অন্তর দহন পর্ব-১৪+১৫

0
358

#অন্তর_দহন
#লেখনিতে_আরুহি_অহি

পর্ব__১৪

__হয়েছে তো স্পন্দন। এবার কোল থেকে নামিয়ে দিবেন দয়া করে।এতো সময় ধরে তো কম লোক হাসালেন না। এবার কি জনাবের মর্জি হবে কোল থেকে নামাতে?

__আমার বউ। আমি কোলে নিয়ে থাকবো না মাথায় নিয়ে নাচবো সেটা নিয়ে তুই কথা বলার কে চন্দ্র?

__আচ্ছা মসিবত তো। আচ্ছা আপনার হয়েছে টা কি বলেন তো?

স্প্দন আর কিছু না বলেই চন্দ্রকে কোলে নিয়েই টুপ করে বিছানায় গিয়ে বসলো। চন্দ্র এবার স্পন্দনের কপালে হাত রেখে বললো,

__কোথায় শরীরে তো জ্বর নেই। তাপমাত্রা তো ঠিকই আছে।

__তো আমি কখন বললাম যে আমার জ্বর আসছে।

__নাহ্।তা বলেন নি। কিন্তু আপনার হাবভাব দেখে আমার মনে হলো হয়তো জ্বর টর এসেছে।তাই আপনার মাথার স্ক্রু গুলো ঠিকমতো কাজ করছে না।

চন্দ্র এবার নাক এগিয়ে স্পন্দনের গায়ের থেকে ঘ্রাণ নিতে নিতে বললো,

__নেশা টেসাও তো করেন নি বলে মনে হচ্ছে।গায়ে তো কোনো নেশার ঘ্রাণ পাচ্ছিনা।

__আমি নেশায়ই ডুবেছি চন্দ্র।তবে এ নেশা সে নেশা নয় যেটা তুই ভাবছিস।

__আল্লাহ বলেন কি?এই জন্যই তো তখন থেকেই উল্টাপাল্টা কথা আর কাজ করছেন।চলেন ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানি দিবেন স্পন্দন।

__তুই কিন্তু আমাকে মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছিস চন্দ্র।

__আরে রেগে যাচ্ছেন কেনো? আমি তো শুধু বলছি আপনি যদি কিছু খেয়ে থাকেন? তাই আর কি?

__আমি কিছু খাইনি চন্দ্র।তবে তুই বললে খেতে পারি।

স্পন্দনের কথায় থতমত খেয়ে চন্দ্র তোতলাতে তোতলাতে বললো,

__ক্ কি খাবেন আপনি?

__চুমু।

চন্দ্রর আবার কান গরম হয়ে উঠলো।এই লোকটি আজকে আমাকে ইচ্ছা মতো লজ্জায় ফেলতেই উঠে পড়ে লেগেছে দেখছি। তারপর একটু পিছিয়ে স্পন্দনের থেকে দূরে বসে চন্দ্র বললো,

__দেখুন স্পন্দন।

__দেখা চন্দ্র।

__এমন উদ্ভট আচরণের কারণ কি স্পন্দন?জ্বীনে টিনে ধরেনি তো?

__ধরেছে কঠিন অসুখে ধরেছে।

__বলেন কি? তাহলে বাইরে চলেন।সবাইকে বলে একটা ডাক্তার আনা যায় কিনা দেখি।

স্পন্দন একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে চন্দ্রের কোলের উপর শুয়ে পড়ল। এরপর বললো,

__ডাক্তার আনতে হবে না। তুই পাশে থাকলে এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে।ঘুম পাচ্ছে। নড়াচড়া না করে ঘুমাতে দে চন্দ্র।

অগত্যা চন্দ্র বসে থেকে স্পন্দনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। এদিকে স্পন্দনের মা এসে উনার শ্বাশুড়ি আম্মাকে সালাম করে চোখ মুছতে মুছতে বললো,

__আম্মা আমার স্পন্দন ফিরে এসেছে।

__দাদুভাই কোথাও গিয়েছিলো বড় বৌমা?

__দু’বছর আগে হারিয়ে যাওয়া আমার সেই স্পন্দন আবার ফিরে এসেছে আম্মা। আমার হাসিখুশি ছেলেটাকে এতো দিন পরে আবার সেই আগের মতোই স্বাভাবিক ভাবে দেখলাম আম্মা।

এরপর একটু আগে যা যা ঘটেছে সব খুলে বললেন স্পন্দনের মা।সব শুনে উনার শ্বাশুড়ি বললেন,

__আমার সিদ্ধান্ত ভুল ছিলো না বড় বৌমা। আমি জানতাম চন্দ্র দিভাই যা পারবে তা আর কেউ পারবেনা বৌমা।

__কিন্তু আম্মা চন্দ্র আমাদের উপর এখনো রেগে আছে যে।আমরা সবাই স্পন্দনের জীবন বাঁচাতে গিয়ে ওর সাথে অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি আম্মা।জানি এর জন্য চন্দ্র আমাদের কখনোই ক্ষমা করবে না আম্মা।

__জানি বড় বৌমা। কিন্তু সত্যিটা যখন চন্দ্র জানবে তখন এই রাগ অভিমান আর থাকবে না বৌমা। তুমি দেখে নিও।আসলে ওকে আমার সব কিছু খুলে বলা উচিত। কিন্তু ও আমার উপর যেভাবে অভিমান করে আছে তাতে এই মুহূর্তে এসব বললে ও বিশ্বাস করতে পারবেনা।সময় আসুক আমি নিজেই সব বলবো বড় বৌমা।

__হ্যাঁ আম্মা। আপনি যা বলবেন তাই হবে।

__আমি জানতাম আমার ভেঙে পড়া দাদুভাইয়ের মনটা যদি কেউ জোড়া লাগাতে পারে সেটা শুধু চন্দ্র দিভাই ই পারবে। তুমি আর এসব নিয়ে চিন্তা করো না বড় বৌমা।

__জ্বী আম্মা।

পরদিন সকালে কারো ধাক্কাধাক্কিতে চন্দ্রের ঘুম ভাঙলো। উঠে বসে দেখে সিঁথি। চারপাশে তাকিয়ে দেখে স্পন্দন নেই।চোখ ডলতে যাবে তখনই সিঁথি চন্দ্রের হাতটা ধরে বললো,

__চন্দ্র আপু?কি সুন্দর করে মেহেদী পড়েছো তুমি।কখন পড়লে?

চন্দ্র নিজেও অবাক। তবুও সিঁথিকে বুঝতে না দিয়ে বললো,

__রাতে পড়েছি সিঁথি।

__খুব সুন্দর হয়েছে আপু। এখন উঠে পড়ো। অনেক বেলা হয়ে গেছে।বড় মামানি তোমাকে ডাকতে পাঠিয়েছেন।কাল রাতে বুঝি ভাইয়া তোমাকে ঘুমাতে দেয়নি?

চন্দ্র ওর কানটা টেনে ধরে বললো,

__বেশি পাকা পাকা কথা বলতে শিখেছিস সিঁথি।দিবো এক থা’প্পড়।

সিঁথি মুখ ফুলিয়ে পড়লো।তা দেখে চন্দ্র ওকে জড়িয়ে ধরে বললো,

__তুই যা। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।

সিঁথি চলে যেতেই চন্দ্র হাতটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলো। আসলেই সুন্দর লাগছে দেখতে মেহেদী।ওর আর বুঝতে বাকি নেই যে এসব স্পন্দন করেছে সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে। আবার ওকে বিছানায় ঠিক করে শুইয়ে ও দিয়েছে। এরপর ফ্রেশ হয়ে নিচে নামার সময় চন্দ্রের মনে হল মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে।হয়তো কাল থেকে না খেয়ে থাকার জন্য হয়েছে। মেহেদী দিতে গিয়ে খাবার যে খায়নি সেটাই ভুলে গেছে ও। এখন এই কথা যদি স্পন্দন শুনতে পায় তাহলে বাড়ি মাথায় তুলে হাঙ্গামা খাড়া করে দিবে।তাই নিরার কাছে গিয়ে বসলো চন্দ্র।বললো,

__বাড়ির সবাই কোথায় রে নিরা?

__ছেলেরা বাজারে গেছে।আর বাবা বড় আব্বু মেজো আব্বু বাইরে ডেকোরেশনের ওদিকটা দেখছে।আর তোমার জ্ঞাতার্থে বলে রাখি ভাইয়াও বাজারে গেছে।যাবার আগে বড় আম্মুকে বলে গেছে তোমাকে যেনো দশটার আগে কেউ না ডাকে।আর এরপর উঠিয়ে খেতে দেয়।তো এবার তুমি খেয়ে এসো আপু। অনেক বেলা হয়ে গেছে যে।

__মিতু আপু কোথায় নিরা?

__ঘরেই আছে।ফুপির সাথে কথা বলছে।জানো তো সকাল থেকেই কান্নাকাটি করছে আপু।

চন্দ্র আর কিছু না বলে উঠে ডাইনিং এ গিয়ে বসলো।মাথার ভেতর ভীষণ খারাপ লাগছে।বসে থাকতেই কষ্ট হচ্ছে। তবুও বড় আম্মুকে ডেকে বললো,

__বড় আম্মু? খাবার দাও।

__বস চন্দ্র।আমি খাইয়ে দেই।

মায়ের কথাটা আর ফেলতে পারলো না।তাই মায়ের হাতে খেতে লাগলো। চন্দ্রের যেমন চোখ ছলছল করছে তেমন ওর মায়ের ও করছে। আরেকজন রান্না ঘরের আড়ালে বসে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছছে আর হাসছে।সে আর কেউ নয়।স্পন্দনের মা। চন্দ্র যে ওর মায়ের সাথে ঠিকমতো কথা বলতে চায়না সেটার জন্য উনি নিজে না এসে এই সুযোগে চন্দ্রের মা’কে পাঠিয়েছেন। খাবার শেষের পথে। এমন সময় চন্দ্র বললো,

__আর দিও না আম্মু। কেমন বমি বমি পাচ্ছে।মাথাটাও ঘুরাচ্ছে।আর খাবো না।

__কি হয়েছে চন্দ্র?শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে?

__তেমন কিছু না আম্মু।কাল রাতে খাওয়ার কথা মনে ছিল না।তাই হয়তো এমন লাগছে।

__আচ্ছা তুই তাহলে একটু শুয়ে রেস্ট নে।আমি একটু শরবত করে আনছি।

চন্দ্র মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলতেই আবার কেমন ঘুরে উঠলো মাথাটা। সামনে আবছা আবছা দেখতে পেলো স্পন্দন মনে হয় দৌড়ে ওর দিকে আসছে। এরপর আর কিছুই মনে নেই।যখন জ্ঞান ফিরলো দেখে একটা হাত শক্ত করে ধরে বসে আছে স্পন্দন।মুখটা শুকিয়ে এতোটুকু হয়ে গেছে।চোখে মুখে উদ্বিগ্নতার ছাপ স্পষ্ট।আরেক পাশে ওর বড় আম্মু মেঝো আম্মু ওর আম্মু ফুপা ফুপিরা দাঁড়িয়ে।ডাক্তার প্রেসার মাপতে ব্যস্ত। চন্দ্র নড়ে উঠতেই স্পন্দন দুই হাতে ওর হাতটা ধরে বললো,

__এখন কেমন লাগছে চন্দ্র?শরীর কি একটু ভালো লাগছে?

__তোমাদের বাপ ছেলের জন্য আজকে আমার মেয়ের এই অবস্থা।তোমরা ওকে এতো মানসিকভাবে বির্পযস্ত করে দিয়েছো যে মেয়েটা আমার মরতে বসেছে।

হঠাৎ করেই আব্বুর এসব কথা শুনে বুঝতে পারলো চন্দ্র নিশ্চিত এতো সময় ওর অসুস্থতার জন্য এমন আরো অনেক কথা বলাবলি হয়েছে।তাই স্পন্দনের চোখ মুখের এই অবস্থা। চন্দ্র খেয়াল করলো স্পন্দনের চোখ মুখ আরো পাংসুটে বর্ণের হয়ে আসছে।সাথে চোখে রাগের চিহ্ন। চন্দ্র স্পন্দনের দিকে তাকিয়ে মিনমিন করে বললো,

__আমি ঠিক আছি স্পন্দন। বিশ্বাস করেন আমার কিছু হয়নি স্পন্দন।

স্পন্দন কিছু না বলে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,

__এসব কিছু নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না চন্দ্র।চোখ বন্ধ করে একটু শান্ত হয়ে থাক।আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।

প্রায় সাথে সাথেই চন্দ্রের আব্বু আবার হু’ঙ্কার দিয়ে উঠলো। বললেন,

__এখন আর লোক দেখানো আদর সোহাগ দেখাতে হবে না তোমাকে স্পন্দন। শুধু আম্মার কথাতেই আমি এই বিয়েতে রাজি হয়েছিলাম।না হলে আমার মেয়েকে সারাজীবন ঘরে বসিয়ে রাখলেও তোমার মতো ছেলের সাথে বিয়ে দিতাম না।আর ছেড়ে দেবো না। আমি আমার মেয়েকে নিয়ে আজকেই আমার বাড়িতে যাবো। এভাবে তোমাদের কাছে ফেলে রাখলে মেয়েটা আমার এভাবেই মরে যাবে।তা আমি ওর আব্বু হয়ে কিছুতেই সহ্য করতে পারবোনা।

স্পন্দন সহ সেখানে উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। সামান্য একটা ঘটনা নিয়ে জল এতো দূরে গড়াবে সেটা বোধকরি কেউই ভাবতে পারেনি।

#চলবে,,,,,,,

#অন্তর_দহন
#লেখনিতে_আরুহি_অহি

পর্ব__১৫

স্পন্দন এতো সময় চুপচাপ বসে শুনলেও এবার আর সহ্য করতে পারলো না।বলে উঠলো,

__চন্দ্র কোথাও যাবে না।এই স্পন্দন যতদিন বেঁচে থাকবে চন্দ্র তার সাথেই থাকবে।স্পন্দন ছাড়া চন্দ্র যেমন কিছু না তেমন চন্দ্র ছাড়া স্পন্দন ও কিছু না।আর বাকি রইল চন্দ্রকে কষ্ট দেওয়া।সেটা যদি দিয়েও থাকি ভুলবোঝাবুঝি থেকে দিয়েছি।তার জন্য আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি মেঝো আব্বু।তবুও একথা বলবেন না যে চন্দ্রকে আমার থেকে কেড়ে নিয়ে যাবেন।স্পন্দন বাঁচতে পারবেনা চন্দ্রকে ছাড়া।দয়া করুন আপনারা আমার উপর। আমি বাঁচতে চাই শুধু চন্দ্রকে বুকে আগলে ধরেই বাঁচতে চাই।

__তোমাকে আমি আর বিশ্বাস করিনা স্পন্দন। আমার মেয়ে তোমার কাছে ভালো থাকবে না। আমি আমার মেয়েকে নিয়ে যাবো।এটাই শেষ কথা।

স্পন্দন অসহায় চোখে চন্দ্রের দিকে তাকিয়ে আছে।মুখ ফুটে বলতেও পারছেনা কিছু।বুকটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছে। চন্দ্র চোখ দিয়ে ইশারা করলো শান্ত থাকার জন্য। তারপর বললো,

__আজকে হঠাৎ মেয়ের প্রতি এতোটা কেয়ার নিতে শুরু করলে কেনো আব্বু?যেদিন তোমার মা তোমাকে আমার সাথে স্পন্দনের বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন সেদিন কোথাও ছিলো তোমার এই ভালোবাসা?

__আমি সেদিন অসহায় ছিলাম চন্দ্র মা। কিন্তু আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি।ওরা তোকে ভালো রাখতে পারবে না।সেটা আমি খুব ভালো করেই বুঝে গেছি।

__আমি স্পন্দনকে ছেড়ে কোথাও যাবো না। সেদিন আমাকে তোমরা জোর করে বিয়ের আসরে বসিয়েছো। আজকে আমি বলছি আমি আমার স্বামীকে ছেড়ে কোথাও যাবো না। কোথাও না।

চন্দ্রের এমনিতেই শরীর ভালো না।তার উপর এভাবে উত্তেজিত হওয়াতে আবার খারাপ লাগছে।স্পন্দন চন্দ্রকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বললো,

__প্লিজ তোমাদের পায়ে পড়ি। আমার চন্দ্র অসুস্থ।তোমরা একটু চুপ করো প্লিজ।ওর কষ্ট হচ্ছে।

সবাই একে একে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।স্পন্দন এখনো চন্দ্রকে বুকের সাথে মিশিয়ে রেখেছে।বাইরে প্রচন্ড শোরগোল শুরু হয়েছে।দুই পক্ষ থেকে পাল্টা পাল্টি অভিযোগ করা হচ্ছে। এমন সময় স্পন্দনের দাদিমা বললেন,

__সবাই চুপ করো।আমি বেঁচে থাকতে তোমাদের সাহস কি করে হয় আমার নেওয়া সিদ্ধান্তকে ভুলে যাও। চন্দ্র দিভাই আর স্পন্দন দাদুভাইকে কেউ আলদা করতে পারবেনা। ওদের এই দাদিমা বেঁচে থাকতে তো নয়।যাও নিজেদের কাজ করো।ছেলের বাড়ি থেকে লোকজন আসার সময় হয়ে গেছে। এখন আমি কোনো ঝামেলা চাই না।

সবাই শান্ত হয়ে গেলো। কিন্তু চন্দ্রের বাড়ির লোকজন বিয়ে ছেড়ে বেড়িয়ে গেলো।দাদিমার কথা মতো কেউ তাদের আটকায় নি।স্পন্দন দাদিমাকে বললো,

__বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে আমি চন্দ্রকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে চাই। আমি ওকে এখানে আর এক মুহূর্তও রাখতে চাই না।

দাদিমা সম্মতি দিয়েছেন।ভালোয় ভালোয় বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে স্পন্দনরা বাড়িতে ফিরে গেছে। চন্দ্র আবার কলেজ যেতে শুরু করেছে।স্পন্দনের কড়া নির্দেশ চন্দ্র একা যেতে পারবে না আবার আসতেও পারবে না।যত ব্যস্ততাই থাকুক না কেনো চন্দ্রকে স্পন্দন ই কলেজে আনা নেওয়া করে।

সেদিন চন্দ্র একা ছিলো।ওর বান্ধবীরা কলেজ আসেনি। চন্দ্র ক্লাস শেষে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলো নিচে।স্পন্দন নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছে।একটু দেরি করলেই উন্মাদ হয়ে যাবে।এসব ভাবতে ভাবতে তাড়াতাড়ি করে পা বাড়ালো চন্দ্র। হঠাৎ মনে হলো কেউ ওর হাত পেছনে আড়মোড়া দিয়ে ধরে মুখ চেপে টানতে টানতে একটা ক্লাসরুমে নিয়ে গেছে। চন্দ্র একেতো ভয় পেয়ে গেছে তার উপর ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করছে। কিন্তু লোকটার জোরের সাথে চন্দ্র পেরে উঠছে না। হঠাৎ একটা বিশ্রী রকমের হাসি হাসলো লোকটা। এরপর বললো,

__ওয়েলকাম মিসেস্ স্পন্দন মির্জা। আহ্ এভাবে ছটফট করতে নেই গো ময়না পাখি।

চন্দ্র উমম্ উমম্ শব্দ করছে।

__কিছু বলার জন্য ছটফট করছেন ভাবী? কিন্তু আমি বললে তো কারোর আর বলার অধিকার থাকে না ভাবী। আপনি জানেন আপনার স্বামী একটা ল’ম্পট দুশ্চরিত্রের?সে একটা ভালোবাসার ফাঁদে ফেলে তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। আপনার শ্বশুর মিস্টার সৈয়দ মির্জার সাথে আপনার স্বামীর এতো দ্বন্দ্ব আর শত্রুতা কেনো জানেন? আপনার শ্বশুর ও একটা মুখোশ ধারী সাপ। গিয়ে জিজ্ঞেস করবেন স্পন্দন মির্জা কে কি কি কুকীর্তি করছে বাপ ছেলে মিলে।আর আপনার স্বামীকে বলে দেবেন আমার কাজ হাসিল করতে আমি আমার পথের কাঁটাকে ও ক্ষমা করি না।

কথা গুলো বলেই এক ধাক্কায় চন্দ্রকে ঠেলে ফললো। চন্দ্র উঠে দাঁড়িয়ে বাইরে এসে দেখে কোথাও কেউ নেই।তাই ওয়াশরুমে গিয়ে হাত মুখ বেয়িয়ে নিচে নেমে দেখে স্পন্দন খুঁজছে।এই টুকুতেই অস্থির হয়ে গেছে। চন্দ্র নিজেও আজ বুঝতে পারলো ওকে নিয়ে এতো ভয় কেনো পায় স্পন্দন। চন্দ্র এক দৌড়ে গিয়ে স্পন্দনের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো।স্পন্দন কিছু না বুঝলেও ও এটুকু বুঝতে পারলো হয়তো কোনো কারণে ভয় পেয়ে গেছে।স্পন্দন হাতের বাঁধন শক্ত করে রেখে ঠোঁট দিয়ে চন্দ্রের কপাল ছুঁয়ে দিয়ে বললো,

__কি হয়েছে চন্দ্র?

__কি কিছু হয়নি স্পন্দন। আমি আপনাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না।

__পাগলী আমি তো গেইটে তোকে দাঁড়ানো না দেখে ভেতরে এদিকে ওদিকে দেখছিলাম। ভাবছিলাম ওদের সাথে আড্ডা দিতে বসে গেছে নাকি আমার চন্দ্র।আর এদিকে স্পন্দনকেই ভুলে গেছে।

__কখনো না। কোনোদিন না। চন্দ্র স্পন্দনকে কোনোদিন ভুলতে পারে না।নাহ্ এটা হতেই পারে না।

চন্দ্রকে এতো উত্তেজিত হতে দেখে স্পন্দন আরো অবাক হলো।তবে মুখে কিছু না বলে দুই হাত দিয়ে মুখটা তুলে ধরে বললো,

__আমি মজা করছিলাম চন্দ্র। এভাবে কষ্ট পাচ্ছিস কেনো?

চন্দ্র জিভ দিয়ে ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে নিয়ে বললো,

__বাসায় যাবো স্পন্দন। আমাকে নিয়ে বাসায় চলেন।

স্পন্দন আর ঘাঁটালো না চন্দ্রকে। গাড়িতে উঠতেই চন্দ্র স্পন্দনের একটা হাতের ভেতর হাত দিয়ে কাঁধে মাথা রাখলো।স্পন্দন এবার পেছনে কাউকে চোখে ইশারা করলো। এরপর গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলো। চন্দ্র আর স্পন্দনকে অফিসেই যেতে দেয়নি।স্পন্দন নিজেও আর যায়নি।

এই মুহূর্তে স্পন্দনের বুকে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে চন্দ্র।স্পন্দন মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। দুপুরের ঘটনায় স্পন্দনের মধ্যে যে চাপা টেনশন কাজ করছে না তা নয়। শুধু চন্দ্রকেই বুঝতে দিচ্ছে না।ফোনে একটা মেসেজ এলো। সেখানে একটা ঠিকানা লেখা।সেটা একবার পড়ে নিয়ে ফোনটা রেখে দিলো। চন্দ্রকে ধীরে ধীরে শুইয়ে দিয়ে ঝটপট তৈরি হয়ে বেরিয়ে গেলো স্পন্দন।যাবার আগে মাকে বলে গেছে চন্দ্রের খেয়াল রাখতে।

সন্ধ্যা এখনো ঠিক নামেনি।রাস্তাটা এমনিতেই শুনশান এই সময় থেকেই। হঠাৎ হঠাৎ একটা দুটো গাড়ি পাশ ঘেঁষে বেরিয়ে গেলেও লোকজন নেই বললেই চলে।স্পন্দন গাড়ি থেকে নেমে একটু ঢালু ধরে নিচের দিকে যেতেই একজন লোক কালো পোশাক পরে বেরিয়ে এলো।স্পন্দন কাছে যেতেই বললো,

__স্যার মা’লটা ভেতরেই আছে।দুই চার ঘা দিতেই সুরসুর করে সব উগলে দিয়েছে।বেটার সাথে আরো একজন আছে। সেই ই সেদিন ট্রাক চালাচ্ছিলো।আর আজকে প্রাইভেট কার।

স্পন্দন ভেতরে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসে বললো,

__চৌধুরীর কাজ থেকে কত টাকা খেয়েছিস?

__এক লাখ।আগে পঁচাত্তর আর আজকে ত্রিশ।

__আমি তোদের আরো বাড়িয়ে দিবো।সেইম কাজটা চৌধুরীর সাথে করতে হবে।

দুজনেই অবাক।সাথে মিশাল ও।মিশাল হলো স্পন্দনের বডিগার্ড।মিশালের মনে একটু কিন্তু কিন্তু থাকলেও স্পন্দনের বিরুদ্ধে কিছু বললো না। কারণ স্পন্দন যখন এই কাজ করছে তখন নিশ্চয়ই কিছু ভেবেচিন্তে করছে। ওদের ছেড়ে দিতেই স্পন্দন বললো,

__তোমার সবথেকে বিশ্বাস যোগ্য লোকটাকে এদের পেছনে যেতে বলো।যদি টোপ গিলেই থাকে তাহলে কাজটা করবে।আর না হলে তাকে অর্ডার দিবে।আর তুমি ভালো করেই জানো ঠিক কি অর্ডার তোমাকে দিতে হবে।

__জ্বী স্যার।আমি এখনি পাঠিয়ে দিচ্ছি।

স্পন্দন তাড়াতাড়ি করে গাড়িতে উঠে বাসার পথে এগুতে লাগলো। চন্দ্রকে রেখে আসছে তাই। চন্দ্র নিচে নেমে বড় আম্মুকে বললো,

__বড় আব্বু কোথায়?

__আরে চন্দ্র উঠে গেছিস?খেয়ে নে কিছু?তোর বড় আব্বু তো ঘরেই আছে।একটু আগে ফিরলো।

__বড় আব্বু?আসবো?

__হ্যাঁ আয় মা।কিছু বলবি?

__জ্বী বড় আব্বু।

__স্পন্দনের সাথে তোমার এতো দূরত্ব কেনো বড় আব্বু?

চমকে উঠলো সৈয়দ মির্জা। চন্দ্র আবার প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,

__দুই বছর আগে কি ঘটেছিল বড় আব্বু?হৃদি আপু কোথায়?তার সাথে কি ঘটেছিল?

সৈয়দ মির্জা ঘামতে শুরু করেছে।রুমাল দিয়ে বারবার কপাল মুছতে লাগলেন। চন্দ্র আবার বললো,

__আমি ওতোটাও ভালো না বড় আব্বু। আমার আর স্পন্দনের মধ্যে যদি কারো জন্য দূরত্ব তৈরি করা হয় তাহলে আমি ঠিক কি কি করতে পারি তা তুমি ভাবতেও পারবে না বড় আব্বু। ভবিষ্যতে আমার পেছনে কাউকে লাগাতে হলে বুঝে শুনে লাগিও।আজ কিছু বলিনি বলে এরপর বলবো না এটা ভেবে থাকলে ভুল করবে।

চন্দ্র গটগট করে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। সৈয়দ মির্জা ধপ করে বসে পড়লো।মনে মনে ভাবতে লাগলেন,

চন্দ্র কি তবে সব জেনে গেছে?নয়তো এভাবে কথা বলতে তো চন্দ্রকে আগে কখনো দেখিনি।

#চলবে,,,,,,

ভুল ত্রুটি মার্জনীয়।