অন্তঃপুর পর্ব-১৩

0
11

#অন্তঃপুর
বিনতে ফিরোজ
১৩.

রুমিলা সহসাই কিছু বললেন না। উত্তেজিতও হলেন না। এটা তার বিশেষ একটা গুণ। ঝুঁট ঝামেলায় মাথা ঠাণ্ডা রাখার বিরল এক গুণটা পেয়েছেন তার বাবার কাছ থেকে। মাথা ঠাণ্ডা রাখার জন্য মনে মনে একবার সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানালেন রুমিলা। শান্ত চোখে রাফির দিকে তাকিয়ে শীতল কণ্ঠে বললেন, “বসো রাফি। বসেও কথা বলা যায়।”
রাফির বিস্ময়, ক্রোধ এক নিমেষেই দুর হয়ে গেল। দাদীমা কখনও তাকে নাম ধরে ডাকে না। তুমি সম্বোধনটাও তার মুখে অপ্রচলিত। রাফি নিশ্বাস ছেড়ে বিছানায় বসল। ঠান্ডা কণ্ঠে বলল, “বিয়ে ছাড়া অন্য বিষয়ে কথা বলো দাদীমা।”
“বিয়ে নিয়ে কথা বলতেই তোমাকে ডেকেছি।”
“তুমি করে বলছ কেন?” রাফি অস্থির হয়ে গেল। রুমিলা মনে মনে হাসলেন। মুখে অবশ্য তার লেশমাত্র প্রকাশ পেল না।
“বিয়ে না করতে চাওয়ার দুটো কারণ আমাকে বলো। ধোপে টেকে না এমন কথা বলবে না।”
রাফি ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠল। রুমিলার কথার মাঝের তারল্য এবং নম্রতা দুটোই উধাও হয়ে গেছে। তার মা বলতে এই বৃদ্ধা মহিলাই। তাকে কোলে পিঠে করে মানুষ করার কাজটা তিনি স্বেচ্ছায় করেছেন। আদর, যত্ন, ভালবাসা যা সবকিছু সে মায়ের কাছে পায়নি সেসবকিছুই এই বর্ষীয়ান মহিলা তাকে আজলা ভরে দিয়েছে। সেই তার মুখেই তুমি ডাকটা রাফি শুনে অভ্যস্ত নয়। ভয়ঙ্কর রেগে গেলেই তিনি এভাবে কথা বলেন। শেষবার বলেছিলেন ক্লাস নাইনে থাকতে। সেবার এক ছেলের সাথে মা-রামা-রি করায় বাড়িতে নালিশ এসেছিল। রুমিলা তাকে কিচ্ছু বলেননি। বকা তো দুর শক্ত কণ্ঠে একটা কথাও বলেননি। তার বদলে তুমি বলতে শুরু করলেন। মেপে মেপে কথা বলতে শুরু করলেন। দুদিন না পেরুতেই রাফি দাদীমার আঁচল ধরে নিজের ভুল স্বীকার করেছিল। কিন্তু ঊনত্রিশের কোঠায় এসে সে কি এমন ভয়ঙ্কর কাজ করল বুঝতে পারছে না।
দাদীমার দিকে একবার তাকিয়ে রাফি বলল, “হাজারটা কারণ আছে। তোমার ছেলে ছেলের বউকে দেখেই আমার শখ মিটে গেছে। এটাই যথেষ্ট নয়?”
“তারা সম্পর্কে তোমার কিছু একটা হয়। আমি কাউকে অভদ্র হতে শেখাইনি।”
রাফির মুখটা থমথমে হয়ে গেল।
“যুক্তিযুক্ত কারণ বলো।”
“দাদীমা বিয়ের জন্য একটা ইচ্ছা থাকা লাগে। পার্টনারের প্রতি বিশ্বাস থাকা লাগে। ইচ্ছা তো আমার কোনো জন্মায়ইনি। আর বিশ্বাস আমার নিজের উপরই নেই। আরেকজনকে কীভাবে করব?”
“নিজেকে বিশ্বাস করার চাইতে নিজের কাছের কাউকে বিশ্বাস করা সহজ। বিশ্বাস খুব ভারী একটা জিনিস। তুমি ভীতু এবং অলস তাই এই কঠিন এবং ভারী কাজটা করতে চাইছো না।”
কথাগুলো যেন রাফির পৌরুষ সত্ত্বায় আঘাত করল।
“বিয়ে তো ধুম করে করে ফেললেই হলো না। এটা দুই দিনের রিলেশন না যে ভাল না লাগলে বাদ দিয়ে দিলাম। অনেক কষ্ট করতে হয়, স্যাক্রিফাইস করতে হয়। কে করে এখন এসব?”
“তোমার বাবা মা করেনি বলে আর মানুষ করবে না এটা ভাবছো কেন? ওরাই কি দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ মানুষ?”
রাফি দুহাতে চুল মুঠো করে ধরলো। এই মানুষটার সাথে সে তর্কে পারে না।
পরাজিত কণ্ঠে বলল, “বিয়ের জিনিসটার উপরে আমার অশ্রদ্ধা কাজ করে। আমি নরমালভাবে নিতে পারব না।”
“তাহলে ডাক্তার দেখাও।”
“দরকার নেই। বিয়ে না করলে কি মানুষ মরে যায়? দুষ্ট গরুর চাইতে শূন্য গোয়াল ভাল।”
রুমিলা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। এতক্ষণ রাফির মন বোঝার চেষ্টা করেছেন। এবার তুরুপের শেষ তাসটা ফেললেন তিনি।
“ঠিকাছে। তুমি যেমন চাও তেমনই হবে। আমি মেয়েটাকে দেখেছিলাম। যতটুকু সাধ্যে কুলিয়েছে পরীক্ষা করেছি। ভেবেছিলাম তোমার ভাল মন্দ হিসাব করতে পারি। তুমি যে কবে এত বড় হয়ে গেছ..” হালকা হাসলেন রুমিলা। “আমার হিসাব নিকাশ ছাড়িয়ে গেছ। বুড়ো হয়ে গেছি তো! বুঝতে পারি না।” শব্দ করে হাসলেন রুমিলা।
রাফির বুকে একটা ধাক্কার মতো লাগল। চোখ দুটো ভরে আসতে চাইল। রুমিলার বয়স সে কখনোই হিসেব করতে চায় না। গুনতে চায় না তার চামড়ার ভাঁজ। তার ভারসাম্যহীন কাজকর্ম দেখলে রাফির মনে হয় এই মানুষটা ভেঙে যাচ্ছে। তাকে গড়তে যেয়ে নিজেকেই ভেঙে ফেলেছে।
হুট করেই রুমিলাকে জড়িয়ে ধরল রাফি। তার কাঁধে মুখ গুজে বলল, “বিয়ে করতে আমার ভয় করে দাদীমা। আমি বাবার মতো হতে চাই না। আমার ছেলেমেয়েরা আমার মতো বাবা মা পাবে আমি কক্ষনো চাই না।”
নাতির গলার কম্পন টের পেলেন রুমিলা। কাজ হয়ে গেছে। মজা করে বললেন, “গাছে কাঁঠাল, গোঁফে তেল। উনি বিয়েই করতে চায় না আর ছেলেপেলের চিন্তায় ম-রে যাচ্ছে!”
“তো বিয়ে করলে ছেলেমেয়ের মা খুঁজব না?”
“অবশ্যই খুঁজবি। ঐরকম দেখেই আমি নিয়ে আসব।”
“তাহলে নিজের ছেলের জন্য আনোনি কেন!”
“তারা দুইজন পছন্দ করে বিয়ে করেছে। আমি খালি পালে হাওয়া দিছি। দুইজন সুখে থাকলে আমার কি? তা সুখের এই নমুনা হবে জানলে অবশ্যই বাঁধা দিতাম।”
“দাদীমা বিয়ের চিন্তাটা বাদ দাও?”
“এই বাড়ি বাড়ি নাই রে দাদা। কবরস্থান হয়ে গেছে। মানুষ আছে কিন্তু রুহ নাই। আমার দম বন্ধ লাগে। কথা বলার একটা মানুষ পাই না। তিতলি আমারে কি বোঝে? আমি এই চার দেয়ালের ভিতরে একা বসে থাকি ভাই। আমার তো জান অস্থির লাগে।”
রাফি শক্ত করে দাদীকে চেপে ধরল। নিজেকে খুব স্বার্থপর মনে হলো। এই মানুষটাকে নিয়ে ভাবতে কীভাবে ভুলে গেল সে?
“তোরে আমি হাসিখুশি দেখে মরতে চাই দাদা। মনের মতো সঙ্গী পাইলে অনেক কষ্টই মানায় নেয়া যায়। এই বাড়িতে একটা ভাল মনে মানুষ আসবে। তোরে বুঝবে, নাবিলারে দেখবে। শ্বশুর শাশুড়ির খুব সেবা যত্ন করার দরকার নাই। একটু আধটু খবর নিবে। অন্তত আর কিছু না হইলেও তোর একটা মানুষ হবে।”
রাফির চোখের কোল থেকে টুপ করে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। তার একটা মানুষ হবে? সত্যিই হবে?
বার কয়েক পলক ঝাপটে সরে এলো সে। রুমিলাকে শুইয়ে দিয়ে বলল, “ঘুমাও। সকালে কত হবে।”
রুমিলা নাতির চোখমুখ দেখেই বুঝে গেছেন কাজ হয় গেছে। তাই আর তাকে ঘাটালেন না তিনি। চোখ বন্ধ করলেন আরামের একটা ঘুমের আশায়। কালকেই অনিককে বলবেন প্রস্তাব পাঠাতে।

আর খেতে ইচ্ছে করছিল না রাফির। নিজের ঘরে যেয়েই বিছানায় গড়িয়ে পড়ল সে। বিয়ের জিনিসটা তার কাছে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভরপুর। কেবল মনে হয় বিয়ের সুখ বইয়ের পাতাতেই পাওয়া যায়। বাস্তবে না। তার বাস্তব অন্তত তাই বলে। ভাবতে ভাবতে এ গলি ও গলি ঘুরতে ঘুরতে সারা হল রাফি। কোনো কূল কিনারা করতে পারল না। একবার ভাবল অনিকের সাথে কথা বলে। পরক্ষনেই মত পাল্টাল। নিরপেক্ষ পরামর্শ ঐ ছেলের কাছে পাওয়া যাবে না। সে তাকে নিয়ের দেয়ার একটা সুযোগের অপেক্ষাতেই আছে।

_______________

প্রস্তাব শুনে অবাকের চূড়ান্ত হলেন মোশাররফ হোসেন। অনিক নিজেই ফোন দিতে চেয়েছিল। পরক্ষনেই মনে হয়েছে বাবার উপস্থিতিতে বন্ধুর নাক গলানোটা অপর পক্ষের কাছে খুব শোভনীয় নাও লাগতে পারে। ফলে মাহমুদ সাহেবকে দিয়েই ফোন দেয়াল। নিতান্ত অনিচ্ছা নিয়েই তিনি ফোন দিলেন। রুমিলার আদেশ আগেই পেয়েছিলেন। তাই আর কথা বাড়ালেন না।

আফসানা নিজেও অবাক হয়েছেন বৈ কি। তবে স্বামীর চেয়ে কম। এই লোক অল্পতেই বেশি প্রতিক্রিয়া দেখায়।
“তাদের মেয়েকে সাহায্য করেছে। ওরকম বিপদ থেকে বাঁচিয়েছে। এজন্যই ভাল লেগেছে। তাছাড়া আমাদের মেয়ে ফেলনা নাকি?”
ঘোর কাটিয়ে মোশাররফ বললেন, “তুমি বুঝতে পারছ না আফসানা! ওদের স্ট্যাটাস জানো? শহরের হাতে গোনা ধনী মানুষদের কাতারে পড়ে।”
“হলো। তাতেই কি? আমার মেয়ের কি ওরকম বাড়িতে যাওয়ার যোগ্যতা নেই?” এক তৃপ্তি কাজ করছে আফসানার মাঝে। আফরিনকে নিয়ে তিনি সবসময়ই গর্ব করেন। যেই নিশ্চয়তা সাদমানকে নিয়ে দিতে করেন না সেটা আফরিনকে নিয়ে চোখ বন্ধ করে দিতে পারেন। মেয়েটা চলেই এত মেপে মেপে!
“তোমার তো বেশ আগ্রহ মনে হচ্ছে!”
“ছেলে ভাল হলে আপত্তির কী আছে?”
“শুধু ছেলে হলেই চলবে?”
“সবই দেখবে। ছেলেটাই আসল। ঐ বিষয়টা ঠিক থাকলে বাকিসব মানিয়ে নেয়া যায়।”
“ছেলের বাবা সরাসরি ফোন করেছে। আমি ভাবতেই পারছি না।” মোশাররফ হোসেন অবাক কণ্ঠে বললেন।
আফসানা হেসে বললেন, “খোঁজ নাও ভাল করে। শ্বশুর শাশুড়ি হওয়ার সময় হয়ে গেছে।”
এই কথায় মোশাররফ হোসেনের বুকে কি যেন একটা বিধল। তিনি বলতে পারলেন না। আবার মেয়ের বিয়েতে তিনি খুশি না এটাও ভাবতে পারলেন না।
আফরিনকে আগেই কিছু না বলে সাদমানকে খোঁজ খবর নিতে বললেন।

_______________

রাফির মন রুমিলার নরম কথার দিকে ঝুঁকেই গিয়েছিল। ঠিক তখনই ঘটনাটা ঘটল।

আসিফার খালা বেশ অসুস্থ। খবরটা শুনে তিনি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। মাহমুদকে জানালে তিনি বললেন বন্ধুদের সাথে শহরের বাইরে গেছেন ফিরতে দেরি হবে। আসিফা বললেন একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে। এই পর্যায়ে মাহমুদ রেগে গেলেন।
“কথার টোন ঠিক করো আসিফা!”
“তোমার মতো মানুষের সাথে এভাবেই কথা বলা উচিত! কী এমন রাজ কার্য উদ্ধার করতে গেছো তুমি যে বাড়িতে আসা যাবে না? সারাদিন তো ছেলের কামাই করা টাকা ওড়াও!”
মাহমুদ সেই মুহূর্তেই কল কেটে দিলেন। এবং আধা ঘণ্টার মাঝে বাড়িতে ফিরলেন। তাই দেখে আসিফার গলা আরও খানিকটা চড়াও হলো।
“ঠিকই তো এলে! আঁতে ঘা লাগলে মানুষ কত কিছুই যে করে!”
মাহমুদ তেড়ে গেলেন। রোজকার কথা কাটাকাটি শুরু হলো নতুন একটা ইস্যুর ওপরে। রাগারাগির এক পর্যায়ে সজোরে আসিফার বাহুতে ধাক্কা দিলে তিনি ভারসাম্য হারিয়ে বাথরুমের মেঝেতে পড়ে গেলেন। দরজার ছিটকিনি খোলা ছিল। ঘরের মেঝে থেকে বাথরুমের মেঝে কিছুটা নিচে হওয়ায় আসিফার পায়ে সাথে সাথেই মচকা লাগল। বেসিনের সাথে শক্ত একটা ধাক্কা খেলেন মাথায়। ওখানেই জ্ঞান হারালেন তিনি।
মাহমুদ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ছোট্ট ধাক্কাটা যে রূপ পরিবর্তন করে এমন হয়ে যাবে তিনি ভাবতেই পারেননি। হুশ ফিরতেই দৌঁড়ে যেয়ে দেখলেন আসিফা জ্ঞানহীন হয়ে পড়ে আছে। চিৎকার করে তিতলিকে ডাকলেন তিনি।

ঘন্টাখানেকের মাঝে আসিফাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে তিনি নিখোঁজ হলেন। ছেলের সামনে এই মুখ নিয়ে দাঁড়াতে পারবেন না।

রাফি ছুটতে ছুটতে হাসপাতালে এল। ঘটনা শুনে তার মনে হলো লজ্জায় সে ম-রেই যায়। ছিঃ! মানুষ তো বলবে তার বাবা মা মা-রামা-রি করে। মুহূর্তেই তার মন বিষাক্ত অনুভূতিতে ছেয়ে গেল। জাফরের সাথেও সে চোখ মেলাতে পারল না। এই ঘটনার পরও এই দুজন একসাথে, একই ছাদের নিচে থাকবে। এর নামই বিয়ে?
সন্ধ্যায় মাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে রুমিলার কাছে গেল সে। ঘোষণা করল, “বিয়ের কথা ভুলে যাও দাদীমা। এটা ছাড়া তুমি যা বলবে আমি তাই করব। কিন্তু মরে গেলেও বিয়ে করব না। দরকার নেই আমার কোন সঙ্গীর। আমি একাই ভাল আছি। অনেক ভাল!”

রুমিলা এই পর্যায়ে কঠোর হলেন। রাফির এই মনোভাব অনিক পর্যন্ত পৌঁছাতে দিলেন না। ফলে পাত্র যাচাইয়ের প্রক্রিয়া আফরিনের বাড়িতে চলতে থাকল স্বাভাবিক গতিতেই।

~চলমান~