অনিমন্ত্রিত প্রেমনদী ২ পর্ব-১৮+১৯

0
249

#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#দ্বিতীয়_অধ্যায়
#পর্ব_১৮
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

অরু আজ দুদিন বাড়ি থেকে আসা-যাওয়া করেই ক্লাস কমপ্লিট করছে। প্রথমদিকে আয়েশা সুলতানা সহ সবার মতামত ছিলো রামি আর অরুকে আপাতত দূরে রাখা। যদিও এতে শতভাগ সাদাদের কানপড়া ছিলো। রামিকে ক্ষে*পা*নো*র জন্যই সে এমন একটা শর্ত দিয়েছে। যেন অরু থেকে দূরে থাকে। রামির হাবভাবে মনে হচ্ছে না সে বেশিদিন শর্ত মানতে পারবে। মাহমুদের মতামতও রামির পক্ষে। বিয়ে তো হয়েছেই। তাহলে অযথা দুজনের মাঝে ভি*লে*ন হওয়ার মানে কী? তাছাড়া, রামির মতো প্রেমিক পুরুষ সেও ছিলো। দায়িত্ব নিয়ে মাকে বুঝালো।
আয়েশা সুলতানা বলে দিলেন অরুকে হল ছেড়ে দিতে। বাড়ি থেকেই পড়াশোনা করবে। বাড়িতে থাকলে পড়াশোনা হবে না বলে গাঁইগুঁই করলো অরু। আয়েশা সুলতানা বললেন,
“পড়াশোনা না হয়ে যাবে কই? মানুষ পে*টা*তে পারবো না, প্রয়োজনে পড়াশোনাকে লা*ঠি দিয়ে পি*টি*য়ে সোজা করবো। পড়ার সময় কেউ বিরক্ত করবে না তোমায়।”

অরু আর কথা বাড়ালো না। সবাইকে ছেড়ে একা থাকতে তারও ইচ্ছে করে না। নিজের ভ*ন্ডা*মি*কে কন্ট্রোলে রাখতেই হলে ওঠা। এবার মনে হচ্ছে আয়েশা সুলতানার কবলে পড়ে ভ*ন্ডা*মি পইপই করে পালাবে আর পড়াশোনা মাথায় জায়গা করে বসবে। সাদা এপ্রন হাতে নিয়ে চশমা ঠিক করতে করতে বের হলো অরু। রামি বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চুপচাপ বাইকের পেছনে বসে পড়লো অরু। রামি খেয়াল করলো অরু আজ বেশ চুপচাপ। চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“মন খা*রা*প অরু? তুই কি হলে থাকতে চাচ্ছিস? তাহলে আমি মায়ের সাথে কথা বলে ম্যানেজ করে নেব।”

অরু নিভু নিভু গলায় বলল,
“না, মন খা*রা*প না।”

“তাহলে?”

“এমনিই, ভালোলাগছে না।”

রামি আরেকটু বিচলিত হলো। তীব্র উৎকণ্ঠা নিয়ে শুধালো,
“শরীর খা*রা*প লাগছে?”

“হুম।”
অরু ছোটো করে জবাব দিলো। রামি একপাশ করে বাইক থামিয়ে দিল। যত্নশীল হয়ে বলল,
“শরীর খা*রা*প হলে যাওয়ার কী প্রয়োজন?”

অরু বলল,
“ইমপোর্টেন্ট ক্লাস। মিস দেওয়া যাবে না। তুমি বাইক স্টার্ট দাও।”

রামি অরুকে নিয়ে বাইক স্টার্ট দিলো। আস্তে করে বলল,
“পিঠে মাথা ঠেকিয়ে রাখ।”

অরু বিনা বাক্যব্যয়ে রামির পিঠে মাথা ঠেকিয়ে পুরো রাস্তা এলো। তাকে নামিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো রামি। তার মুখশ্রীতে দুশ্চিন্তার বলিরেখা। অনবরত পায়চারি করেই তার সময় কাটলো। অরু ক্লাস সেরেই বেরিয়ে এলো।
রামিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক গলায় শুধালো,
“তুমি আবার কখন এলে?”

রামি তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে দ্রুত দু-পা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো,
“এখন শরীর ঠিক আছে?”

“না, অস্বস্তি লাগছে।”

রামি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে অরুর হাত চেপে ধরলো। তাকে টে*নে নিয়ে যেতে দেখে অরু জিজ্ঞেস করলো,
“কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?”

“চল আমার সাথে।”
রামি কথা খাটো করে অরুকে নিয়ে হসপিটালে ঢুকলো। জোরপূর্বক ডাক্তার দেখিয়ে তবেই ক্ষান্ত হলো। তেমন গুরুতর কোন সমস্যা না। পর্যাপ্ত ঘুম আর খাবারের কমতি থাকায় শরীর অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে। অরুকে নিয়ে বেরিয়ে আসতে আসতে রামি জিজ্ঞেস করলো,
“সকালে খেয়ে বেরিয়েছিস?”

অরু সোজাসাপটা জবাব দিলো।
“সকাল সকাল খেতে ইচ্ছে করেনি।”

রামি আর কথা বাড়ালো না। না অরুকে ধ*ম*ক দিলো। তাকে নিয়ে রেস্তোরাঁয় ঢুকলো। একটুখানি খেয়েই অরু মুখে হাত দিয়ে বসলো। রামি চোখে চোখ রাখতেই বলল,
“বমি আসছে আমার।”

সকাল থেকেই না খাওয়ার ফল। অরুর চেহারা দেখে আর কিছু বললো না রামি। অরু ওয়াশরুমে ঢুকলে রামি বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো। বিল মিটিয়ে রামি জিজ্ঞেস করলো,
“বাইকে বসতে পারবি? না-কি সিএনজি ডাকবো?”

“বসতে পারবো।”

অরু ঠিক আগের মতোই বসলো রামির পিঠে মাথা ঠেকিয়ে। রামি হাত দুটো টে*নে তার বুকের কাছটায় রাখলো। অরু হাত সরালোনা। ওভাবেই রামিকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলো। ওঁকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে তরীর কাছে গেল রামি। অরুর অসুস্থতার কথা জানাতেই তরী তাদের বাসায় যেতে নিলো। আয়েশা সুলতানা শুনতে পেয়ে রামিকে বললেন,
“তরীর সাথে গিয়ে অরুকে এ বাসায় নিয়ে আয়। অসুস্থ শরীর নিয়ে মেয়েটা একা-একা কী করবে?”

রামি মায়ের বাধ্য ছেলের মতো তরীর সাথে অরুকে নিয়ে আসলো এ বাসায়। তরীর বাবা প্রথমে না করলেও পরক্ষণে মেয়ের কথা ভেবে আসতে দিলেন। সবটা ঠিকঠাকই হলো। ঝামেলা বাঁধালো রামি নিজেই। অরুকে তার ঘরে নিয়ে যেতে নিলেই অরু বলে উঠলো,
“আমি তোমার ঘরে যাবো না।”

কপাল কুঁচকে গেল রামির। বলল,
“কোথায় থাকবি?”

“এ বাসায় কি আর ঘর নেই?”

“তুই কি এই বাসার মেহমান?”

মাঝখানে ইরা এসে বাঁধা দিলো।
“অরুকে কোথায় নিচ্ছিস?”

রামি ইরার বাঁধা বুঝতে পেরেই ইরাকে জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি কোথায় থাকছো?”

“আমাদের ঘরে।”

“অরুকেও নিয়ে যাচ্ছি আমাদের ঘরে।”

ইরা আবারও বাঁধা দিয়ে বলল,
“তোর ভাইয়ার শর্ত ভুলে গেলি?”

রামি তেতে উঠলো।
“বউ আমার, বিয়ে করেছি আমি। সে কোথায় থাকবে এটার সিদ্ধান্ত নেবে তোমার স্বামী? আজ থেকে তুমিও তাহলে ঈশুর সাথে ঘুমাও। দেখবে তোমার ওই বুড়ো স্বামী হার্ট অ্যাটাক করে বসে আছে। আমার হার্ট তো আরও দুর্বল। যদি ম*রে*ট*রে যাই? তোমার দু-নম্বরের স্বামী আবার আমার বউ নিয়ে টা*না*টা*নি করবে। এসব আমার সহ্য হবে না বলে দিলাম।”

ইরা টি*ট*কা*রি করে বলল,
“মনে হচ্ছে মানুষ একাই বিয়ে করেছে।”

“হ্যাঁ, আমি একাই বিয়ে করেছি। দুনিয়ার আর কেউ বিয়ে করেনি। এবার শান্তি?”

বলেই অরুকে নিয়ে হাঁটা ধরলো রামি। সবার আগে বিছানা দখল করে চোখ বুজে রইলো অরু। সাদাদ বাসায় ফিরে ইরার কাছে সবটা শুনে ছুটে এলো রামির ঘরের দিকে। বড়ো ভাইয়াকে আসতে দেখে দ্রুত দরজা আটকে দিল রামি। সাদাদ বাইরে থেকে দরজায় করাঘাত করে গর্জে উঠে বলল,
“রামি দরজা খোল্। তোকে এতবড়ো সাহস কে দিয়েছে? কার অনুমতি নিয়ে অরুকে তোর ঘরে ঢুকিয়েছিস?”

রামি দরজা না খুলেই ভেরত থেকে জবাব দিলো,
“কারো অনুমতি কেন নেব আমি? আমার সাহসের দেখেছোটা কী?”

“ভুলে যাস না রামি, অরু আমার…”

রামি থামিয়ে দিল সাদাদকে।
“থামো ভাই, এখানেই থেমে যাও।”
অতঃপর অরুকে বলল,
“এই অরু, তুই আমাদের ঘরের বুড়ো গরুটাকে কখনো পাত্তা দিয়েছিস? জিজ্ঞেস কর তো এত লাফাচ্ছে কীসের জোরে?”

অরু দাঁতে দাঁত চেপে এতক্ষণ সবটা হজম করলো। ক্লান্ত শরীর, মেজাজ খিটখিটে হয়ে আছে তার। চোখ দিয়ে রামিকে ভস্ম করে দিচ্ছে। একটা বালিশ ছুঁড়ে মে*রে বলল,
“আমি আমার বাসায় থাকতাম। অন্তত শান্তিতে একটু বিশ্রাম নেওয়া যেত।”

রামি আমতা আমতা করে বলল,
“আচ্ছা ঠিক আছে, তুই ঘুমা। আমিই বাইরে যাচ্ছি।”

দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে সাদাদের হাত ধরে বসার ঘরে টে*নে নিয়ে আসলো রামি।
“কী সমস্যা তোমার?”

“তুই আমার শর্ত অমান্য করে অরুকে নিয়ে ঘরে ঢুকেছিস কোন সাহসে?”

রামি মুহূর্তেই পল্টি নিলো। বলল,
“কীসের শর্ত? কোন শর্তটর্ত আমি মানি না।”

“অরু আমার….”

রামি ইরার দিকে তাকিয়ে বলল,
“এই, তোমার বুড়োকে সামলাও বলে দিলাম। নয়তো একেবারে বুড়িগঙ্গা নিয়ে ভালোভাবে চুবিয়ে দেব। এক পা কবরে নিয়েও আমার বউয়ের দিকে নজর দেয়।”

ইরা কটমট চোখে তাকালো সাদাদের দিকে। বাজখাঁই গলায় বলল,
“আজ তোমার ঘরে জায়গা নেই। অরু নিয়েই থাকো।”

ইরা ধুপধাপ পা ফেলে চলে গেল। সাদাদ ইরার পেছনে ছুটতে ছুটতেই রামির দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে ভুললো না। রামি ভাবলেশহীন বসে রইলো। তার অভিব্যক্তি বলছে “পারলে কিছু করে দেখাও। অরু আমার ঘরেই থাকবে”।

রাতে ঘুমাতে গিয়ে অরু আর রামির মাঝে বাঁধলো আরেকদফা ঝগড়া। দুজনেই বিছানার ডানদিকে ঘুমাবে। অরু নিজের জায়গা ছাড়তে নারাজ। বলল,
“তুমিই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছো। আমি জায়গা ছাড়বো না। তুমি বাঁ পাশে যাও।”

ত*র্কা*ত*র্কি শেষে পরাজিত হয়ে বাম পাশেই শুতে হলো রামিকে। চোখ বুজে এপাশওপাশ করলো কিছুক্ষণ। পরক্ষণেই ধীরে ধীরে অরুর দিকে চেপে এলো। অরু ঝট করে চোখ খুলে তাকালো। কিছু বলতে নিতেই রামি অতি দ্রুত দুহাতে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে বলল,
“কথা বলিস না অরু। আমার ঘুম পাচ্ছে।”

অরু ছটফট করে বলল,
“আমি অসুস্থ।”

“তো? আমি কি তোকে মা*র*ধ*র করছি?”

অরু আর কথা বাড়ালো না। চোখমুখ খিঁচে চুপ করে রইলো।

★★★

বাড়িওয়ালা চাচা সুহার ফ্ল্যাটে এলেন। বাড়ি ভাড়া তো ক্লিয়ার। সুহা বুঝতে পারলো না তিনি হঠাৎ কী মনে করে এসেছেন। ভদ্রতা করে ভদ্রলোকের জন্য চা বানাতে যেতে নিলেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন,
“কোথায় যাচ্ছো?”

“জি চাচা, আপনার জন্য চা বানাতে।”

তিনি গম্ভীর স্বরে বললেন,
“চা বানাতে হবে না। তুমি বসো।”

সুহা একটা চেয়ার টে*নে বসলো। বাড়িওয়ালা গম্ভীর হয়ে বললেন,
“তুমি দু-বছর এখানে থাকছো। তোমার স্বামী প্রবাসী। কিন্তু ইদানীং আমার চোখ অন্যকিছু দেখছে। বাইরের মানুষ এসে তোমার জানালা বরাবর দাঁড়িয়ে থাকে।”

সুহা বুঝে গেল উনি কার কথা বলছেন। তড়িঘড়ি করে বলল,
“চাচা আমি উনাকে চিনি না। উনি কেন দাঁড়িয়ে থাকেন, আমি জানিনা। আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না।”

লোকটি নেহাত ভদ্র বলে ঠান্ডা গলায় বললেন,
“সম্পর্ক আছে কী নেই সেটা তুমি জানো। আমি সেদিনও তোমাকে নিচে নেমে ছেলেটার সাথে কথা বলতে দেখেছি। সাথে আরেকটি মেয়েও ছিল। শোনো, এসব রাজনীতি করা ছেলেদের সাথে মিশবে না। এরা ভালো হয়না। উপরে সবাই নিজেকে ভালো দেখায়। তাছাড়া তোমার স্বামী আছে। তোমাকে দিয়ে এমন কিছু আমি আশা করিনি। দ্রুত বাসা ছেড়ে দিও।”

“চাচা আমার কথা..

সুহাকে কথা সম্পন্ন করতে না দিয়ে তিনি হাত উঁচিয়ে থামিয়ে দিলেন।
“আর কোন কথা বলো না।”
বলে অপেক্ষা করলেন না। দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন। সুহার সমস্ত রা*গ গিয়ে পড়লো মিঠুর উপর। তার জন্যই এখন বাসা ছাড়তে হচ্ছে। শুধুই কি বাসা ছাড়তে হচ্ছে? নিজের সম্মানে আঁচ লাগেনি!

#চলবে…….

#অনিমন্ত্রিত_প্রেমনদী
#দ্বিতীয়_অধ্যায়
#পর্ব_১৯
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা

(কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)

আকাশে কালো মেঘ জমেছে। সেই সাথে সুহা’র মনেও নেমেছে নিকষ কালো অন্ধকার। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে একে একে সবকিছু গুছিয়ে নিলো। অবনির সাথে আগেই কথা হয়েছে ফোনে। আপাতত এই বাসা ছেড়ে অবনির কাছে উঠবে। বাসা ম্যানেজ করতে পারলেই মাথা থেকে একটা বোঝা দূর হবে। সকাল সকাল অবনি এসে উপস্থিত। নিচে মালামাল বহনকারী গাড়ি দাঁড় করানো। খুব বেশি আসবাবপত্র নেই। টুকটাক কিছু জিনিস। ওগুলো পাঠিয়ে অবনির সাথে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হলো সুহা।
অবনি ঠিক করলো ইবতেসামকে সুহা’র আর কোন ইনফরমেশন দেবে না। অনেক হয়েছে। মেয়েটার ভালো চাইতে গিয়ে খা*রা*প*টা*ই হলো। অযথা একটা অপ*বাদ নিয়ে বাসা ছাড়তে হলো। অফিসে ঢুকার আগে মিইয়ে যাওয়া স্বরে ডাকলো,
“সুহা।”

সুহা পেছন ফিরে অবনির নতমুখের দিকে তাকালো। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে সুহা বলল,
“কিছু বলবি?”

“সরি!”

সরি বলাটা সুহার বোধগম্য হলো না। তাই ফের প্রশ্নবাণ ছুঁড়লো,
“সরি? সরি কেন?”

দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো অবনি। বলল,
“তোর এতটা ঝা*মে*লা পোহানোর পেছনে আমিও অনেকটা দায়ী।”

সুহা হাসলো। স্বচ্ছ হাসি। সেই হাসিতে নেই কোন দুঃখ কিংবা বি*দ্রু*প। মুহূর্তেই যেন প্রানবন্ত হয়ে উঠলো মেয়েটা। বলল,
“ধূর, নিজেকে কেন দায়ী করছিস? আমি কাউকেই দো*ষ দিচ্ছি না। যা ভাগ্যে লিখা আছে, তা হওয়ারই ছিলো। বরং তুই না থাকলে আমি এই শহরের বুক থেকে সেই কবেই হারিয়ে যেতাম। ছি*ন্ন*ভি*ন্ন হয়ে যেতাম।”

অবনি একহাতে আলতো করে জড়িয়ে ধরে সুহার গালে গাল মিশিয়ে দিল। আদুরে স্বরে বলল,
“আমি সবসময় তোর পাশে থাকতে চাই। এভাবেই থেকে যাবো তোর জীবনে। ঝঞ্ঝা মনে করে দূরে ছুঁ*ড়ে দিলেও আমি তোর পিছু ছাড়বো না।”

সুহা নিজেও হেসে জড়িয়ে ধরলো অবনিকে।

★★★

তিনদিন হচ্ছে, অথচ এ-কটা দিনে একবারও সুহা’র দেখা মিললো না। ওর জানালার কাছেও আলো জ্বলছে না। ফোন সুইচড অফ। চিন্তিত হলো মিঠু। দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করলো সুহা’কে একপলক দেখার।
বাড়িওয়ালা উপর থেকে মিঠুকে নজরদারিতে রেখেছেন। এক ঘন্টা ধরে ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে। এবার সিঁড়ি ধরে নেমে এলেন তিনি। গলা খাঁকারি দিতেই হকচকিয়ে উঠলো মিঠু। তার দৃষ্টি ছিলো সুহা’র বারান্দায়। আকস্মিক মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে খানিক নড়েচড়ে উঠলো। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ভদ্রলোকের দিকে নজর দিলো। তিনি বেশ শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
“এতরাতে এখানে কী করছেন, বাবা? এটা ভাড়া বাড়ি। এভাবে কারো বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা উচিত নয়।”

মিঠু ভদ্রতা ভুলে বসলো। ভদ্রলোকের প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়েই সুহার জানালায় তর্জনী তাঁক করে দেখালো। অতঃপর উৎকণ্ঠিত গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“সুহা, সুহা কোথায়? সে কি বাসায় নেই?”

ভদ্রলোক বললেন,
“বাসা ছেড়ে দিয়েছে।”

চমকে উঠলো মিঠু। তার কপালে সৃষ্টি হলো বলিরেখা।
“বাসা ছেড়ে দিয়েছে মানে?”

“এটার আর কী মানে হতে পারে? বাসা ছেড়ে হয়তো নতুন বাসা নিয়েছে!”

মিঠুর মাঝে উন্মাদনা খেয়াল করলেন ভদ্রলোক। ব্যাকুল স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“সুহা কোথায় গিয়েছে জানেন? নতুন জায়গার ঠিকানা আপনার কাছে আছে?”

ভদ্রলোক মিঠুকে আবারও আগাগোড়া পর্যবেক্ষণ করে বললেন,
“দেখুন বাবা, মেয়েটা বিবাহিত। এভাবে তার পিছু পড়ে থাকাটা আপনাকে শোভা পায় না। তাছাড়া নতুন করে কোথায় উঠেছে, এতটুকু আমি জানিনা। ভাড়াটিয়া বাসা ছেড়ে কোথায় উঠবে, এটার খোঁজ রাখার দায়িত্ব আমাদের নয়। আপনার কাছে অনুরোধ, এভাবে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকবেন না!”

মিঠু বড়োসড়ো এক মি*থ্যা বলল। ভেবেচিন্তেই মি*থ্যার আশ্রয় নিলো। দৃঢ় গলায় বলল,
“সুহা আমার স্ত্রী। দুই বছর যাবত আমাদের মাঝে দ্ব*ন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে। ও আমার কাছ থেকে আলাদা থাকার জন্য মি*থ্যা বলে আপনার বাসায় উঠেছে। আমি চাইছি সবকিছু মিটমাট হয়ে যাক। কিন্তু সে চাচ্ছে না।”

ভদ্রলোক শুধু চমকালেন না, ভীষণ ভাবে চমকালেন। দুটো মেয়ে কীভাবে ঘোল খাইয়ে উনার কাছ থেকে বাসা ভাড়া নিয়েছে! সেসব চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে গম্ভীর স্বরে বললেন,
“তাড়াতাড়ি সব ঠিক করে নিন। এভাবে স্ত্রীকে একা ছেড়ে দেওয়া ঠিক নয়।”

মিঠু বলল,
“দোয়া করবেন আমাদের জন্য।”

মাথা দুলিয়ে বাড়িওয়ালা ভদ্রলোক সিঁড়ি ধরে যেভাবে এসেছিলেন, ঠিক সেভাবেই উঠে গেলেন। মিঠু আরও একবার সুহার জানালায় দৃষ্টি বুলিয়ে নিলো। বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে পথ ধরলো বাড়ি আসার।
রিয়াজ এখন সুস্থ। নিত্যদিনের মতো আজও মিঠুর পাশে তাকে দেখা যাচ্ছে। সুহার ঠিকানা জানার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে মিঠু। অফিস শেষ টাইমেও এখন আর সুহার দেখা পাওয়া যায় না। আজ অবনির দেখা পেল। সে একাই বেরিয়েছে অফিস থেকে। মিঠু নিজ থেকেই এগিয়ে গেল। অবনির বিপরীতে তাকিয়ে সুহাকে দেখতে না পেয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করলো,
“সুহা কোথায়? উনি কোথায় বাসা নিয়েছে?”

অবনি শক্ত গলায় বলল,
“তা দিয়ে আপনি কী করবেন? মানুষের কি ব্যক্তিগত জীবন নেই? সে যেখানেই থাকুক, আপনাকে জানাতে আমি বাধ্য নই।”

অবনি এতটুকু বুঝতে পেরেছে, সুহার ঠিকানা সে জানেনা বললে অন্তত ইবতেসাম বিশ্বাস করবে না। কারণ এই শহরে সুহার একমাত্র কাছের মানুষ হিসেবে সে-ই আছে।
মিঠু তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে হাসলো। অবনি ভেতরে ভেতরে আ*ত*ঙ্ক টের পেলেও উপরে বেশ শক্ত রইলো। মিঠু বলল,
“ঠিক আছো, ঠিকানা লাগবে না। আপনি এবার যেতে পারেন।”

অবনি পথ খোলসা পেতেই দ্রুত পাশ কাটিয়ে গেল। মিঠু ওখান থেকে গেল না। আড়ালে দাঁড়িয়ে রইলো রিয়াজকে নিয়ে। অবনি যাওয়ার দশমিনিটের মতো সময় পেরোনোর পরই সুহাকে বের হতে দেখা গেল। মুখে মাস্ক এঁটেছে। মিঠু ঠোঁট টিপে হাসলো। শিকারীর চোখকে ধোঁকা দেওয়া এতটা সহজ নয়। সামান্য মাস্ক কী করে গোটা একজন মানুষকে আড়াল করতে পারে? এতদিনে পুরো মেয়েটাকেই তার মুখস্থ হয়ে গিয়েছে। সুহা আশেপাশে নজর বুলিয়ে সাবধানতা অবলম্বন করে একটা গাড়ি নিয়ে চলে গেল। পিছু নিলো মিঠু। অবনির বাড়ির কাছে আসতেই সেই ট্যাক্সিটা থেমে গেল। সুহা ঝটপট অবনির বাসায় ঢুকে পড়লো। মিঠু তা দেখে শরীর দুলিয়ে হাসলো। মুখের কাছে একটা হাত চেপে আছে। খোঁজ নেওয়া শেষ হতেই সে বাসায় ফিরে গেল। দিনে দুপুরে মিঠু খুব একটা বাসায় আসেনা। আজ তাকে বাসায় আসতে দেখে বাবা অবাক হলেন। বললেন,
“কী ব্যাপার? এ সময়ে বাসায়?”

মিঠু সরাসরি বাবার সামনে বসলো। কোনরূপ সময় না নিয়েই বলল,
“আমি বিয়ে করবো। মেয়ে রেডি। শুধু তুমি হ্যাঁ করলেই হবে।”

★★★

অরু সকালে উঠেই বাসায় চলে এসেছে। রাতে তার ঘুম ভালো হয়নি। নিজের ঘরে শান্তিতে চোখ বুজলো।
ঘন্টা না যেতেই রামি এসে বিরক্ত করা শুরু করলো। ঝাড়ি দিয়ে বলল,
“এই বে*য়া*দ*ব, এতক্ষণ কীসের ঘুম ঘুমাচ্ছিস? আমাকে একা রেখে এখানে আসতে তোর একটুও বুক কাঁপলো না?”

অরু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। ঘুম থেকে জাগিয়ে দিয়ে তাকে ঝাড়ি দেওয়া হচ্ছে! চোখ ঘুরিয়ে আবারও শুয়ে পড়তে নিতেই হাত টে*নে আটকে দিল রামি। অরু বিরক্ত হয়ে বলল,
“এমন করছো কেন? কাল আমার ঘুম ভালো হয়নি। এখন বিরক্ত করো না।”

রামির গলার স্বর নিচে নেমে এলো। গতরাতের কথা মনে পড়লে এখনো তার বুক ধড়ফড় করে ওঠে। গতকাল অরুর গা ঘেঁষে পাশাপাশি শুয়ে টের পেলো তার হাত-পা অসম্ভব কাঁপছে। নিজেকে ধাতস্থ করতেই অরুকে ঝাপটে ধরে মটকা মে*রে শুয়ে রইলো। দু’দন্ড ঘুমাতে পারেনি সে। ভোরের দিকেই চোখ লেগে এসেছিল। মেয়েটা দিব্যি ঘুমিয়ে গিয়েও বলে বেড়াচ্ছে তার না-কি ঘুম হয়নি।
তার আর সময় আছে আজ সহ দু’দিন। মনটা নরম হয়ে এলো। বাইরের দিকে তাকিয়ে খাটো স্বরে বলল,
“আমি কাল চলে যাব অরু।”

অরুর ঘুম উবে গেল। তার নিজেরও খা*রা*প লাগছে। ঘুম ছেড়ে বিছানায় পা ভাঁজ করে বসলো।
“কালই চলে যাবে?”

“হুম। আজ আমার সাথে যাবি?”

“কোথায়?”

“যেখানে নিয়ে যাবো, সেখানে।”

“নিয়ে যাবে টা কোথায়?”

“একটা জায়গায়।”

“জায়গার নাম কী?”

“জানিনা।”

অরু ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
“জায়গায় নিয়ে যাবে, অথচ জায়গার নামই জানেনা। সরো, আমি বিছানা গোছাবো।”

রামি সরলোনা। সটান হয়ে অরুর বিছানায় শুয়ে পড়লো। অরু চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই মিঠু ভাবলেশহীন গলায় বলল,
“আমি এখন ঘুমাবো। তুই যা।”

এই বলে বিছানায় কয়েকদফা গড়াগড়ি দেওয়া শেষ। হাল ছেড়ে অরু উঠে গেলো। দশটা পর্যন্ত ঘুমালো রামি। অরু একা একাই ক্লাসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো। বিকেলে দুজনের বের হওয়ার কথা। অরু তৈরি হওয়ার পূর্বেই রামি এসে হাজির।
অরুর মাথায় টোকা মে*রে বলল,
“কীরে ঝ*গ*ড়ু*টে মহিলা, তৈরি হতে এতক্ষণ লাগে?”

অরু মাত্র আইলাইন করতে নিয়েছে। মাথা নড়ে ওঠায় চোখ ভরে গেল কালিতে। আয়নায় নিজের হাল দেখে অগ্নি চোখে তাকালো রামির দিকে। রামি হাসির মাত্রা বাড়িয়ে আগুনে ঘি ঢালার ব্যবস্থা করলো। ব্যস, এতটুকুতেই অরুর মেজাজ বি*গ*ড়ে গেল। বসে থাকা রামির চুলে আ*ক্র*ম*ন চললো। মাথা এদিক-ওদিক নড়ে তো*ল*পা*ড় হচ্ছে রামির। অরুর হাতে কয়েক গাছা চুল উঠে এসেছে। রামি বিস্ফোরিত চোখে তাকালো অরুর হাতে। তার সেট করা চুল আর চুল রইলোনা। এমন অ*ত্যা*চা*র মাসে কয়েকবার হলে অল্পদিনে তাকে ন্যাড়া ট্যাগ নিয়ে চলতে হবে। পাল্টা আ*ক্র*ম*ণ করার উদ্দেশ্যে অরুর চুলে হাত দিতে নিচ্ছিলো রামি। অরু সাবধান করে বলল,
“খবরদার! আমার চুলে হাত দিলে আজ মাটিতে এমন গড়াগড়ি দেব না, বাসাছাড়া হওয়া ছাড়া তোমার কোন উপায় থাকবে না।”

রামি চুপসে গেল। পরাজিত সৈনিকের মতো বলল,
“এবার তৈরি হয়ে নে বোন।”

অরু সূঁচালো চোখে তাকিয়ে বলল,
“নতুন কাউকে পেয়েছো না-কি? বউ ধরে বোন বানাচ্ছো? ব্যাপার কী?”

রামি দু-হাত জোড় করে বলল,
“মাফ কর। ভুল হয়েছে আমার।”

অরু আড়ালে মুখ লুকিয়ে মিটিমিটি হাসলো। তার তৈরি হওয়ার ফাঁকে রামি একপাশে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করে নিলো। অরু তৈরি হয়ে ফোন হাতে নিয়ে পরপর দুটো কাপল পিক ক্যামেরা বন্দী করলো।
বসার ঘর থেকে মিঠুর আওয়াজ আসছে। দুজন বেরিয়ে দেখলো বাবা আর মিঠু কোন জরুরী আলাপে ব্যস্ত। বিয়ে বিষয়ক কিছু কথা অরুর কানে এলো।

#চলবে………