অনুভূতির খাঁচা পর্ব-১৯+২০

0
27

অনুভূতির খাঁচা
পর্ব-১৯
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

গিটারের শব্দ মিশে যায় বাতাসে। মিষ্টি ধ্বনি চারপাশে ছড়িয়ে গানের সুরের সাথে মিলে যায়। সকলে পুলের পাশের বেঞ্চগুলোতে বসে আছে। সবার মনোরঞ্জনের জন্য গান গাইছে সভ্য….

“গল্পটা তোমার-আমার,
মিষ্টি হাওয়া ছুঁয়ে যাবার মতো ভালোবাসার….
তুমি যদি হও মেঘের খেলা,
আমি তোমার ওই আকাশ মেলা,
আমি যদি হই গান শুনো,
তুমি আমার গানের সুরের বন্ধন।
তুমিতে তুমিতে আমারই জান
তুমি ছাড়া আমি যে নাই…হায়!
তুমি আমার জীবন আর মরণ,
তুমি ছাড়া এই জীবনই ছলন….”

অভ্র ফোনে কাজ করতে করতে সেখানে আসে। সকলকে একসাথে বসে এতটা ধ্যান সহকারে গান শুনতে দেখে বিরক্ত হয়। কারও কী আর কোনো কাজ নেই? সবাইকে এড়িয়ে যেতে নেয় সে, কিন্তু মা’য়ের ডাক পড়ে। মা উঠে আসে অভ্রর কাছে,
“তুই কোথায় যাচ্ছিস? সবাই এখানে বসে আছে। তুই-ও আয়।”
“দেখো মা আমার এসব নাটক দেখতে ভালো লাগে না। গানই তো, এখানে সবার এত আগ্রহ দেখোনোর কী হলো?’
মা হাসে। বেশ নরম কন্ঠে বলে,
“এমন আগ্রহ নিয়ে শুনলেই বুঝবি। গানে কেবল কিছু শব্দ থাকে না। থাকে অনুভূতি। এই গানটার প্রতিটি শব্দ সভ্য ইনারার জন্য গাইছে।”
“ওদের ভালোবাসায় আমার আগ্রহ দেখানোর দরকার আছে? আমি গেলাম।”
“ওদের ভালোবাসায় আগ্রহ দেখানোর দরকার নেই কিন্তু তোর সম্পর্কে আগ্রহ দেখানোর বিশেষ প্রয়োজন আছে।”
“মানেটা বুঝলাম না।”
“সভ্যর চোখদুটো দেখ, যেভাবে ইনারার দিকে তাকিয়ে আছে যেন আসলেই মনে হচ্ছে তার জন্য প্রাণ উজার করে দিতে পারবে। ইনারার চোখেও একই অনুভূতি। তোর বাবা এক মুহূর্তও ছাড়ে না আমাকে বিশেষ অনুভব করানোর জন্য, নিজের ভালোবাসা প্রদর্শন করার জন্য পরিবর্তে আমিও তার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছি। তোর দাদা-দাদী জীবনের এত সংগ্রাম লড়ার পরও তাদের ভালোবাসা হারায় নি। তাদের দেখলেই অনুভব হয় তারা একে অপরকে কতটা ভালোবাসে, সম্মান করে, যত্ন নেয়। অথচ তোর আর সুরভির মাঝে এমন কিছু দেখতেই পাই নি।”
” চব্বিশ ঘন্টাও হয় নি আমাদের এনগেজমেন্টের। কী দেখতে পাবে তুমি? ”
“চব্বিশঘণ্টাও লাগে না সম্পর্ককে আঁচ করার জন্য।”
“আমার জন্য এ-সব কেবলমাত্র দেখানো। ভালোবাসা দেখানো লাগে না।”
“হয়তো তোর জন্য। কিন্তু এক সম্পর্কে তুই তো আর একা নেই রে বাবা।” মা অভ্রর কাঁধে হাত রেখে বলে, “অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, মেয়েদের জীবনে সবচেয়ে সুন্দর জিনিসটা কী জানিস? তার জীবনসাথীর কাছ থেকে পাওয়া মিষ্টি অনুভূতি। যে অনুভূতিতে মানুষ স্ব-ইচ্ছায় এই অনুভূতির খাঁচায় সারাজীবন আটক থাকতে চায়। একটি সম্পর্কে তোর সামনের জনের অনুভূতির কথাও ভাবতে হবে, কেবল তোরই নয়। নাহয় যখন সে তার আশেপাশে এত সুন্দর সম্পর্ক দেখবে তখন ওর আফসোস হবে তোর সাথে থাকার কারণে, বুকের ভেতর কষ্ট বেঁধে থাকবে, তখন তুই চেয়েও এই সম্পর্ক সুন্দর করতে পারবি না।”
অভ্র মা’য়ের পিছনে তাকায়। দেখে সুরভিকে। সে হাঁটুতে কণুই রেখে গালে হাত রেখে আগ্রহসহকারে সভ্যর গান শুনছে। সে আবার তাকায় মা’য়ের দিকে, “কেবল তুমি বলছ দেখে যাচ্ছি।”
মা হাসে, “তা তো বুঝতেই পারছি।
মা তাকে নিয়ে যায় সবার কাছে। তাকে বসায় সুরভির কাছে।

সুরভি তাকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে যায়৷ নড়ে চড়ে বসে। একটু সরে যেয়ে দুইজনের মাঝে জায়গা করে নেয়।
আর অন্যদিকে অভ্র এসে বসলেও নিজের ভাব ছাড়ে নি। কিন্তু আড়চোখে ঠিকই তাকায় সুরভির দিকে। তা কেবল এড়ায় না সভ্যর চোখে তাইতো সে গানের মাঝখানে এক হাসি দিয়ে পঙক্তি পালটে দেয়,

” তুমি আমি আর নীরবতা,
শুনতে কি পাও এই মনের কথা?
ভোর আঁধারেও তোমায় দেখি, তুমি কবিতা, তুমি কবি।

আজকাল মন ডুবে যায় অনুভবে তুমি ভাসো তাই
এই আমি না চিনি আমায়, চেনা আয়নায়।
আমি বার বার বহুবার তোমাকে চাই
আমি বার বার হাজার বার তোমাকে চাই…..”

প্রথমে ইনারা অবাকই হয়, হঠাৎ সভ্য এভাবে গান পালটে দিলো কেন? এরপর তার চোখের দিকে তাকিয়ে নিজেও তাকায় সুরভি ও অভ্রর দিকে। অভ্র তাকিয়ে আছে সুরভির দিকে। ইনারা হেসে দেয়। তার মনে পড়ে তাদের গল্প। সভ্য এভাবেই তার দিকে চেয়ে থাকতো। কিন্তু বোকা সে, কখনো তার মনের কথা বুঝতেই পারে নি। কিন্তু অবশেষে তাদের ভালোবাসার সুখময় সমাপ্তি তো এলো।
ইনারা প্রশান্তির এক উষ্ণ নিশ্বাস মেশায় বাতাসে।

রেশমি অন্যস্থান থেকে উঠে এসে বসে অভ্র ও সুরভির মাঝে। সে অভ্রর দিকে তাকিয়ে ঢঙ করে বলে, “আপনি অভ্র তাই না? আপনার নিউজে মাঝেমধ্যে দেখেছি। আপনি মোবাইল থেকে সামনা-সামনি বেশি হ্যান্ডসাম। বাই দ্যা ওয়ে আমি রেশমিকা… আমার নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে অনেক বড় নাম আছে।” সে তার পিছনের চুলগুলো ঢঙ করে সামনে এনে হাত বাড়ায় অভ্রর সাথে মেলানোর জন্য।

অভ্র মুখটা কুঁচকে বলে, “আপনার নাম প্রথমবার শুনেছি। সম্ভবত আপনি নিজেকে যত বড় নায়িকা মনে করেন ততটা নয়। নাউ এক্সকিউজ মি, আমার একটু কাজ আছে।” সে হাত না মিলিয়ে উঠে গেল।
রেশমি চোখমুখ কুঁচকে রাগীস্বরে বলে, “এই লোক নিজেকে ভাবেটা কী?” আবার সুরভির দিকে তাকিয়ে বলে, “তুমি এই এরোগেন্ট লোক ছাড়া আর কাওকে পাও নি?”
সুরভি কেবল হাসে। সে আর কী বলবে? সে যেভাবে ফেঁসেছে কেবল সে-ই জানে। শেয়ালের মতো চালাক লোকটা। তার সাথে চালাকি করতে যেয়ে একবারে ফেঁসে গেছে। আর তার এত সাহসও নেই যে সবাইকে সত্যিটা জানাবে।
দুপুরের খাবারের সময়ও রেশমি বসে অভ্রর পাশে। তার সাথে কথা বলার, তাকে এট্রাক্ট করার চেষ্টা করে। কিন্তু অভ্র তার দিকে ফিরেও তাকায় না। তাকে যেন দেখেও নি।”

কিছুক্ষণ পর দুপুরের খাবার শেষে আবার ইনারাসহ সুরভি ও রেশমি দেখা করে আগের রুমেই। ইনারা বলে, “তাহলে ভাইয়া তোকে পাত্তা দেয় নি। মানে কি সে পাশ?”
“সেখানে তোদের আর সুরভির পরিবার ছিলো। সে তো এতও পাগল হবে না যে নিজের ইমেজ নষ্ট করবে। তোর প্লানটাই ছিলো ফালতু, নাহলে আমার মতো ফেমাস, হট এন্ড প্রিটি মেয়েকে সে কীভাবে ইগনোর করতে পারে।হয়তো নিজের ইমেজ বাঁচানোর জন্য, নাহলে আসলেই তার চরিত্র অনেক ভালো।”
“তোর কাছে কোনো প্লান থাকলে বল।”
“সুরভি তুমি জলদি করে অভ্রকে ফোন করে বলে রুমে আসতে। তোমার জরুরী কথা আছে।”
“আমার আবার কী কথা আছে?”
“আরে বাবা আমার প্লান কাজ করবে এখন। আমি রুমে একা থাকলে তো নিজের আসল রূপ দেখিয়েই দিবে। তোমরা ব্যালকনিতে লুকিয়ে থেকে কেবল কান্ড দেখো।”
সুরভি তার ফোন হাতে নিয়ে একবার ভাবে। যদি অভ্র জানে তার এই পরিকল্পনার ব্যাপারে তার কি অবস্থা করতে পারে। ভেবে একবার ফোন রাখতে যেয়ে আবার ভাবে এই সুযোগে যদি অভ্রর থেকে পিছু না ছুটাতে পারে তাহলে কতদিন এই নাটকে পড়ে থাকতে হবে কে জানে?

সে কল দেয় অভ্রকে, “হ্যালো আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। হঠাৎ আমাকে মনে করা হলো কীভাবে?”
“আপনার সাথে একটু কথা আছে। রুমে আসতে পারবেন?”
“বাহ এনগেজমেন্টের পর দেখি আমার কথা তোমার একটু বেশিই মনে পড়ছে।”
“এমন কিছু না। দ্রুত একটু রুমে আসুন। জরুরি কথা আছে।”
“সব ঠিক আছে তো?”
“আসলেই বুঝবেন।” বলে ফোন রেখে নিশ্বাস নেয়।

কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজায় নক পড়ে। রেশমি যেয়ে খুলে দরজাটি। সুরভি ও ইনারা পরিকল্পনা অনুযায়ী লুকানো বারান্দায়। তারা কান পেতে শুনছে।
সুরভি মৃদুস্বরে ইনারাকে বলে, “উনি আমার মিথ্যা ধরতে পারলে আমাকে রেহাই দিবে না।”
“আরে ঘাবড়াচ্ছিস কেন আমি আছি না?”
“ভাই তুইও জানিস তোর থেকে দশগুণ বেশি ব্রেন চলে উনার। তুই যা মাসের পর মাস চেষ্টা করেও মুশতাককে পরাজিত করতে পারিস নি। সভ্য ভাইয়া তোর সাথে থাকা সত্ত্বেও। আর উনি একদিনে তার খেলা শেষ করে দিলো। কতটা চালাক সে বুঝ। সে জানলে আমার সাথে তোরও ক্লাস লাগাবে।”
“ভাই ভয় দেখাইস না। আগে দেখতে থাক কী হয়?”

অভ্র রেশমিকে জিজ্ঞেস করে, “সুরভি কোথায়? ও আমাকে ডেকেছিল।”
“সুরভি? ও তো কিছুক্ষণ আগেই চলে গেল।”
“আমাকে ডেকে চলে গেল?” কপাল কুঁচকে নেয় অভ্র, “আচ্ছা আমি চলে যাচ্ছি। ওকে আসলে জানিও আমি এসেছিলাম।”
রেশমি অভ্রর হাত ধরে বলে, “আহা সুরভি নেই তো কী হয়েছে আমি তো আছি।”
“এক্সকিউজ মি?”
“দেখেন এখন আশেপাশে আর কেউ নেই তাই এমন সাধু সাজার ভান করার প্রয়োজন নেই। আপনি এখানে সুরভির কাছে যে কাজে এসেছেন তা আমিও পূরণ করতে পারি।”
“ওর সাথে কেবল কথা বলতে এসেছিলাম।” সে বিরক্ত হয়ে হাত সরিয়ে নেয়।
“হ্যাঁ অবশ্যই একটা ছেলে একটা মেয়ের রুমে কেবল কথা বলতে আসে যখন সে রুমে একা থাকে। আপনি বলবেন আর আমি মেনে নিব?”

সুরভি হতবাক হয়ে ইনারাকে বলে, “এই মেয়ে কী বলে?”
“আমিও তো অবাক। অতিরিক্ত করে ফেলছে ও।”

অভ্রর রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। চোখ হয় সরু। তার চোখ দেখে রেশমি একটু ভয়ই পায়। অভ্র এক পা এগিয়ে আসতেই সে পিছিয়ে যায়। অভ্র ভারী কন্ঠে বলে, “আমি এখানে আমার পরিবারের সাথে আছি বলেই আপনাকে ছেড়ে দিচ্ছি, নাহয় আপনার সাহসের জন্য উচিত শিক্ষা পেতেন। আপনার সাহস কী করে হলো সুরভিকে নিয়ে এত জঘন্য জিনিস মাথায়ও আনার। এক মেয়ে হয়ে অন্য মেয়েকে নিয়ে এত খারাপ বলার করার আগে এতটুকু ভাববেন অন্য দশজন আপনাকে নিয়েও একই কথা বলবে। আর আমার জানা মতে একটি মেয়ের কাছে তার সম্মান থেকে বেশি আর কিছু নেই, তার জীবনও না। আরেকটা উপদেশ দিচ্ছি, নিজেকে এভাবে মানুষের সামনে ছোট করলে মানুষও তোমাকে ছোট করেই দেখবে, ছোট করেই ভাববে। তুমি সুরভি বান্ধবী তাই ছোট বোন ভেবে আমি আজকের কথাটা ভুলে যাচ্ছি।”
বলে সে শব্দ করে দরজা বন্ধ করে চলে যায়।

ইনারা প্রথমে অবাক হয়। কিন্তু পরের মুহূর্তে তার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে, “অভ্র ভাইয়া তো হাই মার্কে পাশ করে গেল। সে দৌড়ে রেশমির কাছে যেয়ে বলে, ” তুই ঠিক আছিস? সরি দোস্ত আমার জন্য তোর এত কথা শুনতে হলো।”
রেশমি মাথা নাড়ায়। সে বলে, “আমি বুঝিনি যে কেউ আমাকে এত কথা শুনানোর পরও আমার হ্যাপি লাগবে। বিশেষ করে আমরা যে ইন্ডাস্ট্রিতে আছি সেখানে থাকার পর এমন মানুষ আছে ভেবেই ভালো লাগছে। আর শেষে যখন উনি আমাকে বোন বললো তখন আমার অন্যরকমই ফিল হয়েছে। সত্যিই তাদের পরিবার যেভাবে তাদেরকে শিক্ষা দিয়েছে তা আসলেই প্রশংসনীয়। তুমি আর সুরভি দুইজনেই অনেক লাকি।” সে একপাশে ঝুঁকে ব্যালকনির দরজায় দাঁড়ানো সুরভিকে দেখে বলে, “সুরভি তুমি আসলেই ভাগ্যবান। আর সরি সেই কথাগুলো বলার জন্য। আমি কেবল পরীক্ষা নিচ্ছিলাম।”
সুরভি ঠোঁটে হাসি আঁকে। যখন রেশমি আবার ইনারার সাথে কথা বলতে শুরু করে তখন তখন আবার তার ঠোঁটের হাসি মলিন হয়। সে পিছনে ফিরে ব্যালকনিতে যায়। তার বারান্দা থেকে বাগান দেখা যায়। সে দেখতে পায় অভ্র বের হচ্ছে। তার পিছন দিকটা দেখা যায়। সে সরে যায়, লুকিয়ে পড়ে। আবার আড়াল থেকে দেখে অভ্রকে। সে বড্ড অবাক হয় অভ্রর এই দিক দেখে। বিশেষ করে তার বিপরীতে এমন কথা শুনে অভ্রর ভড়কে যাওয়াটা সে হজম করতে পারছে না। এই অভ্রর এই দিক আগে কখনো সে দেখে নি। সে কি অভ্রকে খুব জলদিই বিচার করে ফেলেছিল? কোনটা অভ্রর আসল দিক, যে তার স্বার্থ পূরণের জন্য যেকোনো সীমা পাড় করতে পারে, না’কি আজ যে দেখল,যে অন্যের কথাও ভাবতে জানে।

সে মাথা নাড়িয়ে কিন্তু এটা বের করে। অভ্র যেমনি হোক কিন্তু তার কি? তাদের এনগেজমেন্টটা আর আসল না। সে ইনারার কাছে যেয়ে জিজ্ঞেস করে, “তোর তৃতীয় পরীক্ষা কী?”
রেশমি বলে, “আমার মনে হয় না অভ্রর কথাগুলোর পর আর কোনো পরীক্ষার প্রয়োজন হচ্ছে।”
“উঁহু সবচেয়ে বড় পরীক্ষা এখনো বাকি। তা হবেই।” ইনারা বলে।
“পরীক্ষাটা কী?” সুরভি জিজ্ঞেস করে।
ইনারা হাত আড়া-আড়ি ভাঁজ করে বলে, “সেটা এখন বলা যাবে না। রাতে নিজেই জানতে পারবি।”
.
.
সন্ধ্যায় বাহিরে বারবিকিউ এর আয়োজন করা হয়। সুরভি ইনারা ও মা’য়ের জুস তৈরি করছিল। আর বারবিকিউ করছিল সভ্য, বাবা ও দাদাজান। সুরভি বলে, “উনারা তিনজন পুরুষ হয়ে এত সুন্দর করে রান্না করতে পারে ভেবে অবাক হই। এতকিছু তো আমিও জানি না।”
“বাবা অর্থাৎ তোমাদের দাদাজান ঘরের ছেলেদের প্রতি সবসময়ই কঠোর ছিলেন। তাদের ঘরের ও বাহিরের সব কাজ শিখিয়েছেন। অভ্র ও সভ্য তো আট বছরেই রান্না পাড়তো। দশ বছরের আগেই ওদের বাহিরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে স্টাডির জন্য।”
“এদিকে আমার ভাই তো ত্রিশ বছরে একটা ডিম ভাজি করে এমন ভান করে যেন অলিম্পিক জিতে গেছে।”
ইনারা জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা মা ছোট বেলায় কে বেশি দুষ্টু ছিলো?”
“সভ্য… আল্লাহ ঘরে যে দৌড়াদৌড়ি করতো ওকে সামলে রাখা একটা কাজ ছিলো। কেবল কথা শুনতো দাদাজান ও অভ্রর।”
“তাহলে উনি কী ছোট বেলা থেকেই এমন কড়া ছিলেন?” সুরভি জিজ্ঞেস করে।
“অভ্রর কথা বলছ? একদম না। ও ছোটবেলা থেকে ঘরের আদর্শ ছেলে ছিলো। সবার কথা শুনতো, সবার কথা ভাবতো, আর নিজের সব দায়িত্ব খুব সহজে পালন করতো। এক কথায় পার্ফেক্ট ছিলো। সভ্যও ওর পথে চলা চেষ্টা করতো। এমনকি অস্ট্রেলিয়ায়ও ক্লাস পাইভ থেকে ওই ক্লাস মনিটর এবং হেডবয় ছিলো। গ্রাজুয়েশন শেষ করে দেশে এসেও ওকে নরমাল দেখেছিলাম। ও আমাদের কোম্পানি সামলেছে একবছর। তারপর কি হলো জানি না হঠাৎ করে ওর পলিটিক্সে ঢুকলো আর পালটে গেল।”
“কখনো জিজ্ঞেস করেন নি?”
“করেছিলাম, বলেনি। হয়তো ওর এতটা কাছের হতে পারিনি যে ও আমাকে নিজের মনের কথা বলবে। এতে ওর দোষ না, আমার দুই ছেলেকেই এত জলদি বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। দোষটা আমারও ছিলো। এত ছোট বয়সে নিজের বাচ্চাদের দূর করা উচিত হয় নি। ছোট বয়সেই এত দায়িত্ব তারা কীভাবে সামলাবে আমার ভাবা উচিত ছিলো। কিন্তু ভালো বউ হবার জন্য ভালো মা হবার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। তারই শাস্তি পেয়েছি। কতবছর আমার একটা ছেলেকেও কাছ থেকে দেখতে পাই নি।” মা’য়ের চোখ ভরে আসে। সে গভীর নিশ্বাস ফেলে। ইনারা তাকে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে বলে, “আহা মা…. আপনার এত কিউট চেহেরায় কী কান্না মানায়। আর কে বলেছে আপনি ভালো মা হতে পারেন নি? আমার জন্য তো আপনি বেস্ট মা। এই’যে আমাকে এত্তগুলা আদর করেন। আর এতবছর দূরে থেকেছে বলেই তো এখন দু’টো ছেলের সাথে দুটো মেয়ে ফ্রী পেলেন। মা দেখেন কেবল আপনার মতো কিউট মা পেয়েছি বলে অসভ্যটাকে সহ্য করেছি, কেবল আপনার জন্য, নাহয় এই অসভ্যটা আমাকে যে জ্বালিয়েছি ওকে তো বট গাছে উলটা লটকিয়ে সাইজ করতাম। আমি তো সেকালে প্লানও করেছিলাম। একটা ভয়ানক মেয়ে ভূতের লোকেশন ট্রাক করব যে বিয়ের জন্য পাগল হয়ে গেছে তারপর এই অসভ্যটাকে সে ভূতের কাছে রেখে আসব। যখন সে ভূতনি সুনসান এলাকায় তাকে জ্বালাবে তখন সে বুঝতো আমার মতো মাসুম মেয়ে কত ভাগ্য করে পেয়েছিল।”
মা হেসে তার মাথায় আলতো করে মারে, “ইমোশনালও হতে পারি না তোর জন্য। এসব মাথায় আসে কীভাবে তোর।”
“টেলেন্ট মা টেলেন্ট।”
সুরভি ইনারার হাতে কাটা লেবুর প্লেট দিয়ে বলে, “সে টেলেন্ট দিয়ে এই লেবুগুলো চিপে রাখ আমি আরও নিয়ে আসছি। আরও লেবু লাগবে।” দিয়ে সে তো চলে যায়। পিছন থেকে ইনারা বলে, “এত লেবু চিপতে গেলে তো লেবুর রসের সাথে আমার টেলেন্টও বেরিয়ে যাবে।”

সুরভি রিসোর্টের পিছনের বাগানের গাছ থেকে কিছু লেবু ছিঁড়ে নেয়। প্রয়োজনীয় লেবু নিয়ে উঠে পিছনে ফিরতেই এক ছায়ামূর্তিকে হঠাৎ সামনে দেখে ভয়ে লাফিয়ে উঠে। চিৎকার করে। তার হাত থেকে লেবুর বাস্কেটটা পড়ে যায়। সে পিছাতে যেয়ে ভেজা মাটি পিছলে পড়ে যেতে নিলেই সে ছায়ামূর্তিটা তার কোমর ধরে নেয়। নিজের দিকে আনতেই দেখতে আবছা দেখতে পায় অভ্রকে। তার জানে জান আসে। সে ঢোক গিলে বলে, “আপনি হঠাৎ করে এলেন কেন?”
অভ্র তার ভারী স্বরেই বলে, “তাহলে কী টিজার টেইলার দিয়ে আসতে হবে? তুমি আমাকে আসতে বলে সারাদিন ছিলে কোথায়? আর ফোন ধরোনি কেন?”

প্রশ্নেরমহল তৈরি হবার আগেই শোনা যায় সভ্যর কন্ঠ, “সুরভি ঠিক আছো?”
তখন ম্যানেজার পিছনে দিকের বাতি জ্বালায়। হঠাৎ দুইজনকে এতটা কাছে দেখে ম্যানেজার ও সভ্য দুইজনই থতমত খেয়ে যায়।
সুরভি খেয়াল করতেই অভ্রকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়।
সে বুঝানোর চেষ্টা করে, “ভাইয়া যেমন দেখা যাচ্ছে তেমন কিছু না। আমি উনাকে অন্ধকারে দেখে ভয়ে পড়ে যাচ্ছি। উনি আমাকে বাঁচিয়েছে।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ অসুবিধা নেই। আমি বুঝতে পারছি হবু ভাবি। কন্টিনিউ কন্টিনিউ।” সে ম্যানেজারকে নিয়ে যেতে নিলে সুরভি আবার বলে, “ভাইয়া সত্যি বলছি আমি।”
“আহা হবু ভাবি আমি বুঝি তো। সমস্যা নেই। এখানে কেউ আসবে না আর, আপনারা নিজেদের কথা বা কাজ যাই হোক চালিয়ে যান।”
সে আর পিছে তাকায় না।

লজ্জায় সুরভির মুখ পুরো লাল হয়ে যায়। সাথে অভ্রর উপর রাগও উঠে তার। সে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকায় অভ্রর দিকে। তারপর চুপচাপ নিচে পড়ে থাকা লেবু বাস্কেটে উঠাতে থাকে।
অভ্রর যেন কিছুই হয় নি, “তোমাকে আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছিলাম।”
সুরভি আবার তার দিকে তাকায় অগ্নি দৃষ্টিতে, “আপনার উপর প্রচুর রাগ উঠছে আমার। দয়া করে চুপ থাকতে পারেন আপনি?”
“আমি রাগ করার মতো কিছু করেছি বলেছি তো মনে হয় না।”
সুরভি মেজাজ খারাপ করে বলে, “সভ্য ভাইয়া কী মনে করবে?”
“তুমি না বললে আমি তোমাকে বাঁচিয়েছি?”
“তারপর তো দূরে সরবেন?”
“কৃতজ্ঞতা বলতেও একটা শব্দ আছে।”
সুরভি বাস্কেট সেখানে রেখে রাগে হনহনিয়ে অভ্রর সামনে দাঁড়ায়, “আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ হবো? আপনি আমার জীবনটা এলোমেলো করে দিয়েছেন। আর গতকাল তো মিথ্যা এনগেজমেন্ট এর নামে এত বড় ভেজালে ফাঁসালেন যে বের হতেই পারছি না। আমি পারলে তো আপনাকেই আমার লাইফ থেকে ডিলিট করে দিতাম।”
অভ্র তবুও স্বাভাবিকভাবে বলে, “হয়েছে? এখন বলো ফোন করে ডেকেছিলে কেন? কী জরুরী কথা ছিলো?”
সুরভি বিরক্তির ভঙ্গিতে বলে, “মানে আমি যে এতকথা বললাম আপনার দেখি কিছুই আসেযায় না।”
অভ্র হাত আড়া-আড়ি ভাঁজ করে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায় সুরভির দিকে, “তুমি বারবার কথা ঘুরাচ্ছো। কী লুকাচ্ছো তুমি?”
“আ…আমি? আমি কী লুকাবো? কী যা তা বলছেন?”
অভ্র সুরভির হাত ধরে তার কাছে টেনে আনে। তার দিকে ঝুঁকে সরু চোখে তাকে ভালো করে যাচাই করে। সুরভিও ভয়ে চোখ মেলায় না।

অভ্র বলে, “তুমি মিথ্যা বলছো। কোনো কিছু একটা তো চলছে তোমার মাথায়। তাই তুমি আমার সাথে চোখ মিলিয়ে কথা বলতে পারছ না।”
সুরভি এবার তাকায় তার দিকে, “এবার তাকিয়েছি হয়েছে? হাত ছাড়ুন এইবার।” বলে সে হাত ছাড়াতে গেলে অভ্র আরও শক্ত করে তার হাত ধরে নেয়। সুরভি হাত মোচড়াতে থাকে। সে বিরক্ত হয়ে বলে, “আপনি বোধহয় ভুলে গেছেন আমাদের এনগেজমেন্টটা ফেইক ছিলো।”
“আমি তো ভুলিনি। কিন্তু তুমি হয়তো ভুলে গেছো।”
সে সুরভির হাতের দিকে তাকিয়ে বলে।
সুরভিও অবাক হয়ে তার হাতের দিকে তাকায়। তার অনামিকা আঙুলে তাদের এনগেজমেন্টের আংটিটা দেখে নিজেই লজ্জায় পড়ে যায়। সে খুলতে ভুলেই গিয়েছিল। ব্যাপারটা ভেবে নিজের উপর রাগ উঠলেও সে জোর গলায় অভ্রকে জানায়, “পরিবারের সকলে এখানে আছে বলেই পরে আছি, নাহয় আপনার নামের আংটি পরার শখ আমার নেই।”
“ওহ আচ্ছা, বুঝিছি। কিন্তু তোমার হাতেই আমার নামের আংটিটা সুন্দর লাগছে। যেন তোমার জন্যই তৈরি হয়েছিল।”
সুরভি তার দিকে আবার তাকায়। অভ্রর তাকানো দেখে নিজেই লজ্জা পায়।
অভ্র বলে, “ওহ রিপোর্টার ম্যাম লজ্জাও পেতে জানে?”
“আমি কোনো লজ্জা টজ্জা পাচ্ছি না। আপনার জন্য আমি কেন লজ্জা পেতে যাব।”
সে হাত ছাড়িয়ে তার বাস্কেট তুলে দ্রুত সেখান থেকে চলে যায়। অভ্র তার দৌড় দেখে নিজ অজান্তেই হেসে দেয়।

বাগানের সামনের পুল সাইডে যায় অভ্র। তার চোখ দুটো খুঁজতে খুঁজতে পেয়েও যায় সুরভিকে। সুরভি তার দিকে তাকিয়ে সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নেয়। আবারও হাসে সে। পুল সাইডের এক বেঞ্চে যেয়ে আবারও ফোনে তার কাজ করতে থাকে। রান্না শেষ হলে সবাই মিলে পুলসাইড বেঞ্চে বসেই খাওয়া দাওয়া করে। সুরভি ও ইনারা উঠে সবার জন্য আরও খাবার নিতে আসলে। ইনারা সুরভির হাতে একটি পানির জগ দিয়ে নিজে মাংসের প্লেটটা নেয়। পুলের কাছে আসতেছে সে আড়চোখে সবাইকে দেখে হাল্কা করে ধাক্কা দেয় সুরভিকে। তার হাতের জগটা নিচে পড়ে যায়। পানি পড়ে তার পা’য়ে। পানি ছিলো একদম ঠান্ডা কিন্তু ইনারা চিল্লানো শুরু করে, “সুরভি তোর পা’য়ে ফুটন্ত গরম পানি পড়েছে। কেউ সাহায্য করো, সুরভির পা’য়ের গরম পানি পড়েছে।”
“গরম পানি? এটা তো ঠান্ডা….”
ইনারা তো আরও জোরে চিৎকার করতে থাকে।

অভ্র ইনারার কথা শুনেই দৌড়ে আসে। তার পিছনে আসে সবাই-ই।
অভ্র এসেই হাঁটু গেড়ে মেঝেতে বসে সুরভির পা ধরে দেখে। ঘাবড়ে যায় সে। তার চোখেমুখে আতঙ্ক দেখা যাচ্ছে। সে ধমক দেয় সবার আগে, “হাঁটার সময় তোমার ধ্যান কোথায় থাকে? এত বড় দুর্ঘটনা ঘটে গেল।” তারপর পিছনে তাকিয়ে বলে, “দাঁড়িয়ে না থেকে কেউ কি ঠান্ডা পানি বা বরফ আনতে পারবে?”
সভ্য তার বলার আগেই ভেতরে গিয়েছিল ঠান্ডা পানি আনতে। তার বলা শেষ হতেই পানির বোতল হাতে এনে দেয়।
সুরভি সবাইকে বুঝানোর চেষ্টা করে কিন্তু কেউ তার কথায় শুনে না। নিজেরাই তার চিন্তায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে ।
অভ্র তার পা’য়ের পানি ঢেলে নরম দৃষ্টিতে তার দিকে তাকায়, “বেশি ব্যাথা করছে?”
সুরভি সবার কথার মাঝে অভ্রর নরমসুরের প্রশ্নটি শুনে তার দিকে তাকায়। তার নরম দৃষ্টি দেখে অবাক হয়। এই প্রথম তার অভ্রর জন্য মায়া হয়। সে তাকিয়ে থাকে অভ্রর দিকে। তারপর মাথা নাড়িয়ে মানা করে।
অভ্র উঠে দাঁড়িয়ে ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করে, “এখানে আশেপাশে হাস্পাতাল আছে? ওকে ডাক্তার দেখানো উচিত।”
সুরভি বলে, “হাস্পাতালে কেন যাব? আমার তো….”
“সাট আপ। পানি বেশি গরম হলে চামড়া উঠে যেতে পারে বা অন্যকোনো সমস্যা হতে পারে।”
সবাই অভ্রর কথার সাথে একমত। কেউ সুরভির কথা শুনছেই না।
“কিন্তু… ”
“কোনো কিন্তু পরন্তু না। আমি তোমাকে নিতে যাচ্ছি।”
অভ্র তাকে কোলে উঠাতে নেবার পূর্বে সুরভি বলে, “জগে ঠান্ডা পানি ছিলো।”
“কী!”
“জ্বি। কতক্ষণ থেকে এই কথা বলতে চাইছি। কিন্তু কেউ আমার কথায় পাত্তাই দিচ্ছে না।”
সবাই একসাথে তাকায় ইনারার দিকে।
ইনারা বলে, “আমি কী জানি নাকি পানি ঠান্ডা না গরম? আমি ভেবেছিলাম দাদাজানের রাতের গ্রিন টি এর জন্য গরম পানি নিচ্ছি।”
“কিন্তু তুই তো আমাকে…. ” সুরভির কথার মাঝে ইনারা সে তার কাঁধে হাত রেখে বলে, “আহা তুই ঠিক আছিস এটাই সবচেয়ে বড় ব্যাপার। আয় আমরা বারবিকিউ এনজয় করি।” বলে তাকে নিয়ে যায়। সুরভি যাবার সময় পিছনে ফিরে অভ্রর দিকে তাকায় একবারের জন্য।

সভ্য ইনারার কাছে এসে বলে, “তাহলে আমার ভাই পাশ হয়ে গেছে?”
ইনারা সভ্যর দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে বলে, “ইয়াপ, ইনারা এপ্রুভ।”
.
.
সকাল সকালই মিটিং বসে। মায়া মিটিংরুমে এসে দেখে বেশিরভাগ বোর্ডমেম্বার উপস্থিত। সে এসে বসে তার চেয়ারে। মায়ার ভাই ওয়াহিদকে জিজ্ঞাসা ঘুম ঘুম কন্ঠে, “হঠাৎ এত সকালে মিটিং রেখেছ কোনো জরুরী কাজ আছে?”
“আমাদের কোম্পানির সম্মানের ব্যাপার। তাই জরুরী মানা যেতে পারে।”
ওয়াহিদ প্রজেক্টর অন করে তার ল্যাপটপে কিছু একটা করে। সকলের ধ্যান ছিলো প্রজেক্টরের দিকে।
ওয়াহিদ ফাইল খুলে বলে, “আজকের মিটিং ডাকার কারণ হলো জোহান।” সে একটা বাটন চাপ দিতেই জোহান ও তার বাবার ছবি আসে। সাথে জোহানের বাবাকে যে পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছিল সে ছবিও। ওয়াহিদ তার কথা চালিয়ে যায়, “আমার মনে হয় না এমন একটা আর্টিস্টকে আমাদের কোম্পানিতে রাখা উচিত যার পরিবার ক্রাইম করে জেলে আছে। এটা আমাদের কোম্পানির জন্য ভালো হবে। তাই আমি চাই আমাদের কন্টেক্ট ক্যান্সেল করে ওকে এই কোম্পানি থেকে বের করে দেওয়া হোক।”
মায়া প্রজেক্টরের থেকে চোখ সরিয়ে ওয়াহিদের দিকে তাকায়। দেখতে পায় ওয়াহিদও তার দিকে তাকিয়েই কথাগুলো বলছিল।
ওয়াহিদ মায়ার দিকে তাকিয়ে থেকেই জিজ্ঞেস করে, “আমি কী ভুল বলেছি মিস মায়া?”

চলবে…

অনুভূতির খাঁচা
পর্ব-২০
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

মায়া প্রজেক্টরের থেকে চোখ সরিয়ে ওয়াহিদের দিকে তাকায়। দেখতে পায় ওয়াহিদও তার দিকে তাকিয়েই কথাগুলো বলছিল।
ওয়াহিদ মায়ার দিকে তাকিয়ে থেকেই জিজ্ঞেস করে, “আমি কী ভুল বলেছি মিস মায়া?”
মায়া তাচ্ছিল্য হাসে, “আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল এই মিটিং এর কারণ জোহানই হবে।”
“তাহলে আমি আশা করছি আপনি নিজেদের ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের কারণে আমাদের প্রতিষ্ঠানের সম্মান হানি করবেন না।”
মায়া চেয়ার থেকে উঠে তার ল্যাপটপ নিয়ে ওয়াহিদের দিকে এগোয়, “জোহানকে যখন আমি এপোয়েন্ট করি তখন আমি তাকে চিনতামও না। তখন বড় কোনো এজেন্সি তাকে নিতে চাচ্ছিল না আর যারা নিতে চাচ্ছিল তাকে সে মানা করে দিয়েছে। তাহলে ভাবতে পারেন আমি ওকেই কেন এপোয়েন্ট করলাম?”
মায়া ওয়াহিদের ল্যাপটপ সরিয়ে প্রজেক্টর নিজের ল্যাপটপের সাথে কানেক্ট করে। সকলের দিকে তাকিয়ে বলে, “আমরা যদি গত দুইবছর বাদ দেই তাহলে দেখতে পাব ২০১৬ সাল থেকে দেশের চারদিকে কেবল জোহানের নাম ছিলো। তা হোক গানের জগতে বা অভিনয়ের। ইনফ্যাক্ট তার ডাউনফলের পরও স্যোশাল মিডিয়া গ্রোথ এবং এলবাম সেইল আমাদের কোম্পানির অনেক আর্টিস্ট থেকে বেশি।” সে ওয়াহিদের দিকে তাকিয়ে খোঁচা মেরে বলে, “যার মধ্যে আপনার গার্লফ্রেন্ডও আছে মিস্টার ওয়াহিদ।”
ওয়াহিদ বিরক্তির ভঙ্গিতে চোখ সরিয়ে নেয়।
মায়া সকলের উদ্দেশ্যে আবারও বলে, “আর আমরা সকলে জানে পঞ্চসুরের মতো ব্যান্ড আজ পর্যন্ত হয় নি। তারা লিজেন্ড। তারা এতবছর আগে আলাদা হয়েছে তবুও তাদের ডিমান্ড আজকালকার যেকোনো সেলিব্রিটি থেকে বেশি।”
মায়ার বাবা বলেন, “কিন্তু ওয়াহিদের কথাটাও ভুল না। এটা আমাদের সম্মানের ব্যাপার।”
“আমি যতটুকু জানি জোহান নিজেই তার বাবার ভুলগুলো জগতের সামনে এসেছে। আই নো এখনো অনেকে তার উপর রেগে আছে। কিন্তু আমি নিশ্চিত ওর গান আসলে সব ঠিক হয়ে যাবে। ও ভবিষ্যতে আমাদের এজেন্সির সবচেয়ে বড় আর্টিস্ট হবে।”
“আমরা এত বড় রিক্স যদি নিতে না চাই তাহলে? আমরা সকল বোর্ড মেম্বার ওয়াহিদের সাথে আছি।” ওয়াহিদের বাবা তারই পক্ষ নিয়ে কথা বলে। এমনকি সকলে তার পাশে। মায়া জানতো এমন হতো। সকলে যে পাল্লা ভারী বেশি সেদিকেই ঝুঁকবে। তবে এতে তার কিছু আসে যায়? একদম না। সে হেসে তার চেয়ারে যেয়ে বসে। বলে, “ঠিকাছে তাহলে আজকের পর থেকে কোম্পানির প্রফিট বা লসের দায়িত্বও আপনাদের।”
“এই দায়িত্ব আমাদের নিতে হলে তোমাকে বেতন দেই কেন?”
“কোম্পানির সকল সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য। কিন্তু আমি যদি সিদ্ধান্তই না নিতে পারি তাহলে দায়িত্বের ভার আমি কেন নিব? আমার থেকে বেশি আপনারা বুঝলে নিজেরাই কোম্পানি চালান। ওয়েট, তাহলে তো একবছরে কোম্পানিটা পথে এসে পড়বে আগের মতো। আহারে!”
ওয়াহিদ উচ্চ স্বরে বলে, “মায়া এখানে সবাই তোমার বড় মুখ সামলে কথা বলো।”
“কাজের ক্ষেত্রে বড়ছোট হয় না। সকলের নিজের দিক রাখার অধিকার আছে। তোমরা বড় হয়ে এমন ফালতু সিদ্ধান্ত নিয়ে কোম্পানিটা শেষ করলে। আর এখন যখন আমি এই কোম্পানিকে আবার দাঁড় করিয়েছি আবার নিজেদের বুদ্ধি ব্যবহার করে আমার সকল পরিশ্রম ভাসাতে চাচ্ছো। তো আমি কী বলব? তোমরা চাও তোমাদের সিদ্ধান্তের ভার আমি নিব? যেন ভবিষ্যতে আমাকে দোষারোপ করতে পারো। না, এসবের মুড আমার নেই।”
“মায়া তোমার মনে হয় না ইগো তোমার মাথায় চড়েছে?”
“ইগো না, এটাকে কনফিডেন্স বলে। আর হ্যাঁ,” মায়া উঠে দাঁড়ায়, “যদি এই কোম্পানিতে আমার সিদ্ধান্ত না চলে তাহলে আমিও এই ভেজালে নেই। যদি আমি এই কোম্পানিতে থাকি তাহলে আপনাদের সুবুদ্ধিসম্পন্ন সিদ্ধান্তের কারণে আমার ক্যারিয়ার শেষ হয়ে যাবে। তাই আপনারা নতুন কাওকে আপনাদের ইশারায় নাচার জন্য খুঁজে নিয়েন।”
মায়া উঠে যেতে নিলেই ওয়াহিদের বাবা তাকে দ্রুত থামায়। মায়ার বাবার সাথে ইশারার মাধ্যমে কিছু আলোচনা করে বলে, “তুমি ভুল বলছো না। জোহান আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় সম্পদ। আর ঝুঁকি না নিলে লাভ হবে কীভাবে?”
“কিন্তু বাবা…” ওয়াহিদের কথা না শুনে বাবা আবারও মায়াকে বললেন, “তুমি নিজের মতো কাজ করে যাও। কেউ তোমাকে বাঁধা দিবে না।।”
মায়া বিজয়ের এক হাসি দিয়ে সেখান থেকে কিছু না বলেই চলে যায়। তার যাবার পর সকলে শান্তির নিশ্বাস ফেলে।
ওয়াহিদের বাবা তাকে কঠোর সুরে বলে,
“ওয়াহিদ তুমি নিজে যখন ছিলে তখন তো কোম্পানি সামলাতে পারো নি। এখন কোনো মাতব্বরি করতে যেও না।”
“বাবা আমি তো….”
“বর্তমানে এই কোম্পানি থেকে আমরা সবচেয়ে বেশি প্রফিট করি। আর এর কারণ হলো মায়া-ই। ওকে নারাজ করার কোনো দরকার নেই।” এরপর সে তাকায় মায়ার বাবার দিকে, “আর বেয়াই সাহেব নিজের মেয়েকে সামলান, ওর মুখ এখন একটু বেশিই চলে।”
“আমার কথাও কোথায় শুনে? নিজে যা ভালো বুঝবে তাই। হাত থেকে বের হয়ে গেছে পুরো। আমার ব্যাংকে টাকা পাঠিয়ে বলে, ওর উপর যে খরচা করেছি তা না’কি ফেরত দিয়েছে, তাও ইন্টারেস্টসহ। চিন্তা করতে পারছেন কী পরিমাণ বেয়াদব হয়েছে।”
ওয়াহিদ তাদের কথাগুলো শুনে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। কিন্তু না পেরে বলেই ফেলে, “এখন আংকেল আপনিই তো সবসময় বলতেন কীভাবে মায়া আপনার জন্য কেবল দায় ছিলো। ওর পিছনে আপনার কত টাকা খরচ হয়েছে। ও জন্ম না হলেই ভালো হতো। তাইতো ও আপনার দায় শোধ করলো। বাবার ভালোবাসা তো ঠিকভাবে দেন নি তাই টাকা দিয়ে এত সহজেই দায় শোধ হয়ে গেল।”
মায়ার বাবা লজ্জায় পড়ে গেল সকলের সামনে এই কথা শোনায়। সকলে তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। ওয়াহিদকে কিছু বলতেও পারে না সে। তার আদরের বড় মেয়ের দেবর বলে কথা। এর উপর তাদের কোম্পানির সবচেয়ে বড় শেয়ারহোল্ডার।
.
.
সকলে বের হচ্ছে রিসোর্ট থেকে। বাসে উঠছিল। ইনারাও ম্যানেজারসহ সকল কর্মীদের ধন্যবাদ জানিয়ে বের হয়। সুরভি তাকে দেখে তার কাছে এসে হাত ধরে, “তোকেই খুঁজছিলাম। তোর শেষ পরীক্ষা তো নেওয়া হলো না আর।”
“কে বলল নেওয়া হয় নি? নেওয়া হয়ে গেছে। আর অভ্র ভাইয়া সে পরীক্ষাটা একশোতে দুইশো পেয়েছে। ফুল মাকর্স। ইনারার দুলাভাই হবার জন্য পার্ফেক্ট।”
“কী বলিছিস তুই? কখন পরীক্ষা নিলি তুই? আর কী এমন পরীক্ষা নিয়েছিস যে সে দুইশো পেল?”
“তোকে ভালোবাসার।”
সুরভি ইনারার কথা শুনে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। ইনারাও দাঁড়ায়। সুরভি জিজ্ঞেস করে, “কখন পরীক্ষা নিলি তুই?”
“গতকাল রাতেই। দেখ যখন যে রেশমির কাছে তোকে নিয়ে একটা খারাপ কথা শুনতে পারে নি তখনই সে পঞ্চাশ পেয়ে গিয়েছিল। এটা পরীক্ষায় ছিলো না কিন্তু তার তোকে প্রটেক্ট করাটা আমার মন ছুঁয়ে গেছে। এরপর রাতে যখন তুই কষ্ট পেয়েছিস শুনে অস্থির হয়ে গিয়েছিল তখন তার যত্ন দেখে আমি তখনই তাকে একশো দিয়ে দিয়েছি। একটা মেয়ে এমন জীবনসাথী চায় সে তাকে রক্ষা করে, তার কেয়ার করে, তার সাথে লয়াল থাকে। এর উপর গতকাল তার চোখে স্পষ্ট তোর জন্য ভালোবাসা দেখতে পেয়েছি। তুই যখন ব্যাথা পেয়েছিস জেনেছে তার চোখ দেখে মনে হচ্ছিল ব্যাথাটা সে অনুভর করছিল। সভ্যর চোখেও আমার জন্য সে অনুভূতি দেখতে পাই আমি। এবার বুঝেছিস তাকে কেন দুইশো দিয়েছি?”
“বুঝেছি।” আফসোসের সুরে বলে সুরভি। হাঁটতে শুরু করে আবার। ইনারাও তার হাত ধরে হাঁটতে শুরু করে। তাকে বলে, “তোর খুশি হওয়া উচিত না তোদের সম্পর্কে এপ্রুভাল দিয়েছি আমি? ”
সুরভি দাঁত বের করে মিথ্যে হাসে, “আমি অনেক হ্যাপি দোস্ত।”
তারা বাসে উঠে। ইনারা আজ যেয়ে বসে সভ্যর কাছে। সুরভিও জানালার পাশে একটি সিট খুঁজে নেয়।

বাসে সবার উঠার পর অভ্র উঠে ফজলু মিয়ার পাশে বসে নিলে ইনারা বলে উঠে, “সুরভি এতদিন তোর ফিয়োন্সে সিঙ্গেল থেকেও ফজলু মিয়ার সাথে ঘুরতো এখন মিঙ্গেল হয়েও তার সাথে বসছে। তোর দেখি এখন ফজলু মিয়ার সাথেই সতিন পাততে হবে।”
সুরভি তার কথা শুনে থতমত খেয়ে যায়। হঠাৎ এই কথা কোথা থেকে আসলো সে বুঝতেই পারছে না। কিছু মুহূর্ত পর বুঝতে পায় অবশ্য। অভ্র যখন তার পাশে এসে বসে। সে ইনারার দিকে তাকাতেই ইনারা চোখ টিপ মেরে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তাকে ‘অল দ্যা বেস্ট’ জানায়। সুরভি চোখ ছোট করে মেজাজ খারাপ দেখায় তাকে। ইনারাও কম যায় না, জিহ্বা বের করে তাকে ভেঙিয়ে দেয়।

অভ্র তাদের এই কারসাজি দেখে কিছু বুঝে উঠতে পারে না। সে সভ্যকে জিজ্ঞেস করে, “কী হচ্ছে?”
“সবে তো শুরু, এক দুইমাস পর আপনি নিজেই বুঝে যাবেন।”
সুরভি কানে হেডফোন গুঁজে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে গান শুনতে থাকে।
সভ্য ইনারার দিকে তাকায়। কিছু একটা বলতে যেয়েও চুপ হয়ে যায়। ইনারা তা খেয়াল করে, “কী বলতে চাইছো বলো।”
“তেমন কিছু না।”
“তোমার তেমন কিছু না মানে কিছু একটা তো হয়েছেই। বলো।”
সভ্য মৃদু স্বরে জানায়, “গতকাল রাতে আমি সুরভির কন্ঠ শুনে বাগানের পিছনের দিকে গিয়েছিলাম মনে আছে?”
“আছে। গতরাতেরই তো ব্যাপার।”
“তো আমি সম্ভবত একটা কথা শুনে নিয়েছিলাম। বুঝতে পারছিলাম না তোমাকে বলা উচিত কি না! দেখো রাগ করো না আর চিৎকার তো করবেই না। আমি শুনেছিলাম যে ওদের এনগেজমেন্টটা…”
ইনারা সভ্যর কথাটা সম্পূর্ণ করে, “মিথ্যা। তাই বলতে চাইছ?”
সভ্য অবাক হয়ে রাকায় তার দিকে, “তুমি কীভাবে জানলে?”
“আমি গতকালই বুঝেছিলাম। সুরভির কথায় আমার গোলমাল লাগছিল। দশ বছরের বেশি হয়েছে আমাদের বন্ধুত্বের। কথার ভাঁজে ওর মাথায় কি চলে তা আমি বুঝব না? অসম্ভব।”
“তাহলে তুমি কীভাবে ওদের এই খেলায় খেলতে শুরু করলে। আমি ভয়ে ছিলাম জানলে ওদের উপর মিসাইল না ছেড়ে দেও।”
“কারণ বলব?” ইনারা সভ্যর কানের কাছে যেয়ে বলে, “তোমার ভাই আমার বান্ধবীকে অনেক ভালোবাসে। আমি তার চোখে গতকালই দেখতে পেয়েছি।”
সভ্য আড়চোখে একবার তার ভাই ও সুরভিকে দেখে হাসে। তারপর ইনারাকে বলে, “আমি তো কেবল এজন্য চুপ ছিলাম যে সুরভির চক্করে আমার ভাই নরমাল হয়ে যাবে। আমাদের কাছে চলে আসবে কিন্তু তোমার কথা শুনে এখন আমি আরও তাদের জুটি একসাথে দেখতে চাই। কিন্তু সে সুরভিকে যতই ভালোবাসুক। আমার মতো আশিক হতে পারবে না। আমি তোমাকে যত ভালোবাসি তার মতো কোনো প্রেমিক ভালোবাসতে পারবে না।”
“হয়েছে নিজের প্রশংসায় মগ্ন হওয়া?” সে হেসে বলে, “অসভ্য!”
সভ্য ইনারারকে ধরে নিজের বাহুতে ভরে নিয়ে বলে, “মহারাণী কেবল মুখে বলার মতো মানুষ আমি নই, আপনিও জানেন আমার মতো প্রেমিক এই জগতে খুঁজে পাবেন না।”
.
.
মায়ার কেবিনে নক পড়ে। জোহান আহবানের অপেক্ষায় থাকে না। অনুমতি পাবার পূর্বেই দরজায় মাথা ঢুকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “আসব?”
“রুমে ঢুকে মানুষ ঢোকার জন্য অনুমতি নেয় না।”
জোহান রুমের ভেতর এসে চেয়ারে বসে আরামে জিজ্ঞেস করে, “ডেকেছিলেন ম্যাম?”
“তোমার ট্রেনারের সাথে গতকাল কথা বলেছিলাম। সে বলেছে তুমি এখন পার্ফেক্টলি রেডি। তোমার কামব্যাকের জন্য তৈরি হও।”
“সিরিয়াসলি?” জোহানের চোখেমুখে খুশি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তাকে দেখে মায়ার ঠোঁটেও হাসি ফুটে তার অজান্তেই। সে মাথা নাড়ায়। সে চেয়ার থেকে উঠে জোহানের কাছে এসে একটি ফাইল ফিয়ে বলে, “আমি এই গানগুলো দেখেছি তোমার জন্য। তোমার কন্ঠে মানাবে। যদি তোমার কাছেও কোনো গান থাকে তা আমাকে পাঠিও। যে গানগুলো তোমার স্বরে সবচেয়ে ভালো লাগবে আমরা তাই ফাইনালাইজ করব। এই এলবাম কেবল তোমার জন্যই নয়, আমাদের জন্যও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সব ঠিক থাকলে দুইমাস পর তোমার জন্মদিনে এই এলবাম রিলিজ করা হবে।”
জোহান উঠে মায়াকে জড়িয়ে ধরে।

মায়া হতবাক। সে এই ব্যাপারটা নিয়ে অপ্রস্তুত ছিলো। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে। তার বুকের ভেতর আবারও আগের মতো উথাল-পাথাকে ঢেউ খেলাতে থাকে। আগেরবার যখন এমন হয়েছিল তখন সে সন্দেহ করেছিল সে অসুস্থ। এখন দেখা যাচ্ছে তার সন্দেহটাই সঠিক। যখন তার ভেতর এমন উথাল পাথাল খেলা করছিল তখন জোহান তাকে ছেড়ে খুব উৎসাহ দেখিয়ে বলে, “তুমি বুঝবে না আমি কতটা খুশি। আমি এই দিনটার জন্য কত মাস অপেক্ষায় করেছি। গান আমার কাছে নিশ্বাস নেওয়ার মতো। আর আমার গান সবাইকে শুনানোটা আমার খুশির নাম। আর আমি আজ অনেক খুশি। থ্যাঙ্কিউ সো মাচ।”
মায়া তখনও স্থির হয়ে দাঁড়ানো। সে জোহানের দিকে তাকিয়ে কেবল অপ্রস্তুত হয়ে হাসি দেয়। জোহান বলে, “তুমি অনুমতি দিলে কি এই ব্যাপারটা আমার মা, বোন আর বন্ধুদের জানাতে পারি?”
মায়া তখনো মুখে কিছু বলে না। হেসে কেবল মাথা নাড়ায়। জোহান দরজা দিয়ে বের হবার পরেই সে গভীর এক নিঃশ্বাস ফেলে চেয়ারে বসে পড়ে। তার বুকের ভিতর এখনো ধুকপুক ধুকপুক করছে। সে চোখ বন্ধ করে নেয়। এখন আবার তার এই কী রোগে ধরল? জলদিই মনে হয় ডাক্তারকে দেখানোর দরকার।
.
.
অভ্র মোবাইলে কাজের ই-মেইল দেখছিল। সফরের একসময় সে তাকায় সুরভির দিকে। সুরভী ঘুমিয়ে পড়েছে। তার মাথা জানালার উপর ঠেকানো দেখে জলদি করে সে সুরভির মাথাটা ধরে তার কাঁধের উপর রাখে। তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে মৃদু হাসে সে। তার মুখে আসা চুলগুলো আলতো করে সরিয়ে দেয়। ঘুমন্ত অবস্থায় তার আসেপাশে যেন মোহ ছড়িয়ে যায়। তাকে দেখলেই মায়া লাগে। কেমন পবিত্র দেখায় তাকে! তাকে এভাবে দেখলে অভ্র কীভাবে যেন তার সব চিন্তা ভুলে যায়।

অভ্র সুরভির কানে গুঁজে থাকা হেডফোন একটি নিজের কানে লাগায়। এখনো গান বাজছে তার ফোনে,
“তোমার পথে পা মিলিয়ে চলা
তোমার হাতটি ধরে বসে থাকা
আমার আকাশে তোমার নামটি লেখা
সাদার আকাশে কালো-আবছা বোনা
তোমায় নিয়ে আমার লেখা গানে
অযথা কত স্বপ্ন বোনা আছে
আমার হাতের আঙুলের ভাঁজে
তোমাকে নিয়ে কত কাব্য রটে
ভুলিনি তো আমি তোমার মুখে হাসি
আমার গাওয়া গানে তোমাকে ভালোবাসি….”

অভ্র হেসে তার মোবাইলটি পকেটে রেখে দেয়। একপলক সুরভির দিকে তাকিয়ে আবার দৃষ্টি আটকায় সে মেঘলা আসমানের দিকে।

তাদের বাড়িতে পৌঁছায় সকাল এগোরাটার মধ্যে। অভ্র সুরভির হাত ছেড়ে তার মাথাটা আবারও সিটে রেখে তাকে ডেকে তুলে। সুরভি টিমটিম করে চোখজোড়া খুলে অভ্রকে দেখে, “আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম?”
“তা আর বলতে। কুম্ভকর্ণর লেডিস ভার্সন তুমি। কতক্ষণ ধরে উঠাচ্ছি। ঘুম থেকে উঠার নামই নেই। সবাই নেমে গেছে আর আমি তোমাকে উঠাতে ব্যস্ত।”
“তো আপনি আমাকে রেখে চলে যেতেন।”
“হ্যাঁ যেন সবাই পরে আমাকে হাজারো প্রশ্ন করে। দেখো তোমাকে ওয়ার্নিং দিচ্ছি, আমার পরিবারের সামনে এমন ব্যবহার করবে যেন আমরা একে অপরকে অনেক ভালোবাসি, নাহলে বুঝে নিও তোমার অবস্থা কী হবে।” বলে সে চলে যায়।
সুরভির তো অনেক রাগ উঠে তার উপর। সে হাওয়াতে ঘুষি মেরে নিজের রাগ কমানোর চেষ্টা করে। গভীর নিশ্বাস ফেলে বলে, “এই লোকটাকে যখনই একটু ভালো ভাবি তখনই আমার ভুল ভাঙিয়ে দেয়। সবই তার নাটক। গতকালও নাটকই করছিল। অভদ্র একটা। আই হেইট হিম।”
সে নিজের জিনিসপত্র নিয়ে বাস থেকে নেমে বাড়িতে যায়।

বাড়িতে যাবার পর সকলে ড্রইংরুমে বসে এই কয়দিনের ছবি দেখছিল। এই তাদের শেষ সময় কাটানো। দুপুরের খাবার খেয়েই তারা সকলে নিজ নিজ কাজে রওনা দিবে। আবার কবে যে এভাবে দেখা হয়। মা সঅবার জন্য নাস্তা এনে দেয় কিছু। ফল এবং নাটস। সবাই খেতে খেতে ছবি দেখে, গল্প করে, হাসি-ঠাট্টায় মেতে থাকে। বিশেষ করে ইনারা ও সুরভি। তারা একে অপরকে পেলে তো জগৎ ভুলে যায়। আজ তাদের সাথে বাবা ও সভ্যও যোগ দিয়েছে। ইনারা সব খাবার নিয়ে একভাগ নিজে খাচ্ছিল আরেকভাগ দিচ্ছিল সুরভিকে। সে কলেজের দিনের মতো। এভাবে ভাবেই সে একমুঠো কাঠবাদাম নিয়ে অর্ধেক দেয় সুরভিকে। আর অর্ধেক নিজে রাখে।

অভ্র কাজ করলেও তার ধ্যান সুরভির দিকেই ছিলো। ইনারা বাদাম তুলে তা যে সুরভিকে দিলো তাও সে দেখে। যখন সুরভি বাদাম মুখে তুলবে তখন সে উঁচু স্বরে বলে উঠে, “সুরভি…”
হঠাৎ এমন ডাকে সুরভি তো ভয়ে লাফিয়ে উঠে। সে অভ্রর দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে।
অভ্র নিজেই বলে, “তোমার না বাদামে এলার্জি আছে? থার্ড ইয়ারে একবার হাস্পাতালে ভর্তি হয়ে ভালো লাগে নি?”
সুরভি তার দিকে আগের মতোই তাকিয়ে থাকে। কেবল এবার তার কপালে ভাঁজ পড়েছে।

ইনারা সুরভির দিকে তাকায়, “তুই হাস্পাতালে ভর্তি হয়েছিলি? কোথায় আমি জানি না তো।” সে আবার অভ্রর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “ভাইয়া আপনি কীভাবে জানেন?”
অভ্র প্রশ্নটা শুনে তাকায় সুরভির দিকে। তারপর আমতা-আমতা করে উওর দেয়, “সুরভি বলেছিল।”
এ শুনে তো ইনারা ক্ষেপে যায়। সে অভিমানের সুরে বলে, “তুই আমাকে ব্যাপারটা জানাস নি অথচ এই কয়মাসেই অভ্র ভাইয়াকে জানিয়ে দিলি? কাট্টি তোর সাথে।”
সে মুখ ফুলিয়ে উঠে যায়। সভ্যও বলে, “এই মেয়েটার কথায় কথায় রাগ করার কি বিমারি আছে? তুমি চিন্তা করো না আমি দেখছি ওকে।” বলে সে-ও চলে যায়।
কিন্তু সুরভি সেদিকে ধ্যান দেয় না। একঘন্টার মাঝে ইনারা নিজেই সব ভুলে যাবে। কিজন্য রাগ করেছিল ওটাও। সেটা বড় বিষয় না। সে কিছুক্ষণ ভেবে অভ্রর পাশে এসে বসে।

অভ্র ল্যাপটপে কাজ করছিল। সুরভিকে তার পাশে এসে বসতে দেখেও না দেখার ভান করে। তবে সুরভি তাকে জিজ্ঞেস করেই বসে, “আপনি কীভাবে জানেন যে আমার নাটস এ এলার্জি আছে?”
অভ্র বেশ আত্নবিশ্বাসের সাথেই উওর দেয়, “আমি নিজের রিসার্চ ভালোভাবেই করি। তোমার সাথে এখন আমার একটা চুক্তি আছে, তোমার কী মনে হয় তোমার খোঁজ ছাড়াই এসব করেছি।”
“তা ভালো কথা, কিন্তু আপনি এটা কীভাবে জানলেন আমার এরজন্য থার্ড ইয়ারে হাস্পাতালে যেতে হয়েছে? ব্যাপারটা ইনারা বা আমার পরিবার কাওকে জানাই নি, চিন্তা করবে বলে। এত আগের এই সামান্য ঘটনা রেকর্ড থাকার কথা না।”
অভ্র ঘাবড়ে যাবার পাত্র নয়। সে সুরভির দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসে। নিজের ল্যাপটপটা বন্ধ করে তার দিকে মুখখানি এগিয়ে বলে, “তুমি তো রিপোর্টার। এতটুকু ধাঁধা যদি সমাধান করতে না-ই পারো তাহলে রিপোর্টার হবার যোগ্যই না। তাই নিজের প্রশ্নের উত্তর নিজেই খুঁজো। আমার গাড়ি মনে হয় এসে পড়েছে। আবার দেখা হবে, যখন আমি চাইব।”
বলে সে উঠে চলে যায় সুরভির সামনে।

সুরভির তখন অনেক মেজাজ খারাপ হয়। কিন্তু সে কিছু বলতে পারে না। এরমধ্যে তাইফার মেসেজ পায় সে,
“দোস্ত সিনিয়র থেকে অর্ডার এসেছে। তোকে আবারও কাজ জয়েন করার জন্য ডেকেছে। ইনফ্যাক্ট তুই এবং আমি দুইটা প্রজেক্টও পেয়েছি। অনেক এক্সাইটিং ব্যাপার না?”
.
.
বুধবার, ভোর তখন পাঁচটা বাজে, মায়া দ্রুত তার ব্যাগ নিয়ে নিচে নেমে আসে। আজ তারা যাচ্ছে রাঙামাটির খাগড়াছড়িতে। মেহেদীর বোনের বিয়েতে। সে গাড়ির সামনে এসে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তন্নি ও আশরাফকে দেখে বলে, “সরি ব্রো…সরি… আমার ঘুম থেকে ঠিক টাইমেই উঠতাম কিন্তু বেয়াদব এলার্মটাই বাজে নি। আমার দোষ নাই এখানে।”
কিন্তু আজবভাবে তন্নি তাকে বকা দেয় নি। শান্ত গলায় বলে, “বাদ দে, গাড়িতে উঠে বস। দেরি হচ্ছে।”
ব্যাপারটা মায়াকে অবাক করে। কিন্তু তেমন মাথা ঘামায় না। সে ভাবে নিজে ব্যাকসিটে আরামেই ঘুমাবে। নিজের ব্যাগ আশরাফকে দিয়ে গাড়ির ভেতরে ঢুকে। ঢুকতেই প্রথমে সে দেখতে পায় জোহানকে। সে চোখ মলে আবার তাকায়, “তন্নিরে আমি মনে হয় সকাল সকাল স্বপ্ন দেখছি, ইয়া বড় ছয় ফিটের মানবকে দেখতে পারছি।”
জোহান বলে, “বাহ স্বপ্নে তুমি আমাকেও দেখো জানতাম না।”
মায়া হা হয়ে দুই সেকেন্ড চুপ থেকে টিপটিপ করে দেখে জোহানকে। তারপর জানালা দিয়ে মুখ বের করে তন্নিকে জিজ্ঞেস করে, “এই ছয়ফিটের দানব এখানে কী করে?”
“দানব?” মুখ কুঁচকে জিজ্ঞেস করে তন্নি।
“আই মিন মানব। মানে জোহান। আর মানব, দানব, জোহান সেইম সেইম। যে লাউ, সেই কদু। এখন বল এই যে মানব সেই দানব এখানে কী করে?”
“তোর ঘুম ভাঙে নি না’কি এখনো? এসব কী যা তা বলছিস?”
“উফফ বলবি?”
“মেহেদী দাওয়াত দিয়েছে।” তন্নি গাড়িতে উঠে বসে।
“এই মেহেদীর বাচ্চাও সে-ই বাড়া বেড়েছে। ওকে একটা শিক্ষা দিতে হবে। কিন্তু তোরা ওকে আমাদের সাথে নিচ্ছিস কেন?”
আশরাফ ড্রাইভিং সিটে বসে তার চোখে সানগ্লাস পরে বলে, “গন্তব্যও এক, সফরও এক, তাই ভাবলাম আরেক সাথী হলে মন্দ হয় না।”
মায়া তার মাথায় হ্যান্ডব্যাগ দিয়ে বাড়ি দিতেই তার সানগ্লাস পড়ে যায়। মায়া বলে, “ভাই তোকে মেয়েদের মেলায় হারিয়ে আসলেও একটা মেয়ে পাত্তা দিব না, গাড়ির মধ্যে সানগ্লাস পরে কাকে ইম্প্রেস করবি? ভালো করে দেখে গাড়ি চালা।”
জোহান চেপে বসে। ভয়ে বলে, “তুমি মনে হয় ফ্রেন্ডদের আসেপাশে থাকলে মাথার যতগুলো স্ক্রু আছে সব পড়ে যায়।”
মায়া আড়চোখে তাকাতেই জোহান ভয়ে জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
তন্নি জোরে বলে, “তাহলে সফর শুরু করা যাক?”
হঠাৎ তার এত জোরে বলাতে জোহান ভয় পেয়ে যায়। সে ভয়ে বুকের উপর হাত রেখে গভীর নিশ্বাস ফেলে। তার ভীতি কাটতে না কাটতেই আশরাফ এবং মায়া আরও চিৎকার করে বলে, “রাঙামাটি আমরা আসছি।”
তারপর তিনজনে মিলে চিৎকার করে।
জোহান সবার দিকে অবাক হয়ে তাকায়। এসব সে আগে দেখে নি। সে বিড়বিড় করে বলে, “এদের আশেপাশে থাকলে যেকেউ হার্টএট্যাক করবে।”

গাড়ি চালু হয়। আশেপাশে তখনও শীতল হাওয়া বইছিল। সূর্যমামার উদয় হওয়ায় আকাশটা কমলা লাগছিলো। কমলামাখা আসমানে মেঘেরা থৈথৈ করে উড়ে বেড়াচ্ছে। রাস্তাঘাট তখন খালি। সারাক্ষণ গাড়িতে ভরে থাকা রাস্তাটা আজ দেখতে সুন্দর লাগছে। যদিও তখনও চারদিকে কেবল ইট-পাথরের দালান-কোঠা। তখনও এই মানবহীন রাস্তাটা দেখতে সুন্দর লাগছিল। মায়া জানালা দিয়ে মুখ বের করে ভোরে শীতল হাওয়ার আনন্দ উপভোগ করতে থাকে।

তন্নি আশরাফকে বলে, “এমনি সফরটা কী ভালো লাগে? গান ছাড়ছিস না কেন?”
“আরে আমরা লাইভ কনসার্ট ইনজয় করতে পারব। মিউজিক প্লেয়ার ছাড়ার কী দরকার?” সে আয়নায় জোহানকে দেখে ভ্রু নাচিয়ে বলে, “ঠিক বলেছি না ব্রো?”
জোহান হেসে তার পাশে থাকা গিটারটি কোলে নেয়।
গিটারের সুরের সাথে মেশায় তার কন্ঠের মোহন,

“মেঘলা আকাশের অপেক্ষায় দিন হারিয়েছি আমি
রাতের মাধুরি মিশিয়ে নিয়েছ তুমি,
শত অক্ষেপ জুড়িয়ে
তোমার কাছে ছুটে এলাম শুনো গো সখী
প্রেম তুমি, প্রেম তুমি
তোমার প্রেমের অপেক্ষায় দিন হারিয়েছি আমি।
প্রেম তুমি, প্রেম তুমি
তোমার মাঝে নিজেকে ভুলিয়ে দিয়েছি আমি।”

গানটা শুনে মায়া একপলক তার দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের কোণে হাসি নিয়ে আবারও বাহিরের আবহাওয়া উপভোগ করতে শুরু করে।

তন্নি সাইড মিরোর এ মায়াকে দেখছিল। হঠাৎ তার এমন মিষ্টি হাসি দেখে তন্নি অবাক হয়ে পিছনে তাকায়। জোহান ও মায়াকে দেখে। আবার সামনে মুখ ফিরিয়ে নেয়।

শহরটা ব্যস্ত হবার পূর্বেই তারা যেয়ে পৌঁছায় চট্টগ্রামে। সূর্যমামা উঠে বসে আছে মাথার উপরে। সকালের নাস্তা ও দুপুরের খাবারটা একসাথে সেরে নিবে। তাদের গন্তব্যে যেতে আর কতক্ষণ যেন লাগে। আশরাফ, তন্নি ও মায়া অনেক উৎসুক হলেও জোহান নিচে নামতে চায় না। জিজ্ঞেস করলে সে বলে, “বাহিরে গেলে ঝামেলা হতে পারে। বেশি মানুষরা চিনতে পারলে ভিড় জমে যায়। তারপর অনেক সমস্যা তৈরি হয়।”
আশরাফ বলে, “হ্যাঁ আমি দেখেছিলাম গতবছরও এক সেলিব্রিটি এভাবে বাহিরে আসাতে ভিড় লেগে গিয়েছিল। আর দুইজন আহতও হয়েছে।”
“নাম ও জনপ্রিয়তা অর্জন করতে হলে নিজের স্বাধীনতা হারাতেই হয়। তোমরা যাও। আমি এখানেই অপেক্ষা করছি।”
তিনজন বের হবার পর জোহান গভীর আফসোসের নিশ্বাস ফেলে। সে বাহিরের কোলাহল দেখতে থাকে। তখনই গাড়ির দরজা খোলার শব্দ পায়। দেখে মায়া এসেছে। দু’টি ওয়ানটাইম প্লেট আর পলিথিন এ কিছু খাবার নিয়ে।

“তুমি এখানে কেন?” জোহান অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।
মায়া সাথে সাথেই তার উওর দেয় না। সে গাড়ির ভেতর ঢুকে তাদের দুইজনের সামনে প্লেট রেখে খাবার বের করতে করতে উওর দেয়, “চট্টগ্রামের খাবারের স্বাদই আলাদা। চট্টগ্রামে এসে এখানের মেজবানি গরুর মাংস, কালা ভুনা, চনার ডাল ভাত দিয়ে না খেলেই মিস। এই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার কথাও না। খাবারের জন্য এই রাস্তা দিয়ে এলাম আর তুমি বলছো খাবে না?”
“উওর দিলে না যে? এখানে কী করছ তোমার বন্ধুদের ছেড়ে।”
“এই’যে বললাম এসব তোমাকে না খাওয়ালে তো আমার পাপ হতো।” বলে হেসে দেয়।
জোহানের ব্যাপারটা ভালো লাগে। সে ঠোঁটের কোণে হাসি আঁকে।
মায়া খাবার বেড়ে দেয় জোহানের দিকে। জোহানের প্রথম প্রশ্ন এটাই, “চামচ আনোনি?”
মায়া মুখ বানিয়ে বলে, “দেশীয় খাবার হাত দিয়েই খায়। তোমার ভেতরের বিদেশী আত্নাটা এতবছরেও উড়ে যায় নি?”
“এখন হাত দিয়ে খেলে তো হাত ময়লা হয়ে যাবে।”
মায়া তার কথায় বিরক্ত হয় বটে কিন্তু তা কেবল চোখ রাঙিয়েই দেখায়। তারপর নিজের হাতেই খাবার মেখে জোহানের মুখের সামনে নেয়।

“না না থাক, আমিই খেতে পারব দেও।” জোহান অপ্রস্তুত হয়ে বলে।
“নেও। খেতে যেয়ে পরে গাড়ির বারোটা বাজাবে। আমাদের গ্রুপে আমি বা তন্নি একজন খাবার মেখে সবাইকে খাইয়ে দেই। এটা বড় ব্যাপার না।”
কিন্তু এটা জোহানের জন্য বড় ব্যাপার ছিলো। তার মা ছাড়া কেউ তাকে এভাবে আদর করে খাইয়ে দেয় নি। সে মায়ার হাতের খাবারটা খায়। একই প্লেট থেকে মায়া নিজে খায় আবার জোহানকেও খাইয়ে দেয়। জোহান জিজ্ঞেস করে, “তোমাকে দেখে চেনার উপায় নেই”
“চেনার উপায় নেই মানে?”
“কাজের প্লেসে তুমি কি কঠোর, কারো কথা শুনো না, মুখের উপর জবাব দেও, গোমড়া মুখ করে রাখো। আর কারো কথা চিন্তা করো না। অথচ বন্ধুদের সাথে তুমি অন্য এক ব্যক্তি। সবার খেয়াল রাখো, খিলখিলিয়ে হাসো, বাচ্চাদের মতো ব্যবহার করো।”
“এই আমি বাচ্চা না। বাচ্চা বলবে না আমাকে।” মায়া ধমক দিয়ে বলে। পরক্ষণেই সে নরমসুরে বলে, “ওরা আমার ঘর। ওরা তিনজন এবং আমার ছোটবোন মিতা। সারা পৃথিবী যখন আমাকে দোষারোপ করছিল, ওরা তখন আমার সাথে ছিলো। এই জগৎ এ সোজা বা সরল মানুষরা বাঁচতে পারে না। বাঁচতে পারলেও নিজের অধিকার পেতে পারে না। একটা মানুষ অন্য মানুষকে
দিয়ে নিজের স্বার্থের কাজ করাতে জুটে থাকে। যদি সামনের মানুষটা তার ইশারায় না চলে তাহলে তার ইগোতে লাগে। আর সেই মানুষটাই খারাপ হয়ে যায়। তাই আমি নিজেই স্বার্থপর হয়ে গেছি।”
“তুমি স্বার্থপর না, কেবল কঠোর।”
মায়া তার দিকে তাকিয়ে খানিকটা হেসে আবার তাকে খাইয়ে দেয়।
জোহান তাকে বলে, “এভাবে তোমাকে বেশি সুন্দর লাগে।”
“কীভাবে?”
“এমন সাধারণ ভাবে। তোমার বসি স্টাইল, আর হেভি মেকাপ ছাড়া তোমাকে নরমালি অনেক কিউট লাগে।”
মায়ার গালদুটো লালচে হয়ে আসে। জোহান মুখটা তার সামনে এনে ভালো করে দেখতে থাকে তাকে। তার কাছে আসা দেখেই বুকের ভেতরটা লাফিয়ে উঠে মায়ার। সে চোখের পলক নামাতে পারে না। নিশ্বাস ফেলতেও যেন ভুলে যায়। কাঁপানো গলায় জিজ্ঞেস করে, “কী দেখছো?”
জোহান বলে, “তোমাকে মনে হয় লম্বা চুলে সুন্দর লাগবে।”
সে পিছনে সরে স্বাভাবিকভাবে বসতেই মায়া গভীর নিশ্বাস ফেলে। এর মধ্যেই আশরাফ ও তন্নি আসে।
তন্নি জিজ্ঞেস করে, “কী কথা হচ্ছে?”
“আমি বলছিলাম মায়াকে লম্বা চুলে বেশি সুন্দর লাগতো।”
কথাটা শুনে তন্নি তার সিটে উঠে বসে তাকায় জোহানের দিকে। জোহান তো হঠাৎ এই কান্ডতে ভয় ই পায়।

তন্নি ক্ষিপ্ত সুরে বলে, “এই মেয়ের চুল আগে হাঁটু পর্যন্ত আসতো। কী সুন্দর চুল ছিলো! সব মেয়েরা দেখে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যেত। এত্ত লম্বা আর এত্তো সুন্দর চুল ছিলো।”
জোহান মায়ার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “তাহলে এখন কী হলো?”
উওরটা তন্নিই দেয়, “ম্যাডাম ফট করে রাগের ঠেলায় একহাত চুল কেটে ফেলছে। এত নির্দয়, পাথর হৃদয়ের কীভাবে যে হতে পারল। আমার বুক ফেঁটে যাচ্ছিল কষ্ঠে। এদিকে আমাদের চুল বড় হয় না আর ওদিকে এই ম্যাডাম এত সুন্দর চুলের বারোটা বাজিয়ে দিলো।”
মায়া বলে, “হইসে ড্রামা বন্ধ কর। ড্রামা কুইন।”
“কথা বলবি না তুই আমার সাথে।”
“কিন্তু কাটলে কেন?” জোহান জিজ্ঞেস করে।
“আরে ওয়াহিদের ওর চুল অনেক পছন্দ ছিলো। তাই ওর আর দিয়ার কথা জানার পর….” তন্নি এতটুকু বলেই থেমে যায়। সে বুঝতে পারে এই কথাটা তুলে সে ভুল করে ফেলেছে। সে মায়ার দিকে তাকায় ভয়ে ভয়ে। মায়া তার সামনের প্লেট গুছিয়ে আশরাফকে বলে, “আমার সাথে আয় তো। হাত ধুঁতে হবে।” বলে সে সেখান থেকে চলে যায়।

মায়া আসার পর সে স্বাভাবিকই ছিলো। সারারাস্তা আবারও তারা গান, হাসিঠাট্টা করে কাটায়। বেশ মজা করে তারা। শেষ জোহান এমন আনন্দ কবে করেছিল তার মনে নেই। আজ তাদের তিনজনকে অনেক আপন মনে হচ্ছে। বন্ধু মনে হচ্ছে। তারা গন্তব্যে পৌঁছানোর পর দেখে পার্কিং-এই মেহেদী দাঁড়িয়ে ছিলো। তাদের দেখেই দৌড়ে এসে সবাইকে জড়িয়ে ধরে। তার কান্ডে আরও বেশি হাসে সবাই। জোহান তাকায় মায়ার দিকে। তার মুখে হাসিটা মানায়। তার খিলখিলিয়ে উঠা হাসিটি দেখতে সুন্দর লাগে। তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই দেখে তার সুন্দর হাসিটা মলিন হয়ে গেছে। মুখে কালো আঁধার নেমে আসছে। সে মায়ার দৃষ্টি অনুসারে সামনে তাকিয়ে দেখে দিয়া এবং ওয়াহিদ দাঁড়ানো।

চলবে…