অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী পর্ব-২৭+২৮

0
365

#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#পর্ব_২৭
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

ঘন অন্ধকার দূর করতে বাড়ির বাইরে কৃত্রিম আলো জ্বালানো হয়েছে। দালানের ভেতর থেকেও দেখা যাচ্ছে আলোকছটা। মাহমুদ দুঃখে জর্জরিত অশান্ত তরীকে শান্ত করার প্রচেষ্টায় নামলো। কন্ঠ স্বর একেবারে ক্ষীণ করে প্রায় ফিসফিসানো গলায় বলল,
-“শান্ত হও তরী। বিল্ডিং এর সবাই জেগে আছে। এই মুহূর্তে আমাদের দেখলে সমস্যা তৈরি হবে।”

তরীর কানে শব্দগুচ্ছ পৌঁছাতেই খানিকটা কান্নার মাত্রা কমিয়ে দিল। এখন কেবল দু-চোখের কোল ঘেঁষে অশ্রুপাত হচ্ছে। মাঝে মাঝে হেঁচকি উঠছে। মাহমুদ তরীর মাথাটা ধরে বুক থেকে তুললো। যত্ন করে চোখের গরম জল মুছে দিল। কোমল স্বরে বলল,
-“এভাবে কেঁদো না, তরী। আন্টি কষ্ট পাবেন। বেশি বেশি আন্টির জন্য নামাজ পড়ে দোয়া কর। নিজেকে ঠিক রাখো। মিঠু আর অরু এখন তোমার দায়িত্ব।”

তরী ঢুকরে উঠলো ছোটো ভাই-বোন দুটোর কথা ভেবে। সাথে সাথে মুখে হাত চেপে বলল,
-“আমার ছোটো ছোটো ভাই-বোন দুটোর কী হবে? অরু মাকে ছাড়া থাকতে পারেনা। এতদিন তাকে সামলাতে খুব কষ্ট হয়েছে। কাল রাতেও ঠিক করে ঘুমায়নি। এখন কোনভাবে ঘুম পাড়িয়ে এসেছি। ও শুধু মায়ের কাছে যেতে চায়। মিঠু খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। বাবা নিজেদের ঘরে পর্যন্ত পা রাখছেন না। উদাস হয়ে পড়ে আছেন গেস্ট রুমে। কী করবো আমি? মা আমার উপর এত এত দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে এক নিমিষেই ফাঁকি দিলো। আমি কিভাবে সব কিছু সামলাবো?”

মাহমুদ স্বভাবসুলভ নরম স্বরেই বলল,
-“তুমি পারবে তরী। কেউ চিরদিন বেঁচে থাকেনা। তোমাকে, আমাকে, সবাইকে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে হবে। নিজে ঠিকঠাক ঘুমাও, খাওয়াদাওয়া করো, মায়ের জন্য দোয়া কর। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।”

মাহমুদ ফোনের স্ক্রিন অন করে সময় দেখলো। পকেটে ফোন গুঁজে বলল,
-“রাত হয়েছে। বাসায় চলে যাও। কোন প্রয়োজন হলেই আমাকে ফোন করবে। রাত হলেও আমি আসবো।”

মাহমুদ আরও একবার তরীর ললাট স্পর্শ করলো। দীর্ঘক্ষণ সময় নিয়ে দুই ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল তরীর কপালে। তরী নিজের ব্যথা গোপন করে একবার ক্ষীণ স্বরে শুধালো,
-“আপনি খেয়েছেন?”

প্রত্যুত্তরে মুচকি হাসলো মাহমুদ। চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো তার।
-“বাসায় গিয়ে খাবো। তুমি এখন যাও।”

বলে মাহমুদ দ্রুত বেরিয়ে গেল। তরী কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে। পা দুটো যেন আর চলছেনা।
বাসায় ফিরে দেখলো অরু উঠে বসে আছে। মায়ের জন্য কান্না করছে। তরীর কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে। অরুকে কোলে নিয়ে থামানোর চেষ্টা করলো। মা কিছুদিন পর আসবে বলে মিথ্যে সান্ত্বনা দিলো। অরুর কান্নার আওয়াজ পেয়ে বাবা ছুটে আসলেন। দরজায় দাঁড়িয়ে দুহাত বাড়িয়ে ডাকলেন অরুকে।
-“আসো মা।”

অরু বাবার কোলে চলে গেল। তিনি তরীকে ঘুমিয়ে যেতে বলে অরুকে নিয়ে চলে গেলেন। মিঠুর ঘরের দরজা ফাঁক করে দেখলেন ছেলেটা ঘুমিয়েছে কি-না! তাকে চোখ বুজে থাকতে দেখে স্বস্তি পেলেন।

★★★

মামি সপ্তাহ খানেক থেকেই চলে গেলেন। উনারও সংসার আছে। তারপর আসলেন তিয়াসের মা। তিনি ও দুদিন থেকে চলে গেলেন। আয়েশা সুলতানা আসা-যাওয়ায় রইলেন। সংসারের একটা জিনিস এক এক জায়গায় অবহেলায় পড়ে আছে। এ এটা করেছে সে ওটা করেছে অথচ কেউ কিছুই সামলাতে পারছেনা। তরী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-“আহারে মা! তুমি চলে গিয়ে দেখো, দশজন মিলেও তোমার সংসারটা সামলাতে পারছেনা।”

অরুর এতদিনে ধারণা হয়ে গিয়েছে মা আর আসবেনা। মেয়েটা আগের তুলনায় একেবারেই শুকিয়ে গিয়েছে। কিছুক্ষণ কাঁদে তো কিছুক্ষণ থম ধরে বসে থাকে। আগের মতো দুষ্ট মিষ্টি, ঝ*গ*ড়ু*টে অরু আর নেই। কারো সাথে খুব একটা কথা বলেনা। মিঠু সারাদিন বাইরে বাইরে থাকে। যখনই বাসায় আসে, তখনই মায়ের ঘরে গিয়ে কাঁদে। বাবা এখনো গেস্ট রুমে থাকেন। ভুলেও ও ঘরে উনার কদম পড়েনা। তরী গতকাল জিজ্ঞেস করলো,
-“তুমি ঘরে যাচ্ছো না কেন, বাবা?”

বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
-“ও ঘরে যেতে আমার বুক কাঁপে। তোর মায়ের কত স্মৃতি ওই ঘরে পড়ে আছে।”

তরীর চোখে পানি চলে এলো। বাবা যতই একরোখা মানুষ হোন না কেন, ভালোবাসতে কার্পণ্য করেননি। বাবাকে আর কিছু বলতে পারেনি তরী।
সামনেই ফাইনাল এক্সাম। রুটিন পাবলিশ হয়ে গিয়েছে। তরী ক্লাস করতে পারেনি এতদিন। দুপুরের রান্না সামলে সবটা গুছিয়ে নিলো। শরীরটা আজ ভীষণ ক্লান্ত। বাড়িতে সে আর অরু একা। মিঠুকে ঠে*লে*ঠু*লে আজ স্কুলে পাঠিয়েছে। অরুকে খাইয়ে দুপুরে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। মায়ের পর বড়ো বোন হলো দ্বিতীয় মা। যার কাছে ছোটো ভাই-বোন গুলো যত্নে থাকে। তরী তাদের ভালো রাখার সব রকম চেষ্টা করে।
ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দেওয়ার কিছুক্ষণ পরই তার ছটফটানি বেড়ে গেল। শরীর কেমন লাগছে সে বলতে পারছেনা। শুয়েও শান্তু পাচ্ছেনা। উঠে বসারও শক্তি নেই।

★★★

স্কুল ছুটির পরও রামি মিঠুকে কিছুক্ষণ আটকে রাখলো। সে জানে মিঠু বাড়িতে গেলেই আরও দুর্বল হয়ে পড়বে। আরও কয়েকজন বন্ধু মিলে ক্লাস শেষে ক্রিকেট এর আয়োজন করলো। স্কুলের গেইট বন্ধ হয়ে যাবে। তাই পাশের একটা বড়ো মাঠে নামলো খেলতে।
খেলা শেষ করে সন্ধ্যার একটু আগেই বাড়ি ফিরলো। ঘরে ঢুকে গোসলে চলে গেল।

এদিকে তরীর ভয়াবহ জ্বর উঠেছে। শরীরটা পুড়ে যাচ্ছে। অথচ পায়ের দিকটা বরফ শীতল। মায়ের ও ঠিক এমনটাই হয়েছিল। তরী ভয় পেলো। হুট করেই বমি পেলো। বিছানা ছেড়ে বেশিদূর যেতে পারেনি। গলগল করে বমি করে ফ্লোর ভাসিয়ে ফেলেছে। মিঠু গোসলে থাকায় কিছুই শুনতে পেলোনা। কষ্ট করে আসবাবপত্র ধরে ওয়াশরুম ঢুকে কুলি করে চোখেমুখে পানি দিলো। মাথা নিচু করে মাথায়ও পানি দিল। কিছুক্ষণ থম ধরে বসে থেকে বেরিয়ে এসে বমি পরিষ্কার করে অজু করে জায়নামাজ বিছিয়ে নিলো। মাগরিবের আজান পড়েছে একটু আগে। নামাজ শেষে আল্লাহর দরবারে চোখের পানি ছেড়ে নিজের জীবন ভিক্ষা চাইলো।

-“আল্লাহ আমার ভাই-বোন দুটোর জন্য হলেও আমার জীবন ভিক্ষা দিন, আমাকে বাঁচিয়ে রাখুন। আমি ম*রে গেলে ওদের কে দেখবে? বাবাকে কে দেখবে? আপনি বড়ো দয়ালু আল্লাহ। আমার মতো পাপী বান্দাকে ক্ষমা করে এই ফরিয়াদ কবুল করুন।”

অরুকে আজ আর ঘুম থেকে তোলা হয়নি। নড়েচড়ে উঠছে মেয়েটা। তরী জায়নামাজ গুছিয়ে অরুকে কোলে তুলে নিলো। মিঠুর ঘরে ঢুকে দেখলো সে গোসল করে বেরিয়েছে। বলল,
-“এত দেরি করলি যে? খেতে আয়।”

“আসছি” বলে মিঠু গেঞ্জি পরে নিলো।
খাবার সময় ঢুলুঢুলু তরীকে দেখে ভুরু কুঁচকে তাকালো মিঠু। জিজ্ঞেস করলো,
-“তুমি কি অসুস্থ আপু?”

-“কিছুনা। একটু জ্বর এসেছে। তুই চিন্তা করিস না।”

মিঠু খেয়ে উঠে নাপা বের করে এনে তরীর সামনে রেখে বলল,
-“খেয়ে নাও।”

তরী বলল,
-“এত ব্যস্ত হতে হবে না, মিঠু।”

মিঠু কাতর গলায় বলল,
-“তোমার কিছু হলে যে আমি আর বাঁচবোনা আপু। মা ছাড়া এমনিতেই আমরা অসহায়। একে অপরকে না দেখলে কেউ আসবেনা আমাদের দেখতে।”

তরী খেয়াল করলো তার পাশাপাশি ছোটো ভাইটাও দায়িত্ববান হয়ে উঠছে। সে ঔষধ খেয়ে নিলো। সেই রাতে তরীর ভীষণ জ্বর উঠলো। মাহমুদ একের পর এক কল দিয়েও রেসপন্স পেল না। তিয়াস ও একবার কল দিল। তরীর মা মা*রা যাওয়ার দিন থেকে আজ সহ মোট তিনবার কল দিয়েছে সে। তরী হু, হা করে রেখে দিয়েছে।

★★★

আজ প্রথম পরীক্ষা তরীর। হল থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামলো। গেইটের সামনে মাহমুদ দাঁড়িয়ে আছে হাসিমুখে। তরী এগিয়ে গেল সামনে। মাহমুদ বলল,
-“ক্লান্ত দেখাচ্ছে তোমায়, কিছু খাবে চল।”

তরী অদ্ভুত ভাবে হাসলো। এলোমেলো চুল, গলায় ঘামের ছাপ, শার্টের টপ বোতাম খুলে রাখা। তারচেয়ে বেশি মানুষটাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। অথচ সে তরীকে নিয়ে ব্যস্ত। মৃদু হেসে তরী বলল,
-“আমার চেয়ে আপনি বেশি ক্লান্ত। চলুন একসাথে খাবো।”

মাহমুদ ও হাসলো। দুজন ঢুকলো একটা রেস্তোরাঁয়। একবার মাহমুদের চুলের ভাঁজে হাত গলিয়ে দিল। বলল,
-“আপনি কেমন শুকিয়ে যাচ্ছেন।”

মাহমুদ রগঢ় করে বলল,
-“বিয়ে করে অবিবাহিতের মতো থাকলে অবশ্যই শুকিয়ে যাওয়ার কথা। তুমি তো দূরে দূরে থাকছো।”

তরী ভুরু উঁচিয়ে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। অতঃপর মাহমুদ বাহুতে মৃদু চাপড় বসালো। শরীর দুলিয়ে শব্দহীন হাসলো মাহমুদ। পরক্ষণে তরী নিজেও হেসে ফেললো।

★★★

স্ত্রী মৃত্যুর দু-মাস না যেতেই মানুষ তরীর বাবাকে বিয়ের পরামর্শ দেওয়া শুরু করলেন। তিনি সব সময়ই ব্যাপারটা এড়িয়ে গিয়েছেন। দু-মাস শেষ হয়ে তিনমাসের মাঝামাঝি সময় চলছে। আজও বাজারে কয়েকজন মিলে ঘিরে ধরলেন উনাকে। শুধু বাইরের মানুষ নয়, আত্মীয়স্বজনরা ও উঠেপড়ে লেগেছেন। আজ তিয়াসের বাবাও উপস্থিত আছেন। তিনি সহ আরও কয়েকজন বোঝালেন,
-“মেয়ে কতকাল তোমার সংসার সামলাবে? তাকে পরের ঘরে বিদায় দিতে হবে। তুমি কাজের বাহানায় সারাদিন বাইরে কাটাও। বড়ো মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলে তোমার ছেলে আর ছোটো মেয়েটাকে দেখবে কে? সংসার সামলানোর জন্য হলেও একজন নারী দরকার। তাছাড়া শেষ বয়সে তোমার দেখাশোনা কে করবে? তাই বলছি বিয়ে করে নাও। আমরা ভালো দেখে মেয়ে দেখে দেবো।”

তরীর বাবা হ্যাঁ, না কিছুই বললেন না। চা শেষ করে বিল মিটিয়ে বাড়ির পথে রওনা হলেন। কে জানে উনার ভেতর কী চলছে?

#চলবে………

#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#পর্ব_২৮
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

গোসল দিয়ে জামা কাপড় কাঁচতে গিয়েই মায়ের কথা মনে পড়ে গেল। তার পরীক্ষা চলছে। আগে পরীক্ষা এলেই মা বলতেন,
-“তোর কাজ করতে হবে না। পড়ায় মন দে।”
পড়ার ফাঁকে ফাঁকে মুখে খাবার তুলে দিয়ে যেতেন। রান্নাঘর থেকে হাঁক ছেড়ে বলতেন,
-“গোসল দিয়ে জামা-কাপড় রেখে দে। আমি ধুয়ে রাখবো। তুই পড়তে বস।”

মায়ের কথা ভাবতে ভাবতেই দু-চোখ ফেটে অশ্রু গড়ালো। জামাকাপড় ধুয়ে চোখেমুখে পানি দিয়ে বেরিয়ে এলো। কলিং বেলের শব্দ শুনে তরী দৌঁড়ে গিয়ে দেখলো বাবা দরজা খুলে দিয়েছেন। তিয়াসের বাবা আর মা হাসিমুখে ভেতরে ঢুকলেন। হাতে ফল-মূলের অভাব নেই, সাথে মিষ্টির প্যাকেট। সোফায় বসতে দেওয়া হলো উনাদের। চাচি তরীকে টে*নে কাছে বসালেন। মুখে হাত দিয়ে আফসোস করলেন,
-“মেয়েটা শুকিয়ে কেমন কাঠ হয়ে গিয়েছে। এবার মেয়েটাকে আমার কাছে নিয়ে যাবো।”

তরীর ভেতরে ভয় ঢুকলো। ভড়কে গেল সে। তিয়াসের বাবা গলা ঝেড়ে বললেন,
-“রুবিনার মৃ*ত্য*র কারণে বিয়ের তারিখ পিছিয়ে গেল। এখন তো আর সমস্যা নেই। কাল নাহয় বিয়েটা হয়ে গেল। তরী আমাদের বাসায় আসা-যাওয়া করবে। পরে তিয়াস আসলে অনুষ্ঠান হবে।”

তরীর বাবার চেহারা থমথমে। তরী চোয়াল কঠিন করে নিলো। আজ সে চুপ করে থাকবেনা। মিঠু বাসায় ছিল। সবার আলাপ-আলোচনার মাঝখানেই তার উপস্থিতি ঘটলো। তাচ্ছিল্য হেসে বিদ্রুপ করে বলল,
-“যারা আমাদের দুঃসময়ে পাশে থাকেনি, তাদের কাছে আমার বোন নিরাপদে থাকবে? আমি কিছুতেই এই বিয়ে মানবোনা।”

বাবা গম্ভীর স্বরে বললেন,
-“মিঠু, বড়োদের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় জানোনা?”

-“আমি খা*রা*প কিছু তো বলিনি। যা সত্যি সেটাই বললাম।”

তরী চাচির পাশ থেকে উঠে পড়ল। অনড় গলায় বলল,
-“আমি বিয়ে করবো না, বাবা। তিয়াস ভাইয়াকে ছোটো থেকেই ভাই হিসেবে জেনে এসেছি আমি।”

তিয়াসের মা-বাবা দুজনেরই চোখমুখ শক্ত। অপমানিত বোধ করলেন উনারা। তিয়াসের বাবা বললেন,
-“তিয়াস তোমার আপন ভাই নয়।”

অতঃপর তরীর বাবার উদ্দেশ্যে বললেন,
-“তুই কিছু বলছিস না কেন?”

তরীর বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
-“এই ব্যাপারে পরে কথা বলি আমরা!”

তিয়াসের বাবা গর্জে উঠলেন।
-“তুই কি আমাদের এড়িয়ে যেতে চাইছিস? ছেলে-মেয়ে দুটো আমাদের মুখের উপর বে*য়া*দ*বে*র মতো কথা বলছে। তুই কিছুই বলছিস না?”

মিঠু অল্প বয়সি ছেলে। মেজাজ গরম হয়ে গেল তার। মাথার রগ ধপধপ করে উঠলো৷ রুক্ষ গলায় বলল,
-“বে*য়া*দ*ব*কে ঘরের বউ বানানোর এত ইচ্ছে কেন, আপনাদের?”

বড়ো ভাইকে সম্মান করলেও মনের মাঝে কিছু তিক্ততা সৃষ্টি হয়েছে তরীর বাবার। তবুও বাবা মিঠুকে ধমক দিলেন। যতোই হোক সে বে*য়া*দ*বি করছে।
-“মিঠু! ঘরে যা।”

ঘাড়ত্যাড়া মিঠু দাঁড়িয়ে থেকে বলল,
-“আমি তো ভুল কিছু বলিনি বাবা। আমাদের ভাইবোনকে বে*য়া*দ*ব বলে আবার কিভাবে আমার বোনকে চাচ্ছে? মায়ের অসুস্থতার সময় হাসপাতালে দৌঁড়ঝাপের সময় পাশে ছিল? অথচ তারা আমাদের আপনজন, আমাদের রক্ত। তখন পাশে ছিল দূরের মানুষগুলো। যাদের সাথে আমাদের আত্মীয়তা নেই, রক্তের সম্পর্ক নেই, তবুও আপনজনের মতো মাকে নিয়ে তোমার সাথে দৌঁড়েছে। তখন তো আমাদের নামমাত্র আপনজনরা কাজের দোহাই দিয়ে সরে পড়েছে।”

বাবা আবার ধমক দিলেন।
-“মিঠু তোকে যেতে বলেছি।”

তরীও ঘরের পথে পা বাড়াতে গিয়ে আরেকবার বলে গেল,
-“আমি কিছুতেই তিয়াস ভাইকে বিয়ে করবোনা।”

থামতে হলো তিয়াসের বাবার কথায়।
-“তো কাকে বিয়ে করবে? ওই ছেলেকে? দুদিন পাশে ছিল বলে সে আপন হয়ে গেল? না-কি তলে তলে প্রেম চলছে?”

তরী ঠান্ডা গলায় বলল,
-“আমি আপনাদের সাথে বে*য়া*দ*বি করতে চাইনা চাচা-চাচি। আমি কী করছি না করছি সেটা দেখার জন্য আমার বাবা আছেন। শাসনের জন্যও আমার বাবা যথেষ্ট।”

তরী আর থামলোনা। চলে গেল ঘরের ভেতর। তরীর বাবা নিশ্চুপ বসে রইলেন। স্ত্রী যাওয়ার পর থেকেই কেমন চুপচাপ হয়ে যাচ্ছেন তিনি। তিয়াসের বাবা-মা উনার নত মুখের দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে গেলেন। মিঠু জোর গলায় বলল,
-“আপনাদের ফল, মিষ্টি নিয়ে যান।”

তিয়াসের বাবা রাগে থরথর করে কাঁপছেন। আবার ফেরত এসে সব নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে তরীর বাবার উদ্দেশ্য বলে গেলেন,
-“কেমন ছেলের সাথে মেয়েকে বিয়ে দিবি, আমিও একবার দেখতে চাই।”

এবারও কিছুই বললেন না তরীর বাবা। দোকান-পাট, রাস্তা-ঘাট সব জায়গায়, আত্মীয়রাও উঠেপড়ে লেগেছেন উনাকে বিয়ে করাতে। তিনি চাইছেন না বিয়ে করতে। কিছু মানুষের যুক্তিও ভুল নয়, তরী আপাতত সংসার সামলাবে। কিন্তু কতদিন? তাকে বিয়ে দিয়ে পরের ঘরে বিদায় দিতে হবে। তখন ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ে দুটোকে কে দেখবে? যদি বিয়ে করেনও তাদের কথা ভেবে, তবে ওই নতুন নারী যদি তার ছেলেমেয়েদের কাছে টা*ন*তে না পারে? উনার আড়ালে-আবডালে যদি অরুকে অত্যাচারিত হতে হয়! মিঠু নাহয় সারাদিন বাইরে বাইরেই কাটালো। সে সন্ধ্যা ছাড়া বাসায় খুব কমই থাকে। অরুকে তো বাসায় থাকতে হবে। এসব ভেবেই শরীর ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে আসছে। সোফায় শরীর এলিয়ে চোখ বুজে রইলেন। কোথায় হারিয়ে গেল এই একরোখা মানুষটির তেজ, জেদ! যার দাপটে স্ত্রী, সন্তান কেঁপে উঠতো, মানুষ কথা বলতে একশবার ভাবতো!

★★★

তরীর পরীক্ষা শেষ হলো অনেকদিন হয়েছে। মায়ের মৃ*ত্যু*র চারটি মাস গড়িয়ে গেল। সংসারের ভার এখন তার কাঁধে। চাচা-চাচির সাথে অদৃশ্য রেষারেষি চলছে তাদের। তরী বাবার অবস্থা দেখেই মাহমুদের কথা বলার সাহস পায়না। সে আগের তরী নেই। ধীরে ধীরে বদলেছে সব। মায়ের মৃ*ত্যু নরম মেয়েটাকে শক্ত বানিয়ে দিয়েছে। অরু এখনো মাকে মনে করে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে। তরী টের পেয়ে সে ও কাঁদে। আশেপাশের মানুষজন বাবাকে বিয়ে করার জন্য বলছে এগুলো তরীর কানে আসলেও সে নির্লিপ্ত রইলো। বাবা যখন বিয়ে করতে চাইবেন কিংবা বলবেন তখন সে কথা বলবে। যেখানে বাবা চুপ সেখানে তার কথা বলাটা বেমানান।

★★★

মাহমুদ কয়েকদিন ধরেই তরীকে দেখছেনা। তরীর পরীক্ষা শেষ হওয়াতে ভার্সিটি আসা-যাওয়া বন্ধ। সংসারের ভারে দু-দন্ড জিরোবার ফুরসত নেই মেয়েটার। সকাল থেকেই মাহমুদের মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠেছে একবার তরীকে দেখার জন্য। তাদের বাসায় যাওয়া সম্ভব নয়। তরী এখন একা থাকবে বাসায়। অরুকে স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছে। তরীর ব্যস্ততা আকাশ ছুঁই ছুঁই। ফোনকলেও পাওয়া যাচ্ছে না মেয়েটাকে। হয়তো ফোন চেইক করার সময় পায়নি৷ মাহমুদ সহজে মেজাজ গরম করেনা বলেই হয়তো এতটা শান্ত আছে। নয়তো ফোন না ধরার অপরাধে তরীর উপর ভীষণ রেগে থাকতো। এখন আছে কেবল অস্থিরতা। তার ব্যাকুল মনকে শান্ত করতেই তরীর ফোন এলো। রিনরিনে কন্ঠ কানে ঝংকার তুললো। বুকের উথাল-পাতাল ঢেউ থামিয়ে দিতে এই মেয়েটিই যথেষ্ট৷ সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ভাবে অনিমন্ত্রিত ভাবে তাদের এই প্রেম। মাহমুদ ভাবেনি সেদিনের মেয়েটার প্রতি একটু একটু ভালোলাগা প্রেমের জোয়ার বইয়ে দিবে। তুলবে প্রেমের তরঙ্গ। সৃষ্টি হবে বিশাল এক নদী। তটিনীতে ভেসে যাবে সে। এখন ভ*য় পরিস্থিতির কারণে তাদের প্রেমনদী না শুকিয়ে যায়। তরী হবে তার একমাত্র খেয়াতরী! এই মেয়েটাকে ছাড়ার কথা মাথাতেই আনতে পারেনা মাহমুদ। এবার তরীর বাবার কাছে যদি সবচেয়ে বেহায়া ছেলে হতে হয়, তাও হবে মাহমুদ। তরীর জন্য সব করা যায়। তরী হ্যালো বলেই থেমে গেল। মাহমুদ ঘন ঘন শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করলো। দেহে বয়ে গেল শীতল শ্রোত। অন্যসব প্রেমিকের মতো সে তার উৎকণ্ঠা ঠিকঠাক প্রকাশ করতে জানেনা। মাহমুদ বেশ খানেক সময় নিয়ে অভিযোগ করলো,
-“কোথায় ছিলে, তরী। সকাল থেকে একবারও কি আমায় মনে পড়েনি?”

ওপাশ থেকে তরীর ক্লান্ত স্বর ভেসে এল।
-“পড়েছে। কাজ করছিলাম বলে সময় পাইনি।”

-“তুমি কেমন আমার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছো, তরী! আমার ভ*য় তোমাকে নিয়ে। তুমি কখনো আমায় ছেড়ে যেও না। আমি আমার চোখে আমাদের মতো দু-জোড়া মাহমুদ তরীর বিচ্ছেদ দেখেছি, তরী। তারাও একে এপরকে ধরে রাখার জন্য আমাদের মতো লুকিয়ে বিয়ে করিয়ে নিয়েছিল। মেয়ে দুটোর সাথে একই ঘটনা ঘটেছে। বাবা মা ভ*য় দেখিয়ে ডি*ভো*র্স করিয়ে নিয়েছে। তুমি কখনো এমন করো না তরী! আমি এটা মানতে পারবোনা।”

মাহমুদের কাতর গলায় অনুরোধ ঝরে পড়লো।
অস্থিরতায় ক্রমশ পায়চারি করছে সে। যার ধপ ধপ শব্দ স্পষ্ট। ওপাশ থেকে তরী শান্ত স্বরে বলল,
-“আপনি শান্ত হয়ে বসুন। ভ*য় আমারও আছে। আমিও পারবোনা আপনাকে ছেড়ে থাকতে। বাবার অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। আমি ভ*য় পাচ্ছি এই মুহূর্তে বাবাকে জানাতে। আল্লাহ ভরসা, আমি জানি আল্লাহ ভালো কিছুই করবেন।”

-“যেই ভালোতে বিচ্ছেদ লেখা, সেই ভালো আমি চাইনা তরী।”

তরী নিশ্চুপ। তার দিক থেকে কোনরূপ শব্দ এলোনা। ভেসে এলো কেবল শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ। মাহমুদ ছটফটিয়ে উঠে বলল,
-“কথা বলছো না কেন, তরী?”

বেশ কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর তরীর জবাব এলো,
-“আমিও আপনাকে চাই, মাহমুদ। তবে বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে নয়।”

অরুর কথা শোনা যাচ্ছে।
-“হয়েছে?”

মাহমুদ জিজ্ঞেস করলো,
-“অরু কী বলছে?”

-“হোম ওয়ার্ক করছে। সেটাই দেখাচ্ছে আমায়।”
তরীর জবাব শুনে মাহমুদ বলল,
-“ওর কাছে ফোন দাও তো।”

অরু ছোটো ছোটো বুলি আওড়ালো,
-“কে বলছেন?”

মাহমুদ হাসলো। বলল,
-“আমি ওই বুড়ো লোক বলছি। শীঘ্রই তোমায় নিতে আসবো আমি।”

অরু তেতে উঠলো,
-“অ*স*ভ্য বুড়োলোক। আমি কি তোমায় বিয়ে করবো? কক্ষনো না। আমাদের বাসায় একবার এসে দেখো। ঠ্যাং ভেঙে দেবো।”

মাহমুদ হো হো করে হেসে ফেললো। বহুদিন পর আগের অরুকে ফিরে পেল। মেয়েটা আগের তুলনায় বেশ চুপচাপ হয়ে গিয়েছে। আজ আবার আগের রূপে ফিরে তাকে কেমন হু*ম*কি দিলো! মাহমুদ গম্ভীর স্বরে বলল,
-“আমি আজই আসবো। তোমায় কে বাঁচাবে আমি দেখবো।”

-“জ্বালিয়ে দেবো তোমায়। সেই ছাঁই দিয়ে দাঁত মাজবো আমি।”

তরীর খিলখিল হাসির শব্দ ভেসে আসছে। দুজনের কথপোকথন সে বেশ উপভোগ করছে, তা বোঝা যাচ্ছে। মাহমুদ তৃপ্ত হলো। বহুদিন পর তরীও এমন প্রাণ খুলে হাসলো। মাহমুদ অরুকে জবাব দিল,
-“আমি খুব ভ*য় পেয়েছি, ম্যাডাম। আমার ভুল হয়ছে। প্লিজ আমায় জ্বালিয়ে মা*র*বে*ন না!”

অরু ভাব দেখিয়ে বলল,
-“মনে থাকে যেন।”

অতঃপর তরীর হাতে ফোন দিয়ে দিল। তরী হাসছে নিঃসংকোচে। মাহমুদ ও হাসছে।

★★★

স্কুল থেকে ফিরছে রামি আর মিঠু। এখন প্রকৃতিতে শীতের আমেজ বিদ্যমান। তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে যাচ্ছে স্কুল। দুটো মেয়ে মুখে একগাদা মেকাপ করে কোথাও যাচ্ছে। যা অতিরিক্ত মনে হচ্ছে। রামি মিঠুকে খোঁচা দিয়ে বলল,
-“দেখ দেখ। আমাদের আপুরা চাঁদের মতো উজ্জ্বল হতে গিয়ে সূর্যের মতো উত্তাপ ঢালছে, দ্বিতীবার তাকানোর ইচ্ছে হবেনা।”

মিঠু তাকালো একবার। রামির কথায় প্রথমে চুপ রইলো, অতঃপর হেসে লুটোপুটি খেলো। সাথে রামিও যোগ দিল। হাসির শব্দ এতটা বেশি ছিল যে, অনেকেই তাকালো তাদের দিকে। মেয়ে দুটো কেমন বাঁকা চোখে তাকালো। নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে, তাদের উদ্দেশ্য করেই হাসছে। একটি মেয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসছো কেন?”

রামি বলল,
-“মেটাকাটাপ বিটেশি হিটয়ে গিটিয়েটে।”

রামির কথা না বুঝে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো মেয়ে দুটো। মিঠু, রামি হাসতে হাসতে একজন অপরজনের গায়ে ঢলে পড়ছে। “মেকাপ বেশি হয়ে গিয়েছে“ কথাটা নির্ঘাত বুঝেনি মেয়ে দুটো। নয়লে জুতো পড়তো তাদের দুই বন্ধুর গালে।

★★★

তরী ছাদে কাপড় শুকাতে গেল। একজন ভাড়াটিয়া আন্টি তাকে দাঁড়াতে বলল। তিনি ওর বাবার ব্যাপারে কথা তুললেন।
-“তোমার বাবার বিয়ে করা উচিত। তুমি কয়েকদিন পর পরের ঘরে চলে যাবে। তখন সবকিছু কে সামলাবে বলো? সবটা তুমি নিজেই চিন্তা করে দেখ।”

তরী কষ্ট পেলেও মুখে প্রকাশ করলোনা। শুধু শক্ত গলায় বলল,
-“আমার বাবা যদি বিয়ে করতে চান, তবে আমি কখনোই বাঁধা দেবো না।”

অতঃপর ধপধপ করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে পড়লো।

#চলবে………