#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#অন্তিম_পর্ব
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
মিঠুর চোখমুখ থমথমে। সন্ধ্যায় বাইরে থেকে এসেই চুপচাপ হয়ে বসে আছে। কারো সাথেই কথা বলছেনা। বাবা খেতে ডাকলেন। মিঠু এলোনা। পরপর কয়েকবার ডাকার পরও যখন সাড়া পেলেন না, তখন বাবা উঠে মিঠুর কাছে বসলেন। আজ আর ধমকা-ধমকি করলেন না। নরম স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
-“কী হয়েছে বাবা? মন খা*রা*প কেন?”
মিঠু জবাব দিলোনা। বাবাকে এড়িয়ে গেল সরাসরি। এতে তিনি খানিকটা কষ্ট পেলেও প্রকাশ করলেন না। ছেলেকে আরেকবার খাওয়ার জন্য ডাকলেন। মিঠু এখনো চোখমুখ লাল করে বসে আছে। অরুকে খাইয়ে একটু আগেই ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছেন। ছেলেমেয়েরা না খেয়ে ঘুমাক, এমনটা বাবার কোন কালেই পছন্দ ছিলোনা। বাবা রাত্রিবেলা তিনতলায় ছুটলেন। জড়তা নিয়ে দরজায় বেল দিতেই খানিক বাদে দরজা খুলে গেল। তরী অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলে,
-“বাবা তুমি? সব ঠিক আছে?”
অতঃপর ভেতরে আসতে বলল। বাবা দরজায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
-“তুই কি ব্যস্ত?”
-“না, কাজ শেষ। বলোনা কী হয়েছে?”
-“মিঠু সন্ধ্যা থেকেই থম ধরে বসে আছে। কোন কথা বলছেনা। এতবার খেতে ডাকলাম, আসলোই না। ও’কে একটু খাইয়ে দিয়ে যা তো!”
তরী বলল,
-“আচ্ছা আসছি।”
ভেতরে ঢুকে মাহমুদকে বলল,
-“আমি একটু উপর থেকে আসছি। আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন।”
মাহমুদ ক্লাস টেস্ট এর খাতা দেখছিলো। তরীর কথায় তার উপর চোখ বুলিয়ে ফের খাতায় মনযোগ দিলো। সে দিকে দৃষ্টি অক্ষুণ্ণ রেখেই বলল,
-“আমি জেগে আছি। তুমি তাড়াতাড়ি এসো।”
তরী আর কথা বাড়ালোনা। মাহমুদের অনুমতি পেয়ে উপরে চলে এলো।
মিঠুর ঘরে গিয়ে দেখলো সে উদাস হয়ে বসে আছে। তরী ভাইয়ের ঘাড়ে হাত রাখলো। ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটলো মিঠুর। সে এতক্ষণ যাবত কঠিন ঘোরে ছিলো। ঘাড়ের হাত অনুসরণ করে পেছন ঘুরতেই তরীকে দেখে চোখমুখ আরও শক্ত করে নিলো। মিঠুর চুলের ফাঁকে চিকন আঙ্গুল চালিয়ে কোমল স্বরে শুধালো তরী,
-“কী হয়েছে মিঠু? খাবি না? চল আপু খাইয়ে দিচ্ছি।”
মিঠু বিরক্তি ঝেড়ে বলল,
-“তুমি তোমার সংসারে মন দাও। আমার আর অরুর কথা তোমাদের কারো ভাবতে হবেনা।”
বিরক্ত প্রকাশের ভঙ্গিটা তরীর কাছে কিঞ্চিৎ রাগের আঁচ মনে হলো। আরেকটু নরম হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“রেগে আছিস কেন?”
মিঠুর রাগটা ঠিক কোন জায়গায়, বুঝে উঠতে পারলোনা তরী! মিঠু নিজেও ঠিকঠাক রাগটা প্রকাশ করছেনা।
এবার খানিকটা নয় সম্পূর্ণ রাগ ঝাড়তে প্রস্তুত হলো মিঠু। বাইরে বের হলেই শুনতে পায়, তার বাবা বিয়ে করবে। চাচা, মামা একজোট হয়ে বাবার জন্য মেয়ে দেখছে। ভীষণ কষ্ট হয় তার। মায়ের সংসারে অন্যের আধিপত্য বিস্তার সে কখনোই বরদাস্ত করবেনা।
বিনা যুদ্ধে মায়ের এই কঠিন পরাজয় মিঠু মেনে নিতে পারছেনা। হুট করেই কাল জ্বর এসে মাকে নিয়ে উড়াল দিলো। মিঠুর সবচেয়ে বেশি রাগ তরীর উপর। সে উঠেপড়ে লেগেছে বাবাকে বিয়ে দিতে। তাদের দেখাশোনা করতে না পারলে করবেনা, কিন্তু বাবাকে কেন বিয়ে দিতে চাইছে? আর বাবাই বা কিভাবে বিয়ে করতে চাইছেন?
মিঠু ভেতরের আক্রোশ প্রকাশ করে ফেললো। গর্জন করে উঠলো তার কৈশোর কন্ঠ। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-“রাগ করার প্রশ্নই আসেনা। খুব সুখেই আছি। আমার নতুন মা আসবে। সংসার সামলাবে।
একটা কথা শুনে রাখো, ওই নতুন মহিলাকে আমি কখনোই মা বলে স্বীকার করবোনা। আমার মা একজনই ছিলো, আর তিনি মা*রা গিয়েছেন।”
তরী এতক্ষণে মিঠুর ক্ষোভ প্রকাশের যথাযথ কারণ খুঁজে পেলো। বলল,
-“শান্ত হয়ে বস, মিঠু। আমি সবটা ভেবেচিন্তেই বলেছি। আমরা শুধু নিজেদের দিকটাই ভাবছি। বাবার দিকটা কেউ ভাবছিনা। তিনি একা হয়ে গিয়েছেন সেটা কেউ বুঝার চেষ্টা করছিনা। বাবা বিয়ে করলে তোর আর অরুর কোন সমস্যা হবেনা। আমি আছি তোদের জন্য।”
মিঠু রাগে থরথর করে কেঁপে উঠলো। উঠতি বয়সের ছেলে অল্পতেই রক্ত গরম হয়ে যায়। প্রথমে কাঁচের গ্লাস টে*নে ছুঁড়ে মা*র*লো ফ্লোরে। ঝনাৎ করে একটা শব্দে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো গ্লাসটি। মিঠু থেমে থাকলোনা। একের পর এক সামনে যা আসবাবপত্র পাচ্ছে, সবকিছু ভাংচুর করছে। তরী বিচলিত হলো। মিঠুকে কিছুতেই রোখাতে পারছেনা। এগোতে গেলেই মিঠু হুংকার ছাড়লো,
-“যদি বাবা বিয়ে করেন, তো আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো। কোন আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের কাছেও যাবোনা। দু-চোখ যেদিকে যায়, আমি চলে যাবো।”
তরী ভয় পেয়েছে ভীষণ। একবার দরজার দিকে তাকিয়ে চাপা স্বরে বলল,
-“দোহাই লাগে ভাই আমার। এমন পা*গ*লা*মো করিসনা। এসব বললে বাবা কষ্ট পাবেন।”
মিঠু তাচ্ছিল্য হেসে বলল,
-“আর আমরা?”
তরী বলল,
-“তুই বস। ঠান্ডামাথায় আমার কথা শোন।”
মিঠু কপাল কুঁচকে নিলো। শান্ত হয়ে ঝড়ের পূর্বাভাস দিলো। জায়গা মতো তীর নিক্ষেপ করতে ভুললোনা। বলল,
-“বাবার থেকে তোমার শাশুড়ীর বয়স কম। তাহলে উনাকে কেন বিয়ে দিচ্ছো না?”
তরী যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। মিঠুর এমন কথা বলবে সে ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি। মিঠু ফের প্রশ্ন করলো,
-“কী হলো? তোমার শাশুড়ীকে কেন বিয়ে দিচ্ছো না?”
তরী তপ্ত শ্বাস ছাড়লো। ঠান্ডা গলায় বলল,
-“আমার শশুর মা*রা যাওয়ার পর উনাকেও পরিবার বিয়ে দিতে চেয়েছেন। কিন্তু তিনি বিবাহযোগ্য তিন সন্তান আর রামিকে বুকে নিয়ে পড়ে রইলেন। নিজ থেকেই বিয়ে করতে চাননি।”
মিঠু বলল,
-“উনি যেহেতু একজন নারী হয়ে থাকতে পেরেছেন, বাবা কেন আমাদের নিয়ে থাকতে পারবেনা?”
তরী বলল,
-“দেখ, বাবা কিন্তু বিয়ে করতে..
তার কথা সম্পন্ন হওয়ার পূর্বেই মিঠু থামিয়ে দিলো। বাবার পক্ষ হয়ে তরীর মতামত অসম্পূর্ণ রয়ে গেল। মিঠু জানতেও পারলোনা বাবা নিজেই বিয়ে করতে চাননা। তারাই জোর করছেন। তরীকে থামিয়ে মিঠু বলল,
-“তুমি এখন যাও।”
তরী বলল,
-“খেতে আয়, তারপর যাচ্ছি।”
নিজের ত্যাড়ামোতে অটল রইলো মিঠু। বলল,
-“তুমি না গেলে, আমিই বেরিয়ে যাচ্ছি।”
দরজার দিকে পা বাড়াতে নিলেই তরী হন্তদন্ত হয়ে বলল,
-“যাচ্ছি আমি।”
বাবা ঘরে বসে সবটাই শুনলেন। লজ্জায় মাথা হেট হয়ে আছে। সন্তানের সামনে মুখ দেখাবেন কী করে?
তরীর নিজেরও বড্ড খা*রা*প লাগছে।
★★★
দুদিন পরই মামা ফোন দিলেন। কুশল বিনিময় শেষে এমন এক কথা জানালেন মামা, তরীর ভেতরটা ছ্যাৎ করে উঠলো। মামা আর চাচা মিলে বাবার বিয়ের জন্য পাত্রী দেখেছেন। বাবাকে ম্যানেজ করা গেলে আজই বিয়ে পড়িয়ে নিয়ে আসবেন।
তরী মায়ের ঘর গোছাতে গিয়ে কেঁদে ফেললো। যেই সংসারে তার মায়ের ছোঁয়া লেগে আছে, সেই সংসারে আজ অন্যকারো দখলে যাবে। মিঠুর কষ্টটা আজ তাকে একটু হলেও ছুঁতে পেরেছে। আবেগ ধরে রাখতে না পেরে বাবাকে বিয়ে করানোর জন্য মামা, চাচাকে নামিয়ে তো দিল ঠিকই। কিন্তু আজ আর সহ্য করতে পারছেনা। মায়ের আলমারি গোছাতে গিয়ে একটা একটা শাড়ি বুকে জড়িয়ে কাঁদছে। আয়েশা সুলতানা তরীর ঘাড়ে হাত রাখলেন। উনাকে দেখে তরী হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো। যত্ন করে তরীকে বুকে টে*নে নিলেন তিনি। বললেন,
-“মা কী জিনিস, সেটা সন্তান মা থাকাকালীন বুঝে উঠতে পারেনা। অনুপস্থিতিতে ঠিকই মায়ের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। আমি যদি নিজের চার সন্তান রেখে অন্যকারো হাত ধরতাম, তবে আমার এই সুন্দর সংসার আর সংসার থাকতোনা। ছন্নছাড়া হয়ে যেতো আমার সন্তানরা। তারা উপর থেকে খুবই ছটফটে আর শক্ত ধারার মানুষ হলেও আমি গভীর থেকে তাদের জানি। খুবই নাজুক তাদের মন। আমি বলবো নিজেকে শক্ত করো। আমি আছি তোমার মা। হয়তো রুবিনা ভাবির অভাব পুরোপুরি ঘুচিয়ে দিতে পারবোনা, তবে আমার চেষ্টায় কোন কমতি থাকবেনা।”
তরী আয়েশা সুলতানার বুকে পড়ে অশ্রু বিসর্জন দিলো। তিনিও পরম মমতায় আগলে নিলেন তরীকে।
★★★
ভাইয়ের জরুরী তলব পড়েছে। জায়গার ঠিকানাও ঠিকঠাক দিয়ে দিলেন। তরীর বাবা দ্রুত সেই ঠিকানায় চলে গেলেন। সেখানে ভাইয়ের সাথে শা*লা*কে উপস্থিত দেখে যা বুঝার বুঝে গেলেন। রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। তিয়াসের বাবা বললেন,
-“বিয়েটা করে নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তুই এখন ছেলেমেয়ের কাছে লজ্জা পাচ্ছিস। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে দেখে নিস। মিঠু অবুঝ ছেলে, সে এসব এখন বুঝবেনা। বড়ো হলে নিজ থেকেই বুঝে যাবে।”
তরীর মামা বললেন,
-“আমরা যাকে দেখে ঠিক করেছি, উনি নিঃসন্তান। বারো বছর সংসার করার পরও যখন সন্তানের মালিক হতে পারেননি, তখন স্বামী ডি*ভো*র্স দিয়ে দেন। এতো বছরে আর বিয়ে করেননি। ভাইয়ের ছেলেমেয়েদের নিজের হাতে বড়ো করেছেন। আশা করি এই নারী সন্তানের মর্ম বুঝবে। অরু, মিঠুকে আগলে রাখতে জানবে। তাছাড়া পরবর্তীতে আর সন্তান হওয়ারও সম্ভাবনা নেই। তোমার ভালো লাগলে আজই বিয়ে পড়িয়ে নিয়ে যাবো।”
তরীর বাবা শান্ত অথচ কঠোর কন্ঠে বললেন,
-“আমার সাথে আর যোগাযোগের চেষ্টা করবেনা তোমরা। যদি আমি স্ত্রী সুখের অভাববোধ করতাম, তবে তোমাদের বলার প্রয়োজন ছিলোনা। এতোদিনে নিজেই বিয়ে করে ঘরে নতুন নারী তুলতাম। আমি কাউকে পরোয়া করিনা এটা নিশ্চয়ই তোমাদের অজানা নয়!”
আর ওখানে দাঁড়ালেন না।
বাসায় এসে তরীকে ডেকে পাঠালেন। তরী আসতেই বাবা সরাসরি বললেন,
-“তোর মা লাগবে, তাইনা? কিন্তু আমার স্ত্রী লাগবেনা। আমার ছেলেমেয়ে দুটোকে মানুষ করার জন্য আমি একাই যথেষ্ট। আজ থেকে এই সংসারে তোকে কোন দায়িত্ব পালন করতে হবেনা। আমি ঘরে বাইরে দু-জায়গা সামলে নেবো। রান্নার লোক এসে রান্না করে দিয়ে যাবে। বাকিটা আমি ঠিকই সামলে নিতে পারবো।”
তরী মাথানিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে পানি টলমল করছে। বাবা যে বিয়ে করেনি, এটা দেখেই কোথাও একটা সূক্ষ্ম ভালোলাগা কাজ করছে। মিইয়ে যাওয়া স্বরে বলল,
-“সরি বাবা! আমাকে ক্ষমা করে দাও।”
বাবা কঠোরতা ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। নরম স্বরে বললেন,
-“তোদের মানুষ করার পেছনে তোদের মায়ের হাত রয়েছে। আমি সারাদিন বাইরে পড়ে থাকতাম। সে যদি একা হাতে তোদের মানুষ করতে পারে, আমি কি বাকি দুজনের জন্য যথেষ্ট নই! বাবা হয়ে তোদের কাছে অনুরোধ করছি আর সবার কাছে আমাকে লজ্জিত করবিনা!”
তরী নাক টেনে বাবাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো। বলল,
-“ভুল হয়ে গিয়েছে বাবা। ক্ষমা করে দাওনা!”
বাবা আলতো হাত রাখলেন তরীর মাথায়।
-“আমি তোদের উপর বেশিক্ষণ রাগ ধরে রাখতে পারিনা। আল্লাহ আমাকে সেই ক্ষমতা দেননি।”
এতদিনে সবাই বুঝে গিয়েছে তরীর বাবা বিয়ে করবেন না। তাই সকলেই থেমে গেল। তরী আগের মতো পুরোদমে দুই সংসার সামলে নিচ্ছে। একজন আদর্শ শাশুড়ী হিসেবে সঙ্গ পাচ্ছে আয়েশা সুলতানার। ভুল হলে ঠিক মায়ের মতোই তিনি বকাঝকা করে ঠিক করে নিচ্ছেন।
মিঠু আর রামির সাপে-নেউলে সম্পর্ক ঠিক আগের মতোই আছে। ছোট্ট অরু বয়সের সাথে সাথে আরেকটু পাঁকা হয়ে উঠছে। তার দুষ্টুমি, পাঁকা কথায় আনন্দ দিচ্ছে সবাইকে। দুই পরিবার দিনের বেশিরভাগ সময়ই অরুকে নিয়ে মেতে থাকে।
সকালে ঘুম থেকে উঠেই ড্রেসিং টেবিলের উপর একটা হরিদ্রাভ শাড়ি দেখতে পেল তরী। সাথে এক মুঠো চুড়ি, একজোড়া দুল।
তরী প্রতিটি জিনিস নেড়েচেড়ে দেখছে। পেছন থেকেই ঘুম জড়ানো চোখে মাহমুদ তাকে আঁকড়ে ধরলো। তরীর ঘাড়ে মাথা রেখে অনুরাগী স্বর বলল,
-“নাস্তা করে তৈরি হয়ে নাও।”
তরী হালকা ঘাড় বাঁকা করে মাহমুদকে দেখার চেষ্টা করলো। বলল,
-“এগুলো কখন এনেছেন?”
-“রাতে, তুমি দেখোনি।”
অতঃপর তরীকে ছেড়ে ফ্রেশ হতে চলে গেল মাহমুদ। নাস্তা করে দুজনই বের হলো। আয়েশা সুলতানা আজ দুজনকে সারাদিনের ছুটি দিলেন। পাঞ্জাবি পরিহিত মাহমুদের শক্ত হাতের ভাঁজে এক মোহময়ী কাঠগোলাপ। এই কাঠগোলাপের একমাত্র মালিক মাহমুদ নিজেই। মৃদুমন্দ বাতাসে তার নাজুক কাঠগোলাপের এলোচুল আরেকটু এলোমেলো হলো। আলগোছে মাহমুদ তা কানের পাশে গুঁজে দিলো। তরী বিভোর হয়ে তাকিয়ে রইলো সে ধারালো চোখে। এই দৃষ্টি এখনো তাকে পোড়ায়, ভয়ঙ্কর প্রেমের সন্ধান দেয়। প্রকৃতিতে ঋতুরাজ বসন্তের আগমন। শীতের রুক্ষতা বিদায় নিয়ে যৌবনে পাদচারণ করলো প্রকৃতি। খোলা চত্বরে কপোত-কপোতীর ভীড়। বাসন্তী সাজে নব নব প্রেমিক-প্রেমিকা যুগল মন বিনিময়ে ব্যস্ত। তাদের মাঝেই এক নব দম্পতি মাহমুদ-তরী। মাহমুদের হাতে একগুচ্ছ দোলনচাঁপা। তাদের নামহীন অনিমন্ত্রিত প্রেমের জয় ঘটাতে আজ চিরাচরিত বেপরোয়া প্রেমিকের মতো হাঁটু গেড়ে বসলো।
-“আমাদের প্রেম হোক বসন্তের মতো। কোথাও মলিনতার ছাপ না থাকুক। মনের ঘরে চিঠি জমুক শতশত। সকল জরাজীর্ণতার অবসান ঘটিয়ে হলুদিয়া রঙে সেজে উঠুক জীবন।
আমার প্রেমনদীতে একমাত্র খেয়াতরী হিসেবে আজীবন তোমায় পেতে চাই, তরী। শুধু আমার হাতটা শক্ত করে ধরে রেখো। আমি তোমার প্রেমের নদীতে দিব্যি ভেসে বেড়াবো।”
ভীষণ অবাক হলো তরী। সাথে ভালোলাগার অভ্যুদয় ঘটলো মনে। মুখে হাত গুঁজে প্রফুল্ল চিত্তে হাসলো। নতুন করে প্রেমের সূচনা ঘটলো। হাত বাড়িয়ে ফুলের গুচ্ছ তুলে নিলো। একহাত বাড়িয়ে মাহমুদের হাতে রাখতেই সে উঠে দাঁড়ালো।
আজ প্রকাশ্যেই সেই একপেশে তিলে উষ্ণ ঠোঁটের ছোয়া দিলো মাহমুদ। শিউরে উঠলো তরী। শরীরে নতুন ভালোলাগার জন্ম হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। তবে আজ আর লোকচক্ষুর ভয় নেই। দু-হাতেে মাহমুদের বাহু আঁকড়ে ধরে এগিয়ে গেল। তাদের প্রেমের মতোই ঋতুরাজ বসন্তে অনিমন্ত্রিতভাবে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো। দৌঁড়ে গাছের ছায়াতলে আশ্রয় নিলো দুজন। হাঁপিয়ে উঠে একে অপরের দিকে তাকিয়ে তীব্র হাসির ঝংকার তুললো ঠিক কিশোর-কিশোরীর প্রেমে পড়ার মতো। বৃষ্টির বেগ বাড়ছে, সাথে তরীর শাড়ি ভিজে আসছে। জড়োসড়ো হয়ে মাহমুদের সাথে লেগে দাঁড়ালো মেয়েটা। মাহমুদ আশেপাশে তাকিয়ে কোনকিছুর হদিস পেলোনা। অতঃপর তরীকে দাঁড় করিয়ে বৃষ্টিমাথায় ছুটে কোথাও গেল। পাঁচমিনিটের মাথায় নতুন প্যাকেটজাত ছাতা নিয়ে আগের মতোই ছুটে এলো। গাছের ফাঁকফোকর বেয়ে তখন বৃষ্টি ফোঁটা বড়ো বড়ো মুক্তো দানায় পরিণত হলো। বেশ খানিকটা শাড়ি ভিজলো তরীর। ছাতা মেলে একহাতে ধরলো মাহমুদ, অপর হাতে তার প্রেমের নরম হাত। তরীকে পুরোপুরি আড়াল করতে গিয়ে তার একপাশ ভিজে জবুথবু। সেদিকে তার ধ্যান নেই। ধ্যান কেবল তার উচ্ছল নদীর চোখেমুখে, মিষ্টি হাসি জড়ানো সেই পাতলা ঠোঁটে।
বাসায় ফিরে তরী আরো একটা চমক পেলো। তারা সিঙ্গাপুর ঘুরতে যাচ্ছে। মাহমুদের বোন সেখানেই হাজবেন্ড এর সাথে স্যাটেল। তাদের কাছেই যাচ্ছে দুজন। তরী মনেপ্রাণে চাইলো তাদের আরো একবার প্রেম হোক। অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী কভু শুকিয়ে না যাক। তার ইচ্ছের জয় হতেই মাহমুদের আগমন। হাতে দু-মগ কফি। তরীর আজ চমকে যাওয়ার পালা। ঝুল বারান্দায় পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কফিতে দুজন দুজনকে খুঁজে নিলো।
#সমাপ্ত।
অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী সিজন-০২ পড়তে লেখটি উপর ক্লিক করুন।