#অনুবদ্ধ আয়াস
#ইফা আমহৃদ
পর্ব:২৩+২৪
পরিবেশ টা কোলাহল পূর্ণ। আমি অনুষ্ঠানের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছি। এদিক ওদিক তাকিয়ে লোকজনের আনাগোনা দেখছি। ইভু এসেছে। আদ্রিতা ইভুর সাথে নিরিবিলি জায়গা বলে গল্প করছে। ইভুর গাড়িতেই আমরা এসেছি। প্রথমে তো আদ্রিতা কিছুতেই কথা বলবে না, কিন্তু ইভুর কাছে হেরে গেছে। অনেক কষ্ট করে রাগ ভাঙিয়েছে তার। আমার থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে রৌধিক। আজ তার বান্ধবীর জন্মদিন। অথচ আমায় বলেছে, তার বন্ধু। আচ্ছা, রৌধিক তো আমাকে বলেনি। বলেছে আদ্রিতা। আদ্রিতা কী মিথ্যা বলছে, না-কি রৌধিক এটা বলতে বলেছে।
কী আদ্যিক্ষেতা। আমার অনুমতি না নিয়েই টানতে টানতে নিয়ে গেছে রৌধিককে। বিরক্ত লাগছে আমার। বাড়িতে থাকলে এতোক্ষণে ঘুমের দেশে পাড়ি জমাতাম। মুখ ভার করে রইলাম। ওয়েটারকে ট্রে নিয়ে যেতে দেখে ডাক দিলাম। একগ্লাস সফ্ট ডিঙ্ক নিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করলাম। দেয়ার ঘড়ির কাঁটা তখন কাঁটায় কাঁটায় বারোটা। একটু জোরে ঢং ঢং করে বেজে উঠে। আমি হকচকিয়ে গেলাম। গ্লাসের কিছুটা আমার শাড়ির উপরে পড়ল। আমি চিন্তিত হয়ে পড়লাম। ডানপাশে তাকালে রৌধিককে দেখা গেল না। আদ্রিতা ইভুও নেই। সবাই নিজ নিজ কাছে ব্যস্ত। কেক কাটার সময় হয়ে গেছে। বারোটা একে কাটবে। সবাই তোড়জোড় করতে ব্যস্ত। ধীরে ধীরে আঠালো হয়ে আসছে শাড়ি। একজন মেয়ের কাছ থেকে ওয়াশরুম কোনদিকে জেনে নিলাম। অতঃপর পা টিপে টিপে সেদিকে গেলাম।
ফাঁকা হয়ে গেছে আশপাশ। শাড়ির আঠালো অংশ ধুয়ে বেরিয়ে এলাম। বিপত্তি বাধল অন্যজায়গায়। প্রায় অর্ধেকটাই ভিজিয়ে ফেলেছি। ভিড় ভাট্টার দিকে আর পা বাড়ালাম না। উল্টো দিকে হাঁটা দিলাম। পাশেই সিঁড়ি পেয়ে গেলাম। সিঁড়ি বেয়ে ছাদে গিয়ে দাঁড়ালাম। প্রচণ্ড দক্ষিণা হাওয়া বইছে। মনে হচ্ছে এই বুঝি উড়িয়ে নিয়ে গেল। লোমকূপ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে গেছে। এককোণে রিলিয়ের উপর গিয়ে বসলাম। এদিকটায় কেউ নেই বিধেয় মন মেজাজ একদম ফুড়ফুড়ে। দূরে অস্পষ্ট নদী দেখা যাচ্ছে। ছোট নদী হওয়াতে নৌকা চলাচল করে শুধু। নিভু নিভু আলো জ্বলছে। এভাবে কেটে গেল কিছু সময়। নিচে যেতে ইচ্ছে করছে না। তাই নিচে বসে পড়লাম। রেলিং এ মাথা ঠেকিয়ে দিলাম। ঘুম ঘুম আসছে। ধীরে ধীরে তলিয়ে গেলাম অতল নিদ্রায়। জানা নেই, কতক্ষণ এভাবে ঘুমিয়ে ছিলাম।
ঘুম ভাঙল হাতে টান পড়াতে। হাত ধরে টেনে ফেলে দিল মাটিতে। অকস্মাৎ ঘটা ঘটনায় আমি হতভম্ব। ঘুমের রেশ কাটতে কাটতেও বেগ পেতে হলো আমাকে। কনুয়ে বেশ কিছুটা ছিলে গেছে। জ্বলছে প্রচুর। আমার সামনে রৌধিক দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষিপ্ত তার দৃষ্টি। মাথার উপর খোলা আকাশ দেখতেই বোধগম্য হলো ব্যাপারটা। উঠে বসার চেষ্টা করতেই হাঁটুতে টান পড়লো। চাপা আর্তনাদ করে উঠলাম। জায়গাটাও প্রচুর জ্বলছে। তবুও দাঁতে দাঁত চেপে উঠে বসার চেষ্টা করলাম। কি বলব খুঁজে পেলাম না।
“শুনছেন..
বাক্য শেষ করার আগেই গাল কাঁপিয়ে চড় পড়ল। পুড়ে উঠলো জায়গাটা। গালটা ডানদিকে ঘুড়ে গেল। আপনাআপনি হাত গিয়ে ঠেকলো বামগালে। আহ্ করে উঠলাম। বাকশক্তি হারিয়ে গেল। চোখের কোণে অশ্রু চিকচিক করছে। এই বুঝি, গড়িয়ে পড়লো। রৌধিক আমার বাহু ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকতে বলল,
“শান্তি পেয়েছ তুমি? প্রাণটা জুড়িয়েছে? কেন এখানে এসেছ, আমাকে শাস্তি দিতে। মানছি, আমি আমার কথা রাখি নি। বন্ধুদের সাথে একটু ব্যস্ত হয়ে গেছিলাম। তাই বলে তুমি এখানে এসে ঘুমিয়ে থাকবে? হ্যাভ অ্যানি আইডিয়া, কতোটায় ভয় পেয়েছিলাম?”
রৌধিক আমাকে ছেড়ে উল্টো ঘুরে ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে, কতোটা রেগে আছে। অনুসূচনা হলো আমার। ঠিকই তো! কেন চলে এলাম এখানে? আমারও তো প্রচণ্ড রাগ লাগছিল। পার্টিতে এনে দাঁড় করিয়ে রেখেছে।
তিনিই বা কি করতেন? বার্থডে পার্টিতে মানুষ আসে কেন? একটু আড্ডা দিতে, বন্ধুদের সাথে আনন্দ করতে। তিনি যখন আমাকে বলেছিলে, যাওয়ার দরকার নেই। তখনই আমার আসা উচিত হয়নি। আমাকে খুঁজতে খুঁজতেই হয়তো পুরোটা সময় কেটে গেছে। আ’ম স্যরি রৌধিক। রিয়েলি স্যরি। কিছু বলার ক্ষমতা নেই। তবুও বিরবির করে শুধালাম,
“শুনছেন?”
“একদম চুপ। একটাও শব্দ মুখ থেকে যাতে বের না-হয়। মাথা নিচু করে চুপচাপ গাড়িতে গিয়ে বসবে। আমার মন মেজাজ ভালো নেই, একটা শব্দ করলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না। আউট!”
আমি মাথা নিচু করে শাড়ির আঁচল টেনে চলে এলাম। চুপচাপ গাড়ির কাছে গেলাম। আমাকে দেখে আদ্রিতা নেমে এলো। উত্তেজিত হয়ে বলল,
“কোথায় গিয়েছিলিস তুই? জানিস তোকে খুঁজতে খুঁজতে ভাইয়ার কী অবস্থা হয়েছিল।”
“ইভু ভাইয়া, আপনি একটু সামনের সিটে বসবেন। প্লীজ।”
আদ্রিতা আর ইভু নিজেদের মধ্যে চাওয়াচাওয়ি করে গাড়ি থেকে নেমে ফ্রন্ট সিটে বসল। আমি পেছনে বসতেই রৌধিক এসে উপস্থিত হলো। ডাইভিং সিটে বসে কঠিন ভাষায় বললেন,
“ঢং না করে সামনে এসো।”
চোখের পানিটুকু মুছে নিলাম। আমি ঢং করছি, এটা রৌধিক বলতে পারল। আমি যাবো না। কিছুতেই যাবো।
রৌধিক লুকিং গ্লাসে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
“দশ সেকেন্ড সময় দিলাম। এর ভেতরে না আসলে হাত ধরে টেনে গাড়ি থেকে বের করে দিবো। এখানে ফেলেই চলে যাবো।”
আমি প্রত্যুত্তর করলাম না। ধীরে ধীরে নেমে রৌধিকের পাশে গিয়ে বসলাম। রৌধিক আমার দিকে তাকায় নি। আমি বসতেই ড্রাইভ করতে লাগলেন।
.
অনেকক্ষণ না খাওয়াতে মাথা ঝিমঝিম করছে। হাঁটু, হাতের কনুই জ্বলছে। সাথে যুক্ত হয়েছে গাড়ির ঝাঁকুনি। কান্নার ফলে চোখে ঝাঁপসা দেখছি। সিট বেল্ট না লাগানোর ফলে শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে ব্যর্থ হচ্ছি। অসাবধানতায় রৌধিকের হাতের উপর হাত রাখল। রৌধিক হাতের দিকে না চেয়েই হাতটা ছুঁড়ে ফেললেন।
গাড়ি যত চলছে তত অস্বস্তি বেড়েই চলেছে আমার। আমি নিশ্চুপ। স্তব্ধ। মাথাটা রৌধিকের কাঁধে রাখলাম। তিনি আমাকে তোয়াক্কা করলেন না। ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন। মাথা গিয়ে ঠেকল গাড়ির সাথে। ভন ভন করে উঠলো। ব্যাথাটা চাড়া দিয়ে উঠল। গাঁ গুলিয়ে এলো। তট জলদি গাড়ির কাঁচ খুললাম। কাঁচের ফাঁক দিয়ে মুখ হেলিয়ে দিতেই বমি করে দিলাম। গাড়ি তখন চলন্ত। আদ্রিতা চিৎকার করে গাড়ি থামাতে বলল। রৌধিক কিছু বলার নিমিত্তে পেছনে ফিরতেই থেমে গেল। নিঃপলক ভঙ্গিতে চেয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিল। অন্য দিকটার কাঁচ খুলে বাইরে তাকিয়ে মৃদু শব্দে বলে, “ঢং।”
“ভাইয়া তুই দেখতে পাচ্ছিস মেয়েটা অসুস্থ। তবুও বলছিস ঢং। কী দিয়ে গড়া তুই?”
আদ্রিতা ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে এগিয়ে দিল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। আমি পানির সাহায্যে কুলি করে বললাম,
“আমি তো ঢং করছি, তুমি কেন বুঝতে পারছ না আদ্রিতাপু। তোমার ভাই এতো সুন্দর বুঝে গেল, তার বোন হয়ে তুমি বুঝতে পারছ না?”
কথার মাঝে ফোড়ন কেটে বলে ইভু,
“থামো তো তোমরা! আগে বল, তোমার কী হয়েছে?” [আমাকে উদ্দেশ্য করে ইভু]
“বেশিক্ষণ না-খেয়ে থাকলে এমন হয়। তবে এতটা হয়না, তোমার ভাই ঢং মনে করে ধাক্কা দেওয়ার পরে এমন হচ্ছে।”
আমার কথার মাঝে রৌধিক নেমে গেল। বিকট শব্দে দরজা বন্ধ করে দিল। কেঁপে উঠলাম আমি। আমার পাশের দরজা খুলে গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
“নামো!”
পরক্ষণেই হাত ধরে টেনে নামালেন। ভারসাম্য বজায় রাখতে গাড়ি ধরে দাঁড়ালাম। রৌধিক এবার আমায় তার বুকের সাথে জড়িয়ে নিলেন। সরে আসার প্রয়াস করলাম। রৌধিক ছাড়ল না। ইভুকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” তোমরা যাও, আদ্রিতাকে বাড়িতে পৌঁছে দিও।”
আমাকে নিয়ে উল্টো পথে হাঁটা দিলেন। আমি বুক থেকে মুখ তুলে বিরবির করে বললাম, ” বিশ্বাস করুন, মাথাটা প্রচুর ব্যাথা করছে। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। সত্যি বলছি, আমি আর একটি কথাও বলব না। প্লীজ!”
“আশেপাশে কোনো দোকান এই সময়ে খোলা নেই। সামান্য একটু দূরে টঙ্কের দোকান খোলা আছে। সেখান থেকে কিছু খেয়ে নিতে হবে। তারপরে বাড়ির পথে হাঁটা ধরবো।”
মিনিট পাঁচেক পর আমরা এসে উপস্থিত হলাম দোকানের সামনে। অনেক অনেক খোদ্দেরের ভিড়। রৌধিক আমাকে নিয়ে বেঞ্চিতে বসলেন। দু’কাপ চা এবং বনরুটি অর্ডার করলেন। আমাকে বসতে বলে চলে গেলেন তিনি। দক্ষিণা হাওয়াতে ফুলের সুবাস আসছে। তবে ভিড়ের কারণে সুবাস ঠিকভাবে কানের দোরগোড়ায় পৌঁছাচ্ছে না। এতো ভিড় দেখে আমার মনে অনেক প্রশ্ন,
আচ্ছা, এরা কী রাতে ঘুমায় না। আচ্ছা, এই দোকানটা কতক্ষণ খোলা থাকে? রৌধিক এই দোকানে সন্ধান পেল কোথায়? রৌধিক গেল কোথায়? ফুলের সুবাস কোন দিক থেকে ভেসে আসছে? ইত্যাদি! ইত্যাদি!
ধীরে ধীরে রাত গভীর হতে গভীরতর হচ্ছে। রাস্তাঘাট জনশূন্য হয়ে পড়ছে। শীতলতা ক্রমশ বাড়ছে। ঘড়ির কাঁটা টিক টিক করতে করতে চারটার ঘরে পৌঁছেছে। থেমে যায়নি। সে নিজের মতো চলছে। চায়ের দোকান বন্ধ করে চলে গেছে। ফজরের আযান পড়েছে। আমি এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। রৌধিকের দেখা নেই। আমাকে একা রেখে কোথায় গেছে সে। এই শহরটা আমার শহর হলেও তেমন চেনা নেই। কখনো এদিকটায় এসেছি বলেও মনে পড়ছে না। আমার চোখের অশ্রু গড়াল। চায়ের কাপ দু’টো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে নির্ঘাত। ফোন সঙ্গে আনিনি যে, রৌধিককে ফোন করব। মাথা ব্যাথাটা চাড়া দিয়ে উঠছে ক্রমশ। টাকা নেই সাথে। আমি তো ভেবেছিলাম, না খেয়ে থাকলে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি, এটা শোনার পর রৌধিক আমাকে কিছু খাওয়াতে নিয়ে এসেছে। কিন্তু আমাকে ভুল প্রমাণ করে দিলেন। আমাকে কথা বলতে বারণ করার পরে, কথা বলেছি বলে এভাবে ফেলে রেখে গেছে।
আমি আপনাকে জীবনেও ক্ষমা করব না রৌধিক। কখনো না।
ড্রাম থেকে পানি তুলে মুখে ছিটিয়ে নিলাম। জানা না, কোন দিকে যাবো। তবুও যেদিক থেকে এসেছিলাম সেদিকেই পা বাড়ালাম।
আশেপাশে কেউ নেই। শুনশান রাস্তাঘাট। শাড়ির আঁচল চেপে সামনে দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। হাত পা ছুলে যাওয়ার ফলে জ্বলছে প্রচুর। টান করতে পারছি না। কিছুদূর এগুতেই কয়েকজন যুবকের দেখা পেলাম। তাদের সুবিধার মনে হলো না। কুচকুচে কালো গায়ের রং। চুলগুলো বড় বড়। কোঁকড়ানো চুলগুলো পাখির বাসার মতো। কাক দেখলেই যখন তখন ডিম পাড়তে চলে আসবে। ফিক করে হেসে ফেললাম আমি। অতঃপর আমার হাঁটা ধরলাম। পিচের রাস্তায় হাঁটার ফলে খ্যাচ খ্যাচ শব্দ হচ্ছে। পায়ের শব্দ বাড়তে লাগল। ছেলেগুলো স্থির রইল না। আমার পিছু পিছু আসছে। পায়ের গতি বাড়িয়ে দিলাম। আমার পায়ের সাথে তাল মিলিয়ে তারও হাঁটতে লাগল। আমার ছুঁই ছুঁই। উপায়ন্তন না পেয়ে সর্বশক্তি দিয়ে ছুটলাম। তারাও ছুটল। দূর্বল শরীরটা বেশিক্ষণ দৌড়াতে পারল না। ভারসাম্য হারিয়ে রাস্তার মাঝে মুখ থুবড়ে পড়লাম। ততক্ষণে তারা আমাকে ঘিরে ফেলেছে। ভয়ে ক্রমশ শরীর কাঁপছে আমার। তৎক্ষণাৎ একটা বাইক এসে রাইণ্ড করে চারপাশে। আমি ঘনঘন শ্বাস নিতে নিতে সামনের দিকে তাকাতেই অপ্রত্যাশিত মানুষটিকে দেখতে পেলাম। ভয় ডর এক নিমিষেই মিলিয়ে গেল। রৌধিক বাইক থেকে না নেমে হেলমেট খুলল। হাতে রেখেই বললে,
“আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি উঠে এসো। ফিরতে হবে।”
অভিমানে নত হলাম আমি। এক মুহুর্তের জন্য মনে হলো, এই মানুষটির সাথে যাওয়ার চেয়ে এদের সাথে থাকা অনেক ভালো। হয়তো কেউ আমাকে চায়। হোক সেটা দেহের প্রয়োজন। আমার ভাবনার মাঝেই ফোড়ন কেটে বলে উঠল একজন ছেলে,
“ও যাবে না, তুই যা। যদি তুই স্বইচ্ছায় যেতে না চাস সমস্যা নেই। আমরা পাঠানোর ব্যবস্থা করব। তবে বাড়িতে না সোজা হসপিটালে নয়তো কবরে।”
“দেখ তোদের সাথে কথা বলে সময় নষ্ট করার মতো সময় আমার নেই। তাই চুপচাপ মেয়েটাকে ছাড়। আমি ক্ষ্যাপলে থামাতে পারবি না।”
দু’টো ছেলে রৌধিককে ঘিরে ধরল। বাইকের উপর পা দিয়ে জোরে আঘাত করল। রৌধিক বাইক সমেত উল্টো হয়ে নিচে পড়লো। একপা বাইকের নিচে চাপা পড়ল। তা দেখে চোখজোড়া খিঁচে গ্ৰথণ করে নিলাম। আহ্ করে উঠলাম। রৌধিক রাস্তায় শুয়ে শুয়ে কাতরাচ্ছে। ছেলেগুলো রৌধিকের হাতে টা দিয়ে আঘাত করে বলে, “তুই না-কি ক্ষ্যাপে গেলে, থামানো যায় না। তাই ক্ষ্যাপার আগেই ফেলে দিলাম। এবার ফোট!”
রৌধিক কর্ণপাত করল না। বাইক ঠেলে উঠে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টা করল। হাঁটতে পারছে না। তবুও খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটছে। বাইক তুলে দাঁড় করাল। বাইকের ভেতর থেকে চেইন বের করল। একের পর এক ঘা দিয়ে যাচ্ছে সে। রক্তে জামা কাপড় ভেসে যাচ্ছে।
এক সময় সবাই আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। আমি উঠে দাঁড়ালাম। রৌধিক আমার দিকে না তাকিয়ে সোজাসুজি বললেন,
“এসো। সময় নেই আমার। তোমাকে তোমাদের বাড়িতে দিয়ে আসবো। আমাকে আবার ফিরতে হবে।”
আমি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। তিনি আমাকে আমাদের বাড়িতে রেখে আসবেন। তারজন্য নিতে এসেছেন, না-কি দায়মুক্ত হতে এসেছেন? আমি উল্টো পথে হাঁটা ধরলাম। রৌধিক বাইক নিয়ে সামনে এসে পথ আঁটকে দাঁড়ালেন। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“উঠবে না-কি উঠবে না। না উঠলে সমস্যা নেই। এখানেই ফেলে চলে যাবো। এরা নিজেদের প্রয়োজন মেটাবে তোমাকে দিয়ে।”
অশ্রুসিক্ত হলো নয়ন। মানুষের প্রতি একটু সহানুভূতি নেই। আমি তার স্ত্রী, সেটা না-হয় বাদ দিলাম। পরিচিতা তো। কিভাবে তিনি এইসব বলছেন?
“আমার চিন্তা আপনাকে করতে হবে না। আগে যখন চিন্তা করতে আসেন নি। এখনো প্রয়োজন নেই। আমি ঠিক চলে যেত পারব।”
ভ্রু কুঁচকালেন তিনি। বাইক থেকে নেমে এলো। ফট করে আমাকে কোলে তুলে নিলেন। বাইকে বসিয়ে দিলেন। ছাড়লেন না। বরং পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে রইলেন। সেভাবেই বাইক স্টার্ট দিয়েন। আমি ছাড়ার চেষ্টা করলে দৃঢ় করে নিচ্ছে হাতের বন্ধন। পাত্তা না দেওয়ার ভাব। বিনিময়ে হাত এবং পায়ের ব্যাথা বাড়ছে। তাই চুপ করে রইলাম। কোনো কথা বলি নি। না নড়াচড়া করেছি।
আমাদের বাড়ির সামনে এনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে চলে গেল। যেন রাজ্যের কাজ পড়ে আছে। একবার ভালো করে তাকায় অব্দি নি। আমি শূন্য পথের দিকে আশাহত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। এটাই কী আমার নিয়তি। আমি এলোমেলো পা জোড়া দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। দরজা নক করার বেশ কিয়ৎক্ষণ পর জয়া এসে দরজা খুলে দিল। ঘুমু ঘুমু তার মুখ। আমাকে দেখে ভূত দেওয়ার মতো চিৎকার করে উঠল। এক দৌড়ে বাবার ঘরে। তৎক্ষণাৎ বাবা এসে হাজির হলো। আমাকে এই অবস্থায় দেখে বিচলিত হয়ে উঠল। কোনো প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়ার আগেই মিনমিনে স্বরে বললাম, ” বাবা আমি একটু ক্লান্ত। রেস্ট নিতে চাই।”
বাবা পথে ছেড়ে সরে দাঁড়ালেন। আমি ভেতরে ঢুকে অন্যরুমে চলে গেলাম। কাবার্ড থেকে পুরোনো জামা নিয়ে শাওয়ার ঢুকে গেলাম। শরীরটা বড্ড ক্লান্ত ঠেকছে। মিনিট দশেক পর রুমে ফিরে গা হেলিয়ে দিলাম বেডে।
তারপরে কেটে গেছে দু’দিন। রৌধিক নামক মানুষটা আমার কোনোরুপ খবর নেয়নি। একবারও ফোন করে বলেনি, খেয়েছ? ঘুম হয়েছে? কিচ্ছু বলেনি। কেন এমন করছেন তিনি। কেন বুঝতে পারেন না, আমার মনের অবস্থায়? তার দেওয়া আঘাতে জর্জরিত আমার বিক্ষিপ্ত মন। খাওয়া দাওয়া এখন অফশনার সাবজেক্টের মতো। ইচ্ছে হলে করলাম নতুবা করলাম না। বেশ কয়েক জায়গায় ইন্টারভিউ দিয়েছি। কোনো কাজ হয়নি।
.
আজকে ভার্সিটিতে এসেছি। মন ভালো রাখার ছোট একটা উপায়। আমি বসে আছি বড় আমগাছটার নিচে। আমার পাশে বসে আছে অহি। তার মনে অনেক প্রশ্ন। কিন্তু আমার জবাব নেই। চোখজোড়া বইয়ের মাঝে নিবদ্ধ করে লোকদেখানো পড়ছি। কিছুই মাথায় ঢুকছে না। আমার এরুপ অবস্থা দেখে ফোড়ন কেটে বলে অহি,
“এমন ভাবে পড়ছিহ, যেন সবকিছুই মুখস্থ হয়ে গেছে। অথচ কিছুই হয়নি। আমাকে দেখাতে হবে না। আমি জানি, একটা শব্দও মুখস্থ হয়নি তোর।”
“চেষ্টা তো করছি। মুখস্থ না হলে আমি কী করতে পারি। আশ্চর্য!” আমার ঝাঁঝালো জবাব।
“সামান্য একটা ব্যাপারে তুই সর্বদা হাইপার হয়ে যাস। অন্যের উপর রাগ আমার উপরে দেখাস। যা থাকবই না।”
মাথায় চপল মা’র’লা’ম আমি। রৌধিকের জন্য এই মেয়েটাকে সবসময় কথা শুনিয়ে দেই। তার সাথে পারার মুরোদ নেই।
অহির হাত ধরে থামিয়ে দিলাম। টেনে টেনে বললাম, “স্যরিরে!”
তবুও মেয়েটা গম্ভীর হয়ে রইল। ফিক করে হেসে দিলাম আমি। আমার সাথে অহিও হাসল। কেউ হাসলে অহি রাগ করে থাকতেই পারে না। বড্ড সহজ-সরল।
আমরা উঠে ক্লাসের দিকে পা বাড়ানোর আগে সেই মেয়েগুলো ঘিরে ধরল আমাদের। সেদিনের মেয়েগুলো। সিনিয়র বলে হয়তো আজকে সেদিনের কথা গুলোর প্রতিশো’ধ নিবে। আমি সরে যাওয়ার চেষ্টা করতেই সেদিক থেকেও ঘিরে ধরল। আমাকে বাঁধা দিয়ে তারাই বলতে শুরু করল,
“স্যরি আপু। আমরা সত্যিই দুঃখিত। মেয়ে হয়েছে আমাদের এমন ভাবে বলা উচিত হয়নি। আমাদের ভাবা উচিত ছিল, শত হোক আমরাও তো মেয়ে।”
“হ্যাঁ আপু। আমরা আপনাকে অনেক খুঁজেছি। কিন্তু পাইনি। প্লীজ আমাদেরকে ক্ষমা করে দিন।
আর কখনো এই ভুল হবে না।”
[চলবে.. ইনশাআল্লাহ]