#অনুরাগে_সখি_নিভৃতে_যতনে
#মৌপ্রিয়া_ইসলাম_মিহি
#পর্ব_০৩
___________________________
তারিনি রুমে গিয়ে বেলকনির রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আকাশের চাঁদ দেখছে।আশহির গিয়ে তার পাশে দাঁড়ালো।তারিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
-“একটু আগে কি বললে?মেনে নিতে?কি মেনে নিবো আশহির?চার বছর প্রেম করে দুই বছর হলো বিয়ে হয়েছে আর এর মধ্যে তুমি নাকি আমি আর বেশিদিন বাঁচবো না শুনে আরেকটা মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছো!এটাই মেনে নিতে বলছো?”
-“তারিনি বারবার মা*রা যাওয়ার কথা বলো না।”
-“ব্রেইন ক্যান্সার হলে বেঁচে থাকা যায় না!”
-“এটা তোমার ভুল ধারণা।সঠিক চিকিৎসা হলে সবই সম্ভব।আর এখন চিকিৎসা প্রযুক্তি অনেক উন্নত হয়ে গিয়েছে।দুইজন ডাক্তার না হয় বলেছেন উনাদের পক্ষে কিছু করা সম্ভব না আর তুমি বেশিদিন……এটুকু বলে থামলো আশহির।তারপরে নিজেকে সামলে বললো,
-“যাই বলেছেন আমি তা বলতে চাচ্ছি না।তাতে কি হয়েছে!আরো অনেক ডক্টর আছে।আমি উনাদের কাছে তোমাকে নিয়ে যাবো।আমি জানি তোমার কিছু হবে না।আমার তারিনি আমারই থাকবে!”
তারিনি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
-“আমার তারিনি!এই কথাটা বলতে লজ্জা লাগছে না?এতো ভালোবাসা যে দেখাচ্ছো তাহলে মৌরিনকে কেনো বিয়ে করে আনলে তুমি?তুমি একসাথে দুইটা মেয়ের জীবন নিয়ে খেলা করতেছো!আর বিশ্বাস করো তুমি যখন মৌরিনকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছো না আমি তখনই ভিতরে ভিতরে ম*রে গিয়েছি।তাই আমার বাঁচার আর বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই।শুধু যেই কয়দিন আছি আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দেও।”
তারিনি কথাগুলো বলে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো।পরক্ষনেই কিছু ভেবে উঠে বসে বললো,
-“তুমি তো রাতে কিছু খাওনি।চলো তোমাকে খেতে দেই।মৌরিন মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে!”
-“থাক দরকার নেই।তুমি ঘুমিয়ে পড়ো আমি একা খেয়ে নিতে পারবো!”
তারিনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
-“তোমার ইচ্ছা!আর হ্যাঁ তুমি আমার সাথে এক বিছানায় ঘুমাবে না!”
কথাটা বলে সে বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল।আশহির কিছুক্ষণ তারিনির দিকে তাকিয়ে থেকে রুম থেকে বের হয়ে চলে গেল।আশহির রুম থেকে চলে যেতে তারিনি চোখ খুলে বললো,
-“আমাদের এতো সুন্দর সম্পর্কটা তুমি নিজেই নষ্ট করে ফেলেছো আশহির!”
আশহির খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করছে তার খেতে ইচ্ছা করছে না।সে খাবার রেখে উঠে পড়লো।রুমে গিয়ে দেখলো তারিনি ঘুমিয়ে পড়েছে।আশহির লাইট অফ করে তারিনির পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
.
.
.
সকালে ঘুম ভাঙতে তারিনি দেখলো আশহির তার পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে।যা দেখে তারিনির মেজাজ বিগড়ে গেল।সে আশহিরকে ডেকে ঘুম থেকে তুললো।আশহির উঠে বসে ঘুম ঘুম চোখে বললো,
-“কি হয়েছে তারিনি?সকাল সকাল এভাবে ডাকছো কেনো?”
-“তোমার সমস্যা কি আশহির?আমি তোমাকে আমার সাথে ঘুমাতে নিষেধ করেছিলাম!”
আশহির হাই তুলে বললো,
-“তো?তুমি বললেই কি তা শুনতে হবে?আমার ইচ্ছা হয়েছে আমি ঘুমিয়েছি।আর হ্যাঁ আমি আরো কিছুক্ষণ ঘুমাবো।আমাকে এখন আর ডাকাডাকি করো না প্লিজ!”
আশহির বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো।তারিনি রাগে বিড়বিড় করতে করতে ওয়াশরুমে চলে গেল।তারিনি ওয়াশরুমে যেতে আশহির মুচকি হেসে বললো,
-“তুমি যতই আমাকে দূরে সরিয়ে দেও না কেনো আমি কিছুতেই তোমার থেকে দূরে সরে যাবো না তারিনি!”
–
–
–
সকালে ঘুম থেকে উঠে মৌরিন রেডি হয়ে নিল।কারণ তার আজকে আশহিরের বিরুদ্ধে কিছু প্রমাণ জোগাড় করতে হবে।মৌরিন রুম থেকে বের হয়ে নিচে গিয়ে বাড়ি থেকে বের হতে যাবে এমন সময় তারিনি বললো,
-“তুমি কি কোথাও যাচ্ছো মৌরিন?”
মৌরিন বাড়ি থেকে বের হতে গিয়ে থেমে গেল।তারিনির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,
-“হ্যাঁ আমার একটু কাজ আছে।”
-“সকালের নাস্তা করে যাও।সব রেডিই আছে।”
-“না থাক আমি অফিসে গিয়ে খেয়ে নিবো।”
আশহির সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে তারিনি আর মৌরিনের কথা শুনতে পারলো।সে তাদের সামনে এসে বললো,
-“তারিনি যখন বলছে নাস্তা করেই বের হন।”
তারিনি আশহিরের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“আমার বলা হয়তো পছন্দ হয়নি,তাই তুমি বলো তাহলে নাস্তা করেই যাবে।”
মৌরিন নিশ্বাস ফেলে বললো,
-“কারো বলার দরকার নেই।আমি অফিসে গিয়েই নাস্তা করে নিবো।”
মৌরিন কথাগুলো বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে চলে গেল।তারিনি রান্নাঘরে যেতে যেতে বললো,
-“মৌরিনের সাথে যাও তুমি।দুজনে বাহিরে একসাথে ব্রেকফাস্ট করে নিও।”
আশহির ডাইনিং টেবিলে বসে বললো,
-“কেনো তোমার কি আমাকে সকালের নাস্তা দিতে সমস্যা হচ্ছে নাকি?”
তারিনি আশহিরের সামনে নাস্তা দিয়ে বললো,
-“মৌরিন না খেয়ে চলে গেল তাই বললাম!”
আশহির খেতে গিয়ে দেখলো তারিনি তাকে অনেক বেশিই খাবার দিয়েছে।আশহির ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“এতো খাবার কিসের জন্য?”
-“রাতে তো খাওনি।তাই দিয়েছি!”
-“তুমি জানলে কি করে?”
-“প্লেটে মাখা ভাত রেখে গেলে মানুষ জানবেই!”
আশহির খেতে খেতে বললো,
-“বাড়ির বাকিরা কোথায়?”
-“বাবা-মা নাস্তা করে রুমে গিয়েছেন আর অথৈ কলেজে!”
আশহির আর কথা না বাড়িয়ে ব্রেকফাস্ট করে অফিসে চলে গেল।
_
_
_
মৌরিন তার ক্যাবিনে বসে কিছু ফাইল ঘাটাঘাটি করছে যেগুলো সে আশহিরের অফিস থেকে আনিয়েছে গোপনীয় ভাবে!ফরহাদ মৌরিনের ক্যাবিনে এসে দেখলো সে ফাইল চেক করছে।কিন্তু মৌরিনের মুখ কেমন যেন শুকিয়ে আছে।ফরহাদ ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“আপনি ব্রেকফাস্ট করেননি?”
মৌরিন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
-“না স্যার।”
-“না খেয়ে আপনি এইসব কাজ করতে বসেছেন?”
-“আসলে স্যার জানেনই তো আশহির মির্জার বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ পাচ্ছি না তাই আরকি!”
-“ক্যান্টিনে চলুন আমার সাথে।”
-“স্যার আপনি যান আমি একটু পরে আসতেছি।”
-“এখনি চলুন!”
মৌরিন আর কথা না বাড়িয়ে ফরহাদের সাথে ক্যান্টিনে গেল।মৌরিন ব্রেকফাস্ট করছে আর ফরহাদ তার সামনে বসে কফি খাচ্ছে।ফরহাদ কফির কাপে চুমুক দিয়ে বললো,
-“আমি তো ভেবেছিলাম আপনি আজকে আসবেন না!”
মৌরিন ব্রেকফাস্ট শেষ করে বললো,
-“কেনো স্যার?”
-“কালকে তো আপনার আর মিস্টার মির্জার বাসর রাত ছিল!”
ফরহাদের কথা শুনে মৌরিন নিঃশব্দে হেসে দিল।তারপরে হাসি থামিয়ে বললো,
-“যেখানে বিয়েটাই মানি না সেখানে বাসর রাত!”
ফরহাদ নিজের বলা কথায় নিজেই বিরক্ত হলো।সে নিশ্বাস ফেলে বললো,
-“আই এম সরি!এইসব কথা বলা আমার ঠিক হয়নি।”
-“ইট’স ওকে স্যার।”
দুজনে আবার কাজে ব্যাক করলো।মৌরিন ফাইল চেক করতে করতে একটা ফাইলে ড্রাগ অর্ডারের কিছু কাগজ পেল।সেগুলো ডেলিভারিও করা হয়েছে আশহিরের কোম্পানি থেকে!মৌরিনের মুখে হাসি ফুটলো।সে কাগজগুলো নিয়ে ফরহাদকে দেখিয়ে বললো,
-“স্যার দেখুন!”
ফরহাদ ফাইলটা চেক করে বললো,
-“একটা প্রমাণ নাহলে পাওয়া গেল কিন্তু উনার তো পাপের শেষ নেই!”
-“তাও স্যার একটা তো পাওয়া গিয়েছে।এতোদিন তো কিছুই পাচ্ছিলাম না!”
-“হুম তা ঠিক।তবে আপনি কি এখনো উনার শাস্তি চান?”
-“শাস্তি না চাওয়ার কি আছে স্যার?”
-“আফটার অল হি ইজ ইওর হাসব্যান্ড!”
মৌরিন ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“আপনার মেইবি বারবার আমাকে এই খোঁটাটা দিতে ভালো লাগছে স্যার!”
মৌরিনের কথায় মৃদু হেসে ফরহাদ বললো,
-“বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন দুজনে এই কথা তো বার বার মুখে আসবেই!”
-“যতই উনার সাথে আমার বিয়ে হোক না কেনো যে অপরাধী সে তার প্রাপ্য শাস্তি পাবেই!”
_________
-“আশহির ভাইয়া এমন একটা কাজ কি করে করলো আমি তো তাই ভাবতে পারছি না!”
নুহাশের কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে অথৈ বললো,
-“এটা তো আমরাও ভাবতে পারছি না।কি থেকে যে কি হয়ে গেল!”
-“তা তারিনি ভাবি কি তোদের বাড়িতে আছে?”
-“ভাবি আমাদের বাড়িতেই আছে।ভাবি বললো যেই কয়দিন বেঁচে থাকবে আমাদের সাথেই থাকবে কিন্তু ভাইয়ার সাথে কোনো বৈবাহিক সম্পর্ক রাখতে চায় না।”
নুহাশ আর কিছু না বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললো।অথৈ নুহাশের কাঁধে মাথা ঠেকালো।নুহাশ অথৈয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।
–
–
–
-“আমাদের মেয়েকে আমরা এই বাড়িতে রাখবো না।আর আমরা কিছুদিনের মধ্যেই আশহিরের সাথে ওর ডিভোর্সের ব্যবস্থা করবো!”
তাহের সাহেবের সাথে তাল মিলিয়ে নিরা বেগম বললেন,
-“হ্যাঁ তুমি ঠিকই বলেছো।তোমার সাথে আমিও একমত!”
তাহের সাহেব এবং নিরা বেগমের এহেন কথা শুনে আহমেদ সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
-“আপনাদের আর আমরা কিভাবে বাঁধা দিতে পারি!আমাদের ছেলে যা করলো তার জন্য আমরাই লজ্জিত।”
অহিদা বেগম কিছু না বলে চুপ করে বসে আছেন।তারিনি সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে সকল কথোপকথন শুনছিল।সে সবার মাঝে উপস্থিত হয়ে বললো,
-“আমি কোথাও যাবো না আম্মু আর আব্বু!”
তাহের বেগম অবাক হয়ে বললেন,
-“কি বলছিস তুই?ওমন একটা ছেলের সাথে সংসার করবি তুই?”
-“আশহির বাদেও এই বাড়িতে আরো লোক আছে আব্বু।আর আশহিরের সাথে আমার সংসার করার কোনো ইচ্ছা নেই।তবো আমি যেই কয়দিন বেঁচে আছি এই বাড়িতেই থাকতে চাই।আর ডিভোর্স!দিবো না!আমি এই কয়দিনে কোনো ঝামেলা চাই না।একটু শান্তি মতো বাঁচতে চাই।তাই তোমরা প্লিজ আমাকে কিছু নিয়ে জোর করো না।”
তারিনি কথাগুলো বলে সিঁড়ি দিয়ে উঠে চলে গেল।
#চলবে……………………
[ভূল-ভ্রান্তি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]