অনুভূতির খাঁচায় পর্ব-৫০+৫১

0
21

অনুভূতির খাঁচায়
পর্ব-৫০
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

তৌফিক তার কানের কাছে যেয়ে ফিসফিস করে বলে, “যেভাবে তোর বন্ধুকে মেরেছিলাম। সেদিন তোকে ছেড়ে দিয়ে ভুল করেছিলাম রে। তুই আমাকে অনেক বিরক্ত করেছিস।”
এই বলে তৌফিক অভ্রর কপালে বন্দুক ঠেকায়।

একটি লোক সুরভিকেও ধরে নিয়ে আসে ভেতর থেকে। অভ্রকে এমন অবস্থায় দেখে সুরভি দৌড়ে আসতে চায় অভ্রর কাছে। কিন্তু পিছন থেকে একটা লোক তার চুলের মুঠি টান দিয়ে ধরে রাখে।

হঠাৎ মহলটা শান্ত হয়ে গেছে। হিতের বিপরীতে ঘুরছে সব পরিকল্পনা। অভ্রের লোকেরা পেড়ে উঠে না। তৌফিকের লোকসংখ্যা অনেক বেশি। অভ্র এমন সময় তাকায় দরজার দিকে। সভ্য বা মায়া কেউ এই সময় লোকদের নিয়ে এলেই হলো।

তৌফিক উঠে ধীর পা’য়ে যায় সুরভির কাছে৷ ব’ন্দুক দিয়ে তার কপাল থেকে গাল পর্যন্ত স্লাইড করে, “তুই ওর মাঝে কী দেখলি রে? যে কারণে ওর জন্য পাগল হয়ে গেলি? এই একটা খারাপ কাজ করলি। তোকে মারার পরে তোর জিনিস ভোগ করতে মজা লাগতো কিন্তু আফসোস আমি আবার সুন্দরী ছাড়া মেয়ে ধরি না। ঘেণা লাগে বুঝলি। তোর জিনিস ভোগ করতে না পাড়ার আফসোস সারাজীবন থেকে যাবে রে। কিন্তু ডোন্ট ওয়ারি আমার লোকেরা আছে প্রতিদিন ওর সাথে….” সম্পূর্ণ কথা বলার পূর্বেই সুরভি তার মুখে একদলা থুথু মারলো।

তৌফিক তো রাগে অগ্নিমূর্তির রূপ ধারণ করল, “তোর এতো বড় সাহস।” সব জোর দিয়ে এক চড় মারল সে সুরভির মুখ। এত জোরে যে তার নাক দিয়ে রক্ত বের হয়ে যায়। কিন্তু তার চোখে এখনো সে মেয়েগুলোর নির্মম অবস্থা ভাসছে৷ সে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “তোর মতো জানোয়ার আমি এই জন্মে দেখিনি। নিজের মা’য়ের বাড়িতে মা জাতিকেই অপমান করছিস? তোর লজ্জা, জ্ঞান, অন্ত নাই? মেয়েগুলোকে এমন পশুর মতো রেখেছিস। পশুদেরও তো মানুষ মায়া করে। তোর তো অন্তরও নাই।”
তৌফিক কথাটায় অট্টহাসি দেয়, “একটু পর তোরও একই অবস্থা হবে। তাই মুখ বন্ধ রাখ।”
অভ্র এতক্ষণ আশেপাশে তাকাচ্ছিল। সবার ধ্যান এই মুহূর্তে তৌফিকের দিকে। সে সুযোগের ব্যবহার করে। তার পাশে দাঁড়ানো লোক থেকে বন্দুক নিয়ে এক লাফে তৌফিকের পিছনে দাঁড়িয়ে তার মাথায় বন্দুক রাখল। পিছন থেকে গলা চেপে ধরল।

“সবাই সেরেন্ডার করো এক্ষুণি, নাহলে এই তৌফিককে এখানেই উড়িয়ে দিব।” অভ্র জোরগলায় বলে। তৌফিকে গলা চেপে বলে, “তুই কি মানুষ না’কি জানোয়ার রে? আমি সত্যিই কনফিউজড হয়ে যাই। মানুষের অন্তর এত কঠোর কীভাবে হতে পাড়ে তা আমি ভেবে পাই না। যে অন্যের খু’ন করতেও একটুও কাঁপে না। আমার এখনো মনে আছে তুই যখন গগণকে স্যু’ট করেছিলি তখন তোর চোখের পলকও ঝপকায় নি। ঠোঁটে ছিলো শান্তির হাসি। আজও দৃশ্যটা আমার চোখে ভাসে। এর উপর তুই মেয়েদের সাথে…ছিঃ! কী করে সম্ভব একটা মানুষের এতটা হৃদয়হীন হওয়া। আর তুই আগামী বছর ইলেকশনে দাঁড়াবি? দেশকে শেষ করতে? যুবকদের শেষ করতে ড্রা’গ আর মদের ব্যবসা করিস। আর দেশকে শেষ করতে ইললিগাল ওয়েপান আনিস। তোর মতো মানুষের হাতে দেশকে দিলে তো দুইদিনে বেঁচে খেয়ে ফেলবি। আজ তোকে আমি শেষ করেই ছাড়ব।” সে গান আনলক করলে সুরভি বলে উঠে, “আপনি এমন করেন না। ওকে শাস্তি আইন দিবে।”
অভ্র তার কথায় পাত্তা দেয় না। সে গুলি চালায় না কিন্তু ব’ন্দুক দিয়ে তার মাথায় সজোরে মারে। মুহূর্তে গড়গড় করে বেয়ে পড়ে র’ক্ত।
অভ্র বলে, “ওরাই আইন। আইন ওদের কী করবে। কিন্তু ওঁকে এত সহজে মারবো না। এত সহজ মৃত্যু ওর কপালে নেই৷ ওর থেকে রেকর্ডার নেও সুরভি।”
সুমন এগিয়ে আসলে অভ্র বলে, “এক পা এগোলে ওর মাথার ভেতর গু’লি যাবে বলে দিলাম।”
সুরভি এগিয়ে এসে রেকর্ডার নিতে গেলে তৌফিক তা সুমনের দিকে ফিক্কা মারে। তা নিচে পড়ে যায়। সুরভি তা নিতে যাবার আগেই সুমন তা তুলে ভেঙে দেয়।

তৌফিক বিজয়ের হাসি দিলো। অভ্রর পেটে কণুই দিয়ে আঘাত করতেই অভ্র সরে যায়। সুমন তার হাত থেকে ব’ন্দুক নিয়ে নেয়। তাকে প্রথমে কয়টা ঘুষি মারে পেটে। তারপর ঘাড়ে কণুই দিয়ে মারতেই সে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। সুমন দুইহাত ধরে তাকে লক করে নেয়। তখন তৌফিক হেসে বসে অভ্রের সামনে বলে, “নট সো ফাস্ট। তোর এখনো সবদিক দিয়ে ট্রেনিং করার প্রয়োজন ছিলো বুদ্ধির আর বল দুইটা দিয়েই।”
মুহূর্তে সব নিয়ন্ত্রণ আবার তৌফিকের কাছে চলে যায়।

অভ্রর মুখ দিয়ে গড়গড়িয়ে র’ক্ত পড়ছিলো। সে ঢুলে পড়তে যেয়েও নিজেকে সামলালো। সুমনের সাথে সে পেড়ে উঠে না। সুমন এক সময়ের সবচেয়ে বড় বক্সার ছিলো। তার সাথে পেড়ে উঠা সম্ভবও না। সে এই যন্ত্রণার মাঝে হাসে তৌফিকের দিকে তাকিয়ে। তার চোখে ভয় না দেখে ক্ষেপে যায় তৌফিক, “আমি তোর সব প্লান, এত বছরের কাজ সব শেষ করে দিয়েছি মুহূর্তে। অথচ তুই হাসছিস? পাগল হয়ে গেলি না’কি?”
“পাগল তো তুই। এত সহজে ভেবে নিলি আমি সব রেকর্ড করে এখানে ওদের বসিয়ে রাখব। রেকর্ডার আগেই পাঠানো হয়ে গেছে।”
মুহূর্তের জন্য তৌফিক স্তব্ধ হয়ে যায়। যেন সে হুঁশ হারিয়ে ফেলেছে। এরই মধ্যেই বাহির থেকে শব্দ শোনা যায়। তৌফিক অবাক হয়। বাহিরে তার লোকেরা এলাকা ঘেরা করে রেখেছিল। হঠাৎ এই শব্দে সে বুঝতে পাড়ে না কি হচ্ছে।

অবশ্য বেশি সময়ও লাগে না। মায়া যখন কতগুলো লোক নিয়ে ঢুকে তখন সে ব্যাপারটা বুঝে যায়। কিন্তু মায়া এখানে কেন? তার তো রুমে থাকার কথা ছিলো, অজ্ঞান অবস্থায়।

তৌফিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় মায়ার দিকে। রাগান্বিত অথচ দৃঢ় স্বরে জিজ্ঞেস করে, “আমি জানতাম তুমি অভ্রের সাথে আছো। কিন্তু তুমি এখানে কীভাবে?”
মায়া শান্ত স্বরে তার পকেটে হাত রেখে এগিয়ে আসে তার দিকে, “আপনার বাড়িটা নিজের অধীনে নিয়ে এসেছি মন্ত্রীসাহেব। মজার কথা কি জানেন? যে আপনাকে বলেছিল আমি অভ্রের সাহায্য করছি সে নিজেই অভ্রের লোক। সব আমাদের প্লান করা।”
“রিয়াদ!” তৌফিক যেন আকাশ থেকে পড়ে।
“হ্যাঁ রিয়াদ। আপনার বউ এখন রিয়াদের সাথে আছে। কোনো সুরক্ষিত স্থানে।”
সুমন তখন চেঁচিয়ে উঠে, “স্যার দেখলেন? আমি বলেছিলাম ওকে বিশ্বাস করতে না। ওকে আমার আগে থেকেই সন্দেহ ছিলো। আপনি আমাকে গাঁধা বলে চুপ করিয়ে দিতেন।”
এমন চিন্তিত মহলে মায়া শব্দ করে হেসে দেয়, “ভাই তুই গাঁধাই।”
কথাটায় সুমন চেতে আগুন হয়ে যায়। সে অভ্রকে ছেড়ে মায়ার দিকে ছুটে আসে রাগান্বিত ষাঁড়ের মতো। আক্রমণ করে মুহূর্তে। মায়া যত দ্রুত সম্ভব তার থেকে বাঁচার চেষ্টা করে। তার আক্রমণ এত দ্রুত হচ্ছে যে মায়া নিজেই তার উপর পালটা হামলা করার সময় পাচ্ছে না। তৌফিক বলে, “সুমন ওর চেহেরায় কিছু করবি না। এদের ব্যবস্থা করে আমি ওকে আজ সারারাত নিজের করে রাখবো।” আবার সে তাকায় অভ্রের দিকে, “তোর কি মনে হয় তুই রেকর্ডার পাঠালেই আমার কিছু হবে? কিছু করতে পাড়বি না তুই আমার। আমি অলরেডি সব মিডিয়া হাউজে জানিয়ে এসেছি আমার কোনো নিউজ ছড়ালে ওদের ধ্বংসকাব্য শুরু করব।”
কথাটায় মায়ার ধ্যান সরে যায় আর সুমনের এক ঘুষি পড়ে তার পিঠে। মায়া মেঝেতে পড়ে যায়। সে ব্যাথায় চোখমুখ কুঁচকে নেয়। সে তাকায় সুমনের দিকে। দানবের মতো লম্বা স্বাস্থ্য। এর উপর মারামারিতে কৌশলগত অর্জন অনেক। এর সাথে সে পাড়বে না। হয়তো বলে পাড়বে না কিন্তু কৌশলে অবশ্যই পাড়বে। সে নিজের পকেটে হাত দিতেই দেখে তাদের কালো পোশাক পরা একটি লোক দৌড়ে এসে সুমনকে লাথি মারে। সুমন এক বিন্দুও নড়ে না। উলটো লোকটাকে আচড়ে নিচে ফেলে দেয়। মুখের মাস্ক সরে গেলে দেখে লোকটা জোহান। মায়া চোখ ঘুরায়। জোহানের দিকে তাকিয়ে বলে, “সাধে সাধে গর্দভ বলি তোমাকে? ওকে দেখ আর নিজেকে দেখ। ওর সাথে মারামারি শুরু করতে গেলে কোন দুঃখে?”
“ও তোমাকে আঘাত করেছে। আমি চুপচাপ বসে থাকব না’কি?”
মায়া তাকে পাত্তা না দিয়ে সামনে তাকায়। সুমন আবার জোহানের উপর হামলা করতে গেলে মায়া পাশের টেবিল থেকে কাঁচের জগ নিয়ে তার দিকে ছুঁড়ে মারলেও সেটা কেবল একটু ছোঁয় তার বাহুতে। ঘটনাটা সুমনকে বেশি আঘাত না করলেও মায়া সময় ঠিকই বের করতে পাড়ে। সে নিজের ফোন বের করে একটা ভিডিও দেখায় সুমনকে। ভিডিওটা দেখে সুমনের সেখানেই যেন শান্ত হয়ে গেল। সে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ফোনটার দিকে। তারপর সিক্ত র’ক্তবর্ণ চোখ নিয়ে তাকাল তৌফিকের দিকে। তার হাত, পা, মুখ সব কাঁপছিল।
তৌফিক কিছুই বুঝলো না। তার পাগল ষাঁড় হঠাৎ এমন শান্ত হলো কীভাবে?
তার মনে জাগন্ত প্রশ্নের উওর দিলো মায়া, “প্রতি বুধবার যখন তৌফিক তোমার বাড়িতে যায় তুমি সেজে নাসরিন নিবাসে আসার জন্য। তখন তোমার স্ত্রী এবং মেয়েদের সাথে জবরদস্তি করে। আর হুমকি দেয় তারা মুখ খুললে সম্পূর্ণ পরিবারকে শেষ করে দিবে। আর তুমি না’কি তার এতই অন্ধভক্ত যে তারা কিন্তু বললে বিশ্বাস তো করবেই না উলটো তাদের গলা কে’টে দিবে।”
সুমনের মতো দানবমূর্তিরও চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করে নিজের মেয়েদের এমন অবস্থা দেখে। সে ছুটে যেয়ে তৌফিকের গলা ধরে বলে, “তোর এত বড় সাহস। আমি তোর জন্য কতকিছু করেছি। প্রায় নিজের জীবনও দিয়ে দিয়েছি আর তুই আমার বউ আর মেয়েদের সাথে… তোকে আমি খুন করে ফেলব।”
অভ্র এসে তাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে, “তুমি ওকে শাস্তি দেওয়ার যোগ্য না। তুমি নিজেও এইসব কাজে জড়িত।”
সে হুঙ্কার দিয়ে উঠে, “আমার মেয়েদের মাত্র বারো ও চৌদ্দ বছর।”
তখন সুরভি বলে, “যেমন এখানে একটা মেয়ের ছিলো। বারো বছর একদম আপনার মেয়ের সমান।”
কথাটা শুনে সুমন শূন্য দৃষ্টিতে তাকায় সুরভির দিকে। সে এক দুই পা করে পিছিয়ে যায়।
সুরভি আরও বলে, “বারো বছরের বাচ্চা মেয়ে ছিলো। ওই মেয়ের শরীরে পোড়া দাগ, কেঁটে যাওয়া অংশের মাংসও দেখা যাচ্ছিল। কয়েক জায়গার তো মাংস উঠানোও ছিলো। হাড্ডি দেখা যাচ্ছিল স্পষ্ট। আপনি নিশ্চয়ই তাকে দেখেছেন। আপনি ওই মেয়ের স্থানে আপনার বারো বছরের মেয়েটাকে রেখে দেখতে পাড়লেন না? ওই বাচ্চা মেয়েটাকে যখন এই রাক্ষস মলেস্ট করছিল তখন আপনি এটাও ভাবেন নি এমন তো আমারও মেয়ে আছে।”

সুমন আরেকটু পিছিয়ে যেয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। চিৎকার করে কেঁদে উঠে সে। বারবার শুফহু একটাই কথা বলে, “আমার মেয়েগুলো… আমার বাচ্চা মেয়েগুলো… ”
কারোই তার জন্য একটুখানিও সহানুভূতি জাগে না। মায়া তো তাকে রীতিমতো এড়িয়ে যেয়ে অভ্রকে বলে, “সভ্যকে রেকর্ডার দিয়েছি। নিশ্চিত উনি কিছু করতে পাড়বে। আপনাদের দাদাজান এতগুলো গার্ড এরেঞ্জ করতে পেরেছে তাহলে… ”
“পাড়বে না।” তৌফিক তখনও নিলজ্জের মতো হেসে বলে, “তোরা টাকা দিয়ে লোক কিনতে পাড়বি। ক্ষমতা না। আমার কাছে এখনো সব ক্ষমতা আছে আর থাকবে। আমি মিডিয়াতে কল দিয়ে যেহেতু মানা করেছি কেউ আমার বিরুদ্ধে যাবার সাহস করবে না। আর আমার বাবা যখন তোদের কথা জানবে তখন তোরা একটাও বাঁচবি না। ক্ষমতা সবচেয়ে বড়। সবচেয়ে ভয়ানক।”
“ওহ।” জোহান ছোট করে বলে উঠে দাঁড়ায়। নিজের কোমড় ধরে বলে, “ব্যাথাটা একটু জোরেই লেগেছে।”
এমন সময় এই কথা বলায় মায়া তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে। তার ইচ্ছে হয় জোহানকে উঠিয়ে কয়েকটা আছাড় মারতে। এমন সময় কেউ এসব বলে?

কিন্তু পরবর্তী মুহূর্তে জোহান এমন কিছু করল যার কারণে তার পরিকল্পনাই উলটো হয়ে গেল। আছাড়ের পরিবর্তে কয়টা চুমু দিতে ইচ্ছা হলো।জোহান তার শার্টের পকেট থেকে ফোন বের করে বলল, “আমি না বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। আমি ইন্সটাগ্রামে লাইভ আছি। দেড় মিলিয়ন মানুষ দেখছে। সবাই হাই বলো।”
বলে সে শার্টের পকেট থেকে ফোন বের করে সবাইকে দেখাতে শুরু করল। তৌফিকের কাছে নিতেই সে সে ফোন ধরে আছাড় মারল। জোহান বলল, “এখন আর লাভ নেই। নিজের দোষ সব নিজেই স্বীকার করে নিয়েছ। মানুষ বিশ মিনিট ধরেই এসব দেখছে। কেবল দেশে না দেশের বাহিরেও। ক্ষমতা ভয়ানক বললে না? জনগণের ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি ভয়ানক। তারা এগোলে প্রধানমন্ত্রীকেও পিছাতে হবে। এখন এই নিউজ আসার পর না তোমার বাবা কিছু করতে পাড়বে না অন্যকেউ। ওহ না করতে পাড়বে। নিজের সম্মান বাঁচানোর জন্য তোমাকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে পাড়বে। ব্যাপারটা সামনে আসার পর কোনো মিডিয়া হাউজও এতবড় নিউজ হাতছাড়া করবে না। সো তুমি শেষ মিস্টার তৌফিক।” আচমকা সে তৌফিককে একে একে দুইটা ঘুষি মারে, “এটা আমার মায়ার দিকে খারাপ নজর দেওয়ার জন্য। যদিও এই অপরাধে তোকে আমার খু’ন করা উচিত।”
মায়া কথাটা শুনে কপাল কুঁচকে তাকায় জোহানের দিকে। তারপর অন্যদিকে তাকায়। তার ঠোঁটের কোণে আপনা-আপনি এঁকে উঠে লজ্জামাখা হাসি।

নাজিম দরজায় এসে বলে, “ভাই সবকিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে। সভ্য ভাই কল দিয়েছিল। জোহান স্যারের লাইভের পর টিভিতে সভ্য ভাইয়ের পাঠানো নিউজ এডিটিং করে ছাড়া হবে। লাইভটা ভাইরাল হয়ে গেছে। কয়েকজন আজই আন্দোলনে নেমেছে। আশা করা যায় আরও নামবে। জনগণকে পুলিশও সব সামলাতে না পেরে আসতেই হবে। সবাই ভীষণ ক্ষেপে আছে।”

এতকিছুর পরও তৌফিক হাসে শব্দ করে, “কিছু হবে না আমার। কিছু হতেই পাড়বে না। কিন্তু তোদের সবটা’কে আমি শেষ করে দিব।” তারপর সে অভ্রের দিকে তাকায়, “বিশেষ করে তোকে। কিন্তু তোকে তোর বন্ধুর মতো সহজ মৃ’ত্যু দিব না। তোকে তিলে তিলে মা’রব। সেদিন তো তাড়া ছিলো। তাই গুলি দিয়েই ওর কাজ শেষ করে দিয়েছিলাম নাহয় যন্ত্রণা দিয়ে মারতাম ওকে। ম’রা মানুষের চিৎকার শোনার আনন্দ জানিস তো?”
কথাগুলো শুনে অভ্রর মাথায় রক্ত উঠে গেল। এতক্ষণ বহু কষ্টে শান্ত রাখার চেষ্টা করল নিজেকে। কিন্তু কিছুতেই পাড়ল না। সে তৌফিকের মাথা ধরে দেয়ালে বারি মারল। একে একে চারটা। তারপর মুখে কতগুলো ঘুষি দিলো। তৌফিক সামলাতে না পেড়ে পড়ে যেতে নিলে সে তার পেটে বুকে অসংখ্যক লাথি মারতে থাকে। যতক্ষণ না পর্যন্ত তার মুখ দিয়ে গড়গড়িয়ে র’ক্ত আসতে থাকে। সুরভি এসে থামায় তাকে, “কী করছেন মরে যাবে তো। সে তার শাস্তি পাবে, আইন দিবে।”
অভ্র রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকায় সুরভির দিকে। তার এমন অগ্নিময় দৃষ্টির দর্শন আর কখনো করে নি সুরভি। সে নিজেই সরে যায়। অভ্র বলে, “অনেক বছরের ক্ষোভ বুকে জমে আছে সুরভি। প্রতিরাতে নিজের বন্ধুর নিস্তর দেহ স্বপ্নে দেখে আমার ঘুম ভেঙে। ও কেবল আমার বন্ধু না আমার পৃথিবী নিয়ে গেছে আমার থেকে। আমার কতগুলো বছর স্বপ্ন, সব এই লোকের ধ্বংসকাব্য লেখার জন্য ত্যাগ করেছি আমি। মেঘলার শরীরে আঘাত দেখো নি? সেই মেয়েগুলোকে দেখো নি? এমন হাজারো মেয়ের জীবন শেষ করেছে এই জানোয়ার। এ দয়ার যোগ্য না। কিন্তু ডোন্ট ওয়ারি ওকে আজই শেষ করব না। এত সহজ মৃ’ত্যু ওর কপালে নেই। আজকের দিন, এই মুহূর্ত ভুলে যাবে তুমি। আমার এই রূপ স্মৃতিতে রাখবে না কারণ আমি কোনোভাবে আজ নিজেকে আটকাতে পাড়ব না।”

কথাটা শুনে সুরভি ঘুরে দাঁড়ায়। মায়া অভ্রকে বলে, “ওর চোখে দেখতে পাচ্ছো তুমি? ও কেন এই অপরাধ করে জানো? এই পিশাচের মতো কান্ড করে কেন? কারণ ওর ভয়ের চিৎকার শুনতে ভালো লাগে। সামনের জনের চোখে আতঙ্ক দেখে শান্তি পায়। তাহলে তোমারও তো তাকে এভাবেই মা’রা উচিত তাই না?” বলে বাঁকা হাসে। পকেট থেকে ধাঁরালো সূক্ষ্ম ছু’রি বের করে তা ছুঁড়ে মারে অভ্রর দিকে৷ অভ্র তা ধরে নেয়। মায়া তআর কথায় যোগ করে, “পুলিশ এসে পড়ার আগে ওর সাথে হিসাব পূরণ করো। সব এখন আমাদের কন্ট্রোলে।”

অভ্র মায়ার কথা বুঝে। সে তাকায় তৌফিকের দিকে। তার মাথা, মুখ দিয়ে র’ক্ত পড়ছে অনবরত। তবুও তার চোখে কোনো ভয় নেই। সে তৌফিকের এক হাত নিয়ে মেঝেতে রাখে। তার দিকে তাকিয়ে ছু’রিটা চালাতে থাকে তার হাতের আশেপাশে। তবুও দেখতে পায় না তৌফিকের দিকে একবিন্দু হয়। আচমকা সে তৌফিকের আঙুলে ভরে দেয় সে ছু’রিটা। তৌফিক চিৎকার করে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায় অভ্রের দিকে। যেন সে ভাবে নি অভ্র এমনটা করবে। সে দ্বিতীয় আঙুলেও একই কাজ করে। তৌফিক তখন নিজের জোর খাটায় অভ্রের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর জন্য। তার চোখে ভয়, আতঙ্ক। অভ্রের লোক এসে তাকে ধরে। অভ্র এক এক করে তার নখে, আঙুল হাতে ছু’রিটা ভরে। তার চিৎকারে যেন বাড়ির প্রতিটি দেয়ালও কেঁপে উঠে। কিন্তু তবুও সে পরাজয় স্বীকার করে না। একটিবারও ক্ষমা চায় না। নিজের করণীয়র জন্য আফসোস করে না।

প্রতিবার তৌফিকের চিৎকারে তার মনে পড়ে তার বন্ধুর শেষ চিৎকার। তার চোখে পানি এসে পড়ে, শান্তির। সে আজ তার বন্ধুকে দেওয়া ওয়াদা পূরণ করতে পেরেছে। অবশেষে। এমন অমানবিক কাজ করেও তার আজ শান্তি লাগছে। সে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে মেঝেতে বসে পড়ে। ছুরি এখনো তৌফিকের কাঁপা কাঁপা হাতে গাঁথা।

পুলিশ আসে মিনিটখানিক পরেই। সাথে তৌফিকের বাবার পি.এ। সে এসে তৌফিকের এই অবস্থা দেখে ভড়কে যায়। দ্রুত যেয়ে তাকে তুলে তার অবস্থা দেখে কেঁপে উঠে।

পুলিশ বলে, “আপনারা আইন নিজের হাতে নিয়েছেন। ফেইক পুলিশও এনে…”
মায়া তার কথা কাটে। সে এগিয়ে এসে দাঁড়ায় এস.আই এর সামনে, “আপনারা আইন হয়ে কিছু করতে না পাড়লে আমাদের তো কিছু না কিছু করতে হবেই। দিনের পর দিন মেয়েরা মিসিং হচ্ছে আর আপনারা তাদের কাওকে খুঁজতে পাড়ছিলেন না? এটাও বিশ্বাসযোগ্য? আর সেকথা নাহয় বাদ দিন, বিদেশ থেকে ইললিগাল ওয়েপান, ড্রাগ ইমপোর্ট করা হয় আর পুলিশ ডিপার্টমেন্ট খবরও পায় না? এমন আইন থেকে লাভ কী তাই না?”
“আপনি বেশি…”
“আমি কমই বলছি। বলবে তো আমাদের লয়ার। আপনি এই এলাকার এস.আই তাই না? আপাতত উনাকে নিয়ে যান। আপনাদের ব্যবস্থাও কোর্টে হবে। এর আগে যে শত মেয়ের কেইস ফাইল হয়েছে আপনাদের পুলিশ স্টেশনে তার কপি আছে আমাদের কাছে। কোর্টে তা যাবে। আর আপনি নিশ্চয়ই নিউজ দেখেছে। আমাদের টার্গেট করলে
আপনাদের কী অবস্থা করবে জনগণ ভেবে নিয়েন। উনাকে ছাড়ার কথা ভাবলে জনগণ আপনাদের ছাড়বে না। শুনলাম অনেক ক্ষেপে আছে না’কি?”

তৌফিক মায়ার কথা কথা শুনে তার বাবার পি.এ আব্দুল কাশেমকে বলে, “আংকেল…আংকেল আমি জেলখানায় যেতে চাই না। বাবাকে ফোন লাগান এক্ষুণি।”
“তোমার বাবা তোমার উপর খুব ক্ষেপে আছে। তুমি তার প্রিয় স্ত্রীর বাড়িতে এসব…ছিঃ! উনি বাহিরের দেশে গিয়েছিল। নিউজ শোনার সাথে সাথে রওনা দিয়েছে। এখন তুমি আসো, সব পড়ে দেখা যাবে।”
কথাটা শুনে অভ্র তাকায় মায়ার দিকে। মায়াও তার দিকে তাকায়। চোখের ইশারায় কিছু একটা বলে।

পুলিশ তাকে গ্রেফতারও করে না। কয়েকজন তাকে ধরে নিয়ে যেতে নেয়। যাওয়ার সময় সে অভ্রের কানে বলে, “ভাববি না তুই জিতে গেছিস। আমি একমাসের মধ্যে বের হয়ে যাব। তারপর তোদের সব ক’টাকে শেষ করব নিজ হাতে।”
অভ্র কিছু বলে না তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার দিকে।

মায়া কথা বলছিল পুলিশের সাথে। প্রধানত বলছিল তাদের কাছে কি কি প্রমাণ আছে আর তারা ঠিকভাবে একশন না নিলে তাদের কি ক্ষতি হতে পাড়ে। তৌফিক একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো তার ফিকে। এই মেয়ের আজকে তার সাথে বিছানায় থাকার কথা ছিলো। সে কিছুতেই তার পরাজয় মেনে নিতে পাড়ে না। এই মেয়ে তার না হলে তাকে থাকতেই দিবে না। নিজের হাতে গাঁথা ছু’রিটা সে লুকিয়েছিল অতি সাবধানে। তার হাতে নিয়ে শক্তি দিয়ে তাকে ধরা দুই পুলিশ অফিসারকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। দ্রুত ছুটে আসে মায়ার দিকে।

মায়া নিজেও হঠাৎ বুঝে উঠতে পাড়ে না কি হলো। শব্দ শুনে সে উপরে তাকাতেই দেখে তৌফিক তার কাছে এসে পড়েছে। শেষ মুহূর্তে জোহান তাকে টান দিয়ে নিজের বুকে টেনে নেয়। তবুও তৌফিক পাশে ফিরে হামলা করে আবার। জোহান সাথে সাথে ঘুরে দাঁড়ায়। ছু’রিটা যেয়ে লাগে জোহানের কাঁধে। তবুও সে শক্ত করে ধরে রাখে মায়াকে। সে মুহূর্তে পুলিশ তৌফিকের উপর নিজের শক্তি প্রয়োগ করে। তাকে হ্যান্ডকাফ বাঁধে। তাকে ধরে নিয়ে যায়। যাওয়ার সময়ও তার চোখেমুখে কোনো ভয় ছিলো না। সে সশব্দে হাসে। যেন সে জানতো তার কিছুই হবে না।
সুমন ও বাকি লোকদেরও গ্রেফতার করা হয়।

মায়া স্থির হয়ে যায় কিছু মুহূর্তে জন্য জোহানের কাঁধে হাত রেখে র’ক্ত দেখেই সে চিৎকার করে উঠে।জোহান তাকে ছাড়ে। তার গালে হাত রেখে শান্ত গলায় বলে, “আমার কাছে তোমার চোখ সমুদ্রের মতো লাগে বলে জলে ভাসাবে না, তোমার চোখ সমুদ্রের মতো গভীর কিন্তু এই চোখে জল আমার সহ্য হয় না।”
মায়া কিছু মুহূর্ত শূন্য দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর বাহুরে দুইটা চাপড় মেরে বলে, “গর্দভ এটা কী তোমার প্রেম করার সময়?”
সুরভি এসে তার ছুরি সরাতে চাইলে বাঁধা দেয় মায়া, “ছু’রি দিয়ে আঘাত করলে আঘাতে যতটা না ক্ষতি হয় তার থেকে বেশি ক্ষতি হয় ছু’রি সরালে। আগে ওঁকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়।”
অভ্র তখন আগে দিয়ে নাজিমের সাথে বের হয়েছে গাড়ি বের করতে। তারা জোহানকে ধরে নিয়ে যায় হাস্পাতালে যাবার উদ্দেশ্যে।
.
.
গাড়ি থামে একটি নির্জন স্থানে। আশেপাশে তেমন বাড়ি নেই। কেবল গাছপালা বাদে। এই স্থানে কেবল একটিই বাড়ি আছে। দোতলা বিশাল বাড়ি। মেঘলা গাড়ি থেকে নেমে আশেপাশে তাকায় অবাক দৃষ্টিতে। সে প্রবেশপথের পাশের নেমপ্লেটে নামটা পড়ে, “মেঘবাড়ি।”
এতটুকু দেখেই মেঘলার নিশ্বাস আটকে আসে। তার বুকের ভেতরটা যেন কেউ চেপে ধরেছে। সে আলতো করে নেমপ্লেটে হাত বুলায়। রিয়াদ বলে, “অভ্র ভাই বলেছিল গগণ ভাই আপনার সাথে যোগাযোগ করতে পাড়ে নি কারণ সে তার মা’য়ের জমিতে অনাথ আশ্রম ও বৃদ্ধা আশ্রম তৈরির কাজে ব্যস্ত ছিলেন। সে এই আশ্রম আপনার নামে দিয়েছেন। মেঘবাড়ি।”
রিয়াদ এবার তাকায় মেঘলার দিকে। এতবছরর সে এই
প্রথম মেঘলার ঠোঁটের কোণে হাসি দেখছে। অথচ তার চোখে এখনো পানি জমা। কিন্তু সে জমা জল গাল বেয়ে পড়ছে না।

রিয়াদ অবাক হয়। এতবছর সে কেবল মেঘলাকে কাঁদতে বা ভয়ে নুঁইয়ে যেতে দেখেছে। কখনো এত বড় হাসি তার ঠোঁটে সে দেখে নি। সে নিজেও হেসে বলে, “আসুন আপনাকে গগণ ভাইয়ের সাথে দেখা করাই।”
মেঘলা অবাক হয়ে তাকায় রিয়াদের দিকে। খানিকক্ষণ পূর্বে মায়াও একই কথা বলছিল। রিয়াদ হাঁটা শুরু করলে সে রিয়াদের পিছু যায়। তার হাত পা কাঁপছে অনবরত। সে গগনের সাথে দেখা করবে? সে বেঁচে আছে? আচ্ছা দেখা করলে কী বলবে তাকে? জড়িয়ে ধরবে? না’কি কিছু সময় নিয়ে কিছু কথা বলবে? অভ্র তাকে জানায় নি কেন যে গগন এখনো আছে? তার গগণ আছে!
হয়তো রক্ষা করার জন্য।

রিয়াদ তাকে সে আশ্রম থেকে একটু দূরের পুকুর পাড়ে নিয়ে যায়। আশ্রমকেন্দ্র থেকে চার/পাঁচ মিনিটের পথ হবে। সে যত এগোচ্ছিল তার নিশ্বাসের গতি ততই বাড়ছিল। শরীর কাঁপছিল।

রিয়াদ হঠাৎ থামে। মেঘলাও থামে তার পিছনে। এখানে কোনো বাড়ি নেই। গগণও নেই। মেঘলা জিজ্ঞাসু দৃষ্টি তাকায় রিয়াদের দিকে।
রিয়াদ বলে, “গগণ স্যার না’কি তার জীবনের প্রিয় দুই নারী থেকে দূরে যেতে চায় নি। তাই তার মা’য়ের জমিতে আপনার নামের আশ্রমে বলেছিল কবর দিতে। যেন আপনাদের অনুভূতি সবসময় তার সাথে থাকে।”
মেঘলা নিচে তাকায়। তার সামনে এক কবর দেখে শূন্য দৃষ্টি তাকিয়ে থাকে। তারপর মাটিতে বসে পড়ে আচমকা। তার জ্বলন্ত বুকের আর্তনাদ শুনে আকাশের বুকেও যেন দুঃখ ছড়িয়ে যায়। পড়ন্ত বিকেলের মিষ্টি রোদ ঢেকে যায় কালো মেঘে।

চলবে….

অনুভূতির খাঁচায়
পর্ব-৫১
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

তার জ্বলন্ত বুকের আর্তনাদ শুনে আকাশের বুকেও যেন দুঃখ ছড়িয়ে যায়। পড়ন্ত বিকেলের মিষ্টি রোদ ঢেকে যায় কালো মেঘে।

মেঘলা বসে আছে পুকুরপাড়ের এক সিঁড়িতে। রিয়াদ তাকে এক বোতল পানি এনে দেয়। অনেকক্ষণ পর তার কান্না থেমেছে। সে পানির বোতলে এক চুমুক দিয়ে তাকায় রিয়াদের দিকে। ভাঙা গলায় বলে, “আপনি তখন বলেছিলেন আপনি আগের থেকেই তৌফিককে শেষ করতে চান। কিন্তু কেন? তৌফিকের এত কাছে কাজ করা আপনার জন্য অনেক বড় রিক্স ছিলো। এত বড় রিক্স কেন নিলেন?”
“আমার বোনের জন্য।”
“তাকেও কি নাসরিননিবাসে বন্দী করে রেখেছিল?”
“এটা আপনার বিয়ের আগের কথা। আমার বোন তখন পনেরো বছরের ছিলো। একদিন স্কুল থেকে পিকনিকে নিয়ে গিয়েছিল। সেদিন ওর স্কুলের বাসের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। সব মেয়েটা নামলেও আমার টুকটুকে বোনটা আর আসে নি। অনেক খুঁজি ওকে। অনেকদিন। দুই সাপ্তাহ পড়ে ওর খোঁজ পাই। একটা পুরনো কারখানায় ওর লাশ পাওয়া যায়। ওখানে একটা ভিডিও ক্যামেরাও ছিলো। তৌফিকসহ তিন বন্ধুরা আমার পিচ্চি বোনটার সাথে….” এতটুকু বলতেই চোখ বন্ধ করে নেয় রিয়াদ। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে আবারো শুরু করে, “আমি ভিডিওর প্রথম অংশটুকু দেখতেই আমার আত্না কেঁপে উঠে। বাকিটুকু আমি চালাতেও পারি না। সে এভিডেন্স যখন পুলিশের কাছে নিয়ে যাই তখন সে তো তৌফিকের কিছু করেই না উল্টো আমার ও আমার বাবা মা’য়ের সামনে সামনে ভিডিওটা ছেড়ে নিজে দেখে। আজও আমার বোনের আর্তনাদ আমার কানে ভাসে। আমার বাবা সেদিনই আত্নহ’ত্যা করে। মা পাগলপ্রায় হয়ে যায়। তার জন্য আমার সম্পূর্ণ দুনিয়া শেষ হয়ে যায়। পরের বছর প্রথমবার তৌফিক তার বাবার সাথে জনগণের সামনে স্টেজে আসে। সেদিনই আমি তাকে শেষ করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু ফজলু ভাই আমাকে থামায়। অভ্র ভাইয়ের কাছে নিয়ে যায়। অভ্র ভাই আমাকে সব জানায়। বলে যে এত গার্ডদের পেরিয়ে আমি তাকে কিছু তো করতেই পাড়ব না উল্টো আমার মা সন্তান হারা হয়ে যাবে। তারপর আমি তার সাথে যুক্ত হই। প্রতিশোধ নিতে। নিজের ছোট্ট পিচ্চি বোনটার প্রতিশোধ নিতে। আমার বোনের সবে পনেরো বছর ছিলো। মানুষ কতটা নির্দয় হলে এমন পিচ্চি মেয়েকে এত যন্ত্রণা দিতে পাড়ে?”
কথাটায় মেঘলা তাচ্ছিল্য হাসে, “যে নিজের সন্তানকে জেদের বসে লাথি দিয়ে মে’রে ফেলে তার হৃদয় থাকবে কীভাবে?”
রিয়াদ বিস্ময় নিয়ে তাকায় মেঘলার দিকে। মেঘলা নিজের পেটে হাত রেখেছে। মেঘলা আরও বলে, “আমি দুইবার প্রেগন্যান্ট ছিলাম। দুইবারই ওই জানোয়ার আমার বাচ্চাদের মে’রে ফেলেছে। তাও প্রথমবার আমার বাবার সামনে। সে একটা শব্দও করে নি জানো? উলটো যখন আমি ব্যাথায় চিৎকার করছিলাম তখন আমাকে মুখ বন্ধ রাখতে বলেছে যেন সে তার ব্যবসায়ের কথা ঠিকভাবে বলতে পারে। আচ্ছা সবাই বলে সন্তানের মধ্যে বাবা মা’য়ের জীবন বাস করে। তাহলে আমার জীবন নিয়ে এভাবে কেন খেলল আমার বাবা?”
রিয়াদ কিছু সময়ের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। সে কি বলবে বুঝতে পাড়ে না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে সে জানায়, “চিন্তা করবেন না মেডাম আজ সবার শাস্তির দিন। আপনার ভাইকে অলরেডি জেলে এক লোক পাঠিয়ে মেরে প্যারালাইজড করা হয়েছে। আপনার বাবার সব ইললিগাল ব্যবসায় রেইড পড়া হয়ে গেছে। জলদি তাকে পুলিশ ধরবে। তৌফিকের ক্ষমতা ছাড়া সে কিছু করতে পাড়বে না। আমার বোনের সাথে যারা তৌফিকের সাথে মিলে খারাপ কাজ করেছে তাদের দুইজনকে তো অভ্রভাই আগেই শেষ করেছিল আজ আরেকজনের পালা। আর রইল তৌফিকের ব্যাপার। তাকে অলরেডি পুলিশ ধরেছে।”
“কী করবে পুলিশ? কয়দিন ধরে রেখে ছেড়ে দিবে। আর যদি না-ও ছাড়ে তাহলে জেলে আরাম আয়েশে থাকবে। তোমরা তো জানো ওর বাবা কে!”
“আর আপনার জানা উচিত আপনার বন্ধুর বুদ্ধি এতটুকুতে থেমে থাকবে না।”
মেঘলা অবাক হয়ে তাকায় রিয়াদের দিকে, “মানে?”
“মানে তৌফিক নিজের অপরাধের যথাযথ শাস্তি পাবে।”
“সেটা নিজের চোখেই দেখতে পাড়বেন।”
“অভ্র সুরক্ষিত থাকুক এটাই চাই।” বলে মেঘলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, “ও ছাড়া আপন বলতে এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই যে।” কথাটা বলে আবার কিছু মনে পড়ে মেঘলার। সে পাশ ঘুরে তাকায় গগনের কবরের দিকে, “তুমি ভুল বলেছিলে রিয়াদ।”
“কী ভুল?” রিয়াদ বিভ্রান্তিতে পড়ে যায়।
“এই আশ্রম কেমন আমার নামে না।” মেঘলা নিজের তলপেটে হাত রাখে। আনমনে তার ঠোঁটের কোণে হাসি এঁকে উঠে, “কখনো এই পৃথিবীতে না আসা আমার সন্তানের নামে। আমি গগনকে সবসময় বলতাম আমাদের ছেলে হোক বা মেয়ে তার নাম মেঘ রাখবো। আমাদের মেঘলা গগনের মেঘ। ও যাবার সময়ও আমাকে স্বপ্ন পূরণ করে গেল দেখলে? দ্বিতীয়বার প্রেগ্ন্যাসির সময় তৌফিক এত জোরে আমার পেটে আঘাত করেছিল যে আমি কখনো আর মা হতে পাড়তাম না। আর দেখো গগণ আমার জন্য এতগুলো বাচ্চা পালন করার দায়িত্ব দিয়ে গেছে। ওদের মা হবার সুযোগ দিয়েছে। আমার বাঁচার কোনো উদ্দেশ্য ছিলো না। জীবনের শেষ মুহূর্তেও আমার বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য রেখে গেছে।”
.
.
হাস্পাতালের করিডরে মায়া পায়চারি করছে। বারবার কেবিনে দেখছে। সুরভি মায়াকে এমন বিচলিত দেখে তার কাছে যায়। তাকে বসিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “তুমি এত চিন্তা করছ কেন মায়া? ডাক্তার বলেছে তো ইঞ্জুরি এত ভয়ানক না। ও সেফ আছে।”
“ডাক্তার তো এটাও বলেছে যে অনেক ব্লাডলস হয়েছে ওর। আমার জন্য… ওই গর্দভকে কে বলেছে আমার জন্য আঘাতটা নিতে?”
“তোমাকে ভালোবাসে এজন্য।” সুরভি তার হাত ধরে বলে।
“কচু বাসে।”
অভ্র রুম থেকে বের হয়ে এতোক্ষণে। মায়াকে এমন বিচলিত অবস্থায় দেখে জানায়, “ডাক্তার বলেছে সব ঠিক আছে।”
“ডান…ডান কাঁধে লেগেছে। ওর গিটার বাজাতে সমস্যা হবে না তো? গান ওর জীবন। আমি চাই না আমার জন্য… ”
“মায়া রিলেক্স। জোহান ঠিক আছে। আরেকটু গভীর আঘাত হলে হয়তো সমস্যা হতো। তুমি ওর সাথে দেখা করতে পাড়ো।”
সুরভি বলে, “হ্যাঁ তুমি জোহানের সাথে থাকো আমি অভ্রর মাথায় ব্যান্ডেজ করিয়ে আনি।”
মায়া সম্মতি জানায়।

মায়া ভেতরে ঢুকে দেখে জোহান বেডের উপর আধশোয়া অবস্থায় বসে আছে। তার কাঁধে ব্যান্ডেজ করা হয়েছে। শার্টের বোতাম খোলা। সে ভেতরে যেতেই জোহান এক হাত মেলে তাকে নিজের কাছে ডাকে একগাল হেসে। মায়াও দৌড়ে যায় তার দিকে। যেয়ে তার পাশে বসে। জোহান এগিয়ে এসে তাকে বাহুডোরে নিতে গেলে মায়া একে একে কতগুলো কিল ঘুষি, চাপড় মারে তার উন্মুক্ত বুকে।

জোহান হতবাক হয়ে তার থেকে নিজেকে রক্ষা করে। বলে, “নির্দয় মহিলা কেউ অসুস্থ ব্যক্তিকে এভাবে মারে?”
“কে বলেছিল তোমাকে আমার সামনে আসতে হ্যাঁ? গর্দভ আপনা-আপনি বলি তোমাকে? কী অবস্থা হয়েছে তোমার? আরেকটু গভীরে আঘাত পৌঁছালে তুমি গিটার বাজাতে পাড়তে না হয়তো।” বলে মায়া তার এতক্ষণ চেপে রাখা কান্না আর থামিয়ে রাখতে পাড়ে না। ফুপিয়ে কেঁদে উঠে।

জোহান তার গালে হাত রাখে। আলতো স্বরে বলে, “তুমি আমার কাছে এখন আমার গান থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ।”
কথাটায় মায়া অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। আর জোহান তার হাত মায়ার পিঠে রেখে তাকে বুকে ভরে নেয়। তারপর শান্তির নিশ্বাস ফেলে, “তৌফিককে যখন তোমার উপর হামলা করতে আসতে দেখেছিলাম আমার নিশ্বাস আটকে গিয়েছিল যেন।”
মায়া তার থুতনি জোহানের বুকে রেখে তার দিকে তাকায়, “আমারই খেয়াল রাখার দরকার ছিলো। আমি খেয়াল করলে ওর হাত ভেঙে দিতাম।”
“ওর হাত আর নেই তোমার আইডিয়াতে মেডাম। কি ভয়ানক তুমি! ভাবা যায়? তোমার সাথে সারাজীবন মেপে কথা বলতে হবে দেখছি। নাহলে কখন আমার উপর কখন এমন ভয়ানক বুদ্ধি খাটাও কে জানে।”
“সারাজীবন?” মায়া ভ্রু কুঁচকায়। তার বুকের থেকে মাথা উঠিয়ে সরে যায়।
জোহান মুচকি হেসে তার পকেট থেকে একটি নীল রঙের বক্স বের করল। করে বলল, “ভেবেছিলাম একদম প্রিপারেশন নিয়ে তোমাকে প্রাপোজ করব। কিন্তু কেন যেন আর অপেক্ষা করতে পাড়ছি না। কেমন ভয় হচ্ছে, বিচলিত মনে হচ্ছে সকাল থেকে। হয়তোবা তোমার চিন্তায়। সেদিন যখন তোমাকে পাচ্ছিলাম না আমার ভেতরটা শূন্য হয়ে গিয়েছিল। জানো আমি তোমাকে ছাড়া আমার ভবিষ্যত কল্পনা করার চেষ্টা করেছি। পাড়ি নি। তোমাকে ছাড়া আমি জীবনটাই কল্পনা করতে পাড়ছি না। আমি জানি না ভবিষ্যতে এই অনুভূতি হারাবে কি-না! কিন্তু আমি আর ভবিষ্যতের কথা ভাবতে চাই না। তাই আর দেরি না করে এই হাস্পাতালের বেডেই তোমাকে আমার নামে করে নিলাম।”
সে বক্স থেকে ব্লু সাফায়ার রিং-টা বের করে মায়ার বাম হাত নিজের হাতে নেয় তার আনামিকা আঙুলে আংটি পড়িয়ে সে আঙুলে একটি চুমু খায়।

জোহান একরাশ হাসি নিয়ে মুখ তুলে দেখে মায়া।স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তার চোখেমুখে কোনো হাসি নেই। তাকে দেখে ঘাবড়ে যায় জোহান, “তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? তুমি হ্যাপি না? তুমি তো চাইতে যেন আমরা বিয়ে করি, সারাজীবন একসাথে থাকি তাই না?”
জোহান তার হাত ধরে নেয়। শক্ত করে।
মায়া শান্ত গলায় প্রশ্ন করে, “এতদিন পর! প্রায় তিনমাস ধরে তুমি বলে এসেছ তুমি কমিটমেন্ট দিতে পাড়বে না। হঠাৎ আজ কেন?”
“এই ‘যে বললাম তোমাকে ছাড়া আমার জীবন শূন্য শূন্য লাগে।”
“হুঁ”
মায়া মাথা নামালে জোহান তার গালে হাত রেখে মাথা উঁচু করে। তার গালে আঙুল বুলিয়ে প্রশ্ন করে, “কী হয়েছে মায়া? অল ওকে?”
“হুম।”
“তুমি কী আমার জন্য চিন্তা করছ?”
জোহান তার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছু সময়। তার গালে রাখা হাত ঘাড়ের পিছনে স্লাইড করে নিয়ে তাকে নিজের কাছে নিয়ে আসে।

মায়া অবাক দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। জোহান বলে, “মিস মায়া চৌধুরী আপনি এখন আনঅফিসিয়ালি আমার। ক’দিনের মধ্যে আপনাকে অফিসিয়ালি আমার মিসেস করে আনবো। এখন সব চিন্তা ভুলে জলদি হ্যাপি হও। কারণ এই মুহূর্ত আমার কাছে অনেক স্পেশাল। হয়তো সবচেয়ে বেশি স্পেশাল।”
মায়ার বুঝে উঠার আগেই জোহান তার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়। মায়া তাকে ঠেলে সরাতে চাইলে তার ঘাড়ে রাখা হাত কোমড়ে নিয়ে আটকায়। তাকে আরও কাছে টেনে আনে। তার ঠোঁটে ছোট একটা কামড় দিয়ে তাকে ছাড়ে।

মায়া ঠোঁটে আঙুল ডলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় জোহানের দিকে। জোহান হাসে তার চাহনি দেখে, “আপনাকে আমার কাছে সবসময়ই ঋণী থাকতে হবে মেডাম।”

এমন সময় দরজায় নক পড়লে মায়া তার কাঁধে একটা চাপড় মেরে তার শার্টের বোতাম লাগাতে শুরু করে, “ইনসিকিউর ফিল করছো না’কি?”
“আমি কেন ইনসিকিউরড ফিল করব?”
” তোমার পুরুষকে অন্য কেউ শার্টলেস দেখে ক্রাশ ট্রাশ খেয়ে নেয় যদি!”
মায়া দু’টা বোতাম লাগিয়ে উঠতে নিলে জোহান তার হাত ধরে টান দিলে সে জোহানের বুকে এসে পড়ে। সে মায়ার চুল আলতো করে কানের পিছনে গুঁজে বলে, “মায়া আমি পুরশু রিলিজ পাবো। হাস্পাতাল থেকে সোজা কাজি অফিসে চলো। বিয়ে করে নেই। পড়ে অনুষ্ঠান করব।”
মায়া একগাল হাসে প্রথমে। তারপর তাকে ঠেলে সরিয়ে বলে, “এত তাড়া কেন মিস্টার? আপনি আমাকে তিনমাস যেভাবে ঘুরিয়েছেন আপনাকে তো এভাবে ছাড় দেওয়া যাবে না।”
“তাহলে কী শাস্তি দিবেন ম্যাডাম? আপনার সব শাস্তি মাথা পেতে নিব।”
“নিতেই হবে।”
দরজায় আমার কড়া পড়লে মায়া দ্রুত জোহানের বাকি বোতাম লাগিয়ে দরজা খুলে যেয়ে। দরজা খুলে দেখে সভ্য ও ইনারা আসে। সভ্য ভেতরে ঢুকে সোজা জোহানের কাছে যায়। উপর থেকে নিচ পর্যন্ত তাকে দেখে, “যখন শুনেছিলাম তৌফিক তোকে আঘাত করেছে তখন তো আমি চিন্তায় আত্নহারা হয়ে গিয়েছিলাম। এভিডেন্সের পেনড্রাইভ কারো কাছে দিয়ে আসতেও পাড়ছিলাম না। অবশেষে কপি করা পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্ত আমার যে টেনশনে কেটেছে। আর এদিকে তুই…তুই তো পুরা সুস্থ।”
“সুস্থ? ভাই ছু’রি বের করার সময় জান শেষ হয়ে গেছে। কত ব্লিডিং হইসে জানিস?”
“দেখে তো মনে হয় না।”
“কী দেখে মনে হয় না? এত বড় ব্যান্ডেজ করেছে সোল্ডার দিয়ে। ডাক্তার ডান হাত নাড়াতেই মানা করেছে।”
ইনারা তখন ঠোঁট টিপে হাসে। একবার জোহানের দিকে তাকায় আবার মায়ার দিকে। মায়ার কাছে তার ব্যবহার আজব লাগে। সে জিজ্ঞেস করে, “আজ মিসেস বকবকানি এখনো চুপ কীভাবে?”
তখনই ইনারা জোরে হেসে দেয়। সভ্য প্রথমে তার দিকে চোখ ঘুরালেও সেও নিজের হাসি থামাতে পাড়ে না। মায়া জিজ্ঞেস করে, “এখানে হাসার কী আছে?”
“তেমন কিছু না প্রথমবার দরজা নক করে ঢুকি নি।” ইনারার কথায় মায়া এবার বিরক্ত হয়, “তো নক না করে ঢোকার সাথে এভাবে হাসার….”
হঠাৎ তার মাথায় কথাটা ঢুকতেই সে লজ্জায় নুইয়ে যায়।
ইনারা তখন তার দিকে ঝুঁকে কানের কাছে এসে জোরে বলে, “আপু তোমার ফার্স্ট কিস কিন্তু দেখে ফেলেছি।”
মায়া আর এখানে থাকতে চাইল না। সে ইনারাকে এতটুকু সময় ধরে যতটুকু চিনেছে ইনারা তাকে সহজে ছাড়বে না। এই এক কথা পেয়েছে। এখন এই কথাটা তার আশেপাশে ঘুরে ঘুরে মাছির মতো ভিনভিন করেই যাবে। তাই সে ভাবলো এখান থেকে কেটে পড়ার কথা। সে ঘুরে দরজার দিকে যেতে নিলেই জোহানের কথা শুনল, “এটা মোটেও ওর ফার্স্ট কিস ছিলো না।”
কথাটা শুনে মায়া ঘুরে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকাল জোহানের দিকে। তার মুখ আপনা-আপনি হা হয়ে গেল। মানুষ এতটা নিলজ্জ হতে পারে?

ভাগ্যিস সে মুহূর্তে অভ্র আর সুরভির আগমন ঘটল। নাহলে এরপর লজ্জায় আর সে আসতেই পাড়তো না সভ্য ও ইনারার সামনে। সুরভি রুমে ঢুকে ইনারাকে দেখে জড়িয়ে ধরল। তাকে ছেড়ে বলল, “তুই এই অবস্থায় এখানে এসেছিস কেন? বাহিরে যে গেঞ্জাম চলছে তোর এখানে আসা মোটেও ঠিক হয় নি।”
জোহান জিজ্ঞেস করে, “কী গেঞ্জাম?”
“জনগণ আন্দোলনে নেমেছে। প্রধানমন্ত্রীকে নিজের পদ ছাড়তে হবে। আর তৌফিককে লাইভ টিভিতে ফাঁসি দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী দেশে আসার জন্য রওনা দিয়েছিলেন। এয়ারপোর্টে এত গেঞ্জাম হয়েছে যে প্লেন থেকে নেমে অন্য প্লেনে ফেরত গেছেন।”
অভ্র জোহানের বেডের পাশের টুলে বসে, “তুমি লাইভ স্ট্রিম অন করেছিলে বলে সবটা আরও সহজ হয়ে গেছে। স্মার্ট মুভ।”
ইনারা প্রশ্ন করে, “কিন্তু ফাঁসি দিতে বললেই কী দিবে? হতে পাড়ে কাস্টাডি নেওয়ার পর তাকে বিদেশে পাঠানো হবে। আর জেলখানায় রাখা হলেও তাকে তো আর কষ্ট পেতে দিবে না তার বাবা। এতটা ক্ষমতা তো আছেই।”
অভ্র ভ্রু নাচিয়ে সভ্যর দিকে তাকায়, “তোর ওয়াইফেরও দেখি ভালো বুদ্ধি আছে। অন্তত তোর থেকে বেশি আছে।”
প্রশংসা শুনে ইনারা ভাব নিয়ে তার চুল ঝটকায়। তারপর সুরভির কাঁধে হাত রেখে বলে, “বুঝলি জান এতদিন ভাইয়ের বউ থাকায় দু’টো প্রশংসার কথাও আসে নি। এখন যেই শালী হয়েছে তোকে পাওয়ার জন্য পটানোর চেষ্টা করছে বুঝলি?”
অভ্র নির্দ্বিধায় বলে ফেল, “ও তো সম্পূর্ণ আমারই।”
সুরভি লজ্জায় লাল হয়ে যায়। আর ইনারা তাকে লজ্জায় দেখে তার সাথে মজা নিয়েই যাচ্ছে।

এমন সময় কল আসে অভ্রের ফোনে। সে কল ধরে কিছুক্ষণ কথা বলে। ফোনটা রাখা মাত্রই সে সকলের দিকে তাকায়, “তৌফিককে পুলিশের গাড়ি থেকেই কেউ নিয়ে গেছে। পুলিশের গাড়িতে হামলা হয়েছিল।”
সকলকে আতঙ্ক গ্রাস করে। ইনারা তো ঘাবড়ে বলে, “আমি বলেছিলাম আপনাদের আইনের হাতে ওকে তুলে দিলে কিছুই হবে না। নিশ্চিত ওর বাবার লোকেরাই তাকে নিয়ে পালিয়েছে। কোনো সেইফ জায়গায় রাখবে এখন।”
জোহান বলে, “তাহলে ওকে শাস্তি দেবার আমাদের সব পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে?”
“মেবি ও এখন সেইফ জায়গায় আছে।” বলে অভ্র মায়ার দিকে তাকায়। মায়াও তার কথায় হাসে, “পার্ফেক্টলি সেইফ জায়গায় আছে।”
সবাই অবাক হয়ে তাদের দিকে তাকায়। ইনারা কুড়কুড় করে এসে দাঁড়ায় সভ্যের পাশে। তার দিকে ঝুঁকে বিড়বিড় করে জিজ্ঞেস করে, “এদের আবার কী হলো? পরাজিত হওয়ার শোকে পাগল হয়ে গেল না’কি?”
“এরা নিজে পাগল হওয়ার লোক নয়, মানুষকে পাগল বানানোর লোক।”
“তাহলে এখন কী হলো এদের?”
“তোমার মনে হয় এই দুই শেয়াল মস্তিষ্কের লোকের ভাষা আমরা বুঝবো?”
“পয়েন্ট আছে।”
“তাই অকারণে নিজের ব্রেন এত চালিও না। সময় এলে আপনা-আপনি জানবে।”

মায়া জোহানকে দেখে আফসোসের সুরে বলে, “এই মহান লোকের কারণে কাল এখানেই থাকতে হবে তাই শো-টা মিস হয়ে যাবে।”
ইনারা মাথা চুলকায়, “কীসের শো আবার?”
“তোর জেনে লাভ নেই তুই যেতে পাড়বি না।”
“মানে সব শো এর মজা তোমরা একাই নিবে? বলো তো কী হবে কালকে?”
.
.
একটি এক্সিডেন্ট হওয়া গাড়ি পাওয়া যায় লেকের পাড়ে। জলন্ত। তাও তিনটি লাশসহ। ধারণা করা হয় তৌফিককে যখন নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল পুলিশের ভ্যানের উপর এট্যাক করে তারপর পালানোর সময় গাড়িটি এক্সিডেন্ট করে। এক্সিডেন্টের ক্ষেত্রে আগুন লাগে। এটি এখন সব নিউজ চ্যানেলের হেডলাইন।
.
.
অন্ধকার রুম। রুমের মাঝখানে হলুদ বাতি জ্বলছে।বাতির ঠিক নিচে একটি লোককে রাখা। তার হাত বাঁধা রশি দিয়ে। লোকটির বাদামী পাঞ্জাবিতে ময়লার দাগ ভর্তি। চোখে মুখে র’ক্ত। হাতে সম্পূর্ণ আঘাতের চিহ্ন।লোকটি মিটমিট করে নিজের চোখ খুলে অন্ধকার রুমে নিজেকে দেখে ছটফট করতে থাকে। কিন্তু রুমাল থাকার কারণে চিৎকার করতে পাড়ে না।

কিছুক্ষণ পর রিয়াদ একটি চেয়ার এনে তার সামনে রাখে। সে তাকায় রিয়াদের দিকে। তার ছটফটানি আরও বাড়ে। সে চেয়ারে এসে বসে অভ্র। একদম তার মুখোমুখি। পা’য়ের উপর পা তুলে। বাঁকা হেসে বলে, “তো মিস্টার তৌফিক কেমন লাগছে আপনার?”
তৌফিক আরও ছটফটিয়ে উঠে। হাত পা এত জোরে টান দিতে থাকে যেন রশি ছিঁড়ে যাবে। অভ্র তা দেখে হেসে দেয়, “নিশ্চয়ই আপনি এটাই ভাবছেন আপনি এখানে কীভাবে তাই না? সবাই ভাবছে আপনাকে বাঁচানোর জন্য আপনার বাবা লোক পাঠিয়েছিল। তাদের সাথে পালাতে যেয়ে আপনার গাড়ি এক্সিডেন্ট হয়েছে। পুলিশের হাত থেকে আমি আপনাকে কীভাবে বাঁচালাম? উপস বাঁচালাম না মা’রলাম। কারণ এই পৃথিবীর কাছে আপনি এখন মৃ’ত। ওহ আমি এটা কেন করলাম?”
অভ্র পা’য়ের উপর থেকে পা সরিয়ে দুই হাঁটুতে কণুই রেখে তাকায় তৌফিকের দিকে, “কারণ আপনি এত জলদি ম’রা ডিসার্ভই করেন না। আর আপনার শাস্তি তো বাকি আছে। এই শাস্তি এত সহজে ম’রলে শেষ হবে না।”
কথাটা শুনে তৌফিক আরও লাফাতে শুরু করে।
অভ্র রিয়াদের দিকে তাকিয়ে বলে, “সেদিন আমি আমার বুক ঠান্ডা করেছি। আজ তুই কর। এই জংলী ষাড়কে কাবু কর যেন নড়তে না পাড়ে।”

রিয়াদ একটু হাতুড়ি নিয়ে আসে। সাথে কয়টা বড় বড় তারকাটা। তা দেখে তৌফিক চোখ বড় বড় করে ডানে বামে দ্রুত মাথা নাড়ায়। রিয়াদ একটা তারকাটা তৌফিকের হাতের উপর রেখে হাতুড়ি দিয়ে মা’রতেই তৌফিক ছাদের দিকে মুখ করে নেয়। তার চোখগুলো বড় বড় হয়ে যায়। যেন এখনই কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে। সে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে চায় কিন্তু রুমাল তার মুখে এভাবে ভরা হয়েছে যেন এক বিন্দু শব্দও মুখ দিয়ে বের হয় না। রিয়াদ তার দুইহাতে চারটা ও পা’য়ে চারটা তারকাটা মা’রল। তারপর অভ্রকে জিজ্ঞেস করে, “ভাই এখন কী করব?”
“করব? কী করব? এখন তো আমাদের কিছুই করার নেই। আমাদের তো বুক ঠান্ডা হয়েছে। এখন যাদের বুক এই জীবনে কখনো ঠান্ডা হতে পাড়বে না তাদের ডাক দে।”
তৌফিক দেখে দরজা দিয়ে মেঘলাসহ কতগুলো মেয়ে আসতে। তাদের হাতে ধোঁয়া উঠা পানির পাতিল, ছু’রি, লাঠি, কয়লা তা সব যা তৌফিক তাদের যন্ত্রণা দেবার জন্য ব্যবহার করতো। সে প্রথম তৌফিকের চোখে ভয় দেখতে পাড়ে অভ্র।

অভ্র হেসে বলে, “আপাতত ওদের থেকে আপ্পায়ন গ্রহণ করেন তৌফিক সাহেব। জলদি আপনার পাচার করা মেয়েদের দেশে ফেরানোর ব্যবস্থা করছি তখন তাদেরও আপ্পায়ন করা লাগবে।” বলে সে উঠে গেল। যাওয়ার সময় মেয়েগুলোর দিকে তাকাল, “আপ্পায়ন করতে যেন অসুবিধা না হয়।”
একটি অষ্টাদশী মেয়ে উওর দেয়, “উনি যেভাবে আমাদের আপ্পায়ন করেছেন সেভাবেই করব।” বলে মেয়েটি যেয়েই তার হাতে রাখা বালতির জ্বলন্ত লাল কয়লা তার পা’য়ে ঢেলে দেয়। আরেকটি মেয়ে ছু’রি দিয়ে তার হাতে একের পর এক কোপ দিতে থাকে যতক্ষণ না পর্যন্ত তার মাংস না বের হয়ে আসে। সবাই একে একে তাদের সাথে করা জুলুমের একভাগ তৌফিককে দিতে ব্যস্ত। মেঘলা দাঁড়িয়ে আছে পিছনে। সে তখনও কাঁপছিল। এই লোকটি তার আতঙ্ক। এত বছর তার দেওয়া আঘাতের ভয় কেবল তার অন্তরে না দেহের শিরায় শিরায় বাস করে। এতবছরের ট্রমা ভুলে যাওয়াটা তার জন্য সহজ নয়।

অভ্র তাকে এভাবে স্থির থাকতে দেখে তার কাছে যায়। তার কণুইয়ে হাত রাখতেই চমকে তাকায় মেঘলা। অভ্রকে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। অভ্র তাকে চোখের ইশারায় সান্ত্বনা দেয়। বলে, “এই লোক তোর জীবন নরক করেছে, তোর বাচ্চা, তোর ভালোবাসাকে খুন করেছে তাকে তুই এত সহজে ছেড়ে দিবি? কেবল মাত্র ভয়ের জন্য? গগণের মেঘলা তো এতটাও দুর্বল না।”
মেঘলা শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে অভ্রর দিকে। তার চোখে পানি চলে আসে। সে কিছু সময় নেয়। নিজের চোখের পানি মুছে দ্রুত এগোয়। তৌফিকের সামনে দাঁড়ায়। একটি মেয়ের কাছ থেকে লাঠি নিয়ে একের পর এক মারতে থাকে।

অভ্র দৃশ্যটা দেখছিল। তৌফিক যখন চোখের জলে ও রক্তে ভাসমান তখন অভ্র বলে, “আজই মে’রে ফেল না। ধীরে সুস্থে আপ্পায়ন করো। এত তাড়াতাড়ি ম’রে গেলে তো হবে না। প্রতিদিন ম’রবে ও।”
কথাগুলো বলে অভ্র বেরিয়ে যায় সেখান থেকে। নিচের গোডাউন থেকে বের হয়ে একপলক দেখে গগণের মেঘবাড়ি। কয়েকটা বাচ্চা এসে তার সাথে কথা বলে। সে সকলকে আদর করে দিয়ে এগোয় সামনের রাস্তায়। তার বন্ধু র কবরের সামনে যেয়ে দাঁড়ায়। কতক্ষণ তাকিয়ে থাকে সেদিকে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার চোখ ভিজে যায়। কিন্তু ঠোঁটে একরাশ হাসি আঁকা। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “আমি আমার ওয়াদা পূরণ করেছি দোস্ত। অবশেষে… অবশেষে… ”
.
.
জোহানকে আজ রিলিজ দেবার কথা। সভ্য, ইনারা, সুরভি ও তার মা তাকে নিতে এসেছে। যদিও এই দুইদিন তার মা ও মায়া তার সাথেই হাস্পাতালে ছিলো। কিন্তু সকাল থেকে সে মায়াকে দেখতে পায় না। যাওয়ার সময়ও জোহান এদিক ওদিক তাকিয়ে মায়াকে খুঁজছিল। সভ্য ব্যাগ নিয়ে জিজ্ঞেস করে, “তাহলে যাই চল।”
“মায়া আসুক। ওর জন্য অপেক্ষা করবি না?”
“ও আসবে না।” কেমন ইতস্ততভাবে কথাটা বলে সভ্য।
“আসবে না মানে?” জোহান কপাল কুঁচকায়। আবার পরক্ষণেই স্বাভাবিক হয়ে যায়, “আমার জন্য বাসায় অপেক্ষা করছে?”
সভ্য চোখ ফিরিয়ে নেয়। সে বলতে যেয়েও বলতে পাড়ছে না। ইনারা তখন বলে, “মায়া আপু চলে গেছে।”
“কোথায় গেছে?” এবার জোহানের হৃদয়ে স্পন্দন কেমন গতি হারা হয়ে যায়। ভয় এসে ভার করে তার বক্ষপিঞ্জরে।
ইনারা আবারও বলে, “মায়া আপু আতিফ ভাইয়ার সাথে বিদেশে চলে গেছে।”

চলবে….