অন্তহীন বসন্ত পর্ব-১৩+১৪

0
292

#অন্তহীন_বসন্ত~১৩
লিখা- Sidratul Muntaz

তুমুল বৃষ্টির পর আকাশ অসম্ভব পরিষ্কার হয়ে যায়। বাতাসের স্পর্শ হয় বিশুদ্ধ। ছাদের চারদিকে শীতল বাতাস। অবন্তী ছাদে উঠে এসেছে। পৃথিবীটা হঠাৎ করেই খুব রঙিন মনে হচ্ছে তার। অস্বাভাবিক ভালো-লাগায় শরীর শিহরীত হচ্ছে। হাতের ফুলগুলো নাকের সামনে এনে বুক ভরে ঘ্রাণ নিল। মিষ্টি আবেশে ভরে উঠল হৃদয়। হঠাৎ করেই আকাশে মেঘ গর্জন করে উঠল। আবার বৃষ্টি হবে নাকি? যদি হয়, তাহলে অবন্তী নিশ্চয়ই ভিজবে। আজকে তার ইচ্ছে করছে সর্বোচ্চ পাগলামি করতে। অযথাই ছাদে এই মাথা থেকে ওই মাথা চঞ্চল পায়ে দৌড়ে বেড়াতে। তার পায়ে নুপুর থাকলে বেশ হতো। নুপুরের ঝনঝন শব্দ বাজতো। অবন্তী মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসল। অকারণেই খুব অস্থির লাগছে তার।

হঠাৎ পেছনে পাতা নড়াচড়ার শব্দ হলো। অবন্তী ভয় পেয়ে তাকাল আমগাছটির দিকে। মনে হলো গাছের ডাল-পালাগুলো নড়ছে। জ্বীন-ভূতের কান্ড নয়তো? এতোরাতে একা একা ছাদে ওঠা ঠিক হয়নি। অবন্তী খুশিতে এমন আত্মহারা হয়েছিল যে সময়ের ব্যাপারটা খেয়ালই ছিল না। সে দ্রুত ছাদ থেকে নেমে পড়তে যাবে তখন পেছন থেকে কেউ ডাকল,” দাঁড়াও।”

অবন্তীর পায়ের নিচের মাটি কেঁপে উঠল। বুক ধুকপুক করছে। মাথা ঘুরিয়ে মানুষটিকে দেখে আরও বেশি ভয় পেয়ে গেল। সানভী দাঁড়িয়ে আছে। তার গায়ে ফতুয়া আর ট্রাউজার। হাতে সিগারেট। কুন্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া উড়ে যাচ্ছে। ধোঁয়ার কারণে তার মুখ স্পষ্টভাবে দেখা গেল না। কিন্তু চোখ দু’টো উজ্জ্বল। যেন তারার মতো জ্বলছে। অবন্তীর চেহারা তমসাচ্ছন্ন। ভয় লাগছে কিন্তু ভয়টা সে প্রকাশ করতে চাইল না। সানভী এগিয়ে আসছে; অবন্তী কিছুটা পিছিয়ে গেল। সানভী বলল,” ভয় নেই। আমি তোমাকে কিছু করব না। শুধু কথা বলার জন্য ডেকেছি। এতোরাতে এখানে কি করছো?”

অবন্তী কঠিন মুখে বলল,” আপনাকে কে বলল যে আমি ভয় পেয়েছি? আপনাকে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। বরং আপনারই উচিৎ আমাকে ভয় পাওয়া। আপনার কীর্তি এখনও কাউকে কিছু বলিনি। যদি বলে দেই তাহলে কারো সামনে মুখ দেখাতে পারবেন না।”

সানভী শব্দ করে হেসে উঠল। বাচ্চারা হঠাৎ বড়দের মতো কথা বললে যেভাবে হাসতে হয়, সেই ধরণের হাসি। অবন্তীর গা তিরতির করে কাঁপছে। সে অসম্ভব ঘৃণা করে মানুষটিকে। সানভী সিগারেটে লম্বা টান দিল। ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে আমুদে গলায় বলল,” তোমার অসম্ভব সাহস অবন্তী। হয়তো এজন্যই তোমাকে আমি খুব পছন্দ করি। বিশ্বাস করো, এই পছন্দে কোনো কলুষতা নেই। অতীতে যা হয়েছে তার সবকিছুই প্রায় আমি ভুলে গেছি। শুধু একটা ব্যাপার ভুলতে পারছি না। বলোতো কোনটা?”

অবন্তী মুচকি হেসে বলল,” বাজারের রাস্তায় আপনাকে একবার জুতো দেখিয়ে অপমান করেছিলাম। সেটার কথা বলছেন?”

” এইতো বুঝেছো। ছয়বছর কেটে গেছে। এখনও মনে পড়লে বুক জ্বালা করে।”

অবন্তী বলল,” কিন্তু আফসোস, আপনাকে আমি সত্যি সত্যি জুতোর বারি দিতে পারিনি। ”

সানভী ঠোঁট উল্টে বলল,” বাহ, আমার উপর এখনও এতো রাগ!”

” রাগ না এটাকে বলে ঘৃণা।”

সানভী মাথা নাড়তে লাগল। কোনো জবাব দিল না। অবন্তী চলে যেতে নিলেই সে একটি দুঃসাহসিক কাজ করল৷ অতর্কিতে অবন্তীর হাত চেপে ধরে বলল,” দাঁড়াও। আমি তো এখনও যেতে বলিনি তোমাকে।”

অবন্তী চোখমুখ কুচকে অস্থির কণ্ঠে বলল,” আপনার সাহস কিভাবে হয়? ছাড়ুন আমাকে। আমি চিৎকার করে যদি বাড়ি মাথায় তুলি তাহলে সেটা আপনার জন্য ভালো হবে না।”

সানভী গর্জন করে বলল,” করো চিৎকার! দেখি কে আসে! করো, করো!”

অবন্তী হকচকিয়ে গেল। সানভী নিজেই উন্মাদের মতো চিৎকার করছে। যদি সত্যি শোর-গোলের আওয়াজে কেউ জেগে যায় তাহলে ব্যাপারটা ভালো হবে না। অবন্তী কোনো ঝামেলা চাচ্ছে না। সে চোয়াল শক্ত করে বলল,” দোহাই লাগে, আমার হাত ছাড়ুন।”

” ছাড়ব অবন্তী, ছাড়ব। কিন্তু এতো সহজে না৷ তুমি আমাকে যে অপমান করেছো তা আমি একটুও ভুলতে পারছি না৷ তুমি এক কাজ করো, আমার কাছে ক্ষমা চাও। এমনভাবে ক্ষমা চাও যেন আমি সাথে সাথে তোমাকে ক্ষমা করে দিতে পারি।”

অবন্তী মুখ বিকৃত করে বলল,” অসুস্থ মানুষ আপনি৷ পাগল, বদ্ধ উন্মাদ। ছাড়ুন আমাকে।”

সানভী পৈশাচিক হাসি হাসল,” ক্ষমা তোমাকে চাইতেই হবে অবন্তী।”

” আমি মরে গেলেও আপনার কাছে ক্ষমা চাইবো না। কি করবেন আপনি?”

সানভী কঠিনচোখে তাকাল। তার বামহাত দিয়ে অবন্তীর গালের কাছটা স্পর্শ করে বিশ্রী ভঙ্গিতে বলল,” এমন অবস্থা করবো যে কাউকে আর মুখ দেখাতে পারবে না।”

অবন্তী তীব্র ঝাঁকি মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। সানভী হাসছে। সে এক মুহূর্ত দেরি না করে দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামতে লাগল৷ তার কান ঝাঁ ঝাঁ করছে। ঘরে এসে দরজা আটকে ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি খেল। মিসেস দিলারা ঘুমে কাতর। তিনি কিছু টের পাচ্ছেন না। একবার শুধু পাশ ফিরলেন। অবন্তী সন্তপর্ণে বিছানায় এসে বসল। খুব কান্না পাচ্ছে। তার ডানহাতের ফর্সা চামড়ায় সানভীর আঙুলের দাগ বসে গেছে।

অবন্তীকে নিতে হেলেনরা এলো খুব সকাল-সকাল। জাকিরের অফিস আছে। সবাইকে বাসায় ড্রপ করে সে অফিসে যাবে। তাই খুব তাড়াহুড়ো শুরু হলো। দিলারা বললেন,” নাস্তা খেয়ে যাও।”

হেলেন বলল,” সময় নেই মা। আমাদের যেতে হবে। একদম বাসায় গিয়েই নাস্তা খাবো। অবন্তী,দ্রুত রেডি হয়ে বাইরে আয়।”

অবন্তী বাথরুমে ঢুকল হাত-মুখ ধুঁতে। মাথাটা অসম্ভব ব্যথা করছে। রাতে ভালো ঘুম হয়নি। আবার সকালেও দ্রুত উঠে পড়তে হয়েছে। চোখ দু’টো ফুলে আছে। নিজের কাছে নিজেকেই অদ্ভুত লাগছে।

বাইরে থেকে ভাঙচুরের শব্দ ভেসে এলো। বাড়িতে কি কিছু হয়েছে? অবন্তী কৌতুহল নিয়ে উঠানে ছুটে গেল। সানভী কুলসুমের উপর চেঁচামেচি করছে। সমস্যা হলো, রাত্রীর একটা স্বর্ণের হার খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। গতকাল রাতেই নাকি হারের বাক্সটি কুলসুমকে গুছিয়ে রাখার জন্য দেওয়া হয়েছিল। এখন কুলসুম বলছে সে বাক্স হারিয়ে ফেলেছে। এই নিয়ে তুমুল হৈ-চৈ। জাকির বলল,” মাথা ঠান্ডা করে খুঁজলেই পাওয়া যাবে৷ এতো বিচলিত হওয়ার কিছু নেই।”

সানভী গরম কণ্ঠে বলল,” দেড়লাখ টাকার হার। আর তুমি বলছো বিচলিত হবো না? আমি নিশ্চিত কুলসুম চুরি করেছে। আর এখন হারানোর বাহানা দিচ্ছে। ওকে আমি জিনিসটা বিশ্বাস করে দিয়েছিলাম। রাত্রীর জন্য কেনা উপহার ছিল ওটা।”

কুলসুম কাঁদতে কাঁদতে বলল,” আমারে মাইরা ফালান, তাও চুরির অপবাদ দিয়েন না। আমি আটবছর ধইরা এই বাড়িতে আছি। কোনোদিন কিছু চুরি গেছে? কেউ কি বলতে পারবেন? আর আজকে আপনি ফট কইরা আমারে চোর বানায় দিলেন?”

দিলারা শাসনের ভঙ্গিতে বলল,” সানভী, তুই বেশি বাড়াবাড়ি করছিস। সরাসরি এভাবে কাউকে চোর বলা তোর উচিৎ হয়নি। আর এতো দামী জিনিস তুই কুলসুমের হাতে দিলি কেন? তোর আক্কেলটা কি?”

” আমি কি তখন বুঝেছি যে ও এই কাজ করবে?”

কুলসুম ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল,” আমি কিড়া কাইটা বলতাছি, আমি চুরি করি নাই। কালকে রাতে আপনে যখন আমারে হারের বাক্সটা দিলেন আমি তখন খাবার গরম করতাছিলাম। হারের বাক্স আমি ডাইনিং টেবিলেই রাখছি। আমার এস্পষ্ট মনে আছে। একটু পরে সবার খাওয়া শেষ হওয়ার পরে যখন টেবিল গুছামু, তখন দেখি বাক্স নাই। আমার মাথায় আসমান ভাইঙ্গা পড়ল।”

দিলারা বিরক্তিভরা কণ্ঠে বললেন,” কি আবোল-তাবোল কথা! টেবিল থেকে বাক্স যাবে কই? এখানে তো সব বাড়ির মানুষ। বাইরের তো কেউ নেই।”

কুলসুম আঁড়চোখে তাকাল অবন্তীর দিকে। তার দৃষ্টিকে অনুসরণ করে প্রায় প্রত্যেকেই তাকালো অবন্তীর দিকে। অবন্তীর বুক ধড়াস করে উঠল। এই কথার পর সবাই অবন্তীর দিকেই কেন তাকাচ্ছে! সানভী ঠান্ডা গলায় বলল,” তুই কি বলতে চাস? টেবিল থেকে কেউ ছোঁ মেরে বাক্স নিয়ে চলে গেছে?”

কুলসুম চোখ মুছে বলল,” আমি কি কমু? সারাঘর তন্ন-তন্ন কইরা খুঁজলাম। কোথাও তো পাইলাম না। আর তখন রাত বারোটা বাজে। বাড়ির সবাই ছিল ঘুমাইয়া। টেবিলে খাইতে বসছিল নিশান্ত ভাইয়আ আর অবন্তী আপা।”

সবাই আবারও অবন্তীর দিকে তাকাল। দিলারা ক্ষীপ্ত গলায় বলল,” এখন তুই নিশ্চয়ই এই কথা বলবি না যে আমার নাতি হার চুরি করেছে!”

কুলসুম চোখ বড় করে বলল,” আস্তাগফিরুল্লাহ। এই কথা আমি কখন কইলাম? ”

হেলেন শীতল স্বরে বলল,” তোর যা বলার পরিষ্কার করে বল কুলসুম। তুই কি অবন্তীকে সন্দেহ করছিস?”

দিলারা বিব্রত কণ্ঠে বলল,” ধূর, এসব কি বলো? অবন্তীকে কেন সন্দেহ করবে? আর চুরির প্রসঙ্গ আসছেই বা কেন? হার নিশ্চয়ই বাড়িতেই কোথাও আছে। ভালোমতো খুঁজলেই পাওয়া যাবে।”

সানভীকে কেমন গম্ভীর দেখাচ্ছে। হেলেন স্পষ্ট করে বলল,” আমি কুলসুমের থেকে শুনতে চাই। তুই সত্যি করে বল কুলসুম, অবন্তীকে সন্দেহ করিস? ও তো আমার বোনজী। ছোটবেলা থেকে ওকে আমি কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছি। ওর স্বভাব সম্পর্কে আমি সব জানি। ও এমন কিছু জীবনেও করবে না। তাও যদি কারো সন্দেহ থাকে তাহলে অবন্তীর ব্যাগ চেক করতে পারেন।”

অবন্তী মাথা নিচু করে রইল। জাকির বলল,” ধূর হেলেন, কি বলছো তুমি এসব? ব্যাগ চেক করবে কেন? আমরা কেউ কি একবারও অবন্তীর দিকে আঙুল তুলেছি!”

হেলেন উত্তপ্ত কণ্ঠে বলল,” কিন্তু সানভীকে দেখে তো মনে হচ্ছে সেও এটাই চায়।”

সানভী আড়ষ্ট গলায় বলল,” দেখো ভাবী,জিনিস আমার হারিয়েছে। তোমাদের কারো হারায়নি। তাই আমি বুঝতে পারছি আমার কি অবস্থা। একবার অবন্তীর ব্যাগ চেক করলে যদি তাকে অপমান করা হয় তাহলে বাদ দাও৷ আমি শুধু আমার মনের স্বস্তির জন্য চাইছি। এমনও হতে পারে, ভুল করে জিনিসটা ওর ব্যাগে চলে গেছে। আর নিশান্তও সেখানে ছিল৷ প্রয়োজনে আমি নিশান্তর ব্যাগও চেক করব।”

এই কথায় সবাই সানভীর উপর রেগে গেলেও হেলেন ঠান্ডা মাথায় বলল,” ঠিকাছে। জিনিস যেহেতু তোমার, যেভাবে ইচ্ছা তুমি খুঁজতে পারো। অন্তত মনের মধ্যে কোনো সন্দেহ রেখো না।”

সবার আগে নিশান্তর লাগেজ চেক করা হলো। তারপর অবন্তীর হ্যান্ডব্যাগ নেওয়া হলো। বাড়ির সবার সামনে তার ব্যাগ উল্টো করে ঝাঁকাতে লাগল সানভী। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, এই ব্যাগে যে হার পাওয়া যাবে এই ব্যাপারে সে পুরোপুরি নিশ্চিত। আর হলোও তাই। হারের ছোট্ট বাক্স বেরিয়ে এলো অবন্তীর ব্যাগের সিকরেট পকেট থেকে। সবাই বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ়। অনেকক্ষণ কেউ কোনো কথা বলতে পারল না। অবন্তী স্তব্ধ। তার মনে হলো, সে একটা ঘোরে চলে গেছে। এটা বাস্তব হতেই পারে না। সে ভয়ানক কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছে। হঠাৎ হেলেন এসে অবন্তীর গালে কষে একটা চড় মারল৷ অবন্তী তার সম্বিৎ ফিরে পেল।

চলবে

#অন্তহীন_বসন্ত~১৪
লিখা- Sidratul Muntaz

” বলেছিলাম না, এমন অবস্থা করব যে কাউকে মুখ দেখাতে পারবে না?”

সানভী তার জঘন্য হাসিটা হাসল। অবন্তী কাঁদছে শিশুদের মতো। তার ইচ্ছে করছে মেঝেতে হাত-পা ছড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে। সে বসে আছে ছাদের চিলেকোঠার ঘরে। সহজ কথায় লুকিয়ে আছে। সকালের ওই ঘটনার পর কারো মুখোমুখি হতে ইচ্ছে করছে না। সবাই কেমন দৃষ্টিতে যেন দেখছে অবন্তীর দিকে। দুপুরে অবন্তী খাওয়ার জন্যেও নিচে যায়নি। আর স্বাভাবিকভাবে, তাকে কেউ জোরাজুরিও করতে আসেনি। আগে এই বাড়িতে তার যতটুকু সম্মান ছিল এক নিমেষে তা ধুঁলোয় মিশে গেছে। হেলেন কঠিন গলায় বলে দিয়েছে,” আমার চোখের সামনে তুই আর আসবি না।” এই বাড়িতে অবন্তীর একমাত্র আপনজন ছিল হেলেন। সে-ই যখন এভাবে বলছে, তখন অবন্তী আর কি করবে? নিজেকে সে গুঁটিয়ে রেখেছে ঘরের কোণায়। মিসেস দিলারা অবশ্য এদিকে একবার এসেছিলেন। অবন্তীকে শুকনো মুখে বসে থাকতে দেখে ভদ্রতার খাতিরেই বললেন,” খাওয়া-দাওয়া করছো না কেন? এসো, কিছু মুখে দাও৷ সকাল থেকে না খাওয়া।”

আগে তিনি নরম সুরে কথা বলতেন। এখন কথা বলেছেন ইস্পাতের মতো কঠিন গলায়। অবন্তীর লজ্জায় মুখ লুকিয়ে রাখতে ইচ্ছে করল। অবশ্য সকালের ওই ঘটনার পরেও যে তিনি অবন্তীর সঙ্গে কথা বলবেন তা অবন্তী ভাবতে পারেনি। নেহায়েৎ এই বাড়ির মানুষগুলো ভদ্র। অন্যকোনো বাড়ি হলে নির্ঘাত অবন্তীকে নোংরাভাবে অপমান করতো। এই বাড়িতে এখন পর্যন্ত কেউ তার সঙ্গে খারাপ আচরণটুকুও করেনি। তবে সবাই কেমন নির্বিকার, ভাবলেশহীন। এই ব্যাপারটাও অবন্তীর গায়ে লাগছে। এর মানে কি সবাই ধরেই নিয়েছে, অবন্তীর জন্য চুরি করা কোনো ব্যাপার না? সে গরীব ঘরের মেয়ে বলে এমন একটা কাজ তার জন্য খুব স্বাভাবিক? তার সঙ্গে দেখা হলেই সকলে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এতো অসম্মান আর সহ্য করা যায় না। অবন্তী খুব দ্রুত এই বাড়ি থেকে বের হতে চায়। কিন্তু কিভাবে বের হবে? তার কাছে টাকা-পয়সা কিছু নেই। টাকা থাকলে সে চলে যেতো। সানভী পকেটে হাত গুঁজে বলল,” অপেক্ষা করো। আর কিছুক্ষণ পর পুলিশ আসবে।”

পুলিশের নাম শুনে ধ্বক করে উঠল অবন্তীর বুকটা। আর্তনাদের স্বরে সে বলল,” এসব আপনি কেন করছেন আমার সাথে? কি পাচ্ছেন এসব করে?”

সানভী আপত্তিকর ভঙ্গিতে হেসে উঠল,” শান্তি! মনের শান্তির চেয়ে বড় পাওনা এই দুনিয়ায় আর কিছু নেই অবন্তী।”

অবন্তী করুণ দৃষ্টিতে তাকাল। জিজ্ঞেস করল,” সবাই ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে আমার দিকে। মুখে কেউ কিছু না বললেও আমি বুঝতে পারি, কেউ আমার উপস্থিতি সহ্য করতে পারছে না। কোনো দোষ না করেও আমি শাস্তি পাচ্ছি, অপমানিত হচ্ছি। এতেও কি মন শান্ত হয়নি আপনার?”

সানভী দুইপাশে মাথা নেড়ে বলল,” না৷ এতো সহজে তো শান্ত হবে না আমার মন! এই বাড়িতে পুলিশ আসবে৷ তোমার মা-বাবার চোখের সামনে দিয়ে তারা তোমাকে থানায় নিয়ে যাবে৷ সেই দৃশ্যটা দেখার অপেক্ষাতেই আমি বসে আছি।”

অবন্তী বিস্ময় নিয়ে বলল,” আমার বাবা-মায়ের চোখের সামনে দিয়ে মানে? তারাও কি আসবে?”

” আসবে না। তারা আসছে। পথেই আছে। এতোক্ষণে তো চলে আসার কথা। দেরি কেন হচ্ছে সেটাই বুঝলাম না। ”

” তারা কিভাবে জানল?”

” আমি খবর দিয়েছি!” সানভী হাসল। যেন খুব দারুণ একটা কাজ করতে পেরে সে গভীরভাবে আনন্দিত। অবন্তী ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। একটা মানুষ এতো হৃদয়হীন কিভাবে হতে পারে? তার আবারও কান্না পাচ্ছে। অবন্তী মুখ ভেঙে কেঁদে উঠল। রাগে-দুঃখে মাটির সাথে মিশে যেতে মন চাইছে তার। সানভী এক কদম এগিয়ে এসে বলল,” ছয়বছর ধরে অপমানের যন্ত্রণা পুষে রেখেছি। আজকে তুমিও বুঝবে অপমান কাকে বলে। জীবন এতো সহজ না অবন্তী!”

” আপনি কি চান? কি করলে আপনি থামবেন?”

সানভীর মুখ কঠিন হয়ে এলো। ধারালো দৃষ্টিতে বলল,” কোনোকিছুই আমাকে থামাতে পারবে না। যতক্ষণ না আমার মন শান্ত হচ্ছে তার আগে তো অবশ্যই না।”

তারপর কি একটা ভেবে কোমল স্বরে বলল,” কিন্তু তুমি চাইলেই আমি থেমে যাবো৷ সবকিছু আগের মতো করে দিবো। তুমি কি চাও?”

অবন্তী অসহায়ের মতো তাকাল। মানুষটি কি তাকে নিয়ে ঠাট্টা করতে চাইছে? সে কোনো জবাব দিল না৷ সানভী দেয়ালের সাথে লেগে আয়েশ করে দাঁড়ালো। নিচু কণ্ঠে বলল,” অবন্তী তুমি তো জানো আমি কি চাই! জানো না? আমরা একটা চুক্তি করতে পারি কিন্তু। তুমি যা চাইবে তা আমি দিবো আর আমি যা চাইবো তা তুমি দিবে। ক্লিয়ার?”

অবন্তী নিজেকে সামলে বলল,” কি চান আপনি?”

সানভী কাছে এসে ফিসফিস করে বলল,” তোমাকে চাই। এক রাতের জন্য। ”

অবন্তী এতোটাই কেঁপে উঠল যে দাঁড়ানো অবস্থা থেকে পড়ে যেতে নিচ্ছিল। সানভী দুইহাতে তাকে ধরল। অবন্তী ছিটকে সরে গেল৷ তীব্র ঘৃণাভরা কণ্ঠে বলল,” আমাকে ধরবেন না। ছি, ছি, ধরবেন না। একদম ধরবেন না।”

মুখ বিকৃত করে নিল অবন্তী। থরথর করে কাঁপছে তার শরীর। কপালে ঘাম, চোখ ভর্তি জল আর ঘৃণা। তাকে ভয়ংকর হিংস্র দেখাচ্ছে। সানভী শান্ত স্বরে বলল,” কুল, এটা শুধু একটা অফার। তুমি রাজি না হলে নেই। ইটস ওকে। একটু পর পুলিশ আসবে। চুরির দায়ে তোমাকে ধরে নিয়ে যাবে৷ তোমার বাবা-মায়ের চোখেত সামনে সব ঘটবে। তারা কষ্ট পাবে, কাঁদবে, লজ্জিত হবে। এসব যদি তোমার ভালো লাগে তাহলে ইটস ফাইন। আই হ্যাভ নো প্রবলেম। কিন্ত তুমি চাইলেই সবকিছু আটকাতে পারো।”

অবন্তী চিলেকোঠার ঘর থেকে কিছু খালি বোতল, স্টিলের মগ, নোংরা জুতো, ঝাড়ু, তুলে তুলে সানভীর দিকে ছুঁড়ে মা-রতে লাগল। হিংস্র বাঘিনীর মতো ফোঁস ফোঁস করে বলল,” বের হয়ে যান৷ এক্ষুণি বের হয়ে যান। আপনার এই রূপ আমি সবাইকে দেখিয়ে ছাড়ব।”

সানভী বের হওয়ার আগে শুধু বলল,” এখন তোমার কথা আর কেউ বিশ্বাস করবে তা আমার মনে হয় না। তবুও চেষ্টা করে দেখতে পারো। বেস্ট অফ লাক।”

অবন্তী মেঝেতে বসে দুইহাতে মাথা চেপে ধরল। কাঁদতে লাগল শব্দ করে। সকাল থেকে কাঁদতে কাঁদতে সে হাঁপিয়ে উঠেছে। সানভী নামক মানুষটা যে এমনভাবে তার জীবন বিভীষিকাময় করে তুলবে তা সে চিন্তাও করেনি কখনও। এই মুহূর্তে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা সে ভুলতে পারছে না। ভয়ে শরীর কাঁটা দিচ্ছে। সে কাঁপছে অনবরত। এইযে এতোকিছু হয়ে গেল, একবারও তো নিশান্ত অবন্তীর সঙ্গে দেখা করতে এলো না! সেও কি সবার মতো অবন্তীকে ঘৃণা করছে? অবন্তীর অবচেতন মন বলে উঠল,” নিশ্চয়ই। সে তোমাকে কেন বিশ্বাস করবে অবন্তী? তুমি তো বিশ্বাসের মর্যাদা রাখোনি!”

অবন্তী শিউরে উঠল। ইদানিং অবন্তীর নতুন একটা অভ্যাস তৈরী হয়েছে। সে মাঝে মাঝেই তার ব্যক্তিগত সত্ত্বার কথা শুনতে পায়। যখন তার মন খুব খারাপ হয় অথবা অস্বাভাবিক ভালো হয় তখনি জেগে উঠে অদৃশ্য কণ্ঠস্বর। অবন্তী তার নাম দিয়েছে, মুনিয়া। যে মনের সব গোপন কথা জানে। মুনিয়া বলল,” তোমার কি ধারণা? নিশান্ত তোমাকে ভালোবাসে?”

অবন্তী ফিসফিস করে বলল,” ভালো না বাসলে ওইভাবে তাকায় কেন?তার চাহনী, কথা-বার্তা, স্পর্শ, সবকিছু স্পষ্ট বলে দেয় যে সে আমাকে ভালোবাসে। আমাকে চায়।”

” এই চাওয়াটা তো ভালোবাসা নাও হতে পারে। তাছাড়া তুমি বাস্তবতা ভুলে গিয়ে আবার আবেগের দুনিয়ায় গা ভাসাচ্ছো। তুমি নিজেও জানো তোমাদের এই সম্পর্ক কখনও স্বীকৃতি পাবে না। নিশান্ত তার পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে তোমাকে বিয়ে করবে না। কোথায় নিশান্ত আর কোথায় তুমি! নিজেকে দেখো একবার!”

অবন্তীর মন বিষণ্ণ হয়ে উঠল। কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল,” নিশান্ত আমার জন্য সব করতে পারবে।”

মুনিয়া হেসে উঠল। তার হাসিতে ভর্ৎসনার সুর।

” তুমি অনেক বোকা অবন্তী। সামান্য দু’টি ফুল ছিঁড়ে দিয়েছে বলেই কিন্তু প্রমাণ হয় না যে সে তোমাকে ভালোবাসে। তোমার জায়গায় অন্যকেউ হলেও সে এটা করতে পারতো। তোমার প্রতি তার একটা আকর্ষণ নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু সেটা ভালোবাসা নয়। যদি সে সত্যি তোমাকে ভালোবাসতো তাহলে এতোক্ষণেও বুঝি তোমার খোঁজ নিতে আসতো না সে? অন্তত তার তো উচিৎ ছিল তোমাকে বিশ্বাস করা। সে চাইলেই সরাসরি এসে তোমাকে জিজ্ঞেস করতে পারতো, তুমি সত্যি চুরি করেছো কি-না৷ কিন্তু সে এসব কিছু করেনি। কারণ তার তোমাকে নিয়ে মাথাব্যথাই নেই। সামান্য একটু আহ্লাদীপনাকে তুমি ভালোবাসা ভেবে ভুল করতে পারো না। ”

অবন্তী বলল,” এমনও তো হতে পারে… সে ঘটনাটা বিশ্বাস করেনি। ”

” তাহলে তোমার সাথে দেখা করতে আসবে না কেন?”
” হয়তো তাকে কেউ এখানে আসতেই দিচ্ছে না।”
” সেই সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ। সে এখন আর ছোট নেই। নিজের ইচ্ছায় সে সব করতে পারে। সমস্যা হলো, জীবনটাকে তুমি আবারও রূপকথার মতো সাজানোর চেষ্টা করছো।”

অবন্তী চুপ করে গেল। এবার কি বলবে সে? নিশান্তকে নিয়ে কি সত্যি খুব বেশি বেশি ভাবা হচ্ছে? পরে যদি সব মিথ্যে হয়, যদি মন ভেঙে যায়? অবন্তী আফসোস করতে চায় না। আর সত্যিই তো, তার আর নিশান্তর মাঝে ব্যবধান অনেক। এসব জানাজানি হলে হেলেন খালামণির শ্বশুরবাড়িতে আরও অশান্তির সৃষ্টি হবে। রিমা এমনিতেও তাকে অপছন্দ করে। আর এই ঘটনার পর সে হবে সকলের চোখের বিষ। আর মা যদি এসব জানতে পারে তাহলে অবন্তীকে গলা টিপে মা-রবে। বাবাই বা কি ভাববে? অবন্তীর মনটা দপ করে নিভে গেল। গতরাতে নিশান্তর দেওয়া ফুলগুলো সে খুব যত্নে রেখেছিল। সেগুলোও এখন দুমড়ে-মুচডে ছিঁড়ে ফেলে দিল। আর একদম ভাববে না নিশান্তর কথা। বড় ভুল হয়েছে। শাস্তিযোগ্য ভুল। অবন্তীর ইচ্ছে করছে নিজেকে শাস্তি দিতে। কিভাবে শাস্তি দেওয়া যায়? নিজেকে শাস্তি দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা কি আছে? থাকলে ভালো হতো।

চলবে