অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব-১৯+২০

0
637

#অনুবদ্ধ আয়াস
#ইফা আমহৃদ
পর্ব:১৯+২০

“আপনারাই বলেন, এই মেয়েকে অফিসে রাখা উচিত কিনা? যে মেয়ের জন্য আমাদের স্যারকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। তাকে অফিসে রাখার কোনো মানেই হয়না।”

সবাইকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলল আরু নামক মেয়েটা। সে বর্তমানে অফিসের ম্যানেজারের দায়িত্ব পালন করছেন।‌ ভিড় জমে গেছে আমাকে ঘিরে। আমি হাত মুষ্টিবদ্ধ করে খুকখুক করে কেশে উঠলাম। সবাই আরুর সাথে তাল মিলিয়ে বলল,

“হ। এই অ’সভ্য মেয়েটাকে এখানে রাখা যাবে না। এই মেয়ে ছলচাতুরি করে আমাদের স্যারকে উস্কেছে। এতো দিন ভালোই মনে করছিলাম। কিন্তু বুঝিনি, এর পেটে এতো দূর। কতো ছেলের সাথে থেকেছে হিসেব নেই।”

আমি স্থির। চোখজোড়া মাটির দিকে নিবদ্ধ। তিক্ত কথাগুলো দেহটাকে দহনে ভরিয়ে দিচ্ছে। দেহের লোমকূপ বন্ধ হয়ে গেছে। নিঃশ্বাস ভারী ঠেকছে। অক্সিজেনের মাত্রা কমে গেছে। কথা বলার শক্তি হারিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। আহির সারা একপাশে দাঁড়িয়ে সব শুনছে। কিছু বলতে পারছে না। আমার কাছে এগিয়ে এলো। আমাকে ধরে ধীরে ধীরে বলল,
“কিছু হয়নি জোনাকি।”

আমি মিনমিনে স্বরে বললাম, “ব্যাগের চেইন খুলে দেখ, একটা পেপার আছে। ওটা বের করে পড়ে শোনা সবাইকে।”
কনুইতে চেপে রাখা ব্যাগটা আলগা করে দিলাম। সারা ব্যাগের চেইন খুলে কাগজ বের করে পড়তে লাগল,

“আমি আদ্রিক আহম্মেদ। কিছুদিনের জন্য আমার কোম্পানির যাবতীয় দায়িত্ব জোনাকির নিকট অর্পণ করলাম। আশাকরি, আপনারা আমার মতামতকে গুরুত্ব দিবেন। ধন্যবাদ।”
সবাই একে অপরের মুখের দিকে চাওয়া চাওয়ি করল। আরু কাগজটা ছিনিয়ে নিয়ে চোখ বুলিয়ে নিল। রুদ্ধ কন্ঠে বলল, ” এটা কিছুতেই হতে পারে না।”

আমি কাগজটা নিয়ে দেখার ভান ধরে বললাম, “কী হতে পারি, কী পারে‌ না। বিশ্বাস করবে, কি করবে না। এটা আপনার ব্যাপার। নিচে বাবার সিগনেচার রয়েছে। চাইলে ফোন দিয়েও জানতে পারো।”

বাবা হিসেবে সম্মোধন করাতে সবার চোখ চড়কগাছ। অবিশ্বাসের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে রৌধিকের কেবিনের দিকে পা বাড়ালাম। আসার আগে বলে এসেছি, সবাইকে কাজ করতে। তাই যে যার কাজে ব্যস্ত। কিন্তু অদ্ভুত লাগছে, আরুর ব্যবহার। রৌধিককে নিয়ে এতো দরদ কেন তার। কেবিনের ভেতরে রৌধিকের আসনটা দেখে বুকে তার অনুপস্থিতি অনুভব করলাম। তিনি বরাবর এই চেয়ারে বসে ঘুরতেন আর মুখে কলম পুড়ে, সেটা কামড়াতেন। বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। আজ দুদিন হয়েছে রৌধিককে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। মিঃ নিহালের অবস্থা শোচনীয়। মাথা ফেটে গেছে। মাথায় আঘাত পাওয়ার কারণে হসপিটালের ইমার্জেন্সিতে এডমিট করা হয়েছে। অনেক প্রয়াস করেও বেইল করাতে পারি না। সকালের দিকে জ্ঞান ফিরেছে মিঃ নিহালের, তাই আজকে বেইল হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। অফিসের অবস্থায়ও ভালো নয়, তাই আদ্রিক আহম্মেদ আমাকে অফিসের দায়িত্ব দিয়েছেন। তিনি আর মৌমিতা আজকে জর্জ কোর্টে যাবে।
আদ্রিক আহম্মেদ আগেই অনুমান করেছিলেন এমন কিছু হতে পারে, সিগনেচারসহ তিনি লিখিত দিয়েছেন। মন খারাপ হওয়ার সত্বেও অফিসে এসেছি। তারপরে এমন ঝামেলা শুরু করল আরু।
______
সূর্য ডুবে গেছে অন্তরিক্ষ থেকে। আকাশে বাঁকা চাঁদের ফালি। অফিস ছুটি হয়ে গেছে। সবাই চলে গেছে। অফিসের এতো এতো কাজের কারণে সারাদিন ব্যস্ততায় কেটে গেছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, নয়টা ছাড়িয়েছে। ফাইলপত্র গুলো গুছিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ালাম। নিশ্চয়ই রৌধিকের বেইল হয়েছে। দরজা খুলে পা বাড়াতেই ধাক্কা দিল কেউ। পিছিয়ে গেলাম আমি। আচম্বিতে ধাক্কা দেওয়াতে নিজের ব্যালেঞ্জ হারিয়ে ফেলি। ফ্লোরে ছিটকে পড়ি। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল আরু। বিরক্ত নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্যাগ তুলে হাঁটার চেষ্টা করলাম। বাহু টেনে ধরল। এই মুহূর্তে আমি এই মেয়েটির সাথে কথা বলে মুড নষ্ট করতে চাই না। রৌধিককে দেখার তৃষ্ণায় বড্ড কাতর আমি। পেছনে না ফিরে ধীরে ধীরে বললাম,

“সমস্যা কী তোমার? হাত ছাড়ো। আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে।”

দ্বিমুহূর্ত অতিবাহিত হওয়ার পূর্বে হাত ছেড়ে দাঁড়ালো আরু। কপালের পেছনটায় স্লাইড করতে করতে বলল, ” স্যরি। আসলে আমার একা একা ভয় করছে।এই কক্ষটা লক করা বাকি আছে শুধু। তুমি যদি একটু থাকো, তাহলে আমার ভালো লাগছে।”

“ঠিক আছে।” বলে হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রইলাম। আরু দরজা জানালা। এমনকি ওয়াশরুমের দরজাও লক করে দিল। মোটেও সন্দেহজনক লাগে নি আমার। আরু রিমোট দিয়ে এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিল।‌ হতবাক হলাম আমি। এখন এসি বন্ধ করে দেওয়ার পরিবর্তে পাওয়ার কেন হাই করল। সন্দিহান স্বরে বললাম, ” মিস্ আরু, আপনি হয়তো ভুল করে ইসির পাওয়ার বাড়িয়েছেন। যেটা দিয়ে বাড়িয়েছেন। তার বিপরীত দিকেরটা দিয়ে কমাতে হয়। এবং প্রথমটা দিয়ে অফ করে।”

“আমি জানি মিস্ স্যরি মিসেস জোনাকি। কিন্তু আপনি জানেন না।”

“কী জানি না..

আর কিছু বলার আগেই আরু নামক মেয়েটি বেরিয়ে গেল। হঠাৎ তার আক্রমনে স্থির আমি। এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দেওয়ার কারণে শীতলতায় দেহ বরফের আঁকার ধারণ করছে। আমি হাত গুটিয়ে নিলাম। দরজা ধাক্কাতে লাগলাম। মনে হচ্ছে, দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিলাম,

“আরু, এটা মোটেও ফাজলামির জিনিস নয়। দরজা খোল। শুনতে পারছ? আরু?”

“রৌধিকের দিকে হাত বাড়ানোর দুর্সাহস দেখিয়েছ তুমি, এখন তার ফলাফর ভুগো।”

বাইরে থেকে আর কারো কোনো শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। এদিকে শীতলতা ক্রমশ বাড়ছে। থরথর করে কাঁপছে আমি। ছুটে জানালা কাছে গেলাম। জানালা খুলতে পারছি না। মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। ওয়াশরুমের দরজাও বন্ধ। মাথায় একটু পানি দিবো, তারও উপায় নেই। হুট করে আরো নিভে গেল। বিদ্যুৎ বিভ্রাট হয়েছে ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলাম। কিন্তু বিদ্যুৎ বিভ্রাট হয়নি। হলে শুধু আলো কেন নিভে যাবে? ইসিও বন্ধ হয়ে যেত। এদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার অন্যদিকে হাড় কাঁপানো ঠান্ডা। শরীর জমাট বেঁধে যাচ্ছে। বসে পড়লাম নিচে। কাঁতরাতে কাঁতরাতে জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম সেখানে।
.
.
বিন্দু বিন্দু জলকণা চোখের উপর পড়তেই নড়েচড়ে উঠলাম আমি। তখনও মাথাটা ঝিমঝিম করছে। শরীর অকেজো। নিভু নিভু চোখজোড়া মেলে তাকাতেই রৌধিকের কাতরতা ছড়ানো মুখমণ্ডল নজরে এলো। আবছা আবছা। দুই দিনে একদম শুকিয়ে গেছে। চোখে মুখে ভাঁজ পড়েছে। মুখের ওয়ান টাইম লাগানো। নিশ্চয়ই তাকে প্রচণ্ড মে’রেছে। জ্ঞানহীনতার মাঝেও বুক কেঁপে উঠল আমার। একেমন অবস্থা হয়েছে তার। আমার শরীরের কম্পন বাড়ছে। রৌধিক আমার গালে হাত রেখে অসহায় কন্ঠে বলে,

“জোনাকি, আমার কথা শুনতে পারছ? আমি রৌধিক। দেখ আমি এসেছি। কথা বলো? কীভাবে হয়েছে এইসব? বলো আমাকে?”

ইসি বন্ধ থাকলেও শরীরের ভেতরের শীতলতায় কাতর আমি। সাথে যুক্ত হলো রৌধিকের স্পর্শ। অতিশয় বেড়ে গেল কম্পন। এই মানুষটিকে দেখার জন্য আমি অধিক আগ্ৰহে প্রহর গুনছিলাম। তার স্পর্শ পাওয়ার জন্য চাতক পাখির ন্যায় হাপিত্যেশ করে ছিলাম। জড়তার মাঝেই অদ্ভুত ক্ষমতা উপলব্ধি করলাম দেহে। টেনে টেনে বললাম,

“আরু, আরু ইচ্ছে করে আমাকে..
আঁটকে রেখেছে। দরজা জানালা বন্ধ করে চলে গেছে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল জানেন। আমি অনেক ডেকেছি। কিন্তু কেউ আসেনি।”

রৌধিক সময় নিল না। আমাকে জড়িয়ে ধরে অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিল। আমার নিস্তেজ হাতটা রৌধিকের পিঠে রাখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ভারী হাতটা শক্তিতে পেরে উঠল না। আপ্রাণ চেষ্টা করে হাতটা রৌধিকের পিঠে রাখলাম। রৌধিকের চোখের অশ্রু গড়িয়ে পড়ল আমার চোখে। একত্রিত হয়ে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল নিচে। আমাকে পাঁজাকোলা করে তুলে হাঁটতে লাগল। আমি ভারী চোখের পাতা নিয়ে নিজের সাথে যুদ্ধ করে তার দিকে তাকিয়ে আছি। আজ তাকে প্রাণ ভরে দেখতে ইচ্ছে করছে। ক্ষমতা শক্তি দুটোই হ্রাস পেতে লাগল। ধীরে ধীরে জ্ঞান হারালাম। ঢলে পড়লাম রৌধিকের বাহুডোরে। অস্ফুট কষ্ঠস্বর শ্রবণ হলো। রৌধিক আমার নাম ধরে ডাকছে। সাড়া দেওয়ার ক্ষমতাটুকু লোপ পেয়েছে আমার। অতঃপর কী হয়েছে, জানা নেই।
#অনুবদ্ধ_আয়াস 💚
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২০

গভীর নির্জন রাত। ভারী মাথাটা ধীরে ধীরে হাল্কা হয়ে এলো। শত বাঁধা অগ্রাহ্য করে চোখের পাতা খুলতে সক্ষম হলাম। সর্বপ্রথম নজরে এলো মাথার উপরে থাকা মস্ত সবুজ রঙের সিলিং ফ্যানটা। দেয়ালের রং ধবধবে সাদা। দৃষ্টি সরিয়ে ডানপাশে তাকাতেই দেখলাম স্যালাইন চলছে। প্রায় শেষের দিকে। বুক পর্যন্ত শুভ্র রঙের কাপড় টানা। শরীরটা বড্ড ভারী। ধীরে ধীরে গতরাতের ঘটনা মনে করার প্রয়াস করলাম। ধীরে ধীরে পরিষ্কার হলো সবটা। রৌধিক কী সত্যিই এসেছিল নাকি পুরোটা আমার সাজানো জল্পনা, কল্পনা।

তলপেটের ভেতরে মোচড় দিয়ে উঠল। দাঁত চেপে সহ্য করে নিলাম। ধীরে ধীরে উঠে বসার প্রয়াস করলাম। কিন্তু সম্ভব হলাম না। ওয়াশরুমটা কোনদিকে তাও জানা নেই। আশেপাশে কাউকে দেখতে পেলাম না। ধীরে ধীরে কাউকে ডাকলাম। কিন্তু শব্দগুলো গলায় দলা পাকিয়ে গেছে। অধর জোড়াই একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারছি না। শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে তলপেটে ব্যাথা প্রকট হতে লাগল। তৎক্ষণাৎ কেউ দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করল। শুভ্র রঙের পোশাক পড়া নার্স এসেছে। আমি স্থির। হাতে মেডিসিনের ট্রে। আমাকে সজাগ দেখে মৃদু হাসলেন তিনি। পাশে বসতে বসতে বললেন,

“বাহ্ পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে দেখছি। আমাদের তো চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলেন। রৌধিক স্যার বাইরে বসে আছেন। আপনার কখন জ্ঞান ফিরবে, জিজ্ঞাসা করতে করতে পা’গল করে দিচ্ছিলেন।”

আমি মুচকি হাসলাম। কিছু বলতে পারলাম না। চোখের ইশারায় ওয়াশরুমের দরজার দিকে অবলোকন করলাম। তিনি বুঝতে পারলেন আমার সমস্যাটা। আমার হাত ধরে ধীরে ধীরে উঠে বসানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু ব্যর্থ হলেন। আমার শরীরের ভার তুলনামূলক বেড়ে গেছে অনেকটা। বড় বড় পা ফেলে বেরিয়ে গেলেন তিনি। মিনিট পাঁচেক অতিবাহিত হওয়ার পর সাথে করে নিয়ে এলেন আরো একজন নার্স। দুইজনে তুলে নিয়ে গেলেন। ওয়াশরুমের দরজার ভেতরে রেখে বেরিয়ে এলেন। স্বাভাবিক স্বরে বললেন,

“দরজা বন্ধ করো না। তুমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললে, বের করতে কষ্ট হবে।”

আমি দরজা ভিড়িয়ে রাখলাম। পরবর্তীতে দরজায় নক করতেই ছুটে এলেন তারা। আমাকে ধরে ধরে বেডের কাছে নিয়ে গেলেন। স্যালাইন লাগিয়ে দিলেন। পাশে বসে দু’জনে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন,

“তুমি বরফের মতো শক্ত এবং লোহার মতো ভারী হয়ে গেছ!”

আরেকজন বললেন, ” হ্যাঁ! সেদিন ঠাণ্ডায় কাঁপছিল। কতো ভারী হয়ে গেছিল, দেখিস নি। রৌধিক স্যার কিভাবে ওনাকে কোলে তুলে নিয়ে এসেছে, ভাবা যায় না।”

“হ্যাঁ। ভালোবাসা আছে, বলতে‌ হবে।”

এদের কথার মাথা মণ্ড বুঝতে পারলাম না। রৌধিক আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। তারমানে আমার দেখা সেটা কল্পনা ছিল না। রৌধিক ছিল। তিনি সত্যিই আমার সুপারম্যান। সব বিপদ থেকে সুপারম্যানের মতো আমাকে বাঁচিয়ে নেয়। আমি মিনমিনে গলায় বললাম,

“উনি কোথায়? উনি কী বাড়িতে চলে গেছে?”

ওরা নিজেদের দিকে তাকিয়ে আমার দিকে তাকালেন। আমার দিকে তাকিয়ে সন্দিহান গলায় বললেন, ” তুমি কী বলছ, একটু জোরে বলো। শুনতে পারছি না।”

আমি তো যথেষ্ট জোরে বলছি, তাহলে?

আমাকে কিছু না বলে তারাই বিদ্রুপ করে বলল, “পেশেন্ট হয়তো তার উনাকে খুঁজছেন। তাই আস্তে আস্তে লজ্জা পেয়ে কথা বলছে।”

“উনি তো রৌধিক স্যার, তাই তো! দাঁড়া আমি স্যারকে ডেকে আনছি।”

বলেই একজন নার্স রৌধিককে ডাকতে চলে গেল। মিনিট পেরুবার পূর্বেই রৌধিক হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইল আমার মুখের দিকে। দু’জনের চোখজোড়া একত্রিত হলো। পলক ফেলতে ভুলে গেল। নার্স সরে দাঁড়াল। রৌধিক ভেতরে ঢুকল। কাউকে কিছু না বলে হুট করে জড়িয়ে ধরলো আমায়। আকস্মিক ঘটা এই ঘটনার স্তব্ধ আমি। অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিয়েছে আমায়। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,

“কিছু হবে না তোমার। আমি জানতাম কিছু হবে না।”

আমি নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। সন্তর্পণে নিজের বাম হাতটা রৌধিকের পিঠে রেখে বললাম,

“শান্ত হন আপনি। আপনি ঠিকই জানতেন, আমার কিছু হবেনা।”

রৌধিকের পা’গলা’মির পূর্বের তুলনামূলক বেড়ে গেল। আমার কথা তার কর্ণপথে গেল কি-না জানা নেই। মনে হলো না গেছে। কোনো প্রত্যুত্তর করল না। সবাই মিটিমিটি করে হাসছে। আমি পিঠে চপল মা’রলাম! পুনরায় রিনরিনে গলায় বললাম,

“ছাড়ুন। সবাই দেখতে পারছে।”

রৌধিক ছাড়লেন আমায়। গালে হাত রেখে ললাটের মাঝবরাবর অধর ছুয়ে দিয়ে বললেন,

“আমি আসতে দেরি করেছি বলে তুমি আমার সাথে কথা বলবে না। আ’ম স্যরি। কিছু অন্তত বলো।”

কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলাম আমি। কি বলছেন রৌধিক। আমি তো তখন থেকেই কথা বলে চলেছি। তিনি কী শুনতে পারছেন না। আমার উপর কী কোন জ্বীন ভর করেছে। কিন্তু তা কি করে সম্ভব? রৌধিক তো আমাকে ছুঁয়ে আছেন। তাহলে জ্বীন ভর করার প্রশ্নই আসেনা।

রৌধিকের পিঠে রাখা হাত সরিয়ে নিজের গলায় রেখে খুকখুক করে কাশি দিলাম। কিন্তু কোনো শব্দ হলো না। গলা স্লাইড করে কথা বলার প্রয়াস করলাম। কিন্তু বৃথা হলো আমার প্রয়াস। গলা থেকে একটি শব্দও বের হলো না। আমি উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। সবাই স্তব্ধ। বারবার বলার চেষ্টা করছি, আমি কথা বলতে পারছি না।

স্যালাইনের ক্যানেলে টান অনুভব করলাম। রক্ত উঠে গেল। নার্স এসে টান দিয়ে খুলে ফেলল ক্যানেল। রৌধিক আমাকে পেঁচিয়ে ধরে বলল,

“শান্ত হও জোনাকি। শান্ত হও। এতো হাইপার হয়ো না।
আশ্চর্য, আপনারা এখানে দাঁড়িয়ে কী দেখছেন? যান। ডাক্তারকে ডেকে আনুন।”

তারা দু’জনেই ছুটে গেল। আমি রৌধিকের বুকে চুপটি করে মাথা গুঁজে রইলাম। রৌধিক মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আমাকে শান্ত করলেন। পানির বোতল বের করে এক ঢোক মুখে দিয়ে বললেন,

“ডাক্তার এক্ষুনি চলে আসবে। তুমি একটু অপেক্ষা করো।”

নার্স ডাক্তারকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। রৌধিক আমাকে ছেড়ে দাঁড়ালেন। পরীক্ষা করে বললেন,

” আমি বুঝতে পারছি, তুমি কথা বলতে পারছ না। আর চেষ্টা করো না। দুদিন আগে হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে তোমায়। তখন তোমার ওজন স্বাভাবিক ছিল না, পাঁচ গুণ বেড়ে গেছিল। তোমার পুরো শরীর বরফের চেয়েও ঠাণ্ডা হয়ে গেছিল। গলা শরীরের সাধারণ একটা অঙ্গ। হাল্কা ঠাণ্ডা লাগলেই কথা বলা যায় না। অনেকক্ষণ ঠাণ্ডায় থাকার কারণে তোমার গলা বসে গেছে। কিছুদিন কথা বলতে পারবে না। ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে।
এবার কিছু খেয়ে ঘুমিয়ে পড়। একদম প্রেশার দিও না।”

সবাই চলে গেল। আমি চুপ করে রইলাম। রৌধিক হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। তার গড়াগড়ি খাওয়ার মানেটা না জানলেও আমার কথা বলতে না পারাকে ঘেরা, সেটা বুঝতে অসুবিধে হলো না। চোখ রাঙালাম।
রৌধিক হেসে আরো‌ গড়াগড়ি খেলেন। হাসতে হাসতে বললেন, ” তো ঝাঁঝের রানী। ফুড়ৎ। সব তেজ হাওয়া। যা হয় ভালোর জন্যই হয়। কিছুদিন কথা বলতে পারবে না।

আমি অসহায় চোখে চেয়ে রইলাম। এটা কেমন শাস্তি? এই ছেলেটা আমাকে নিয়ে হাসছে আর আমি কিছুই বলতে পারছি না। নার্স খাবার দিয়ে গেলেন। আমি খাবো না মানে খাবো না। এই ছেলেটা যতক্ষণ পর্যন্ত না স্যরি বলবে, কোন কথা নেই। ধ্যাত আমি তো কথাই বলতে পারি না। খাওয়া বন্ধ।
কিন্তু রৌধিক তা তোয়াক্কা করলেন না। গাল চেপে ঈষৎ ফাঁক করে মুখে পুড়ে দিলে‌ন। রাগান্বিত স্বরে বললেন,

” চুপচাপ খেয়ে কালকে সকালের ভেতরে সুস্থ হয়ে যাও। যে তোমার এই অবস্থা করেছে, তাকে তো শাস্তি পেতে হবে।”

[চলবে.. ইনশাআল্লাহ]