অদ্ভুত প্রণয়নামা পর্ব-২২+২৩

0
338

#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#পর্ব_২২
#তাশরিন_মোহেরা

আজ প্রায় একমাস হতে চললো মুখরের কোনো হদিস নেই। এলাকার আনাচে কানাচে খোঁজা হয়ে গেছে, কিন্তু তার দেখা কোথাও মিললো না। মিলবেই বা কি করে! যারা নিজের ইচ্ছায় হারিয়ে যায় তাদের খুঁজে পাওয়াটাও অনিশ্চিত!
একবুক হতাশা নিয়ে দরজা খুলে মুগ্ধের বাসায় প্রবেশ করলাম। ঢুকতেই দেখলাম আন্টি পড়ার রুমটা গুছিয়ে রাখছেন। আমাকে আসতে দেখেই মলিন মুখটায় হালকা হাসি টেনে বললেন,

‘এসেছো মা! বসো, আমি মুগ্ধকে ডেকে দিচ্ছি।’

আমি চুপচাপ বসলাম। মুগ্ধ এ কদিন যাবৎ স্কুলে যায়নি। তার পায়ের ক্ষতটা সেরেছে তবে আন্টি তাকে বাইরে বের হতে দিতে নারাজ। তিনি এখনো বেশ ভয়ে আছেন। আমাকেও কিছুদিন ছুটি দিয়েছিলেন তবে মুগ্ধের জন্য তা আর হলো না। সে আমার কাছে পড়ার অনুরোধ করলো মা’কে। তাই আবারো আগের মতো তাকে পড়াতে আসছি।
পড়ার রুমের ঠিক সামনেই আগে মুখরকে দেখতাম আমি। মুগ্ধকে পড়ানোর ফাঁকে উঁকি মেরে দেখতাম সে তার রুমটা খুব সুন্দর করে গুছিয়ে রাখছে। কিন্তু এখন সেই রুমটায় মুখর নেই। আন্টি থাকছেন সেখানটায় মুগ্ধকে নিয়ে।
কিছু সময় পর মুগ্ধ এসে বসলো। আজ তাকে অতিরিক্ত শান্ত দেখাচ্ছে। চুপচাপ বসে আছে। গত একমাসে সে প্রতিদিন তার ভাইয়ার জন্য কেঁদেছে। পড়তে বসে কেঁদেছে, স্কুলে গিয়ে কেঁদেছে, খেলতে গিয়ে কেঁদেছে। আমি এলেই সে দৌঁড়ে এসে আমায় জড়িয়ে ধরে বলতো,

‘ম্যাম, ভাইয়া আজও আসেনি!’

আর আমি নির্বাক হয়ে তার দুঃখের সঙ্গী হতাম। আন্টিও ভেতরের রুম হতে থেমে থেমে কাঁদতেন।
তবে আজ তার ভাবভঙ্গি সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। আমি যা প্রশ্ন করছি তার বাইরে একটা কথাও সে বলছে না। ভাইয়ার কথাও আজ জিজ্ঞেস করছে না! তার এমন শান্ত আচরণ দেখে অদ্ভুত লাগলো। পড়ানো শেষে আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম,

‘কি ব্যাপার, মুগ্ধ? আজ সকালবেলা উঠেই কাঁদলে না যে?’

সে আগের মতোই বেশ শান্ত হয়ে বললো,

‘আমি আর কাঁদবো না, ম্যাম!’

আমি অবাক হলাম। তাকে আবারো জিজ্ঞেস করলাম,

‘কেন, বাবা?’

‘আমাকে ভাইয়া বলেছে!’

আমি এবার তার কথায় চমকে উঠলাম। মুখর বলেছে মানে? সে কি ফিরে এসেছে? সে ফিরে এলে মুগ্ধ আমায় বলেনি কেন? আর কেনই বা তার মুখখানা মলিন হয়ে আছে?
আমি মুগ্ধকে বললাম,

‘ভাইয়া বলেছে মানে? মুখর সাহেব ফিরে এসেছেন?’

সে দু’দিকে মাথা দুলালো। তার মানে মুখর এখনো ফেরেনি। আমার মনে যে ক্ষীণ আশাটুকুর সঞ্চার হয়েছিলো তা তক্ষুণি নিভে গেল। মুগ্ধ আবারো বললো,

‘ভাইয়া আমার স্বপ্নে এসেছিলো। আমাকে বলেছে, বড় ছেলেরা কাঁদে না। তাই আমাকেও নিষেধ করেছে আর না কাঁদতে। তাই আমি ভেবেছি আর কাঁদবো না কখনো!’

ঠোঁট দুটো কাঁপতে লাগলো তার। বহুকষ্টে কান্না থামাচ্ছে সে। মুগ্ধের পেছনে ঠোঁটে হাত চেপে আন্টিও নিঃশব্দে অশ্রুপাত করছেন। আমার বুকটা ছিন্নভিন্ন হতে চাইলো যেন।

‘কোথায় গেলেন আপনি, মুখর সাহেব? এতোগুলো মানুষগুলোকে কষ্টে ফেলে কোথায় গেলেন আপনি?’

আমার ছিন্ন মনটা ভেতর থেকে ডেকে উঠলো। মুখরের উপর ঘটা করে আবারো রাগ উঠলো, চরম রাগ! যেন সামনে পেলেই শার্টের কলার চেপে ধরবো! কিন্তু তা হওয়ার নয়। আর কবে মুখরের দেখা মিলবে কেউ জানে না। সে যে আদৌও বেঁচে আছে তা নিয়েও সন্দেহ আছে সবার। নিজের প্রাণ হাতে নিয়ে ছেলেটা প্রতিপক্ষের সাথে লড়তে গিয়েছে। জিতে গেলে তো কবেই ফিরতো, তাই না? কিন্তু আজ তো পাক্কা একমাস হতে চললো! এখনো তার বাঁচার আশা করাটা যে বড্ড বোকামি হয়ে যাবে।

.

দীর্ঘ এক ব্যস্ত দিন পার করে বাসায় পৌঁছালাম। এসে জিরোবারও ফুরসত নেই। রান্নাঘরে ঢুকে আব্বার জন্য সহ দু’কাপ চা বসিয়ে দিলাম চুলোয়। চা বানাতে গিয়ে হঠাৎ মনে পড়লো এক সকালে আমি মুগ্ধ আর মুখরের জন্য কেক বানিয়ে এনেছিলাম আমার জন্মদিন উপলক্ষে। সেদিন মুখর আমাকে বলেছিলো,

‘চলুন, মিস.তিথিয়া! আপনাকে আমার স্পেশাল চা খাওয়াই!’

আমিও খুশিতে গদগদ হয়ে বললাম,

‘ঠিক আছে, মুখর সাহেব!’

সেদিন দেখলাম মুখর সাহেব সম্পূর্ণ উল্টো পদ্ধতিতে চা বানাচ্ছেন। আমি সচরাচর নিজের জন্য চা বানাতে গেলে প্রথমেই একটা লিকার তৈরি করে তাতে পরিমাণমতো তরল দুধ ঢেলে দেই। চা হয়ে গেলে এক কাপে চিনি নিয়ে চা’টা তাতে ঢেলে দেই। কিন্তু মুখর প্রথমেই একটা কড়া লিকার তৈরি করে তা আলাদা করে রাখলেন। একটা কাপে তরল দুধ নিয়ে তাতে আধা চামচ চিনি আর দু’চামচ পাউডারের দুধ দিলেন। কড়া লিকারটা ছাকনি দিয়ে ঐ দুধ-চিনির মিশ্রণটাতে ঢেলে দিলেন। গরম গরম চা’টুকু থেকে অদ্ভুত সুন্দর একটা ঘ্রাণ পেলাম আমি। চায়ে চুমুক দিতেই মনে হলো স্বর্গে চলে এসেছি। এরপর আমিও কয়েকবার বাসায় এমন করে চা বানানোর চেষ্টা চালিয়েছি। মুখরের মতো অতুলনীয় না হলেও ভালো হয়েছে!

পুরোনো এই স্মৃতিতে ডুব দিয়েই মনটা আরও চূর্ণবিচূর্ণ হলো। চোখ বেয়ে অশ্রুধারা পড়ার আগেই নাক টেনে তা থামিয়ে ফেললাম। চা’টা বানিয়ে আব্বার সামনে এক কাপ রাখলাম। কিন্তু তিনি তাতে চুমুক দিতেই থু মেরে সবটা ফেলে দিলেন। বললেন,

‘এসব কি বানিয়েছিস, তিথি? চায়ের বদলে লবণ দিয়ে দিয়েছিস এতে।’

আমি অবাক হয়ে বললাম,

‘কই আব্বা! আমি তো চিনিই দিয়েছিলাম।’

নিজে চুমুক দিয়ে বুঝলাম আব্বা আসলে ঠিকই ধরেছে। আমি চিনির বদলে একগাদা লবণ দিয়ে ফেলেছি। আব্বাকে বললাম,

‘আপনি একটু অপেক্ষা করুন। আমি আরেক কাপ বানিয়ে আনছি!’

আব্বা আমাকে পিছু ডাকলেন। ইশারা করে পাশে বসতে বললেন। আমিও গুটিশুটি মেরে বসলাম। আব্বা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

‘তোর কি হয়েছে বল তো! সারাক্ষণ মুখটা মলিন হয়ে থাকে। চোখের নিচেও কালি জমেছে।’

আমি নিচে তাকিয়ে বললাম,

‘পরীক্ষার জন্য পড়ার চাপ বেড়েছে, আব্বা। তাই এমন লাগছে দেখতে!’

‘আমাকে বোকা বানাতে যাস না। পড়ার যত চাপই হোক তোর চোখের নিচে কখনো কালি পড়েনা। কেননা তোর রাত জেগে পড়ার অভ্যাস নেই। কোনো সমস্যা হলে আমাকে খুলে বলতে পারিস, মা!’

ক্ষীণ স্বরে বিড়বিড় করলাম,

‘আব্বা, আমি আপনাকে কেমনে বলি একটা ছেলে আমায় এমন অসুস্থ বানিয়ে দিয়েছে?’

আব্বা আমাকে আবারো বললেন,

‘আমি জানি আমার পাগলামো তুই পছন্দ করিস না। তাই কখনো কিছু খুলেও বলিসনি আমায়। নিজের মধ্যে রেখেই সবসময় ফাইট করে গেছিস। কিন্তু আমারো যে আমার মেয়ের সাথে সময় কাটাতে ভালো লাগে। আমিও যে চাই তুই এসে আমাকে এটা ওটা বলিস।’

আমার মনটা আরো ছোট হয়ে গেল। আব্বা নিজের দুর্নাম করছে ঠিক, তবে আমার মনে হচ্ছে আমিই বোধহয় আব্বার মনের মতো একটা মেয়ে হয়ে উঠতে পারিনি। আব্বার অপছন্দের সবকিছুতেই আমি জড়িয়ে ফেলেছি নিজেকে। তন্মধ্যে সবচে’ বড় অপছন্দের ব্যাপার হলো আমি ভালোবেসেছি। মুখর নামের নিখোঁজ এক পথিকের কাছে মন দিয়ে এসেছি নিজের। যা ফেরত দেওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব।

ভাবনার মাঝে আব্বা বললেন,

‘মানুষ অনেক সময়ই মনের দ্বন্দ্বে পড়ে পথ হারিয়ে বসে। বুঝে উঠতে পারে না তার ঠিক কি করা উচিৎ! তুই যদি এমন দ্বন্দ্বে পড়ে থাকিস তবে অবশ্যই আমায় বলবি! আমি তোকে সাহায্য করতে না পারি অন্তত আমাকে বলে তোর মনটা হালকা হবে।’

আমার বুকটা দুরুদুরু করছে। আব্বাকে কি সবটা খুলে বলবো? কিন্তু এতে করে আব্বা যদি আমাকে মায়ের মতো বন্দী করে রাখে? কিন্তু এতো কিছু বলার পরও কি তিনি আমার উপর রুষ্ট হবেন? শেষমেশ কিছু না ভেবেই আব্বাকে বলে ফেললাম,

‘আব্বা, আমি আসলে একজনকে ভালোবাসি!’

(চলবে)

#অদ্ভুত_প্রণয়নামা
#পর্ব_২৩
#তাশরিন_মোহেরা

‘আব্বা, আমি আসলে একজনকে ভালোবাসি!’

কথাটুকু বলার পরই চোখ খিঁচে বসে আছি। কেননা আমি জানি কথাটা শুনতেই আব্বা আমাকে এই মুহুর্তেই ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দেবেন গালে। চোখটা হালকা খুলে দেখলাম আব্বার অবস্থা। তিনি হাতটা উঁচালেন। এখনি বোধহয় মারবেন। তাই আবারো চোখ খিঁচে ফেললাম। কিন্তু মাথায় হাতের স্পর্শ পেলাম। অবাক হয়ে চোখটা খুলতেই দেখলাম আব্বা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। আমাকে অবাক হয়ে চেয়ে থাকতে দেখে তিনি এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,

‘আমি জানি মা, তুই কাউকে ভালোবেসেছিস। আর যাই হোক, আমি তো তোর বাবা! আর এটাও জানি তুই কাকে ভালোবাসিস!’

আমি আরো অবাক হলাম। সেকি? আব্বা কি করে জানলো আমি মুখরকে ভালোবাসি? আমি তো কখনো বলিনি আব্বাকে! তবে? আবারো মাথাটা খাটিয়ে মনে করতে লাগলাম। আমি ভুলে নামটা বলে দেইনি তো! কিন্তু কবে বললাম তা মনে করতে পারলাম না। আব্বা আমার ভাবনার মাঝে বলে উঠলো,

‘তুই নিশ্চয়ই ঐ রূপক ছেলেটাকে ভালোবাসিস, তাই না তিথি? আমি এতো না করার পরও ছেলেটাকে ভালোবাসতে গেলি, মা! আমি একজন খারাপ বাবা হতে চাইছিনা বলেই রাগটা সামলে রেখেছি এতোদিন। ভেবেছি তুই ছেলেটাকে ছেড়ে দিবি, কিন্তু এখন তো দেখছি আমার সামনেই বড় মুখে বলছিস তুই ছেলেটাকে ভালোবাসিস!’

আমি তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে পড়লাম। রাগে আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। আব্বা এসব কি যা তা বলছে! মাথা থেকে এখনো রূপক ভাইয়ের ভুতটা তবে চাপেনি! রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললাম,

‘আপনি কি বলছেন এসব, আব্বা? রূপক ভাইকে কেন আমি ভালোবাসতে যাবো?’

আব্বা বললেন,

‘শান্ত হ, মা! আমি তোর হাবভাব বুঝে গেছি বলে তোর রাগ করাটা স্বাভাবিক। আর তুই মিথ্যা বললেও আমি বুঝি তোর অনুভূতি!’

‘কচু বোঝো তুমি! রূপক ভাইয়ের সাথে আমার সম্পর্ক শুধুমাত্র ভার্সিটির চার দেয়ালের মাঝেই বন্দী। আমি মুখরকে ভালোবাসি। মুখর শিকদারকে ভালোবাসি আমি!’

আব্বা আমার এমন রাগত ভাব বোধহয় আশা করেননি। তিনি এবার আমার সামনে এগিয়ে বললেন,

‘মুখর শিকদার? কে সে? যার জন্য আমার মেয়েটা এভাবে তার বাবার সাথে বেয়াদবি করছে? এজন্যই তো বলি, এসব ভালোবাসা মানুষকে অন্ধত্ব এনে দেয়! ধ্বংস ডেকে আনে, শুধুই ধ্বংস!’

আমি কিংকর্তব্যবিমুঢ়! আব্বার সাথে একটু বেশিই উঁচু গলায় কথা বলে ফেলেছি! তা মানছি আমি! কিন্তু তাই বলে আব্বা সরাসরি মুখরকে টেনে আনবেন এতে? আমার সহ্য না হওয়া সত্ত্বেও চুপচাপ দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে আছি। না হয় আবারো আমার নিখোঁজ ভালোবাসা নিয়ে আব্বা যা নয় তা বলবেন।

বড় বড় শ্বাস ছেড়ে শান্ত হলাম। আব্বাকে বললাম,

‘ভুল হয়ে গেছে, আব্বা! আর কখনো বেয়াদবি করবো না। তবে আমি সত্যিই মানুষটাকে ভালোবাসি!’

আব্বা আমার কল্পনাটাকে সত্যি করে এবার সামনে এসে কষে একটা চড় লাগিয়ে দিলেন গালে। চড়টা কষে দেওয়া হলেও আমার তেমন একটা ব্যথা অনুভূত হলো না। কারণ আমি যে আগে থেকেই এটাই আশা করছিলাম। আব্বা কপট রাগ নিয়ে বললেন,

‘কখন থেকে “ভালোবাসি, ভালোবাসি” করছিস! এই ভালোবাসা আমায় অন্ধকারে ডুবিয়েছে, তোকেও ডুবিয়ে মারবে। ঠিক কতোবার তোকে সতর্ক করবো আমি? আর কখনোই বলবি না তুই কোনো ছেলেকে ভালোবাসিস। ভুলে যা এসব!’

এটুকু বলেই তিনি হনহনিয়ে চলে গেলেন। গালে হাত দিয়ে সোফায় বসে পড়লাম। মনটা অনেকটা হালকা লাগছে এখন! এই কথাটা এতোদিন লুকিয়ে রাখাতে মনের উপর যেন একটা শক্ত পাথর দেবেছিল। সে পাথরটা এখন সরে গেছে। কিন্তু তাতেও আমার বিন্দুমাত্র ভালো লাগছে না। কেননা যাকে ভালোবাসি সে-ই তো আমার ভালোবাসাকে সামান্যতম তোয়াক্কা না করে চলে গেছে। যেন তার কোনো পিছুটান নেই!

.

ভার্সিটিতে পরীক্ষা থাকায় আজ বাসা থেকে একটু তাড়াতাড়িই বের হতে হয়েছে। পরীক্ষার জন্য বেরিয়েছি ঠিকই তবে পরীক্ষা সম্পর্কিত কিছুই আমি পড়িনি এতোদিন! এমনকি এটুকুও জানা নেই যে আজ আসলে ঠিক কি পরীক্ষা! তবুও নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য ভার্সিটি প্রদর্শন করতে যাচ্ছি! বাসের জন্য দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি। এমন সময় পাশ দিয়ে চাদর মোড়ানো একটা সুঠামদেহী লোক গেল। তার দেওয়া পারফিউমের ঘ্রাণটা সম্পূর্ণ মুখরের ব্যবহৃত পারফিউমের ঘ্রাণের মতোই। আর এই ঘ্রাণটা একটু অন্যরকমই! অনেকের সংস্পর্শে-ই আমি প্রায় গিয়ে থাকি, কিন্তু কখনো এই ঘ্রাণের পারফিউমটা মুখর ছাড়া কারো কাছ থেকে পাইনি। অন্যমনস্ক থাকায় লোকটার মুখটাও দেখতে পেলাম না। ক্ষণিকের জন্য মনটা উতলা হয়ে উঠলো। মানুষটা নিশ্চয়ই মুখর! আমার মন বলছে ছেলেটা মুখর! তাই সাতপাঁচ না ভেবেই আমি লোকটার পিছু দৌঁড়ালাম। তার কাছাকাছি এসেই কাঁধ ধরেই তড়িৎ সামনে ফেরালাম। মুখটা দেখার আগেই উচ্ছ্বাসে ভরে গিয়েছে আমার মন। তাকে ফিরিয়েই অস্পষ্ট স্বরে বললাম,

‘মুখর সাহেব!’

কিন্তু! মুখটা দেখেই মনটা চুপসে গেল মুহুর্তেই। ছেলেটা মুখর নয়! সাথে সাথেই আমার উচ্ছ্বাস উড়ে গেল। মনটা তবে ভুল বললো আমায়! ছেলেটা আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। আমি জোরপূর্বক হেসে ধীরভাবে বললাম,

‘দুঃখিত!’

ছেলেটা বিড়বিড় করে বললো,

‘চোখ কি হাতে নিয়ে হাঁটেন নাকি? আজব!’

আমি নিঃশব্দে মাথা নিচু করে পিছু হটলাম। মুখরের জন্য আজ কতো কিছুর সম্মুখীন হতে হচ্ছে আমায়!

‘ছেলেটা আর ফিরবে না, তিথি! নিজেকে মানিয়ে নে!’

আমার বিবেকটা জাগ্রত হলো। মনকে বললাম যদি বিবেকের কথা শুনে ছেলেটাকে ভালো না বাসতাম তবে আজ হয়তো এতো কষ্ট পেতে হতো না!

ভার্সিটি গেইট থেকে বেরোতেই রূপক ভাই ডাক দিলো,

‘তিথু! তিথু!’

আমি পেছন ফিরে দেখলাম রূপক ভাই দৌঁড়ে আমার দিকেই আসছে। কাছে এসে বললো,

‘কিরে এক্সাম দিয়েই চলে যাচ্ছিস! আমার সাথে একটু দেখাও করলি না! এই কদিনে ভুলে গেলি রে!’

আমি হালকা হাসলাম। সেই হাসিটা বোধহয় দৃশ্যমান নয়। রূপক ভাই আমাকে নিয়ে একটা বটের পাশে বসলো। একপ্রকার জোর করেই বসালো সে আমায়! খানিকক্ষণ বকবক করার পর ক্লান্ত হয়ে আমার দিকে প্রশ্ন ছুড়লো,

‘কিরে? আজ একদম বোবা হয়ে গেছিস যে? কি হয়েছে?’

আমি দু’দিকে মাথা দুলিয়ে বললাম,

‘নাহ! কিছু না!’

রূপক ভাই নিঃশব্দে আমাকে খানিক পর্যবেক্ষণ করলো। তাকে এভাবে দেখে থাকতে দেখে আমি হাসলাম। তাকে জিজ্ঞেস করলাম,

‘কি হয়েছে, রূপক ভাই?’

সে প্রত্যুত্তরে বললো,

‘তুই হাসছিস অথচ তোর চোখ ছলছল করছে। কি হয়েছে আমায় বলবি, তিথু?’

তার কথাটা শুনে আমি আর হাসিটা মুখে রাখতে পারলাম না। আপনাআপনি ঠোঁট ভেঙে কান্না এলো। শুধু কান্না আসেইনি বরং বাধভাঙ্গা অশ্রু ঝরতে লাগলো আমার চোখ বেয়ে। নিজের কান্নাটা ঢাকার বৃথা চেষ্টা করে ব্যাগটা মুখের সাথে চেপে ধরলাম। এই থেকে আমার মনে পড়লো আমি কাঁদছি বলে মুখর একসময় আমায় মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে। আমার দিকে না দেখেই আমায় শান্তিতে কাঁদতে দিয়েছে।
কি আশ্চর্য! আমি এই সময়েও লোকটার কথা ভাবছি! কেন ভাবছি? অন্য চিন্তা বাদ দিয়ে আমি কেনই বা শুধু মুখরের কথা ভাবছি? বে’হা’য়া মনটা বারবার মুখরকেই বা কেন চাইছে?

ভাঙা গলায় বলতে লাগলাম আমি,

‘মুখর সাহেব এখনো ফেরেনি, রূপক ভাই! সে আমাকে একা রেখে চলে গেছে! আমার ভেঙে যাওয়া মনটা আর সহ্য কর‍তে পারছে না কিছু। তার অনুপস্থিতি আমি আর নিতে পারছি না, পারছি না আমি, রূপক ভাই!’

(চলবে)