অতীত দেয়ালে লেখা গল্প পর্ব-৯+১০

0
144

#অতীত_দেয়ালে_লেখা_গল্প
#তাহসিনা_অরিন
#পর্ব_৯_১০

ধরনীতে আগমন ঘটলো রাতের। আজ ভরা পূর্ণিমা। আকাশে মস্ত বড় এক চাঁদ উঠেছে। তার রূপালি আলো আছড়ে পরছে ধরায়। তমসা আজ পালিয়েছে বহুদূর। নিজস্ব আলোকহীন চাঁদের কাছে হার মেনেছে সে। এমন একটা রাতে জোছনা বিলাশ করার শখ ছিল খুব কুঞ্জের। উহু একা নয়। অর্কের সাথে। একা, মায়ের সাথে, বাবার সাথে, কখনো বা ভাই-বোনদের সাথে; বহুবার জোছনা বিলাশ করেছে কুঞ্জ। তবে হ্যাঁ বাবা মায়ের সাথে জোছনা বিলাশ হয়নি কখনো। আজ অর্কের সাথেও হবে না। শখ করলেই তা পূরণ হবে এমন কোন কথা নেই। কুঞ্জ আশাও করলো না। তবুও একটু মন খারাপ হলো। বুকের বা পাশে একটু ব্যাথ হলো। কুঞ্জ আনমনে আকাশ দেখতে বসলো। চাঁদের পাশে জ্বলজ্বল করতে থাকা তারা গুলোকে গুনতে চাইলো। মন খারাপ কে দূরে ঠেলে দিতে চাইলো। কিন্তু মন কি এতো কথা মানে? সে ঘুরেফিরে সেই একই জায়গায় আটকায়। দীর্ঘশ্বাস ফেললো কুঞ্জ। বারান্দার রেলিঙের উপর শরীরের ভর ছেড়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলো।

বসার ঘরে মা-বাবার সাথে বসে আছে অর্ক। মিসেস তানহা দৃঢ় কন্ঠে বললেন,
-এটাই আমার শেষ কথা অর্ক। আমি মানি না তাকে।
-কেন মা? কারণ বলো!
মিসেস তানহা চকিত তাকালো ছেলের দিকে। দরাজ স্বরে বললেন,
-তোমাকে কারণ বলতে আমি বাধ্য নই।
অর্ক গম্ভীর হলো। লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল,
-আমি দুঃখিত আম্মু। নিজের ইচ্ছেয় বিয়ে করে কোন
কারণ ছাড়া একটা মেয়েকে আমি ছাড়তে পারি না।
-তুমি আমাদের কথা শুনবে না?
মিসেস তানহার কন্ঠে বিস্ময়। অর্ক গম্ভীর স্বরে বলল,
-আমাদের কেন বলছো আম্মু? তুমি ছাড়া আর কারো সমস্যা নেই। ইভেন কি সমস্যা তোমার সেটাও বলছো না।
দমে যাওয়ার পাত্রী নয় মিসেস তানহা। বললেন,
-আমি গুরুত্বপূর্ণ কেউ নই তোমার?
অর্ক বিরক্ত হলো। উঠে দাঁড়ালো। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
-মা প্লিজ! টেক ইট ইজি। কেন ঝামেলা করছো। ভালো লাগছে না আমার!
কথা বাড়ালো না আর অর্ক। এগিয়ে গেলো নিজের ঘরের দিকে। মিসেস তানহার মন খারাপ হলো। তিনি আফসোসের শ্বাস ফেললেন। ওই মেয়েকে কেন অপছন্দ তার বুঝাবে কি করে ছেলেকে। মেয়েটাকে যতবার দেখে ততবার বুক কাঁপে তার।

ঘরে বউ নেই। অর্ক অবাক হলো। এই রাতে গেলো কোথায় মেয়েটা। অদিতির কাছে? হঠাৎ মনে পড়লো বারান্দার কথা। দ্রুত সেদিকে গেলো। যা ভেবেছিল! বউ তার বারান্দায় চোখ বুজে দাঁড়িয়ে আছে। অর্ক ধীর পায়ে এগিয়ে কুঞ্জের পিছনে দাঁড়ালো। কুঞ্জ তখনো বুঝতে পারেনি অর্কের উপস্থিতি। অর্ক পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো বউকে। কুঞ্জ অবাক হলো তবে ভড়কালো না। মৃদুস্বরে বলল,
-কখন এলে?
বউয়ের চুলে মুখ ডুবিয়েছে অর্ক। জরানো স্বরে বলল,
-মাত্র!
কুঞ্জ আর কথা বাড়ালো না অনুভব করলো স্বামীকে।কিছু সময় পর অর্ক মুখ তুলে বলল,
-ঘুমাননি যে? কালকে ক্লাস আছে না?
কুঞ্জ উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,
-কত্ত বড় চাঁদ উঠেছে দেখো। তোমার সাথে জোছনা বিলাশ করবো বলে ঘুমায়নি।
অর্ক মৃদু হাসলো। বউকে নিয়ে বসলো নিচে। বউয়ের পাশে বসে নিজের কাঁধে কুঞ্জের মাথা রাখলো। দুজনের দৃষ্টি আকাশে। নিশাপতির বিমোহিত রূপ একসাথে দুজন অবলোকন করছে আজ।

গ্রীষ্মের দুপুর মানে তীব্র রোদ। অসহনীয় তাপমাত্রা। তবে আজকে গরমের মাত্রা যেন আরো বেশি। প্রণীকূল তীব্র গরমে হাসফাস করছে। সূর্য তার সব তেজ নিয়ে আকাশ থেকে আছড়ে পরছে ধরনীতে। সখীপুর পি. এম. পাইলট মডেল গভঃ স্কুল এন্ড কলেজের সামনে বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নুহাস ও পূর্ব। নুহাস নিজের বাইকের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি তার একবার গেটের দিকে তো একবার ঘড়ির দিকে। পূর্ব নিজের বাইকে বসে আছে। দুজনের পরনেয় সাদা শার্ট। ঘেমে-নেয়ে একাকার। শরীরে লেপ আছে শুভ্র শার্ট। ভার্সিটি থেকে এসেছে দু’জন। নুহাসের কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে। সেদিকে নজর দেওয়ার সময় কোথায় তার? পূর্ব নুহাসের অবস্থা দেখে ঠোঁট টিপে হাসলো। গলা শুকিয়ে উঠেছে তার। বাইক থেকে উঠে একটা ঠান্ডা সেভেন আপ কিনে আনলো। আগে টাইগার খেত তারা। বড় আপা গন্ধ সহ্য করতে পারে না। তাই বাদ দিয়ে দিয়েছে। পূর্ব আনমনে হাসলো। পরক্ষণেই বুঝলো বড় আপা কে মিস করছে সে। এবার দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ভিতর থেকে। সেভেন আপ এগিয়ে দিলো নুহাসের দিকে। মুখে বলল,
-ঘেমে গেছিস। একবার নে।
নুহাস তাকালে না। গেটের দিকে স্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
-তুই খা। আমার লাগবে না।
পূর্ব হাসলো। ঢকঢক করে একবার মুখে নিয়ে হতাশ ভঙ্গিতে বলল,
-তোরে দেখলে আমার প্রেম করার শখ চলে যায় ভাই। সারাদিন চোখের সামনে থাকে তাও এতো ইনসিকিউরড ফিল করোস। আমি তো ভাই সারাদিন চোখের সামনে রাখতে পরবো না। আমার অবস্থা কি হবে?
পূর্বের বলার ভঙ্গি দেখে নুহাস হেসে ফেলল। পূর্বের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলো। হেসে বলল,
-আম্মুকে আর একটা ডাউনলোড দিতে বলি, কি বলিস?
পূর্ব অসহায় হয়ে বলল,
-বল না ভাই।
নুহাস তির্যক হেসে বলল,
-অ্যহ! আম্মু বোন আনলেই তোকে দিব নাকি? বুড়ার সাথে বোন বিয়ে। কখনো না।
পূর্ব বাঁকা হেসে বলল,
-মেঝমা কে জাস্ট বেবি আনতে বল, তাকে পটানোর দায়িত্ব আমার। তুই দিবি নাকি দিবিনা আই ডোন্ট কেয়ার।
নুহাস হু হা করে হেসে উঠলো। ওকে সঙ্গ দিলো পূর্ব।

দুই ভাইয়ের হাসির মাঝে ছুটির ঘন্টা বাজলো। কর্ণকুহরে ঘন্টার শব্দ যেতেই দুই ভাইয়ের দৃষ্টি স্কুলের গেটে স্থির হলো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তারা। কুহুকে স্কুল থেকে তারা দুজনেই নিয়ে যায়। কয়েকদিন ভার্সিটিতে পরীক্ষা ছিল তাও আবার কুহুর ছুটির টাইমে। আসতে পারেনি তারা। কিছুদিন আগে আবার কলেজে নতুন ছেলে মেয়ে ভর্তি হয়েছে। একাদশ শ্রেণিতে। তাদের মাঝে একজনের সাহস বেশি হয়েছে। কুহুকে ডিস্টার্ব করে। ছুটির সময় নাকি ব্যাগও টেনে ধরে। কথাটা শুনে নুহাস ভীষণ ক্ষেপে গেছে। পারলে ছেলেটাকে খু*ন করে সে। পূর্ব বুঝদার। নুহাসকে সামলে নেয়। বলে দেয় কালকে দেখে নিবে। সে জন্য আজকে আসা। দুই ভাই ঈগলের মতো সরু চোখে তাকিয়ে আছে। একে একে ছেলেমেয়ে বের হয়ে আসছে। পূর্বের চোখ তার দুই বোন ছাড়া অন্য মেয়েতে আটকায় না কখনো। আজও আটকালো না। তাই দেখতে পেলো কলেজ ড্রেস পরিহিত একটা মেয়ে তার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে রাস্তার অপর পাশ থেকে। তিথিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে আছ সরু চোখে তাকিয়ে থাকা পূর্বের দিকে। সে এ এলাকায় নতুন। কলেজ শুরু হয়েছে এইতো সপ্তাহ খানেক হলে। এরমাঝে কখনো এখানে পূর্বকে দেখেনি। আজকে দেখে প্রথমে অবাক হলেও পরক্ষণেই মনে আসলো এখানে কি করছে পূর্ব! তার কি গার্লফ্রেন্ড আছে? ঠিক করলো দাঁড়িয়ে থাকবে এখানে। দেখবে কি করে পূর্ব চৌধুরী!

স্কুল গেটে কুহুর দেখা মিললো। নুহাস এগিয়ে যেতে চাইলে আটকে দিল পূর্ব। ইশারায় এখানে থাকতে বলল। নুহাস থামলো। দুই ভাইয়ের দৃষ্টি এখনো কুহুর দিকে। কুহু আর একটু আগাতেয় একটা ছেলে কুহুকে ডাকলো। কুহু পিছনে ফিরলো না। সাথে সাথে কুহুর ব্যাগ টেনে ধরলো। ছেলেটার কিছু বন্ধু হাসতে লাগলো। নুহাস দুই হাত মুঠো করে দাঁড়ালো। তার কপালের রগ দপদপ করে উঠছে রাগে। পূর্ব গম্ভীর হলো। কত বড় সাহস এই ছেলের! কুঞ্জ আপা তাদের থেকে তিন বছরের বড়। তবুও আপার পাশে থাকতো দুই ভাই সব সময়। তিন বছরের সিনিয়র ছেলেরাও আপার দিকে তাকাতে সাহস পেত না তাদের ভয়ে। আর এই হাঁটুর বয়সী ছেলে কিনা তাদের আরেক কলিজায় হাত দেয়! কুহু অসহায় হয়ে এদিক সেদিক তাকালো। তখনি চোখে পড়লো গেটের অপর পাশের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা দুই ভাইকে। হেঁচকা টান দিয়ে ব্যাগ ছুটিয়ে নিলে কুহু। এরপর এক দৌড়ে চলে গেলো সেদিকে। একদৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো ভাইকে। পূর্ব আগলে নিলো বোনকে। বোনের মাথায় হাত রেখে চোখে আগুন নিয়ে তাকালো ছেলেটার দিকে। নুহাস ছেলেটাকে এদিকে আসতে বলল। ছেলেটা যেতে চাইলো না। তখন পাশ থেকে একজন ছেলেটাকে বলল,
-ডাকছে শুনে আয়। নাহয় পরে নুহাস ভাইয়া তোকে সামনে পেলে খু*ন করে দিবে। কেউ কিছু বলবেও না।
ছেলেটা ভয়ে ভয়ে এগিয়ে এলো। পূর্ব বোনকে সামলে বসালো বাইকের উপর। আধ খাওয়া সেভেন আপটা হাতে দিয়ে বলল,
-আরামছে বস। গলা ভিজা। চিন্তা নেই। ভাইয়া এখানেই আছি।
কুহু হাসলো। ভরসার হাসি। সে জানে ভাইয়া আর নুহাস পাশে থাকলে তাদের দুই বোনকে কোন বিপদ ছুঁয়ে দিতে পারবে না। সেভেন আপের বোতল হাতে নিয়ে তাকালো নুহাসের দিকে। চোখ দিয়ে আগুন ছুটছে যেন। কুহু হাসলো। সম্পর্কটা একটু অন্যরকম হয়ে যাওয়ার পর থেকে নুহাস ভাইয়ার সামনে তার জড়তা কাজ করে। কয়েকদিন আগে হলে হয়তো সামনে নুহাস থাকায় ছুটে এসে নুহাসকে জড়িয়ে ধরতো। কিন্তু এই মুহূর্তে তার ভাই নামক ভরসা দরকার ছিল। তাই তো নুহাসকে পিছনে ফেলে ছুটে মুখ লুকিয়েছে পূর্বের বুকে। তার একমাত্র ভাই নামক ভরসা হলো পূর্ব।
ছেলেটাকে নুহাস মারতো। কিন্তু পূর্ব বারণ করলো। পূর্ব বুঝালো ছেলেটাকে। ছেলে টাও বললো আর কখনো এমন করবে না। নুহাস রাগ কন্ট্রোল করতে পিছনে ফিরে গেলো। পূর্ব ছেলেটার চুল এলোমেলো করে দিয়ে বাঁকা হেসে বলল,
-সাবধান করে দিলাম ছোট ভাই। নুহাস পূর্বের কলিজায় হাত দেওয়ার আগে দশবার ভাববা। আজকেই নুহাস তোমার রুহু শরীর থেকে বের করে দিত। আর আমার কথা যদি বলি তাহলে শোন আমি নুহাস থেকেও বেশি খারাপ!
কথা শেষ করে পূর্ব দু’হাত পকেটে গুঁজে বাইকের দিকে এগুলো। নুহাস বাইকে বসেছে। পূর্ব বোনের কাছে গিয়ে ইশারায় বুঝালো ওর পিছনে বসতে। কুহু গিয়ে বসলো। নুহাস বাইক স্টার্ট দিলো। তার রাগ কমেনি। ছেলেটাকে ইচ্ছা মতো মারতে পারলে মন ভরতো। কত্ত সহস দেখতো। কুহু আলতো করে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো তাকে। নুহাস একবার পিছনে তাকালো। রাগ সরে গেলো চেহারা থেকে। বাইক চলতে শুরু হলো। পূর্বও বাইক স্টার্ট দিলো। কুহু পিছনে ফিরে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে হাসলো। পূর্ব হেসে চোখ টিপ দিলো।

পূর্বের গার্লফ্রেন্ড আছে ভাবতেই মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল তিথিয়ার। মনে মনে দোয়া করছিল তেমন কিছু যেন না হয়। কিন্তু তার ভাবনাকে সত্যি প্রমাণিত করে ছুটে পূর্বকে জড়িয়ে ধরলো একটা মেয়ে। তিথিয়ার বুকটা ছ্যাত করে উঠলো। তবুও তিথিয়া পজিটিভলি ভাবতে চাইলো। পূর্ব এক্ষুনি মেয়েটিকে সরিয়ে দিবে নিজের কাছ থেকে। কিন্তু এবার তার ভাবনা ভুল প্রমাণিত হলো। পূর্ব মেয়েটিকে আগলে নিলো। ঠিক সেই মুহূর্তে তিথিয়া শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গেলো যেন। বুকের উপর পাথর চেপে দিলো কেউ! চোখ দিয়ে জল গড়ালো। তাদের পাশের বাসার আপু পূর্বের সহপাঠী। কথায় কথায় তার থেকে শুনেছিল পূর্বের প্রেমিকা নেই। মেয়ে বন্ধু অবধি নেই। তাহলে এই মেয়ে কে। তিথিয়া আর ভাবতে পারলো না। চোখেল জল বাঁধা মানলো না। অভিমানে মুখ ফুলালো। অভিমানী কন্যার মনে পড়লো না তার অভিমান ভাঙানোর অধিকার এখনো পূর্ব চৌধুরী নেয়নি!

মেয়েটি যদি সারাদিন বাসায় থাকতো তবে মিসেস তানহা তাকে অনায়াসে ভেঙে গুড়িয়ে দিতে পারতো। কিন্তু সমস্যা হলো মেয়েটা বাসা থেকে বের হয়ে যায় সকালে। বাসায় ফিরে আসে দুপুরের পর। কখনো আবার সন্ধ্যায়। দুপুরে ছেলে-মেয়ে দুজনেই বাসায় চলে আসে। খুব কম সময় সে মেয়েটাকে একা পায়। সবার সামনে খারাপ ব্যবহার করতে ইচ্ছে হয় না তার। আবার সহ্য হয় না মেয়েটিকে। মনে পড়ে যায় অনেক কথা। আর সেসব কথা মনে পড়লেই মেয়েটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে হয়। ঠিক তার মতো করে। তাকেও তো ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। শুধু তাকে? উহু সাথে তার কতশত স্বপ্নকে!

ক্লাস শেষ হয়েছে দেড়টায়। কুঞ্জ পলাশীতে এলো রিক্সা করে। এরপর রাস্তার একপাশে দাঁড়ালো। অর্ক একটু পরে আসবে। একসাথে বাসায় ফিরবে। হঠাৎ পশ্চিম আকাশে ঘন কালো মেঘের দেখা মিললো। কিছু সময়ের ব্যবধানে পুরো আকাশ ছেয়ে গেলো কালো মেঘে। চারদিকে অন্ধকার নেমে এলো। শো শো শব্দ বইতে লাগলো বাতাস। একটু পরে বিক্ষিপ্ত ভাবে বৃষ্টি পড়তে লাগলো। প্রথমে কিছু কম থাকলেও সময়ের সাথে সাথে বাড়তে লাগলো বাতাস ও বৃষ্টির মাত্রা। কুঞ্জ রাস্তার পাশের একটা দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। একটু ভিজে গেছে। ঝড়ের মাত্রা বড়লো। দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেলো। রাস্তায় জনমানব নেই বললেয় চলে। অর্ক আটকা পড়েছে ক্যাম্পাসে। কিছুক্ষণ পরে কুঞ্জের ফোন বাজলো। রিসিভ করতেই ভেসে এলো অর্কের চিন্তিত স্বর,
-তুমি কোথায় কুঞ্জ?
-পলাসীতে।
-বাসায় গেছো?
-না। রাস্তায়।
অর্ক ভয় পেলো,
-রাস্তায় কোথায়?
-পপুলার ফার্মেসির সামনে দাঁড়িয়ে আছি।
-তুমি একটু দাঁড়াও আমি আসছি।
-না অর্ক শোন….
বাকি কথা শেষ করতে পারলো না কুঞ্জ। অর্ক কল কেটে দিলো। এই ঝড়ো আবহাওয়ার মাঝে কি করে আসবে অর্ক ভাবতে পারলো না কুঞ্জ। বারবার পথের দিকে চাইতে লাগলো। এই বুঝি অর্ক এলো।
বৃষ্টি মথায় নিয়ে তীব্র বাতাসের মাঝে অর্ক ক্যাম্পাস ছাড়লো। ঝড় বৃষ্টি কিছু গ্রাহ্য করলো না। মন তার পড়ে আছে বউয়ের কাছে। এই ঝড়ের মাঝে বউ একা রাস্তায় ভাবতেই বুক কাপন ধরছে। যে দিনকাল এখন। কখন কি হয়! নিশ্চয়তা দিবে কে? রাস্তায় মানুষ নেই বললেই চলে। অর্কের ভয় বাড়তে লাগলো। তাড়াহুড়োয় করে রাস্তা পার হতে লাগলো। হঠাৎ একটি গাড়ি চলে এলো খুব কাছে। অর্ক কিংকর্তব্যবিমূঢ়! সরে আসতে চাইলো। পরলো না। ফুল স্পিডে আসা গাড়িটা ধাক্কা মেরে রাস্তা থেকে প্রায় পনেরো মিটার দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিলো অর্ককে। তবুও অর্কের ভাগ্য ভালো এই ঝড়ের মাঝে এক সহকর্মী তার দেখা পেলো। দ্রুত নিয়ে গেলো হাসপাতালে। ফোন থেকে কল করলো অর্কের মা কে।

অর্কের আসতে যেখানে সর্বোচ্চ দশ মিনিট লাগার কথা সেখানে আধঘন্টা পার হয়ে গেছে। অর্ক আসেনি। রাস্তায় জনমানব নেই। কুঞ্জ অস্থির ভাবে এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো। হাজারো খারাপ চিন্তা আসছে মাথায়। কল করলো অর্কের নাম্বারে। রিসিভ হলো না। ভয়ের মাত্রা বড়লো কুঞ্জের। আবার ডায়াল করলো এবার রিসিভ হলো। কুঞ্জ হ্যালো বলতেই একজন বলে উঠলো,
-ভাবি আমি অর্কের সহকর্মী। অর্ক রোড এক্সিডেন্ট করেছে। মেডিকেলে নিয়ে এসেছি।
কুঞ্জ স্তব্ধ হয়ে গেলো। শুধু বলল,
-আমি আসছি।
কুঞ্জ ঝড়ের মাঝে বের হয়ে গেলো। আশেপাশে রিক্সার দেখা নেই। হেঁটে গেলো অনেকদূর। একটা রিক্সা পেলো ঠিক। তবে যেতে রাজি হলো না। প্রায় চারগুণ ভাড়া দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে কুঞ্জ রিক্সায় উঠে বসলো। চোখ দিয়ে অবিরাম গড়িয়ে পরছে জল। নিজের কাছে নিজেকেই দোষী মনে হলো। কেন অর্ককে সত্যি বলতে গেলো? ঠিক তখন ভরসা দেওয়ার জন্য বোধহয় কল দিলো পূর্ব। কুঞ্জ সামলাতে পারলো না নিজেকে। কল রিসিভ করে কেঁদে ফেললো। বোনের কান্না শুনে বুক কেঁপে উঠলো পূর্বের। উৎকন্ঠা হয়ে জানতে চাইলো,
-বড় আপা। এই আপা? কি হয়েছে?
কুঞ্জ উত্তর দিতে পারলো না। কান্নার গতি বাড়লো। অপরদিকে পূর্বের নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। আপা কাঁদছে কেন। এক্ষুনি ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে হলো বোনের কাছে। তা সম্ভব নয়। পূর্ব নিজেকে শান্ত করলো। আবার জিজ্ঞেস করলো,
-আপা বলো কি হইছে?
এবার কুঞ্জ ফুঁপিয়ে উঠে বলল,
-অর্ক এক্সিডেন্ট করেছে।
পূর্ব আপাকে বুঝালো কিছু হয়নি। সব ঠিক হয়ে যাবে। আপা যেন দ্রুত হাসপাতালে যায়। কাজ হলো। কুঞ্জ কান্না থামালো। হাসপাতালে পৌঁছে কুঞ্জ দ্রুত চলে গেলো এমারজেন্সি বিভাগে। ফের কল দিয়ে শুনে নিলো কোথায় আছে। নিজের ক্যাম্পাস হওয়ায় পৌঁছাতে বেগ পেতে হলো না তার। দ্রুত গিয়ে দেখে তার শ্বশুর, শ্বাশুড়ি ও ননদ সবায় চলে এসেছে। কুঞ্জ দ্রুত শ্বশুরের সামনে গেলো। অস্থির ভাবে জানতে চাইলো,
-অর্ক কোথায় বাবা? ঠিক আছে ও?
আলম সাহেব পুত্রবধূর দিকে চাইলেন। বৃষ্টিতে ভিজে একাকার হয়ে গেছে। তবুও যেন বৃষ্টির পানি থেকে তার চোখের পানি আলাদা করা যাচ্ছে। মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
-ঠিক আছে মা। ডাক্তার দেখছেন। চিন্তা নেই।
এতো ভালো ব্যবহার সহ্য হলো না মিসেস তানহার। ফোঁস করে উঠলেন তিনি। স্থান, কাল ভুলে চিৎকার করে বললেন,
-বেলাজ, বে*হায়া মেয়ে। তুই না এখানে পড়িস। তাহলে এতক্ষণ কই ছিলি? কোন ছেলের সাথে ফষ্টিনষ্টি করছিলি? আমরা পলাশী থেকে আসতে পারলে তুই কেন পারলি না বল? এসব ই তো করবি। শরীরে তো ধোঁকাবাজের রক্ত বয়ে বেড়াচ্ছিস। ভালো হবি কি করে?
বলেয় মুখ ঘুরালেন। আলম সাহেব তাকে থামাতে চাইলো পারলো না। অদিতও অস্পষ্ট স্বরে বলল,
-মা!
কুঞ্জ বলতে পারলো না কিছু। শরীরের ভর ছেড়ে দিলো সে। স্থির ভাবে তাকিয়ে রইলো শ্বাশুড়ির দিকে। পরক্ষণেই হেসে দিলো! তাচ্ছিল্যের হাসি!

#চলবে…?