অনুভূতির খাঁচা
পর্ব-৩১
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
অফিস শেষে সুরভি বের হয়ে দেখে অভ্রর গাড়ি দাঁড়ানো। তার নতুন অফিসের সামনে। তার মুখ দেখে মনে হয় এটা প্রথমবার না। সে গাড়ির কাছে যেয়ে জানালায় নক করতেই দরজা খোলা হয়। সে দরজা দিয়ে উঁকি মেরে বলে, “এখানে কী? আসতে মানা করেছিলাম না?”
“সকালের নাস্তা তো খাওয়াতে পারি নি তাই ভাবলাম ডিনার করতে পারো আমার বাসায়। আধা ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছিলাম।”
“কাজ ছিলো আজ অনেক বেশি।”
“তুমি চাইলে আমি কথা বলতে পারি।”
“একদম না । আপনার কারণে আগের চাকরিটা ছাড়তে হয়েছে মনে আছে তো?”
“আসো, বসো।”
“আজ….” সুরভি দ্বিধা নিয়ে তার ফোনে সময় দেখে।
অভ্র বলে, “ডিনার বানানো শেষ। বেশি সময় লাগবে না।”
কথাটা শুনে সুরভি উঠে বসে তার গাড়িতে।
অভ্র বাঁকা হেসে বলে, “তবে একটা জিনিস ভালো করেছ। আমার বাসার এতটা কাছে অফিস নিয়েছ।”
“এভাবে বলছেন যেন আপনার জন্যই নিয়েছি।”
“এখন তোমার মনে কি চলে কে জানে?”
সুরভি তার দিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটে। অভ্র হাসে। গাড়ি চালু হয়।
তাদের বাসায় পৌঁছাতে দশ মিনিটও লাগে না। সে বাসায় পা রাখতেই বিরিয়ানির ঘ্রাণ তার নাকে এসে লাগে।
“মনে হচ্ছে আমি না আসলে মিস করে যেতাম। আজ কী আপনার অফফ ডে না’কি?”
“যেদিন কাজ থাকে না ওদিনই আমার অফফ ডে। গত তিনদিন টানা কাজ করায় আজ ছুটি পেলাম।”
“টানা মানে? কেবল দিনে টানা কাজ করেছেন না’কি দিন রাত টানা কাজ করেছেন।”
“দ্বিতীয়টা।” অভ্র রান্নাঘরে যায়। তার পিছু পিছু যায় সুরভিও। বকা দেয় তাকে, “আপনি এই কয়দিন ঘুমানোর সময় পান নি৷ আর আজ সময় থাকা সত্ত্বেও ঘুমান নি। এটা রান্না করা কি বেশি জরুরী ছিলো?”
“আমার খেতে মন চাচ্ছিল আর তোমার ফেভারিট বিরিয়ানি তাহলে কেন নয়?”
“আপনার খেতে মন চাইলে আপনি আমাকে বলতেন। আমি অফফ ডে-তে রান্না করে আনতাম।”
অভ্র খাবার নাড়তে যেয়ে তাকায় সুরভির দিকে, “তুমি আমার জন্য রান্না করে আনতে?”
“বিশেষ করে আপনার জন্য নয়, আমার রান্না করাটা পছন্দ। আমার রান্নার প্রশংসা আমাদের এলাকাজুড়ে আছে।”
“আফসোস আমার কপালেই তোমার হাতের খাবার নেই।” অভ্র তার দিকে ঝুঁকে এসে বলে।
সুরভি পিছিয়ে যেয়ে কাউন্টারের সাথে যেয়ে দাঁড়ায়। সে আসেপাশে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “ফজলু ভাইকে দেখছি না।”
অভ্র সালাদ বানানোর জন্য শসা, পেয়াজ, মরিচ নেয় কাঁটার জন্য। উওর দেয়, “আজ আমার কাজ নেই তাই ওর ছুটি।”
“আপনি জানেন আজ কী হয়েছে?”
“রাণীসাহেবা আপনি বললে আমি জানতে পাড়ব। এখন আমি তো আর আপনার মনের কথা পড়তে পারি না।”
“ওই আপনি একবার একটা ফাইল দেখেছিলেন না? একটা রেইপ কেইসের?”
“মনে আছে। বলতে থাকো।”
“ওই কেইসের তো তিনজন আগে থেকেই শাস্তি পেয়েছে আর গতকাল রাতে একজনের উপর এসিড এট্যাক হয়েছে।”
“সবারই নিজের কর্মের পরিণতি পেতেই হয়।”
“কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এসব কেউ ইচ্ছা করে করছে।”
অভ্র থেমে যায়। সে তাকায় সুরভির দিকে, “আর তোমার তা কেন মনে হচ্ছে?”
“একমাস আগে দুইজনের ড্রাগ এডিক্টের গাড়ি থেকে তার আরেকজনের বন্ধুরই এমন এক্সিডেন্ট হয় যে ছেলেটা এতদিন কোমায় ছিলো। কোমায় থেকে জাগার পরও সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেছে। তার ক্যারিয়ার শেষ। সেলিব্রিটির এক্সিডেন্টের কারণে সারাদেশে ব্যাপারটাকে বেশ গুরুত্ব সহকারে নিয়েছে। বাকি দুইজনের উপর তদন্তর পর তাদের জেলে আটক করা হয়েছে। আর এখন এই ছেলেটা…. তার উপর প্রথম কেইস এসিড এট্যাকেরই হয়েছিল। ছেলের ফ্যামিলির বেশিরভাগ মানুষ আইনের সাথে যুক্ত, অর্থাৎ আইনের দিকে তার শাস্তি হলেও খুব কম হতো। তাই তাকে তার জবাবেই কর্মের ফল দেওয়া হয়েছে। এসব কেবল এক্সিডেন্ট আমার মনে হচ্ছে না।”
অভ্র তার ছুরিটা টেবিলে রেখে তার দিকে এগোয়। তার সামনে যেয়ে দাঁড়িয়ে বলে, “তারা নিজের কর্মের পরিণতিই পাচ্ছে। এতটুকু মাথায় রেখে সব ঝরে ফেলো। তুমি এসব নিয়ে ভেবে রাতের ঘুম হারাম করো না।”
“আপনি কীভাবে জানেন চিন্তা করলে আমার ঘুম আসে না?” সুরভি অবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করে। সাথে আরও যোগ করে, “আপনি কী আমার থেকে কিছু লুকাচ্ছেন?”
“সময় এলে জানতে পাড়বে, হয়তো…” অভ্র ফেরত যেতে নিলে সুরভি তার হাত ধরে জিজ্ঞেস করে, “আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করলে সময়ের বাহানা দেন কেন সবসময়? আপনি এতটা রহস্যময় কেন?”
“তুমি রহস্য ভালোবাসো, তাই না?” অভ্র তার চোখে চোখ রেখে তার ধরা হাতটা তুলে তাদের এনগেজমেন্ট রিং-এ চুমু খেতে নিলে সুরভি হাত সরিয়ে নেয়। চোখ নামিয়ে নেয় সে।
অভ্র বাঁকা হাসে। সে তার হাত সুরভির চুলের কাছে নিয়ে তার চুলের ক্লিপ খুলে দেয়। ঝরে পড়ে সুরভির ঘন কালো কেশগুলো। তার মুখে ছুঁয়ে গেল কিছু চুল, যা আলতো করে সরিয়ে দিলো অভ্র। তার আঙুলের ছোঁয়া পেতেই কেঁপে উঠে সুরভি। সে চোখ তুলতেই অভ্রর চোখে চোখ মিলে। অভ্র তার দিকে ঝুঁকে তার একপাশের কাউন্টারে হাত রেখে ভর দেয়। চোখে চোখ ডুবিয়ে রেখে মাতোয়ারা কন্ঠে বলে, “তোমাকে না বলেছিলাম, তোমায় খোলা চুলে বেশি ভালো লাগে, লক্ষ্মী মেয়ের মতো আমার সামনে এভাবে থাকতে পারো না?”
“এতটা কাছে না আসলেও আপনার কথা শুনতে পারি আমি।” সুরভি তার বুকে হাত রেখে সরাতে নিলে অভ্র তার হাত হাতের উপর হাত রেখে দেয়।
সুরভি জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে।
অভ্র কিছু বলে না, কিন্তু সে উওর পেয়ে যায়।
ধীরে ধীরে সে অনুভব করতে পাড়ে অভ্রর বাড়িতে থাকা স্পন্দনের শব্দ। সে শব্দের গতি অনুভব করার সময় তারও স্পন্দন বাড়ে। দ্রুততম হয়।
কিছু মুহূর্ত কাটে। হঠাৎ অভ্র জিজ্ঞেস করে, “এভাবে তাকিয়ে আছো যে? প্রেমে পড়েছ?”
ঘোর ভাঙে সুরভির। সে অভ্রকে তার বুকে রাখা হাত দিয়েই ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলে, “আমি সালাদ কেটে আনছি। মিষ্টি কিছু খাবেন?”
“তুমি রাজি থাকতে আমার সমস্যা নেই।”
সুরভি তার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকায়, “কী আজেবাজে কথা বলছেন আপনি?”
“কী আজেবাজে বললাম? তুমি জিজ্ঞেস করলে মিষ্টি কিছু খাবেন না’কি? তুমি কষ্ট করে বানাতে রাজি হলে খাব না কেন? এখানে আজেবাজের কী হলো? একমিনিট তুমি কি উল্টাপাল্টা কিছু ভাবছিলে? ছি: সুরভি! কী ডার্টি মাইন্ট তোমার।”
“আমি খারাপ কিছু ভাবছিলাম না। আপনি যান তো এখান থেকে।”
অভ্র তার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, “ওকে আমি তাহলে চেঞ্জ করে আসছি।”
সুরভি মাথা নাড়ায়। অভ্র যাবার সময় স্বাভাবিকভাবে সালাদ কাটলেও সে যাবার পর কান্নামাখা মুখ করে নেয়। নিজেকেই তার মারতে মন চায়। তার সামনে কি বলে ফেলল এসব!
.
.
ইনারা দরজা খুলে দেখে মায়া দাঁড়িয়ে আছে। হাতে ছয়টা ব্যাগ নিয়ে। সে কপাল কুঁচকে অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করে, “এসব কী?”
“একটাতে তোমার জন্য একটু নাটস, ফ্রুটস আর স্টোরলেডি প্রেগ্ন্যাসির টাইমে যা খাওয়া সাজেস্ট করল। আর সবগুলোতে বাচ্চাদের কাপড়-চোপড়।”
“আমি মাত্র তিনমাসের প্রেগন্যান্ট।”
মায়া ভেতরে ঢুকে সব ব্যাগ রেখে বলে, “এজন্যই তো মাত্র বাবুর পাঁচবছর হওয়া পর্যন্ত কাপড় এনেছি। ছেলে মেয়ে দুইজনের।”
“কেন?” ইনারা থতমত খেয়ে বলে।
“কেন মানে? যত যাই হোক আমি ফার্স্ট টাইম আন্টি হতে যাচ্ছি। ওরও মনে হওয়া উচিত ওর আন্টি কত কুল।”
“সত্যিই তুমি আমারই বোন। অতিরিক্ত জ্ঞানী হবার রোগ আছে দুইজনের। আচ্ছা তুমি চেঞ্জ করে নেও। আমি নতুন নাইটস্যুট একটা বাহির করে রেখেছি তোমার জন্য। ফ্রেশ হয়ে নেও সভ্য ডিনার বানিয়ে রেখে গিয়েছে।”
“ডিনার তো করে এসেছি। বের হবার সময় জোহানের সাথে দেখা হয়েছিল তখন…. ”
“জোহানের সাথে?” ইনারা কৌতূহল নিয়ে তাকায় তার দিকে। সোফায় বসে, একটি বালিশ নিয়ে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করে, “ডিনার ডেইটে গেছো না’কি? তোমাদের মাঝে কিছু চলছে না’কি? আমাকে তো বলতেই পারো।”
“ডিনারে আমার আর জোহানের সাথে ওর ফ্রেন্ড ছিলো। স্পেসিফিকভাবে বলতে গেলে ওর এক্স-গার্লফ্রেন্ড।”
কথাটা শুনে ইনারার মুখ লটকে যায়।
তার ফোনে কল আসে। সভ্যর কল। মায়া বলে, “তুমি কথা বলে নেও, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। কোন রুমে যাব?”
ইনারা দেখিয়ে দেয়। তার যাবার পর ইনারা সভ্যর কল ধরে।
“কী করছ তুমি? মায়া কী এসেছে?”
“এলো মাত্র। তুমি জানো তো তোমার ফ্রেন্ড এক নাম্বারের গাঁধা। চরম লেভেলের গাঁধা।”
“কী হলো?”
“জোহান মায়াকে ডিনারে নিয়ে গিয়েছিল। তার এক্স গার্লফ্রেন্ডের সাথে।”
“হতে পারে আমাদের ভুল মনে হচ্ছে। ওরা আসলে একে অপরকে বন্ধু ভাবে।”
“দেখো জান, আমাদের লাভ স্টোরির পরে এতটুকু তো আমার অভিজ্ঞতা হয়েছে যে বুঝতে পাড়বে কেউ কাওকে পছন্দ করে না’কি!”
“জ্বি মহারাণী আপনি তো মহাজ্ঞানী। আপনি তো সবই জানেন। এখন দয়া করে ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করেন আর কোনো জাঙ্কফুড খেয়েন না।”
“তুমি তো যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিলে। তোমার মনে হয় আমি তোমার কথা অমান্য করবো?”
“একশো শতাংশ মনে হয়। আমি নিশ্চিত তুমি অলরেডি নুডলসের প্যাকেট বের করে রেখেছ।”
ইনারা ভেবে পায় না কি বলবে। সে চুলায় পানিও বসিয়ে দিয়েছে পাস্তা রান্না করার জন্য। সে আমতা-আমতা করে বলে, “তুমি যেয়ে পৌঁছে আমাকে জানিও। টাটা… বাই বাই…আই লাভ ইউ। উম্মাহ।” বলে ফোন কেটে দেয়।
গভীর নিশ্বাস ফেলে উঠে গুনগুনিয়ে যায় রান্নাঘরে।
ফ্রেশ হয়ে মায়া এসে ড্রইংরুমে ইনারাকে পায় না। সে ইনারার নাম ডাকে। তার শব্দ আসে রান্নাঘর থেকে। সে রান্নাঘরে যেয়ে দেখে ইনারা চুলার সামনে দাঁড়িয়ে চামচে তুলে গভীরভাবে কিছু দেখছে।
“কী করছ?” জিজ্ঞেস করে মায়া।
“পাস্তা বয়েল হবার জন্য চুলায় দিয়েছি। কতক্ষন হলো হচ্ছেই না।”
মায়া ইনারাকে সরিয়ে এক দেখায় বলে দেয়, “আরও সাত মিনিট লাগবে। সরে দাঁড়াও আমি রান্না করছি।”
“আরে না, লাগবে না।”
“সেদিন সবার কথা শুনে বুঝেছি তুমি রান্নার কিছু জানো না। তাই অকারণে খাবার নষ্ট করার দরকার নেই। আর উল্টাপাল্টা রান্না করে তোমার পেট খারাপ হলে তোমার হাসবেন্ড আমাকে ধরবে। তাই সরে দাঁড়াও ওকে?”
মায়া ইনারাকে এক বাটিতে পেস্তা বাদাম দিয়ে বলে, “এগুলো খেতে থাকো। আমি যা করার করছি।”
মায়া ফ্রিজ থেকে কিছু সবজি বের করে চপিজবোর্ড নেয় কাটতে। সে এতটা দ্রুত কাটছিল যে ইনারা ড্যাবড্যাব করে তার দিকে দেখতে থাকে।
এরপর পাস্তা বয়েল হলে সে নিজে নিজে সস বানিয়ে পাস্তা রান্না করতে থাকে। এত দ্রুত করছিল যে ইনারা কিছু ভালোভাবে খেয়ালই করতে পারছিল না। সে বলে, “তুমি দেখি প্রফেশনাল সেফদের মতো রান্না করছ।”
“আমেরিকায় থাকাকালীন অবস্থায় আমার ফ্লাটের পাশে একজন দাদুর ইটালিয়ান রেস্টুরেন্টে ছিলো। আমি প্রায় খেতে যেতাম। বয়স্ক দুইজন একা থাকতো বলে মাঝখানে তাদের জন্য কিছু নিয়ে যেতাম। উনারাও আদর করতেন অনেক। তারাই শিখিয়েছেন।”
“একটা কথা বলো তুমি কী পারো না? শুনেছিলাম তুমি বিদেশে যেয়ে সবাইকে পিছনে ছেড়ে ওখানের কোন ইউনিভার্সিটিতে প্রথম হয়েছ, সবাই বলে বিজনেসে তোমার ব্রেইন শেয়ালের মতো দ্রুত চলে, জোহানের কথানুযায়ী তোমার গানের গলা মাশাআল্লাহ, আর দেখতে তো তুমি সুবহানাল্লাহ, আর মারামারিতে তো আমার বোন এক্সিলেন্ট হবেই, এখন রান্নাতেও এক্সপার্ট। পারো না কী তুমি?”
মায়া আড়চোখে তাকে দেখে। ইনারার এত কথা শুনে মাথা ব্যাথা ধরে গেছে তার। তার এত কথা শোনার অভ্যাস নেই। সে বলে, “সে দাদুর স্ত্রী ছিলো জাপানিজ। অনেক টেস্টি কেক বানাতে পারে। আমাকেও শিখিয়েছে। তুমি যদি চুপচাপ যেয়ে টিভির রুমে বসো আমি বানাতে পারি।”
“চকোলেট কেক?”
মায়া তাকায় তার দিকে, “যদি বাসায় চকোলেট থাকে।”
“আরে আমার বাসায় আবার চকোলেট থাকবে না? ফ্রিজে কতগুলো আছে। তা দিয়ে না হলে সভ্য থেকে লুকিয়ে রেখেছি কয়েক জায়গায়, ওগুলোও আনতে পারি।”
মায়া হেসে বলে, “লাগলে ডাক দিব। যেয়ে বসো যা-ও।”
ইনারা টুকটুক করে সেখান থেকে চলে যায়। মায়া তাকে দেখে হেসে বলে, “এবার মনে হচ্ছে মিতুর অতিরিক্ত কথা বলার অভ্যাস বংশে একা না। আজমল চাচা থেকে জিজ্ঞেস করতে হবে এরা এত বকবক করার অভ্যাসটা পেয়েছে কার থেকে।”
সে জলদি করে পাস্তা রান্নার পাশাপাশি কেকের ব্যাটার তৈরি করে ওভেনে রেখে দেয়। তারপর পাস্তা নিয়ে যায় ড্রইংরুমে।
ইনারাকে একপ্লেট পাস্তা দিয়ে নিজেও একটু নেয়। তারপর বসে টিভির সামনে। ইনারা ডেরোমোনের একটু মুভি দেখে কান্না করছিল। তা দেখে মায়া বলে, “তোমার নিজের বাচ্চা হবে দুইদিন পর। আর নিজে বাচ্চাদের মতো কার্টুন দেখে কান্না করছো?”
“ডোরেমনের মুভিগুলো আসল মুভি থেকেও বেশি ইমোশনাল হয়। তুমি বুঝবে না। ওদের ফ্রেন্ডশিপের গল্পগুলো বেস্ট।”
“ফ্রেন্ডরা তো হয়-ই বেস্ট। আমার লাইফের কঠিন সময়েও আমার ফ্রেন্ডরাই আমার সাথে ছিলো।”
ইনারা গভীর নিশ্বাস ফেলে জোরকরে হাসার চেষ্টা করে, “এখন আমার কাছে সব আছে। দুইটা পরিবার, আত্নীয়, বন্ধুবান্ধব, এত্তগুলা ফ্যান, ভালো ক্যারিয়ার, আমার স্বপ্ন আর আমার জীবনসাথী যে আমাকে এতটা ভালোবাসে। কিন্তু একসময় ছিলো এর মাঝে কিছুই ছিলো না, কেউ ছিলো। তখন আমার কাছে কেবল ছিলো আমার সে দুইবন্ধু, আমার খালাজান এবং এক ফুফা যে আমাকে আদর করতো। আপন বলতে তারাই ছিলো। সে দুইবন্ধু সারাজীবন স্বার্থহীনভাবে আমার সাথে ছিলো। সুরভি যে সবসময় চেষ্টা করেছে তার যত্নে আমার কখনো আমার মা বাবার কথা মনে না পড়ুক, আর প্রিয় যে সবসময় আমাকে ভাইয়ের মতো রক্ষা করেছে। অথচ আমি তাকে রক্ষা করতে পারিনি। আমার জন্য সে……” কাঁপানো নিশ্বাস ফেলে সে। আবার নিজের পেটে হাত রেখে বলে, “আজ ও থাকলে কতটা খুশি হতো যে ও মামা হবে। ওর মামা ওকে কতটা আদর করতো।”
মায়া তার দিকে তাকিয়ে থাকে। কি বলবে বুঝে না। সে ইনারার গল্পটা শুনেছিল আজমল চাচার কাছ থেকে। সে সব পারে কিন্তু এমন সময় কাওকে কিভাবে সান্ত্বনা দিতে হয় তা জানে না। তবুও কাওকে এভাবে কষ্টেও দেখতে পারে না। সে বলে, “জোহানকেও মামা বানানো যাবে।”
ইনারা তার দিকে তাকায়। হাতের উল্টোপাশ দিয়ে চোখ মুছে বলে, “সেদিন সভ্য আর জোহানের কথা শুনে এমনটা বলছ?”
“দুইজন সেদিন কার্টুন থেকে কম যায় নি। পুরাই কার্টুন লাগছিল।”
ইনারা কথাটা শুনে হেসে দেয়। তার মায়ার দিকে ফিরে বসে বলে, “তো কি চলছে তোমার আর জোহানের মাঝে?”
“কী চলবে?”
“তুমি জোহানকে লাইক করো তাই না?”
“কী! আ…আমি জোহানকে লা…ইক করব? মাথা খারাপ তোমার?” সে চোখ ফিরিয়ে নেয়। অন্যদিকে তাকিয়ে জলদি করে পাস্তা খেতে শুরু করে।
“তো করো না? শিউর তো?”
“একদম।”
“ঠিকাছে।” ইনারা আবারও টিভির দিকে মুখ করে বসে। আবার বলে, “আমি তো ভেবেছি তোমাকে বলব কীভাবে জোহানের ফিলিংস সম্পর্কে জানবে তুমি।”
কথাটা শুনে মায়ার আগ্রহ জাগে, “কী?”
“দরকার কী? তুমি তো ওকে পছন্দই করো না। খাও, ভালো মতো পাস্তা খাও। অনেক টেস্টি রান্না করেছ।”
মায়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে কথাটা নিজের মাথা থেকে বের করতে চায়। কিন্তু পারে না। সে ইনারার দিকে তাকিয়ে গলা পরিষ্কার করে জিজ্ঞেস করে, “কি বলতে চাচ্ছিলে তুমি?”
“আরে বাদ দাও সে ব্যাপারে। তুমি জেনে কী করবে?”
“এমনিতেই জানতে চাচ্ছি। বিশেষ কিছু না।”
ইনারা তার দিকে তাকায়ও না। সে টিভিতে কার্টুন দেখে আর খাবার খায়।
মায়ার সহ্য হচ্ছিল না। তার মন মানছিল না। সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পাড়ছিল না। সে বলে, “তুমি বলবে?”
ইনারা তার হাসি চাপিয়ে রাখার যথেষ্ট চেষ্টা করে। বলে, “কোন শব্দ পাচ্ছ তুমি? আমি ভালোমতো শুনতে পাচ্ছি না।”
মায়া রাগ ওঠে। কিন্তু সে নিজেকে যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ করে, “প্লিজ বলো।”
“এখনো ভালো মতো শুনতে পাচ্ছি না। তুমি কিছু শুনতে পাচ্ছ?”
মায়া নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করে গভীর নিঃশ্বাস ফেলে। শান্ত গলায় বলে, “আমি জানতে চাই জোহানের অনুভূতির ব্যাপারে। প্লিজ বলো, কীভাবে জানব।”
ইনারা মুখের উপর হাত রেখে তার হাসি লুকায়। মায়ার দিকে তাকিয়ে বলে, “জোহান ডায়েরি লেখে। আমরা কেউ তা আগে জানতাম না এই ব্যাপারে কিন্তু আমার বিয়ের আগে ব্যাপারটা বাহিরে আসে। জোহান তার অনুভূতিগুলো প্রকাশ করতে পারে না বা বলতে পারো চায় না। ও নিজেও জীবনে অনেককিছু সহ্য করেছে কিছু ওর বাবার দোষে আর কিছু নিজের দোষেও। মেন্টালি ডিস্টার্ব ছিলো অনেক বছর। কিন্তু কখনো তা কাওকে বলেনি। কেবল নিজের ডায়েরিতে লিখেছে। তবে ও সবাইকে নিয়ে নিজের ডায়েরিতে লেখে না। যদি তোমার নাম ওর ডায়েরির পাতায় থাকে তাহলে তুমি ওর জীবনের পৃষ্ঠার বিশেষ অংশ।”
মায়ার তখন মনে পড়ে রাঙামাটির শেষদিনের কথা। জোহান কীভাবে নিজের ডায়েরিটা তার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়েছিল। সে বলে, “একারণে সেদিন ও নিজের ডায়েরিটা আমার হাত থেকে এভাবে নিয়েছিল।” সে আবার তাকায় ইনারার দিকে, “কিন্তু ওই ডায়েরিটা তো ওর গানের ছিলো। যেটা আগে আমাকে দিয়েছিল গান সিলেক্ট করার জন্য। আর আমাদের কাজের কয়েকজন তা পড়েছে।”
“সেটা তোমার খুঁজতে হবে ও হঠাৎ এমন কেন করল।”
“কিন্তু ডায়েরিটা পাব কোথায়?”
ইনারা তার কাঁধে হাত রেখে বে, “কেন তুমি তো ওকে পছন্দই করো না তাহলে ডায়েরির খোঁজ নিয়ে কী করবে?”
মায়া সরু চোখে তাকায় তার দিকে।
ইনারা বলে, “এসব আমাকে দেখিয়ে লাভ নেই। ইনারা কারো থেকেই ভয় পায় না।”
“তাহলে কী চাই?”
“ব্লুবেরি চিজ কেক।”
“ডিল। তুমি আমাকে ডায়েরির খোঁজ দিবে আমি কেক বানিয়ে দিব।”
“ছোট বোনের সাথেও বিজনেস করা শুরু করে দিলে?”
বোনের কথাটা শুনে মায়া মৃদু হেসে অন্যদিকে তাকায়। বলে, “হয়েছে এখন খাবারে ধ্যান দেও।”
.
.
সুরভি সালাদ কেটে ডাস্টবিনে ময়লাগুলো ফেলে। তখন ডাস্টবিনের পাশে মোড়ানো এক কাগজ পায়। সে উঠিয়ে দেখে কাগজটা। কাগজটায় একটি মেয়ের আর্টিকেলের পৃষ্ঠা। সাত বছর আগে একটি মেয়ের উপর এসিড এট্যাকের আর্টিকাল। মেয়েটা যে দেশের নামকরা অকিলের ছেলে রিফাদের উপর এই কেইসের আরোপ দেওয়া হয়েছে। আর্টিকেলটা পড়ে তার মনে পড়ে। যেদিন সে প্রথম নীরার কেইসের ব্যাপারে জেনেছিল সেদিনই অভ্রর সাথে দেখা হয়েছিল তার। সে তাকে এসবে জড়াতে মানা করেছিল। সাথে সে বলেছিল, “তুমি চুপ থাকলেই যে ওরা শাস্তি পাবে না এমনটা তো বলিনি। কেবল তুমি এসবের মাঝে জড়িও না। ওদের শাস্তির ব্যবস্থা ওরা নিজেই করবে।”
তার ভাবনার মাঝেই কেউ একজন তার পিছন থেকে এসে তার হাত থেকে কাগটা নেয়। আর ভারী এক কন্ঠ তার কানে ভেসে ওঠে, “কী করছ?”
সে পিছনে ফিরতেই দেখে অভ্র তার ভীষণ কাছে। সে সাথে সাথে পিছিয়ে যায়। সে দেখে অভ্র কালো শার্টের সাথে টাউজার পড়ে আছে। সে এই প্রথম অভ্রকে পাঞ্জাবি ছাড়া দেখল। অন্যরকম দেখাচ্ছে তাকে, ভালো দেখাচ্ছে। বেশি সুদর্শন দেখাচ্ছে বললেও ভুল হবে না।
অভ্র বলে, “এভাবে না জিজ্ঞেস করে কোনো কাগজ ধরা উচিত না।”
সুরভি উওর না দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকায় সে হেসে আবার ঝুঁকে তার মুখোমুখি হয়ে বলে, “এভাবে তাকিয়ে থাকলে প্রেমে পড়ে যাবে তো।”
সুরভি লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। তারপর আবার তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “রিফাদের ব্যাপারে আপনি রিসার্চ করেছেন। ও যেমন করেছে তেমনভাবেই ওকে শাস্তি দিয়েছেম তাই না?”
অভ্র বাঁকা হেসে অন্যদিকে চলে যায়। দুইটা প্লেট নিয়ে বিরিয়ানি বাড়তে শুরু করে। তবুও সুরভি তার পিছু ছাড়ে না, “আপনি সেদিন বলেছিলেন আমি যেন এসবে না জড়ালেও ওরা শাস্তি পাবে। আপনি ওদের সাথে এমন করেছেন?”
অভ্র প্লেট নিয়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে রওনা দেয়। বলে, “সালাদের প্লেটটা নিয়ে আসো।”
সুরভি তার পিছু যায় প্লেট নিয়ে। বলে, “আপনি বলেন নি কেন?”
“কী বলব?”
“যে এসব আপনি করেছেন।”
অভ্র যেয়ে প্লেটগুলো টেবিলে রেখে চেয়ারে বসে।
“তাহলে আগের তিনজকেও আপনি শাস্তি দিয়েছিলেন। বলেন নি কেন?” সুরভি জিজ্ঞেস করে।
“বলার কি দরকার?”
“আপনি কাওকে কিছু বলতে চান না কেন? আপনি সব লুকিয়ে রাখতে চান কেন? আপনি এসব করেছেন কিছু বলেন নি। এসব তো ভালো কাজ। আপনি কাওকে এটাও জানান নি যে আপনি একটি আশ্রম চালান। বললে কি হয়? এত রহস্য রাখতে ভালোবাসেন কেন আপনি? আমার রহস্য একটুও পছন্দ না।”
তার একের পর এক এত প্রশ্ন শুনে অভ্রও অতিষ্ঠ হয়ে যায়। সে সুরভির হাত ধরে নিজের দিকে টান দেয়। সুরভি তার কাছে আসলে সে মৃদুস্বরে বলে, “তাহলে আমার বউ হয়ে যাও। আমার বউয়ের কাছে কোনো রহস্য রাখব না।প্রমিজ।”
স্থির হয়ে যায় সুরভি। অভ্রর এই কন্ঠটা মারাত্নক। কেমন নেশা ধরানো। শুনলেই বুকের ভেতর নড়ে উঠে। সে কন্ঠের নেশা ভাঙিয়ে যখন শব্দচয়নে ধ্যান দিলো তখ হুঁশ আসে তার। সে সঠিক শুনেছে তো? না’কি কন্ঠে হারিয়ে ভুল শুনে ফেলেছে? সে থতমত খেয়ে বলে, “হুঁ?”
স্থির হয়ে যায় সুরভি। অভ্রর কথাটা সে কি বলবে ভেবে পায় না। অভ্র কী আসলে তাকে বিয়ের জন্য প্রস্তাব করল না’কি সে মজা করছে?
চলবে…
অনুভূতির খাঁচা
পর্ব-৩২
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
“তাহলে আমার বউ হয়ে যাও। আমার বউয়ের কাছে কোনো রহস্য রাখব না। প্রমিজ।”
স্থির হয়ে যায় সুরভি। অভ্রর এই কন্ঠটা মারাত্নক। কেমন নেশা ধরানো। শুনলেই বুকের ভেতর নড়ে উঠে। সে কন্ঠের নেশা ভাঙিয়ে যখন শব্দচয়নে ধ্যান দিলো তখন হুঁশ আসে তার। সে সঠিক শুনেছে তো? না’কি কন্ঠে হারিয়ে ভুল শুনে ফেলেছে? সে থতমত খেয়ে বলে, “হুঁ?”
স্থির হয়ে যায় সুরভি। অভ্রর কথাটা সে কি বলবে ভেবে পায় না। অভ্র কী আসলে তাকে বিয়ের জন্য প্রস্তাব করল না’কি সে মজা করছে?
“আপনি কী মজা করছেন?” সুরভি জিজ্ঞেস করে। তার চোখ চোখ রেখেই।
“কী মনে হয় তোমার?”
“মনে হয় আপনি মজা করছেন। তাই না?”
অভ্র আর হাত ছেড়ে সামনের দিকে ঘুরে বসে। সুরভি আবারও জিজ্ঞেস করে, “আমি ঠিক বলছি না?”
অভ্র তার কথা না শোনার মতো বিরিয়ানির প্লেট কাছে টেনে খাওয়া শুরু করে। সুরভিকেও বলে, “খাওয়া শুরু করো। ঠান্ডা হয়ে যাবে ত।”
সুরভি বসে তার পাশের চেয়ারে। তাকায় তার দিকে। অভ্রকে দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করার পরেও উওর না দেওয়ায় সে আর কথাটা বাড়ায় না।
অভ্র ঠোঁটে হাসি নিয়ে তার দিকে তাকায়। বলে, “আশ্রমটা আমার না। আমার এক প্রিয় মানুষের রেখে যাওয়া উপহার। আমার বন্ধু গগনের।”
“গগন?”
“আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিলো গগন।”
“ছিলো? এখন আর কথা হয় না? ঝগড়া হয়েছে?”
“সে আর নেই।”
সুরভি খাবারে হাত দিয়েছিল কিন্তু অভ্রর কথাটা শুনে থেমে গেল। চকিতে তাকায় তার দিকে। কি বলবে ভেবে পায় না। সে আজ আরেকটি জিনিসও বুঝতে পারে সেদিন তার ও ইনারার সাথে প্রিয়’র ছবি দেখে অভ্র এত আবেগী হয়ে গিয়েছিল কেন? কাছের মানুষ হারানোর দু:খটা তারও আছে একারণেই সে এই দু:খটা বুঝতে পাড়ছে। কথাটা ভাবতেই তার প্রিয়’কে শেষ দেখাটা মনে পড়ে। বুক কেঁপে উঠে তার। সে জীবনে কোনো মৃতদেহ দেখ নি, ভয়ে। অথচ সেদিন জীবনের প্রথম মৃতদেহ সে দেখেছিল, সর্বপ্রথম, তাও তার কাছের বন্ধুর। তা ভেবে অজান্তেই তার চোখের কোণে জলের ধারা ঝরে। তার বুকের ভেতর ভার হয়ে যায়। নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিল তার। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, “আমার এখন আর খেতে মন চাইছে না। আমি জানি আপনি কষ্ট করে রান্না করেছেন এসব। তবুও আমি না খেলে কী আপনি খারাপ মনে করবেন?”
সে চোখ তুলে চায় না অভ্রর দিকে। তার এতটা খারাপ লাগছিল।
“মনে করব।” অভ্রর কন্ঠ শোনার পরই সে দেখে অভ্র খাবারের এক নলা তার দিকে এগিয়ে দিয়েছে। সে তাকায় অভ্রর দিকে।
“সারাদিন ধরে তোমার জন্য ইউটিউবে দেখে বিরিয়ানি রান্না করেছি। তুমি না খেলে ত খারাপ মনে করবোই।”
কথাটা শুনে সুরভি অবাক হয়। সাথে তার ঠোঁটে হাসিও ফুটে। সে অভ্রর হাত থেকে খাবার খেয়ে বলে, “অনেক ভালো হয়েছে।”
“আমার সাথে থাকতে থাকতে মিথ্যা বলাও শিখে গেছো। লবণ, মরিচ দুইটাই বেশি হয়েছে।”
সুরভি হেসে দেয়, “আপনি চেষ্টা করেছেন। এটাই সবচেয়ে বড় কথা।”
অভ্র অন্য হাত দিয়ে সুরভির গালের জল মুছে দেয়। আর বলে, “এখন কষ্ট করে খেয়ে নেও, ওকে? আমি অনেক বছর ধরে আমার জন্য বেসিক খাবার ছাড়া কিছু রান্না করিনি তাই ভুলে গেছি। ধীরে ধীরে শিখলে আবার ভালো করে রান্না করে খাওয়াব।”
“আপনি আমার জন্য বিরিয়ানি রান্না শিখবেন?”
“কেন? কোনো প্রবলেম না’কি?”
“প্রবলেম নেই, কিন্তু আপনার কষ্ট করা লাগবে না। আপনার যেদিন খেতে ইচ্ছা করবে আপনি আমাকে বলবেন। আমি রান্না করে খাওয়াব।”
অভ্র তার দিকে তাকায়, মাতোয়ারা নজরে, বলে, “তুমি সারাদিন অফিস করো তাও কষ্ট করে আমার জন্য রান্না করবে? কেন?”
“আপনিও তো কয়দিন একটানা কাজ করে আজ রান্না করেছেন।”
“আমার তো তোমাকে ভালো লাগে, কিন্তু তোমার জন্য তো এমন না।”
কথাটা শুনে সুরভি তার দিকে এক পলক তাকে চোখ নামিয়ে নেয়। তার ঠোঁটের কোণে দুষ্টুমির হাসে। সেএটাও বুঝেনা যে অভ্র কি সত্যি বলছে না’কি তার মজা নিচ্ছে।
এরপর সে চুপচাপ নিজের হাত দিয়েই খাওয়া শুরু করে।
কিছুক্ষণ পরেই অভ্র নিজেই গাড়ি চালিয়ে সুরভিকে বাসায় পৌঁছে দেয়। যখন তার বাসার সামনে গাড়ি এসে থামে তখন সে অভ্রর দিকে তাকিয়ে বলে, “বাসায় এসে চা খেয়ে যান।”
“অন্য একদিন।”
“আচ্ছা তাহলে আমি যাই?”
অভ্র মাথা নাড়ায়। সুরভি দরজা খুলে কিছু একটা ভেবে আবারও দরজা লাগিয়ে দেয়। অভ্রর দিকে তাকিয়ে বলে, “আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞেস করছি। সোজা উত্তর দিবেন, কথা ঘুরাবেন না। আপনি যে তখন ওই কথাটা বললেন না যে… যে বিয়ে….বউয়ের কথা।”
“তুমি যা মনে করো ওটাই।”
“আপনাকে বলেছি না সোজা সাপ্টা উত্তর দিতে।”
“তুমি যা সোজা মনে করো তাই।”
“আপনার মতো ত্যাড়া মানুষ আমি এর জনমে আর দেখিনি।”
সুরভির মেজাজ খারাপ হয় তার উত্তর শুনে। সে রাগে বের হয়ে শব্দ করে গাড়ির দরজাটা লাগায়।
তার রাগ দেখে অভ্রর হাসি থামে না। তার কেন যেন সুরভির রাগ দেখতে ভালোই লাগে।
.
.
এত বছরে প্রথমবার মায়ার অফিসে আসতে দেরি হয়। তাও সে আসে দুপুরে, লাঞ্চের পর। ইনারাকে বাসায় একা রেখে আসা তার উচিত মনে হয় নি। সভ্য আসার পর সে বাসায় যেয়ে রেডি হয়ে অফিসে আসে। অফিসে আসার পর সে জোহানের রাখা চকোলেটের সাথে পায় একটি পেনড্রাইভ। যেখানে জোহানের এলবামের সব গান আছে রেকর্ড করা। এডিট ছাড়া। জোহানের কম্পোজার তার কাছে পাঠিয়েছে অনুমোদন জন্য। রাতে বাসায় যাবার পূর্বে এই এলবাম নিয়ে টিম মিটিং বসবে। তখন সকলকে নিজের উপদেশ দিতে হবে।
মায়ার প্রায় বেশিরভাগ গানই পছন্দ হয়। তার বারবার শুনতে শুনতে নিজের সকল কাজ শেষ করে সে। রাতে মিটিংরুমে যেয়ে দেখে সেখানে এই এলবামের সাথে কাজ করা সকলে আছে কেবল জোহান ও রিসা বাদে। তাদের ছাড়াই মিটিং শুরু করার আদেশ দেয় মায়া। আর তা যথার্থই বের হয়। কারণ তারা দুইজন একঘন্টার মতো দেরি করে রুমে প্রবেশ করতে। জোহান মিটিং এর শেষের দিকে ঢুকে রুমে,
“সরি সরি…. রাস্তায় অনেক ট্রাফিক ছিলো তাই দেরি হয়ে গেছে। রিসার অনেক খিদে পেয়েছিল তাই ডিনারে গিয়েছিলাম।”
তার কম্পোজার সোহাগ জানায়, “সরি ব্রো তোমার অপেক্ষা করেছিলাম কিছুক্ষণ। কিন্তু তুমি আসছো না বলে মায়া ম্যাম মিটিং শুরু করতে বলেছে।”
রিসা তখন খিটখিটে মেজাজে বলে, “এলবামটা তো জোহানের, গানগুলো জোহানের, সব কাজ করেছে ও তাহলে ওকে ছাড়া কীভাবে মিটিং শুরু হতে পারে?”
“শেষ কথাটা ভুল বললে,” মায়া তার আঙুল দিয়ে একটি কলম ঘোরাচ্ছিল, যখন তার দৃষ্টি আটকে ছিলো কাগজে, সে বলল, “সব কাজ জোহান একা করে নি। প্রত্যেকটি গানে ওর সাথে কমপক্ষে আরও দশজন কাজ করেছে। কেবল গানে। ভিডিও, এলবাম ডিজাইন, তৈরি করা, তা মার্কেটে নামানো, প্রমোট করা, ডিস্ট্রিবিউট করা এসব ছাড়াও আরও অনেক অনেক কাজ থাকে যার সাথে শ-খানিক মানুষ জড়িয়ে থাকে। আর আমার কাছে প্রত্যেকটা মানুষ সমান। কারণ সবার পরিশ্রম থাকে এই কাজে। আর এত পরিশ্রম করার পর তোমাদের ডিনার শেষ হওয়া পর্যন্ত ওরা না খেয়ে অপেক্ষা করবে তা আমার পছন্দ হবে না। এখন যদি বসতে চাও বসো, নাহলে গেট আউট।”
জোহান মায়াকে এতদিনে যতটুকু চিনেছে খারাপ থাকা অবস্থায় তার সাথে তর্ক করা মানেই নিজের জন্য সমস্যা দাঁড় করানো। তাই সে রিসার হাত ধরে তাকে নিয়ে একটি চেয়ারে বসিয়ে নিজেও অন্যচেয়ারে বসে। সে বলে দেয়, “রিসা এখানে আমাদের ভুল ছিল যে আমাদের দেরি হয়েছে। তাই আমরা বেশি কথা না বলি ওকে?” তারপর সে মায়ার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “মিটিং-য়ে কোন কোন বিষয়ে কথা হয়েছে? কোনো কিছু কি পরিবর্তন করা লাগবে?”
“এলবামের শেষ গানটা যে পরিবর্তন হয়েছে তা আবারও আগেরটাই দেওয়া হবে। আর দুইটা গানের সাথে যে মিউটিক ছিলো তা পরিবর্তন হওয়া দরকার। সোহাগ তোমাকে সব ডিটেইলে বলে দিবে। তোমার কিছু বেঠিক মনে হলে সব কাজ শেষে আগামী সাপ্তাহে আবারও মিটিং রাখা হবে। তখন সময়ে এসো। সবাইকে ধন্যবাদ আজ আসার জন্য। মিটিং শেষ, সকলে নিজ নিজ কাজে যেতে পারেন।”
মায়া উঠে তার ফাইল গোছাচ্ছিল, তখন রিসা আবার বলল, “তুমি জোহানকে পছন্দ করো তাই এমন করছ তাই না?”
কথাটা শুনে সকলে বিভ্রান্তিতে পড়ে যায়। বিশেষ করে জোহান। সে বিস্মিত সুরে বলে, “এসব কী বলছ তুমি?”
রিসা তার কথা না শুনে মায়াকেই বলে, “আমি জোহানের সাথে একা ডিনার করতে গিয়েছিলাম বলে তুমি একটু অপেক্ষা করতে রাজি হওনি, হিংসা করে। আমি দিবানিশি গানটা পরিবর্তন করতে বলেছিলাম যেন নতুন জেনারেশন সে গানের সাথে ভাইব করতে পারে। আমি পাল্টেছিলাম বলে তুমি কেবল ওটাই চেঞ্জ করলে তাইতো?”
মায়া তার কথা শুনে হেসে দেয়। সে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলে, “তোমার নিজের ব্রেনের সাথে আগে ভাইব বসানো উচিত তারপর গানের ভাইব নিয়ে কথা বলো। এলবামের প্রত্যেকটি গান একটা গল্প বলে আর একটা গানের জন্য এলবামের স্টোরি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আর তোমার নতুন জেনারেশন একটি সাইড গানের জন্য সম্পূর্ণ এলবাম কিনবে না। আমরা লার্জ অডিয়েন্স টার্গেট করছি কেবল নতুন না। ওকে? আর হ্যাঁ, আমার দুই রকমের মানুষ সহ্য হয় না। যে সময়ের কদর করে না আর যে নিজের ভুল স্বীকার করে না। তাই তুমি যে গতকাল বলেছিলে এই কোম্পানিতে যুক্ত হবার কথা, এই দুইটি অভ্যাস ঠিক করে যোগাযোগ করো। তুমি যত বড় তারকা হও, আই ডোন্ট কেয়ার। এটা আমার কোম্পানি, আমার রুলসে চলতে হবে সবাইকে।”
তারপর সে তার ফাইলগুলো নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।
সোহাগ রিসাকে বলে, “মায়া ম্যাম তো কোম্পানির চেয়ারম্যানদের জন্যও অপেক্ষা করে না। আজ তাও আপনাদের জন্য দশমিনিট অপেক্ষা করেছে এটাই অনেক।”
জোহান যায় মায়ার পিছনে। সে মায়ার একটু পরই কেবিনে ঢুকে বলে, “সো সরি মায়া। আমি রিসাকে বলেছিলাম আমরা আশেপাশের কোনো রেস্টুরেন্টে খেয়ে নেই বাট ওর ফেভারিট রেস্টুরেন্টেই যেতে হতো। আমি ভাবতেও পারিনি এত ট্রাফিক হবে ওদিকে।”
“মিটিং রুমের কথা সেখানেই শেষ।” সে চেয়ারে বসে বলে।
“তুমি রাগ করোনি তো?”
“বললাম তো মিটিং এর কথা মিটিং রুমেই শেষ।”
“না মানে…. রিসা যে হঠাৎ বলল যে তুমি আমাকে পছন্দ করো এজন্য… সরি এগেইন। ও একটু না বুঝে কথা বলে ফেলে আরকি। কথাটা মনে লাগিও না।”
মায়া কিছু বলে না।
জোহান আবারও বলে, “তুমি কী ডিনার করেছ?”
“না, কেন?”
“মা এসেছিল আমার বোন ঐশির বাসা থেকে। তোমাকে দেখতে চাইছিল। ডিনারের জন্য ডেকেছে।”
“আচ্ছা আমি কাজ শেষ হলে সবার আগে যেয়ে আন্টির সাথে দেখা করে নিব।”
“আমি তাহলে অপেক্ষা করছি।”
“তাহলে রিসার কী হবে?” সে টেবিলে কণুই রেখে গালে হাত রাখে।
“ওয়েট তুমি কী ভাবছো ওর সাথে আমার কিছু চলছে?”
“ভুল ভাবছি? সেই লেভেলের ডেইটিং এ যাচ্ছো তো দেখছি। আর ও তোমাকে পছন্দ করে বলল।”
“এসব ভুলেও ভেবো না।” সে এসে মায়ার সামনের চেয়ারে বসে গম্ভীরমুখে বলে, “ওকে একবছর ডেইট করে আমার তেল মজে গেছে। যাস্ট শো-অফফ ছাড়া কিছু করে না। রিলিশন কী শো-অফফ এর জিনিস? অবশ্য সেটা কেবল মিডিয়া প্লে ছিলো। আমার বাবার কাছে মিডিয়া প্লে-ই কেবল সাফল্যের রাস্তা ছিলো। কোনো সাকসেসফুল লেডি থাকলে তার সাথে আমার রিলেশন হলে দুইজনের জনপ্রিয়তা বাড়তো আর যদি কোনো নিউ মেয়ে কোম্পানিতে জয়েন করতো তাহলে আমার সাথে ডেইটের নিউজ আসলে সে মেয়ের ফলোয়ার বাড়তো। দুইদিকে কোম্পানির মুনাফা ছিলো আর বিশ্বাস করো, আমার বাবার কাছে আমার থেকে বেশি তার কোম্পানি প্রিয় ছিলো। আমি জীবনে কেবল একটা সিরিয়াস রিলিশনে গিয়েছিলাম তাও প্রায় আটবছর পূর্বে। আমার ক্যারিয়ারের শুরুতে। তাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। আরেকবারও ভালোবেসেছিলাম কিন্তু….”
মায়া তার কথা কেটে বলে, “কিন্তু সে ভাবি হয়ে গেছে।” বলে নিজেই হেসে দেয়।
“তুমিও মজা নিচ্ছো?”
জোহানের কথা শুনে মায়ার হাসি আরও বাড়ে। সে বলে, “তোমাকে আর সভ্যকে যে কার্টুন লাগছিল সেদিন। না হেসে পারা যায়।”
“দেখো আমার উপর হাসবে না বলে দিলাম।”
“আমি হাসলে তুমি কী করতে পাড়বে শুনি?”
জোহান মুখ খুলে কিছু বলার জন্য। কিন্তু চুপ করে যায়। কিন্তু সময় বিরতি নিয়ে বলে, “আচ্ছা তুমি হাসতে পারো। তোমাকে হাসলে সুন্দর দেখায়।”
কথাটা জন্য মায়া অপ্রস্তুত ছিলো। সে চোখ সরিয়ে নেয়। একটি ফাইল হাতে নিয়ে বলে, “আচ্ছা তুমি যাও তাহলে। আমি একটু কাজ শেষ করে তোমাকে ফোন দিচ্ছি।”
“ওকে… অপেক্ষা করছি তাহলে।”
মায়া দেখে জোহান গিয়েছে কি-না! সে দরজা দিয়ে বের হবার পর বুকের বা পাশে হাত রেখে গভীর নিঃশ্বাস ফেলে। জোহানের চোখে তাকালে তার হৃদপিণ্ডটার এমন বেহাল অবস্থা কেন হয়?
কিছুক্ষণ পর কাজ শেষ সে কেবিন থেকে বেরিয়ে কলই দিচ্ছিল জোহানকে। হঠাৎ করে কেউ তার কাঁধে হাত রাখে, সে তাকায় পিছনে কিন্তু কাওকে পায় না। তারপর সামনে তাকিয়ে হঠাৎ জোহানকে দেখে ভয় পেয়ে যায়। সে পিছিয়ে যায়। বুকে হাত রেখে গভীর নিশ্বাস ফেলে বলে, “ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”
“মায়া চৌধুরী ভয়ও পায়। এটা লেটেস্ট নিউজ।”
সে জোহানকে একবার কাঁধে মারে, কিন্তু মারতে নিলে জোহান হাত ধরে নেয়। সে এক’পা এগোলে মায়া পিছিয়ে যায়। সে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারে না জোহানে চোখে, তাই চোখ সরিয়ে নেয়। জোহান প্রশ্ন করে, “বেশি ভয় পেয়েছ বুঝি?”
“না।”
“তাহলে তোমার নিশ্বাস এত দ্রুত নিচ্ছো কেন?”
সে চোখ তুলে তাকায়। সরাসরি তার চোখ পড়ে জোহানের চোখে। তার বুকের স্পন্দন এমনিতেই বেগতিক ছিলো তার চোখে চোখ আটকাতেই তা বেগতিক হয়ে যায়।
সে বলে, “হাত ছাড়ো, নাহলে আজকে রিসার পর আরও কতজনের ভুল ধারণা হবে।”
“কেমন ভুল ধারণা?”
“যে আমি তোমাকে পছন্দ করি।”
“করো না?”
মায়ার চোখ দুটো বড় হয়ে যায় কথাটা শুনে। জোহান তার হাত ছেড়ে বলে, “ফ্রেন্ড হিসেবে তো পছন্দ করোই। অবশ্যই করতে হবে।”
“হুম।”
“আচ্ছা ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দিয়েছি বাসায়। তোমার বাইক দিয়ে আজ যাব। সেদিন আমার গাড়ি তুমি চালিয়েছিলে তাই আজ বাইক আমি চালাবো, ওকে?”
সে মায়ার দিকে হাত বাড়ায় চাবির জন্য। মায়া তার হাতে চাবিটা দেয়-ও। সাথে জিজ্ঞেস করে, “চালাতে পারো?”
“সেটাতো চালালে বুঝা যাবে।”
“ওয়েট তুমি আগে বাইক চালিয়েছ।”
“আগে চালাতাম।”
“আমার চাবি ফেরত দেও। তোমার ভরসা থাকলে বাসায় পৌঁছাতে হবে না হয়তো হাসপাতালে পৌঁছাব, নাহলে একবারে আল্লাহর কাছে।”
“আরে চিন্তা কীসের? হাত-পা ভাঙলেও।একসাথে ভাংবে আর মরলেও একসাথেই মরবো।”
“চাবি দেও আমার।”
চাবিটা নিতে গেলে জোহান হাত উঁচু করে নেয়। মায়া লম্বা হলেও জোহানের মতো তো আর নয়। সে লাফিয়ে জোহানের হাত থেকে নিতে গেলে জোহান চাবিটা অন্য হাতে নিয়ে সরিয়ে নেয়। তারপর তার হাত ধরে বলে, “আরে হাত-পা ভাঙলেও একই হাস্পাতালে ভর্তি হয়ে আড্ডা দিব। নো চিন্তা।”
“মানে হাস্পাতালেও তোমাকে সহ্য করতে হবে?”
জোহান প্রথম মুখ বানায় তারপরে এক গাল হেসে মাথায় উপরে নিচে করে। মায়ার হাত ধরে নিয়ে যায়।
তারা বাইকে উঠার পর মায়ার না চাওয়া সত্ত্বেও পিছনে বসতে হয়। জোহান তাকে জিজ্ঞেস করে, “ভয় করছে?”
“নিজের জানের ভয় সবারই থাকে।”
“মিস মায়া চৌধুরীর কোনো ভয়ও আছে? এটা নতুন এবং ইন্টারেস্টিং ছিলো।”
“মাইর খাবার বেশি ইচ্ছা হচ্ছে? আদিলের কী অবস্থা করেছি মনে আছে না’কি লাইভ ডেমো দিব।”
“আমি তো ভয় পেয়ে গেলাম।” জোহান হেসে বলে, “জোরে ধরে বসো। হাড্ডি-গুড্ডি ভেঙে গেলে আমি দায়ী নয়।” বলা শেষেই সে বাইক স্টার্ট করে। মায়াও জলদি করে ধরে নেয় জোহানের জ্যাকেট। সে চোখ বন্ধ করে নেয় শক্ত করে। কিছুক্ষণে বুঝতে পারে জোহান আসলে ভালো করেই বাইক চালাতে পারে। কিন্তু সে এত ব্যস্ত রাস্তায় তাকে কিছু বলে না। তার সাধারণত এত গাড়ির শব্দ পছন্দ না৷ কিন্তু আজ তার বিরক্ত লাগছে না। তার আজ এই ব্যস্ত পথটাও আনন্দিত মনে হচ্ছে।
সে জোহানের কাঁধে মাথা রেখে পথটা উপভোগ করতে থাকে। এই কোলাহলভরা ব্যস্ত শহরটাও তার কাছে বিরক্তির লাগে না।
তারা যেয়ে পৌঁছানোর পর জোহানের মা এসে মায়াকে জড়িয়ে ধরে, “কতদিন পর দেখা হলো তোমার সাথে। কেমন আছো?”
“এইত্তো আন্টি, ভালো। আপনি?”
“আমিও ভালো। তুমি রাতে খেয়ে আসো নি তো? আমি কিন্তু অনেক কিছু রান্না করেছি তোমাদের জন্য। সারাদিন কাজ করেছ এখন সবার আগে খেয়ে নেও। জোহান তুইও আয়।”
“আন্টি আমার পেটে তো ইঁদুরটা হৈচৈ করছে কিন্তু জোহান তো ডিনার করে এলো।”
মা মুখ মলিন করে বলে, “কিন্তু আমি তো বলেছিলাম আজ আমি রান্না করব।”
“আন্টি ও আপনার কষ্টের মূল্য না দিলে কী হয়েছে? আমি আছি তো। আমি তো আর কোনো ডিনার ডেইটে যাই নি। আপনার সাথেই আজ ডিনার ডেইট করি আসেন।”
জোহান তখন নিজের পক্ষ রেখে বলে, “প্রথমত আমি কোনো ডেইটে যাই নি। রিসার খিদে লেগেছিল ওকে খাওয়াতে নিয়ে গেছি। আর দ্বিতীয়ত আমি খাই নি তোমাদের সাথে খাব বলে।”
“একদম ভালো করেছিস, আজ অনেক কিছু বানিয়েছি। দুইজন খেতে বসো, আসো।”
দুইজন হাত ধুঁয়ে ডিনার টেবিলে বসে। টেবিলে সাজিয়ে রাখা ছিলো কয়েক ধরনের খাবার। জোহানের মা মায়ার প্লেটে খাবার দেওয়ার সময় বলে, “জোহান বলেছিল তোমার চট্টগ্রামের মেজবানি খাবার পছন্দ। তাই আজ রান্না করেছি। তোমরা খাওয়া শুরু করো আমি পানির জগ নিয়ে আসছি।”
“আন্টি আপনি খাবেন না?”
“আমার এসব খাবার পছন্দ না তো তাই আমি ভর্তা বানিয়ে খেয়ে নিয়েছি আগেই। আসলে আমার মাছ মাংস এসব থেকে ডাল, ভর্তা দিয়েই খেতে ভালো লাগে।”
“ওহ আচ্ছা।”
জোহানের মা চলে গেলে মায়া জোহানকে জিজ্ঞেস করে, “আর তোমার কী ভালো লাগে?”
“কেন?”
“আজ আন্টি আমার জন্য এত কিছু রান্না করেছে তাই ভাবছি শুক্রবার আন্টির জন্য কিছু রান্না করে আনব। তুমি আমার পছন্দ মনে রেখেছো তাই তোমার জন্য একটা ডিস তৈরী করে আনতাম।”
“তুমি রান্না করবে?” জোহান হেসে উঠে, “বাদ দাও তোমার দ্বারা সম্ভব না।”
“কেন সম্ভব না?” মায়া ভ্রু কুঁচকে নেয়।
“ম্যাডাম জীবনে কি রান্না করে চেহারা দেখেছেন? সারাদিন তো কাটে অফিসেই।”
“মিস্টার উক্তিটি শুনেন নি? যে রাঁধে সে চুলও বাঁধে।”
“সে জন্য চুল হওয়াও তো লাগবে। এক্সের শোকে এত সুন্দর চুল তো কেটে রেখেছ।”
“তোমার কি নিজের চেহারার কদর নেই? এক ঘুষিতে ত্যাড়াব্যাকা করে দিব।”
“এর থেকে ভাল রিসার সাথেই ডিনারটা করে নিতাম। এটলিস্ট ও আমাকে হুমকি তো দেয় না। আর মাঝেমধ্যে মজাও করে।”
মায়া ভ্রু কপালে তুলে বলে, “তোমাকে আজ অনেক সুন্দর লাগছে।”
“তাই? আমি তো আজ সাধারণভাবেই আছি। সবসময় তো আমি এমন….”
মায়া তার কথা বলে, “আমি মজা করছি।”
জোহান মুখ বানায়, “ভেরি ফানি। হাসা লাগবে?”
মায়া হাসে। জোহানের মা আসার পর তাদের সাথে বসে। রাতের খাবারের পর তারা সবাই মিলে চা’য়ের সাথে আড্ডা দেয়। তারপর জোহান উঠে যায় তার রুমে।
মায়ার যাওয়ার সময় হয়। জোহান রুম থেকে ফেরত না আসায় নিজেই যায় তার রুমে বিদায় নিতে। সেখানে যেয়ে জোহানকে তো পায় না কিন্তু স্টাডি টেবিলে তার চোখ প্রথম যেয়ে আটকায়। সেখানেই জোহানের গানের ডাইরিটা পায় সে। গতকাল রাতের ইনারার কথা মনে পড়ে তার। সে ডায়েরিটা উঠিয়ে রেখেও দেয়। এভাবে কারও ব্যক্তিগত জিনিসে হাত দেওয়া কি ঠিক হবে?
সে ডায়েরিটা রেখে সামনে এগিয়ে রুমটা দেখতে থাকে। তবুও বারবার তার চোখে ডায়রিতে যেয়ে আটকাচ্ছিল। শেষমেষ তার মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে সে আবারও টেবিলের সামনে যেয়ে ডায়েরিটা খুলে নেয়। দেখে প্রথম কয়েক পৃষ্ঠায় কেবল গান লেখা। কিন্তু যখন গানের পৃষ্ঠা শেষ হয় তখন সে দেখে সেখানে কিছু পৃষ্ঠা লেখা আছে কেবল। সে একনজর চোখ বুলিয়ে দেখে প্রায় পৃষ্ঠা তার নামেই ভরা। তার মনে কৌতুহল জাগে। জোহান তার নামে এত কি লিখেছে? সে একবার ভাবে, আর কি সত্যি পড়া উচিত জোহানের ডায়েরি? আবার ভাবে কেন নয় তার নামেই তো লেখা। সে দ্বিধায় ভুগে। তারপর কিছু সময় চিন্তা করে তার ব্যাগে ডায়েরিটা ঢুকিয়ে বের হয়ে যায় রুম থেকে।
বেরিয়ে জোহানের মা’কে বলে, “আন্টি জোহানকে পাচ্ছিলাম না রুমে।”
“হয়তো গোসল করছে। ওর আবার রাতে গোসল করার অভ্যাস। এসেই চা বা কফি খেয়ে গোসল করে ডিনার করবে। আজ তোমার জন্য আগে করল।”
“আচ্ছা আন্টি তাহলে ওকে বলেন আমি চলে গিয়েছি?”
“আচ্ছা আবার এসো কিন্তু।”
“আপনি আগামীকাল সকালে হাঁটতে এসেন আমরা গল্প করব। আসি আন্টি।”
মায়া বিদায় নিয়ে দ্রুত আসে। বাসায় এসে গভীর নিশ্বাস ফেলে সে। সে ভয়ে আছে। এর আগে কখনো না বলে সে কারও কাছ থেকে কিছু নেয় নি। কিন্তু আজ তার মনকে ধরে রাখতে পাড়ল না। এক সময় পর সে নিজের হৃদয়কে গুরুত্ব দেওয়া বন্ধ করেছিল। সে গুরুত্ব দিতো কেবল নিজের মস্তিষ্ককে। কিন্তু ইদানীং তার হৃদয়টা বড্ড বেয়াদব হয়েছে। তার কথা আর মানে না।
সে ব্যাগটা রেখে নিজের সোফায় বসেই ডায়েরিটা পড়া শুরু করে। ডুবে যায় সে ডায়েরির পাতায়…..
জোহানের ডায়েরি
পৃষ্ঠা-১
মায়াকে যখন প্রথম দেখেছি তখন ভেবেছিলাম বাইক কোনো ছেলে চালাচ্ছে। সে খুব বসী। অফিসে সবাই তাকে রাক্ষুসি ডাকে। কিন্তু তারা তো জানে না বাহিরে খোলস রাখা এই বোসি লেডিটার অন্তরটা নরম মেয়ের। যে তার কাছের মানুষদের খেয়াল রাখে। আজ সকালে ওর বন্ধুদের সাথে আমার সময়টা খুব ভালো কেটেছে। আমার খুব ভালো লেগেছে যখন ও নিজের হাতে আমাকে খাইয়ে দিচ্ছিল। আমার কথা চিন্তা করে সবাইকে বলল যেন আমাকে স্পেশাল ট্রিটমেন্ট না দেয়, সাধারণভাবে আমিও যেন ফাংশনগুলোতে আনন্দ করতে পারি। এভাবে আমাকে যত্ন দেখানো মানুষ জীবনে খুব কম ছিলো। আশরাফ, তন্নি, মেহেদী ও মায়ার সাথে আজ অনেকদিন পর মজা করলাম। ওদের বন্ধুত্ব দেখে আমার মনে পড়ে গিয়েছিল আমাদের পঞ্চসুরের প্রথম দিনগুলো। ওদের মতোই দুষ্টুমি করতাম, ভালো সময় কাটাতাম, একসাথে সারাক্ষণ গান গাইতাম। গান গাওয়ার কথায় মনে পড়ল, যে কারণে আমার গানের ডায়েরিটায় লিখছি, মায়ার গলায় জাদু আছে। ও যখন আজ গান গাইছিল তখন ওর কন্ঠ শুনতেই কিছু মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে পড়েছিলাম। হাওয়াও যেন উপভোগ করছিল ওর গানের সুর। যেন এক মিষ্টি বাতাস তাকে ছুঁয়ে গেল আমায়। আমি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মায়ার দিকে। কেন? তা জানি না। কেবল চোখ সরাতে পাড়ছিলাম না। আমি শুনেছিলাম, মায়ার গানের গলা সুন্দর। কিন্তু এতটা মধুর সে ভাবতেও পারেনি। তার কন্ঠ যেন বৃষ্টি আসার পূর্বের মিষ্টি হাওয়ার ন্যায়, মধুর।
সূর্য লেকের জলের ভেতর ডুবে যাচ্ছিল। সে দৃশ্যটা কত সুন্দর হতো। কিন্তু আমার এক মুহূর্তের জন্যও সেদিকে তাকাতে ইচ্ছা হয় নি। মায়া তাকায় আমার দিকে। আমি তখনো অবাক দৃষ্টিতে তার দিকেই দৃষ্টি আটকে রেখেছিলাম। চোখে চোখ পড়ে দুইজনের। মিষ্টি মুহূর্তটায় আমার বুকের ভেতর যেন ঝড় ওঠে, সে প্রথমবার।
পৃষ্ঠা-২:
মায়ার গানের সুর গতকাল থেকে কানে বাজছিল। ঘুমাতে যেয়েও। মেয়েটার জ্বালায় সারারাত আমার ঘুম হয় নি। এজন্য খুব রাগছিলাম আমি। সাধারণত কারও উপর রাগ হলে আমি তার চেহারাটাও দেখতে চাই না। কিন্তু সকালে রুম থেকে বের হবার পর তাকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে গেছি। তাকে না দেখতে পেয়ে খুঁজতে গেলাম। তাকে প্রথম রঙ আমি লাগালাম। জিনিসটা আমার কাছে কেন যেন বিশেষ লাগছিল। কিন্তু এটা কি খুব সাধারন বিষয় নয়? তারপর যখন আমরা সকলে নাচা-নাচি শুরু করলাম তখন সে পড়ে যেতে নিলে আমি তাকে ধরেছিলাম। সে সামনে তাকাতেই দৃষ্টিবন্ধন হয় দু’জনের। ওর চোখ দুটো কী সুন্দর! সে ভাগ্যবান হবে যে এই চোখদুটোর দিকে সারাদিন তাকিয়ে থাকতে পাড়বে। আমি আরেকটু তাকিয়ে থাকতে চাচ্ছিলাম কিন্তু ওর চুলগুলো বাঁধা দিচ্ছিল। তাই হাত উঠিয়ে তার সামনে আসা চুলগুলো ঠিক করে দিচ্ছিলাম। তার পূর্বেই মায়া পিছিয়ে যায়। আমার ইচ্ছাটা পূর্ণ হতে দেয় না। আমার এতে বিরক্ত লাগে। ও যেতে নিলেই হাত ধরে নেই। সে পিছনে তাকায়। ওর চোখদুটোয় ডুব দেবার আরেকটু সময় পাই। আমার মনে পড়ে, ও আমায় রঙ লাগায় নি।
আমি মায়ার হাতে রঙ দিয়ে নিজের গালে ছুঁইয়ে দিলাম। খুবই অদ্ভুত একটা কান্ড ঘটালাম। কেন? নিজের কাছে লজ্জা লাগছে ভেবে। আর যে কারণে এই লজ্জাজনক কান্ডটা করলাম তখনই মায়া চোখ বন্ধ করে নিলো। ওর নয়নজোড়া আরেকটু দেখাও হলো না। ভাগ্যিস তখন কয়েকজন এসে আমাকে নিয়ে গেল। নাহয় মায়াকে কী বলতাম? লজ্জায় বোধহয় প্রাণ যেত।
তাদের সাথে যাবার সময়ও পিছনে তাকালাম। দেখতে পেলাম মায়া তার বন্ধুদের সাথে মজার সময় কাটাচ্ছে। তাদের সবাইকে এভাবে দেখে আমার ঠোঁটের কোণে হাসি আঁকে। আর মায়ার সাথে কথা হয় নি। সবে দুপুর। রাতে হলুদের আয়োজনে কীভাবে ওর সাথে কথা বলব তাই চিন্তা করছি।
পৃষ্ঠা-৩:
মায়াকে আজ ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছিল। নীল রঙের পোশাকে রুপালী কারচুপির কাজ। কানে রুপালি কানেরদুল। আর একপাশে চুলগুলো বেণী করা, বেণির উপর বেলিফুল মোড়ানো। ওর টানা টানা চোখে নীল কাজল ভরা। কী সুন্দর লাগছিল ওকে! কিন্তু ওর উপর আমার রাগও লাগছে, এভাবে বারবার চোখ সরিয়ে নেওয়া লাগে? আমার চোখের দিকে তাকায় না কেন? আমাকে কী এতটা অপছন্দ করে? আমার তো ওর চোখদুটো আরেকটু ভালো করে দেখতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু ম্যাডামের আলাদা এটিটিউড। তার প্রশংসা করলেও দোষ। নাচার মাঝে কীভাবে রাগ করে চলে গেল?
আজ যখন শুনলাম আদিল ওকে খারাপ ভাবে ছুঁয়েছে তখন আমার মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিল। সাহস কী করে হয় ওই ছেলের মায়াকে ছোঁয়ার? আমি ওকে মেরে আমার রাগটাও কমাতে পাড়লাম না। মায়া এসে আমাকে ধরে ফেলল, নাহয় ছেলেটাকে হয়তো মেরেই ফেলতাম। ওর উপর এখন আমার এত রাগ লাগছিল। আদিলের বাচ্চাকে তখনই শাস্তি দেয় নি কেন? অপেক্ষা করল কেন? আর আমাকে থামাল কেন? কিন্তু যখন শুনলাম ও আমার জন্য চিন্তা করছিল তখন অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করা শুরু করলো। আমাকে নিয়ে এত কিছু চিন্তা করে? আমাকে নিয়ে, আমার স্বপ্নকে নিয়ে!
পৃষ্ঠা-৪:
মায়া বড্ডই অদ্ভুত জিনিস। মানুষকে ভেতর থেকে শেষ করে দেবার পরও শান্তি আসে না। কেউ একবার মায়ায় জড়ালে তা থেকে বেরিয়ে আসাটা কতটা কঠিন আমি জানি। তারপরও। এই বেহায়া মন কী মানে? এই রাঙামাটির যাত্রাটা আমার জন্য স্মৃতিদায়ক রয়ে গেল।
প্রতিটি মুহূর্ত বিশেষের পাতায় রইল৷ বিশেষ করে মায়ার সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো। এখনো এই যাত্রা শেষ হয় নি। আর আমার ইচ্ছা যাত্রা কখনো শেষ না হোক। আজ চন্দ্রিমার আলোতে নাচছিলাম আমরা দুইজন। এ রাত, এই আকাশ, এই চাঁদ, এই মায়া আমি হয়তো ভুলতে পাড়ব না। ও যখন চলে গিয়েছিল তারপরও আমি সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভেবেছি কেবল। আমি কী এইবার মায়ার মায়াজালেই জড়িয়ে পড়ছি? এই মায়া তো ভয়ংকর। আমি তো নিজেকে ওয়াদা করেছিলাম আর কখনোই মায়ায় জোড়াবো না। তো এই হৃদয়টা এমন করছে কেন? এমন বেহায়া হলো কেন? মায়ার সাথে থাকতে, কথা বলতে, সময় কাটাতে আমার ভালো লাগছে কেন? নিজেকে হাজার প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করছে। আমি কী আকর্ষিত হচ্ছি মায়ার প্রতি? না, এটা সম্ভব না। আমি অন্তত মায়াকে পছন্দ করতে পারি না। ওকে ভালোবাসতে পারি না। আমাদের দুইজনের অতীত দু:খে ভরা। দুইজনের বুকের কোথাও না কোথাও এখন অতীতের আঘাতের চিহ্ন রয়ে গেছে। একটি ভাঙা মনকে ভালোবাসা দিয়েই ঠিক করা যায়। কিন্তু দুটো ভাঙা মন কখনো একে অপরকে পরিপূর্ণ করতে পারে না।
চলবে…