অনুভবে তুই পর্ব-১৭+১৮

0
465

#অনুভবে_তুই
#লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৭

সারারাত ঘুম আসেনি আদ্রিশের চোখের পাতায়। ভোর রাতের দিকে কখন যে চোখ দুটো লেগে এসেছিল টের পায় নি। বিছানায় এলোমেলো ভাবে শুয়ে ঘুমে মগ্ন সে। ব্যলকনির খোলা দরজা দিয়ে সকালের মিষ্টি রোদ বিছিয়ে পড়েছে ওর বিছানার একাংশে, মেঝের কার্পেটে। শীতল উষ্ণ আবহাওয়া। চারদিকে ফুরফুরে হাওয়া বইছে। পাখিদের আনাগোনায় মুখরিত ব্যলকনি। সদ্য ফোটা গোলাপের সুগন্ধে ভুরভুর করে ভাসছিলো আদ্রিশের ঘরটা। হন্তদন্ত ফিহা যখন দ্রুতপদে ওর ঘরে এসে দরজায় টোকা দিতেই পুরো দরজাটাই খুলে গেল। ইতস্তত করে ঘরের ভেতর সামান্য উঁকি দিয়ে ঘুমন্ত আদ্রিশকে দেখে পা বাড়ায় রুমের ভেতর। ডাকবে কি ডাকবে না ভেবেই গলা খাকারি দেয় ফিহা। তারপর উচাটন কন্ঠে একটু জোরেই জিজ্ঞেস করে ওঠে, ‘ভাইয়া? এই ভাইয়া তুমি কী ঘুমে আছ?’

আদ্রিশের ঘুম বরাবরই পাতলা। কোনো নারীকন্ঠ কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই ঘোর কাটে ওর। ফিহার উত্তেজিত কন্ঠস্বর শুনতে পেয়ে পিটপিট করে তাকানোর চেষ্টা করে। আলসে ভঙ্গিতে হাতের তালুতে ভর দিয়ে বিছানায় ওঠে বসার চেষ্টা করতেই কাটা জায়গার ব্যথায় মুখটা বিকৃত হয়ে ওঠল। ফিহা জহুরি চোখে ওর বিকৃত মুখভঙ্গি লক্ষ্য করলো। অতি সূক্ষ্মভাবে বাম হাতের তালুতে শুকিয়ে থাকা রক্ত দেখতে পেয়েই আঁৎকে ওঠে বলল, ‘একি! কীভাবে কাটলো?’

আদ্রিশ ঘুমুঘুমু কন্ঠে বলল, ‘কিছুনা। তুই কী বলতে এসেছিস?’

ফিহা কিঞ্চিৎ রাগ নিয়ে ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল, ‘তোমার হাত কীভাবে কাটলো সেটা বলো আগে।’

আদ্রিশ গর্জে ওঠে বলল, ‘থাপ্পড় খেতে না চাইলে যেটা বলতে এসেছিস সেটা বল। নয়তো চোখের সামনে থেকে যা!’

ফিহা থমকে গেল। আদ্রিশ এতো কঠোর ব্যবহার কখনো করে নি ওর সাথে৷ ভাইয়ের মুড ‘ভালো নেই ভেবে ফিহা হতাশ হয়ে বলল, ‘সকাল থেকে রোজাকে পাওয়া যাচ্ছে না।’

আদ্রিশ রোজার নামটা শুনে কপালে ভাঁজ ফেলে তাকালো, ‘মানে?’

‘রোজাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।’

সামান্য বিরক্ত হলো আদ্রিশ। চোখেমুখে সেটা ফুটে ওঠলো। ব্যগ্র কন্ঠে সে বলে ওঠল, ‘পাওয়া যাচ্ছে না? ভালো করে খুঁজে দেখ ছাদে-টাদে পেয়ে যাবি।’

‘বুঝতে পারছো না ভাইয়া, রোজা কোথাও নেই। এমনকি ওর জামাকাপড়, বইপত্র কিচ্ছু নেই। কাউকে কিছু বলেও যায় নি।’

আদ্রিশ ভ্রু কুঁচকে তাকালো। কথাটা ওর বোধগম্য হচ্ছে না। ফিহা কি বলছে তার অর্থোদ্বার করে বিস্মিত হয়ে গেলো সে। চোখমুখে কাঠিন্যতা ছড়িয়ে পড়লো।
রাতের করা ব্যবহারটার জন্যই কি রোজা বাড়ি থেকে চলে গেল?

আদ্রিশ ভ্রু জোড়া উঁচিয়ে তাকালো, ‘একা একাই গেল?’

‘জানি না।’

‘উৎস কোথায়? ওকে গিয়ে বল খুঁজে দেখতে। আমার মন-মেজাজ ভালো না।’

‘ভাইয়া বাসায় নেই। সেজন্যই তো তোমার কাছে এলাম।’

আদ্রিশ তিক্ত কন্ঠে বলল, ‘আমার কাছে? আমি এক্ষেত্রে কী করতে পারি? তোর বোনকে কী বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছি? নিজের ইচ্ছেতে কোথায় গিয়েছে সেসব আমি জানবো কীভাবে? আমি কী ওর গার্ডিয়ান? নাকি আমাকে বলে গেছে? তোর কী মনে হয়?’

ফিহা ভয় ভয় কন্ঠে বলল, ‘তুমি একটু দেখবে না? মানে মেয়েটা কোথায় গেল না গেল? মা-চাচীরা চিন্তায় চিন্তায় তো কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে।’

আদ্রিশ কড়া গলায় বলে ওঠল, ‘আমি কী দেখবো? তোরা গিয়ে দেখ। আমাকে এসব বিষয়ে জড়াবি না। রাতে ঘুমুতে পারি নি। তোকে রিকুয়েষ্ট করতে পারবো না৷ মাথার কাছে ঘ্যানঘ্যান করলে থাপ্পড় খাবি। যেটা তোর একদমই পছন্দ হবে না। যা এখন, বিরক্ত করবি না।’

ফিহা মেঝেতে অবনত দৃষ্টি ফেললো। হতাশ হয়ে ধীরপায়ে আদ্রিশের ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। ও বেরিয়ে যেতেই শব্দ করে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দিলো আদ্রিশ। তারপর ফিরে এসে বিছানার হেডবোর্ডে মাথা হেলিয়ে বসলো। পানির গ্লাসে চুমুক দিতেই বিস্বাদ লাগলো। ঠাস করে বিপরীত দিকের দেওয়ালে ছুঁড়ে মারতেই গ্লাসটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। রাগে, বিরক্তিতে মাথা ধরে গেছে ওর। বারবার মাথায় বাজছে একটি কথা, ‘রোজাকে বাড়ির কোথাও পাওয়া যাচ্ছেনা।’ মানে শুধু একটাই। মেয়েটা বাড়ি থেকে চলে গেছে৷ কেউ না জানলেও আদ্রিশ জানে সে-ই একমাত্র এরজন্য দায়ী৷ কিন্তু ভুলটা কোথায় ছিল ওর? সে-তো সব সম্পর্কের বোঝাপড়া, বিচ্ছেদ কাল রাতেই করে ফেলেছে। আচ্ছা, মেয়েটা কি ওকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করছে? ওকে একটু ভালো থাকতেও দিবে না? এত অহংকার, অবিশ্বাস নিয়ে বাঁচে কীভাবে মেয়েটা? গত রাতের কথা কাটাকাটিকে কেন্দ্র করে সকলকে কাঁদিয়ে, চিন্তায় ফেলে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে? আর একেই নিজের বক্ষগহ্বরে আদুরে বেড়ালের মতো জড়িয়ে নিতে চেয়েছিল? আদ্রিশ শ্যেনদৃষ্টিতে ফোনটার দিকে তাকিয়ে অনিচ্ছাস্বত্ত্বেও ডায়াল করলো রোজার নাম্বারে। দু-বার সুইচড অফ বলার পরে আর চেষ্টা করলো না৷ উৎসের নাম্বারে চেষ্টা করলো এবং একসময় লাইন পেতে সফল হলো আদ্রিশ।

——————————————————

রোজাদের গ্রামের নাম হরষপুর। নামটির মতো গ্রামটি অবশ্য খুব বেশি বড় নয়। সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা বলাই যায়। আধুনিকতার ছোঁয়া তেমনভাবে এখনো না পৌঁছালেও গ্রামে কোনো খারাপ কাজের বালাই নেই৷ এখানকার বেশিরভাগ মানুষজনই বনেদি। অর্থসম্পদের কমতি নেই। তবে অহংকার, জিঘাংসাও নেই। মানুষজন সবাই মিলেমিশে শান্তিতে বসবাস করে। এর পেছনে অবশ্য চেয়ারম্যান আজিজুর রহমানের বড় একটি ভূমিকা আছে। বিগত বছরগুলোতে তিনি গ্রামের সরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন। সহানুভূতিশীল এবং গ্রামের মানুষের বিপদেআপদে এগিয়ে আসেন বলে গ্রামের মানুষজন তাঁকে খুব সম্মান করেন। চেয়ারম্যান পদের জন্য তিনিই একমাত্র সুযোগ্য বলে মনে করে গত নির্বাচনে একপ্রকার জোর করেই গ্রাম ও জনসাধারণের সেবা করার দায়িত্বটি তাঁর কাঁধে তুলে দেয় গ্রামবাসী। কাঁচা মাটির রাস্তা ধরে সোজা গেলেই চেয়ারম্যান আজিজুর রহমানের দোতলা বিশাল বাড়িটি নজরে পড়ে। তাঁর-ই একমাত্র মেয়ে রোজা। সকালে উঠোনে বসে পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠাতে চোখ বুলাচ্ছিলেন আজিজুর রহমান। নয়টার দিকে বাড়ির গেইট পেরিয়ে মেয়েকে ঢুকতে দেখেই ভড়কে যান তিনি। অবশ্য তাঁর মেয়ে একা আসেনি, সঙ্গে উৎসও আছে। অনেকদিন পর বাড়িতে ফিরে রোজার আনন্দের যেন সীমা রইলো না। অতিরিক্ত খুশিতে সে কেঁদেই ফেলল। চোখের সামনে বাবাকে বসে থাকতে দেখেই ছুটে আসে ও। প্রায় কয়েকমাস পর মেয়েকে দেখতে পেয়ে আজিজুরের চোখ দুটো খুশিতে চিকচিক করে ওঠে। বসা থেকে ওঠে দাঁড়িয়ে মেয়েকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নেন। কিন্তু এত সকালে কাউকে কিছু না জানিয়ে হুট করে বাড়ি চলে আসার পেছনে কোনো কারণ আছে কি-না বোঝার চেষ্টা করেন তিনি। ক্লান্ত উৎস খালুর সঙ্গে কুশল ও সালাম বিনিময় করেন। আজিজুর রহমান সালামের উত্তর দিয়েই জিজ্ঞেস করেন, ‘ব্যাপার কী? এত সকাল সকাল বাড়িতে? কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি?’

উৎস রোজার দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করে জবাব দেয়, ‘না না তেমনকিছুই না খালু। আসলে আপনাদের অনেকদিন দেখেনি তো, সেজন্য রোজার মন খারাপ। কাল-ই আসতে চেয়েছিল, আমি নিয়ে আসি নি।’

‘ওহ। তা তোমাদের বাড়ির সবাই ভালো আছে তো?’

‘জি খালু। সবাই ভালো আছে।’

‘নেহার বিয়ে ঠিক হয়েছে শুনলাম। আমাকে তো ফোন করে কতবার যেতে বললো, কাজের চাপে যেতে পারি না কোথাও। একেবারে বিয়েতেই যাব।’

‘হ্যাঁ, দোয়া করবেন খালু।’

‘পাত্র কেমন?’

‘পারিবারিক এবং চারিত্রিক দু’দিক দিয়েই ভালো আলহামদুলিল্লাহ।’

আজিজুর রহমানও সমস্বরে বলে ওঠলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ।’

তারপর বলে ওঠলেন, ‘এখনো দাঁড় করিয়ে রেখেছি। চলো ভেতরে চলো!’

উৎস বিনয়ের সাথে সায় জানালো, ‘জি চলেন।’

——————————————————————

বাড়ির মেয়ে শহর থেকে এতমাস পরে ফিরেছে শুনে রোজার মা-চাচীদের আনন্দের কমতি নেই। ইতোমধ্যেই বাজার থেকে ফ্রেশ শাক-সবজি, মাছ-মাংস নিয়ে আসা হয়েছে। মেয়ের পছন্দের রান্না চাপানো হয়েছে চুলাতে। বাড়ির গিন্নিরা সবাই ব্যস্ত বিভিন্ন কাজে। আজিজুর রহমান আর তার বড়ভাই একটা সালিশ মীমাংসা করতে গিয়েছেন। উৎস বসে আছে দোতলার ড্রইংরুমে। রোজা বাড়ি ফিরে প্রথমেই গোসল সেরে নিলো। অনেকদিন পর নিজের ঘরটাতে পা ফেলতেই শিহরণ বয়ে গেল। নিজেকে সামলে নিলো। ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়াতেই ক্ষত-বিক্ষত ঠোঁটজোড়া দৃশ্যমান হলো। কেমন রক্ত জমাট হয়ে আছে। আসার পথে মুখে মাস্ক থাকায় উৎসের নজরে পড়ে নি। কিন্তু এখন? বাড়ির এতগুলো লোকের সামনে কীভাবে যাবে সে? মিথ্যে বলা ছাড়া আর উপায় রাখেনি বজ্জাত লোকটা। রোজা বিষন্ন চেহারা নিয়ে রাগে জর্জরিত হয়ে গেলো। কোনোমতে চুলটা আঁচড়ে ব্যাগ থেকে জামাকাপড় বের করতে লেগে পড়লো রোজা।

ওদিকে চা-নুডুলস দিয়ে সকালের নাস্তা শেষ করে পকেট থেকে ফোনটা বের করলো উৎস। বাড়ির সবার অবস্থা কি কে জানে! চিন্তায় মাথার রগ দাপাদাপি করছে উৎসের। ফোনটা সুইচড অন করার সঙ্গে সঙ্গেই আদ্রিশের কল। স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করে রীতিমতো কাঁপতে লাগলো নামটি। উৎস ঢোক গিলে রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে শান্ত গলায় আদ্রিশ জিজ্ঞেস করল, ‘খবর জানিস?’

‘কীসের?’

‘তোর কাজিনকে পাওয়া যাচ্ছে না। তুই জানিস সে কোথায়?’

উৎস আমতাআমতা করে বলল, ‘আসলে ভাইয়া..’

আদ্রিশ গলা চড়িয়ে বলল, ‘কী?’

‘আসলে রোজাকে আমি ওর বাড়িতে নিয়ে এসেছি।’

আদ্রিশ উচ্চস্বরে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। যদিও ভেতরে ভেতরে চিন্তায় অস্থির হয়ে যাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল দম আটকে যাবে কিন্তু বাইরে সেটা ভুলেও প্রকাশ করে নি সে। নিজের মনকে কঠোর করার প্রাণপণ চেষ্টা করছিল যেন। শুধু নিরবে হেসে বলল, ‘শিওর হয়ে নিলাম। আর আসবে না তো?’

উৎস এ পর্যায়ে বলল, ‘না। আসবে না। এত অপমানের পরেও কেউ চাইবে না ওইবাড়ি ফিরে যেতে।’

আদ্রিশের মোটেও ধরা পড়ার ভয় ছিল না৷ কিন্তু হেসে হেসেই সে জিজ্ঞেস করল, ‘অপমান? তোর বোনের এত্ত অপমানবোধ তো ভালো না রে উৎস। পরে পস্তাতে হয়। সেল্ফ রেস্পেক্ট ভালো, তবে ওভার হয়ে গেলে কোনোমতেই ভালোর কাতারে পড়ে না৷ তোর বোনকে এটুকু জ্ঞান অন্তত দিয়ে দিস আমার পক্ষ থেকে।’

উৎস বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘কি বলছো ভাই তুমি? ফুপির ঘটনাটা জানো? আর জেনেও একথা বলছো তুমি? এটা তো ভীষণ অন্যায়।’

কথাটা শুনেই আদ্রিশের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। ফুপি? মানে ইশার মা সুহানা শেখ? ওনার প্রসঙ্গ এলো কোথা থেকে? তাঁরই ছোটভাই মাতৃতুল্য ফুফুকে নিয়ে ন্যায়-অন্যায়ের বিভেদ করছে! আদ্রিশ ভ্রুজোড়া কুঁচকে ব্যগ্র কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘কি করেছে ফুপি তোর বোনকে?’

উৎস ধাপে ধাপে পুরো ঘটনাটা খুলে বললো। সবটা শুনে আদ্রিশ হতবাক, হতবিহ্বল। তারমানে পুরো ঘটনাটার পেছনে ওর ফুফুর হাত আছে? অথচ সুহানা শেখকে নিজের মায়ের মতো ভালোবাসে। আদ্রিশ অনেক কষ্টে শব্দব্যয় করে জিজ্ঞেস করলো, ‘কে বলেছে এসব কথা তোকে?’

উৎস নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল, ‘আমাদের বাড়ির কাজে সাহায্য করে যে খালাটা, তাঁর কাছ থেকে জেনেছি। রোজা আমাকে এখনো খোলাসা করে কিছু বলে নি। পুরো বিষয়টাতে তুমি জড়িয়ে আছো, আচ্ছা সত্যিই কি তুমি রোজাকে পছন্দ করো ভাই?’

আদ্রিশের মাথা ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে ওঠছে। কোনোক্রমে উৎসকে বলল, ‘ফোন রাখ। বাড়ি ফিরে আমার সাথে দেখা করিস।’

______________________________________

চলবে…

#অনুভবে_তুই
#লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৮

তপ্ত অলস দুপুরের সোনালি সূর্যের ঘন আলোয় উদ্ভাসিত পৃথিবী। গ্রামীণ পরিবেশের মুগ্ধতা ছড়িয়ে আছে চর্তুদিকে। অদ্ভুত নীরবতার মাঝে রেইনট্রি গাছের ঝিঁঝিঁ পোকার কর্কশ আওয়াজ ত্যক্ত করে তুলেছিল দুপুরটাকে। সিমেন্টের মেঝে উত্তপ্ত হয়ে পা পুড়িয়ে দিচ্ছিলো রোজার। ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে সে। বাড়ির পেছনের ঘন জঙ্গল, ঝোপঝাড় থেকে দৈবাৎ হাওয়া এসে ওড়িয়ে দিচ্ছিলো ওর ঘন কেশ। চুলগুলো হালকা করে ঠেলে পেছনে সরিয়ে হাতখোঁপা বেঁধে কাঠের চেয়ারে বসে পড়লো সে। ছাদের অর্ধেকটা জুড়ে রয়েছে কাঁঠাল গাছের একাংশ। রেলিঙের ওপর বসে পাতা ছিঁড়তে ছিঁড়তে উৎস তীব্র কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘ফুপি যে তোকে এসব কথা বলেছে আমাকে জানাস নি কেন তুই?’

রোজা তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলল, ‘এসব তোমাকে কে বললো?’

‘যেখান থেকে হোক শুনেছি। তুই আগে আমাকে সত্যিটা বল। আমাদের বাড়ি ছেড়ে আসার পেছনে ওই একটা কারণই কি আছে?’

রোজা থমকে গেল, ‘মানে?’

‘তুই কি ছোট বাচ্চা রোজানু? আমি তোর কাছে পুরো ঘটনাটা শুনতে চাইছি। ফুপি তোকে কেন এত অপমানজনক কথা বললো?’

রোজা বিরক্ত হলো। এসব কথা উৎস জানলো কীভাবে? সে শক্ত কন্ঠে বলল, ‘এসবই তোমার প্রয়োজনীয় কথা? এজন্যই ছাদে ডেকেছিলে?’

‘হুম। কিন্তু তুই কথা এড়িয়ে যাচ্ছিস। হুট করে এত বড় হয়ে গেলি তুই? আমাকে নিজের ভাই মনে করিস না? তাহলে এত ভনিতা কেন তোর?’

রোজা বোঝানোর চেষ্টা করল, ‘ভাইয়া তুমি ভুল বুঝছো আমাকে। হ্যাঁ, এটা সত্যি। আমি তোমার ফুফুর বলা তিক্ত কথাগুলোর ভার সইতে না পেরে চলে এসেছি। কিন্তু তোমাকে আমি নিজের আপন লোক মনে করি।’

উৎস রাগী স্বরে বলল, ‘আমাকে একবারও জানালি না কেন? ফুপিকে বুঝিয়ে দিতাম তুই আসলে কে!’

রোজা হতাশ হয়ে বলল, ‘ঝামেলা তো আমার সাথে হয়েছে। তোমার সাথে না। শুধু শুধু তোমাদের জড়িয়ে লাভ কী? তাছাড়া ওনি যা বলেছেন সবগুলো সত্যি না হলেও কিছু কথা নির্মম সত্য।’

উৎস জিজ্ঞেস করল, ‘কোনটা সত্যি রোজানু? ভাই যে তোকে পছন্দ করে এটা নাকি তুই লোভী ওটা?’

রোজা আঁৎকে ওঠলো। মুখ রক্তশূণ্য হয়ে গেল। ফ্যাকাসে মুখখানা তীব্র গরমে ঘেমে একাকার হয়ে গেলো। আমতা-আমতা করে বলল, ‘কী বলছো তুমি?’

‘ভাবিস না আমি কিছু জানি না৷ তোকে সেদিন ফুপি কী কী বলেছিল সেসব আমার মস্তিষ্কে খুব সুন্দর করে গেঁথে আছে। তাই সত্যটা বললে আমি খুশি হবো।’

রোজা ওড়নার একাংশ মুঠো করে রেখেছিল হাতের তালুতে। চোখদুটো মুদিত করে নিঃশ্বাস বন্ধ করে নিজের আবেগ, অনুভূতি লুকানোর কঠোর প্রচেষ্টা চালিয়ে শুকনো একটা হাসি দিয়ে বলল, ‘সবসময় সত্য স্বীকার করা যায় না ভাইয়া। কিছু কিছু সত্য মিথ্যের আড়ালে চাপা থাকাই ভালো।’

উৎস কপালে ভাঁজ ফেলে বলল, ‘তাহলে কি ধরে নেব তুইও ভাইয়ার জন্য কিছু অনুভব করিস?’

রোজা জানে না বা স্বীকার কর‍তে চায় না সত্যটা। নিজের কাছে নিজেই পরিষ্কার নয় ব্যাপারটা নিয়ে, উৎসকে সে কি বলবে। রোজা ঢোক গিলে ব্যগ্র কন্ঠে বলল, ‘একদম না। ঝামেলাটা তোমার ভাই শুরু করেছে। ওনিই তোমার ফুফুর কাছে আমার নামে বদনাম করেছেন বলেই আমার বিশ্বাস।’

উৎস চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘কেন এমন মনে হলো তোর?’

‘কেননা, ওনি সেই প্রথম থেকে আমার পিছু লেগে আছেন। যদিও কোনোদিন অসভ্যতামি বা খারাপ কিছু নজরে পড়েনি তথাপি আমি বারবার ওনাকে এড়িয়ে চলছিলাম। কারণ পড়াশোনা করতে গিয়ে কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে পড়তে চাই নি। বলতে বাঁধা নেই, ওনাকে খুবই বিবেকবোধ সম্পন্ন মানুষ বলে মনে হয়েছিল আমার। ওনার আমার প্রতি এত কেয়ারিং থাকাটা আমি কোনোদিন কারো সাথেই আলোচনা করিনি বা কাউকে জানাইনি। বিষয়টা নিজের মনের মধ্যে রেখে দিয়েছিলাম। কিন্তু আমাকে এটা বলো, যেখানে কেউওই এ সম্বন্ধে ঘূর্ণাক্ষরেও কিছু ভাবে নি; তোমার ফুফু জানলো কীভাবে? তার মানে কী এটাই নয় তোমার ভাই-ই ওনাকে বলেছে? যেহেতু ফুফুর সাথে তার খুব ভালো সম্পর্ক!’

উৎস রোজার প্রতিটি কথা মনোযোগ সহকারে শুনলো। বোনের মুখের কথা আর চোখ দুটো যেন ভিন্ন ভিন্ন কথা বলছে। সূঁচালো চক্ষু মেলে একপলক রোজাকে দেখলো। অতঃপর বিদ্রুপের সুরে বলল, ‘আচ্ছা রোজা, এই বিশ্রি ঘটনাটাকে দূরে সরিয়ে, নিজের মনকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখ তো ; ভাইয়ের জন্য তুই কিছু ফিল করিস কি-না। আই মিন, ভাইকে তুই ভালোবাসিস কিনা? ড্যাম শিওর আমার ভাই কারো কাছে তোর নামে বদনাম করেনি।’

রোজা চিবুকে হাত রেখে পূর্ণদৃষ্টিতে ভাইকে দেখলো। উৎস জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে আছে। রোজা থতমত খেলো। বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারলো না উৎসের প্রশ্ন তীরে বিদ্ধ হওয়ার ভয়ে। দ্রুত নেমে পড়লো ছাদ থেকে।

————————————————

আষাঢ়ের চতুর্থ দিবস। শুভ্র-কৃষ্ণ মেঘে পরিপূর্ণ আকাশ, জলে থইথই জলধার। আকাশের কান্না থামানোর কোনো অবকাশ নেই। গত দু’দিন যাবৎ একনাগাড়ে কেঁদেই চলেছে সে। ঘনকালো তুলোর পসরা সাজিয়ে সিক্ত করে তুলেছে প্রতিটি ক্ষণ। এরইমধ্যে দু’টি দিন পেরিয়ে গেছে। আদ্রিশের প্রতিটি মুহূর্ত কাটছে উৎকন্ঠার সহিত। অপেক্ষা করছে কখন সুহানা শেখের কাছে এ বিষয়ে কৈফিয়ত চাইবে সে। কিন্তু রোজা যেদিন চলে গেল সেদিনই সুহানা নিজের বাড়ি ফিরে গেছেন ইশাকে নিয়ে, যারজন্য কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ পায় নি আদ্রিশ। প্রথমে মাতৃতুল্য ফুফুর বিরুদ্ধে এমন কুৎসিত অভিযোগ মানতে না পারলেও বাড়ির কাজের মহিলাটাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছে আদ্রিশ। একদিকে রোজাকে না দেখার যন্ত্রণা ওকে কুঁড়েকুঁড়ে খাচ্ছে। আর অন্যদিকে উৎসটাও খালার বাড়িতে গিয়ে আয়েশ করে দিন কাটাচ্ছে। ওর আসার নামগন্ধই নেই। ত্যক্তবিরক্ত আদ্রিশ নিজের রাগ কমাতে সারাদিন বৃষ্টিতে ভিজলো।

সেদিন রোজাকে নিয়ে হরষপুর গ্রামে এসে আটকে পড়েছে উৎস। মাঝেমধ্যে নেটওয়ার্ক-ও ডিসকানেকটেড হয়ে যায়। এরকম বাজে অবস্থায় বেশিরভাগ সময়ই বাড়ির কারো সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হচ্ছে না উৎসের। নেহাকে ফোন করে সুহানা শেখের বিষয়টি গোপন করে খালার বাড়িতে আটকে পড়ার ঘটনাটি জানিয়ে দিয়েছিল সে; যার জন্য ওদের বাড়ির প্রতিটি লোকজন নিশ্চিন্ত হয়েছে। বৃষ্টির কারণে গ্রামের পথঘাট হাঁটু সমান জলে ডুবে গেছে। রোজাদের বাড়ির উঠোন অবধি ওঠে এসেছে পানি। তারমধ্য আবহাওয়া অত্যধিক ঠান্ডা থাকায় উৎসের জ্বর ওঠে, গলা বসে গেছে। সেজন্য রোজার মা সুলতানা বেগম বোনপো’কে কিছুতেই শহরে দূর বাড়ির চৌকাঠ-ই পেরুতেই দিলেন না। কম্বলের ভেতর গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে থাকা অবস্থায় হঠাৎ উৎসের ফোনটির উচ্চস্বরে থরথর করে কেঁপে ওঠলো। লাফিয়ে ওঠে ফোন রিসিভ করে দ্রুতগতিতে জিজ্ঞেস করল, ‘হ্যালো কে?’

‘তুই কী সারাজীবন বোনকে পাহারা দেওয়ার জন্য ওই গ্রামেই থেকে যাবি?’

‘ভাই তুমি? এখানে নেটওয়ার্কের যা ছিরি ফোন আসাটাই আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো। ওফ..’

আদ্রিশ তিক্ত কন্ঠে বলল, ‘কেন? অন্য কাউকে আশা করেছিলি নাকি?’

‘নাহ। আসসালামু আলাইকুম ভাই।’

আদ্রিশ শান্ত কন্ঠে জবাব দিল, ‘ওয়ালাইকুমুস সালাম।’

‘কেমন আছো?’

আদ্রিশ রোষগ্নি কন্ঠে ধমক দিল, ‘মজা করছিস তুই?’

কম্বলের ভেতর ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে ওর ধমকে উৎস কেঁপে ওঠলো। মুখখানা চুপসে গেল। এই আরামদায়ক বিছানা ছাড়তে কিছুতেই ইচ্ছা করছে না ওর। আর বাড়ি ফিরে গেলেই অশান্তির সম্মুখীন হতে হবে, যা মোটেও ওর পছন্দ নয়। কিন্তু আদ্রিশের রাগ সম্বন্ধে ধারণা করতে পেরে উৎস নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল, ‘আজই ফিরবো। চিন্তা করো না।’

আদ্রিশ হুমকি দেওয়া গলায় বলল, ‘সন্ধ্যের মধ্যে যেন তোকে বাড়িতে দেখি। ফুপি আজ ইশাকে নিয়ে বাসায় আসবে। আমি আজই এর একটা বিহিত করতে চাই। সেখানে তোর থাকাটা দরকার। যদিও তোর অহংকারী বোনটাকে বেশি প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তিনি তো মহারাণী। ওনার পদধূলি যত্ন করে রাখার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছি আমরা, তাইনা! যাইহোক, যা বলেছি তার সামান্য হেরফের করলে সারাজীবন অহংকারী বোনের বাড়িতেই কেটে যাবে তোর। মনে রাখিস!’

————————————————————–

ড্রইংরুমে নেহার বিয়ের শপিং নিয়ে আলোচনা চলছে। সুহানা শেখ খুব উৎসাহ নিয়ে খাতা-কলম নিয়ে খরচাপাতির হিসাব কষছেন। ইশা মায়ের পাশে বসে তাঁকে সাহায্য করছে। ইনায়েত ও ইমতিয়াজ সাহেব অফিস থেকে ফিরেছেন খানিক আগে। চা-নাস্তার আয়োজন পর্ব চলছে এখন। এরইমধ্যে হন্তদন্ত পায়ে ঢুকলো উৎস। এইমাত্র হরষপুর থেকে ফিরছে সে। সবার মনোযোগ এবং দৃষ্টি চলে গেল ওর দিকে। ওকে দেখতে পেয়েই নিশিতা ছুটে এলেন৷ জিজ্ঞেস করলেন, ‘ফিরলি তবে! আমার মেয়েটা কেমন আছে?’

উৎস ক্লান্ত শরীর নিয়ে ধপ করে সোফায় বসে পড়লো। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে সে বলল, ‘আমাকে জিজ্ঞেস না করে ফুপিকে জিজ্ঞেস করো কি পরিমাণ কথা শুনিয়ে বাড়ি থেকে চলে যেতে বাধ্য করেছে আমাদের রোজানুটাকে। এ অবস্থায় আমার বোনটা কীভাবে ভালো থাকে বলো?’

উপস্থিত সবাই সচকিত দৃষ্টিতে তাকালো উৎসের দিকে। তাঁরা কিছুই বুঝতে পারলো না। এদিকে সুহানা শেখের চেহারা বেলুনের মতো চুপসে গেল। আর কেউ বুঝতে না পারলেও তিনি ঠিকই বুঝতে পারলেন ভাইয়ের ছেলে কোন বিষয়টিকে ইঙ্গিত করেছে। রোজা মেয়েটা তো আসলেই একটা চিজ। সব কথা কেমন ভাইকে বলে দিয়েছে! ইনায়েত, ইমতিয়াজ সাহেব জানতে পারলে তো আর ক্ষমা-ই করবে না তাকে। অত্যাধিক শীতল আবহাওয়া থাকা স্বত্তেও সুহানা শেখ কুলকুল করে ঘামতে শুরু করলেন।

——————————————

চলবে…