অনুরাগে সখি নিভৃতে যতনে পর্ব-০৭

0
2

#অনুরাগে_সখি_নিভৃতে_যতনে
#মৌপ্রিয়া_ইসলাম_মিহি
#পর্ব_০৭
___________________________
কোনো বাড়ি বা হোস্টেল ভাড়া না পেয়ে মৌরিন হতাশ হয়ে আবার অফিসে ফিরে আসলো।মৌরিনকে দেখে ফরহাদ বললো,

-“তা কোনো থাকার ব্যবস্থা করতে পারলেন?”

মৌরিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

-“না স্যার পাইনি।তবে সমস্যা নেই আজকের মধ্যে পেয়ে যাবো।”

-“আপনি চাইলে আমার বাড়িতে থাকতে পারেন।বাড়িটা ছোট না কিন্তু!”

-“না স্যার সেটা সম্ভব না।এমনিই জীবনে অনেক কথা শুনেছি এখন আপনার সাথে একা এক বাড়িতে থেকে আর কথা শোনার ইচ্ছা নেই।তাই কিছু মনে করবেন না।”

ফরহাদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,

-“ওকে আপনার ইচ্ছা।”

_______________
-“মা চিন্তা করিস না আমার বিশ্বাস কালকে অপারেশনটা হলে তুই একদম ঠিক হয়ে যাবি।তারপরে আমরা তোকে আমাদের সাথে নিয়ে যাবো।”

নিরা বেগম’ তারিনিকে জড়িয়ে ধরে কথাগুলো বললো।তারিনি আর কিছু বললো না।অহিদা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

-“তারিনি তো সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাচ্চাটা হলে আশহিরকে ডিভোর্স দিবে তখনই না হয় একেবারে চলে যাবে।এই কয় মাস থাকুক না এখানে।ও-কে ছাড়া থাকবো ভাবলেই কেমন যেন লাগে আমার!”

-“আপনার ছেলে যা করেছে তারপরে এই বাড়িতে আমার মেয়েকে কেনো রাখবো আমরা?”

নিরা বেগমের কথার বিপরীতে অহিদা বেগম কিছু বলতে যাবেন তার আগে তারিনি বললো,

-“তোমরা আগেই সব ঠিক করে ফেলো না।কালকে আমি ম*রেও যেতে পারি।তাই এইসব নিয়ে এখন কথা না বলাই ভালো।”

অহিদা বেগম গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,

-“এইসব কি বলছিস তুই?তোর কিছু হবে না তুই ঠিক হয়ে যাবি।”

নিরা বেগমও অহিদা বেগমের সাথে তাল মিলিয়ে বললেন,

-“হুম তোর কিছু হবে না মা।আল্লাহ আমাদের সাথে এতো বড় অন্যায় করবেন না।”

আশহির সেই সময় বাড়িতে এসে উপস্থিত হলো।নিরা বেগমকে দেখে সে সালাম দিল।নিরা বেগম সালামের উত্তর দিয়ে সেখানে আর এক মুহুর্ত না থেকে বাড়ি থেকে বের হয়ে চলে গেলেন।আশহির ভ্রু কুঁচকে বললো,

-“মা কি আমাকে দেখে চলে গেলেন?”

অহিদা বেগম চোয়াল শক্ত করে বললেন,

-“তা আবার তোমাকে বুঝিয়ে বলতে হবে নাকি?নিজে কুকর্ম করে আবার প্রশ্ন করে!”

অহিদা বেগম কথাগুলো বলে রুমের দিকে চলে গেলেন।অহিদা বেগম যেতে আশহির তারিনির দিকে তাকালো।আশহির তাকাতে তারিনি বললো,

-“মৌরিনের কোনো খবর জানো?”

-“অফিসে যাওয়ার সময় দেখা হয়েছিল।”

-“তো কি হলো?ও-কে নিয়ে আসলে না কেনো?”

-“উনি আসবেন না।আর আমিও জোর করিনি।”

তারিনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,

-“রুমে গিয়ে ফ্রেশ হও।সন্ধ্যা তো হয়ে গিয়েছে।আমি চা-নাস্তা নিয়ে আসতেছি।”

-“কোনো দরকার নেই তারিনি।কালকে তোমার অপারেশন সেদিকে মন দেও।আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না।”

তারিনি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,

-“ভাবতেছে কে?সৌজন্যবোধ দেখাচ্ছি!নতুন বউও তো চলে গিয়েছে।আর কালকে যদি আমি আর না বেঁচে ফিরি কেউ যেন আমার জন্য বদদোয়া না করে তাই এটুকু বললাম!”

-“আমি তোমার জন্য বদদোয়া করবো?”

-“করতেই পারো।যে বউ বেঁচে থাকতে বিয়ে করে আনতে পারে সে বউ মা*রা গেলে বদদোয়াও করতে পারে।”

তারিনি কথাগুলো বলে রান্নাঘরে চলে গেল।আশহির কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে রুমের দিকে গেল।

_______________________
মৌরিন দেখলো তার থেকে কয়েক কদম দূরে একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে।মুখে মাস্ক আর মাথায় ক্যাপ থাকায় মৌরিন মুখটা দেখতে পারছে না।সে বন্দুকটা হাতে নিয়ে লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,

-“এটা কোনো ফাঁদ হলে আগে বলে দিন।নাহলে কিন্তু আপনার ক্ষতি হয়ে যাবে।”

এতোক্ষণে লোকটা তার মুখ থেকে মাস্কটা খুললো।তারপরে মাথা থেকে ক্যাপটা খুলে কপালে পড়ে থাকা চুল গুলো ঠিক করে বললো,

-“মিস. ওপ্স সরি মিসেস. গোয়েন্দা আমি আপনার ক্ষতি না বরং উপকার করতেই এসেছি।”

লোকটির মুখ দেখেও মৌরিন চিনতে পারলো না।অচেনা মুখ তার কাছে!মৌরিন ভ্রু কুঁচকে বললো,

-“আমি তো আপনাকে ঠিক চিনলাম না?আর আপনি আমার পরিচয় কিভাবে জানেন?”

মৌরিনের কথায় তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তি মৃদু হেসে বললো,

-“আমি হলাম রেজওয়ান মাহতাব।হয়তোবা আপনাদের আসামির খাতায় নাম দেখে থাকবেন।”

-“ওহ্ আচ্ছা আপনিই সেই লোক।আপনার বাবা রায়হান মাহতাব মানে আমাদের মন্ত্রীসাহেব তো খুব ভালো লোক ছিলেন।উনার ছেলে হয়ে আপনার এই হাল কেনো?”

-“কথায় আছে না ‘সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে’ তাই হয়েছে আমার সাথে।তবে এখন আমি শুধরে গিয়েছি।এরজন্যই তো যেটুকু প্রমাণ আছে তা আপনার হাতে তুলে দিতে চাই!”

কথাগুলো বলে রেজওয়ান মৌরিনের হাতে একটা পেনড্রাইভ দেয়।মৌরিন তা নিয়ে বললো,

-“তা আপনি তো আশহির মির্জার বন্ধু ছিলেন আমার জানা মতে।তা আপনি এখন উনারই ক্ষতি করতে চাচ্ছেন!”

-“হ্যাঁ কারণ ও বিশ্বাসঘাতকতা করেছে আমার সাথে।”

-“মানে?”

-“চলুন ওখানের বেঞ্চে গিয়ে বসি এতো কথা দাঁড়িয়ে বলা সম্ভব না।”

মৌরিন সম্মতি জানালো।দুজনে গিয়ে একটা বেঞ্চ বসলো।রেজওয়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করলো,

-“ওর সাথে মিলে অনেক অন্যায় করেছি আমি।তবে ওর মতো বিশ্বাসঘাতকতা করিনি।আমি তারিনিকে ভালোবাসতাম।তবে ও-কে বলার সাহস হয়নি আমার।ও-কে জানাতেও পারিনি কতটা ভালোবাসতাম ও-কে!তবে আশহির সবটাই জানতো।আমি এইসব খারাপ কাজে জড়িয়ে যাচ্ছি দেখে বাবা আমায় জোর করে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিল।দেখতে দেখতে চার বছর কেটে যায় তবে আমি কিন্তু তারিনিকে তখনও ভুলতে পারিনি।একদিন হঠাৎ খবর পাই মিরাজ আর শাফিনের কাছে থেকে,যারা বর্তমানে কারাগারে বন্দী!আশহির নাকি তারিনিকে বিয়ে করেছে আর ওদের নাকি প্রেমের বিয়ে!আমি তখনই দেশে ফিরে আসতে চেয়েছিলাম কিন্তু বাবার কারণে আসতে পারিনি।যেহেতু পুলিশের খাতায় আমার নাম আছে তাই বাবা আমাকে দেশ থেকে দূরেই রেখেছিলেন।আমিও পরে সিদ্ধান্ত নিলাম যাক ওরা যখন একে অপরকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে তাহলে আমি আর ওদের মাঝে আসবো না।কিছুদিন আগে বাবা মা*রা যাওয়ায় দেশে ফিরলাম তখন জানতে পারি তারিনি ওমন অসুস্থ আর তা জানা সত্ত্বেও আশহির বিয়ে করেছে আর সেটা আপনাকে।তাই নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না।ক্ষতি হলে হবে তবুও আমি ওর শাস্তি চাই।”

-“কিন্তু আমাদের বিয়েটা একটা এক্সিডেন্ট!”

-“আমি সবটা জানি।ও চাইলে আপনাকে বিয়ে না করেও বাঁচাতে পারতো।ও বিয়েটা ইচ্ছা করেই করেছে কারণ ও ভেবেছিল বিয়েটা হলে আপনি ওর কোনো ক্ষতি করতে পারবেন না।ওর মানুষের জীবন নিয়ে খেলতে ভালো লাগে!”

মৌরিন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,

-“পেনড্রাইভটায় কি আছে?”

-“যা আপনি এতোদিন ধরে খুঁজছেন তা।তবে ভিডিওতে আমি উপস্থিত থাকলেও তা ছিলাম ও-কে বাঁধা দিতে তবে ও আমার কোনো কথাই শুনেনি।আপনি ভিডিওটা দেখলে বুঝবেন।আর হ্যাঁ চিন্তা নেই।আমি কোথাও পালাবো না।আমার অপরাধের শাস্তি আমি গ্রহণ করবো।”

কথাগুলো বলে উঠে দাঁড়িয়ে রেজওয়ান বললো,

-“বাড়ির ঠিকানা তো জানেনই।অ্যারেস্ট করতে ওখানেই চলে আসবেন।আজকের মতো বিদায়!”

রেজওয়ান চলে গেল।মৌরিন পেনড্রাইভটা হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করছে।তার হার্টবিট ক্রমশ বেড়ে চলেছে।সে উঠে দাঁড়িয়ে একটা রিক্সা নিয়ে অফিসে গেল।অফিসে যেতে ফরহাদ বললো,

-“কোথায় গিয়েছিলেন আপনি?একবার তো জানানো উচিত ছিল আমাকে!”

-“স্যার এবার মনে হয় আমার এতোদিনের কষ্ট স্বার্থক হবে।”

-“মানে?”

-“আশহির মির্জার কুকর্মের প্রমাণ এখন আমার হাতে।”

মৌরিন কথাগুলো বলে পেনড্রাইভটা ফরহাদকে দেখালো।ফরহাদ ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললো,

-“সময় নষ্ট করছেন কেনো?এটা কানেক্ট করুন।”

মৌরিন ল্যাপটপের সাথে পেনড্রাইভটা কানেক্টেড করলো।ভিডিওটা দেখে দুজনে থ হয়ে বসে আছে।মৌরিন আর নিজেকে সামলাতে না পেরে কেঁদে দিল।কাঁদতে কাঁদতে বললো,

-“আমার ওই ছোট বোনটাকে ওই নরপিশাচরা এভাবে মে*রেছি!কি দোষ ছিল মালিহার?ওই রাজের বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হয়নি দেখে এভাবে মে*রে ফেললো?কিভাবে মাথায় আঘাত করলো।ওর তো জ্ঞানও ছিল!সেই অবস্থায় জ্যান্ত……”এটুকু বলে থামলো মৌরিন।সে আর বলতে পারছে না তার গলা আটকে আসতেছে।ফরহাদ নিজেকে কিছুটা সামলে বললো,

-“মৌরিন নিজেকে সামলান।এভাবে কাঁদলে তো চলবে না।এভাবে কাঁদলে মালিহা ফিরে আসবে না।তবে আপনার হাতে এখন প্রমাণ আছে আপনি কিন্তু ওর হত্যাকারীদের শাস্তি দিতে পারেন।তবে ওই লোকটা কে?যে বারবার বাঁধা দিচ্ছিল কিন্তু উনাকেও তো মাথায় আঘাত করে সরিয়ে ফেলেছে সেখান থেকে।”

মৌরিন চোখের পানি মুছে বললো,

-“রেজওয়ান মাহতাব।উনিই আমাকে এই পেনড্রাইভটা দিয়েছেন।”

-“রেজওয়ান মাহতাব?মানে রায়হান মাহতাবের ছেলে?”

-“জ্বি স্যার।ভিডিও দেখে মনে হলো উনার দোষ ছিল না কোনো।রইলো বাকি আর তিনজন।তার মধ্যে দুজনে নিজের অপরাধ স্বীকার করে কারাবন্দী!তবে মেইন কাজটা করেছেন আশহির মির্জা,কিন্তু তার বিরুদ্ধেই কোনো প্রমাণ ছিল না।তবে আজ যখন প্রমাণ পেয়েছি উনাকে আর ছাড়ছি না।”

#চলবে…………

[ভূল-ভ্রান্তি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]