#অনুরিমা
#সূচনা_পর্ব
#মেঘা_সুবাশ্রী (লেখিকা)
কবুল বলার পূর্বমূহুর্তে এক বজ্রধ্বনিতে কাজিসহ উপস্থিত সবাই নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। তাদের বিস্ফোরিত দৃষ্টি সামনে দাঁড়ানো বলিষ্ঠ সুঠাম গড়নের এক যুবকের দিকে। এই যুবককে তারা চিনে না, না কখনো এই গ্রামে দেখেছে। তাহলে এই যুবক কোথা হতে উদয় হলো। উপস্থিত সবার কৌতূহলী দৃষ্টি।
গ্রামের সর্দার জসিম মিয়া। সমাজের একজন মাথা হিসেবে তার দায়িত্ব আছে। দুই বিবাহযোগ্য কন্যা রেখে বাবা আকবর গত হয়েছে বছর দু’য়েক হবে। বড়ো মেয়ের বয়স পনেরো আর ছোটো মেয়ের বারো বছর। বাবা নেই তাই তিনি নিজেই এই বিয়ে ঠিক করেছেন বড় মেয়ের জন্য। কত কসরত করে একটা ছেলে ঠিক করে বিয়ে দিচ্ছেন তিনি। আর এই ছেলে হুট করে এসেই বলছে বিয়ে হবে না। জসিম মিয়ার রাগে মাথার রগ ফুলে উঠলো। তিনিও সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দৈবাৎ আমন্ত্রিত যুবকের দিকে কর্কশ ধ্বনিতে চেঁচালো,
কে তুমি? এসেই আমাদের হুমকি দিচ্ছো এই বিয়ে বন্ধ করতে। তুমি জানো তুমি কার সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলছো? আমার ক্ষমতা সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণাই নেই আমি কি করতে পারি?
সামনে দাঁড়ানো যুবকের মুখে কিঞ্চিৎ হাসির রেখা দিলো। সে তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,
আমি না আপনার পরিচয় জানতে এখানে এসেছি আর নাহ আপনার ক্ষমতা সম্পর্কে। আপনি পনেরো বছরের একটা নাবালিকা মেয়েকে পঁয়ত্রিশ বছরের লোকের সাথে বিয়ে দিচ্ছেন। যার বয়স মেয়েটার বয়সের দ্বিগুণ।একে তো মেয়েটা নাবালিকা যার বিয়ের বয়সই হয়নি তার উপর তার দ্বিগুণ বয়সের একটা বয়স্ক ছেলের সাথে বিয়ে দিচ্ছেন। এত বড় অন্যায় কাজ করছেন তাও আপনার একটু লজ্জাবোধ নাই দেখছি। কেমন সর্দার আপনি? আর এটাই বুঝি আপনার ক্ষমতা? অন্যায় করে জোর জবরদস্তি করে একটা নাবালিকা মেয়ের সাথে তার দ্বিগুন বয়সী পুরুষের বিয়ে দেয়া।
জসিম মিয়া ক্রোধে ফেটে পড়লেন। তার মত একজন গণ্যমান্য ব্যক্তিকে এভাবে অপমান। তিনি তীব্র রোষানলে মুখ নিঃসৃত এক বাক্যই বলে উঠলেন,
বিয়ে তো হবেই। তুমি কেনো তোমার বাপকে নিয়ে আসলেও এ বিয়ে বন্ধ হবে না। কি করতে পারো আমিও দেখি।
যুবকের মুখের আদল পরিবর্তন হলো না। সে তাচ্ছিল্যের সুরে আবারও বলে উঠল,
ঠিক আছে আমিও দেখি আপনি কিভাবে এই বিয়ে দিতে পারেন। পুলিশকে অলরেডি ইনফ্রম করা হয়েছে। তো পুলিশ যদি আপনাকে ধরে নিয়ে যায় তাহলে নাবালিকা মেয়েকে বিয়ে দেয়ার অপরাধে বাল্যবিবাহ নিরোধক ২০১৭ এর ৭ ধারা অনুযায়ী আপনার সর্বোচ্চ শাস্তি হবে দু’বছরের জেল নতুবা মাত্র এক লক্ষ টাকা জরিমানা কিংবা জেল জরিমানা উভয়ই হতে পারে। তো ভেবে দেখুন বিয়ে বন্ধ করবেন কি করবেন না। বাকি’টা আপনার মর্জি।
জসিম মিয়ার রক্তিম চোখ আচমকাই ভীতিগ্রস্ত হয়ে উঠলো। কম বেশি অনেক সুনাম আছে তার। সর্দার আছেন এই গ্রামের টানা পনেরো বছর ধরে। তিনিও কাঁচা খেলোয়াড় নয়, ফন্দি আঁটলেন কিভাবে এই যুবককে শায়েস্তা করা যায়। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তার একজন চ্যালা এসে কানের কাছে কিছু একটা ফিসফিস করে বললেন। এটা শুনেই তিনি একটু দমে গেলেন। এজন্যই এই ছেলের এত সাহস তাকে তার ঘাঁটিতে এসে ধমকাই।
কাজি আতংকিত হয়ে ইতিউতি করছিলো। একপর্যায়ে তার দিকে যুবক তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখলেন। তারপর তাকেও উদ্দেশ্য করে বললেন,
বিয়ে পড়াতে আসছেন কিন্তু আপনি কি জানেন? নাবালিকা মেয়ে বিয়ে পড়ানোর জন্য ছয়’মাসের জেল বা পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা হতে পারে। এমনকি আপনার লাইসেন্সও বাতিল হতে পারে।
ভয়ের ছোটে কাজির আঁখি দু’টি ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। বার বার শুকনো ঢোক গিলতে লাগলো। সে সত্যিই এতকিছু জানতো না।
যুবকটি এবার বরের দিকে তাকিয়ে বিকৃত একটা হাসি দিলেন। বরের সামনে গিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে বললেন,
আমি কি আপনার শাস্তির ধারা বলবো নাকি নিজ থেকে প্রস্থান করবেন। তবে আপনার শাস্তিও কিন্তু ঐ সর্দারের মতই হবে। খুব একটা কম শাস্তি পাবেন না আপনি। দু’জনে সমান সমান করে শাস্তি পাবেন। অন্যায় যেহেতু দু’জনে সমান করেছেন।
বরের আসনে বসে থাকা মধ্যবয়স্ক পুরুষটি রাগে ফোঁস করে উঠলেন। গর্জে উঠে বললেন ফাইজলামি পাইছেন। আপনার কথায় কি বিয়ে ভাঙবো না’কি? এই বিয়ে হইবই। দেখি আপনে কি করতে পারেন? তারপর কাজিকে ডাকলেন। বিয়ে পড়ান জলদি।
যুবকটি কিছু বলতেই উদ্বত হতেই আচমকাই জসিম মিয়া ক্ষিপ্তস্বরে বলে উঠলেন,
এই বিয়ে হবে না। মেয়ের বয়স কম। এখনো আটারো হয়নি। তার ওপর তোমার বয়স তার থেকে মেলা গুণ বেশি। আমি ভুল করছি আগে বুঝি নাই। এখন আমার ভুল বুঝতে পারছি। তাই এই বিয়ে আমি আর হতে দিমু না। তুমি যাও সলিল সওদাগর এই বিয়ে হবে না।
জসিম মিয়ার কথা শুনে সলিল যেনো শুকনো মাটিতেই আঁছাড় খেলেন। এই বিয়ে করার জন্য সে গুনে গুনে তাকে বিশ হাজার টাকা বকশিস দিয়েছে। আর এখন এই লোক একদমই পাল্টি খাচ্ছে। সে তো জসিম মিয়ার কথা শুনবেই না। বিয়ে সে করেই যাবে। গলায় তেজ ভাব দেখিয়ে বলল,
বিয়ে তো হবেই সর্দার। আপনি নিজেই আমার থেকে টাকা খেয়েছেন। এখন বিয়ে না দিয়ে কোথায় যাবেন?
জসিম মিয়া সলিলের একদমই সামনে এসে তার কলার চেপে বললেন,
আমার সাথে চোখ রাঙিয়ে কথা বলছ। আবার বিশ হাজার টাকার ধমক দ্যাস। জসিম মিয়া নিজের পকেট হাতড়ে বিশ হাজার টাকার একটা ব্যান্ডেল তার দিকে ছুঁড়ে মারলেন। এ্যাই নে তোর টাকা। এখন এইখান থেকে ভালোই ভালোই কেটে পড়। নয়তো আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না।
সলিল যেনো জসিম মিয়ার অন্যরূপ দেখছে। লজ্জায় আর রাগে গজগজ করতে করতে উঠে দাঁড়ালো সে। তার সাথে আসা বরযাত্রীদের বললেন চলো এখান থেকে। এত অপমানের পর এই বাড়িতে আর একমিনিটও থাকুম না। উঠো সবাই। সলিলের সাথে বাকী বরযাত্রীরাও চলে গেলেন।
জসিম মিয়া মুখে মেকি হাসি ঝুলিয়ে যুবকের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন তুমি আমাদের চেয়ারম্যান আজিজ শেখ সাহেবের ছেলে? তোমার নাম কি বাবা? আসলে তোমাকে গ্রামে তেমন একটা দেখিনি। তাই চিনি না। তা, বাবা তুমি কোথায় থাকো?
যুবকের মুখে প্রশান্তির হাসি। সেও হাসি মুখে বললো,
আমার নাম শেখ ফারিজ ফাজ। আমি গ্রামে খুব একটা থাকি না। তাই হয়তো আপনি আমাকে চেনেন না। আমি পরিবারের মেঝো ছেলে। ছয় সাত বছর ধরেই ঢাকা আছি। আসলে আমি আইন নিয়ে পড়াশোনা করেছি। যদিও এখনো আইনজীবীর লাইসেন্স পাইনি তবে অঘোষিত আইনজীবী বলতেই পারেন। কারণ কিছুদিনের মধ্যেই আইনজীবী হয়ে যাবো ইনশাআল্লাহ।
জসিম মিয়ার মুখে মলিন হাসি। না চাইলেও হাসি ঝুলিয়ে রাখলেন তিনি। আকস্মিক তিনি প্রশ্ন করলেন। আচ্ছা, বাবা তুমি কি করে জানলে এই মেয়েটা নাবালিকা।
ফারিজ মুখে পূর্বের ন্যায় হাসি ঝুলিয়ে রাখলেন। দৈবাৎ তার পাঞ্জাবীর পকেট থেকে কুঁচকানো একটা কাগজ বের করে জসিম মিয়ার মুখের সামনে মেলে ধরলেন। জসিম মিয়া মেলে রাখা কাগজ দেখে ভয়ে শুকনো ঢোক গিললেন। এভাবে এই ছেলের হাতে ধরা পড়বেন বুঝতে পারেন নি। কম্পিত কন্ঠস্বর তার,
মেয়েটা এতিম। বাবা নাই গত দুই বছর। দেখতে মাশাল্লাহ অনেক সুন্দর। গ্রামে পোলাপান ভালো না। কে কখন কি কুৎসা রটাই দেয় তার কি ঠিক আছে। অভিভাবক ছাড়া আজকাল চলা যায় না। তাই আমি নিজেই অভিভাবক হয়ে ওর জন্য বিয়ে ঠিক করছি। কিন্তু বিয়ে দিতে গেলেই বয়স নিয়ে ঝামেলা হবে আমি জানতাম। তাই নিবন্ধন কার্ড পুনরায় বানাতেই চেয়্যারম্যান সাবের কাছে দিছিলাম। কিন্তু সেই নিবন্ধন কার্ড তোমার হাতে কেমনে পৌঁছাইলো?
নিবন্ধন কার্ড আমি না পেলে আপনার এই কুর্কম কখনো দেখাই হত না। তাই না সর্দার।
এতিম মেয়েকে বিয়ে দিয়ে ফরয কাজ আদায় করা কি কুর্কম বলছো বাবা।
ফারিজ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জসিম মিয়ার দিকে তাকালেন। তার পাশে চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললেন এসব ভোজপুরি গল্প অন্যদের বলবেন। অন্তত আমাকে এসব ভুজুংভাজুং শোনাতে আসবেন না। এতিমের জন্য চাইলে আপনি অন্যভাবে সাহায্য করতে পারতেন। কিন্তু আপনি তো সোজা বিয়েতে চলে গেছেন। তাও দ্বিগুণ বয়স্ক ছেলের সাথে বিয়ে। এরকম বিয়ে-সাদি হলে টাকার পরিমাণ বেশিই পাওয়া যায়, তাই না?
জসিম মিয়ার মুখে কোনো রা’ নেই। এই ছেলের সাথে কথা বলে তার মান-সম্মান আর খোঁয়াতে চান না। তাই আর কথা বাড়ান না। মুখে আফসোসের সুর তার,
আসলে, বাবা’ আমি বুঝতে পারি নাই। সত্যি অনেক বড়ো ভুল হয়ে গেছে। তুমি না আসলে অনেক কিছুই জানা হতো না।
ফারিজ আর কিছু বললো না। উঠে দাঁড়ালো বাড়ির উদ্দেশ্য। কিন্তু তাকে পিছন থেকে জসিম মিয়া আটকালেন। বসো বাবা যা রান্না হয়ছে সেখান থেকে কিছু খেয়ে যাও। ফারিজ না করতে গিয়েও না করলো না। সে তার পাশে বসলো। আশে পাশে একবার চোখ বুলালো সে। বাড়িটি সম্ভবত নতুন বাড়ি হবে। এই বাড়ি থেকে আশে-পাশের বাড়ি ঘর একটু দূরেই আছে। বাড়ির পূর্ব দক্ষিণে খোলা জমি আর উত্তরদিকে মেহগনি বাগান আর পশ্চিমে গাড়ি চলাচলের রাস্তা। বিয়ে বাড়ি হলেও খুব একটা লোক সমাগম নাই। গরীব এতিমের বিয়ে তাই হয়তো মানুষ নাই। কিংবা সর্দার কাউকে আসতেই দেয়নি এমনটাও হতে পারে। ঘরের অবস্থা খুবই নাজুক। হাফটিন আর হাফবেঁড়ায় নির্মিত এই ঘর। আয়তনে খুব বেশি বড়ো নয় আবার একেবারে ছোটোও নয়। উঠোনে ছোট করে প্যান্ডেল বসানো। একপাশে মাটির চুলা আর অন্য পাশে খাবার সাজানো টেবিলের মধ্যে। খুব বেশি অতিথিও নেই। তবে তার অবাক লাগছে এই ভেবে কোনো মহিলাকে সে এই পর্যন্ত দেখেনি। আচ্ছা, মেয়েটার বিয়ে ভেঙ্গে গেলো কিন্তু কাউকে এই পর্যন্ত সামনে আসতেই দেখলো না। মেয়েটার পরিবারে মানুষ নাই না’কি? কে আছে জানতে হবে। সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। জসিম মিয়া পিছন থেকে তাকে জিজ্ঞেস করলো কোথায় যাও বাবা? সে উত্তর দিলো না সোজা ঘরে ঢুকে পড়লো। কিন্তু ঘরের ভিতরে প্রবেশ করেই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এতক্ষণ সে মনে মনে আফসোস করছিল বিয়েতে কোনো মানুষ নাই দেখে। কিন্তু ভিতরে যে মানুষে গিজগিজ করছে সে ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি।
বাপরে! তার আক্কেলগুড়ুম কত মেয়ে মানুষ এখানে। সে তপ্ত নিশ্বাস ছাড়লো। তাকে দেখে অনেকেই পড়িমরি করেই পগারপার হয়ে গেছে। এতে তার ভীষণ অবাক লাগলো। সবাই তাকে দেখে পালাচ্ছে কেনো? সে আরো একটু এগিয়ে গেলো সামনে একজন বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলা বসা দেখতে পেলো। তাকে দেখে বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলাটি হেসে উঠল। ফারিজ তাকে সালাম দিলো। জিজ্ঞেস করলো,
ভালো আছেন দাদু।
জমিলা হ্যাঁ বলে মাথা নাড়ালো। তারপর তার পাশে বসতে বললো। তাকে ফিসফিস করে বললো,
ঐ হারামজাদা গুলো বিদায় হয়ছে?
ফারিজ নিশব্দে মুচকি হাসলো। সেও হ্যাঁ বলে মাথা নাড়ালো।
জমিলা তাকে ক্ষীণ স্বরে বললো বড্ড বাঁচাইছো বাপ। আমার নাতনিটার জীবন নরক বানাই ফেলতো ঐ হারামজাদায়। তুমি ফেরেশতার মতো কোত্থেকে উদয় হইলা। আল্লাহর লাখো শুকরিয়া। কিন্তু ভাই আমার নাতনিটা আধো কি শান্তি পাইবো এবার।
ফারিজ কিছুক্ষণ ভাবলো। তারপর চট করে বলল কেনো দাদু?
জমিলার চোখে হতাশার সুর। ঐ আমার নাতনিটারে বাঁচতে দিবো না। বিয়ে ভাঙছে তো জ্বালায় মারবো এবার।
ফারিজ জমিলার হাত দুটো আঁকড়ে ধরে বলল চিন্তা করবেন না। আমি আছি তো আপনাদের পাশে। কেউ কিচ্ছু করতে পারবে না। তারপর সে নিজের পকেট হাতড়ে একটা কার্ড বের করে দেয়। দাদু এটা আমার কার্ড যখনি আমাকে প্রয়োজন মনে করবেন নিঃসংকোচে কল দিবেন। কথাগুলো বলে সে উঠে দাঁড়ালো। যাওয়ার আগে আরও একবার এ ঘর ভালো করে দেখে নিল। এই রুমে কিছুক্ষণ আগেও মহিলা দ্বারা পরিপূর্ণ ছিল কিন্তু এখন জনশূন্য। তবে বেঁড়ার দেয়ালের অন্যপাশে মহিলাদের ফিসফিস শব্দ তার কানে আসছে। মহিলারা সামনে না আসলেও ঠিকই বেঁড়ার ফাঁক-ফোকর দিয়ে তার উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখছে। ভারী অদ্ভুত গ্রামের মহিলারা।
বাইরে এসে সে চেয়ার টেনে বসে। ঘড়ির কাটা এখন বিকেল ৪ টার ঘরে। তার অবশ্য তেমন খিদে নেই। তাও প্লেটে সামান্য কিছু নিয়ে খেতে বসলো। জসিম মিয়ার দিকে সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে বলল,
আপনি আমার বাবার মতই। তাই ছেলে হিসেবে আবদার করেই বলছি। এতিম মেয়েটার খরচ প্রয়োজনে আমিই দেবো। তাও তাকে অল্প বয়সে বিয়ে দিবেন না। মেয়েটাকে পড়তে দিন। গ্রামের সর্দার হিসেবে তাকে নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব আপনার সাথে তার পরিবারের সুরক্ষাও। বাকিটা না হয় আমি সামলাবো। সে খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়ালো। জসিম মিয়াকে সালাম দিয়ে বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে।
_______________________
সন্ধ্যের নাস্তা করে মাত্রই রুমে এসেছে ফারিজ। দৈবাৎ আজিজ হন্তদন্ত হয়ে তার রুমে আসে। রক্তবর্ণ অক্ষিযুগল তার। কোপিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
তোমার এত দুঃসাহস কি করে হলো? তুমি আমার অফিসরুমে কেনো গিয়েছো? এটা তোমার ঢাকা শহর নয়। এখানে মেয়েদের পনেরো বছর কোনো ম্যাটারেই করে না। এর থেকেও কম বয়সে মেয়েদের গ্রামে বিয়ে হয়। নতুন কিছু নয় এটা। কিন্তু তুমি কেনো গিয়েছে মেয়েটার বিয়ে ভাঙতে।
ফারিজ তার বাবার কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলো। তার বাবা একজন জনগণের রক্ষক হয়ে কিভাবে এমন একটা বেআইনি কথা বলতে পারে। যেখানে তাদেরকে রোজ আইনের বুলি আওড়াই তার বাবা। তার মুখে তাচ্ছিল্যের সুর।
বাবা তুমি এসব বলছো। ভাবতেই পারছি না।
আজিজের কোনো ভাবাবেগ নেই। সে আগের মতই ধারালো কন্ঠে বলল,
মানুষই আইন সৃষ্টি করেছে, কিন্তু আইন মানুষ সৃষ্টি করেনি। তাই এত জ্ঞান দিয়ে বেড়াবে না আমাকে। সমাজে আমাকে চলতে হবে। তাই কিছু জিনিস দেখেও না দেখার ভান করতে হয়। কারণ দশের লাঠি একের বোঝা। আমার একার যুক্তি দিয়ে সমাজ বদলানো সম্ভব না। বুঝলে।
ফারিজ কিছু বলতেই উদ্বত হতেই তার বাবা তাকে থামিয়ে দিলেন। তিনি দৃঢ় গলায় বললেন কাল সকালেই ঢাকা চলে যাবে। আর গ্রামে আসার দরকার নেই। তোমার আইন তোমার মধ্যেই রাখো।
ফারিজ কিছু বলতে গিয়েও আর বলা হয়নি তার। সমাজের এমন অবৈধ নিয়ম সে মানবে না কখনোই। ভাঙবে এসব কু-প্রথা একদিন।
নিস্তব্ধ গভীর রাত। নভোমণ্ডলে এক ফালি চন্দ্রকিরণে উজ্জ্বল হয়ে আছে চারপাশ। জানালার ছোট্ট ছিদ্র দিয়ে ফারিজের ঘরে সেই আলোর উজ্জ্বলতা উঁকি দিচ্ছে। ফারিজ গভীর নিদ্রায় নিমজ্জিত তখন। কিন্তু আচমকাই তার মুঠোফোন কর্কশ ধ্বনিতে কম্পিত হতে লাগলো। নিদ্রাঘোরে কল রিসিভ করে কে জিজ্ঞেস করতেই কারো কম্পিত ভয়ার্ত সুর ভেসে আসলো তার কর্ণকুহরে।
প্লিজ ভাইয়া আমার আপুকে বাঁচান। তারা আমার আপুকে সর্দার বাড়িতে নিয়ে গেছে। কি করবে জানি না। জলদি আসুন।
চলবে,,,,,,,,,,,