অনুভূতির খাঁচা পর্ব-২৩+২৪

0
34

অনুভূতির খাঁচা
পর্ব-২৩
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

জোহান যাবার সময় পিছনে তাকায়। দেখতে পায় মায়া তার বন্ধুদের সাথে মজার সময় কাটাচ্ছে। তাদের সবাইকে এভাবে দেখে তার ঠোঁটের কোণে হাসি আঁকে।

মায়ার গলা শুকিয়ে যাওয়ায় সে পানি নিতে যায়। সে একপাশে পানি ও সফটড্রিংক্সস দেখে এক বোতল পানি নেয়। পানি পান করতে যাওয়ার সময় একজন পুরুষের স্পর্শ পায়। সে তার গালে রঙ লাগিয়ে দেয়। ততটুকু পর্যন্ত ঠিক ছিলো। কিন্তু সে হাত তার গাল থেকে কাঁধ পর্যন্ত এসে পড়ে। আতঙ্কে মায়া কেঁপে উঠে। সে তৈরিই ছিলো সামনে পিছনের মানুষটার মাথা ফাটিয়ে দেবার জন্য। কিন্তু অন্তিম মুহুর্তেই থেমে যায়। পিছনে আদিলকে দাঁড়াতে দেখে। নিজের রাগটাকে নিয়ন্ত্রণ করে হাসিমুখে বলে, “আপনি এখানে?”
“কেন আমার সাথে দেখা করে ভালো লাগে নি আপনার?”
“ভালো লাগবে না কেন? কিন্তু এখন তো আপনার মালার সাথে থাকার কথা তাই আপনাকে এখানে আশা করিনি আরকি।”
“মালার সাথে থেকেও চোখ আপনাকেই খুঁজছিল। তাই ছুটে এলাম।”
মায়া হেসে বলে,”মজা ভালোই করতে পারেন।”
“আপনি সিঙ্গেল তাই না?”
“হুম।”
“এত সুন্দরী মেয়ে সিঙ্গেল কীভাবে থাকে আমি বুঝতে পারি না।”
মায়া সুযোগ পেয়ে তার তালের সাথে তাল মেলায়, “আসলে হয়েছে কি এত বড় কোম্পানি সামলানোর চক্করে সময় পায় নি। আমার বাবা দ্বিতীয় বড় অংশীদার তো মানে কোম্পানিতে প্রফিট হলে আমাদের কাছেই আসবে। আবার আমি কয়েকটা কোম্পানি ইনভেস্ট করেছি। সেখানেও আলাদা খাটুনি। এরজন্য সময় হয়ে উঠে নি। এখন মন মতো কাওকে পেলে সোজা বিয়ে করে নিতাম। বিজনেস ফিল্ডে হলে বেশি ভালো হতো। কিন্তু তেমন কাওকে পাই-ই না।”
“কেমন ছেলে পছন্দ আপনার?”
“আপনার মতো…আই মিন আপনার মতো হলেই হবে। যে বিজনেসে পারদর্শী। আসলে আমি একটি নতুন কোম্পানি খোলার চিন্তাভাবনা করছি। বিজনেস সম্পর্কে ধারণা থাকলে তাকে পার্টনারও বানাতাম আবার একসাথে সময়ও কাটাতে পারতাম। বুঝতে পারছেন তো কি বলতে চাইছি। আপনার মতো কেউ থাকলে বলেন, তার সাথে বিজনেস পার্টনারশিপ আর লাইফ পার্টনারশিপ দুটোই হবে।”
“আমার মতো? আপনি সত্যি আমার মতো কাওকে খুঁজছিলেন?”
“কেন আপনার মধ্যে কোনো কমতি আছে না’কি?”
“না… মানে একদমই না।”
“আপনার সাথে ভুল সময়ে দেখা হলো বুঝলেন। আপনার বিয়ের দুইদিন আগে। আচ্ছা আমার বন্ধুরা অপেক্ষা করছে। আমি আসি।”
মায়া তাকে ভাবনার জালে ফাঁসিয়ে এসে পড়ে।
.
.
গাড়ি এসে থামে সুরভিদের বাসার সামনে। সুরভি গাড়ি থেকে বের হয়ে ড্রাইভারকে ধন্যবাদ জানায়। অভ্র বলে, “এই’যে আমাকেও ধন্যবাদ জানাও।”
“কোন দু:খে?”
“আমি তোমাকে এখানে ড্রপ করেছি।”
“গাড়ি চালিয়েছে ড্রাইভার ভাইয়া। আপনাকে কেন ধন্যবাদ দিব?”
অভ্র বিরক্তি বোধ করে তার কথায়। সে ঠিক মতো বসে ড্রাইভারকে বলবে গাড়ি ছাড়তে তখনই পাশ থেকে আসে তার ভাই সাঈদ। সুরভিকে দেখে জিজ্ঞেস করে, “তুই দিনদুপুরে বাসায় কী করিস?”
“ছুটি পেয়েছি। কিন্তু তুমি কী করছ?”
“জোহান তো নেই তাই আমারও কাজ নেই।”
এতক্ষণে তার ধ্যান যায় তার পাশে দাঁড়ানো এত বড় গাড়িতে। সে বলে, “এই গাড়ি আমি কোথাও দেখেছি।”
ঝুঁকে অভ্রকে দেখতেই সে বলে, “আরে অভ্র ভাই আপনি এখানে? ওহ সুরভিকে বুঝি দিতে এসেছিলেন? এখান থেকেই কেন যাচ্ছেন ভেতরে আসুন।”
“না থাক।”
“থাকবে কীভাবে? আপনার আসতেই হবে। আসুন। রাতে খেয়ে যাবেন।”
সুরভি বলে, “আরে না ভাইয়া। উনি এত ব্যস্ত মানুষ। উনার কী ভেতরে যাবার সময় হবে?”
অভ্রর ভেতরে যাবার পরিকল্পনা তো ছিলো না কিন্তু যেহেতু সুরভি মানা করেছে সেহেতু এখন সে যাবে। তাই সে বলে, “আমি ফ্রী আছি। এ বাহানায় আপনাদের জেনে নিব।”
তারপর সে ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দেয়।
সাঈদ তো খুশি হয়ে তাকে স্বাগতম করে।
সুরভির মেজাজ আরও চওড়া হয়। সে রাগে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “খাটাইশ একটা।”
তারপর তাদের পিছনে ঘরে ঢুকে।
ঢুকে দেখে অন্য কান্ড। তার মা, ভাবি রিধু আরও ব্যস্ত হয়ে পড়ে। যেন কোনো মহান ব্যক্তি এসে পড়েছে। তাকে আপ্পায়নের কোনো সুযোগ হাতছাড়া করতে রাজি না তারা। কতরকমের শরবত আর নাস্তা দেয়।

সুরভির তো তাদের দেখেই মাথা ঘুরাচ্ছিল। তাই সে যায় নিজের রুমে। ভাবে গোসল করে সারাদিনের ক্লান্তি দূর করবে। কিন্তু মা তাকে ধরে নিয়ে এসে তাকেও কাজ দেয়। কিছুক্ষণ পর আসে তার বাবা, হাতে কতগুলো খাবারের প্যাকেট। সুরভি বুঝে উঠতে পারে না সবাই এতকিছু কেন করছে? এত ব্যাকুল হয়ে গেল কেন সব? রান্নাবান্নায় তার ভাগের কাজ শেষে এসে দেখে তার বাবা ও অভ্র বসে দাবা খেলছে। সে যেয়ে তার ভাইয়ের পাশে দাঁড়ায় কোমরে হাত দিয়ে। উঁকি মেরে বোর্ডের দিকে তাকিয়ে বলে, “আমার বাবা দাবা খেলায় এক্সপার্ট। তাকে হারানোটা মুশকিল।”
সাঈদও ধ্যানসহকারে খেলা দেখছিল। সে সুরভির কথা শুনে বলে, “অভ্র অলরেডি তিনবার হারিয়ে ফেলেছে।”
“হে?” সুরভি যেন এক ঝটকা খায়।
“চেকমেট।” অভ্রর কথা শুনে সুরভি তার দিকেও অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
সাঈদ বলে, “মাত্র সাত মিনিটে… ইম্প্রেসিভ।”
“মাত্র সাত মিনিট?” সুরভি বিস্মিত সুরে বলে।
বাবাও তার প্রশংসা করে, “সত্যি আমি এত ভালো প্রতিদ্বন্দ্বী আগে পাই নি। হেরেও ভালো লাগছে। কিন্তু অবাক হচ্ছি না, তোমার বাবা সেদিন বলেছিল তুমি না’কি ছোট থেকেই বোর্ডগেইম খেলতে পছন্দ করো। আর কখনোই পরাজিত হও না।”
“আসলে আংকেল হেরে যাওয়াটা আমার পছন্দ না। তা যার কাছেই হোক।” বলে সে হেসে তাকায় সুরভির দিকে। সুরভির তখন মনে পড়ে তাদের এনগেজমেন্টের কথা। সেদিন তার প্লান নষ্ট করে কীভাবে সব নিজের কথামতো করেছিল। ভেবেই সে মুখ বানায়। তারপর সেখান থেকে চলে যায়।

লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে সুরভি বের হয় বাথরুম থেকে। তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে তার টেবিলের উপর দেখতে পায় তার, ইনারার ও প্রিয়র ছবি। ছবিটা দেখ সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফ্রেমটা উঠিয়ে বলে, “তুই আজ এখানে থাকলে ইনারার নিউজ শুনে কতটা খুশি হতি। আমি খালামণি হতে যাচ্ছি, আর তুই মামা। জানিস জীবনে সবকিছু পার্ফেক্ট আছে, কিন্তু তুই নেই বলে সব কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে।”
মা’য়ের কন্ঠ শুনে সুরভি ফ্রেম ও তোয়ালে রেখ বের হয়। সে দরজার বাহিরে যেতেই তার মা দ্রুত এসে তাকে আবারও রুমে নিয়ে যায়।

“কী করছ মা?” সুরভি জিজ্ঞেস করে।
“আমি কি করছি? তুই কি পড়ে আছিস?”
“সেলোয়ার-কামিজ।”
“এত সাধারণ সেলোয়ার-কামিজ। তাও সাদা রঙের। সাদা পরলে তোকে আরও বেশি কালো দেখায়। বাহিরে তোর হবু বর এসেছে আর তুই এভাবে আসবি? পোশাক পালটে একটু সাজুগুজু করে আয়।”
“উফফ মা, নট এগেইন। আমি আমার স্কিনে খুশি আছি। আর আমার কারো জন্য সাজুগুজু করতে হবে না। আমার পছন্দ না। আমার নিজেকে এভাবে ভালো লাগে, আমি ঘরে এভাবে থাকি, তাই বাহির থেকে কেউ আসলে আমাকে এভাবেই দেখতে হবে।”
“অন্যসবাই আর ও কী এক না’কি?”
“তাহলে বলো, বিয়ের লেহেঙ্গা পরেই এসে পরি।”
“একটা কথা না। ভালো মতো তৈরি হয়েই বের হবি বলে দিলাম।”
মা চলে যাবার পর সে তৈরি হবার নামে চোখে কাজল দিয়ে বেরিয়ে পড়ে। বেরিয়ে দেখে সবাই বসে গল্প করছে। সেদিকে যেতেই মা’য়ের নজর পড়ে তার, এভাবে চোখ রাঙিয়ে আছে যেন তার কপালে আজ শনি আছে। সে এই অগ্নিদৃষ্টি না দেখার মতো এড়িয়ে যায়। বকা থেকে বাঁচার জন্য দ্রুত যেয়ে বসে তার বাবার পাশে।

অভ্রর হঠাৎ চোখের সামনে হঠাৎ সুরভি এসে পড়ায় সে চমকে উঠে। ভেজা চুলে, কাজলমাখা নয়নে, শুভ্র রঙের পোশাকে তাকে অন্যরকম সুন্দর দেখা যাচ্ছিল। থৈথৈ করে করে বেয়ে পড়া কোঁকড়াচুলগুলো থেকে টিপ টিপ করে পানি পড়ছিল। মেয়েটা সারাক্ষণ চুল বাঁধাই রাখে, ওকে কে বলবে খোলা চুলে ওকে কতটা মায়াবী দেখায়।
তার টানা চোখে কাজল যেন হাতিয়ারের মতো কারও বুকে আঘাত করতে পারবে। সে চোখ অভ্রর দিকে যেয়ে আটকাতেই সে ঘাবড়ে যায়। চুরি করতে যেয়ে যেন ধরা পড়েছে। সকলের উপর রাজত্ব চালানো পুরুষটাও এক নারীর দৃষ্টিতে বিচলিত হয়ে পড়লো। সে এদিক ওদিক তাকাতে শুরু করে। সাঈদ তখনই বলে, “এই যে ভাই চা নিন।”
সুযোগ বুঝে জলদি সে চা’য়ের কাপটা ধরে যেয়ে গরম চা তার হাতে পড়ে যায়। সাথে সাথে সে চা’য়ের কাপ টেবিলে রেখে দেয়।
সবাই তো আঁতকে যায়। কিন্তু অভ্র সবাইকে আশ্বাস দেয় সে ঠিক আছে। তেমন কিছু হয় নি, সে ঠিক আছে। সবাই একটু শান্ত হয়। কিন্তু সুরভি দাঁড়িয়ে তাকে বলে, “উঠুন, বেসিনে ঠান্ডা পানি দিয়ে হাত ধুয়ে নিন। বেশি পুড়লে টুথপেষ্ট লাগিয়ে দিচ্ছি।”
“রিলেক্স চা এতটা গরম ছিলো না।”
“তাই বলে কি হাতটাও ধুঁবেন না? আসুন।”
এবার কড়া কন্ঠে বলে সুরভী। অভ্রও সবার সামনে তাকে মানা করতে পারে না। সে অভ্রকে নিয়ে ডাইনিং রুমের বেসিনের সামনে নিয়ে আসে। সুরভি বিড়বিড় করে বলে, “পুড়ে গেলেও এই অভদ্র লোক নিজের ভাবের ঠেলায় বলবে না।”
অভ্র হাত ধুঁতে ধুঁতে বলে, “আবার আমার নামে কি বদনাম করছ?”
সুরভি তার হাতের দিকে তাকায়। বেশি লাল হয়ে গেলে টুথপেষ্ট লাগিয়ে দিবে নাহলে ভাইকে দিয়ে মলম আনাবে।
“দেখলে আমার এত সুন্দর চেহেরা আছে তা দেখো। হাত দেখে কী বলবে।”
সুরভি বিরক্তি নিয়ে আর দিকে তাকায়। তারপর তার হাত ধরে ভালো করে দেখে হাতের কোথাও পুড়েছে না’কি!
অভ্র আবারও বলে, “বললেই তো আমার হাত ধরতে চাও এত বাহানার প্রয়োজন নেই।”
সুরভি রাগী দৃষ্টিতে তাকায় অভ্রর দিকে।
কিন্তু অভ্র তার থেকে ভয় পাবার লোক তো নয়। সে বলে, “আমি বুঝতে পারছি আমার হাত ধরে অনেক ভালো।লাগছে তোমার কিন্তু বাসায় তো এখন সবাই আছে। কেউ এসে পড়লে তোমারই লজ্জায় পড়তে হবে।”
“ধ্যুর কিছু হয় নি আপনার। অকারণে আপনার আজেবাজে কথা সহ্য করেছি।”
সুরভি আবার ড্রইংরুমে যেতে নিলে মা তাদের দেখে বলে, “সুরভি শুন, আমি অভ্রর জন্য চা বানাচ্ছি। তুই ততক্ষণ অভ্রকে ঘরটা ঘুরে দেখিয়ে আয়।”
“দেখানোর কি আছে? এটা তো সাধারণ ঘরই, মিউজিয়াম না’কি?”
“চুপচাপ যা বলেছি তা কর।”
“আমি কেন? ভাইয়াকে বলো।”
মা মুখে কিছু বলে না, কেবল চোখ রাঙায়।
“ভাইয়া কেন করবে? আমি আছি তো। আমিই দেখাচ্ছি।” সুরভি পিছনে ফিরে অভ্রর দিকে তাকিয়ে বলে, “আসুন মিউজিয়ামের সব আর্টপিস দেখে নিন।”
সুরভি অভ্রকে নিয়ে যায়। সব রুমে নিয়ে ঘুরতে থাকে। এখানে কিছু বলতে হবে না’কি সে তাও বুঝে না। সে সামনে ঘুরে আর অভ্র তার পিছনে। ঘুরতে ঘুরতে অভ্রকে তার রুমে নিয়ে আসে। সুরভি বিরক্তির সুরে বলে, “এখানে দেখার কি আছে আমি বুঝি না।”
অভ্র টেবিলের কাছে যেয়ে তার বন্ধুদের ফটোফ্রেম হাতে নেয়। সুরভি জানায়, “আমার আর ইনারার আরেকজন বন্ধু ছিলো, এখন আর এই পৃথিবীতে নেই।”
“জানি।”
“আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম জনাব অভ্র সব জানে।”
সে টেবিলের একপাশে এসে দাঁড়ায়।
“খুব মিস করো তাই না?”
সুরভি একপলক তাকায় অভ্রর দিকে। গভীর নিশ্বাস ফেলে, “মিস করতেও কষ্ট লাগে। চোখের সামনে এমন কিছু মুহূর্ত ভেসে উঠে যা মনে করতে চাই না। কিন্তু ওকে না মনে করেও থাকতে পারি না। অনেক স্মৃতি একসাথে আছে।”
“কিছু মানুষের স্থান অন্যকেউ পরিপূর্ণ করতে পারে না। জীবনে হাজারো মানুষ আসলেও ওই একটি মানুষের স্থান সবসময় শূন্য থেকে যায়।”
সুরভির পুরনো এক কথা মনে পড়ে। একরাতে সে আহনাফের সাথে কথা বলছিল ফোনে। প্রিয়’র মৃত্যুবার্ষিকী ছিলো। তার প্রচুর কান্না পাচ্ছিল। সে আবেগী মানুষ হলেও সহজে কারও সামনে কাঁদে না। তবে সেদিন নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে প্রিয়’র কথা বলতে বলতে কান্না করে দেয়। তখন আহনাফ খানিকটা বিরক্ত হয়ে বলে, “এত কান্না করার কি আছে? ওতো কেবল তোমার বন্ধুই ছিলো। পরিবারের কেউ তো না। রক্তের সম্পর্ক নেই। এছাড়া সে গেছে এতগুলো বছর হয়ে গেছে। আমার মা মারা গেছে, যাকে আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। আমি আমার মা’য়ের জন্য এভাবে কান্না করলে তাও বুঝা যায়, তোমার কান্নার কারণটা বুঝতে পারছি না।”
কথাটা শুনার পর থেকে এরপর আর সুরভি তাকে তার মনের কথাগুলো বা কষ্টগুলো বলে নি।
এটা সত্য মা বাবাকে হারানোর মতো কষ্ট সবচেয়ে বেশি। এর মানে কি কাছের কাওকে হারালে কী কষ্ট পাওয়া যাবে না? আপন হবার জন্য কী রক্তের সম্পর্ক প্রয়োজন? কিছু বন্ধুত্বের রঙ রক্ত থেকেও গাঢ় হয়।
সেদিনের পর থেকে প্রিয়কে নিয়ে সে ইনারা ছাড়া কারও সাথে তেমন কথা বলে নি।
আজ অভ্রর মুখে এসব কথা শুনে সে অবাক হয়। সে ভাবে নি জনাব আরিফুর ইসমাত অভদ্র অনুভূতির কথা জানবেন।

ফটোফ্রেমটা রেখে দেয় অভ্র। সুরভির দিকে তাকিয়ে দেখে মেয়েটা তার দিকেই তাকিয়ে আছে। সে বাঁকা হেসে চোখ টিপ মেরে জিজ্ঞেস করে, “এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? প্রেমে পড়লে না’কি?”
সুরভি মুখ বানিয়ে সেখান থেকে বারান্দায় চলে যায়। অভ্রও যায় তার পিছনে।
“আপনি আমার পিছু পিছু ঘুরছেন কেন?” সুরভি জিজ্ঞেস করে।
“কারণ তুমি ঘর দেখাচ্ছো তাই।”
“দেখা তো শেষ। এখন বাহিরে চলে যান। আপনার মুখ দেখে দেখে এখন আমার চোখ জ্বলতেছে।”
“সারা পৃথিবী আমার সম্মান করে। আদব কায়দার সাথে কথা বলে বা ভয় পায়। কিন্তু দাদাজান, তুমি আর তোমার বান্ধবী তিনজনের মুখ থেকে আমাকে সম্মান দিয়ে দু’টা কথা বের হয় না? আর তুমি তো সারা দেশের সামনে আমার সম্মান ডাস্টবিনে মুড়ে ফেলে দিতে চেয়েছ।”
“মহারাজ দয়া করিয়া এই স্থান থেকে প্রস্থান করুন। আপনার চেহেরা দেখিয়া আমার নিদারুণ বিরক্তি লাগছে।”
অভ্র তার দিকে এগিয়ে আসে।
“আপনি… আপনি আমার দিকে এগোচ্ছেন কেন? দেখেন এটা আমার ঘর। এক চিৎকার কারলে আমার ভাই এসে আপনার অবস্থা করুণ করে দিবে।”
অভ্র তাও তার দিকে ঝুঁকে আসে। সুরভির পিছনের বাগান বিলাশ গাছ থেকে একগুচ্ছ গোলাপি পাতা ছিঁড়ে নেয়। তারপর সুরভির দিকে তাকিয়ে বলে, “কিন্তু আমার তোমার দিকে তাকিয়ে থাকতে দারুণ লাগে।”
“হুঁ?”
অভ্র তার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ায়। তার একগুচ্ছ চুল কানের পিছনে গুঁজে দেয় সে বাগানবিলাসের পাতাগুলোর কানের কাছে গুঁজে দেয়। তার দিকে কেমন একটা দৃষ্টিতে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলে, “আজ তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।”
সুরভি অবাক হয়ে চোখ তুলে তাকায় তার দিকে, “আমি সাজুগুজু করি নি তো।”
“এভাবেই সুন্দর দেখাচ্ছে।”
খুব সাধারণ শব্দগুলো। অথচ সুরভির কাছে প্রশংসাটা খুব ভালো লেগেছে। সে মৃদু হেসে অভ্রর বুকে হাত রেখে তাকে পিছনে সরিয়ে বলে, “কথাটা দূর থেকেও বলতে পারেন।”
অভ্র সুরভির বুকে রাখা হাতটা ধরে নেয়, “প্রশংসার পরিবর্তে ধন্যবাদ দিতে হয়।”
“ধন্যবাদ দেবার জন্য সামনের মানুষটাকে ভালোও লাগতে হয়।”
“ভালো না লাগলে আমাদের সম্পর্কের চিহ্ন এখনো খুলো নি কেন?”
সুরবি তার হাতে পরা আংটিটা দেখে তাকায় অভ্রর দিকে, “আকাশ কুসুম ভাবার প্রয়োজন নেই। এটা টাইট হচ্ছিল তাই খুলতে পারিনি।”
“তাই? তাহলে আমি খুলে দিচ্ছি…” অভ্র তার হাত ধরে রিং খুলিতে যেতেই সুরভি তার হাত পিছিয়ে নেয়।
“আপনার কী আমি রিং পরি বা না পরি? সম্পর্কটা ভাঙলে আপনার আংটি আমি ফেরত দিয়ে দিব ওকে?”
সুরভি বলে বারান্দা থেকে বাহিরে যেতে নেয়, আর অভ্র হাত ধরে ফেলে। সুরভি কপাল কুঁচকে পিছনে তাকায়। অভ্র বলে, “আংটিটা তোমার হাতেই সুন্দর দেখায়।” সে এসে সুরভির সামনে দাঁড়িয়ে আবার বলে, “আমার মনে হয় কি জানো আংটিটা তোমার হাতের জন্যই তৈরি হয়েছে।”
সুরভি তার হাত ছাড়িয়ে নেয়।

এতক্ষণে মা’য়ের কন্ঠ ভেসে আসে, “সুরভি চা তৈরি হয়েছে। জলদি আয়।”
অভ্র তাকে ছেড়েই বাহিরের দিকে হাঁটতে শুরু করে। কিন্তু আবার থেমে পিছনে তাকায়, “কিন্তু তোমাকে শাড়িতে সবচেয়ে বেশি সুন্দর লাগে।”
সুরভি তখন ভেংচি কেটে মুখ ফিরিয়ে নিলেও অভ্র সামনের দিকে মুখ ফিরিয়ে যেতে নিলে মুচকি হাসে। হঠাৎ তার মাথায় আসে এক কথা, সে উচ্চস্বরে জিজ্ঞেস করে, “কিন্তু আপনি আমাকে শাড়িতে কবে দেখলেন? আমি তো আপনার সাথে দেখা হবার পর শাড়িই পরিনি।”
অভ্র দরজা পর্যন্তই গিয়েছিল। সুরভির কথা শুনে পিছনে তাকিয়ে বলে, “ওটা একটা সিক্রেট।” বলে চোখ টিপ মেরে চলে যায়।
.
.
হলুদের আয়োজন করা হয়েছে একই স্থানে। আশরাফ ও জোহান নিচে এসে পরেছিল। জোহান কয়েকজনের সাথে ছবি তুলছিল এবং আশরাফ তার একপাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। ছেলে মেয়েগুলো যাবার পর আশরাফ বলে, “ব্রো তোমার বিরক্ত লাগে না, ওরাই কেবল গতকাল থেকে চারবার এসে তোমার সাথে ছবি তুললো। বাকিসবার কথা বাদ-ই দিলাম।”
“মাঝেমধ্যে লাগে বাট মোস্টলি এত ভালোবাসা দেখলে ভালোই লাগে।”
আশরাফ ফোন বের করে সময় দেখে বলে, “এই মেয়েগুলো মনে হয় অনুষ্ঠান শেষে আসবে। বউ এসে পড়েছে ওদের খবর নেয়।”
এমন সময় ফোন আসে আশরাফের। তন্নির ফোন। সে কল ধরে কথা বলে জোহানকে জানায়, “ম্যাডামরা বের হচ্ছে। আমাদের যেয়ে তাদের রিসিভ করতে হবে।”
তারা দুইজন তাদের হোটেলের সামনে দাঁড়ায়। তন্নি প্রথমে বের হয় দরজা দিয়ে। আশরাফ জিজ্ঞেস করে, “আমাদের দ্বিতীয় ম্যাডাম কোথায়?”
“রুম লক করে আসছে।”
জোহান তার ফোনে মেসেজ দেখছিল তখন তন্নি ও আশরাফের কথা শুনে।
তন্নি জানায়, “আজ একবারে অন্যলুক দিয়েছি। পুরাই বোম্ব ডট কম লাগছে ওকে।”
“এই’যে ম্যাডাম এসেও পড়েছে। বাহ মায়া তোকে তো আজ অনেক সুন্দর লাগছে।” আশরাফ প্রশংসা করে তার।
জোহান তাদের কথা শুনে মুখ তুলে সামনে তাকায়। মায়াকে আসতে দেখে। সত্যিই আজ মায়াকে অন্যরকম দেখাচ্ছে। নীল আনারকলিতে রুপালী কারচুপির কাজ। কানে রুপালি কানেরদুল। আর একপাশে চুলগুলো বেণী করা, বেণির উপর বেলিফুল মোড়ানো। চোখে কাজল ভরা, হাল্কা মেকাপ করা আর কপালে ছোট একটি লাল টিপ। তার হেঁটে আসার সময় শব্দ হচ্ছিল, ছনছন ছনছন….

মায়া এসে তাদের সামনে দাঁড়ায়। আশরাফকে জিজ্ঞেস করে, ” কী বলছিস?”
“আপনার প্রশংসা করছি ম্যাডাম।”
“প্রশংসা পরে করিস এই ব্যাগ ধর।” সে আশরাফের হাতে ব্যাগ ধরিয়ে দেয়। সাথে তন্নিও দেয়। আশরাফ বলে, “আমাকে তো এজন্যই রাখছিস তোরা। তোদের ব্যাগ ধরার জন্য। একটা কথা বল এই তো ইন্দুরের লেজের মতো চুল এত বড় হলো কীভাবে?”
“তোর গার্লফ্রেন্ডকে জিজ্ঞেস কর। একতো এত ভারী জামা পরায় দিসে এর উপর চুলেও কী কী যে লাগালো।”
মায়া জোহানের দিকে তাকিয়ে দেখে সে মোবাইল টিপছে। সে বলে, “কাকতালীয় ব্যাপার, তুমিও নীল কুর্তা পরেছ।”
জোহান তার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ায়। তেমন কিছু বলে না। আশরাফকে বলে, “আমাদের অনুষ্ঠানের দিকে যাওয়া উচিত।”
তারপর নিজেই হাঁটতে শুরু করে।
মায়া বলে, “ওর আবার কী হলো?”
তারা সবাই জোহানের পিছনে যায়। বর ও বধূ দুইজনকে হলুদ লাগাচ্ছে। মায়া বলে, “আজ রাতই যা করার করতে হবে। সকালে জাল তো বিছিয়ে ছিলাম এখন জালে মাছ ফাঁসলেই হয়।”
“আমি খোঁজ নিয়েছি, এই ছেলে না’কি কয়েকটা মেয়েকে জ্বালিয়েছে কলেজের দিনে।”
“একবার জালে ফাঁসুক, সবার পক্ষ থেকে হিসাব ক্লিয়ার করে দিব।”
আশরাফ পিছনে তাকিয়ে বলে, “গাইজ লম্বা লাইন হলুদ লাগানোর জন্য। ওদিকে বনফায়ারের আশেপাশে কাপল ডান্স হচ্ছে, আয় ওদিকে যায়।”
আবার ঘুরে অন্যদিকে যায় তারা। আসলেই অনেক সুন্দর দৃশ্য। মাঝখানে আগুন জ্বলছে, হাল্কা মিউজিক চলছে আর চারপাশে কাপলরা ডান্স করছে। এর মধ্যে দিয়া ও ওয়াহিদকেও দেখতে পায় তারা। তাদের দেখে তন্নির মেজাজ খারাপ হয়। সে মায়াকে বলে, “এখানে থাকা লাগবে না চল।”
“কেন?”
“ওয়াহিদ আর দিয়াও এখানে আছে।”
“তো কি হয়েছে? আমার এখন আর এসব থেকে কিছু আসেযায় না। সারাজীবন কি এই রাগ নিয়ে বাঁচবো না-কি? তুই ও আশরাফ যেয়ে ডান্স কর।”
“কিন্তু… ”
“কোনো কিন্তু না। আমি ওকে আছে। তোরা না গেলে আমি কষ্ট পাব।”
তন্নি ও আশরাফ এসে অপরের দিকে তাকায়। তারা ভাবে কি করবে।
মায়া এবার জোর করে পাঠায় তাদের। আর নিজে দাঁড়িয়ে তাদের সকলের নাচ দেখে। তন্নি ও আশরাফকে দেখেও তার ঠোঁটে হাসি এঁকে আসে।

হঠাৎ তার সামনে জোহান এসে দাঁড়ায়। সে হাত বাড়িয়ে বলে, “উইড ইউ লাইক টু ডান্স?”
“আমি? আমি তেমন ভালো ডান্স পারি না।”
“আমি শিখিয়ে দিব।” সে মায়ার হাত ধরে তাকে নিয়ে বনফায়ারের কাছে যায়। জোহান সবার পূর্বে মায়ার হাতটা নিজের কাঁধে রেখে তার কোমড়ে হাত রাখে এবং অন্যহাত ধরে নেয়। তাকে কাছে টানতেই মায়া তার দিকে তাকিয়ে। চোখে চোখ মিলে। এক মুহূর্তের নয়নবন্ধন থাকে তাদের। চোখ সরিয়ে নেয় মায়া।
জোহান জিজ্ঞেস করে, “তুমি এখন আর আমার চোখের দিকে তাকাও না কেন?”
মায়া নীল কাজলমাখা চোখ নিয়ে তার দিকে তাকায়, “মানে?”
“মানে আমার চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারো না, কেন?”
“তুমি কী চাও তোমার চোখের দিকে সারাক্ষণ তাকিয়ে থাকি আমি?”
“সেটা বলিনি। এমনিতেই খেয়াল করেছি তাই বললাম।”
“ওহ।”
“আজ অন্যরকম দেখাচ্ছে তোমাকে।”
“প্রতিদিন থেকে আলাদা জামা পরেছি, আলাদা তো লাগবেই।”
“অন্যরকম সুন্দর লাগছে।”
মায়া আবারও তার দিকের থেকে চোখ সরিয়ে নেয়।
জোহান বলে, “তোমার চুল আবার বড় করা উচিত। অনেক সুন্দর দেখায়।”
“চিন্তা করে দেখব।”
“তোমাকে এমন পোশাকে বেশি সুন্দর দেখা জানোতো।”
“জানি।”
“তোমাকে আজ বেশিই সুন্দর দেখাচ্ছে।”
“এই ডায়লগ কতগুলো মেয়েকে মেরেছ?”
“এই শতখানিক।”
মায়ার মন আর মেজাজ দুটোই খারাপ হয়ে যায়। সে বিরক্তির স্বরে বলে, “এত কম কেন?”
“আই মিন মেয়েদের প্রশংসা পছন্দ তাই না?”
“মানে যে মেয়ে পাও তারই প্রশংসা করে বসো তাইতো?” মায়া মেজাজ খারাপ করে নাচ ছেড়ে সেখান থেকে যেতে থাকে। জোহান তার পিছনে আসে,
“তোমার আবার কী হলো?”
“মুড নষ্ট হয়ে গেছে।”
“কেন?”
“আমার মুড, আমার ইচ্ছা। তুমি আমার পিছু আসছো কেন?”
জোহান মায়ার হাত ধরে নেয়, “হঠাৎ কী সমস্যা হলো তোমার?”
মায়া জোহানের দিকে তাকিয়ে বিরক্তির সুরে বলে, “এমনি আমার ভালো লাগছে না। আমি একা থাকতে চাই।”
সে যেতে নিলে জোহান তার হাত ধরে নিজের দিকে টানে তাকে, “আমি তোমাকে একা থাকতে দিব না।”
আবারও চোখে চোখ পড়ে তাদের। হৃদস্পন্দন বাড়ে, শীতল হাওয়া চলে, বাতাসে প্রেম বহে। সে চোখ নামিয়ে নেয়।
এই মুহূর্তটা মায়ার যেমন সুন্দর লাগছে, তেমনই বিরক্তির লাগছে। সত্যিই তো জোহানের চোখে চোখ মিললেই তার বুকের ভেতর এমন উথাল-পাথাল হয় কেন?

চলবে…

অনুভূতির খাঁচা
পর্ব-২৪
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

মৃদু আলোর বনফায়ার একটি প্রেমের সাগর তৈরি করেছিল। আর সকল প্রেমিকরা সে সাগরে ডুব দিয়েছিল। ওয়াহিদ এবং দিয়াও ছিলো সে প্রেমিকদের মধ্যে একজন। অন্তত ততক্ষণ, যতক্ষণ পর্যন্ত ওয়াহিদ জোহান এবং মায়াকে একসাথে দেখেছে। সে রাগান্বিত স্বরে বলে, “এই জোহানকে আমি মায়া থেকে দূরে থাকতে বলেছিলাম। দাঁড়াও, আমি আসছি।”
ওয়াহিদ যেতে নিলে দিয়া আটকায় তাকে, “কোথায় যাচ্ছো তুমি? ওদের ব্যাপার ওদের দেখতে দেও। ওদের মাঝে পড়ো না। তারপর সবাই তোমাকেই শোনাবে।”
“ও আমার বেস্টফ্রেন্ড দিয়া…”
“হোক। এই মুহূর্তে যদি তোমার কাওকে নিয়ে ভাবতে হয় আমাকে নিয়ে ভাবো।”
ওয়াহিদ কথা বাড়ায় না। তার সাথেই থাকে কিন্তু যখন মায়াকে এভাবে যেতে দেখে তখন দিয়াকে ছেড়ে বলে, “তুমি একটু থাকো আমি আসছি।”
দিয়া এতে অনেক অপমানিতবোধ করে। সে ওয়াহিদকে সরাসরি জিজ্ঞেস করে, “তোমার যদি ওরই এত চিন্তা থাকে তাহলে অকারণে এত সম্পর্ক নষ্ট করার প্রয়োজন কী ছিলো? ওকেই বেছে নিতে।” বলে সে নিজেই যেতে নেয়। ওয়াহিদ তাকে আটকায়, “তুমি রাগ করছো কেন? তুমি জানো মায়া আমার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। ও আমার ছোটবেলার বেস্টফ্রেন্ড। আমার পরিবারের মতো।”
“আর আমি কে?”
“তুমি আমার ভালোবাসা।”
“তাহলে তুমি এখন এমন বিহেভ করছো কেন? তোমার যেকোনো একজনকে বাছাই করতে হতো, তুমি আমাকে বাছাই করেছ। তাহলে এখন সব আরও জটিল কেন করছ? আমি তো তোমাকে তখনই বলেছিলাম আমাদের অনুভূতি ততটুকু পর্যন্তই থাক। কিন্তু তুমি বলেছিলে তুমি কেবল আমাকেই ভালোবাসো, এনগেজমেন্টটা হলেও তিনজনের কেউ সুখী হতে পাড়বো না। আমি তোমার কথা মেনে নিয়েছি। পরিণাম কী? মায়া খুশি না, তুমি কনফিউজড কোনদিকে যাবে, আর আমি? সবাই ভাবে আমি কারো সম্পর্ক ভেঙে দিয়েছি, তোমার টাকা দেখে তোমাকে বিয়ে করছি, তোমার পরিবারের কথা শুনছি, আমার অপমান সহ্য করছি, আমার পরিবারের অপমান সহ্য করছি। অবশেষে তো দেখা যাচ্ছে এখনো কেউ খুশি না। এর থেকে ভালো আমরা তখনই আলাদা হয়ে যেতাম।”
“দিয়া আমার…”
“প্লিজ আপাতত একা থাকতে দেও আমাকে। আমি এখন তোমার কোনো কথা শুনতে চাই না।”
সে চলে যায় সেখান থেকে। ওয়াহিদ বুঝে উঠতে পারে না কি করবে সে। এমন সময় তন্নি আসে আগুনে ঘি ঢালার জন্য। সে একগাল হাসি নিয়ে বলে, ” কারও ব্যক্তিগত কথা শুনা উচিত না কিন্তু তোদের কথা শুনে না হেসে পাড়লাম না। কী পার্ফেক্ট রিলেশনসিপ তোদের! আসলে কাওকে কষ্ট দিয়ে নিজেও সুখে থাকা যায় না জানিস তো?”
“আমি কাওকে ইচ্ছা করে কষ্ট দেই নি। আমি যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলাম, অন্য কেউ না জানলেই তুই জানিস। কিন্তু আমি মায়ার জন্য রোমেন্টিক ওয়েতে কিছু ফিল করতে পাড়ছিলাম না। যাকে সারাজীবন বন্ধু, নিজের বোনের মতো ভেবে এসেছি তাকে ভালোবাসি কীভাবে আমি? আর দিয়াকে ভালোবাসা বন্ধ করতে পারছিলাম না। আমার অনুভূতি আমি নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে মায়াকে কষ্ট দিতাম না ”
“তুই নিজের এসব কথা নিজের কাছেই রাখ। কারও গুরুত্ব কাজ দিয়ে দেখাতে হয়, কথা দিয়ে না। তোর জন্য মায়া অনেক কষ্ট পেয়েছে। এখন একটু খুশি পেয়েছে তা ওকে উপভোগ করতে দে। তুই ওর আশেপাশেও ঘুরবি না।”
“খুশি বলতে জোহানকে বুঝাচ্ছিস? তুই কী জোহানের সাথে এখন মায়ার সম্পর্ক করানোর চিন্তা করছিস?”
“তোর এতকিছু জানার দরকার নেই।”
“তুই জানিস তো ওর কতগুলো মেয়ের সাথে সম্পর্কের খবর বের হয়েছে।”
“খবর মিথ্যাও হয়। আমি এই কয়দিনে ওকে চিনেছি, আর আমি ভালো করে জানি মায়ার জন্য কি বেস্ট।”
“যতটুকু নিউজ থেকে আমি জেনেছি জোহানের কাছে এসব সম্পর্ক কেবল খেলা। মায়া ওর প্রতি সিরিয়াস হলে কষ্ট পাবেন কেবল।”
“ওর কষ্টের কথা চিন্তা করা তুই ছেড়ে দে, আমি আছি তার জন্য। তুই যা তোর প্রেমিকার কাছে। আর দয়া করে মায়ার জীবনে দখল দেবার চেষ্টা করিস না।”
ওয়াহিদ গভীর নিশ্বাস ফেলে বলে, “ওকে ফাইন। আর আমি কারও লাইফেই দখল দিব না কিন্তু একটা জিনিস মনে রাখবি তুই আবারও ভুল করছিস। মায়া আবারও কষ্ট পাবে আমার কথা লিখে রাখিস।”
“ওর চিন্তা করার জন্য আমরা আছি। তুই কেবল আমাদের জীবন থেকে দূরে থাক তাহলেই হবে।”

মায়া জোহানের হাত ছাড়িয়ে বলে, “আচ্ছা তাহলে তুমি কী চাও?”
“যে তুমি আমার সাথে ডান্স কমপ্লিট করো।”
“আর যদি বলি তোমার সাথে ডান্স করার মুড আমার নেই।”
“তাহলে বলবো তোমার মুড অনেক দ্রুত চেঞ্জ হয়। এতক্ষণ তো খুব ভালোই হঠাৎ কি হলো বুঝতে পারছি না।”
“তোমার এত ডান্স করতে ইচ্ছা করলে অন্য কাওকে খুঁজে নেও। তোমার কতগুলো ফ্যান আছে এখানে। ওরা তো খুশিতে আত্নহারা হয়ে যাবে।”
“কিন্তু আমার তো তোমার সাথে ডান্স করার ইচ্ছা ছিলো।”
জোহান কিউট ফেইস বানিয়ে বলে। এতে মায়ার মন একটু গললেও সে জোহানকে পাত্তা দেয় না। সে অন্যদিকে তাকাতেই তার নজর পড়ে তন্নি আর ওয়াহিদের দিকে। সে অবাক হয়ে বলে,
“এটা আজব। তন্নি তো ওয়াহিদের নাম শুনেই রেগে যায়। আজ ওরা কী কথা বলছে?”
ওয়াহিদ যেতেই সে তন্নির কাছে যায়। আবারও জোহান যায় তার পিছনে। সে আফসোসের সুরে বলে, “কী দিন এসে পড়লো এত বড় স্টার একটা মেয়ের পিছু ঘুরছে একটু ডান্সের জন্য।”
“কে তোমাকে পিছু ঘুরতে বলেছে? মেয়ের ঘাটতি আছে না’কি? যেকারো সাথে যেয়ে নাচলেই তো হয়।” সে আবার তন্নির দিকে তাকিয়ে বলে, “তুই ওয়াহিদের সাথে কথা বলছিলি?”
“হ্যাঁ। বিশেষ কিছু না যাস্ট আমাদের লাইফে বেশি ঘাটাঘাটি করতে মানা করলাম।”
“আবার কী করল?”
“বাদ দে, তেমন কিছু না।”

মেহেদীও তাদের খুঁজতে খুঁজতে এসে পড়ে,
“তোরা এখানে নাচছিস আর ওখানে আমার বোনের জীবন নাটক হয়ে গেছে।” সে মায়াকে আবার বলে, “তুই যদি কিছু না করিস তাহলে আমি করছি।”
“হ্যাঁ করার পর আংকেলের মাইর খাওয়ার জন্যও তৈরি থাকিস। কিছু তো হবেই না হুদাই ফ্রী তে মাইর খাবি। আংকেলের এত ভালো বন্ধুর ছেলে। কোনো প্রমাণ ছাড়া গেলে তোর কথা বিশ্বাস করবে না তাদের?”
“তো এখন প্রমাণ কই খুঁজে পাব?”
“ভাই তুই চুপচাপ দাঁড়ায় থাক তো। ওই পোলা নিজে যতক্ষণ না আসে ততক্ষণ শান্ত থাক।”
“আমার তো মনে হয় তোর প্লানই ফালতু।”
“তুই ফালতু, তোর ব্রেন ফালতু, আমার প্লান না।”
তন্নি তাদের বাচ্চামোতে বিরক্ত হয়ে বলে,
“তোরা চুপ করবি? তোরা ঝগড়া করলেই কি সব ঠিক হয়ে যাবে? মেহেদী তুই আমাদের স্টেজের উঠার ব্যবস্থা করে দে, বাকিটা আমরা দেখছি।”
“তা বললেই তো হয়। জোহানকে স্টেজে উঠতে দেখলে মালা নিজেই সবাইকে ভাগিয়ে দিবে।”
“তো অপেক্ষা কীসের? চলেন সুপারস্টার।” মায়া জোহানকে বলে।
জোহানও সুযোগ ছাড়ে না, “তাহলে আমার সাথে ডান্স করতে হবে।”
“আসা লাগবে না।” বলে সে তার বন্ধুদের নিয়ে হাঁটতে শুরু করলে জোহানও তার পিছনে আসে।

আসলেই জোহানকে স্টেজের কাছে দেখে মালা নিজেই সবাইকে সরিয়ে দেয় তার বান্ধবীদের দিয়ে। স্টেজের সবাইকেও নামিয়ে দিয়ে জোহানকে উঠতে বলে।
জোহানের সাথে অবশ্য তাদের সকলে বন্ধুবান্ধবও উঠে। একে এক সবাই দুইজনকে হলুদ দেবার পর মায়া হলুদ দিয়ে আসে। মায়া তাকে বলে, “থ্যাঙ্কিউ সো মাচ আপু, আপনি জোহানকে নিয়ে এসেছেন। আপনার জন্য আমার স্পেশাল দিন আরও স্পেশাল হয়ে গেল।”
মায়া জোরপূর্বক হাসে। কোনো উওর দেয় না। মালার এত প্রশান্তির হাসিটা কিছু সময়েই মলিন হয়ে যাবে ভেবেই তার কষ্ট হচ্ছে। সে তো বুঝে এই কষ্টটা। সে এটাও জানে আজকে যদিও আদিল নামের ছেলেটা ভুল প্রমাণিত হবে, তবুও সবাই মালাকে খোঁটা শুনাবে। যদিও এখানে সে-ই প্রতারিত হয়েছে। তবুও সারাজীবনের দু:খ থেকে এই সামান্য কষ্টই ভালো।

মালাকে মিষ্টি খাইয়ে তার পাশের আদিলকে হলুদ দেবার সময় আদিলকে চিন্তিত দেখা যায়। সে তা খেয়াল করে ভালো করেই। জিজ্ঞেস করে, “কী ব্যাপার আজ তোমাকে খুশি মনে হচ্ছে না। চিন্তিত দেখাচ্ছে। পালিয়ে যাবার চিন্তা করছ না’কি?”
আদিলের কপালের ভাঁজ গাঢ় হলে মায়া বলে, “আরে আমি তো মজা করছি। সিরিয়াস হবার কিছু নেই।”
তারা সকলে ছবি তোলার জন্য একলাইনে দাঁড়ায়।
তন্নি ইচ্ছা করেই মায়া ও জোহানকে পাশাপাশি দাঁড় করায়। ছবি তোলার আগ মুহূর্তে জোহানের মাথায় দুষ্টুমি ঘুরে। সে তার হাতে থাকা হলুদ মায়ার নাকের ডগায় লাগিয়ে দেয়। মায়া অবাক হয়ে তাকায় তার দিকে। আর তখনই ছবি তোলা হয়।

মায়া মেজাজ খারাপ করে টেবিল থেকে টিস্যু নিয়ে স্টেজের নিচে নেমে যায়। জোহান যেতে নিলে তন্নি তাকে থামায়। সে বলে, “আদিল উঠে যাচ্ছে ওর পিছনে। এখন যেও না।”

আদিল মায়াকে ডাক দেয় পিছন থেকে, “মিস মায়া…”
মায়া পিছনে তাকায়। আদিল বলে, “আপনি আজ সকালে বলছিলেন আপনি আমার মতোই কাওকে খুঁজছিলেন। কথাটা সত্যি?”
মায়া হেসে হাত আড়া-আড়ি ভাঁজ করে বলে, “আপনার সাথে মশকরা করে আমার কি লাভ হবে তা আমি খুঁজে পাচ্ছি না। আর আমি নিজের লাভ ছাড়া কিছু করি না।”
“আসলেই আপনার আর আমার অনেক মিল। হয়েছে কি আমি আপনাকে বলতে চাচ্ছিলাম যে…যে…”
“আপনি দ্বিধাবোধ করছেন কেন? আমার এমন মানুষ একটুও পছন্দ না যারা কথা বলতেই ভয় পায়। আমি ভীতু মানুষদের চরম পর্যায়ে অপছন্দ করি।”
কথাটা শুনেই আদিল ফটাফট বলে ফেলে, “আমার মনে হয় আমি বিয়েটা করে ভুল করছি।”
মায়া হাসে, “আপনার জীবন আপনি ভুল করতেই পারেন। এখানে আমি কি করতে পারি?”
“আপনিই যা করার করতে পারেন।” সে এগিয়ে এসে মায়ার হাত ধরে বলে, “আপনাকে দেখেই আমার বুঝ এসেছে। আমি কত বড় ভুল করতে যাচ্ছিলাম। আপনার প্রেমে আমি প্রথম নজরেই পড়ে গেছি। কিন্তু আজ আপনার কথাগুলো শোনার পর বুঝ হলো আমি কত বড় ভুল করতে যাচ্ছিলাম। আমার কখনোই মালার মতো মেয়ে পছন্দ ছিলো না। আপনি আমার টাইপ। যেমন আমি চেয়েছি একদম তেমন। প্রিটি, কনফিডেন্ট, ইন্টেলিজেন্ট, আর আমার মতো বিজনেসের ভাষা বুঝেন। আই থিংক আমি আগামীকাল বিয়েটা করলে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করব।”
“তাহলে আপনি কী চান?”
“আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই।”
“ওহ কিন্তু আমি আপনাকে বিয়ার কেন করব? আপনি আমাকে কী দিতে পারবেন? আপনাকে বিয়ে করে আমার কী লাভ?”
“আমি আপনাকে ভালোবাসবো, সারা জীবন খেয়াল রাখব….”
মায়া তাকে সেখানে থামিয়ে বলে, “আমি এগুলো শুনতে চাইনি। আমার খেয়াল আমি নিজেই রাখতে পারি। আপনাকে বিয়ে করলে আমার কি লাভ? তা জিজ্ঞেস করেছি।”
“ওহ, এজন্যই আপনাকে পছন্দ হয় আমার। আমি আপনার ভালো লাইফ পার্টনারের সাথে অত্যন্ত ভালো বিজনেস পার্টনার হতে পারব। আমিও নিজের লাভ ছাড়া কিছু করি না। এই বিয়েটাও আমাদের বিজনেস বড় করার জন্য করছি।”
“এখন ঠিক আছে।”
“কালই তো বিয়ে, আজই সময় আছে আমরা পালিয়ে যেতে পারি।”
“পালিয়ে যাব? আমি? মায়া চৌধুরী?” মায়া তার কথায় হাসে, “মায়া চৌধুরী এত ভীতু না যে পালিয়ে বেড়াবে। আপনাকে ভালো লেগেছিল কিছু মুহূর্তের জন্য কিন্তু এখন… চিন্তা হচ্ছে আরকি। আমি এমন ভিতু মানুষকে বিয়ে করতে পাড়ব না যে আমাকে সবার সামনে আপন করতে পাড়বে না। সো…সরি।”
মায়া হাঁটা শুরু করে।
“না ওয়েট…মায়া…”

এমন সময় এনাউন্সমেন্ট হয়, হলুদের কার্যক্রম শেষে এখন সবার নাচের আয়োজন হবে। মায়া তার বন্ধুদের কাছে যায়। মেহেদী ইশারায় মায়াকে জিজ্ঞেস করে, “কাজ হয়েছে?”
মায়াও ইশারা দেয়, “হয়েছে।”
মালা ও আদিলের সব কাজিন ও বন্ধুবান্ধবদের নাচ হলো। মেহেদীসহ তার বন্ধুদেরও ছিলো কিন্তু শেষ মুহূর্তে তারা পিছিয়ে গেল। তার বোনের সাথে এমন একটা মানুষের বিয়ে হচ্ছে জেনে মেহেদী কীভাবে নাচে অংশগ্রহণ করতে পারে?
সর্বশেষে বিশেষ পারফরম্যান্স ছিলো জোহানের। এর আগে মালা ও আদিলের নাচ হবে। একবার এনাউন্সমেন্টের পরই মালা স্টেজে উঠলেও আদিল উঠে না। তাকে তিনবার ডাকা হয়। সে না উঠলে মালা নিজেই তাকে নিতে নিচে নামে। তার সামনে যেয়ে দাঁড়িয়ে বলে, “কী হলো তুমি আসছো না কেন? আসো আমাদের পারফরম্যান্স আছে তো।”
মালা তার হাত ধরে নিয়ে যেতে নেয় স্টেজে। কিন্তু আদিল তার হাত সরিয়ে বলে উঠে, “আমি এই বিয়ে করতে পাড়ব না।”
কথায় সব বন্ধুরা তাকায় মায়ার দিকে। কাজ হয়ে গেছে। মাছ জালে ফেঁসে গেছে।
মায়াও প্রশান্তির গভীর নিশ্বাস ফেলে, সে নিজেও ভয়ে ছিলো পরিকল্পনাটা কাজ করবে না’কি!

মহলটা থমথমে হয়ে যায়। এমন খুশির মহলে এই কান্ডটা ঘটবে কেউ ভাবেও নি। আদিলের বাবা ভড়কে যায়, “তুই পাগল হয়ে গেছিস? কি বলছিস তুই?”
“ঠিক বলছি। আমি এই বিয়ে করতে পারবো না।”
“গতকাল পর্যন্ত সব ঠিক ছিল। আজ কি হলো?””
“আমি এই অনুষ্ঠানে এমন একজনকে পেয়েছি যে আমার যোগ্য। আমি তাকেই বিয়ে করবো?”
মালা তার হাত ধরে কান্না করতে করতে বলে, “তুমি এমন মজা করছ কেন? প্লিজ এমন মজা করো না। আমার কষ্ট হচ্ছে।”
আদিল বিরক্ত হয়ে তাকে ধাক্কা দেয়। মায়ার মা শেষ মুহূর্তে এসে তাকে ধরে।
মালার বাবা রাগান্বিত স্বরে বলে, “তুমি কি ফাজলামো করছো? এটা কী ফাজলামো মনে হয় তোমার? এতদিন সব ঠিক ছিলো। বিয়ের আগের রাতে কী হলো?”
“কারণ এখন আমি আমার যোগ্য কাওকে পেয়েছি।”
সে দ্রুত যেয়ে মায়ার হাত ধরে তাকে সবার সামনে নিয়ে আসে, “আমি মায়াকে পছন্দ করে ফেলেছি। আর ওকেই বিয়ে করব।”
আদিলের বাবা তাকে আবার বকতে গেলে ওর মা বাবাকে থামায়। সে মৃদুস্বরে বলে, “কী করছ? আমাদের ছেলে স্বর্ণের মাছ ফাঁসিয়েছে। ওর নাম শুনো নি খবরে? ও মায়া চৌধুরী… ”
আদিলের বাবা তাকে ভালো করে দেখে চিনতে পায়। চুপ হয়ে যায়।

মালার মা বলে, “আমি আগে থেকেই জানতাম এই মেয়ের চরিত্র ভালো না, নাহলে দুইবার বিয়ে ভাঙে কারো? নিজের বিয়ে টিকাতে না পেরে এখন আমার মেয়ের বিয়েটা ভেঙে দিলো। মেহেদী তোকে কতবার বলেছি এই মেয়ের সাথে বন্ধুত্ব রাখতে না।” সে আবার আদিলের বাবা মা’য়ের দিকে তাকিয়ে বলে, ” বেয়াইন সাহেবা আপনি নিজের ছেলেকে কিছু বলছেন না কেন?”
আদিল উওর দেয়, “তারা কী বলবে? মায়ার সামনে আপনের মেয়ের কোনো যোগ্যতা আছে? মায়া আপনার মেয়ের থেকে কতগুণ বেশি সুন্দর, কনফিডেন্ট, যোগ্য। এত বড় একটা কোম্পানি চালায়। এত জায়গায় ইনভেস্ট করেছে। আর আপনার মেয়ে কান্না ছাড়া কিছু পারে? ওকে তো কেবল আপনাদের কোম্পানি পাওয়ার জন্য বিয়ে করছিলাম। এখন তার প্রয়োজন নেই। মায়ার সাথে এর থেকে বড় কোম্পানি বানাতে পাড়ব আমি। চলো তো মায়া এখানে এদের কান্না দেখে আমার বিরক্ত লাগছে।”
সে মায়াকে নিতে চায়, কিন্তু মায়া নড়ে না। সে পিছনে তাকিয়ে বলে, “আসো…”
মায়া তার হাত উঠিয়ে মিষ্টি গলায় জিজ্ঞেস করে, “তুমি বলেছিলে না আমার হাত অনেক নরম?”
“হ্যাঁ, কেন?”
মায়া প্রথমে একগাল হাসে। আর এতটা কষিয়ে থাপ্পড় মারে সে আদিল যেয়ে পড়ে মাটিতে।
আদিল উঠে রাগান্বিত স্বরে বলে, “হোয়াট দ্যা হেল?”
সে ফেরত মায়াকে মারতে নিলে জোহান তার দিকে যেতে নেয়, তাকে বাঁচাতে কিন্তু তন্নি তাকে থামায়। আর বলে, “তোমার কিছু করা লাগবে না, শুধু দেখে যাও।”

আদিল মায়ার উপর হাত তুলতে নিলে মায়া তার নাকে এক ঘুষি মেরে রক্ত বের করে দেয়। এরপর একেরপর এক দুইটা লাথি মারে তার পেটে, তারপর তার পা’য়ের এরপর হাঁটুতে। সে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে মাটিতে। সে হামলাটা সামলে উঠবার আগেই মায়া তার চুলের মুঠি ধরে বলে, “তোর মনে হয় আমি তোর মতো জানোয়ারকে বিয়ে করতে চাইব? আমি গতকালই আমি বুঝে গিয়েছি তুই কেমন মানুষ। কিন্তু আমি এটাও জানতাম আমি নিজে এসে এইকথা বললে কেউ বিশ্বাস করতো না। তাই এই প্লান করেছি।”
আদিলের বাবা মা দৌড়ে আসে তার ছেলের কাছে। তাকে ছাড়ানোর জন্য।
মেহেদী বলে, “মায়া যখন আমাকে গতকাল ঘটনাটা বলেছিল তখনই আমার ইচ্ছা করছিল ওকে এসে মাটির নিচে পুঁতে দেই। কিন্তু ওই মায়ার কথা, কেউ বিশ্বাস করত না। তন্নি খোঁজ নিয়েছে ও ভার্সিটিতেও অনেক মেয়েকে উত্তপ্ত করতো।”
কথাটা শুনে মেহেদীর মা রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকায় মেহেদীর বাবার দিকে, “আপনি আমাদের মেয়ের বিয়ে দেওয়ার আগে একবারও কি ছিল খোঁজ নেন নি?”
“আমার ছোটবেলার বন্ধুকে বিশ্বাস করে নিজের মেয়েকে দিচ্ছিলাম। আমি কি জানতাম সে তার এত জঘন্য ছেলেকে আমাদের মেয়ের সাথে বিয়ে দিবে।”

এতকিছুর পরও আদিলের মা চিল্লায় মায়ার উপর, “বেয়াদব মেয়ে…বেয়াদব মেয়ে আমার ছেলেকে ছাড় নাহলে… ”
সে উঠে এসে মায়াকে মারতে নিলে মায়া বলে দেয়, “দেখেন একদম কাছে আসবেন না। আমি সঠিক বেঠিকে বয়সের পার্থক্য মানি না।” সে ভয়ে পিছিয়েও যায়। এবার অনুরোধে সুরে বলে, “দয়া করে আমার ছেলেকে ছেড়ে দে। ওর নাক দিয়ে রক্ত বের হয়ে গেছে।”
মায়া দয়া করে, কিন্তু দয়ার পূর্বে আদিলকে গালে আরও জোরে দুইটা ঘুষি মারার পর।
তার মা বাবা সামলাচ্ছিল তাকে। মায়া তার বন্ধুদের কাছে এসে বলে, “অনেক হয়েছে, এখন চল। আমার ক্লান্ত লাগছে।”
তন্নি মেহেদীর দিকে তাকায়। মেহেদী তাকে ইশারায় যেতে বলে। সে-ও মালাকে রুমে নিয়ে যায়। জোহানসহ তারা চারজন যাবার সময় জোহান বলে, “আমি জানতাম তুমি ডেঞ্জারাস, কিন্তু এতটা ডেঞ্জারেস ভাবিনি।”
আশরাফ বলে, “আরে কি বলো। বিদেশে গ্রাজুয়েটের সময় মার্সালাট শিখেছিল। সব টাকা পানিতে। আমি ভেবেছিলাম আজ মার্সালাটের স্কিল দেখব।”
তন্নি বিরক্ত হয়ে বলে, “তোর সব কথায় মজা…” আবার মায়াকে জিজ্ঞেস করে, “অতিরিক্ত মেরেছিস না? শেষের দুইটা ঘুষি না মারলেই হতো।”
“তো মারব না? আজ সকালে রঙ মাখার বাহানায় আমাকে খারাপ ভাবে ধরেছে ও। আমার তো তখনই মন চাইছিল ওর মাথা ফাঁটিয়ে দেই।”
জোহান তার কথা শুনে থেমে যায়, “কী হয়েছে? ও তোমাকে খারাপ ভাবে ছুঁয়েছে?”
মায়া পিছনে ফিরে তাকে উত্তর দেবার পূর্বেই সে দেখে জোহান আবার পিছনে ফেরত যাচ্ছে, দ্রুত। যেয়ে আদিলকে তখনও কষ্ট করে দাঁড়াতে দেখে। কিছু না ভেবে সে তার পাঞ্জাবির হাতা উঁচু করে মুঠোবন্ধ করে এত জোরে আদিলকে ঘুষি মারে যে সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তার মুখ থেকে রক্ত বের হয়ে যায়।

মায়া তা দেখে অবাক। সে আবার তাকে তুলে মারা পূর্বেই মায়া দৌড়ে এসে তার হাত ধরে নেয়। রাগান্বিত স্বরে বলে, “তুমি পাগল? তুমি এখানে জড়াতে গেলে কেন? তুমি জানো না এই নিউজ পাব্লিক হতে তোমার ক্যারিয়ারে সমস্যা হতে পারে?”
“আই ডোন্ট কেয়ার।”
“জোহান…না।”
জোহান তার দিকে তাকিয়ে তার হাত ধরে নিয়ে যেতে থাকে। সে যে তন্নি আর আশরাফকেও পিছনে ছেড়ে যাচ্ছে তাও খেয়াল করে না।
.
.
ইনারা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলো। তাকে কেমন উদাসীন দেখা যাচ্ছিল। বাহিরে শীতল হাওয়া বইছিল, চন্দ্রের রশ্মি আজ তীব্র, এত বড় একটা খুশির সংবাদ পেয়েছে সে অথচ তার মনের উদাসীনতা মোটেও দূর হচ্ছে না। হঠাৎ এই শীতল হাওয়ায় এক উষ্ণ ছোঁয়া তাকে জড়িয়ে ধরে। তার কানের কাছে উষ্ণ নিশ্বাস অনুভব করতে পারে সে।

“আজ এতটা খুশির দিন অথচ তুমি উদাস, কেন?” সভ্য জিজ্ঞেস করে।
“আজ আমরা এই খবরটা পেয়ে কতটা খুশি হয়েছি। এই শুক্রবার বাসায় জানালে সবাই আনন্দে আত্নহারা হবে। কিন্তু আমার আজ যতটা খুশি হচ্ছে ততটা বুকে ব্যাথাও হচ্ছে৷ আজ আমার মা, বাবা আর প্রিয় থাকলে তারাও কতটা খুশি হতো তাই না?”
সভ্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার কাঁধে মাথা রেখে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকে, “আমি নিশ্চিত তারা এই খুশি থেকে তোমাকে উদাসী মনে দেখলে আরো বেশি কষ্ট পেতো।”
ইনারা পিছনে ফিরে সভ্যর বুকে লেপ্টে যায়। তারপর শব্দ করে কান্না করতে থাকে। সভ্য তাকে কিছু বলে না। তার মনটা হাল্কা করতে দেয়। অনেক সময় পর ইনারা যখন মুখ তুলে কাঁদোকাঁদো মুখ নিয়ে তার দিকে তাকায়। তখন সভ্য তার গালে আলতো করে চুমু খায়। তারপর তার পেটে হাত রেখে বলে, “কয়মাস পর আমরা ওকে অনুভব করতে পাড়ব তাই না? ছেলে বা মেয়ে যেই হোক, তোমার মতো হলে লাথি ঘুষি তো অবশ্যই মারবে।”
ইনারা কান্নার মধ্যেই তাকে একটা থাপ্পড় মারে, “অসভ্য একটা!”
সভ্য তাকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় নিয়ে যায়। তাকে বুকে ভরে তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে, “তোমার মা, বাবা ও প্রিয় সবসময়ই আমাদের সাথে আছে। আমাদের হৃদয়ে। আচ্ছা শুনো, আমাদের যদি ছেলে হয় তাহলে তার নাম রাখবো ইমতিয়াজ এবং মেয়ে হলে সাইয়ারা…”

চলবে…