অন্তর্ভেদী পর্ব-০৩

0
13

#অন্তর্ভেদী
#লেখিকাঃ#ইশা_আহমেদ
#পর্ব_৩

অনিচ্ছা নিয়ে গেলাম ছাদে। ভদ্রলোক উল্টো দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি তার দিকে এগিয়ে গিয়ে সোজা বলতে শুরু করলাম,
-“দেখুন বিয়েটা আমি করতে পারবো না। আমার পক্ষে সম্ভব নয় বিয়েটা করা। আপনি ভেঙে দিন বিয়েটা।”

ভদ্রলোক ঘুরতেই আমার মাথা ঘুরে উঠলো। ড.অনয়! নীল পাঞ্জাবি পরিহিত অনয়কে আমি হতভম্ব হলাম। পাত্র হিসেবে তাকে আশা কি আমি কখনো কল্পনাই করিনি। অনয় আমার দিকে গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আমার অস্বস্তি হলো। আমি নিচু কন্ঠে শুধালাম,
-“অস্বস্তি হচ্ছে দৃষ্টি সরান”
অনয় চোখ সরালেন না। আমি না তাকিয়েও বুঝে ফেললাম তিনি আমার আপাদমস্তক খুঁটিয়ে দেখছেন। আমার অস্বস্তির মাত্রা আরো বাড়লো। দাঁড়িয়ে থাকতেও অস্বস্তি হচ্ছে। অনয় হুট করে বলে বসলেন,
-“শাড়ি পাল্টালেন কেনো মিলি? আপনায় শাড়িতে ভালো লাগে”

আমি তাকালাম অনয়ের দিকে। অনয় তখনও তাকিয়ে। তার চোখে অন্য কিছু ছিলো। মেয়ে হয়ে সেই অন্য কিছু আসলে কি তা ধরতে বেশি সময় লাগলো না। লোকটা আমায় দেখলোই কিছুদিন আগে তার মাঝে বিয়ে অব্দি চলে এসেছেন? নাকি তিনি জানতেনই না আজ আমাকে দেখতে এসেছেন তিনি। আমি অনয়ের চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলাম না।

দ্রুত চোখ সরালাম। বললাম,
-“আপনি কি জানতেন পাত্রী আমি?”
অনয় চোখ সরালেন এবার। আকাশের দিকে তাকালেন একবার।অতঃপর আবারও আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,“সে বলবো একদিন। আপনি যেনো কি বলছিলেন?”
আমি গলা ঝেড়ে বললাম,
“আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না। শুধু আপনাকে কেনো বলছি কাউকেই আমি বিয়ে করতে পারবো না। আপনি বিয়েটা ভেঙে দিবেন মানে দিবেন!”
-“বিয়ে না করার কারন?”
-“আপনাকে বলতে যাবো কোন দুঃখে। আপনাকে বিয়ে ভাঙতে বলেছি বিয়ে ভাঙবেন। বেশি বাড়াবাড়ি করলে হাত পা ভেঙে দিবো। মাইন্ড ই’ট”

আমি চলে আসলাম। পেছনে ফেলে আসলাম অভদ্র ড.অনয়কে। পাত্র পক্ষ গেলো সন্ধ্যায়। আমাকে সবার পছন্দ হয়েছে, এমনি ড.অনয়ের মায়েরও। তিনি নাকি খুব শৌখিন মানুষ। বেশ খুঁতখুঁতে স্বভাবের। আমাকে নাকি এক দেখাতেই পছন্দ হয়েছে। বিয়ে মোটামুটি ঠিক। আমি বিরক্ত হলাম ড.অনয়ের উপর। তাকে বললাম বিয়েটা ভাঙতে আর সে কি না ঠিক করে চলে গেলো। অসভ্য ডাক্তার। তার সাতদিন পর আব্বু আমায় জোর করে পাঠালেন অনয়ের সাথে দেখা করতে। রেস্টুরেন্টে পৌঁছে দেখলাম অনয় এখনো আসেননি। অনয়ের উপর প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হলো। অসহ্য লোক! গুনে গুনে অনয় আমাকে পাক্কা তিরিশ মিনিট অপেক্ষা করালো। এসেই তিনি বসলেন। সরি টুকু ও বললেন না।

শুরুতেই বললেন,
-“কেমন আছেন মিলি? মাইগ্রেনের ব্যাথাটা কি কমেছে?”
আমি অনয়ের প্রশ্নের জবাব দিলাম না। উল্টো অনয়কে জিজ্ঞেস করলাম,
-“আপনাকে তো বিয়েটা ভেঙে দিতে বলে ছিলাম। ভাঙলেন না কেনো?”
-“এমনিতেই। মামনির খুব পছন্দ হয়েছে আপনায়”
রাগ উঠলো। মৃদু চিৎকার করে বললাম,“আপনাকে আমি আবারও বলছি বিয়েটা ভেঙে দিন। আমি বিয়ে করবো না”
-“কারণ বলুন। যদি আপনি উপযুক্ত কারণ দেখাতে পারেন। আমি অবশ্যই বিয়েটা ভেঙে দিবো।”
আমি ইতস্তত করে বললাম,“আমার পাহাড়ে চড়ার নেশা। আমি আরো ঘুরতে চাই। প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যেতে চাই”

-“শুধু এটুকুই?”

আমি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলাম। অনয় হাসলেন। এরপর লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলা শুরু করলেন,
-“আমারও ট্রাভেল করার বাজে নেশা আছে। মেডিকেলে পড়া কালীন ছুটিতে হুটহাট বন্ধুদের সাথে ঘুরতে গিয়েছি। এখনও সেই নেশাটা রয়ে গিয়েছে। তবে সময় কম পাই এখন। আপনি চাইলে আমি আপনায় নিয়ে যাবো মাঝে মাঝে। আর যখন আমি যেতে পারবো না। আপনি মামনিকে নিয়ে যেতে পারেন। তিনি খুবই শৌখিন মানুষ। আপনি তো সেদিন রাগের কারণে কারো দিকে চোখ তুলেই তাকালেন না। আমার মামনিকে দেখলে আপনি বুঝতেন। আপনার সাথে দারুন জমবে। কম্বিনেশনটা সুন্দর হবে। আপনি ভরসা করে দেখুন। আমি আপনায় কথা দিচ্ছি আমি আপনায় সুখে রাখার চেষ্টা করবো, যতোটা আমার সাধ্যের মাঝে। আপনি বড্ড রাগী,রাগলে বেশ লাগে। এবার বলুন করবেন আমায় বিয়ে?”

আমি উত্তর দিলাম না। সেদিন আমাদের এসব নিয়ে আর কথা হলো না। আমি যতটা মেজাজ নিয়ে গিয়েছিলাম ঠিক ততোটাই না তার থেকেও বেশি মুগ্ধতা নিয়ে ফিরেছি। আমি এতোদিনে এই প্রথম অনয়কে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছি। ভদ্রলোক আসলেই সুদর্শণ ভীষণ। আমায় ভালো রাখবে। কি মনে করে বিয়েতে মত দিয়েই ফেললাম। আমাদের বিয়ে ঠিক হলো মাস খানেক পর। আমাদের চেনা-জানা প্রয়োজন। আব্বু বোধ হয় খুশি হলেন। তার চেহারায় খুশি যেনো উপচে পরছে। আমি হেসেছিলাম, আব্বুর আড়ালে।

৫.

একদিন নিজ থেকে গেলাম ড.অনয়ের চেম্বারে। আজ কিন্তু দেখা করতে যাচ্ছি তার হবু বউ হয়ে। আজকে কাউকে সাথে নেইনি। খুব ইচ্ছে করছিলো শাড়ি পরতে। শাড়ি পরেছি হলুদ নীলের কম্বিনেশনে। ড.অনয়ের চেম্বারে যখন পৌঁছালাম। তখন প্রায় সন্ধ্যে। অনয় সাধারণত সন্ধ্যা পর্যন্ত রোগী দেখেন। আমি অপেক্ষায় বসে রইলাম। রোগী দেখা শেষ হতেই ভেতরে প্রবেশ করলাম। তিনি তখন বের হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমায় দেখলেন না। আমি রোগীর চেয়ারে বসলাম। পেছন থেকে আমায় দেখে বললেন,

-“কে আপনি? আমার ভিজিটিং আওয়ার তো শেষ”

আমি পিছু ফিরে চাইলাম। বললাম,“আমার জন্যও বুঝি ভিজিটিং আওয়ার লাগে?”

ভদ্রলোক চমকে তাকালেন। আমি বেশ মজা পেলাম। অনয়ের থতমত মুখটা দেখতে দারুন লাগলো। তাকে অবাক করে দিয়ে হাসলাম। তাকে জানালাম সন্ধ্যেটা তার সাথে কাটাতে চাই। তিনি বিনা বাক্যে রাজি হলেন। তিনি চাইলেন বাইকে ঘুরতে, আমি নিষেধ করলাম। বললাম রিকশায় চড়বো। অনয় রিকশায় বসে আফসোসের স্বরে বললেন,
-“মিলি কেনো যে বললেন না আপনি শাড়ি পরবেন তাহলে আমিও হিমু সেজে আসতাম। আপনার পাশে আমায় একটুও মানাচ্ছে না”

আমি হাসতে হাসতে বললাম,“তা না মানাক। আপনি যে একজন ডাক্তার আপনার লুকের সাথে কখনোই তা যায় না। আমি তো প্রথম দিনই কি ভুল করে বসলাম”

আমি বলেই শব্দ করে হাসলাম। অনয় কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। আমি দৃষ্টি নামালাম। রিকশায় চড়ে আসলাম শহর থেকে কিছুটা দূরে। তিনি ভাড়া মিটিয়ে আমাকে নিয়ে গেলেন টং দোকানে চা খেতে। অনয় আমাকে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিলেন। আমরা কথা বললাম না। দমকা হাওয়া বইছে। যখন তখন বৃষ্টি নামবে। চা খেয়ে অনয় আমায় নিয়ে শহরের দিকটায় আসলেন। গুটি কয়েক ফুলের দোকান দেখে আমায় নিয়ে সেদিক গেলেন। দোকানে থাকা অবস্থায় ঝুম বৃষ্টি নামলো। অনয় আমায় ফুল কিনে দিলো। দুটো লাল গোলাপ আর একগুচ্ছ কদম। হাত ভর্তি কদম ফুল দেখতে বেশ লাগছে। অনয় সমস্ত কিছু উপেক্ষা করে আমার হাত ধরলেন শক্ত করে। আমার দৃষ্টি এলোমেলো হলো। এই অভদ্র লোকটার প্রেমে পরছি দিন দিন। দু’জন রাস্তায় ভিজলাম, প্রচন্ড বৃষ্টি আর দমকা হাওয়াও দু’জনের প্রেমকে থামাতে পারলো না। বৃষ্টিতে ভিজে আমরা প্রেম করলাম? আদেও কি তাই? হয়তো বা!

অনয় আমায় বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে বললেন,
-“মিলি জ্বর আসতে পারে। আপনি ওষুধ নিয়ে নিবেন। আমি কিন্তু আপনায় ফোন করবো রাতে।”

সে রাত আমায় ঘুম হলো না। চোখে ভাসলো নীল শার্ট পরা পুরুষটার অবয়ব। পুরুষালি শক্ত হাতের ছোঁয়া তখনও আমায় হাতে লেগে আছে। আমি আগে কখনো প্রেমে পরিনি। এই প্রথম প্রেমে পরা। তাও কি না যেই জিনিসে আমার এলার্জি ছিলো। ডাক্তার আর ঔষুধ দু’টোই খুব অপ্রিয় হলেও এখন ড. অনয় আমার খুব প্রিয়। একটু বেশিই প্রিয়। আমায় রাতে ফোন করলেন সাহেব।

-“মিলি মাইগ্রেনে ব্যাথা উঠলে আমায় সাথে সাথে কল করবেন। আর তো অল্প কিছুদিন এরপর খুব বেশি সমস্যা হবে না। তখন তে আপনি আমায় কাছেই থাকবেন।”

আমার সে কি লজ্জা। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে বলে বসলাম,“আপনি নির্লজ্জ হয়ে যাচ্ছেন অনয়। আমি রাখছি”

#চলবে