অনুভূতির খাঁচা
পর্ব-৩৩
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
আমাদের দুইজনের অতীত দু:খে ভরা। দুইজনের বুকের কোথাও না কোথাও এখন অতীতের আঘাতের চিহ্ন রয়ে গেছে। একটি ভাঙা মনকে ভালোবাসা দিয়েই ঠিক করা যায়। কিন্তু দুটো ভাঙা মন কখনো একে অপরকে পরিপূর্ণ করতে পারে না।
মায়া ডায়েরি বন্ধ করে দেয়। আরও কয়টি পৃষ্ঠা লেখা ছিলো কিন্তু তার আর পড়তে ইচ্ছা হচ্ছিল না। তার ডায়েরিটা পড়ার সময় প্রতিটা লাইনে ঠোঁটের কোণে হাসি ছিলো কিন্তু শেষ ক’টা লাইন পড়ার সময় তার বুকের ভেতরটা খুব ব্যাথা হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল কেউ চাপ দিয়ে ধরে রেখছে তার হৃদপিণ্ডটা। এটা কী স্বাভাবিক? না’কি তার কোনো রোগ হয়েছে হৃদপিণ্ডের? কী জানি?
সে উঠে যায় সোফা থেকে। ড্রেস চেঞ্জ করে হাতমুখ ধুঁয়ে নিলো। তারপর গেল চুলায় গরম পানি দিলো। রাতে এক কাপ রঙ চা তার প্রয়োজনীয়। সে আবার ভাবনার চিন্তায় ডুবে, আচ্ছা সত্যিই দু’টো ভাঙা মন কী আসলেই একে অপরকে পরিপূর্ণ করতে পারে না? কেন পারে না? তাদের কী নতুন করে ভালোবাসার অধিকার নেই? ভালোবাসা শব্দটা তার মাথায় আসতেই তার হুঁশ ফিরে। সে ভালোবাসার কথাই বা ভাবছে কেন?
তার হুঁশ আসতেই সে দেখে পানিতে বলক এসেছে। সে তাড়াহুড়োয় খালি হাতে পাতিল ধরতে গেল নিজের হাত পুড়ায়। নিজের উপরই রাগ লাগছে তার। কি একটা ভাবনা তার মস্তিষ্ককে কাবু করে বসল এর উপর সে হাত পুড়িয়ে বসলো। সে এবার লুসনি দিয়ে পাতিল ধরে গরম পানি তার চা’য়ের কাপে ঢালে। দেয় একটি টি-ব্যাগ। সে হাঁটতে শুরু করে। তার রুমের দিকে যায় চা’য়ের কাপ নিয়ে। এবারও তার ভাবনায় হারিয়ে যায়। আচ্ছা জোহান যে লিখল তার চোখে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগে। কিন্তু কেন ভালো লাগে? আর মায়াই বা কেন তাকিয়ে থাকতে পারে না তার চোখে? এটাও কি অসুখের লক্ষ্মণ? তার এই ব্যাপারে একটু খোঁজ নেওয়া উচিত।
হঠাৎ ফোন বেজে ওঠে। মায়া আঁতকে উঠে, তার হাত থেকেই পড়ে যায় কাপটি। গরম পানি যেয়ে পড়ে তার পা’য়ে। ব্যাথায় লাফিয়ে উঠলে আরও বেশি ব্যাথা পায় সে। সে বিরক্তির সুরে বলে, “ধ্যুর আজকের দিনটাই খারাপ।”
সে রুমের ভেতর যেয়ে ফোন তুলে দেখে জোহানের কল। ফোনের স্ক্রিনে তার নাম দেখে কিছু মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে যায় মায়া। সে দ্বিধায় পড়ে যায় কল ধরবে কি-না! তার কেমন অস্থির লাগতে শুরু করে। সে ফোন পাশে রেখে দেয়। কিন্তু তার বেহায়া মন কি তার কথা মানে? না চাওয়া সত্ত্বেও ফোনটা হাতে নিয়ে কল রিসিভ করে।
“তুমি আমার সাথে না দেখা করে চলে গেলে কেন?”
জোহানের কন্ঠ শুনে তার হৃদপিণ্ডটা আরও দ্রুত হয়ে পড়ে। তার অসুখ বেড়েই যাচ্ছে এর কোনো না কোনো সমাধান খুঁজতেই হবে।
সে আমতা-আমতা করে বলে, “তুমি রুমে ছিলে না।”
“বারান্দায় আসো তো।”
“কেন?”
“যাওয়ার সময় তোমাকে দেখিনি তাই এখন দেখে বিদায় দিব।”
তার বুকের স্পন্দন আরও বেগতিক হয়। সে বুঝে না কি করবে। সে বলে, “আগামীকাল তো দেখা হবেই। দেখার প্রয়োজন নেই।”
কথাটা বলেও সে উঠে দাঁড়ায় বারান্দায় যাবার জন্য। কিন্তু তার পা’য়ে ব্যাথা হয়। সে শব্দ করে উঠলে জোহান জিজ্ঞেস করে, “কী হলো সব ঠিক আছে তো?”
“বিশেষ কিছু না এবসেন্ট মাইন্ডে ছিলাম তখন হাত থেক চা’য়ের কাপ পড়ে যায়।”
“কাঁচ ঢুকে নি তো পা’য়ে?” আঁতকে উঠে জোহান।
“না, যাস্ট পানি পড়েছে।”
“তুমি… তুমি নিজের এতটুকু খেয়াল রাখতে পারো না?”
জোহান কল কেটে দেয়। মায়া ফোনের দিকে তাকিয়ে রাগান্বিত স্বরে বলে, “আমার মুখের উপর কল কেটে দিয়েছে। সাহস কত্ত লোকটার!”
সে মুখ বানিয়ে বলে, “এখন আবার এসব পরিষ্কার করতে হবে।”
সে উঠতে যেয়ে একটু আলসেমি করে। মোবাইল হাতে নিয়ে ছবি দেখছিল সে। এমন সময় কলিংবেল বাজে। সে উঠে যায় দরজার দিকে। তার পা’য়ে খানিকটা ব্যাথা হলেও যতটুকু ভেবেছিল তার থেকে কমই ব্যাথা পেয়েছে। সে লুকিংহোলে দেখে জোহানকে। তাকে দেখে থতমত খেয়ে যায়। তাড়াহুড়ো করে সোফা থেকে তার ডায়েরিটা কোথায় লুকাবে বুঝতে পারে না। কিছু মাথায় আসছিল না তার। তাই সোফার কুশনের পিছনে রেখে দেয়। তারপর গভীর নিশ্বাস ফেলে স্বাভাবিক হবার অভিনয় করে দরজা খুলে। কিন্তু অস্বাভাবিকভাবে একগাল হেসে বলে, “আরে তুমি এখানে কী করছ?”
“পা’য়ের সাথে কি ব্রেনেও ব্যাথা পেয়েছ? দাঁত কেলিয়ে এভাবে হাসছ কেন?” জোহান কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করে।
তখন মেজাজ খারাপ হয় মায়ার। সে বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞাসা করে, “কি করছ তুমি এত রাতে বাসায়।”
“এখন স্বাভাবিক লাগছে। মলম এনেছি তোমার পা’য়ের জন্য। এক স্টক কিনে রেখেছিলাম কেবল তোমার জন্য। আপনি যে ক্লামজি।” সে ভেতরে ঢুকে নিজেই দরজা লাগায়। তারপর আবার মায়ার দিকে তাকিয়ে কৌতুহল নিয়ে প্রশ্ন করে, “আচ্ছা অফিসে তো তোমার কিছু হয় না। সারাক্ষণ সবাইকে বকতে আর আদেশ দিতে দিতেই সময় কাটে তাহলে বাসায় তোমার সাথে এত এক্সিডেন্ট কীভাবে হয়? মনে হয় অফিসে যাদের বকো তাদের বদদোয়ায় বুঝলে?”
“তোমারও কী এক সেশন বকার দরকার আছে?” নিজের হাত আড়া-আড়ি ভাঁজ করে মায়া।
“আরে আমি মজা করছি। তুমি রাগ করছ কেন? বসো মলম লাগিয়ে দিচ্ছি। হাঁটতে পারবে না’কি কোলে তুলব?”
জোহান তার দিকে এলে মায়া পিছিয়ে যায়, “কোনো দরকার নেই। মলম লাগানোরও দরকার নেই। আমি ওকে আছি। পানি একবারে গরম ছিলো না। চা নিয়ে একটু ঘুরঘুর করেছিলাম তখন ঠান্ডা হয়েছে মনে হয়।”
জোহান তার পা’য়ের দিকে তাকায়, “তা তো দেখতেই পারছি। লাল হয়ে আছে।”
সে মায়ার হাত ধরে তার সোফার কাছে নিয়ে বসায়। তারপর নিজে মেঝেতে বসে তার পা’য়ে মলম লাগাতে শুরু করে। আর অহং করে বলে, “আমার মতো এত যত্ন কেউ নিতে পারবে তোমার?”
“নেয় তো। তন্নি, মিতু, আশরাফ, মেহেদী আর….”
এদের পরও আরেকজনের নাম আসবে শুনে অবাক হয় জোহান সে মাথা তুলে তাকায় মায়ার দিকে,
“আর?”
“আমেরিকায় আমার এক ফ্রেন্ড ছিলো, ও…”
কথাটা শুনে বিশেষ খুশি হয় না জোহান। যে মুখ নিচে নামিয়ে রাগী রাগী কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, “ওই যে তোমার ত্রিশ বছর পর্যন্ত বিয়ে না হলে যাকে বিয়ে করার প্রমিজ করেছ তার কথা বলছ?”
“হ্যাঁ। ও একবারে জেন্টালম্যান। সবসময় সবার সাহায্য করে। সবার খেয়াল রাখে। আমি যখন ওখানে একা ছিলাম আমাকেও অনেক সাহায্য করেছিল। ওর মতো কেয়ার আর কেউ নিতে পারে না।”
কথাগুলো শুনে জোহান মলম লাগানো শেষে রাগান্বিত মুখে মায়ার পাশে বসে, “তাহলে ওকে তখনই হ্যাঁ বলে দিতে। এই ত্রিশ বছরের ড্রামা করার কী দরকার ছিলো?”
“জানি না, ওকে কখনো বন্ধু থেকে বেশি মনেই করতে পারি নি। ভালোবাসতে পারিনি। ইচ্ছাও ছিলো। দ্বিতীয়বার এই ডিপ্রেশনে সেশন কে পাড় করবে? ধ্যুর!” সে কিছুটা চিন্তা করে জোহানের দিকে তাকায়, “আচ্ছা ভালোবাসা কীভাবে বুঝা যায়?”
“তোমার তো জানার কথা।”
“সেটা তো বহু আগে। এত্তো মোটা মোটা বই পড়েছি ওগুলোকে মাথায় স্পেস দেওয়ার জন্য ওসব আউট করতে হয়েছে।”
“তুমি দেখি এখন আর ব্রেকাপের কথা তুললে রাগী মোডে এসে পড়ো না উল্টো নিজেই মজা উড়াচ্ছো।”
জোহান হেসে বলে। পিছনে হেলান দিতেই তার পিছনে খোঁচা লাগে। সে পিছনে ফিরে বলে, “তোমার সোফায় কিছু আছে।”
সে কুশনের পিছনে হাত দিতে গেলে ঘাবড়ে যায় মায়া। সেখানে তো সে জোহানের ডায়েরি লুকিয়েছে। সে ভেবে উঠতে পারে না কি করবে! চিন্তা ভাবনা না করেই সে জোহানের শার্টের কলার ধরে নিজের দিকে টান দেয়।
জোহান তার মুখোমুখি এসে পড়ে। সে বুঝে উঠতে পারে না কি হলো সবে মাত্র!
কাছাকাছি আসার পর দু’জনের চোখে চোখ পড়ে। একমুহূর্তে জন্য যেন সময় থেমে যায়। জোহান তখনও কোনো প্রশ্ন করে না। অপলক তাকিয়ে থাকে মায়ার দৃষ্টিতে। তাকে বিরক্ত করছিল মায়ার মুখের সামনে আসা চোখগুলো। সে আলতো আঙুলে তা সরিয়ে কানের পিছনে গুঁজে দেয়। দু’জনে ডুব দিয়েছিল একে অপরের দৃষ্টির সাগরে। মায়ার হুঁশ আসে, সে চোখ সরিয়ে নেয়। জোহান খানিকটা বিরক্তির স্বরে জিজ্ঞেস করে, “এভাবে টান দিলে কেন?”
মায়া নিজের তার হাত জোহানের মুখের সামনে রাখে, ” খালি হাতে চা’য়ের পাতিল ধরেছিলাম। মলম লাগিয়ে দেও।”
জোহান তার হাত ধরে দেখে হাতে ভালোই পুড়েছে। তার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়, “তুমি নিজের একটু খেয়ালও রাখতে পারো না? গরম পাতিলে কে হাত দেয়?”
“তোমারই দোষ।”
“আমার দোষ? আমি তোমাকে বলেছিলাম যে পাগলের মতো গরম পাতিলে যে হাত দিতে।”
মায়া চুপ করে যায়। সে কিভাবে বলতে পারে যে তার খেয়ালে ডুবে থাকার পরিণাম। ডাইরি লেখা পড়ার পর কিছুতেই আর মন বসছে না।
জোহান ডান হাতে মলম লাগিয়ে যাবার সময় বললো,
“তুমি জিজ্ঞেস করেছিলে কাওকে ভালোবাসলে কীভাবে বুঝা যায় তাই না? ভালোবাসা নামক প্রশ্নের উওর কোনো একটা হতেই পারে না। ভিন্ন মানুষের জন্য ভিন্ন অনুভূতি হয়। তবে আমার যতটুকু মনে হয় ভালোবাসলে ভালোবাসার মানুষের কথাই কেবল মাথায় ঘুরে, তাকে না দেখল ব্যাকুলতা কাজ করে, সারাক্ষণ তাকে দেখতে মন চায়, তাকে দেখলে হার্টবিট দৌড়াতে থাকে, তার চোখে চোখ পড়লে চোখ সরাতে ইচ্ছা হয় না, কেবল ইচ্ছা হয় মুহূর্তটা যেখানেই থেমে যায় যেন। তার সাথে এভাবেই কাটাতে ইচ্ছা হয়। তাকে সারা পৃথিবীর কাছ থেকে রক্ষা করতে ইচ্ছা করে। আরও কতকিছু… ”
সে মায়ার দিকে তাকায়। মায়া তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো কিন্তু তার তাকানোর সাথে সাথে সে চোখ সরিয়ে নেয়। জোহান তার হাত ছাড়লে সে সোজা হয়ে বসে। বলে, “তোমার সব কথার সাথে আমি একমত হলেও একটি কথার সাথে আমি একমত নয়। ভালোবাসা কী বা কীভাবে হয় আমি কিছুই বুঝতাম না। একদিন তন্নি বলেছিল আমরা যখন কাওকে ভালোবাসি তখন তার চোখে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারি না। হৃদয়ের স্পন্দন এত বেড়ে যায় যে মনে হয় আরেকটু তাকিয়ে থাকলে নিজেই শেষ হয়ে যাব সামনের জনের ভালোবাসায়।”
“তাহলে তোমার শেষ এমন কখন মনে হয়েছে?” জোহান মায়ার দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করে।
তার প্রশ্ন শুনে তাকায় জোহানের দিকে। কি উওর দিবে বুঝে উঠতে পারে না। সে আমতা-আমতা করে বলে, “আমার প্রচুর ঘুম পাচ্ছে। গতকাল রাতে ইনারার সাথে মুভি দেখেছিলাম তো।”
“আচ্ছা তুমি বসো আমি এসব পরিষ্কার করে দিয়ে যাচ্ছি।”
“প্রয়োজন নেই…”
“না করলে তুমি আবার কাঁচ পা’য়ে ঢুকিয়ে বসে থাকবে।”
বলে জোহান উঠে প্রথম কাজ করে জায়গাটা পরিষ্কার করে। তারপর মায়ার জন্য রঙ চা বানিয়ে বেইড সাইড টেবিলে রেখে যায়। যাবার আগে জিজ্ঞেস করে, “তুমি আগামীকাল একা যেও না। আমি নিয়ে যাব।”
মায়া মাথা নাড়ায়। রাজি হয় সে।
জোহান যাবার পর সে এসে ডায়েরিটা আবার বের করে। তা ধরে বলে, “আমি তোমাকে কিভাবে বলবো শেষ এমনটা তোমার সাথেই হয়েছে। তোমার চোখেই চোখ রাখতে পারি না আমি। তোমাকে দেখলে, তোমার কন্ঠ শুনলে, তোমার চোখে চোখ রাখলে আমার হৃদয়ের স্পন্দন দিশেহারা হয়ে যায়৷ ইচ্ছা হয় মুহূর্তটা সেখানেই থেমে যায়। এটাই কী তাহলে ভালোবাসা? আমি কী তোমাকে ভালোবাসি জোহান?”
.
.
আজ সুরভি সকাল থেকে ব্যস্ত। তৌফিকের ইন্টারভিউ আছে আজ। সবাই এই ইন্টারভিউ এরজন্য খুবই উৎসুক। কেননা তৌফিক সোশ্যাল মিডিয়াতে তেমন আসে না। কিন্তু আজ তাদের চ্যানেলে আসছে। সবাই নিশ্চিত এই ইন্টারভিউ টিভিতে আসার পর তাদের চ্যানেল অনেক জনপ্রিয় হয়ে যাবে৷ তাই সবাই লেগে আছে যেন সবকিছু সঠিক হয় ইন্টারভিউতে। তেমন হয়ও। ইন্টারভিউ খুব ভালো যায়। সবাই তাদের ইন্টারভিউ দেখছিল। ইন্টারভিউ শেষ হবার পর ম্যানেজার এসে সুরভিকে জানায় তৌফিক তার সাথে দেখা করতে চায়। সে একবার অবাক হলেও ভাবে হয়তো সেদিন পার্টিতে দেখার পর তাকে চিনেছে তৌফিক। তাই কথা বলার জন্য ডাক দিয়েছে।
তৌফিক তখনও সেটআপের সোফায় বসেছিলো। তার হাতে ছিলো এককাপ চা। সে সুরভিকে দেখে উঠে দাঁড়ায়,
“কেমন আছেন?”
“এইত্তো আলহামদুলিল্লাহ। আপনি আমাকে এখানে দেখে মনে রেখেছেন ভেবে অবাক হলাম।”
“আমি তো আপনার জন্যই এখানে এলাম।”
কথাটা শুনে সুরভি অবাক হয়। সে জোর করে ঠোঁটে হাসি রেখে জিজ্ঞেস করে, “মানে?”
“বসুন।” তৌফিক তার সামনের সোফার দিকে ইশারা করে বলে। সুরভি বসলে সেও নিজের সোফায় বসে।
সুরভি খেয়াল করে তাদের আশেপাশের লোকগুলো এক এক করে চলে যাচ্ছে। কিন্তু সে বুঝতে পারে না যে ঠিক কি হচ্ছে এখানে।
তৌফিক তাকে বলে, “আমি আপনার সাথে কিছু জরুরী কথা বলতাম। তাই আপনার ম্যানেজারকে বলেছি যেন আশেপাশে কেউ না থাকে।”
“কী কথা?”
“আপনি একটু শান্ত মাথায় আমার কথা শুনেন। আমার মনে কিছু প্রশ্ন ছিলো। আমার মনে হচ্ছে তার উত্তর আমি আপনার কাছে পাবো। তাই এলাম এখানে।”
“বলুন।”
“মেঘলার ছোট ভাই মিদুল। ওর সকল বন্ধুর সাথে কিছু না কিছু খারাপ হচ্ছে। কেউ জেলে, আর কেউ মৃত্যুর দরবারে ঝুলছে। সেদিন আপনার ফোনে আমি মিদুলের ছবি দেখেছি।”
সুরভি ঘাবড়ে যায়, “আমি…ওই হয়েছে কি…”
তৌফিক তাকে শান্ত গলায় বলে, “ঘাবড়ানোর কিছু নেই। যদি কিছু জানেন তাহলে, আপনি আমাকে শুধু সত্যি কথাটা বলুন। আমি জানি যে ওর বন্ধুরা কেউ এত ভালো ছিলো না। যদি ও ভুল কিছু করে তাহলে আমি নিজে ওঁকে আইনের আওতায় এনে শাস্তি দিব।”
কথাটা শুনে প্রাণে প্রাণ ফিরে সুরভির। সে এক শান্তির নিশ্বাস ফেলে বলে, “ক’দিন আগে নিরা নামক একটি মেয়ের ধর্ষণের আরোপে কেইস করা হয়েছিল তাদের পাঁচজনের উপর। বিচার না আসায় মেয়েটা আত্ন*হত্যা করে। আমার বান্ধবী আমাকে কেইসটা সম্পর্কে বলেছিল। আমি সেকারণে সবার তথ্য নিচ্ছিলাম। কেইসটা স্টাডি করার জন্য। সেদিন মিদুলকে দেখে ওর ছবির সাথে মিলাচ্ছিলাম। আমি জানতাম না ও মিসেস মেঘলার ছোট ভাই।”
“আপনার যা তথ্য জোগাড় করেছেন তা কি আমাকে দিতে পারবেন? আমি ওয়াদা দিচ্ছি খোঁজ নেবার পর যদি ও দোষী বের হয় তাহলে আমি নিজে ওকে কঠিন শাস্তি দিব।”
“জ্বি, পাড়ব।”
“গ্রেট তাহলে আগামীকাল অফিস শেষে আমার এক লোক আসবে আপনার কাছে।”
“ঠিকাছে।”
তৌফিক চা’য়ের কাপ টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়ায়, “তাহলে আসি।” সে হাত বাড়ায় সুরভির দিকে হ্যান্ডসেকের জন্য।
সুরভিও তার সাথে হাত মেলায়।
তৌফিক যেতে নিলেও একবার ফিরে তাকায়, “আচ্ছা আপনি নিশ্চিত জানেন না যে মিদুলের বন্ধুদের সাথে এমনটা কে করেছে।”
সুরভি হেসে উওর দেয়, “হয়তো পরিণতি বা বদদোয়া। তারা এতগুলো জীবন নষ্ট করেছে তাদের রুহ এর কষ্ট তাদের বরবার করার জন্য যথেষ্ট।”
তৌফিক হেসে বেরিয়ে যায়। সে যত এগোতে থাকে তার পিছনে ততই তার কর্মী যুক্ত হয়। তার বিশেষ কর্মী তার পিছনে হাঁটছিল। তার হাতে একটি পানির বোতল দেয়। তৌফিক বেরিয়ে সবার আগে হাত ধুঁয়ে রুমাল দিয়ে হাত মুছে। গাড়িতে উঠে সেনিটাইজার হাতে লাগিয়ে বিরক্তির স্বরে বলে, “মিদুলের জন্য কতকিছু করতে হচ্ছে। এই ছোটলোকের সাথে হাতও মেলাতে হয়েছে। নোংরা হয়ে গেছে আমার হাত।”
রাতের সময়, ঘুমানোর পূর্বে কল আসে অভ্রর, “কী খবর আপনার রাণীসাহেবা? আপনার তো আমার কথা মনে পড়ে না সারাদিনে একবার।”
“সারাদিনে কাজের মধ্যে থাকি আমি।”
“আমার তো সারাদিনে কোনো কাজই থাকে না। আমি তো সারাদিন শুয়ে বসে থাকি। সারাদিন আমিও কাজ করি আর তোমাকে কল আর মেসেজ দেওয়ারও সময় বের করি।”
সুরভি হেসে জিজ্ঞেস করে, “তো এখন আপনি কী চান?”
“চাইলেই কী সব দিবে? প্রমিজ?”
“সব না যা দেওয়ার সামর্থ্য আছে। না আপনার মতো টাকা আছে আর না দেওয়ার মতো ভালোবাসা। যা আমার সামর্থে আছে তা চাইতে পারেন।”
“শেষ কথাটা বললে কেন?”
“এর আগের সম্পর্কটা খুব ভয়ানক ছিলো।”
অভ্র খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর জিজ্ঞেস করে, “খুব ভালোবাসতে?”
“সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে যতটুকু লাগে। ভালোবাসতাম না’কি জানি না। কিন্তু ভালো লাগতো। আর এখানে ভালোবাসার ব্যাপারটা বলছি না। একটা সম্পর্ক টিকাতে ভালোবাসা লাগে না কিন্তু বিশ্বাস লাগে ঠিকই। ভালোবাসা ছাড়া সম্পর্ক টিকে বিশ্বাস ছাড়া টিকে না। আর আমার যেকোনো সম্পর্কে যাবার পূর্বে এখন বিশ্বাস আনাটা কষ্টের হবে।”
“আচ্ছা তাহলে আমাকে সময় দিও। সারাদিনে দশমিনিট হলেও হবে।”
সুরভি হাসে তার কথায়। অভ্র তখন কথাটা পালটে নেয়, “আজ সারাদিন কি করলে?”
“সকাল থেকে কাজ করছিলাম। আজ সবচেয়ে বেশি কাজ ছিলো। আজ তৌফিক স্যার আমাদের অফিসে এসেছিল ইন্টারভিউ দিতে।”
“হোয়াট! কে এসেছে?” চমকে উঠে অভ্র।
“ওদিন যার পার্টিতে নিয়ে গিয়েছিলেন।”
” ও তোমাদের অফিসে কেন এসেছিল? তোমার সাথে কথা হয় নি তো? তোমাকে কিছু বলেছে? কোনো সমস্যা তৈরি করেছে তোমার জন্য? ইন্টারভিউ কী তুমি নিচ্ছিলে?”
অভ্রর এমন চিন্তিত ভাব দেখে সুরভি পুরো কথাটা জানায় না তাকে, “ইন্টারভিউ অন্য একজন নিয়েছিল। আমি কেবল প্রশ্ন তৈরি করে দিয়েছি। তারপর পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলাম।”
“ওহ…” শান্তির নিশ্বাস নেয় সে, “আচ্ছা শুনো তুমি নিজের খেয়াল রেখো। আমার কাজ আছে।”
আর কিছু বলার পূর্বেই অভ্র ফোন কেটে দেয়। সে অবাক হয় তার এমন প্রতিক্রিয়া দেখে। তার মনে হয় তৌফিক মেঘলার স্বামী বলেই অভ্র এমন করছে। দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে সুরভি। সে ফোনের দিকে তাকিয়ে বলে,
“কারও আগের ভালোবাসা তার মনে এখনও উপস্থিত থাকলে তার প্রতি কিছুতেই আমি অনুভূতি আনার ভুল আবার করব না। এই ভুল দ্বিতীয়বার করব না। তাই আপনাকে কিছু দেওয়ার সামর্থ্য আমার নেই। সময়ও না। আমার ভয় হয়, যদি বেশি সময় আপনার সাথে কাটাই তাহলে…. আপনার প্রেমে পড়ে যাব।”
পরদিন অফিস শেষে সুরভি বাহিরে দাঁড়িয়ে ছিলো নীরার ফাইল নিয়ে। সে অপেক্ষা করছিল তৌফিকের লোকের। একটি গাড়ি তার সামনে এসে দাঁড়ায়। গাড়ি থেকে বের হয় তৌফিকের বিশেষ লোক। যাকে গতকাল সে দেখেছিল তৌফিকের সাথে। সুরভি ফাইল এগিয়ে দেয় তার দিকে, “এই’যে ফাইলগুলো। এখানে সব তথ্য আছে।”
লোকটা ফাইলগুলো নেয় না। উল্টো বলে, “তৌফিক সাহেব আপনাকে রাতের খাবারের জন্য আমন্ত্রণ করেছে। আপনার সাথে কিছু কথা আছে। আপনি গাড়িতে বসুন।”
চলবে…
অনুভূতির খাঁচায়
পর্ব-৩৪
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
“তৌফিক সাহেব আপনাকে রাতের খাবারের জন্য আমন্ত্রণ করেছে। আপনার সাথে কিছু কথা আছে। আপনি গাড়িতে বসুন।”
সুরভি তার দিকে ফাইলটা আবার এগিয়ে দিয়ে বলে, “তৌফিক স্যারের কাছে আমার পক্ষ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিয়েন। আর বলেন, অন্য একদিন আগে থেকে বললে আসব।”
“আপনি তৌফিক সাহেবকে মানা করছেন? জানেন তাদের বাড়িতে বড় বড় ব্যবসায়ী আর নেতা ছাড়া কেউ দাওয়াত পায় না। আর আপনাকে উনি নিজে দাওয়াত দিয়েছেন।”
“এজন্যই তো আমি আদবের সাথে দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করছি। সারাদিন কাজ করে এবং আপনার জন্য এখানে পনেরো মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে আমার এখন শুধু শান্তির ঘুম দরকার। এক কাজ করুন আপনি তৌফিক স্যারকে বলুন এই শুক্রবার দাওয়াতটা রাখতে। আমিও একটু ভালোমতো যেতে পাড়ব। আর এই নিন আপনার ফাইলটা।”
লোকটা ফাইলটা নিয়ে খুলে দেখে সেখানে কেবল মিদুল ও তার বন্ধুদের বায়োডেটা এবং তাদের সকল অপরাধের তথ্য আছে। এসব দেখে লোকটা বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করে, “এসব কী? এটা তো শুধু ওদের তথ্য। তাও ফটোকপি। এসব তো আমরা জানিই।”
“আর পিছনে ওদের সকল অপরাধের তথ্য আছে। তৌফিক স্যার এটাই চেয়েছিল।”
“আপনার কাছে শুধু এতটুকু আছে?”
“হ্যাঁ, তো আর কী থাকতে পারে?” সুরভি নিজেও বুঝতে পারে না। তার কাছে আর কী তথ্য থাকবে?
সে আবার বলে, “আপনার হলে আমি যাই?”
“আপনাকে গাড়িতে ছেড়ে দিয়ে আসি। আসুন।”
“না ভাই থাক, সারাদিন অফিসে বন্দী থেকে দম বন্ধ হয়ে আসে একটু রিকশায় বসে যাই। হাওয়া বাতাস দরকার আছে। আল্লাহ হাফেজ।”
তারপর সে একটা রিক্সা ডেকে উঠে যায়।
বাসায় যেয়ে গোসল করে বের হয়ে দেখে অভ্রর কতগুলো কল এসেছে। চৌদ্দটার মতো। তা দেখে সুরভি ঘাবড়ে যায় একটু। সে তাড়াহুড়ো করে কল করে এবং প্রথম রিং এই অভ্র কল ধরে নেয়।
সুরভি চিন্তিত সুরে বলে, “আপনি এতবার কল করলেন যে? সব ঠিক আছে তো?”
“তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করছ? তুমি আজ কী করেছ? তুমি তৌফিকের লোকের সাথে দেখা করেছ কেন?”
” আপনি কীভাবে জানেন? আপনাকে তো আমি বলিনি? আপনি কী আমার পিছনে লোক লাগিয়েছেন?” সুরভি রাগান্বিত স্বরে বলে।
“তোমার পিছনে আমি কোনো লোক লাগাই নি। যেকরেই হোক আমি জেনেছি। কিন্তু আমি মানা করা সত্ত্বেও তুমি তার সাথে দেখা করলে কেন?”
“আমি নিজে দেখা করতে যাই নি। উনি আমাকে গতকাল ইন্টারভিউ এর পর ডেকেছিল।”
এই কথা শুনে তো অভ্রর মাথায় রক্ত উঠে যায়, “তুমি না মিথ্যা বলো না? আমাকে এত জ্ঞান দেও আর নিজে দেখা করে আমাকে মিথ্যা বলেছ?”
“এই দেখেন মিস্টার অভদ্র আমি কোনো মিথ্যা বলিনি, আপনি যা প্রশ্ন করেছেন তার উওর সত্য ছিলো। আমি কেবল প্রশ্ন লিখেছি, ইন্টারভিউ নেই নি। আর আমি ক্যামেরার পিছনেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। ইন্টারভিউ শেষে উনি আমাকে ডেকেছে, ভালো মানুষ মনে হয় উনাকে তাই আমি গিয়েছি।”
“আমি ছাড়া তো এই পৃথিবীর সবাইকে তোমার ভালো মনে হয়।”
সুরভি কথাটার উওর দেয় না। সে খারাপ মেজাজে চেয়ারের উপর ভেজা তোয়ালে রেখে বিছানায় যেয়ে বসে আর বিনা শব্দে অভ্রকে কতগুলো বকা দেয়।
অভ্র কঠিন গলায় বলে, “এখন মনে মনে না বকে বলো তো কী কারণে তৌফিক তোমাকে ডেকেছে?”
“নীরার কেইসের জন্য। মিদুলের সব বন্ধুর এত বাজে অবস্থা হচ্ছে আর সেদিন তিনি আমার ফোনে মিদুলের ছবি দেখেছিলেন। আর আমি যেহেতু রিপোর্টার তাই তিনি কৌতূহলবশত আমার সাথে দেখা করতে আসলেন।”
“সেদিন বলতে কী তুমি পার্টির দিনের কথা বলছো?”
“দেখেন বকা দিবেন না। আপনি সেদিন এত চিন্তায় ছিলেন তাই আমি আপনাকে কিছু বলিনি। বকা দিবেন না আগেই বলে দিলাম।”
অভ্র গভীর নিশ্বাস ফেলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার যথেষ্ট চেষ্টা করে, “আজ তুমি নীরার কেইসের ফাইল তাদের দিয়েছ?”
“হ্যাঁ, তবে ফটোকপি। তাইফার কাছে সব প্রধান কাগজগুলো।”
“ফাইলে কী ছিলো?”
“কেবল মিদুল ও তার বন্ধুদের বায়োডেটা এবং তাদের অপরাধের আর্টিকেল যতগুলো পেয়েছি।”
“আমি যে ওর বন্ধুদের সাথে এতকিছু করেছি তা বলো নি?”
“বলেছি হয়তো তারা তাদের কর্মের পরিণতি পেয়েছে, নয়তো নীরার রুহ এর বদদোয়া। তারা শাস্তি যার হাত থেকেই পাক, কারণ তো এটাই।”
“তোমাকে যতটা বোকা মনে করেছি এতটাও নও দেখা যাচ্ছে।”
“হ্যাঁ, সব চতুরতা তো আপনার আছেই আছে। আচ্ছা শুনুন, তৌফিক স্যার আমাকে আজ তার বাসায় দাওয়াত দিয়েছিল। যাই নি।”
“জানি। কিন্তু যাও নি কেন? তোমার নজরে তো তার থেকে ভালো আর কেউ হতেই পারে না।”
“দেখুন, ঢাকা শহরে এতগুলো বছর একা চলাফেরা করছি। নিজেকে কীভাবে রক্ষা করতে হয় তার বেসিক নলেজ তো আছে আমার। সেখানে কাওকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি না এর উপর মিদুল এত জঘন্য একটা কাজ করেছে। তাদের সাথে একা যেয়ে নিজের সম্মানকে ঝুঁকিতে ফালানোর প্রশ্নই আসে না। একটা মেয়ের কাছে তার সম্মান সবার আগে আসে।”
“তাহলে আমার সাথে তো একা এসে পড়ো, কেন? আমাকে বিশ্বাস করো বলে?”
প্রশ্নটা শুনে দ্বিধায় পড়ে যায় সুরভিও। সত্যিই অভ্রর সাথে ইদানীং তার অস্বস্তি লাগে না। তার মস্তিষ্ক চায় না কাওকে বিশ্বাস করতে কিন্তু তার মনটা অভ্রর প্রতি আপনা-আপনিই বিশ্বাসটা নিয়ে আসে।
তবুও সে ভাব নিয়ে বলে, “নিজেকে এত গুরুত্ব দেবার প্রয়োজন নেই। আপনি সভ্য ভাইয়ার ভাই হন। আর সভ্য ভাইয়ার মতো ভালো মানুষ আর হয় না। এখন তার মতো ভালো না কিন্তু আপনার মধ্যে তো দুই চারটা গুণ থাকবেই তাই না? আর আপনি ভুল কিছু করলে কি দাদাজান আপনাকে ছেড়ে দিবে না-কি? আপনার জানের একটা ভয় আছে না?”
“হয়েছে হয়েছে বুঝেছি। এবার কাজের কথায় আসো।”
“আচ্ছা শুনুন, আমি এখনো নিশ্চিত না তবুও আপনাকে জানাচ্ছি, আমি বলেছি তৌফিক স্যারকে জানাতে আমি আজ যেতে পাড়ব না। কিন্তু শুক্রবার আমি ফ্রী আছি। যদি উনি আমাকে ডাকে আপনি সাথে যাবেন? প্রধানত আমি আপনার জন্যই শুক্রবারের কথাটা বলেছি, নাহলে বলতাম না।”
“আমার জন্য কেন?”
“সেদিন ফজলু ভাই বলেছিল আপনারা এত চেষ্টার পর মেঘলা আপু সাথে দেখা করতে পাড়ছেন। যেন যদি আপনার মেঘলা আপুর সাথে কোনো কথা থাকে বলতে পারেন।”
অভ্র চুপ থেকে বলে, “কিছু কথা চেয়েও বলা যায় না।”
“তাহলে মানা করে দিব?”
“না না….সেখানে যাওয়াটা আমার জন্য জরুরী।”
“আচ্ছা তাহলে যদি ডাকে, আমি আপনাকে জানাব। এখন রাতের খাবার খাব তো। রাখি তাহলে?”
“আচ্ছা, নিজের খেয়াল রেখো।”
অভ্রর কল রাখার পর সুরভি ফোনটার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ কাঁপা নিশ্বাস ফেলে।
.
.
শুক্রবার সন্ধ্যায় মায়া একটি টিফিনবক্স নিয়ে গেল জোহানদের বাসায়। তার কথামতো জোহানের মা’য়ের জন্য কতরকমের ভর্তা ও জোহানের জন্য গাজরের হালুয়া করে নিলো। সাথে একটি ব্লুবেরি চিজ কেকও।তার হাতে এত রকমের ভর্তা দেখে জোহানের মা হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “এত কিছু তুমি বানিয়েছ? তোমাকে দেখে বুঝাই যায় না তুমি এতকিছু জানো।”
“আমার দাদি সবসময় ভর্তা করতেন। উনার হাতে ভর্তাগুলো অনেক মজার। আমি তার মতো বানাতে পারি না কিন্তু যতটুকু দেখেছিলাম সে হিসেবে বানালাম। আসলে আমার সামনে কাওকে কিছু করতে দেখলে আমি তা করতে পারি।”
“ভালোই তো। ফটোগ্রাফিক ম্যামোরি আছে তোমার।”
মায়া হাসে, “আজমল চাচাও তাই বলে।”
“আজমল?” নামটা শুনে জোহানের মা’য়ের এতবড় হাসিটা মলিন হয়ে আসে। সে জিজ্ঞেস করে, “আজমল চৌধুরী?”
“জ্বি, পরিচালক উনি।”
“ওহ, আমি জানতাম না উনি তোমার চাচা।”
“উনি আমার বাবার চাচাতো ভাই। ইনারার আপন চাচা উনি।”
“ওহ…”
“আপনি না’কি ইনারার আম্মুর অনেক ভালো বান্ধবী ছিলেন। তাহলে তো চেনার কথা।”
“বেশ পুরনো পরিচয়।”
মায়া তার চোখ আশেপাশে বুলায়। জোহানকে না দেখতে পেরে জিজ্ঞেস করে, “জোহানকে দেখতে পারছি না।”
“ও ব্যায়াম করে এসেছে একটু আগে। গোসলে গিয়েছিল।”
“ওহ।”
“আচ্ছা তুমি বসো আমি রান্নাঘরে এসব রেখে দ্রুত কিছু বানিয়ে আনছি।”
“আন্টি প্রয়োজন নেই। আমি চলে যাচ্ছি।”
“একদম না। আজ তুমি রাতে আমাদের সাথেই খাবে।”
“আন্টি আমি….”
“তুমি না থাকলে আমি মন খারাপ করব।”
“ওকে আন্টি সারেন্ডার করলাম। আমি আছি।”
সৌমিতা হেসে রান্নাঘরে চলে গেলেন।
মায়া সুযোগ বুঝে গেলে জোহানের রুমে। সেখানে যেয়ে দেখে জোহান এখনো বের হয় নি ওয়াশরুম থেকে। সে তার ব্যাগ থেকে ডায়েরিটা বের করে তার বুকসেল্ফের কিছু বইয়ের পিছনে রেখে দেয়। সে জোহানের সম্পূর্ণ ডায়েরি পড়ে নি, কিন্তু বাকি পৃষ্ঠাগুলো ছবি তুলে রেখেছে। সে এখানে ডায়েরিটা রেখে শান্তির নিশ্বাস ফেলে। এতদিন এই ডায়রিটার জন্য সে ভয় ছিল। হঠাৎ শব্দ হয়। শব্দ শুনে সে পিছনের দিকে তাকায়। দেখে জোহান ওয়াশরুম থেকে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বের হচ্ছে। সে কেবল টাওজার পরা। তার গায়ে কোনো শার্ট বা টি-শার্ট কিছু নেই। সাথে সাথে সে চোখ বন্ধ করে পিছনে ফিরে যায়।
“তুমি এখানে কী করছ?” জোহান তাকে দেখে অবাক হয়।
“আমি…আমি… আমি তো কিছু খাবার নিয়ে এসেছিলাম। আন্টির জন্য। আন্টি আমাকে বলল রাতে না খেয়ে যেতে না। এমনেই ঘুরেফিরে দেখছিলাম। তোমার রুমে বইয়ের কালেকশন দেখে থেমে গেলাম।”
কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থাকে কক্ষটা। হঠাৎ করে মায়া দেখে জোহানের হাত তার কাঁধের পাশ দিয়ে সামনে যেয়ে একটি বই তুলছে, সে বলে, “তোমার বই পড়ার ইচ্ছা থাকলে এটা পড়ে দেখতে পারো সুন্দর আছে।”
মায়া ভাবে জোহান এতক্ষণে শার্ট পরে ফেলেছে তাই সে পিছনে ফিরতেই আবার চোখের উপর হাত রেখে নেয়।
“তুমি শার্ট না পরে এমন ঘুরঘুর করছ কেন?”
“তুমি এমন এবনরমাল বিহেভ করছ কেন?”
“আমি এবনরমাল। বিহেভ করছি? তুমি বেশরমের মতো বিহেভ করছ? কেউ কারও সামনে এভাবে ঘুরে?”
“দেখো আমার যখন ফটোশুট হয় তখন শতমানুষের সামনে এভাবে থাকতে হয়। আমার জন্য এটা নরমাল।”
মায়া পাশ কেটে যেতে নিলে জোহান তার সামনে এসে দাঁড়ায়। মায়া অন্যদিকে যেতে নিলে সে আবারো এসে বিরক্ত করে। মায়া রাগ হয়ে এবার তার দিকে তাকিয়েই জিজ্ঞেস করে, “কী সমস্যা তোমার?”
জোহান তার গাল টেনে বলে, “তুমি এমন লাল টমেটো হয়ে গেলে কেন?”
মায়া দেখতে পায় জোহানের চুল থেকে এখনো টুপ টুপ করে পানি তার মুখে পড়ছে। তাকে ভীষণ সুদর্শন দেখাচ্ছে। তার চোখ যেয়ে আটকায় জোহানের চোখে। তার তাকানোটা কেমন মারাত্নক। যেন দৃষ্টি দিয়েই হৃদয়হরণ করে নিবে। জোহানের কাছ থেকে সুগন্ধি আসছে একরকম। যা তার প্রতি ভীষণ আকর্ষণ অনুভব হচ্ছিল মুহূর্ত। তার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল হঠাৎ করেই। সে জোহানের ডায়েরিতে পড়েছিল, তারও না’কি মায়ার চোখে তাকালে এভাবেই হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। তার খুব জানতে ইচ্ছা করছিল, কথাটা কী সত্য?
সে হাত তুলে, জোহানের বুকে হাত রেখে দেখবার জন্য কিন্তু তার এত সাহস আসে না। সে উল্টো চোখ নামিয়ে নেয়। মায়া নিজের প্রতিই অবাক লাগে, সে কারো মুখের উপর কিছু বলতে দ্বিধাবোধ করে না। কিন্তু এই মানুষটার চোখে চোখ মেলাতেও পারে না।
হঠাৎ জোহান তার থুতনিতে হাত রেখে তার মুখ তুলে বিরক্তির সুরে বলে, “এই তুমি বারবার এভাবে চোখ নামিয়ে নেও কেন?”
“তুমি আমার চোখে তাকিয়ে থাকো কেন?”
“আমার ভালো লাগে।”
“কেন?”
“জানি না।”
“না জানা কিছু করাটা ক্ষতিকর হতে পারে। হয়তো স্বাস্থ্যের জন্য, নাহয় মনের জন্য।”
কথাটা বলে সে যেতে নিলে জোহান তার কাঁধের অন্যপাশে হাত রেখে দেয়।
“কী করছ তুমি?” মায়া প্রশ্ন করে।
“জানি না।”
“আর দুইসাপ্তাহ পর তোমার জন্মদিন এবং সাথে এলবাম রিলিজ। মুখের আকৃতি বিগড়ে যাবার কাজ করো না।”
“আচ্ছা কি করবে তুমি?” বলে জোহান তার একটু কাছে আসতেই সে জোহানের পা’য়ে সজোরে লাথি মেরে পালিয়ে যায়। যাওয়ার আগে জিহ্বা বের করে ভেঙিয়ে যায়, আর বলে, “বের হবার আগে কিছু পরে নিও।”
.
.
সুরভি তৈরী হচ্ছিল। এর মধ্যে টিভিতে এক সংবাদ আসে। মিদুল নিজে একটি ভিডিও ক্লিপে সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট করেছে যেখানে সে স্বীকার করেছে যে নীরার ধর্ষণ তার সাথে তার চার বন্ধুও করেছে। তার দুলাভাই তৌফিক এই কথাটা জানার পর তাকে এসে বুঝিয়েছে এবং তার অপরাধ স্বীকার করে শাস্তি ভোগ করার কথা বলেছে।
এই ভিডিওটা সকালে ছাড়া হয়েছিল। দুপুরে মিদুল নিজে যেয়ে সেরেন্ডার করেছিল পুলিশের কাছে এবং বিকেলে তৌফিকের পক্ষ থেকে তাকে আমন্ত্রণ পাঠানো হয়েছে। ব্যাপারটা বেশ আজব কিন্তু তৌফিক নিজের কথা রেখেছে দেখে ভালো লাগে সুরভির।
সে বের হয় তৈরি হয়ে। তার গলির মাথাতেই দেখতে পারে অভ্রের গাড়িটাকে। সে উঠে বসে গাড়িতে। সে গাড়িতেই বসে জিজ্ঞেস করে, “নিউজ দেখেছেন?”
“দেখলাম তো।”
“আমি বলেছিলাম না, তৌফিক স্যারকে আমার ভালো মনে হয়।”
অভ্রর চোখ ছিলো মোবাইলের দিকে। সে সুরভির কথা শুনে বাঁকা হেসে তাকায় তার দিকে,
“তোমার মনে হয় তৌফিক এই কাজটা ন্যায় বলে করেছে?”
“একারণেই তো করেছে।”
অভ্র হাসে তার কথায়, “ও এমনটা করেছে যেন সত্যিটা আসার পর তার কোন বদনামি না হয়। কোনো ক্ষতি না হয়। ওর বাবার পজিশনের যেন কোনো ক্ষতি না হয়। এতবড় খবর বাহিরে এলো কিন্তু দেখো এখন ওর বাহবা হচ্ছে। তুমিও করছো।”
“আপনার সাথে কথা বলাটাই ভুল ছিলো। আপনি নিজেই বলেন আমি কেবল নেগেটিভ কথা ভাবি ও বলি। এখন পজিটিভভাবে বলছি তাও আপনি এভাবে বলছেন।”
কথাটা বলে সুরভি মুখ ফুলিয়ে অন্যদিকে মুখ করে নেয়।
“আমি ওভাবে বলিনি।”
সুরভি উওর দেয় না।
অভ্র আবার বলে, “আচ্ছা আমার কথা তো শুনো।”
তাও সুরভি উওর দেয় না। সে মুখ ফুলিয়ে অন্যদিকেই তাকিয়ে থাকে। তাই অভ্রও আর জোর করে না তাকে। সে-ও চুপ হয়ে যায়।
গাড়ি যেয়ে থামে এক মহলের সামনে। অভ্র সবার পূর্বে গাড়ি থেকে নেমে সুরভির জন্য হাত বাড়ায়। কিন্তু সুরভি তাকে এড়িয়ে নিজেই বের একপাশ দিয়ে। সে সুরভির হাত ধরলেও সুরভি হাত ছাড়িয়ে নেয়।
“তুমি এখানেও রাগ দেখাবে?”
সুরভি ভেংচি কেটে অন্যদিকে মুখ করে নেয়।
অভ্র তার এমন বাচ্চামো মাখা অভিমান দেখে হাসে। সে হাত কণুই ধরে নিজের দিকে টান দিলে সুরভি তাকায় তার দিকে।
“কী চাই?” সুরভি জিজ্ঞেস করে।
“রাগ করলে কিউট লাগে তোমাকে।”
অভ্রর মুখ থেকে নিজের প্রশংসা শুনে গাল লাল হয়ে যায় সুরভির। সে বলে, “এতগুলো মানুষের সামনে এমনভাবে চিপকাচ্ছেন কেন?”
“এতগুলো মানুষ দেখে কি হয়েছে? আমার হবু বউ তুমি, তোমাকে আমার কাছে না রাখলে কাকে কাছে রাখব?”
সুরভির লজ্জায় চোখ সরিয়ে নেয়। সে অনুভব করতে পারে অভ্র তার কণুই থেকে হাত নিচের দিকে এনে তার আঙুলে আঙুল ডুবিয়ে শক্ত করে ধরে তার হাত।
সাথে সাথে কেঁপে উঠে সে। তাকায় অভ্রর দিকে।
তখনই তাদের সামনের দরজা খোলা হয়। সামনে থেকে আসে তৌফিকের এক লোক, “আসসালামু আলাইকুম, আমি তৌফিক সাহেবের কর্মী। আমার নাম নাজিম। তৌফিক সাহবে আপনাদের অপেক্ষা করছেন।”
সুরভি তার সালামের উওর দেয়। কিন্তু লোকটা অভ্রর দিকে তাকিয়ে ছিলো। ইশারায় কিছু একটা বলে। সে তাকায় অভ্রর দিকে, অভ্রও তার কথার উওর দেয়। সুরভি তাদের ইশারা বুঝতে না পাড়লেও এতোটুকু বুঝতে পারে যে অভ্র সেদিন তৌফিকের লোকের সাথে দেখাটা এই ব্যক্তি দ্বারাই জেনেছে। কিন্তু সে এ ব্যাপারে অভ্রকে এখন কিছু জিজ্ঞেস করে না।
তারা বাড়ির ভেতরে যায়। সুরভি দেখতে পায় তৌফিক দোতলার সিঁড়ি দিয়ে নামছে। অভ্রর উপর তার চোখ যেতেই তার মুখের হাসিটা কিছু মুহূর্তের জন্য বিরক্তিতে পরিবর্তন হয়। কিন্তু সে আবারও সে হাসিটা আনতে সক্ষম হন। সে নিচে নেমে সুরেভিকে দেখে বলে, “আসার জন্য ধন্যবাদ। আমি চিন্তা করছিলাম আপনি আবার আগেরদিনের মতো মানা না করে দিন। আর আপনি আরেক বিশেষ মেহমান এনেছেন তাও দেখে খুশি হলাম।”
সুরভি জোরপূর্বক হাসে। কারণ একটু আগের তৌফিকের বিরক্তির এক ঝলক সে দেখেছে। সে বলে, “আমন্ত্রণের জন্য ধন্যবাদ স্যার।”
“আপনাকে ধন্যবাদ। আপনার জন্য আমি মিদুলের এত জঘন্য ভুলের জন্য তার সাথে কথা বলতে পাড়লাম। বুঝাতে পাড়লাম তাকে যে সে কত বড় গুনাহ করেছে। আর ও নিজে কনফেশন করার জন্য রাজি হয়েছে। ভালো কিছু করেছি, জিনিসটা ভেবে অনেক শান্তি লাগে। আশা করি এখন মেয়েটার আত্না শান্তি পাবে।”
সে আবার অভ্রর দিকে তাকিয়ে বলে, “সেদিন পার্টিতে আপনার সাথে দেখা হয় নি কিন্তু আপনার অনেক কথা শুনেছি। বাবা জানাল আপনি না’কি খুব বুদ্ধিমান। কথাটা সত্য?”
“নিজের প্রশংসা নিজের মুখে কীভাবে করি?”
“আমি বুঝতে পাড়ছি বাবা আপনার উপর এত ইম্প্রেস কেন হয়েছে! বাই দ্যা ওয়ে, আপনাকে না আমার অনেক চেনা চেনা লাগে। কোথাও দেখেছি আপনাকে।”
“হয়তো আপনার বাবার সাথে, নাহলে টিভিতে। আপনার মতো লুকিয়ে থাকার অভ্যাস তো নেই আমার তাই টিভিতে প্রায়ই আসি। আর আপনাকে দেখেও আমার এক কাছের বন্ধুর কথা মনে পড়ে।”
নুপুরের শব্দ আসে এমন সময়। সুরভি চোখ তুলে দেখে মেঘলা নামছে সিঁড়ি দিয়ে। হাল্কা গোলাপি রঙের এক শাড়ি পরা সে। সাজুগুজু করা। সুরভি মেয়ে হয়ে নিজেই তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়। সে হাসিমাখা মুখে বলে, “আপনার ওয়াইফ সত্যিই খুব সুন্দর।”
তারপর কিছু একটা ভেবে তার হাসিটা মলিন হতে শুরু করে। সে তাকায় অভ্রর দিকে। সে মেঘলাকেই দেখছিল।
সুরভি আবার তাকায় মেঘলার দিকে। সে এক কদমও বাড়ায় নি। সে তাকিয়ে ছিলো অভ্রর দিকে। তার চোখেমুখে আতঙ্ক ও ভয় স্পষ্ট ভেসে উঠেছে।
চলবে…