডাকলো? পরিচিত কোন নামে?

#চলবে…?