অতীত দেয়ালে লেখা গল্প পর্ব-১৮+১৯

0
211

#অতীত_দেয়ালে_লেখা_গল্প
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_১৮

সময়ে বয়ে চলছে তার নিজ গতিতে। তাকে থামানোর সাধ্য কারো নেই। কেটে গেছে প্রায় দুই মাস। অর্ক সম্পূর্ণ সুস্থ এখন। পলাশীর মোর থেকে ডান দিকের গলিটাতে ঢুকতেই যে দশতলা বিল্ডিংটা দেখা যায়, তার চারতলার বা’পাশের ফ্লাটটিতে ইদানীং সুখ সুখ আবহাওয়া দেখা যায়। মিসেস তানহা কেমন শান্ত হয়ে গেছেন। বকাঝকা তো বহু দূরের ব্যাপার তিনি কুঞ্জের সাথে উঁচু গলায় কথা অবধি বলেন না। তার মাঝে অপরাধবোধ কাজ করে। সেদিনের পর অনেক ভেবেছেন তিনি। তার বিবেক কাজ করেছে। কাজল চৌধুরীর করা অন্যায়ের শাস্তি অবশ্যই তিনি কুঞ্জকে দিতে পারেন না। আর আফজাল চৌধুরীর ও তো দোষ ছিল না এতে। তবে কুঞ্জের উপর কিসের ক্ষোভ দেখাবেন তিনি। এতদিন নিজের মাঝে জ ঘন্য একটা ইচ্ছে পুষে রেখেছিলেন ভাবলেই আরও খারাপ লাগে তার। কুঞ্জকে গভীর ভাবে খেয়াল করেন তিনি। মেয়েটা এক কথায় অসাধারণ। অসাধারণ হতে যত গুণ লাগে সব তার মাঝে বিদ্যমান। মেয়েটি বলেছিল তাকে সে অন্যরকম। আসলেও তাই। রাইমা নামের মেয়টিকে হিংসে করার দায়েও নিজের ভিতরে খচখচ করে তার। রাইমা মেয়েটা ধৈর্যশীল খুব। নাহয় ভালোবাসাহীন সংসারে থেকেও এমন চমৎকার ভাবে মেয়ে গড়ে তোলা চাট্টিখানি কথা নয়।

কোরবানি ইদের বাকি আছে আর দশদিন। দিনটি শুক্রবার। সবার ছুটি আজ। সকালে ডাইনিং টেবিলে একসাথে বসলো সবায়। অর্ক আর অদিতি অকারণে ঝগড়া করছে। আলম সাহেব মৃদু হেসে তাকিয়ে আছে ছেলে-মেয়ের দিকে। কুঞ্জ টেবিল সাজাচ্ছে। মিসেস তাহনা অপলক চেয়ে দেখছেন মেয়েটার নিপুণ হাতের কাজ। কুঞ্জ সবার প্লেটে খাবার বেড়ে দিলো। অর্ক কিছু বলবে তার আগে মিসেস তানহা বলে উঠলেন,
-তুমিও বসো।
অর্ক হাসলো। তার হাসিতে প্রাপ্তি। এটায় তো চেয়েছিল সে। হাসলো আলম সাহেব আর অদিতিও। অদিতি মুখে পায়েস নিয়ে বলল,
-উফফ ভাবি! তোমার হাতের পায়েসটা জাস্ট ওয়াও।
আলম সাহেব সায় দিয়ে বলল,
-একদম ঠিক বলেছিস। বারবার খেতে মন চায়।
কুঞ্জ মুচকি হেসে বলল,
-একদম পাম দিবে না তোমরা। মায়ের হাতের টা বেশি মজা।
অর্ক হাসলো। সাথে সবায়। কি সুখ এই বাসায়। আহা। দেখেলেও প্রাণ জুড়ায়।
কুঞ্জ মুখে একবার খাবার নিয়ে মিসেস তানহাকে ডাকলো,
-মা।
-বলো।
-আমি একটু বাড়ি যেতে চাচ্ছিলাম।
মিসেস তানহা পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন কুঞ্জের দিকে। কিছুটা অবাক হয়ে বলল,
-ও বাড়িতে তো কেউ জানে না। কে নিয়ে যাবে তোমাকে? আর এই সময় যাবে। ইদ সমানে।
কুঞ্জ আলতো স্বরে বলল,
-দুইদিন থাকবো শুধু মা। চলে আসবো তারপর। আমার ভাইদের বললে এসে নিয়ে যাবে।
-তোমরা না দুই বোন? ভাই?
-আমরা দুই বোন মা। আমার ছোট চাচা আর মেঝ চাচার ছেলে।
-আকরাম ভাই আর আরিফের ছেলে?
কুঞ্জ মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো। মিসেস তানহা ফের বলল,
-কত বড় ওরা?
-দু’জনেই অনার্স র্ফাস্ট ইয়ারে পড়ে।
-সম বয়সী?
-হ্যাঁ। ছয় মাসের ছোট বড়।
-আচ্ছা আসতে বলো তাহলে।
কুঞ্জ ধীর কন্ঠে বলল,
-তাহলে কাল যাই মা? দু’দিন পর ফিরবো?
মিসেস তানহা মাথা নাড়লেন। মুখে বললেন,
-আচ্ছা বেশ।
পরক্ষণেই মুখ তুলে তাকালেন কুঞ্জের দিকে। চোখ বড় বড় করে বললেন,
-আফজাল তোমায় আসতে দিবে?
কুঞ্জ হাসলো। তৃপ্তির হাসি। তাকে সহ্য করতে না পারা মানুষটা তার জন্য চিন্তা করছে। ভাবা যায়? মৃদুস্বরে বলল,
-চিন্তা করবেন না মা। আমি দু’দিন পর এ বাসায় থাকবো। প্রমিজ!
এবার ভরসা পেলো তাহনা। আর কথা বাড়ালেন না। এদিকে অর্ক অবাক হয়ে একবার বউ তো একবার মায়ের দিকে তাকাচ্ছে। মাথায় ঘুরছে প্রশ্ন, মা চৌধুরী বাড়ি সম্পর্কে এতকিছু কি করে জানে? আর বউ শাশুড়ির ভাব দেখেছো? বউ তার অথচ টেনশন মায়ের বউ ফিরবে কবে। আসতে দিবে কিনা, কার সাথে যাবে। বাপরে। তার তিন বছরের প্রেমকে তো মা দুই মাসের প্রেমে হারিয়ে দিলো!

দুপুরের খাবারের পর কুঞ্জ অর্কের বুকে মাথা দিয়ে শুলো। কল করলো ভাইয়ের নাম্বারে। পূর্ব রিসিভ করলো সাথে সাথেয়। যেন বোনের কলের অপেক্ষায় ছিল সে। কুঞ্জ আলতো স্বরে বলল,
-পূর্ব।
-বড় আপা! কেমন আছো?
-ভালো আছি ভাই। তুই ভালো আছিস?
-হ্যাঁ আপা।
-কালকে ফ্রি আছিস পূর্ব?
-কি করতে হবে তাই বলো আপা। আমার আপা সবার আগে। বাকি সব নিয়ে আমার কিচ্ছু যায় আসে না।
কুঞ্জ আজকের দিনে দ্বিতীয় বার তৃপ্তির হাসি হাসলো। এমন ভাই ক’জনের ভাগ্যে জোটে? কুঞ্জ ভীষণ ভাগ্যবতি। সব দিক দিয়ে; ভালোবাসা, ভাই-বোন, মা, বাবা, চাচা-চাচি,শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদ। সবায় তাকে ভালোবাসে।
-নুহাস কে নিয়ে কাল আয় ভাই। আমি বাড়ি যাব।
-সত্যি আপা?
-আপা তোকে কখনো মিথ্যা বলেছি?
-কখন আসবো আপা?
-সকাল করে চলে আয়।
-আচ্ছা আপা আসবো।
-আচ্ছা রাখ। আর শোন। কাউকে বলতে যাবি না। কুহুকেও না। জাস্ট দু’জন চলে আসবি। ওকে?
-আপার কথা শীরধার্য।
কুঞ্জ হাসলো। হাসলো পূর্বও। শোনা গেলো নুহাসের স্বর, আপা কি বলল, এই বল। বল না। পূর্ব কল কাটলো তখন। কুঞ্জ আর এক দফা হাসলো। তার ভাই দু’টো এতো ভালো কেন? এত মায়া কেন? এত ভালোবাসে কেন?

অর্ক বউয়ের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। কিছু সময় পর মৃদুস্বরে বলল,
-কাল চলে যাচ্ছেন কুঞ্জলতা?
-জি মশাই।
-আপনার কষ্ট হবে না আমাকে ছাড়া থাকতে?
-একটু হবে।
অর্ক বউয়ের দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বলল,
-একটু?
কুঞ্জ হাসলো। হাসতে হাসতে বলল,
-হ্যাঁ একটু।
বলে কুঞ্জ আঙুল দিয়ে অল্প একটু পরিমাণ ইশারায় দেখালো। অর্ক অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে ফেলল। কুঞ্জ ফিক করে হেসে দিলো বরের অভিমান দেখে। এরপর নিজেও ওপাশে গিয়ে অর্কের বুকে মাথা রাখলো। কিছু সময় ওভাবে থাকার পর মাথা তুলে চাইলো অর্কের চোখের দিকে। দু’হাতে অর্কের মুখটা আগলে নিয়ে বলল,
-বউ চলে যাচ্ছে। যদি তোমাকে ভুলে যায়? আদর করে দাও।
কুঞ্জের চোখে মাদকতা। অর্ক কিয়ৎকাল তাকিয়ে থাকলো সেই চোখে। অতঃপর ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো প্রেয়সীর ঠোঁটে। কুঞ্জ আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেললো।

পরেরদিন সকাল দশটা নাগাত পলাশীতে পৌঁছালো নুহাস আর পূর্ব। গাড়ি নিয়ে এসেছে তারা। বাড়িতে কাউকে কিছু বলে আসেনি। কুঞ্জ ভোরে উঠে রান্নায় হাত দিয়েছে। ভাইরা প্রথমবার তার শ্বশুর বাড়ি আসছে, আদর যত্ন করতে হবে না? মিসেস তানহাও সাহায্য করছে সব কাজে। অদিতি শসা, গাজর কাটছে। পলাশীর মোরে এসে পূর্ব কল করতেয় অর্ক নেমে গেলো ওদের আনতে। কুঞ্জের তাড়া বেড়ে গেলো। দক্ষ হাতে সামাল দিতে লাগলো সব কাজ; টেবিল সাজানো। প্লেট বাটি ধুয়ে রাখা, নাস্তা সাজিয়ে রাখা, ভাইরা ফ্রেস হবে তার জন্য তোয়ালে, সাবান আলাদা করে রাখা। মিসেস তানহা অবাক হয়ে দেখলেন সব।

ফ্লাটে প্রবেশ করে পূর্ব শান্ত থাকলেও নুহাস শান্ত থাকতে পারলো না। চোখ জোড়া চোরকির মতো ঘুরছে তার। শেষে না থাকতে পেরে বলে উঠলো,
-আপা কোথায় অর্ক ভাইয়া?
নুহাসের কন্ঠে অস্থিরতা। বোনকে দেখার তৃষ্ণা। অর্ক হাসলো। নুহাসকে উত্তর না দিয়ে ডাকলো,
-কুঞ্জ, কুঞ্জ এদিকে আসো।
কুঞ্জ শাশুড়ি মায়ের দিকে তাকালো। মিসেস তানহা হেসে বললেন,
-যাও। বাকিটা আমি সেরে নিচ্ছি।
কুঞ্জ মৃদু হাসলো। ছুট লাগালো ড্রয়িং রুমের দিকে। ভাইদের দেখে থামলো। পূর্ব চুপ। কিন্তু অনবরত ঢোক গিলছে। বহু কষ্টে নিজেকে শান্ত রাখছে বুঝতে পারলো কুঞ্জ। কিন্তু ছটফটে নুহাস কি শান্ত থাকার পাত্র? কখনো না। এক ছুটে এসে বোনকে আগলে নিলো। অস্ফুট স্বরে ডাকলো,
-আপা!
কুঞ্জ চোখ বুজে ফেললো। কতদিন পর ডাকটা শুনলো; ভাইয়ের বুকে মাথা রাখলো। পূর্বের দিকে তাকালো সে। হাতের ইশারায় ডাকলো। ভাইটা তার চুপচাপ কিছুটা, কুঞ্জ জানে। নুহাসের মতো খোলামেলা ভাবে অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে না। তাই নিজে ডাকলো। এবার পূর্ব কে আর পায় কে। বোনকে আগলে নিলো সেও। তিন ভাই-বোনের অসাধারণ মিলন চোখ ভরে দেখলো অর্ক, মিসেস তানহা আর অদিতি। ভাই-বোনের ভালোবাসা এত সুন্দর হয়। ইশ!

#চলবে…?

#অতীত_দেয়ালে_লেখা_গল্প
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_১৯

ডাইনিং টেবিলে হরেক পদের খাবার সাজানো। বিরিয়ানি, ঝালঝাল গরুর মাংস, মুরগির রোস্ট, ডিমের কোর্মা, রুই মাছ ভুনা সহ আরো অনেক কিছু। অর্ক, পূর্ব, নুহাস এবং আলম সাহেব টেবিলে বসে গল্প করছেন আর খাচ্ছেন। মিসেস তানহা তাদের খাবার এগিয়ে দিচ্ছে। কুঞ্জ পাশে দাঁড়িয়ে প্রাণ ভরে ভাইদের খাওয়া দেখছে। মিসেস তানহা বলে উঠলেন,
-চুলায় পায়েস গরম করতে দিয়েছি বউ। একটু দেখে আসতো।
কুঞ্জ মাথা নাড়িয়ে রান্নাঘরে গেলো। অদিতি ভাবির পিছু পিছু সেদিকে পা বাড়ালো। কুঞ্জের পিছে দাঁড়িয়ে আলতো স্বরে বলল,
-তোমার ভাইরা তো ঝাক্কাস ভাবি।
কুঞ্জ পায়েস নাড়তে নাড়তে ননদের তিকে তাকালো। ভাবির চোখের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলো অদিতি। হেসে বলল,
-ভাল্লাগছে!
কুঞ্জ ফিক করে হেসে দিলো। পুনরায় পায়েসে চামচ চালান দিয়ে সুধালো,
-কাকে ভালো লাগলো ননদিনী? ছটফটে, চঞ্চল সাদা বিলাই টাকে নাকি চুপচাপ, গম্ভীর বাদামী বিলাই টাকে?
-ওমা সাদা বিলাই, বাদামী বিলাই কই পাইলা।
কুঞ্জ হেসে দিলো অদিতির কথায়। হাসতে হাসতে বলল,
-ধবধবে সাদাটা সাদা বিলাই অন্য টা বাদামী বিলাই। ওর চোখ বাদামী রঙের।
অদিতি মাথা চাপড়ে বলল,
-তাই বলো। আমি আরো ভাবলাম বিলাই কই থেকে আসলো!
-বললে না তো কোনটাকে ভালো লেগেছে।
-দুটোয় জোস।
কুঞ্জ একপলক অদিতির দিকে তাকালো। আলতো হেসে বলল,
-সাদা বিলাইয়ের দিকে নজর দিয়ে কিন্তু লাভ নেই। ওটা বুকড।
-কে বুক করলো?
অদিতি ভ্রূ নাচিয়ে প্রশ্ন করল।
কুঞ্জের হাসি চওড়া হলো। আলতো অথচ দৃঢ় কন্ঠে বলল,
-কুহু চৌধুরী বুক করে ফেলেছে গো।
-তোমার বোন?
চোখ বড় বড় করে জানতে চাইলো অদিতি। কুঞ্জ মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো। অদিতি স্বস্তি পেয়ে বলল,
-যাক আলহামদুলিল্লাহ। ভুল জায়গায় চোখ যায়নি। আমার ওই গোমড়া মুখোকেই ভালো লেগেছে।
অদিতির বলার ধরন দেখে হেসে ফেললো কুঞ্জ। মৃদু স্বরে বলল,
-অপেক্ষা করুন, নিজের অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করুন। গভীর হলে আমাকে বললেন। আপনাদের কথা বলার ব্যবস্থা করে দিব। ভাইকে পটাতে পারলেই সই। বাকিসব ম্যানেজ হয়ে যাবে। আপনাকে ভাবি বানাতে আপত্তি নেই আমার ননদিনী।
চুলা নিভিয়ে দিয়ে চলে গেলো কুঞ্জে। অদিতি আনমনে হাসলো। তার অনুভূতি সত্যি কেমন? গভীর? নাকি জাস্ট ভালো লাগা?

জোহরের পর ওরা তিন ভাই-বোন বের হয়ে গেলো। মিসেস তানহা, আলম সাহেব থেকে বিদায় নিলো কুঞ্জ। তানহা মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
-তাড়াতাড়ি ফিরো।
আলম সাহেব হেসে বলল,
-সাবধানে যাও মা।
কুঞ্জ সবার থেকে বিদায় নিয়ে নিজের ঘরে গেলো। নুহাস আর পূর্ব আগে নেমে গেছে। অর্কের মুখ ভার। কুঞ্জ হেসে বলল,
-মুখটা বাংলার প্যাঁচের মতো করে রেখেছো কিসের দুঃখে?
অর্ক জবাব দিলো না। কুঞ্জ দুষ্টমি ভরা কন্ঠে বলল,
-আপনার বউ পালিয়ে গেছে মশাই?
অর্ক সরু চোখে তাকালো কুঞ্জের দিকে। কুঞ্জ মিটমিট করে হাসছে। অর্ক রাগী স্বরে বলল,
-খবরদার আমার বউকে নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলবে না। আমার বউ তোমার মতো?
-ও আচ্ছা। আমি কে?
-আমার বউ।
কুঞ্জ হু হা করে হেসে ফেললো। আর্ক বোকাবনে গিয়ে ফের মুখ ফুলালো। কুঞ্জ হাসি থামিয়ে একটু উঁচু হয়ে অর্কের কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো। অর্ক কিছু সময় তাকিয়ে থাকলো তার দিকে। অতঃপর একের পর এক চুমু এঁকে দিলো কুঞ্জের সারামুখে। শেষে কপালে কপাল ঠেকিয়ে দাঁড়ালো। আলতো স্বরে বলল,
-আমি তোমায় মিস করবো বউ। ছয়মাসে পুরো অভ্যাস হয়ে গেছো তুমি। একটুও ভালো লাগে না তোমায় ছাড়া।
-আমিও মিস করবো মি. বর।
কুঞ্জের কপালে গাঢ় চুমু খেলো অর্ক। ফিসফিস করে বলল,
-ভালোবাসি বউ।
কুঞ্জ অর্কের বুকে মুখ লুকিয়ে বলল,
-আমিও ভালোবাসি। ভীষণ।
অতঃপর দুজন বের হলো। অর্ক নিচ পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এলো ওদের। কুঞ্জ গাড়িতে বসে হাত নাড়লো। অর্ক তাকিয়ে থাকলো এক দৃষ্টিতে। গাড়ি ছেড়ে দিলো নুহাস। অর্ক তাকিয়ে রইলো। যতক্ষণ দেখা যায়!

আবার নিজের ঠিকানায় যাচ্ছে কুঞ্জ। নিজের ঠিকান? হ্যাঁ, নিজের ঠিকানায় তো। এই পথ, এই গাড়ি, খোলা জানালা দিয়ে আসা হাওয়া, পাশে ভাই আর গন্তব্য চৌধুরী নিবাস! এতটুকু ভাবলেই সুখি মনে হয় নিজেকে। কতদিন পর মায়ের সাথে দেখা হবে, ছোট আবেগি বোনটা অভিমানে মুখ ফুলাবে। সব কিছু ভেবে হাসলো কুঞ্জ। শঙ্কা থাকলো শুধু একটা জায়গায় বাবা! বাবা কি ঝামেলা করবে খুব?

চৌধুরী নিবাসে সন্ধ্যার নাস্তার আয়োজন করা হচ্ছে। নুডলস পাকোড়া, পাপড় ভাজা, মুড়ি মাখা আর চা। তিন গিন্নি পটু হাতে সামলাচ্ছে সব। তবে রাইমার কাজে মন নেই। আজ সারাদিন মেয়েকে কলে পাননি তিনি। টেনশনে মাথা ফেটে যাচ্ছে। নুহাস আর পূর্বটাও বাড়ি নেই। একবার ভাবলেন রাবুকে কল দিবে কিন্তু পরক্ষণেই সে চিন্তা মাথা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। রাবুকে তিনি নিজে কল করেন না কখনো। রাবু করে। সে করলে যদি তাহনা ধরে ফোন? ওদের সুন্দর সংসারে কোন ঝামেলা চায় না রাইমা। কিন্তু এখন মেয়ের খবর কোথা থেকে জানবে? তার ভাবনার মাঝেই বাড়ির বাইরে গাড়ির হর্নের শব্দ শোনা গেলো। কুহু দোতালা থেকে ছুটে নামলো। আজ নুহাস ভাইয়ার খবর আছে। তাকে না বলে কোথায় চলে গিয়েছিল? রাইমাও ছুটে বের হলেন। অজানা কারণে তার মন টিকলো না রসুইঘরে। সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলো রাইমা আর কুহু। গাড়ির সামন থেকে নামলো নুহাস। নেমে দ্রুত চলে গেলো পিছনের দিকে। পূর্বও ইতিমধ্যে নেমে পড়েছে, সে ডিকি থেকে লাগেজ বের করলো। অবাক হলো রাইমা। ওরা তো লাগেজ নিয়ে যায়নি। হৃৎস্পন্দন দ্রুত হলো তার। নুহাস খুলে দিলে পিছনের দরজা। বের হলো কুঞ্জ। রাইমা চোখ দু’টো ঝাপসা হয়ে এলো। কুহু অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করলো,
-আমার আপা। বড় আপা!
রাইমা দরজা ছেড়ে এগুলেন, এলোমেলো পায়ে চারটে সিঁড়ি অতিক্রম করলেন। কুঞ্জ ছুটে গেলো মায়ের কাছে। একদম মায়ের বুকে। মৃদু কন্ঠে ডাকলো,
-আম্মু!
রাইমা এবার আর চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না। কেঁদে ফেললেন। কুঞ্জের মুখে অজস্র চুমু দিয়ে ফের বুকে টেনে নিলেন। আলতো স্বরে বলতে লাগলেন,
-আমার আম্মা, আমার মেয়ে, আমার কুঞ্জফুল, সোনামাণিক।
কুঞ্জ হাসলো। মায়ের আবেগ প্রকাশ করতে দিলো। ব্যাঘাত ঘটালো না। কিছু সময় পর মাকে ছেড়ে বোনকে জড়িয়ে ধরলো। কুহু কোন কথা বললো না। কেঁদে দিলো। কুঞ্জ হাসলো। বকলো না। পরম মমতায় আগলে নিলো। মা পাখি যেভাবে ছানাদের আগলে নেয় ঠিক সেভাবে। ছোট বাচ্চার মতো কুহু জড়সড় হয়ে থাকলো বোনের বুকে। থাকবেই না কেন। তার কাছে দ্বিতীয় মা কুঞ্জ।
মা বোনকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই ছুটে এলো দুই চাচি। কুঞ্জকে ফের তার আরও দুই মা বুকে টেনে নিলো। আদরে ভরিয়ে দিলো। এরপর পাঠিয়ে দিলো ফ্রেস হতে। আজ অনেকদিন পর বাড়ির পাঁচটা বাচ্চা একসাথে নাস্তায় বসবে। চায়ের কাপ নিয়ে মারামারি করবে। গিন্নিদের মন ভালো হয়ে গেলো অনায়াসে।

আফজাল চৌধুরী বাড়ি ফিরলেন নয়টার পর। দোতলা থেকে হাসির আওয়াজ আসছে৷ তিনি শুনলেন কিন্তু পাত্তা দিলেন না। শুধু মন ভার কলো। তার মেয়েটা নেই। মেয়েটা তাকে ভুলে গেছে? মন খারাপ করে তিনি ফ্রেস হলেন। কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে দশটা বাজার কিছু আগে টেবিলে গিয়ে বসলেন। বাড়ির তিন গিন্নি খাবার সাজাচ্ছে। চৌধুরী বাড়ির বিশাল ডাইনিং টেবিলে বারোটা চেয়ার। সবার চেয়ার বরাদ্দ করে দেওয়া। কুঞ্জ না থাকলেও তার চেয়ারে কেউ বসে না। কুঞ্জের জায়গা বরাবর প্লেট রাখতেই আফজাল চৌধুরী অবাক হয়ে তাকালেন। ভ্রূ কুঁচকিয়ে কিছু বলতে যাবেন তার আগে চোখ গেলো সিঁড়ির দিকে। তার বড় মেয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামছে। পিছনে বাকি তিনজন। আফজাল চৌধুরী বহুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। মেয়েকে দেখার তৃষ্ণা মিটালেন। কুঞ্জ এসে নিজের চেয়ারে বসলো। সুন্দর করে সালাম দিলো,
-আসসালামু আলাইকুম আব্বু।
সালামের উত্তর নিলেন আফজাল চৌধুরী। আর কন্ঠ কাঁপছে, চোখ ছলছল করছে। কিন্তু মুহুর্তেই আবেগ লুকিয়ে ফেললেন তিনি। গম্ভীর স্বরে সুধালেন,
-কখন এসেছো?
-বিকালে আব্বু।
-একা?
-না, ভাইরা গিয়েছিল।
আর কথা বাড়ালেন না তিনি। খাবার সময় কথা বলা তার পছন্দ নয়। ঝামেলা করা তো নয়। তাই কিছু বললেন না। নীরবে খাওয়া শেষ করে হুকুম দিলেন,
-খাওয়া শেষে আমার ঘরে আসো কুঞ্জ।
-আসছি আব্বু।
কোনরূপ ভনিতা ছাড়া জবাব দিলে কুঞ্জ। খাওয়া শেষ করে উঠে গেলো বাবার রুমের দিকে। এদিকে চৌধুরী নিবাসের বাকি আটজন সদস্য রুদ্ধশ্বাসে বসে রইলো। আবার কি শুরু হবে বাবা মেয়ের নীরব স্নায়ুযুদ্ধ?

#চলবে…?