অধ্যায়টা তুমিময় পর্ব-০২

0
2

#অধ্যায়টা_তুমিময়
#সমুদ্রিত_সুমি
পর্ব ২

খাবার টেবিলটা সাজানো হয়েছে হরেক রকমের খাবার দিয়ে। যে খাবার দেখলেই লোভ হয়। মনে হবে এখনি সব পেটপুরে খেয়েদেয়ে হাতিঘোড়া-বজরাপানসি চড়ে বসে শিকার করতে যাই। এতো এতো খাবারের আয়োজন দেখে মেঘ খুব খুশিই হলো। তাঁর মনে হলো হয়তো তাঁর জন্য জোনাকি এমন আয়োজন করেছে। কিন্তু সে জানে না, এমন আয়োজন সপ্তাহে তিনদিন হয়ে থাকে এই বাড়িতে। সে জানবে কিভাবে তাঁর তো সাত বছর এই বাড়ির সাথে কোন দেখা ছিলো না। পুরো টেবিল জুড়ে আনন্দের মেলা বসেছে। আলতাফ হোসেন বসে আছেন টেবিলের সোজাসুজি। তাঁকে ঘিরেই সবাই বসেছে। তাঁর ডান দিকে তাঁর ছেলে আলিফ বসেছে, তাঁর কাছ ঘেসেই বসে আছে শাপলা এবং তাঁর স্বামী রূপ। তাঁর কিছু দূরে বসে সবার খাবার তুলে দিচ্ছে মনি এবং আলতাফ হোসেনের স্ত্রী মনোয়ার বেগম, তিনিও মনিকে সাহায্য করছে। আলতাফ হোসেনের বাম পাশে, মনির দশ বছরের ছেলে মোহন বসেছে, সাথে আছে শাপলার সাত বছরের ছেলে। তাঁর কিছুটা দূরে দু’টো চেয়ার ছেড়ে বসে আছে মেঘ। তাঁর চোখে খুশি উপচে পড়ছে। কিন্তু সে জানে না। মেয়েদের রাগ ভাঙাতে যতটা সহজ অভিমান ভাঙতে ঠিক ততটাই কঠিন। তাঁর প্লেটে খাবার তুলে দেওয়ার সময় মনি কানে কানে বললো–

_ যেটা ভেবে মনে মনে লাফালাফি করছো, তেমন কিছু হয়নি মেঘ। আজ তোমাকে দেখে কোন আয়োজন হয়নি খাবার টেবিলে। এরকম সপ্তাহে তিনদিন হয়েই থাকে। তাই যে খুশিতে ভেতরে ভেতরে লাড্ডু ফুটাচ্ছো সোনা, তা বহুত দেরি।

ভাবির কথাটা শুনে বেচারা মেঘের মুখটা চুপসে গেলো। সে ভাবলো কি আর ভাবি বললো কি? দূরছাই ভাল লাগে না। কথাটা মুখ ফস্কে বলতেই আলতাফ হোসেন চোখ সরু করে তাকালেন।

_ কিরে কি বলছিস আবোল তাবোল, খাবার টেবিলে।

_ না ছোট বাবা তেমন কিছু না।

ওদের কথার মাঝে তখনই হঠাৎ কথা বলে উঠলো রূপ। রূপ মেঘের ছোট। কিন্তু সে মেঘের থেকে অনেক দায়িত্বশীল। মেঘ সব কিছু গা-ছাড়া একটা ভাব নিয়ে ঘুরে বেড়ালেও রূপ সেটা পারে না। সে নিজের দায়িত্ব গুলো খুব ভালো করে পালন করে।

_ হঠাৎ কি মনে করে ফিরে এলি।

_ কেন কি মনে করে ফিরবো। নিজের বাড়িতে ফেরার জন্য কি কোন কারণ দরকার।

_ তোর সব কিছুতেই একটা গা-ছাড়া ভাব, তাই বললাম। আর যে জন্য আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলি সেই কাজে কি তুই সফল হয়েছিস।

_ না, সফল হইনি বলেই আমার চোখ খুলে গেছে আর দেশে ফিরে এসেছি। সফল হলে হয়তো রঙিন চশমাটা আমার চোখে বাঁধা থাকতো। রঙিন চশমা বাঁধা ছিলো বলেই সেদিন ওত বড় ভুল করেছিলাম।

_ তাহলে তুই মানিস তুই ভুল করেছিস।

_ এখানে মানা না মানার কথা কোথা থেকে আসছে।

_ না এমনই।

_ তুই কি আমার ফিরে আসায় খুশি হসনি। নাকি তোর জীবনে আমি ভাগ বসাতে এসেছি।

_ সব সময় তোর বুঝটা উল্টো কেন হয়।

_ উল্টো না সঠিকটা হয়।

_ জীবনে তো কোন দায়িত্ব পালন করিসনি। একটা দায়িত্ব ছোট বাবা তোকে দিলো, সেটাও আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে পালিয়ে গেলি।

_ কি বলতে চাইছিস তুই, জোনাকি তোদের ঘাড়ে চেপে ছিলো মানে। তুই তো তাঁর কোন দায়িত্ব পালন করিসনি। যদি কেউ করে থাকে সে ছোট বাবা, কই তিনি তো আমায় কিছু বলছেন না তুই কেন এতো কথা বলছিস।

_ পরিবারের একজন দায়িত্ব পালন করা মানেই তো আমারও করা হলো তাই-না।

_ আচ্ছা, তাঁর মানে আমি পরিবারের বাহিরের কেউ?

_ সেটা কখন বললাম

_ এই-তো এখন বললি।

_দেখলেন ছোট বাবা মেঘ ভাই কেমন করে রিয়াক্ট করলো।

এতোক্ষণ সব কিছু শুনে যাচ্ছেন আলতাফ হোসেন। এবার তিনি খাবারের প্লেটে চোখ রেখে বললেন।

_ ভুল মানুষ মাত্র হয়। কেউ যদি সেই ভুল সংশোধন করে সব ঠিক করতে চায়, তাহলে তাঁকে সেই সুযোগ দেওয়া উচিত রূপ। আর কে কি করেছে তাঁর হিসেব না রেখে, সে কি করবে তাঁর দিকে খেয়াল রাখলে বেশি ভালো হবে। আর মেঘ তুমি অন্যায় করেছো তাই তোমাকে কিছু কথা শুনতেই হবে। তাই মাথা গরম করে কিছু বলা যাবে না। আর এতো কিছুর মাঝে একটা কথা ভুলে গিয়েছিলাম আমি। তুমি তো আমাদের সাথে যোগাযোগ রেখেছিলে! গত দুই মাস তুমি কোন রকম যোগাযোগ রাখোনি কেন?

_ আমি জেলে ছিলাম ছোট বাবা।

কথাটা মাথা নিচু করে বললো মেঘ। মেঘের কথাটা শুনে সবাই চমকে উঠলো। সবার খাওয়া দাওয়া কয়েক মুহূর্তে বন্ধ হয়ে গেলো। রান্না ঘরের টুকিটাকি কাজ গুছিয়ে নিচ্ছিলো জোনাকি। হঠাৎ মেঘের কথাটা তাঁর কানে আসতেই সে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো। হঠাৎ কেন জানি তাঁর কোথাও কষ্ট অনুভব হচ্ছে। কিন্তু কোথায় আর কেন? আলতাফ হোসেন মুখ তুলে মেঘের দিকে তাকালেন, মেঘ তখনো খাবারের প্লেটে তাকিয়ে আছে। তিনি গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন–

_ খুলে বলো কি হয়েছে।

মাফ করবেন ছোট বাবা আজ কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না, পড়ে একদিন বলবো।

কথাটা বলেই মেঘ অর্ধেক খাবার রেখে উঠে পড়লো। সবার মুখে আর কোন কথা নেই। রূপের কয়েক মুহূর্তে মনে হলো, কথা গুলো এখন না তুললেই ভালো হতো। কিন্তু সে-ও বুঝতে পারেনি, মেঘ সব কিছু সিরিয়াস ভাবে নিয়ে নিবে। সে আসলে দেখতে চেয়েছিলো মেঘ এখনো আগের মতো আছে কিনা। তাঁরা দু’জনেই পিঠাপিঠি। রূপ মাত্র এক বছরের ছোট মেঘের থেকে। তাই তাঁর দাবি গুলো অন্য ভাইদের থেকে একটু বেশি। ছোটবেলা থেকেই খাওয়া দাওয়া থেকে শুরু করে সব কিছুই একসাথে ছিলো তাঁদের। এমন কি বিয়েটাও একদিনে হয়েছিলো, অথচ সাত বছর সেই ভাইটা দূরে ছিলো তা-ও সামান্য একটা কারণে। এই কথা মনে পড়তেই কেমন কষ্ট হয়। তাই তো এই প্রশ্ন গুলো করা। এটা জানার জন্য, তাঁর ভাই আবার সেই ভুল জায়গায় ফিরে যাবে কিনা। এসব ভাবতেই বুকটা ভারি হয়ে এলো, তাই তাঁর-ও আর খাওয়া হলো না। হাত ধুয়ে উঠে নিজের ঘরে চলে গেলো। একটু আগে খাবার টেবিলে যে আনন্দ দেখা দিয়েছিলো তা কয়েক মুহূর্তেই উধাও হয়ে গেলো। স্বামীর দেখাদেখি শাপলাও উঠে দাঁড়ালো। সবাই চলে গেলেও আলতাফ হোসেন উঠলেন না। তিনি বসে থেকেই জোনাকিকে ডাক দিলেন।

_ জোনাকি–

জোনাকি দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে হয়তো এই ডাকটির অপেক্ষায় ছিলো। তাইতো ডাক পড়তেই সে ছুটে এলো।

_ বাবা বলুন।

সবাই আলতাফ হোসেনকে ছোটা বাবা বলে ডাকলেও জোনাকি শুধু বাবা বলেই ডাকে। কারণ জোনাকি নিজের বাবা-র ছায়া আলতাফ হোসেনের মাঝে দেখতে পায়।

_ যে দায়িত্ব আমি তোমায় সাত বছর আগে দিয়েছিলাম, সেটা নতুন করে তোমায় আজ আবার দিলাম। যাঁর অপেক্ষায় তুমি নিজের জীবনের সাতটি বছর নষ্ট করেছো, আমি জানি সেই সাতটি বছর ফিরে পাবার নয়। কিন্তু যে তোমার সাতটি বছর নষ্ট করেছে তাঁকে তাঁর দায়ভার নিতে দাও। অনেক তো হলো অপেক্ষা করা, এবার তাঁকে অপেক্ষা করতে দাও। তাঁকে বুঝতে দাও অপেক্ষা করা কত কঠিন। মেঘ না বললেও আমি জানি ও প্রতারিত হ’য়েছে ওর বন্ধুদের কাছে, তাই ওর চোখের রঙিন চশমা ভেঙে গুড়িয়ে গেছে। তাই আজ বাস্তব ওর চোখের সামনে ভাসছে। ওকে আরো বাস্তবের দুনিয়া দেখাতে হবে। ওকে বোঝাতে হবে আবেগের বসে যে ভুল গুলো ও করেছে, তা আসলে ভুল না অন্যায়। ওকে এ-ও বুঝতে হবে দায়িত্ব থেকে পালিয়ে গেলেই পুরুষ হওয়া যায় না। দায়িত্ব পালন করার নামই পুরুষ।

—————–

আকাশে আধখাওয়া চাঁদ উঠেছে, সেদিকে তাকিয়ে আছে মেঘ। হাতে জলন্ত সিগারেট একটান দিয়ে হাতে রেখেই আকাশ পানে চেয়ে আছে। সময় গড়িয়ে সেই সিগারেট পুড়ে যখন তাঁর হাত স্পর্শ করলো, তখন তাঁর বোধগম্য হলো সে ভাবনার জগতে হারিয়েছে। হাত থেকে সিগারেটটা ফেলে দিয়ে ঘরে এলো। বিছানায় বসে পাশের ড্রায়ার থেকে একটি মলম বের করলো। সে জানতো এখানে এই মলমটা থাকবে। ঘরের প্রতিটা জিনিস যখন এলোমেলো হয়নি, তাহলে এই জিনিস গুলোও এলোমেলো হওয়ার কথা নয়। ঠিক তাই হলো যেটা সে ভেবেছিলো। শুধু পার্থক্য এটাই পুরাতন মলমের জায়গায় নতুন মলমের স্থান এখানে। হাতে মলম লাগিয়ে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজতেই বুঝলো কেউ ঘরে এসেছে। চোখ না খুলেই বুঝলো জোনাকি ঘরে এসেছে। চোখের পর্দা সামান্য খুলে জোনাকির গতিবিধি শনাক্ত করতে রইলো মেঘ। জোনাকির হাতে একটি খাবার প্লেট। প্লেটটা একটি টি-টেবিলের ওপর রেখে জোনাকি ওয়াশরুমে চলে গেলো। মেঘের ঠোঁটের কোণে আলোড়ন তৈরি হলো। জোনাকি ওয়াশরুমে যেতেই মেঘ উঠে বসলো। কথার বলার জন্য খাবারের স্বাদ ভালো করে নেওয়া হয়নি, এক সময় তো রাগ করে খাবার ছেড়ে উঠেই আসলো। তাই এখন মজা করে খাওয়া যাক। টেবিলটা সামনে এনে খাওয়া শুরু করলো। না রান্নাটা সত্যি অসাধারণ। যাকে বলে বাজিমাত। অনেক দিন হলো এমন রান্না খাওয়া হয়নি। না, না অনেক দিন নয় অনেক বছর। খাওয়া শেষে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে সামনে তাকালেই দেখলো জোনালি একটা হলুদ রঙের শাড়ি পড়েছে, আঁচলটা ছাই রঙের। চুল থেকে টপটপ করে পানি ঝড়ছে। দেখে বোঝাই যাচ্ছে জোনাকি গোসল করেছে। জোনাকিকে দেখে হঠাৎ মেঘের ভেতরে কেমন অনুভূতি হচ্ছে। এই অনুভূতির কি নাম। কিছু বলতে উদ্যোগ হলে জোনাকি কিছু না বলেই খাবারের প্লেট নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। মেয়েটা যে খুব করে তাঁকে এভোয়েড করছে তা ভালোই বুঝলো মেঘ। কিন্তু এরকম চলতে থাকলে কখনোই সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে না। তাই জোনাকি দরজার কাছে যেতেই মেঘ বললো।

_ আপনারা হাতের রান্না সত্যি অসাধারণ। খেয়ে আমার মন শরীর দু’টোই তাজা হয়ে গেছে।

মেঘের কথা শুনে আমার কেমন জানি রাগ হলো। কারো হাতের রান্নার প্রশংসা বুঝি এভাবে করে। কিন্তু তাঁর এই প্রশংসা যে মন থেকে আসেনি তা ভালোই বুঝলাম। আমি পিছন ফিরে লোকটার দিকে তাকাতেই তিনি এক পা পিছনে চলে গেলো। তাঁকে এটা বোঝাতে চাইলাম, আপনি সুনাম না করলেও আমি জানি আমার রান্না সুন্দর। তারপর আমি দ্রুত গতিতে বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে।

_জোনাকির ওমন চাহনি দেখে আমি ভয় পেলাম। তাঁর ওই চাহনিতে কিছু একটা ছিলো। মনে হলো যেন তাঁর চোখ বলছে, মিথ্যা সুনাম করবেন তো চোখ দিয়ে বর্শ করে দিবো। বাপরে এই মেয়ে দেখি সত্যি মিথ্যা কথার ভাঁজেই ধরে ফেলে। হ্যা এটা ঠিক তাঁর রান্না খুব সুন্দর! কিন্তু আমি যে সুনামটা করলাম সেটা ইচ্ছে করে, তাঁর মনোযোগ পাওয়ার জন্য। কিন্তু তিনি যে ভাবে আমাকে বুঝালেন তাতে দ্বিতীয়বার আর তাঁকে কিছু বলার সাহস আমার মধ্যে নেই। কিন্তু সব থেকে বড় কথা এই পর্যন্ত মেয়েটা কোন কথা বলেনি আমার সাথে! এমনি কি বাড়ির অন্য কারো সাথেও তাঁকে কথা বলতে শুনিনি, তিনি কি পণ করেছে নাকি কথা না বলার। আমি আর কিছু ভাবতে পারলাম না। তাই লাইট অফ করে শুয়ে পড়লাম। শুয়ে শুয়ে ভাবছি আবার কোন পরিস্থিতিতে পড়তে হয় কে জানে, যখন সে ঘুমাতে আসবে। সিনেমার মতো না বলে, আপনি বিছানায় ঘুমান আমি সোফায়। দূর এই নেকামি গুলো একদম অসহ্য লাগে। এরকম কোন কিছু হলে আমি কোন মতেই তাঁকে আটকাব না হুঁ।

—————–
অন্ধকারের এক কোণে বসে আছে জোনাকি। পুরো ড্রইংরুমের আলো নেভানে। সবাইকে খাইয়ে দিয়ে নিজের আর খাওয়ার ইচ্ছে নেই। খাবারের টেবিলেই বসে আছে। তাঁর মন ঘরে টানছে না। কেন জানি মেঘকে দেখলে মনে হয়, মেঘ কোন বিশেষ কারণে ফিরে এসেছে। কিন্তু সেই কারণ যে জোনাকি নয় তা জোনাকি ভালো করেই বুঝেছে। কিন্তু কি সেই কারণ। লোকটার চোখে কোন অনুশোচনা নেই, যেই অনুশোচনা মানুষকে দগ্ধ আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। তাঁর ভেতরে নেই কোন আক্ষেপ। তাহলে কি তাঁর কোন স্বার্থের জন্য ফিরে আসা। সত্যিই যদি এমন কোন কারণ হয় তাহলে জোনাকির কি হবে? কোথায় যাবে সে। এসব আকাশ পাতাল চিন্তার মাঝে ফোনটা বেজে উঠলো। স্কিনে ভেসে উঠলো, নয়ন নামটা। আজ সারাদিন ব্যস্ততার জন্য ফোন দেওয়া হয়নি। হয়তো তাই ও ফোন দিয়েছে। নয়ন জোনাকির চাচাতো ভাই, ওর থেকে বছরের খানেকের বড়। ফোনটা রিসিভ করে কানে তুললো জোনাকি।

_ বল।

_ সারাদিনে একবারও ফোন দিসনি কেন?

_ ব্যস্ত ছিলাম।

_ কাকে নিয়ে, যাকে নিয়ে থাকবি সে তো কবেই হারিয়ে গেছে।

_ ফিরে এসেছে।

_ মানে।

_ মানে মেঘ ফিরে এসেছে।

_ কবে কখন কিভাবে?

_ জানি না, আর জানতে চাই না। আজ স্কুল থেকে ফিরে এসে দেখি তিনি বাড়িতে, কখন কেন কিভাবে এসেছে আমি কিছু জানি না।

ভেতরের একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে নয়ন বললো।

_ তাহলে নতুন করে সব শুরু করছিস।

_ চাইলেই নতুন করে সব শুরু করা যায় না নয়ন।

_ শুরু করবি বলেই তো এতো বছর ওই বাড়িতে পড়ে রইলি।

_ আমি কেন এই বাড়িতে পড়ে রয়েছি, সব জেনেও তুই এসব বলছিস। আমি অন্তত তোর থেকে এটা আশা করিনি।

_ আশা তো আমি অনেক কিছু করিনি, কিন্তু হয়েছে তো অনেক কিছু।

_ সেই আগের মতো হেয়ালি করছিস। কোন কথাই সোজা ভাবে বলিস না, সব সময় ঘুরিয়ে বলিস।

_ হুম সেই ছোটবেলা থেকেই। তো খেয়েছিস।

_ না, ভালো লাগছে না।

_ কেন মেঘ তোকে খাইয়ে দেয়নি। আমি হলে তো এই সুযোগটা হাত ছাড়া করতাম না।

_ এখন অবধি সে এটাই জানতে চাইলো না আমি ভালো আছি কিনা। আর তিনি দেবে খাইয়ে। ভালো লাগছে না রাখছি।

নয়নের কথা না শুনেই জোনাকি ফোনটা কেটে দিলো। বুকের মাঝে ফোনটা নিয়ে চাপিয়ে রাখা সেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল নয়ন। জীবন কেন তাঁদের সাথেই এমন করলো। জীবনের থেকে কি খুব বেশি চেয়ে ফেলেছিলো। হুম চেয়েছে তো খুব দামি কিছু! যা সবাই পায় না, আর যাঁরা পায় তাঁরা কদর করে না “ভালোবাসা” স্বপ্ন ছিলো ছোট্ট কুঁড়ে ঘরের, যে ঘরে অভাব থাকলেও ভালোবাসা থাকবে ভরপুর। কিন্তু ভালোবাসা তো আজ অন্য কারো। আজ অন্য কারো ভালোর জন্য নফল নামাজ পড়ে, অন্য কারো ভালোর জন্য হাতে চুড়ি নাকে নাকফুল দেয়। ভালোবাসার মানুষটা এক আছে শুধু তাঁর জায়গায় অন্য কেউ দখল করে আছে।

———–
এক পা দু পা করে ঘরের দিকে এগিয়ে এলো জোনাকি। এখন ঘরটা শুধু তাঁর নয় অন্য কারোও। দরজার কাছে এসে থমকে দাঁড়ালো জোনাকি। ঘরের ডিমলাইটে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে মেঘের মুখ। কত নিশ্চিন্তে সে ঘুমাচ্ছে, অথচ তাঁর উচিত ছিলো কত কি। থাক সব চাওয়া তো পূরণ হবার নয়, এটা হবে ভাবলো কি করে জোনাকি। এখন যদি জোনাকি ঘরে গিয়ে সোফায় ঘুমায় বিষয়টা চক্ষু লজ্জার। তাঁর অগোচরে যদি তাঁর সব কিছু ব্যবহার করতে পারে তাঁর নাম সূত্র ধরে, আজ কেন তাঁর পাশে শুতে পারবে না। আর এটা কোন গল্প বা নাটক নয় যে এমন কিছু করবে জোনাকি। মেঘ যথেষ্ট জায়গা ছেড়ে ঘুমিয়েছে, সেখানে জোনাকির কোন অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। বড়সড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে ঘরের দরজা লাগিয়ে বিছানার এক কোণে শরীরটা এলিয়ে দিলো। দু’জন দু’দিকে মুখ করে শুয়ে আছে। কারো চোখেই ঘুম নেই। মেঘ ঘুমিয়ে গেছে এটা জোনাকি ভাবলেও মেঘ এখনো ঘুমাতে পারেনি। জোনাকি যখন দরজার কাছে এসে থমকে দাঁড়ালো, তখনও মেঘ জেগেই ছিলো। জোনাকির গতিবিধি দেখছিলো। সে-ও ভেবেছিলো হয়তো জোনাকি তাঁর পাশে ঘুমাবে না, কিন্তু তাঁর ভাবনা পাল্টে দিয়ে জোনাকি তাঁর পাশের বালিশেই নিজের মাথা রাখলো। জোনাকি মেঘের মাঝে দূরত্ব অনেক, কিন্তু হঠাৎ মেঘের ভেতরে কেমন করে উঠলো। একেই বুঝি বলে আগুন মোম কখনো এক জায়গায় স্থীর হয়ে থাকতে পারে না। এপাশ ওপাশ করেও নিজের ভেতরের অনুভূতি লুকিয়ে রাখতে পারলো না মেঘ। পাশাপাশি শুয়ে থাকা এই দম্পতির ভেতর কি চলছে তা একমাত্র তাঁরাই জানে। চোখটা বুজে নিয়ে জোনাকি ভাবলো, মানুষটা কখনো তাঁর ছিলো না, তাই আজ-ও তাঁর হওয়ার কোন চান্স নেই। আচ্ছা একান্ত নিজের হওয়া মানে কি শুধু শরীরকে বোঝায়। না শুধু শরীর না, মনও আছে। যে নারীর হৃদয় ছুঁতে পারেনি তাঁর কোন অধিকার নেই নারীর শরীর ছুঁয়ে দেওয়ার। এমন আকাশ পাতাল ভাবনায় যখন মগ্ন ছিলো জোনাকি তখন মেঘ জোনাকির হাত আঁকড়ে ধরলো। জোনাকি আতংকে উঠলো। ভয়ে সে নিজেকে গুটিয়ে নিলো। জোনাকিকে গুটিয়ে যেতে দেখে মেঘ কিছুটা কাছ ঘেঁসে জোনাকিকে নিজের মাঝে আবদ্ধ করলো। জোনাকি চেয়েও নিজেকে ছাড়াতে পারলো না। মানুষটা এমন কেন করছে, এতোদিন পড়ে ফিরে তাঁর এই আচরণটা জোনাকির প্রাপ্য ছিলো না। জোনাকিকে নিজের বুকের মাঝে চেপে ধরে মেঘ বললো—

_ আজ রাতে যদি আমি তোমায় আমার করে পেতে চাই, তুমি কি খুব রাগ করবে জোনাকি।

কথাটা বলেই নিজের হাতের বাঁধন শক্ত করলো মেঘ। এতোক্ষণ নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলেও এবার জোনাকি স্থীর হয়ে রইলো। চোখের কানিশ বেয়ে দু’ফোটা চোখের জল গড়িয়ে পড়লো মেঘের দৃষ্টির অগোচরে। লোকটাকে খারাপ ভেবেছিলো জোনাকি, কিন্তু এতটা খারাপ ভাবেনি। ভেবেছিলাম বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলবে, আমার ভুল হয়েছে জোনাকি আমাকে ক্ষমা করে দাও। কিন্তু সে কি বললো। নিজের অস্তিত্ব আমার মাঝে যতটা উপস্থাপন ছিলো, তা-ও হারিয়ে ফেললো নিজে।

জোনাকিকে চুপ থাকতে দেখে মেঘ আবার বললো।

_ কিছু বলো জোনাকি।

জোনাকি মেঘের হাত সরিয়ে দিলো। বিছানা ছেড়ে উঠে বেলকনিতে দাঁড়ালো। মেঘও জোনাকির পিছু নিলো। জোনাকি দূর আকাশের দিকে চেয়ে রইলো। মেঘ জোনাকির পিছনে দাঁড়িয়ে জোনাকির ঘাড়ে হাত দিলো। মেঘের ছোঁয়া যেখানে জোনাকির শিউরে ওঠার কথা, সেখানে জোনাকির অস্থির লাগছে। হয়তো একেই বলে ভালোবাসার ছোঁয়া আর চাহিদার ছোঁয়া দু’টোই আলাদা। ঘাড় ফিরিয়ে মেঘের হাত সরিয়ে দিয়ে একটু দূরে সরে এলো জোনাকি। নিজেকে সামলে বললো—

_ আপনার কি মনে হয়, আমার আপনাকে গ্রহণ করা উচিত নাকি ফিরিয়ে দেওয়া। সাত বছর ধরে যাঁর জন্য নিজের মাঝে একটু একটু করে ভালোবাসা জমিয়েছি, তাঁর কাছে ভালোবাসা না হয়ে চাহিদা হলাম। আল্লাহর বিধান অনুযায়ী নিজের সর্তীত রক্ষা করেছি কি নিজের স্বামীর কাছে নিজেকে নিজের অনিচ্ছায় তুলে দিতে। যাঁর ছোঁয়ায় আমার শিউরে ওঠার কথা, তাঁর ছোয়া আমার অসস্থি হচ্ছে! তাঁর কাছে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া কি আমার ঠিক হবে। যে আমাকে কোন কারণ ছাড়াই ফেলে চলে গিয়েছিলো, তাঁকে এতো সহজে মেনে নিয়ে সংসার করাকে মানুষ কি বলবে, আমি লোভী। যখন আপনার পরিবারের প্রতিটা মানুষ জানতে চাইলো আমাকে ছেড়ে যাবার কি কারণ? কাউকে আপনি ভালোবাসেন কিনা? কিন্তু আপনি উত্তর দিলেন, আপনি এখনো প্রস্তুত নন কারো দায়িত্ব নেওয়ার জন্য। এখনো আপনার পুরো দুনিয়া দেখা বাকি। নিজের পায়ে দাঁড়ানো বাকি। নিজের ক্যারিয়ার গড়ার সময় এখন! এখন আপনি কোন মতে পিছু ফিরে তাকাতে চান না। কেন এতোদিন কি আপনি অন্যের পায়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আজ যদি আপনার বন্ধুরা আপনার সাথে বেঈমানী না করতো,আজও তো আপনি আমার কাছে ফিরে আসতেন না। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ওখানেই থেকে যেতেন। তাহলে আমার কি হতো একবারও খোঁজ নিতেন। বাড়ির সবার সাথেই তো কম বেশি যোগাযোগ রেখেছিলেন, কিন্তু একবারও খোঁজ নিয়েছিলেন! যে মেয়েটাকে নিজ দায়িত্বে বাড়িতে এনে ফেলে চলে গিয়েছিলেন তাঁর কি খবর। সে ভালো আছে কিনা? এই সমাজের নোংরা মানসিকতার থেকে সে নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছে কিনা। আপনি আমায় ভালোবেসে আমার কাছে আসেননি, এসেছেন বেঈমান বন্ধুদের বেঈমানী সহ্য করতে না পেরে। আমি চাইলেই এতোদিনে নতুন করে সব শুরু করতেই পারতাম, কিন্তু আমি অপেক্ষা করেছিলাম আপনার ফিরে আসার। কারণ আমার মহান রাব্বুল আলামিনের উপর বিশ্বাস ছিলো, আমি কোন অন্যায় যেহেতু করেনি আমার সাথে তাহলে কোন অন্যায় হতেও পারে না। মহান আল্লাহ আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছেন, জানিনা আমি পাশ করেছি কিনা কিন্তু চেষ্টা করেছি। ভালোবেসে আমার কাছে আসবেন যেদিন, সেদিন আপনাকে বলতে হবে না! সেদিন আমি নিজেই আপনার কাছে ধরা দিবো, তাঁর আগে প্লিজ আমার কাছে আসবেন না। স্বামী হন আপনি আমার, আপনাকে নিজের চোখে এতটা নিচু হতে দেখতে পারছি না। এতটা নিচু হবেন না, যতটা নিচু হলে মাথা তুলে সামনে তাকাতে পারবেন না। আমি নিঝুমের ঘরে যাচ্ছি, অনেক রাত হয়েছে শুয়ে পরুন।

এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে জোনাকি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। মেঘ খুব মনোযোগ সহকারে পুরো কথা গুলো শুনলো। হ্যা জোনাকি ঠিক বলেছে! সে তো জোনাকিকে ভালোবেসে কাছে টানেনি, টানতে চেয়েছিলো শরীরের জন্য। সে ফিরেও আসতো না কোনদিন যদি তাঁর বন্ধুরা তাঁর সাথে বেঈমানী না করতো। যদি জোনাকিকে সে ভালোই বাসতো তাহলে তাঁকে কাছে টেনে আগে জানতে চাইতো, সে কেমন আছে। কই সেই কথা তো একবারও জানতে চাইলো না সে। আচ্ছা আজ জোনাকির মনের যে অবস্থা হয়তো সে রাতের খাবার টাও খায়নি। অথচ সে নিরদ্বিধায় নিজে খেয়ে নিলো। তাহলে কি এটাকে ভালোবাসা বলে। সে সত্যি সব কিছু ঠিক করতেই ফিরে এসেছে, তাহলে তাঁর এসব করার কি দরকার। কথায় আছে,যদি কাউকে ভোলাতে চাও, তাহলে নিজের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা উপহার দাও। দেখবে সে তাঁর জীবন উৎসর্গ করে দেবে।

চলবে,,,