অনুবদ্ধ আয়াস পর্ব-৩১+৩২

0
600

#অনুবদ্ধ আয়াস
#ইফা আমহৃদ
পর্ব:৩১+৩২

নোংরা টি শার্ট গায়ে জড়ানো। বিশ্রী গন্ধে গাঁ ক্রমশ গুলিয়ে উঠছে। তবুও এই টি শার্টটা খুলতে ইচ্ছে করছে না। সাতদিন হয়েছে ধোয়া হয়না। ধুলেই রৌধিকের শরীরের তীব্রতম সুবাসটা মিলিয়ে যাবে। বাইরে ঝিরিঝিরি ধারায় বৃষ্টি আঁচড়ে পড়ছে। বজ্রসহিত বৃষ্টি। অর্থাৎ কালবৈশাখী ঝড়। আমি ভারাক্রান্ত অন্তঃকরণ নিয়ে বসে আছি। রৌধিকের সাথে কথা হয়না বললেই চলে। তিনি সচরাচর ‌ফোন দেয় না। সপ্তাহ পেরিয়েছে তিনি গমন করেছেন। অফিসের বদ্ধ কার্যের মাঝে আমাকে ফোন দিয়ে দুই মিনিট কথাও বিশাল ব্যাপার। রৌধিকের পাঠানো টাকার বিনিময়ে বাড়ি ছাড়ানো হয়েছে ব্যাংকের থেকে। আগামীকাল থেকে বাড়িতে ফিরে যাবো।

হুট করেই বৃষ্টিস্নাতে সর্বাঙ্গে লেপ্টাতে স্পৃহা প্রকাশ পেল। আমি দ্রুত ছাদে চলে গেলাম। বর্ষন ধারা প্রখর হল। আর্দ্র মেঝেতে পা স্পর্শ করতেই কম্পিত হল দেহ। বৃষ্টির ধাঁচ ভিজিয়ে তুলল আমায়। আমি মাটিতে আসন পেতে বসলাম। রৌধিক নেই, আমার প্রাণটাও যেন নেই। যাওয়ার পূর্বে স্মৃতিগুলো এতোটা প্রখর করেছেন, যে মুহুর্মুহু তাকে অনুভব করছি। আমি নেত্রযুগল গ্ৰথণ করে সোজা হয়ে শুয়ে পড়লাম। বৃষ্টির ফোঁটা সরাসরি পতিত হল মুখশ্রীতে। কতক্ষন ওভাবে শুয়ে ছিলাম জানিনা। যখন চোখ মেললাম তখন নিজের অস্তিত্ব সিলিং ফ্যানের নিচে উপলব্ধি করি। আমাকে কেন্দ্র করে রয়েছে সকলে। এখানে আসার কারণটা বোধগম্য হল না। আমার পিটপিট করা নেত্র দেখেই মা বললেন,

“জোনাকি ঠিক আছিস তুই? কী হয়েছিল তোর মা? ছাদে গিয়েছিলিস কেন? ওভাবে পড়ে ছিলিস কতটা ভয় পেয়েছিলাম, জানিস?”

“মা, চুপ করবে তুমি। মেয়েটা সবে চোখ মেলেছে ইতোমধ্যেই তুমি শুরু করে দিলে। দিলে তো দিলে একসাথে এতগুলো প্রশ্ন।”

মা নিশ্চুপ আদ্রিতার কথায়। গাঁ পুড়ে যাচ্ছে। গলাও শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। আমি ধীরে ধীরে শুধালাম, “পানি, পানি খাবো।”

তৎক্ষণাৎ আদ্রিতা পানির গ্লাস দিয়ে নিজেই পানি পান করতে সহায়তা করেন। নিজের দিকে অবলোকন করতেই দেখতে পারলাম ব্লাঙ্কেট দিয়ে পেঁচিয়ে রেখেছে আমায়। মায়ের কোলে মাথা রেখে আছি। নিশ্চয়ই জামা কাপড় চেঞ্জ করেছে, তাহলে রৌধিকের কি শার্টটা কোথায়? পরক্ষণেই বিচলিত হলাম।

“আমার পড়নের টি শার্ট কোথায়?”

“কেন ওটা পড়তে ইচ্ছে করছে, তাহলে পড় গিয়ে। ব্যালকেনিতে মেলে রেখেছি। নিয়ে আসব?”

মুখ কৃষ্ণের ন্যায় কালো করে রইলাম। আমি জানি আদ্রিতা আপু আমাকে বিদ্রুপ করছেন। মা তো বলেই দিয়েছে, রৌধিককে ফোন করে আমার বর্তমান অবস্থার কথা জানাবেন। একবার রৌধিকের কাছে খবর পৌঁছে গেলে অবিলম্ব এসে হাজির হবেন তিনি। আমি অনেক জোর করে অবশেষে ব্যাপারটা ওখানেই ধামাচাপা দিলাম।
___
এভাবে গড়িয়ে গেল মাসখানেক। নিজের মনমর্জি চলছি। চারিদিকে সবকিছু বিষাদ পূর্ণ রৌধিকহীনা। দূরে থাকলেও সর্বদা তিনি আমার মনে বিরাজ করেন। আমাকে সর্বদা হাসিখুশি রাখতে আদ্রিতার বিয়ের তোড়জোড় করছেন। আজ আদ্রিতা আপুর শপিংয়ে নিমিত্তে বেরিয়েছে সবাই। আমাকে শতবার বলার সত্বেও যাইনি। এত আনন্দময় পরিবেশের মাঝে মন কষাকষি সর্বদা থাকে। আমার মনে শান্তি নেই, খাওয়াতে অনিয়ম না হওয়ার সত্তেও শরীরটা ক্রমাগত মন্দের দিকে ধাবিত হচ্ছে। মাথা সর্বদা ধরে থাকে। উগ্র মেজাজের সঙ্গি আমি। হ্যাঁ। বলাই তো হল না, আমরা এখন আমাদের বাড়িতে থাকি। আজ একটু বেশিই মন খারাপ। নিদ্রা ভঙ্গের পর থেকেই মনের মাঝে কু ডেকে চলেছে।
সেদিনই পরই ঐবাড়ি থেকে চলে এসেছি। এরমাঝে ঘটে গেছে অন্যরকম একটা ঘটনা। একটা খবর বদলে দিয়েছে আমায়।

এইত সেদিনের কথা, আদ্রিতা আপু তৈরি হচ্ছিল। তার সাজ অন্তের পথে। ইয়ানাত আপু সাজিয়ে দিচ্ছেন আদ্রিতা আপুকে। আমিও একটা গোলাপী রঙের শাড়ি পড়েছি। তেমন সাজ নেই। নিচে সকলে বসে খোষ গপ্পে মেতেছিল। ডাক পড়ল মিতা আন্টির। ইয়ানাত আপু ধরে ধরে নিচে দিকে অগ্রসর হলেন। আমি পা বাড়ানোর পূর্বেই ফোন বেজে উঠল। আমি চরণজোড়া স্থির করে হাতে রক্ষিত ফোনের দিকে চাইলাম। রৌধিক ফোন করেছেন। মুহুর্তেই হাসির রেখা ফুটে উঠল। চটজলদি ফোনটা রিসিভ করতেই অপর পাশের উগ্র কণ্ঠে বলে,

“সমস্যা কী তোমার? লাইনে এসো জলদি।”

আমি ইন্টারনেট কানেকশন অন করতেই কান ফেটে যাওয়ার উপক্রম। একের পর এক ম্যাসেজ। কল আসছে। তৎক্ষণাৎ তুমুল শব্দে ফোন বেজে উঠল। আমি ফোন রিসিভ করলাম না। ভিডিও কল ছিল। কেটে গেল। পরক্ষণেই ভয়েজ এলো রৌধিকের। বাজখাঁই কণ্ঠে বলেছেন,

“ফোনের টাকা কী তোমার শ্বশুর দেয়? ধরছ না কেন?”

পুনরায় কল বেজে উঠল। আমি ধরফরিয়ে রিসিভ করলাম। টেনে হাসলাম।

“একটা ফোন রিসিভ করতে কতক্ষন লাগে?”

“সে যাই হোক। টাকা কিন্তু আমার শ্বশুরই দেয়।”

“হোপ। একদম চুপ। তোমার শ্বশুর কী গাছ লাগায়? লাড়া দিবে আর ঝড়বে? আমি দিনরাত পরিশ্রম করি, বুঝছ?”

“সে যাই হোক, আমার জামাইয়ের টাকা আমি নষ্ট করি। আপনার তাতে কী?”

রৌধিক ফোনের ওপাশ থেকে এক গাল হাসলেন। অতঃপর গম্ভীর গলায় বলেন, শাড়ি পাল্টে নিতে।‌ আমাকে না-কি আজও শাড়ি পড়ে ফুটবলের মত লাগছে। পাক্কা দশ মিনিট সময় দিলেন, পাল্টে নেওয়ার জন্য। খবরদার বলেছেন। সরাচার খবরদার শব্দটি উচ্চারিত করেন না। তবে ইদানিং করছেন। একেই তো শরীর ভালো লাগছে তার উপরে তার আদেশ। আমি দ্রুত রুমে গিয়ে একটা থ্রী পিস বের করে‌‌ পড়ে নিলাম। কাঁটায় কাঁটায় যখন দশ মিনিট অতিবাহিত হল, এক সেকেন্ডও এদিক ওদিক নড়াচড় নয়। তখনই ফোন করলেন রৌধিক। ফোন নিয়ে নিচে যেতে বললেন।

বিলম্বে তিঁতকুটে ঢেকুর উঠল। আমি দ্রুত মুখ চেপে ধরলাম। রৌধিক চ্যাঁচিয়ে উঠলেন, “ওয়াট হ্যাপেণ্ড জোনাকি? কী হয়েছে?”
প্রতুক্তি দেওয়ার ন্যায় শক্তিটুকু অবশিষ্ট নেই। আমি ফোনটা ফেলে ওয়াশরুমে ছুটলাম। লহমায় বমি করে ভাসিয়ে দিলাম। মাথা ঘুড়ছে, তবে একটু ভালো লাগছে। ট্যাপ খুলে কুলি করলাম। মাথায় পানি দিলাম। অতঃপর পরিষ্কার করে ঘরে ঢুকলাম। টাওয়াল দিয়ে মাথা মুছতে নিলাম। এখনও রৌধিক কলে আছেন। আমাকে দেখেই জোনাকি জোনাকি বলে ডেকে উঠলেন। আমি ফোনের কাছে যেতেই ধমকে উঠলেন তিনি!

“খাওয়া দাওয়া করো না তুমি। শরীর দুর্বল লাগছে নিশ্চয়ই। বমি হয়েছে?”

“হম। তবে এখন ঠিক আছে।”

“আমি ওখানে থাকলে ঠিক থাকতে পারতে না। চড়িয়ে তোমার দাঁতগুলো ফেলে দিতাম।
কিছু খেয়েছ?”

“হম। তাহলে কেন এমন হল? পেইন কিলার আছে?”

না বলতেই ধমকে উঠলেন তিনি। পেইন কিলার কেন নেই হ্যান ত্যান ইত্যাদি ইত্যাদি। আবারও দশ মিনিট সময় দিয়েছে। লাইনে রেখেছেই মায়ের কাছে গিয়ে ফোনটা দিতে হবে। যা বলার তিনিই বলবে। আমি মুখ গোমড়া করে অগ্ৰসর হলাম সামনের দিকটায়। সম্পূর্ণ পথ অতিক্রম করতে ব্যর্থ হলাম। কিছুদূর যেতেই মাথা ঘুড়ে উঠল প্রচণ্ড। সিঁড়ির রেলিং ধরলাম ফটাফট। অন্ধকার দেখছি সবকিছু। রেলিং মাথা ঠেকিয়ে শ্বাস প্রশ্বাস টানলাম। অতঃপর জ্ঞান হারালাম। যখন জ্ঞান ফিরে তখন আমারে ঘিরে দাঁড়িয়ে ছিল তাঁরা। কেউ কিছু বলছে না। নিশ্চিত মুখশ্রী প্রত্যেকের। ইভু হেসে বলে,
“সুখবর টা আগে কাকে দিতে চাও? নিজের পরিবারকে না-কি রৌদুকে?”

“মানে!” মিনমিনে গলা আমার।

“এই, আমি মামা হতে চলেছি!”

কিংকর্তব্যবিমূঢ় হলাম আমি। তার মামা হওয়ার সাথে আমার সম্পর্ক কিসের? পরক্ষণেই মস্তিষ্কে এসে হানা দিল। আমি মাথানত করে রইলাম। বড়রা আশির্বাদ করলেন। আদ্রিতা আপু তো চূড়ান্ত খুশি। একই দিনে দু’টো খুশির খবর। আমি শুধু পেটে হাত রেখে চোখজোড়া বন্ধ করে বসে ছিলাম। কার্নিশ গড়িয়ে জলকণা গড়াল। অনুভূতিরা পূর্ণতা পেল। আচ্ছা রৌধিক তিনি জানলে খুশি হবেন তো! নিশ্চয়ই হবে। তবে আমি তাকে বলব না, একদম বলব না। আমি স্বচোখে দর্শন করতে চাই।

“প্লীজ আপনারা কেউ ওনাকে কিছু বলবেন না। তিনি দেশে ফিরলে আমি বলব।”

“কিন্তু ভাইয়া ইতোমধ্যে অনেকবার ফোন করেছে। কী বলব তাকে।”

প্রতুক্তি করলাম না। সেদিনের পর থেকে নিজের প্রতি যত্নটা হাজার গুণ বেড়ে গেছে। রৌধিককে সময় দেওয়া কমে গেল। হুট করে বদলে যেতে শুরু করলাম। বাড়ির সকলে একটু বেশিই যত্ন নিতে শুরু করেছে।
.
.
বর্তমানে আমি ফোনে গেমস খেলছি। রৌধিকের সাথে কথা হয়নি। তিনি জানেন না, আমার প্রেগন্যান্সির কথাটা। হুট করেই ফোন বেজে উঠল। অপরিচিত নাম্বার দেখে রিসিভ করলাম না। আমার বেজে উঠল। আমি দ্বিধা নিয়ে রিসিভ করতেই মহিলা কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম।

“এটা কী রৌধিকের ওয়াইফের নাম্বার?”

“হ্যাঁ। কিন্তু আপনি কে?”

“আমি হসপিটাল থেকে বলছি। রৌধিক নামক একজন যুবক হসপিটালে ভর্তি আছেন। আমি তার ফোন থেকে নাম্বার কালেক্ট করে ফোন দিয়েছি।”

আমার স্থির দৃষ্টি নিবদ্ধ মেঝেতে। ফোনটা হাত ফস্কে আঁচড়ে পড়েছে ইতোমধ্যে। বাঁধ ভেঙেছে নেত্রযুগলের। বর্ষণ হচ্ছে অবিরাম। হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে। নিঃশ্বাস থমকাল। কথনগুলো গলায় দলা পাকিয়ে থেমে রইল। বাড়িতে কেউ নেই, সবাই শপিং মলে গেছে। মস্তিষ্ক শূন্য। আমি মেঝে থেকে দ্রুত ফোন তুললাম। কয়েক খণ্ডে বিভক্ত হয়েছে। বালিশের পাশ থেকে ওড়না তুলে গায়ে জড়ালাম কোনোমতে। কাবার্ড থেকে পার্স বের করে ছুটলাম। ভুলে গেলাম আমার ছোট বেবীর কথাটা।

আকাশ মেঘের ঘন আঁধারে আবৃত হয়েছে। ইতোমধ্যে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ঝরছে। রাস্তা ঘাট জনশূন্য। কোন হসপিটালে রৌধিক আছেন, সেটাও জানি না। ফোন বের করে দ্রুত কল করলাম। রিসিভ হচ্ছে না। পরপর কয়েকবার ফোন করেও রেসপন্স পেলাম না‌। দেহটা ক্রমশ বরফাচ্ছন্ন হয়ে আসছে। কি মনে করে লোকেশন চ্যাক করলাম।
হসপিটালটা আমাদের বাড়ির থেকে ঘণ্টাখানেকের পথ। আকাশ অন্ধকারে আচ্ছন্ন আছে বিধায় রাস্তায় গাড়ি নেই। কিছুদূর অগ্রসর হতেই রিক্সা পেলাম। আগ পিছু না ভেবে রিক্সায় চড়ে বসলাম। ডাবল ভাড়ার লোভে রাজি হলেন।
ভিজে জবুথবু হয়ে গেছি আমি। শীতল হাওয়াতে ক্রমাগত কাঁপছি। যত সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে বৃষ্টির ধাঁচ যথারীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। কম্পনের মাত্রা বেড়ে গেল। ঘণ্টাখানেকের পথ দুই ঘণ্টায় এলাম। দ্রুত ভাড়া মিটিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। সবাই আমার দিকে অবাক চোখে চেয়ে আছে। হয়ত এমন অবস্থায় কাউকে হসপিটালে দেখে না। আমি ওড়না পেঁচিয়ে রিসেপশন দিকে এগিয়ে গেলাম। মেয়েটা আমার দিকে অবাক চোখে চেয়ে থেকে থেমে থেমে বলেন,

“ম্যাম আপনি ভিজে গেছেন‌ তো। জামা কাপড় সাথে থাকলে চেঞ্জ করে নিন।”

“আ আমি ঠিক আছি। আগে বলুন, একটু আগে কেউ আমাকে এই হসপিটাল থেকে ফোন করেছিল। বলেছিল, আমার হাসব্যান্ড এই হসপিটালে ভর্তি আছে।”

অতিশয় যাতনায় কথাগুলো বলি আমি। বলার সময় প্রচণ্ড কাঁপছিলাম আমার। তিনি লিস্ট বের করে নাম জিজ্ঞেস করলাম। রৌধিক নামটা উচ্চারিত করতেই বুকটা কেঁপে উঠল। তিনি লিস্ট চ্যাক করে বলেন,

“রৌধিকের ডেডবডি তো কালকে নিয়ে গেছে।”

ব্যাগটা হাত ফস্কে নিচে পড়ল। ঘনঘন শ্বাস নিতে নিতে বলি,
“মানে? কীসব যাতা বলছেন? একটু আগে আমাকে‌‌ ফোন করে বলে, রৌধিক হসপিটালে।”

“স্যরি ম্যাম রৌধিক নামের কেউ নেই হসপিটালে। যিনি ছিলেন, গতকাল তিনি মারা গেছেন। ও হ্যাঁ। তার জিনিস পত্র পড়ে আছে, নেয়নি। দাঁড়ান, আমি আনিয়ে দিচ্ছি।”

রিসেপশনের মেয়েটা কাউকে ফোন করলেন। মিনিট পাঁচেক পর একটা ওয়ার্ডবয় এলেন ব্যাগপত্র নিয়ে। কিৎকর্তব্যবিমূঢ় আমি। এটা তো রৌধিকের লাকেজ। চটজলদি লাকেজের চেইন খুললাম। রৌধিকের জামা কাপড়গুলো ভাঁজে ভাঁজে রাখা। নিঃশ্বাস ক্রমশ বন্ধ হয়ে আসছে। মাথা ঘুড়ছে। ভারসাম্যহীন হয়ে বসে পড়লাম আমি। ভিড় জমে গেছে। বাকরুদ্ধ হলাম। কী করা উচিত ভুলে গেলাম সবকিছু। ঘণ্টাখানেক নিশ্চুপ হয়ে অবশেষে মস্তিষ্ক হার মেনে নিল। জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। ধীরে ধীরে সবকিছু ঝাঁপসা হয়ে এলো। মৃত্যু কামনা করলাম তীব্রভাবে। কিন্তু আদৌও কী সম্ভব তা।
.
জ্ঞান ফিরতেই নিজেকে সিলিং ফ্যানের নিচে উপলব্ধি করলাম। মাথার উপরে ভনভন শব্দে ফ্যান ঘুরছে। বাম হাতে স্যালাইনের ক্যানেল লাগান। হুট করেই আমার বেবীর কথাটা মস্তিষ্কে হানা দিল। ধরফরিয়ে উঠে বসলাম। পেটে হাত রেখে ফুঁপিয়ে উঠলাম। রৌধিক জানতেই পারল না, তার পুঁচকুর কথা। পাশের টেবিলে আমার পার্স আর ভেজা জামা কাপড় রাখা। জামা কাপড় শুকিয়ে গেছে। ফোনটাও পড়ে আছে।আমি দ্রুত ফোন নিয়ে আদ্রিতা আপু ফোনে কল করার প্রয়াস করলাম। ইতঃপূর্বে আদ্রিতা আপু বেশ কয়েকবার ফোন করেছেন। ফোনের স্ক্রিনে অবলোকন করতেই নজরে এলো পাঁচটা পঁয়তাল্লিশ। চমকে উঠলাম আমি। ভিশন চমকালাম। বাড়ি থেকে যখন বেরিয়েছিল তখন সময় ছিল দশটা নাগাদ। এতক্ষণ আমি জ্ঞানহীন, অচেতন অবস্থায় পড়ে ছিলাম।

আদ্রিতা আপুর নাম্বারে ফোন করতেই রিসিভ করলেন। কিছু বলার উদ্যেগ নিতেই আমি ধীরে ধীরে শুধালাম,

“আদ্রুপু।”

আর বলতে পারলাম না। ঢুকরে কেঁদে উঠলাম। ওপাশ থেকে বিচলিত হলেন আদ্রিতা আপু। পরপর বললেন,

“ওয়াট হ্যাপেণ্ড জোনাকি? কাঁদছিস কেন? কোথায় তুই? না বলে কোথায় গেছিস? কতবার ফোন করেছি, ধারণা আছে তোর? একবারও ফোন ধরলি না।”

এতগুলো প্রশ্ন শুনে ঘাবড়ে গেলাম আমি। বারবার ঝাঁপসা দেখছি। কীভাবে ওনার কথা বলব। পুনরায় কেঁদে উঠলাম,

“আদ্রুপু।”

“জোনাকি, বোন আমার। কাঁদছিস কেন? ভয় পেয়েছিস? বাবু ঠিক আছে? কিছু বল?”

ওষ্ঠদ্বয় কিঞ্চিৎ ব্যবধান করে কিছু বলতেই প্রয়াস করলেই ফোনটা হাতছাড়া হয়ে গেছে। মানুষটিকে দেখার উদ্বেগ প্রকাশ করলাম। পাশ ফিরতেই রৌধিকের আঘাতপ্রাপ্ত মুখশ্রীতে দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো। আমি নিঃপলক। মানুষটি আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমার হাত থেকে ফোন নিয়েছে। আদৌও কী সম্ভব? ফোনে আদ্রিতা আপুকে বলছে,

” ও আমার সাথে আছে। তুই ফোন রাখ। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আমরা আসছি।”

“ভাই। তুই কোথায়। জোনাকি তোর কাছে কীভাবে? তুই দেশে ফিরে এসেছিস?”

“হ্যাঁ। এসেছি। রাখছি,‌ বাড়ি এসে বাকিটা বলছি।”

তিনি ফোন কেটে আমার পাশে বসলেন। আমিও এখনো ঘোরের মাঝে বিরাজমান। কাঁপা কাঁপা হাতজোড়া দ্বারা রৌধিককে স্পর্শ করলাম। এটা আমার হ্যালোসেলুশন নয়ত! না-কি স্বপ্ন। যদি স্বপ্ন হয়, তাহলে জনম জনম এটা স্বপ্ন হিসেবে থাকুক।

পরক্ষণেই আস্টে পিস্টে জড়িয়ে নিলাম রৌধিককে। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম। রৌধিক আমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। আমার কান্নার গতি তুলনামূলক বেড়ে গেল। আশ্বাসের স্বরে বললেন,

“জোনাকি কেঁদো না, দেখ এইত আমি। এমনভাবে কাঁদছ যেন, মরে গেছি আমি।”

দৃঢ় করে মুড়িয়ে নিলাম। অশ্রুমিশ্রিত কণ্ঠে বললাম,

“কী বলছেন এইসব? আপনার কিচ্ছু হবে না।”

“কিন্তু তুমি এমনভাবে কাঁদছ, মনে তো হচ্ছে আমি নেই।”

মুখ তুলে চাইলাম। অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিলাম তাকে। রৌধিক শুধু চেয়ে রইলেন। কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,

“আপনি না-কি অ্যাক্সিডেন্ট করেছেন?”

“আমাকে দেখে তোমার কি মনে হচ্ছে?”

রৌধিকের মাথায়, হাতে- পায়ে মোটা ব্যাণ্ডেজ। এমনকি ললাটের পাশ ঘেঁষেও মোটা ব্যাণ্ডেজ। আমি হাত ছুঁয়ে দিলাম। বললাম,

“ওরা বলছিল, আপনি, আপনি নাকি..

“মরে গেলে বুঝি খুশি হতে?”

আঙুলের সাহায্যে ওষ্ঠদ্বয় ঠেকিয়ে থামিয়ে দিলাম তাকে। মাথা নাড়িয়ে না-বোধক বোঝালাম। তৎক্ষণাৎ প্রবেশ করলেন নার্স এবং রিসেপশনিস্ট। হাসির আধো আধো রেখে টেনে বিনয়ী সুরে বলেন,

“স্যরি মিসেস জোনাকি। আপনাকে ভুল ইনফ্রম দেওয়ার জন্য। আসলে আপনার হাসব্যান্ড ভর্তিই হয়নি। অন্য রৌধিকের নাম ছিল। তিনি অ্যাক্সিডেন্টে মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি ভুলবশত তার নাম বলেছিলাম। দুঃখিত। আমি অনেক অনুতপ্ত। তবে আপনাদের স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসা দেখলাম। বেঁচে থাকুক এমন ভালোবাসা।”

আমি প্রত্যুত্তরহীন। তিনি প্রস্থান করলেন। আমি নির্বাক হয়ে রৌধিকের বুকে মুখ গুঁজে দিলাম। আঁকড়ে ধরে রইলাম। অনুভব করলাম, পূর্ণ আমি পূর্ণ। আমার ন্যায় সুখী বর্তমানে কেউ নেই পৃথিবীতে, কেউ নেই।

“সামান্য একটুতেই এই অবস্থা মিসেস রৌধিক। বলি সত্যিই যদি মরে যেতাম, তাহলে হয়তো একবিন্দুও শান্তি পেতাম না।”

“না। শান্তি দিতাম না। প্রয়োজনে আমি আগে চলে যাবো।”

“এভাবে বলো না, বুকে লাগে জোনাকি। অনেক কষ্টে তোমাকে ফিরে পেয়েছি আর হারাতে দিচ্ছে না।”
________
পাশাপাশি শুয়ে আছি আমি আর রৌধিক। ইভু ভাইয়াকে ফোন করেছেন তিনি। এলেই বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাবো। বাড়ির কেউ রৌধিকের অ্যাক্সিডেন্টের ব্যাপারে জানেন না। রৌধিক কড়া নিষেধাজ্ঞা। সবাই চিন্তা করবে। ইভু ভাইয়াকেও বারণ করে দিয়েছেন। রৌধিক আর আমার একার পক্ষে এই অবস্থায় বাড়িতে যাওয়া অসম্ভব। নাহলে ইভুকেও জানাতেন না।

ইভু ভাইয়া উপস্থিত হলেন। কীভাবে এক্সিডেন্ট করেছেন জানতে চাইলেন।
বাড়িতে ফেরার পথে উল্টোদিক থেকে গাড়ি এসে ধাক্কা দিয়েছে। অতঃপর ইভু ভাইয়া রিসেপশনে গেলেন। টাকা প্রে করে এলেন। অতঃপর আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য এলেন। রৌধিককে ধরে ধরে নিচ অব্দি নিয়ে গেলেন। আমিও ধরেছি একটু।

চলবে.. ইনশাআল্লাহ