#অন্তহীন_বসন্ত~১৯
লিখা- Sidratul Muntaz
অবন্তীকে যখন জীপে তোলা হবে তখনি উপস্থিত হলো রিমা। পুলিশদের উদ্দেশ্যে বলল,” মেয়েটিকে ছেড়ে দিন। আমরা আমাদের অভিযোগ তুলে নিবো। অবন্তী নির্দোষ সেই প্রমাণ পাওয়া গেছে।”
সবাই বিস্মিত হলো। অবন্তীর বাবা মিরাজ উদ্দিন বলল,” আমি জানতাম, আমার মেয়ে চুরি করবেই না।”
পুলিশদের একজন মহিলা অফিসার অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলল,” তাই যদি হবে তাহলে আগে আপনারা থানায় চলুন৷ কেইস ডিসমিস করতে হবে৷ তারপর মেয়েটিকে ছাড়া হবে। উনি কি আপনাদের বাড়ির কাজের মেয়ে?”
রিমা স্পষ্ট গলায় বলল,” একদম না। অবন্তী এই বাড়ির মেয়ের মতো। ওকে ফাঁসানো হয়েছে। এটা এখন আমাদের পারিবারিক ঝামেলা। আমরা ঠিক করে নিবো। আপনারা যেতে পারেন।”
অফিসার বলল,” এতো সহজে তো সবকিছু হয় না। সানভী সাহেব কোথায়? তিনি বললে কেইস তুলে নেওয়া হবে।”
সানভীকে ডাকা হলো। কিন্তু সে কেইস তুলতে নারাজ।
” প্রশ্নই উঠে না। আমি কেইস কেন তুলব? আমি জানি চুরি অবন্তীই করেছে।”
বিলকিস ক্ষেপে উঠে বলল,” খবরদার আমার মেয়ে সম্পর্কে আর একটাও খারাপ কথা বলবে না। অনেকক্ষণ ধরে সহ্য করেছি।”
রিমা পুলিশদের কিছু টাকা দিয়ে বিদায় করল। তারপর অবন্তীর কাঁধে হাত রেখে বলল,” ভয় নেই। এসো মা, আমি জানি তোমার কোনো দোষ নেই। কুলসুম ধরা পড়ার ভয়ে ওই হার তোমার ব্যাগে রেখেছিল।”
মিসেস দিলারা বললেন,” বলিস কি রিমা? কুলসুম এই কান্ড কেন করবে? এতোবছর ধরে মেয়েটা এই বাড়িতে কাজ করে অথচ কখনও কোনো অকারেন্স করেনি।”
রিমা হাসিমুখে বলল,” মানুষের মন বদলাতে সময় লাগে না। একটা কাজের মেয়ের উপর তোমরা বেশিই ভরসা করেছো।”
জাকির রাগী গলায় বলল,” কুলসুম এখন কোথায়? ”
রিমা বলল,” পালিয়েছে। ওকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।”
সানভী বেশ অবাক হলো,” কুলসুম পালিয়েছে মানে?”
রিমা আঁড়চোখে তাকাতেই সানভী বুঝে গেল এই সবকিছু রিমার কারসাজি। সে অবশ্যই কলকাঠি নেড়েছে। কুলসুমকে ভাগানোও কি তার কাজ? সে নিজে থেকে কখনও পালাবে না তা সানভী জানে। কিন্তু রিমা এসব কেন করছে? অবন্তীকে সাহায্য করে তার কি লাভ? রিমা বিলকিসের কাছে গিয়ে বলল,” বিলকিস আপা, আমাকে মাফ করবেন। আমি না জেনে অনেক উল্টা-পাল্টা কথা বলেছি আপনাদের। কিন্তু এখন আমি ভীষণ লজ্জিত। কুলসুম আমার কাছে সব স্বীকার করার পর আমি বুঝতে পেরেছি অবন্তী নির্দোষ ছিল।”
বিলকিস কোনো জবাব দিল না। অবন্তী হতভম্ব হয়ে রিমার দিকে তাকিয়ে আছে। যে মানুষ কখনও স্বাভাবিকভাবে তার সাথে কথা বলেনি সে হঠাৎ এতো মিষ্টিভাষী হয়ে গেল কি করে?
হেলেন সন্ধিগ্ন কণ্ঠে বলল,” আমরা সবাই মিলে কুলসুমকে এতোবার জিজ্ঞাসাবাদ করলাম তাও সে কিছু স্বীকার করল না, অথচ তোমার কাছে সব এতো সহজে স্বীকার করে ফেলল? ব্যাপারটা তো খুব অদ্ভুত! ”
রিমা জানে হেলেন তাকে খোঁচাতে চাইছে। সে একদমই বিচলিত হলো না। মুখের হাসি ধরে রেখে বলল,” এসবের টেকনিক জানতে হয় ভাবী। আমি কুলসুমকে আমার মতো করে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। আর আমার সামনে কেউ মিথ্যা বলে পার পায় না।”
রিমা এবার বিলকিসের উদ্দেশ্যে বলল,” আপা প্লিজ আমাকে মাফ করে দিন। আমি জানি আমি অনেক আজে-বাজে কথা বলেছি। আমি মন থেকে লজ্জিত। মিরাজ ভাই, আপা তো মনে হয় আমার সঙ্গে কথাই বলবে না। আপনি অন্তত কিছু বলুন।”
মিরাজ অপ্রস্তুত হাসি দিয়ে বলল,” থ্যাঙ্কিউ রিমা। তুমি আমার মেয়েকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেছো সেইজন্য আমি কৃতজ্ঞ।”
রিমা বিনীত কণ্ঠে বলল,” এতোবড় হ্যারেসমেন্টের জন্য আমাদের সবাইকে আপনারা মাফ করে দিন প্লিজ। মনে কোনো কষ্ট রাখবেন না। অবন্তী, এদিকে এসো। তুমি নিশ্চয়ই আমার উপর খুব রেগে আছো? আমি জানি তুমি আমাকে ভয় পাও আর মনে হয় অপছন্দও করো। যদিও দোষটা আমারই। ”
রিমা অবন্তীকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দিল। আদুরে কণ্ঠে বলল,” তুমি আমার মেয়ের মতো। যদি কখনও অজান্তে তোমার মনে কষ্ট দিয়ে থাকি, তাহলে আমাকে মাফ করে দিও মা। কেমন?”
অবন্তী কি বলবে ভেবে পেল না। মাথা নাড়ল কেবল। দিলারা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,” আমি তো আগেই বুঝতে পেরেছিলাম অবন্তীর দোষ নেই। চুরির মতো কাজ ও করতেই পারে না। কিন্তু কিছু বলতেও পারছিলাম না। ওই কুলসুম হারামজা*দি কত খারাপ! ভালোই হয়েছে পালিয়ে গেছে। মা বিলকিস, তোমাদের অনেক অসম্মান হলো বুঝতে পারছি। আমাদের মাফ করে দাও। অনেক জঘন্য একটা ব্যাপার ঘটে গেছে। মনে কিছু রেখো না।”
বিলকিস শান্ত গলায় বলল,” ঠিকাছে খালাম্মা। মনে কিছু রাখলাম না।”
সব আবার আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে গেল। নিশান্ত দূর থেকে দেখছিল। অবন্তীর মা আর বাবা তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করছে। অবন্তীর মুখে অনেকক্ষণ পর হাসির রেখা দেখা যাচ্ছে।
___________
সানভী তন্ন-তন্ন করে কুলসুমকে সারা বাড়ি খুঁজেও যখন পেল না তখন বাধ্য হয়ে রিমার কাছে গেল। রিমা তার ঘরে পায়ের উপর পা তুলে টেলিভিশন দেখছিল। তার চেহারায় উৎফুল্ল ভাব। মেজাজ হাসি-খুশি। সানভী সুইচবোর্ড থেকে টিভির লাইন একটানে খুলে ফেলে দিল। রিমা এক ঝটকায় উঠে দাঁড়িয়ে বলল,” কি ব্যাপার সানভী? অসভ্যতা করছিস কেন?”
সানভী দরজা আটকে নিল। তারপর রিমার মুখোমুখি এসে গজগজ করে বলল,” কুলসুম কোথাও নেই। আমাকে না বলে ও কোথাও পালাতে পারবে না। আমি জানি তুই ওকে লুকিয়ে রেখেছিস। ও কোথায় আপা?”
রিমা নির্বিকার স্বরে বলল,” ওকে কিছু টাকা দিয়ে ওর দেশে পাঠিয়ে দিয়েছি। ”
” মানে? তুই এসব কেন করলি? তুই তো অবন্তীকে পছন্দ করিস না৷ তাহলে ওকে বাঁচিয়ে সবার সামনে ভালো সাজার মানে কি?”
” আমি শুধু আমার ছেলের ভালো দেখেছি। আর কিছু না।”
সানভী হতভম্ব গলায় বলল,” এর মানে কি? তুই আবার অবন্তীকে পুত্রবধূ করার কথা ভাবছিস না তো?”
রিমা চোখ বড় করে বলল,” অসম্ভব। বরং কখনও যেন সেইদিন দেখতে না হয় সেই ব্যবস্থাই করেছি।”
সানভী দিশেহারার মতো বলল,” আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। ভেঙে বল।”
” নিশান্ত আর আমার মধ্যে একটা চুক্তি হয়েছিল। অবন্তীকে যদি আমি বাঁচাই তাহলে নিশান্ত অবন্তীর সাথে ব্রেকাপ করবে।”
সানভী অবাক হয়ে বলল,” ভাগিনা রাজি হয়ে গেছে?”
” অবশ্যই রাজি হয়েছে। রাজি হবে না কেন? এখন থেকে অবন্তীর সব ভালো-মন্দের দায়িত্ব আমার। যেহেতু আমি নিশান্তকে কথা দিয়েছি। শোন সানভী, তোকে সাবধান করে দিলাম। তুই কিন্তু অবন্তীর থেকে দূরে থাকবি। ওর যাতে কোনো ক্ষতি না হয়।”
সানভী হাত-তালি বাজিয়ে বলল,” বাহ, এক্সিলেন্ট। তোরা মা-ছেলে মিলে সব ঠিক করে নিলি। আর আমার কোনো ভ্যালুই নেই।”
” তুই যে কাজ করেছিস এরপরেও আমার সামনে আসতে লজ্জাবোধ করার কথা। নির্লজ্জ কোথাকার! আমি চাইলেই তোর সব কুকীর্তি ফাঁস করতে পারতাম। কিন্তু করিনি। ছোটভাই হিসেবে মাফ করেছি। কিন্তু অবন্তীর যদি কিছু হয় তাহলে রাত্রীসহ বাড়ির সবাই জানবে কুলসুমের সাথে তুই কি কি করেছিস। ও আমাকে সব বলে গেছে। এখন বুঝতে পারছি কেন ফাঁকা বাড়িতে সবসময় তুই থেকে যেতি। ছি, শেষমেষ বাড়ির কাজের মেয়েকেও ছাড়লি না? এতো নিম্নরুচি তোর?”
সানভী ক্রোধে লাল হয়ে বলল,” শা*লী মুখ খুলেছে! এতোবড় সাহস কিভাবে হলো?”
রিমা হাত ভাঁজ করে বলল,” মনে রাখিস, তোর সব পাপের খবর এখন আমি জানি।”
” তুই কি এখন আমাকে থ্রেট করবি?”
” আমি চাইলে সেটা করতেই পারি।”
” ভালো হবে না আপা। আর অবন্তীকে তো আমি এমনিও ছাড়ব না। ছাড়ার প্রশ্নই আসে না। ”
” অবন্তীকে ছাড়বি না মানে? খবরদার সানভী, আমি নিষেধ করছি। ওর কিছু হলে আমি নিশান্তর কাছে কোনো জবাবদিহি করতে পারব না।”
” সেটা তোর ব্যাপার।”
” তুই কি চাস আমি রাত্রীকে সব জানিয়ে দেই?”
সানভী বাঁকা হেসে বলল,” রাত্রী জানলেও আমার কিছু যায়-আসে না। কি আর হবে? বড়জোর আমাকে ডিভোর্স দিবে। এতে আমারই লাভ। সংসার করতে করতে হাঁপিয়ে গেছি। এখন একটু ব্রেক দরকার।”
সানভী ঘর থেকে বের হয়ে গেল। রিমা দাঁড়িয়ে আছে স্তম্ভিত হয়ে। মাঝে মাঝে সে ভেবে পায় না যেখানে তার পরিবারের বাকি সদস্যরা এতো ভালো সেখানে সানভী কি করে এমন কুলাঙ্গার পয়দা হলো? তাকে নিজের ভাই বলতেও ঘৃণা হয় আজ-কাল।
__________
নিশান্ত ছাদে দাঁড়িয়ে ছিল। অবন্তী তাকে দেখেই ছুটে এসে ডাকল,” নিশান্ত।”
নিশান্ত সামান্য চমকালো। ম্লান মুখে হাসার চেষ্টা করল। অবন্তী কাছে এসে বলল,” থ্যাংকস।”
“থ্যাংকস কেন?”
অবন্তী এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে নিশান্তকে আলতোভাবে জড়িয়ে ধরল। বুকে মাথা ঠেঁকিয়ে চোখ বুজে বলল,” আমি জানি সবকিছু তুমিই করেছো। ”
নিশান্ত কিছু বলল না। বিষাক্ত একটা অস্থিরতা বুক বেয়ে নেমে নিশ্বাসটা বন্ধ করে দিল। যন্ত্রণাবিদ্ধ কণ্ঠে সে জানতে চাইল,” কি করেছি আমি?”
অবন্তী আহ্লাদী স্বরে বলল,” ঢং কোরো না। রিমা আন্টি এই সবকিছু তোমার কথাতেই করেছে তা আমি খুব ভালো করে জানি বুঝেছো? ”
নিশান্ত চুপ করে রইল। অবন্তী কৃতজ্ঞ স্বরে বলল,” থ্যাঙ্কিউ সো মাচ নিশান্ত। তুমি যখন বলেছিলে সব ঠিক হয়ে যাবে তখন আমি একদম তোমার কথা বিশ্বাস করিনি। আই এম স্যরি।”
অবন্তী এবার লাজুক কণ্ঠে বলল,” আই লভ ইউ।”
নিশান্তর চোখ জ্বালা করছে৷ বুকের কাছে বিষব্যথার মতো জ্বালাময়ী যন্ত্রণাটা বেড়েই চলেছে। এই রকম একটা জাদুময়ী মুহূর্তের জন্য কত প্রতীক্ষায় ছিল সে এক সময়। কিন্তু এখন নিজেকে বন্দী মনে হচ্ছে। অবন্তী মাথা তুলে নিশান্তর দিকে তাকাল। ভ্রু কুচকে বলল,” কি ব্যাপার তোমার? কিছু বলছো না কেন?”
নিশান্ত ক্ষীণ স্বরে বলল,” কি বলব?”
অবন্তী গম্ভীর মুখে বলল,” আমরা একটু পর চলে যাচ্ছি।”
” ও আচ্ছা।”
” শুধু ও আচ্ছা? আর কিছু বলবে না?”
” ভালো থেকো।”
অবন্তী মুখ অন্ধকার করে ফেলল। বিরক্ত গলায় বলল,” তোমার কি হয়েছে নিশান্ত?”
” কিছুই হয়নি। ”
” উহুম। আমি শিউর কিছু একটা হয়েছে। আচ্ছা তুমি কি কাঁদছ?”
” কাঁদব কেন? আমার মনে হয় আমি একটা ব্যাপার রিয়েলাইজ করেছি। সেটা তোমাকে কিভাবে বলব বুঝতে পারছি না।”
” কি ব্যাপার শুনি? বলে ফেলো।” অবন্তী তাকিয়ে রইল। নিশান্ত কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল,” আমি তোমাকে ভালোবাসি না।”
অবন্তী আহত কণ্ঠে বলল,” মানে?”
” মানে তুমি যা ভাবছ তাই। কিছু সম্ভব না। ধরে নাও কখনও কিছু ছিলই না আমাদের মধ্যে।”
অবন্তী কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার পর থমথমে গলায় বলল,” নিশান্ত এসব তুমি কি বলছো?ফাজলামি করছো নাকি আমার সাথে?”
নিশান্ত অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল অবন্তীর মুখের দিকে। তার বড় বড় চোখ দু’টো টলমল করছে। দেখতে এতো মায়া লাগছে! নিশান্তর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গেল৷ বাকি কথাগুলো সে অবন্তীকে কিভাবে বলবে ভেবে পেল না। জীবন এতো কঠিন কেন?
অবন্তী বিক্ষিপ্ত গলায় বলল,” নিশান্ত কথা বলো। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। তুমি কি বলতে চাও?”
” আমি বলতে চাই, আমাদের ব্রেকাপ করা উচিৎ। ”
অবন্তীর মাথায় বজ্রপাত হলো। করুণ গলায় বলল,” আমার পাশে তুমি সবসময় থাকতে চাও, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত, এভাবেই বলেছিলে তাই না? তাহলে এখন এইসব কথা কেন? আমাদের ব্রেকাপ করা উচিৎ মানে?”
নিশান্ত মাথা নিচু করে উত্তর দিল, ” ভুল বলেছিলাম। সেজন্য ক্ষমা চাইছি।”
অবন্তী নিশান্ত কলার চেপে ধরল শক্ত করে। কটমট স্বরে বলল,” কিসের ক্ষমা হ্যাঁ? তুমি কারো অনুভূতি নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারো না। আমি নিশ্চিত তুমি আমার সাথে মজা করছো৷ দেখতে চাইছো আমি এগুলো শুনলে কেমন রিয়েক্ট করি তাই না? প্লিজ এরকম কোরো না! আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, খুব!”
নিশান্ত অনেকক্ষণ কোনো জবাব দিল না। অবন্তী অশ্রুসিক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল জবাবের আশায়। বেশ কিছুক্ষণ পর নিশান্ত অবন্তীর হাত নিজের কলার থেকে ছাড়িয়ে শান্ত গলায় বলল,” আমাকে ভুলে যাও প্লিজ।”
অবন্তী পাগলের মতো ছটফট করে উঠল,” ভুলে যাবো মানে? এতো সহজে কিভাবে ভুলে যাবো? তুমি কি মানুষ নাকি অন্যকিছু? এই কথা বলার চেয়ে ভালো আমাকে মেরে ফেলো!”
নিশান্ত কিছু বলতে পারল না। অবন্তীকে সরিয়ে বলল,” আমাকে যেতে দাও প্লিজ। মাথা ধরেছে। এ বিষয়ে আমরা পরে কথা বলব।”
অবন্তীকে পেছনে ফেলে নিশান্ত এগিয়ে গেল। তখনি টপটপ করে তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল। সে একহাতে মুছে নিল দ্রুত। অবন্তী চিৎকার করে ডাকল,” নিশান্ত দাঁড়াও। তুমি এভাবে যেতে পারো না৷ আমার জীবন শেষ করার কোনো অধিকার নেই তোমার। থামো!”
নিশান্ত থামল না। অবন্তী দৌড়ে এসে তার পথ আটকে দাঁড়ালো। স্পষ্ট করে বলল,” আমার সাথে এমন কেন করছো তুমি? জবাব না দিয়ে কোথাও যেতে পারবে না। বলো!”
অবন্তী গলা ফাঁটিয়ে চিৎকার করল। নিশান্ত ক্ষীপ্ত গলায় বলল,” কারণ আই হেইট ইউ।”
অবন্তী কথাটা সহ্য করতে না পেরে নিশান্তর গালে চড় মারল।
চলবে
#অন্তহীন_বসন্ত~২০
লিখা- Sidratul Muntaz
বেঈমান, বেঈমান, বেঈমান! এই একটি শব্দই প্রতিধ্বনিত হতে লাগল অবন্তীর সদ্য ভঙ্গুর হৃদয়জুড়ে। কত সুন্দর করেই না ভালোবাসার প্রকাশ করেছিল নিশান্ত। মাত্র কয়েক প্রহরের ব্যবধানেই কি কারো অনুভূতি এমন আকাশ-পাতাল বদলে যেতে পারে? অবন্তী ভেবে পায় না। তার দুনিয়া লন্ড-ভন্ড করে দিতে মন চাইছে। এক মুহূর্তের জন্য নিজেকে বিলীন করে দেওয়ার ইচ্ছেটাও মাথাচাড়া দিয়ে উঠল ভীষণভাবে। সে ম-রে গেলেই কেবল এই অসহ্য, বিশ্রী, অপমানিত অনুভূতি থেকে মুক্তি পাবে। নিশান্ত ছাদ থেকে চলে যাওয়ার পর অবন্তী হাউমাউ করে কিছুক্ষণ কাঁদল। অযথাই মাথার চুল ছিঁড়ল, নখ দিয়ে খামচালো হাত-পা। মা ঠিকই বলেছিল, নিশান্তকে নিয়ে দিবাস্বপ্ন দেখা অন্যায়, অন্যায়, অন্যায়। আচ্ছা, নিশান্ত কি তাকে মন থেকে বিশ্বাস করতে পারেনি? অন্য সবাই তো রিমার কথায় মেনে নিয়েছে অবন্তী নির্দোষ। কিন্তু নিশান্ত কি অবন্তীকে এখনও দোষী ভাবছে? সন্ধ্যায় সে যা কিছু বলেছিল তার পুরোটাই কি ছিল ভাণ? অভিনয়?তাই যদি হবে তাহলে ওইভাবে কেন অবন্তীর নিরাশ মনে ভালোবাসার স্বপ্ন ছড়ালো? আবার মুহূর্তেই তা কেন মিথ্যে করে দিল? অবন্তী বুঝি তার হাতের খেলনা! যখন ইচ্ছা তাকে নিয়ে খেলা যায়!
” এই অবন্তী, কাঁদছো নাকি?”
ঈশিতার ডাকে ঘোর কাটল অবন্তীর।অবন্তী চমকে গেল। দ্রুত হাতে চোখমুখ মুছে স্বাভাবিক হতে চাইল। মেয়েটা কখন ছাদে এসে দাঁড়িয়েছে তা টেরও পায়নি অবন্তী। অবশ্য টের পাওয়ার কথাও তো নয়। এই মুহূর্তে হৃদয় ভাঙনের নিষ্ঠুর, পীরাদায়ক, কঠিন শব্দ ছাড়া অন্য কোনো শব্দই অবন্তীর কাছে পৌঁছাবে না। নিজেকে শূন্য লাগছে তার৷ জীবনটা যেন এক লহমায় ধ্বংস হয়ে গেছে। ঈশিতা বলল,” নিচে চলো অবন্তী। তোমার জন্য পলি আপুরা অপেক্ষা করছে। তুমি আজকে আমাদের সাথে ঘুমাবে। মনে আছে ছোটবেলায় একসঙ্গে আমরা ঘুমাতাম?”
চোখ মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়াল অবন্তী। ঈশিতা আবার তার সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ শুরু করেছে। অথচ আজ সকালেও কথা বলছিল না। বিপদে পড়লেই আসলে মানুষ চেনা যায়৷ অবন্তী এখন খুব ভালো করে জানে এই বাড়িতে কারা তাকে কোন চোখে দেখে। নিজেকে সামলে অবন্তী ভ্রু কুঁচকে বলল,” তোমাদের সাথে ঘুমাব মানে? আমাদের তো একটু পরেই চলে যাওয়ার কথা।”
ঈশিতা হাসিমুখে বলল,” যাচ্ছো না তোমরা। ”
” কেন?”
” নিচে চলো। বলছি।”
অবন্তী ঈশিতার সাথে নিচে এলো। বসার ঘরে জড়ো হয়েছে সবাই। বর্ষা, নিয়ন, পলি, রেবা আর নিশান্ত। অবন্তীর চোখ নিশান্তর দিকেই আটকে গেল। দমবন্ধ কষ্ট আর বুকেত জ্বালা-পোড়া তীব্র হয়ে উঠল। চোখ অশ্রুসজল। বাকিরা সবাই অবন্তীকে দেখে হাসিমুখে কথা বলল। গম্ভীর হয়ে রইল কেবল নিশান্ত। ঈশিতা অবন্তীকে টেনে সোফায় বসানো মাত্রই নিশান্ত ঘর থেকে বের হয়ে গেল। সাথে সাথেই অপমানের সুতীক্ষ্ণ আঘাত ফলার মতো ফানা-ফানা করে দিল অবন্তীর মন। নিশান্ত কি আর মুখোমুখিও থাকতে চাইছে না তার? সত্যি বুঝি এতো ঘৃণা করে? মুখটা শুকিয়ে এতোটুকু হয়ে উঠল বেদনায়। চোখের পানিতে কার্ণিশ ভরে যাচ্ছে। পলি অবন্তীর চোখের মুক্তোদানার মতো অশ্রু মুছে দিতে দিতে বলল,” আহারে, মেয়েটা এখনও কাঁদছে, দ্যাখ! অবন্তী প্লিজ তুমি এরকম কোরো না। আজকের দিনটাই অনেক বিশ্রী ছিল। দুঃস্বপ্ন মনে করে ভুলে যাও। হাসো প্লিজ।”
পলি মিষ্টি করে হেসে অবন্তীকে জড়িয়ে ধরল৷ বাকিরাও তাকে সান্ত্বনা দিল। অবন্তীকে সহজ করতে নানা রকম হাসি-তামাশা শুরু করল তারা। অথচ আজ সকালে এদের মধ্যে একজনও অবন্তীর পক্ষ নিয়ে একটা কথা বলেনি। সবাই তো অবন্তীকে ছোটবেলা থেকে চেনে। চুরির মতো ঘৃণ্য কাজ অবন্তীর স্বভাবের সাথে যায় না এটুকু ধারণা নিশ্চয়ই তাদের আছে। আচ্ছা, অবন্তীর জায়গায় ঈশিতা যদি এই বিপদে পড়তো তাহলে কি সবাই ঈশিতার পাশে এসে দাঁড়াতো না? অবন্তীর পাশে তো নিশান্ত ছাড়া কেউ দাঁড়ায়নি। অবশ্য নিশান্ত যা করেছিল সবই ভাণ। তা এই মুহূর্তে বেশ বুঝতে পারছে অবন্তী। যদিও তার মন একটুও মানতে চায় না এই কথা। এতোবড় ঘটনায় অবন্তী একটা শিক্ষা ভালো করেই পেয়েছে। পর কখনও আপন হয় না।
ডাইনিংরুমে বিলকিস বসেছিল। অবন্তী মায়ের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলল,” আমাদের না আজকে চলে যাওয়ার কথা ছিল মা?”
বিলকিসের মুখ মলিন হয়ে উঠল। সে তো এই বাড়িতে এক মুহূর্তও থাকতে চায় না। কিন্তু মিসেস দিলারার অনুরোধে থাকতে হলো। তিনি কোনোমতেই এই রাতের বেলা তাদের বের হতে দেবেন না। আসলে মানুষটিকে বিলকিস ভীষণ সম্মান করে। তাই মুখের উপর কিছু বলতেও পারেনি। অবন্তী কাতর গলায় বলল,” আমার এই বাড়িতে একদম ভালো লাগছে না, মা। চলো না চলে যাই!”
বিলকিস অবন্তীর মাথায় হাত বুলিয়ে নিষ্প্রাণ কণ্ঠে বলল,” সকাল হলেই আমরা চলে যাব মা। তারপর আর কোনোদিন আসব না এই বাড়িতে।”
দলা পাকানো কান্না উঠে এলো অবন্তীর গলায়। দুমড়ে-মুষড়ে যাচ্ছে বুকের ভেতরটা। এই বাড়িতে আর কখনও আসতে চাওয়ার কারণ নেই। তবুও কষ্ট হচ্ছে। নিশান্তর মুখোমুখি অবন্তী জীবনে আর কখনও হতে চায় না। তাই মায়ের কথায় সায় দিয়ে বলল,” আমিও আর এই বাড়িতে আসতে চাই না মা। একদম না!”
বিলকিস অবন্তীকে বুকে জড়িয়ে ধরল। ভাবল অবন্তী বুঝি সারাদিনের অপমান এখনও ভুলতে পারেনি। কিন্তু অপমানের চেয়েও প্রত্যাখ্যানের কষ্ট তাকে বেশি পোড়াচ্ছে৷ ভালোবাসা না পাওয়ায় যেমন একরকম কষ্ট তেমনি পেয়ে হারানোয় আরও দ্বিগুণ রকম কষ্ট! অবন্তী নিঃশব্দে কাঁদছে মায়ের বুকে মাথা রেখে। মনে মনে বলল,” তুমি ঠিক বলেছিলে মা। আমি আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম। কিন্তু মাটিতে পা রেখে কখনও আকাশ ছোঁয়া যায় না। এতোবড় দুঃসাহস করা আমার উচিৎ হয়নি। ”
রাতে অবন্তী অন্যকোথাও গেল না৷ তার মায়ের সাথেই ঘুমালো। কিন্তু ঘুম আসছিল না। অনেকক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে অবশেষে উঠে বসল। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। ঠান্ডা বাতাস শরীর ছুঁয়ে দিচ্ছে মনের মধ্যে অশান্তির একটা ঘাঁ তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছে। যা ক্রমশ যন্ত্রণা দিচ্ছে। এতোবড় ঘাঁ শুকাতে কয়দিন লাগবে কে জানে? হঠাৎ দুইতলার বারান্দায় নিশান্তকে দেখা গেল। তার ঘরের বাতি জ্বলছে। পেছন থেকে আলোর প্রতিফলনের কারণে কেবল নিশান্তর অবয়বটুকু দেখা যাচ্ছে। সে কি এদিকে তাকিয়ে আছে? কিছু অস্বস্তিকর মুহূর্ত কাটল। অবন্তী নিশ্চিত হলো যে নিশান্ত এদিকেই তাকিয়ে আছে। হঠাৎ ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিল। অবন্তী তখনও একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। অবন্তী। তারপর খুব অদ্ভুত একটা ইচ্ছা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। গায়ে ওরনা জড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো অবন্তী।
মাঝরাতে দরজায় করাঘাত শুনে নিশান্ত সামান্য বিস্মিত হলো। ঘুম আসছিল না তার। এজন্য বাতি জ্বেলে একটা বই নিয়ে বসেছিল। বইটি পড়ার চেষ্টা করছিল কিন্তু মনোযোগ পড়ায় ছিল না। সে ভাবছিল অবন্তীর কথা। অসহ্য অস্থিরতায় মন বিষিয়ে উঠছে। সারা রাতটাই হয়তো অনিদ্রায় কাটবে আজ। দরজা খোলার আগে নিশান্ত বলল,” কে?”
ওই পাশ থেকে জবাব এলো না কোনো। শুধু শোনা গেল উচ্চ কম্পাঙ্কের একটি কান্নার সুর৷ আজব তো! নিশান্ত দরজাটা খুলে অবন্তীকে দাঁড়ানো দেখেই চমকালো। পর মুহূর্তেই থমকে গেল বুকের বামপাশ। এমনিতেও অপরাধবোধের দহনে ছাড়খাড় হয়ে যাচ্ছে হৃদয়টা। তার উপর অবন্তীর কান্নামাখা মুখশ্রী দেখে হৃদয়ের সেই দহনে যেন দাবানল শুরু হলো। খুব কষ্টে নিজেকে শান্ত রেখে নিশান্ত প্রশ্ন করল,” কি ব্যাপার? তুমি?”
অবন্তী উত্তর দিল না৷ চট করে নিশান্তকে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল। অবন্তীর এহেন আচরণে নিশান্ত ভালোই ভড়কালো। কয়েক মুহূর্ত স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে থেকে দরজা বন্ধ করল৷ অবন্তী মাথা নিচু করে বিছানার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তার মাথা থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত কাঁপছে। ঘোমটার আড়ালে মুখ ঢাকা বলে নিশান্ত একপাশ থেকে দেখতে পেল না সে কাঁদছে কি-না। তবে নিশান্তর ধারণা, সে অবশ্যই কাঁদছে।
” কিছু বলতে চাও?” খুব স্বাভাবিক স্বরে প্রশ্ন করল নিশান্ত। অবন্তী তার চেয়েও স্বাভাবিক স্বরে বলল,” আমাকে বসতে বলবে না?”
” বসতে ইচ্ছে করলে বসো!” নিশান্ত দায়সারা ভাব দেখাল। কিন্তু মনের মধ্যে ভূমিকম্প শুরু হয়েছে কত আগেই। অবন্তী বিছানায় বসতে বসতে বলল,” আমি কি এসে বিরক্ত করলাম?”
নিশান্ত গম্ভীর হয়ে বলল,” সেরকম কিছু না। বলো কি জন্য এসেছো?”
অবন্তী নিরুত্তাপ কণ্ঠে শুধাল,” আমি কি এখানে থাকতে পারি?”
তার প্রশ্নে বৈদ্যুতিক শক খেল নিশান্ত। বড় বড় চোখে তাকিয়ে হতবাক হয়ে বলল,” মানে?”
” যা শুনেছো তাই। আমি এখানে ঘুমাবো। আর কখনও তো দেখা হবে না আমাদের। মনে করো এটা আমার শেষ আবদার। আর একদম বিরক্ত করব না তোমাকে। বাতি নিভিয়ে দাও।”
অবন্তী সত্যি সত্যি বালিশ ঠিক করে, গায়ে কাঁথা টেনে সাবলীল ভঙ্গিতে শুয়ে পড়ল। মাথা থেকে ঘোমটা সরাল না। নিশান্ত হাঁ করে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল। তার গলাটা শুকিয়ে যাচ্ছে৷ একটু পানি খাওয়া দরকার। কিন্তু পানি ঢেলে খাওয়ার ইচ্ছে বা শক্তি কোনোটাই হলো না। অবন্তী কিছুক্ষণ পর বিরক্ত স্বরে বলল,” এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? কেউ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলে আমি ঘুমাতে পারি না। আর তোমাকে লাইট নেভাতে বললাম না?”
নিশান্ত ধীর গতিতে হেঁটে গেল সুইচবোর্ডের কাছে। লাইট নিভিয়ে বিছানায় এসে বসল ঠিক অবন্তীর কাছাকাছি। তার মনে হচ্ছে সে একটা স্বপ্ন দেখছে। এই মুহূর্তে হয়তো অবন্তী তার ঘরে নেই। পুরোটাই তার অবচেতন মনের কল্পনা। তাই যদি হয়, তাহলে অবন্তীকে সামান্য ছুঁয়ে দেখলে দোষ হবে না নিশ্চয়ই! কিন্তু ছুঁতে গেলে যদি স্বপ্ন ভেঙে যায় কিংবা ঘোর কেটে যায়? তাহলে তো আর অবন্তীকে দেখতেও পাবে না সে৷ এই ভয়ে নিশান্ত তাকে ছুঁয়ে দেখছে না। শুধু তাকিয়ে আছে নির্ণিমেষ। একটু পর বলল,” তুমি কি চাও অবন্তী? কেন এইরকম করছো?”
অবন্তী চোখ মেলে তাকালো না। সামান্য রাগী স্বরে উত্তর দিল,” তুমি জানো না আমি কি চাই?”
” হ্যাঁ জানি। কিন্তু এটা সম্ভব না বিশ্বাস করো!” নিশান্তর কণ্ঠ অসহায় শোনায়। বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে। অবন্তী উঠে বসল হঠাৎ। ঝাঁজ মেশানো কণ্ঠে বলল,” সত্যিই কি কখনও ভালোবাসোনি আমাকে? নিজের বুকে হাত রেখে বলতে পারবে? আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলোতো!”
নিশান্ত অধৈর্য্য হলো। ভীষণ অশান্ত গলায় বলল,” আমি জানি না অবন্তী। প্লিজ এইরকম কোরো না আমার সাথে।”
অবন্তী ফটাস করে একটা চড় বসিয়ে দিল নিশান্তর গালে। নিশান্ত হকচকালো। অবন্তী তার শার্টের কলার চেপে ধরে কাছে টেনে আনল। তারপর মুখ ভেঙে কেঁদে যে গালে চড় দিয়েছিল সেই গালেই চুমু দিতে শুরু করল পাগলের মতো৷ তীব্র হাহাকার মেশানো কণ্ঠে বলতে লাগল,” কেন এমন করলে নিশান্ত? কি দোষ ছিল আমার? আমি তো সেই ছোটবেলা থেকে তোমাকে ভালোবেসেছি। বুঝতে শেখার আগে থেকেই আমার জল্পনা-কল্পনায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ছিলে তুমি। একটুও কি বুঝতে পারোনি কখনও? এতো নিষ্ঠুর তোমার মন? কেন? কেন? কেন? যদি সত্যিই ভালো না বাসো তাহলে কেন স্বপ্ন দেখালে আমাকে? আমার জীবন শেষ করার অধিকার আমি তোমাকে দেইনি। আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি নিশান্ত৷ আমার একদম মরে যেতে ইচ্ছে করছে। প্লিজ আমাকে মেরে ফেলো তুমি। আমি এই যন্ত্রণা নিয়ে কিভাবে বাঁচবো?”
কাঁদতে কাঁদতে হাঁপিয়ে উঠল অবন্তী। আছড়ে পড়ল নিশান্তর বুকে। তার ছোট্ট দেহটা কান্নার দমকে কেঁপে কেঁপে উঠছে৷ ভীষণ, ভীষণ অসহায় দেখাচ্ছে তাকে। নিশান্তর চোখ বেয়েও প্রবাহিত হলো শ্রাবণ ধারা। অবন্তীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ব্যাকুল কণ্ঠে বলল,” আই এম স্যরি।”
অবন্তী তাকাল অবাক হয়ে। নিশান্তর চোখে অশ্রু! অবন্তী অস্থিরচিত্তে বলল,” কিসের স্যারি? আমাকে ভালো না বাসলে তোমার চোখে পানি কেন এলো? বলো, তুমি আমাকে ভালোবাসো না? প্লিজ সত্যি কথা বলো না!”
নিশান্ত মাথা নাড়ল। সত্যি করেই বলল,” হুম ভালোবাসি। অনেক বেশি ভালোবাসি।” অবন্তীর যন্ত্রণা দগ্ধ মনে এক পশলা বৃষ্টির মতো শীতলতা ভর করল মুহুর্তেই। প্রশান্তি ছুঁয়ে গেল হৃদয়ে। নিশান্তর কপালে আলতো চুমু দিয়ে জিজ্ঞেস করল,” তাহলে কেন এতো কষ্ট দিলে?”
” আর কখনও কষ্ট দিবো না।” নিশান্তর কণ্ঠে অনুতাপ।অবন্তী ছোট্ট কিশোরীর মতো হেসে উঠল। নিশান্ত গাঢ় করে চুমু দিল তার ঠোঁটে। কিছুক্ষণ পর অবন্তীও সমানতালে সায় দিতে লাগল। তারা দু’জন ব্যাকুল হয়ে আশ্রয় খুঁজতে লাগল একে-অন্যের কাছে।
চলবে