অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব-১৭+১৮

0
665

#অনুবদ্ধ আয়াস
#ইফা আমহৃদ
পর্ব:১৭+১৮

লম্বা আঁচলটা বারবার বিরক্ত করছে আমায়। কোমরে গুঁজে নেওয়ার পরেও অহেতুক ডিস্টার্ব করছে। এই পুঁটি মাছের চক্করে তিন ঘণ্টার বেশি গড়িয়ে গেছে। বিকেলের রোদ এখন রাতের আঁধারে আবৃত হয়ে গেছে। সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়াতে রাস্তা ঘাট নিরিবিলি। গাড়ি চলাচল নেই বললেই চলে। হাতে গোনা কয়েকটা শুধু। চিংড়ি মাছ আর সবজি কাটতে কাটতেও ঘণ্টা দুই লেগেছে। অসহায় আমি। ভিশন অসহায়। বাড়িতে এতো এতো লোকজন থাকার ফলেও কারো থেকে কোনরুপ সাহায্য নিতে পারছি না। রৌধিকের বারণ। আজ কেউ কিচেনের দিকে এক পা এগুতে পারবে না। চক দিয়ে দাগ টেনে রেখেছে।
আজকের রেসিপি ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত আর গলদা চিংড়ির মালাইকারি। পুঁটি মাছগুলো ধুয়ে ফ্রিজে রাখতে বলেছে। আমি হান্ডেট পার্সেন সিউর, আমাকে শাস্তি দিতে এই মাছগুলো নিয়ে এসেছে। ইচ্ছে করে, গাল চেপে সবগুলো মাছ খাইয়ে দিতে। অস’ভ্য ছেলে একটা।
আমি রান্না করতে ব্যস্ত। তদানীং নিজের উন্মুক্ত পেটে শীতল হাতের স্পর্শ পেলাম। থমকে উঠলাম আমি, ভিশন চমকালাম। কম্পন ছড়িয়ে গেল সর্বাঙ্গে। খুন্তি চেপে ধরলাম আমি। হাতের স্পর্শ আরো গভীর হয়ে উঠল। গলায় উষ্ণ নিঃশ্বাস পড়ল। হিম হয়ে এলো দেহ। স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি। ঘাড় কাত করে মানুষটিকে দেখার চেষ্টা করতেই চিবুকের উপর জ্বলজ্বল করা লালচে তিলটা নজরে এলো। বোধগম্য হতে সময় লাগল না, এই মানুষটি কে। আমার পেটের উপর রাখা রৌধিকের হাতের উপর হাত রেখে টেনে টেনে বললাম,

“ক কী করছেন?”

থমথমে গলায় বলল, “কী করছি?”
পুড়ে যাওয়া গন্ধ নাকে ভেসে এলো। আমি হাতার সহায়তায় নাড়াচাড়া দিতে দিতে বললাম,

“ছাড়ুন, রান্না করতে পারছি না। তরকারি পুড়ে যাচ্ছে।”

দৃঢ় করে মুড়িয়ে নিলেন। অন্য হাতটা সামনে থেকে ঘুড়িয়ে কাঁধে রাখলেন। রৌধিক নিজে দুলছে সাথে আমাকেও দুলাচ্ছেন। ফোড়ন কেটে বললেন,

“সাপের মতো এতো মুচড়ামুচড়ি কেন করছ, আশ্চর্য! মানুষ রান্না করে হাত দিয়ে। আমি তোমার হাত ধরি নি। তাহলে ডিস্টার্ব করব কিভাবে।”

আমি রৌধিকের স্পর্শ উপেক্ষা করে কাজে মন দিলাম। তৎক্ষণাৎ গলায় কিছু পড়িয়ে দিলেন রৌধিক। পেটের দিকটায় শাড়ি টেনে ঢেকে দিলেন। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল, ” আমার একটু ছোঁয়াতেই তুমি বাঁকা হয়ে যাচ্ছ। অন্যকিছু করার চেষ্টা করলে খুঁজেই পাওয়া যাবে না। নিজের জিনিস আগলে রাখতে শেখ। সেটা হোক তোমার অলংকার, হোক তোমার স্বামী।
আর হ্যাঁ, শাড়ি পড়লে অবশ্যই পেট ঢেকে পড়বে। তোমার এই রুপে, একজন সিদ্ধ পুরুষকেও তার পথভ্রষ্ট করে দিতে সক্ষম।”

“মানে..
প্রত্যুত্তর না দিয়েই আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন তিনি। তার কথাগুলো এখনো কানে বাজছে। এতোকথা বললেন, সবকিছু কেমন গুলিয়ে গুলিয়ে যাচ্ছে। ধোঁয়াশা লাগছে। নিজেকে সংযত করে আমি গলায় হাত দিলাম। একটা লকেট হাতে এলো। অনুভব করলাম অপ্রত্যাশিত কিছু। তবুও মনে হলো, এর আগেও বহুবার এটা স্পর্শ করেছি। যথারীতি হাত পা কাঁপতে লাগল। পুরোনো কিছু ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা দানা বাঁধল মনে। গুছিয়ে রাখা খালা বাসনের ভেতর থেকে স্টিলের প্লেট তুলে দেখলাম নিজেকে। জমে গেলাম আমি। নিজের প্রিয় জিনিসটা ফিরে পাওয়ার আনন্দ। সেদিন বাবার অসুস্থতার কারণে হসপিটালের বিশ পরিশোধ করার জন্য লকেটটা পঁয়ত্রিশ হাজারে বিক্রি করেছিলাম। বড্ড শখের ছিল এটা। আমার জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই আমার গলায় থাকত। আজ হুট করে এটা ফেরত পারো ভাবতেই পারিনি। কিন্তু রৌধিকের কাছে গেল কিভাবে? তিনি বুঝলেনই বা কিভাবে, এটা আমার। এই বাড়িতে থাকতে এটা পড়ি নি কখনো।

রান্নার কাজ সেরে রুমের দিকে পা বাড়ালাম। ল্যাপটপ বেডের একপাশে পড়ে আছে। আশেপাশে রৌধিক নেই। শরীর থেকে আঁশটে গন্ধ আসছে, তাই শাড়ি চেঞ্জ করে চুরিদার পড়ে নিলাম। জীবনের মতো শাড়ি পড়ার শিক্ষা হয়ে গেছে আমার। রৌধিকের জন্য তো কখনোই শাড়ি পড়ব না।
____________
মাথার উপর মস্ত বড় অন্তরিক্ষ। এখন শরৎকাল। শরৎ মানেই নীল আকাশে শুভ্র মেঘের ভেলা। শরৎ মানে আকাশের গায়ে যেন মেঘ–তুলোর ওড়াউড়ি! কখনো সাদা, কখনো কালচে রূপ ধারণ করে শরতের আকাশে ভাসা–ভাসা মেঘের দল। ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলায় শরতের আকাশ। নীল আকাশে সুতো-নাটাইহীন সাদা ঘুড়ির মতো দিনভর উড়ে বেড়ায় মেঘের দল। গোধূলিলগ্নে সোনারঙে রঙিন হয়ে ওঠে আকাশ। রাতের আকাশের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম নয়। দূর থেকে গানের সুর শোনা যাচ্ছে। রৌধিকে রেলিংয়ের ওপর বসে আছে। একহাত মাথায়, আরেকহাত রেলিংয়ের ওপর দিয়ে আছে। সামনের দিকে মুখ করে বসে আছে বিধায় রৌধিকের মুখশ্রী দেখা যাচ্ছে না। আমি গিয়ে রৌধিকের ঈষৎ দূরে বসলাম। রৌধিক আড়চোখে অবলোকন করলেও ঘাড় কাত করল না। নিরবতার সমাপ্তি টেনে ফোড়ন কেটে বললাম, ” আপনি আমার লকেট কোথায় পেলেন?”

“ইচ্ছে হলে রাখো, নতুবা ফেরত দাও।” রৌধিকের একরোখা জবাব।

“ফেরত দেবো, মানে কী? আমার জানার অধিকার নেই?”

“ধীরে ধীরে এবং আস্তে আস্তে কথা বলবে। জোরে জোরে কথা বলা আমার পছন্দ নয়।
তুমি সেদিন যখন বিক্রি করতে জুয়েলারি দোকানে গিয়েছিলে, আমি তখন সেখানেই ছিলাম। তোমাকে ফলো করে তোমার হসপিটাল এবং তোমার বাড়ি অবধি গেছিলাম।”

তাজ্জব বনে গেলাম আমি। রৌধিক কিভাবে আমাদের বাড়িতে গেছিল, তা তো তার থেকে জানা হয়নি। আমি তাকে কখনো ভুলবশতও বলি নি। আমি যখন গভীর চিন্তায় ব্যস্ত তখন তিনি গম্ভীর মুখে বললেন, ” কালকে নাকি শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছি আমরা?”

“মানে, আমি তো শ্বশুর বাড়িতেই আছি!”

রৌধিক পা তুলে ভেতরের দিকে মুখ করে বসলেন। আমার দিকে ঈষৎ ঝুকে বললেন,
“আমি আমার শ্বশুর বাড়ির কথা বলছি, তোমার নয়।”

নিজের মাথায় নিজেই মৃদু শব্দে চপল মার’লাম। তুই এতো বোকা কেন জোনাকি? সবাই তোরে বোকা বানাচ্ছে‌। বিশেষ করে এই রৌধিক। তোকে একদম মুরগি বানিয়ে দিচ্ছে ইদানীং। কদাচিৎ পর দেখা যাবে, ঘুম থেকে উঠে তুই মুরগির মতো কক কক করছিস। ডিমও পারছিস। গাঁধী একটা, ছাগল একটা।

“মাছির মতো ভনভন না করে, জোরে জোরে বল। আমিও একটু শুনি, নিজেকে কী বলে গা’লাগা’লি করছ?”

আমি সিউর, এই ছেলেটা জ্যোতিষী ছিল। আমি মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই ফট করে সেটা বলে ফেলবে।

“কালকে তোমার বাবা সব সত্যিটা জানতে পারবে। আমাদের যেতেই হবে সেখানে, কিন্তু কাল তিনটা বাজে একটা ডিল আছে।”

“কিসের ডিল?”

“সেদিন যে ডিলটা ক্যান্সেল করা হয়েছিল সেটা। ডিলটা না করলে আমাদের অনেক লোকসান হয়ে যাবে। তাই বাধ্য আমি। কিন্তু..

“কিন্তু কী?”

“ওরা চাইছে কালকে তুমি আমার সাথে যাও। তারা জানে, তুমি অফিসের স্টার্ফ। বাবার সাথে তুমি অনেকবার ডিল ফাইনাল করতে গিয়েছিলে। কিন্তু আমি তোমাকে এইসবে ইনভল্ট করতে চাইছি না।”

চমকে উঠলাম আমি। ধীরে ধীরে শুধালাম, “কী বলছেন আপনি? এতোবড় একটা ডিল। আমি অবশ্যই যাবো। কালকে বাবাকে সবটা জানিয়ে আমরা একসাথে যাবো।”

আর কথা না বাড়িয়ে নিচে নেমে এলাম। এই বাড়ির মানুষগুলো আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। আমার জন্য এই বাড়ির লোকেদের কোনো ক্ষতি হোক আমি তা চাই না।
____________________
সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে এলাম। আমি রৌধিক, বাবা মা আদ্রিতা সবাই একসাথে। রৌধিক আজকে অফিসে যায়নি। অফিসের দায়িত্বটা আপাতত আরু নামক মেয়েটাকে দিয়েছে। বাড়িতে গেলে বাবা এতোজনকে দেখে চিন্তিত হয়ে পড়েছে। আমাকে কিছু বলতে দেয়নি, মৌমিতা আর আদ্রিক আহম্মেদ। তারা দু’জনে বাবার সাথে কথা বলছে। আমি আদ্রিতা আর রৌধিক অন্যরুমে বসে আছি। চিন্তায় মাথা ফেটে যাওয়ার উপক্রম। আমাকে এতো চিন্তা করতে দেখে আদ্রিতা সান্তনা দিয়ে বলল,

“জোনাকি চিন্তা করিস না। দেখবি বাবা ঠিক তোদের মেনে নিবে।”
আদ্রিতার সাথে আমার সম্পর্কটা বন্ধুসুলভ। সে আমাকে তুই করে আর আমি তাকে তুমি বলে সম্বোধন করি।
“আমি চিন্তা করতে চাই না আদ্রিতা আপু। কি করব বল, এমনিতেই চিন্তা হয়।”

আর কিছু বলার আগে নক পড়লো দরজায়। বাবা ডাক পাঠিয়েছে। আমি ধীর গতিতে গিয়ে হাজির হলাম।‌ মাথা নত করে রইলাম। বাবা এগিয়ে এলেন আমার দিকে। আমার থুতনি ধরে উপরে তুললেন। পলকহীন চোখে চেয়ে আছে। তাঁর চোখেও অশ্রু। অশান্ত লাগল নিজেকে। বাবা কী তাহলে আমার কথা কাজে কষ্ট আয়াস পেলেন। বিচলিত হয়ে বললাম,

“বাবা কী হয়েছে তোমার? কাঁদছ কেন?”

আমার কান্নার গতি তুলনামূলক বেড়ে গেল। কথা বলার প্রয়াস করছি, কিন্তু কোন রুপ শব্দ বের হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, কেউ শক্ত করে আমার গলা চেপে রেখেছে। বাবা নিজের হাতে চোখের অশ্রু মুছে দিলেন। মাথায় হাত রেখে বললেন,

“আমার ছোট মেয়েটা আজ কতো বড় হয়ে গেছে, ভাবা যায় না। বাবাকে বাঁচাতে নিজের জীবনকে বিক্রি করে দিতে একবারও ভাবে নি। আমি কিছু করতে পারলাম না।”

চমকে উঠলাম আমি, ভিশন চমকালাম। কি বলছে বাবা এইসব? কথাগুলো আমার বুকে তীরের মতো বিঁধছে, তিনি কী বুঝতে পারছে না। আমি তো আমার বাবার জন্য করেছি। তাহলে?
“তুমি তো অনেক দিয়েছ, এবার নাহয় আমি দিলাম।”

বাবা নেত্র যুগল গ্ৰথণ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। মন ভরে দোয়া করলেন আমায় এবং রৌধিককে। সেদিন রৌধিকের ব্যবহারে বাবার মন জয়ে করে নিয়েছি। রৌধিক আমার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসলেন। কষ্ট লাগল, জয়ার জন্য।
আমরা আসার আগেই জয়া পরীক্ষা দিতে গেছে। পরীক্ষা দিয়ে ফিরতে ফিরতে তিনটা বেজে যাবে। আমরা দুইটার আগেই বের হবো।
_____________
শুভ্র রঙের শাড়ি পড়ে তৈরি হয়েছিল আমি। একদম সিদ্ধ লাগছে আমায়। আমার সাথে মিলিয়ে রৌধিকও ওয়াইট ব্রেজার, ওয়াইট সুজ, ওয়াইট জিন্স পড়েছে। রৌধিকের বাবা মা চলে গেছে। আমি আর রৌধিক আরো দুদিন থাকবো। তাই ল্যাকেজ ভর্তি জামা কাপড় নিয়ে এসেছি।

রেস্তোরাঁর সামনে এসে গাড়ি থামল। জনশূন্য নির্জন রেস্তোরাঁ। চারিপাশে কারো দেখা নেই। রেস্তোরাঁর ভেতরেও কেউ নেই। অজানা আশঙ্কা দুমড়েমুচড়ে দিল দেহের অন্তর্ভাগ। ভীত হলাম আমি। রৌধিকের বাহু চেপে মিনমিনিয়ে বললাম,

” শুনছেন? আমার ভয় করছে। খুব ভয় করছে।”

রৌধিক সন্তর্পনে আমার হাতের উপর হাত রেখে আশ্বাসের স্বরে বললেন, “এতো ভয় কিসের? আমি আছি না। আমি থাকতে কখনো তোমার কোন বিপদ হবে না।”

রৌধিক আর আমি ভেতরে ঢুকলাম। স্টার্ফরা নেই। বড্ড বেশি পরিপাটি করে সাজানো ভেতরটা। একপাশের টেবিলের উপর খাবার রেখে অন্য প্লেট দিয়ে উবুত করে ঢেলে রাখা। রৌধিক ক্লাইন্টদের ফোন করার প্রয়াস করলেন। অন্যপাশে গেলেন। আমি সেখানে দাঁড়িয়ে উঁচু স্বরে বললাম,

“হ্যালো। কেউ আছেন? আমার কথা শুনতে পারছেন?”

বিনিময়ে কোন প্রত্যুত্তর শোনা গেল না। আমার কন্ঠ ধ্বনি হাওয়ার সাথে ঘর্ষণ সৃষ্টি করে ফিরে এলো। রৌধিক ততক্ষণে ফিরে এসেছে। সাথে নিয়ে এসেছে তিনজনকে। তাদের চিনতে মোটেও অসুবিধে হয় নি আমার।‌ দূরত্ব রেখে বসে কিয়ৎক্ষণ বিশ্রাম নিল সকলে। দুপুরের খাবারের সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। তাদের যেহুতু লাঞ্চের সাথে ডিল ফাইনাল করার জন্য ডাকা হয়েছে। তাই আগে লাঞ্চ করে নিলাম। বস নামক নিহাল ছেলেটিকে আমার একদম ভালো লাগল না। পায়ের পাতায় অপ্রত্যাশিত স্পর্শ নড়ে উঠলাম আমি। নিচের দিকে তাকাতেই দেখলাম, পা উধাও। সবাই নিজেদের মতো খাচ্ছে। দৃষ্টিভ্রম মনে করে খেতে লাগলাম। পুনরায় একই ঘটনা ঘটল। কানের কাছে রৌধিক এসে বললেল,

“এনি প্রবলেম জোনাকি?”

“না।”
রৌধিকের কথার সাথে তাল মিলিয়ে নিহাল বললেন,
“আমারও মনে হচ্ছে, তুমি কোনভাবে ডিস্টার্ব? তোমাকে অনেক চিন্তিত লাগছে।”

হুট করে কাউকে দেখেই তুমি সম্মোধন, অস্বস্তি এবং অসন্তুষ্ট হলাম। রৌধিকও অসন্তুষ্ট তা কাল রাতেই বুঝতে পেরেছি। কাঁটা চামচ টেবিলের উপর গেঁথে একহাতের উপর আরেক হাত রেখে বললেন,

“মিস্টার নিহাল। একবার দেখাতে অপরিচিত একটা মেয়েকে তুমি করে বলাটা শোভা পায় না, এম আই রাইট।”

নিহাল অপমান বোধ করল। গলা খাঁকারি দিয়ে খেতে লাগলেন। তবে শান্ত হলেন না। খাচ্ছে আর নিজের পা দিয়ে আমাকে ডিস্টার্ব করছে। অফিসের কথা ভেবে ছিল বলতেও পারছি না। শুধু পা জোড়া পশ্চাৎ সরিয়ে ফেললাম।
খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ হলো। অন্য টেবিলের গিয়ে বসলাম আমরা। রৌধিক একবার ফাইল পরে শোনালেন সবাইকে। নিহাল ফাইল নিয়ে আরো একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। কলমটা কপালের পাশে স্লাইড করতে করতে বললেন,

“আমি সাইন করব, মিঃ রৌধিক। কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে।”

রৌধিক ভ্রু কুচকালেন। তেমন কোন শর্তের কথা বলা হয়নি। তাহলে এখন কেন শর্তের কথা বলছে। রৌধিকের ললাটে রুদ্র ভাঁজ ফেলে সোজাসাপ্টা বললেন,

“কী শর্ত? কিসের শর্ত? আপনার সাথে শর্ত কি কোন কথা হয়নি। তাহলে হঠাৎ এখন শর্ত আসছে কেন?”

“সো ওয়ার্ট? ইউ সুড হ্যাভ থ্রো বিফর। হোয়াই ইউ সুড আই একসেপ্ট দা ডিল দ্যাট এই হ্যাভ ক্যান্সেল্ড? হোয়াই?

”কি শর্ত?”

আমার দিকে বাঁকা হেঁসে তাকালেন নেহাল। ঘোর লাগা কন্ঠে বললেন, ” আপনার অফিসের এই স্টার্ফকে আমার চাই‌।”

“স্যরি। আই ক্যান নট আন্ডাস্ট্যাণ্ড।”

রৌধিক অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। এদিক আমার শরীর উত্তপ্ত হয়ে আসছে আর তিনি হাসছেন? নিহাল কি হাসির কথা বলেছেন? আশ্চর্য! রৌধিক হাঁসি থামিয়ে বিদ্রুপ করে বলল, ” এখন কী আমি অফিস ছেড়ে ঘটকালি করব? আর তাছাড়া সি ইজ ম্যারিড এবং মাই অনলি ওয়াইফ।”

আমার দিকে খানিকটা এগিয়ে আসার প্রয়াস করলেন। আমি পিছিয়ে গেলাম।

“তাহলে ওয়ান নাইট। জাস্ট টুয়েলভ অ্যায়ার। দেখতে দেখতে কেটে যাবে। আমি এক্সট্রা পেমেন্ট করব। আপনার ব্যবসায়ও উন্নতি হবে, আমার আকাঙ্ক্ষাও পূরণ হবে।”

বলেই ওষ্ঠদ্বয় কা’মড়ে ধরলেন। ঘৃণায় গুলিয়ে উঠল আমার দেহ। রৌধিকের মুখের হাসিটা ইতোমধ্যে মিলিয়ে গেছে। রাগে ফোঁস ফোঁস করছে। আগে পেছনে না ভেবেই খপ করে শার্টের কলার চেপে ধরল নিহালের। তার গার্ডরা রৌধিককে থামানোর চেষ্টা করল। আমি ছুটে গেলাম রৌধিকের কাছে। নির্ঘাত আজ নিহালের খবর আছে। রৌধিক এতোটাই হিংস্র বাঘের ন্যায় হয়ে আছে, তাকে থামানোর চেষ্টা করাই বৃথা। এমনিতেই তার শক্তির কাছে আমি মশা। এখন তো আরো আগে পারব না। আমি অসহায় কন্ঠে বললাম,

“রৌধিক প্লীজ থামুন। কি করছেন আপনি? ভয় করছে আমার।”

রৌধিক শান্ত হয়ে গেল। হাত আলগা করে সরে এলো। আমার সামনে দাঁড়িয়ে গভীর ভাবে তাকিয়ে রইল। হুট করেই বাহু চেপে ধরল। বাম হাতের তর্জনী ও মধ্যমা আঙুল গুড়িয়ে গুড়িয়ে আমায় নিয়ে বেরিয়ে এলেন। হাতে টান পড়ছে তবুও নিশ্চুপ আমি। রৌধিকের সাথে কথা বাড়ানো মানেই নিজের বিপদ নিজে বয়ে আনা।

গাড়িতে এসে ফেলে দিলেন আমায়। উল্টো ঘুরে গাড়িতে বসে পড়লেন। বোতলের ছিপি খুলে এক ঢোক পানি খেল। বাকি পানিগুলো মাথায় ঢেলে দিল। অতঃপর মাথা চেপে বসে রইলাম। ফোন বের করে কাউকে একটা ফোন করে বললেন,

“আমি এড্রেস পাঠাচ্ছি। দ্রুত যাও। ওদের তিনজনকে আঁটকে রাখবে। আমি আসার আগ পর্যন্ত কিছুতেই না যেতে পারে।”

বলেই লাইন কেটে কিছু একটা টাইপ করল। আমি ফোন নিয়ে নিলাম। কিন্তু ততক্ষণে এড্রেস সেন্ড করে দিয়েছে। ক্ষোভে ফোনটা ছুড়ে ফেললাম। হুট করেই ড্রাইভ করতে লাগল রৌধিক। ব্যালেঞ্জ হারিয়ে খামচে ধরলাম রৌধিককে। ফুল স্পিডে গাড়ি ড্রাইভ করে বাড়ির সামনে এনে দাঁড় করালেন। গাড়ির উপর চোখ বন্ধ করে রেখে বললেন,

“ভেতরে যাও জোনাকি।”

“আপনি যাবেন না?” জিজ্ঞাসা সূচক দৃষ্টি।

“আমি এখন যেতে পারব না। তুমি যাও। কিছু হিসেব নিকেশ বাকি আছে। সেগুলো পূরণ করে আসছি।”

“শুনেন!”
রৌধিক চলে গেলেন পূর্বের পথ ধরে। কেমন শূন্য শূন্য লাগছে নিজেকে। কোথায় গেছে তিনি। ক্ষোভের বশে কিছু করে ফেলবে না তো? আমি নিজের ভাঙা ফোনটা দিয়ে রৌধিকের বাবাকে ফোন করলাম। রিং বাজতেই রিসিভ হলো। আমাকে সহজ ভাষায় বললেন,

“হ্যালো। জোনাকি।‌ অববেলায় ফোন করেছ, কিছু হয়েছে?

“বাবা..
থেমে গেলাম আমি। ফুঁপিয়ে উঠলাম। মিনমিনে স্বরে বললাম,” বাবা প্লীজ রৌধিককে বাঁচান। প্লীজ।”

আশ্বাসে মাখা গলায় বললেন, “কি হয়েছে রৌদুর। কেঁদো না, শান্ত হও। আমাকে খুলে বলো।”

ভেতরে চাপা আঘাত রেখে ধীরে ধীরে সবটা খুলে বললাম তাকে। অতঃপর বাড়ির ভেতরে গেলাম। বাবা ঘুমিয়ে আছে। জয়া দুপুরে খেয়ে ঘুমানোর অভ্যাস আছে, তাই সেই ঘুমিয়ে আছে। ঘুম নেই আমার চোখ। শাড়িটা চেঞ্জ করে বেলকেনিতে গেলাম। রেলিং এ হাত রেখে মেইন দরজার দিকে তাকিয়ে রইলাম। মনে হলো, এই বুঝি রৌধিক আসবে। কিন্তু এলো না। মাথা রাখলাম দেয়ালে। তার অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে কখন যে চোখের পাতা বুজে ভারী ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেছি‌। জানা নেই। নিদ্রার মাঝেও ভীত আমি। ভয়ে শরীর কাঁপছে।

চলবে.. ইনশাআল্লাহ