অন্তহীন বসন্ত পর্ব-২১+২২

0
255

#অন্তহীন_বসন্ত~২১
লিখা- Sidratul Muntaz

তারপর অনেকটা সময় কা-টল নীরবে। ঘড়ির কা-টার টিকটিক শব্দ, ফ্যানের ঘূর্ণন, ঝিঁঝির ডাক সবকিছু মিলে তৈরী হয়েছে একটি ঐশ্বরিক পরিবেশ। জানালা ভেদ করে অর্ধচাঁদের আলো বিছানায় এসে পড়েছে। সবকিছু কেমন স্বর্গীয় বোধ হচ্ছে। তারা একে-অপরের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। অবন্তী তার মাথাটা গুঁজে রেখেছে নিশান্তর বুকে। নিজেকে সবচেয়ে নিশ্চিন্ত, সুরক্ষিত আর সুখী মনে হচ্ছে। তার চেয়ে সুখী বুঝি এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই, থাকতে পারে না৷ হঠাৎ করেই সমস্ত নীরবতা ভেঙে নিশান্ত উত্তাল স্বরে বলল,” অবন্তী, চলো আমরা পালিয়ে যাই।”

অবন্তী হেসে ফেলল। অন্ধকারে নিশান্তর মুখ দেখলে হয়তো সে বুঝতো মজা নয়, সিরিয়াস হয়েই কথাটা বলেছিল নিশান্ত। অবন্তী অকপটে বলল,” পালিয়ে কোথায় যাবো আমরা? ”

নিশান্ত পরিকল্পনা করার মতো বলল,” এখান থেকে সোজা উত্তরায় চলে যাবো, প্রীতমদের বাড়িতে। সারারাত আমরা ওখানেই থাকব। প্রীতম আমার স্কুল ফ্রেন্ড। খুবই ভালো ফ্রেন্ড। কোনো অসুবিধা হবে না। সকালে আমরা যাব কাজী অফিস। তারপর বিয়ে করে এখানে চলে আসব। কেউ মানুক আর না মানুক, তুমি আমার সাথে কানাডায় যাবে।”

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে শেষ করল নিশান্ত। অবন্তী অবাক হয়ে উঠে বসল। জিজ্ঞেস করল,” তুমি কি সিরিয়াস?”

” অবশ্যই সিরিয়াস। নিশান্তর স্পষ্ট উত্তর। অবন্তী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,” আর আমার বাবা-মা? তাদের কি বলব?”

নিশান্ত অবন্তীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,” একবার বিয়েটা হয়ে গেলে সবাই এমনিতেও মেনে নিবে। কিন্তু আমি যদি কানাডা চলে যাই তাহলে তোমার সাথে আবার দেখা হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। আমি আম্মুকে প্রমিস করেছিলাম, তোমাকে ভুলে যাবো। এরপর আম্মু যদি কখনও জানতে পারে আমি প্রমিস ভেঙেছি.. তাহলে তোমার কোনো ক্ষতি করবে। আমি এতোবড় রিস্ক নিতে পারব না অবন্তী।”

কথা শেষ করে নিশান্ত অবন্তীর কপালের এক পাশে চুমু দিল। অবন্তী মাথা নিচু করে মনখারাপ মেশানো গলায় বলল,”এইরকম প্রমিস তুমি কেন করলে নিশান্ত?”

” তোমাকে বাঁচানোর জন্য করেছিলাম।”

” আমি তো একবারও বলিনি যে আমাকে বাঁচাও। তুমি আমাদের ভালোবাসা নিয়ে চুক্তি কিভাবে করতে পারলে?”

নিশান্ত রুদ্ধস্বরে বলল,” আই এম স্যরি। তখন আমার মাথা কাজ করছিল না। আর কোনো উপায়ও ছিল না।”

নিশান্ত অবন্তীর একটা হাত নিয়ে চুমু দিয়ে বলল,” আমি তোমাকে আর কখনও হারাতে চাই না। এখন থেকে সবসময় তুমি আমার চোখের সামনে থাকবে, আমার পাশে থাকবে।”

অবন্তী হাত ছাড়িয়ে হতাশ কণ্ঠে বলল,” তাই বলে আমি পালিয়ে বিয়ে করতে পারব না। কেউ আমাদের ক্ষমা করবে না।”

” এটা তো একদম পালিয়ে বিয়ে হচ্ছে না। আমরা শুধু না জানিয়ে বিয়ে করছি। সকালে এসেই সবাইকে সবকিছু জানিয়ে দিবো। তারপর তারা যা শাস্তি দিবে আমরা মেনে নিবো। শুধু আলাদা হওয়া ছাড়া।”

অবন্তী নিশান্তর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। কি করবে বা বলবে ভেবে পেল না। নিশান্ত রাশভারী কণ্ঠে বলল,” ভালো করে ভেবে দেখো। আজকে সামান্য একটু রিস্ক নিলেই কিন্তু আমরা সারাজীবনের জন্য এক হয়ে যেতে পারি। এর চেয়ে ভালো কি আর কিছু হতে পারে?”

” আমার ভয় লাগছে…” অবন্তী দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। নিশান্ত অবন্তীর মুখটা আঁজলায় নিয়ে বলল,” একদম ভয়ের কিছু নেই। আমি পাশে আছি, থাকব। শুধু তুমি আমাকে একটু বিশ্বাস করো।”

কিছুক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে চিন্তা করল অবন্তী। মা তো বলেছিল এই বাড়িতে আর কখনও আসা হবে না। তাই নিশান্ত কানাডায় চলে গেলে আবার দেখা হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কিন্তু এই মুহূর্তে অবন্তীর মনে হচ্ছে সে নিশান্তকে না দেখে একটা দিনও টিকতে পারবে না৷ ভালোবাসার জন্য মানুষ কত রকম পাগলামিই তক করে। তারাও না হয় একটা ছোটখাটো পাগলামি করল। তাতে কি এমন হবে? অনেক দ্বিধা, অনিশ্চয়তা মনের মধ্যে উঁকি দিলেও সবকিছুকে পাশ কাটিয়ে অবন্তী শেষমেষ রাজি হয়ে গেল নিশান্তর প্রস্তাবে৷ হাসিমুখে বলল,” ঠিকাছে।”

নিশান্ত যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে গেছে এমন আনন্দিত কণ্ঠে শুধালো,” সত্যি?”

” হুম। ভেবে দেখলাম, তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না। তাই একটু রিস্ক নিয়েই দেখি। যা ভাগ্যে আছে হবে।”

নিশান্ত দ্রুত স্টাডি টেবিল থেকে ফোন নিয়ে প্রীতমের নাম্বার ডায়াল করল। তারা আসছে এই খবর জানিয়ে দিল। বের হওয়ার আগে নিশান্ত রিমার জন্য একটা চিরকুট রেখে গেল। সেখানে লেখা-” প্রমিস ভাঙতে আমি বাধ্য হয়েছি আম্মু। সেজন্য আমাকে মাফ করে দিও। অবন্তীকে ছেড়ে থাকার কথা আমি চিন্তাও করতে পারি না। আমরা বিয়ে করতে যাচ্ছি। খুব শীঘ্রই দোয়া নিতে আসব তোমার কাছে।
-নিশান্ত।”

সে’রাতে তারা জীবনের সবচেয়ে সঠিক ‘ভুল’ সিদ্ধান্তটি নিয়ে ফেলল। অনিশ্চিত এই জীবনে মানুষ জানে না কার সাথে কখন কি হবে৷ আগামী পাঁচমিনিটে সে বেঁচে থাকবে কি-না এটুকু নিশ্চয়তাও কেউ দিতে পারে না।তাই সে’রাতে কাজটি করার আগে তারা জানতো না ভুল হচ্ছে নাকি ঠিক। তারা শুধু জানতো ওই মুহূর্তে মনের কথা শোনা সবচেয়ে বেশি জরুরী ছিল। মাঝরাস্তায় গিয়ে ট্যাক্সিতে ওঠার সময় অবন্তীর হঠাৎ আত্মবিশ্বাস কমে গেল। সে কাঁদতে কাঁদতে বলল,” আমরা কি ঠিক করছি নিশান্ত? আমার প্রচন্ড ভয় লাগছে। আমরা হয়তো অনেক বড় অন্যায় করছি।”

নিশান্ত অবন্তীকে শান্ত করতে বলল,” ঠিকাছে। তুমি না চাইলে থাক। চলো ফিরে যাই।”

অবন্তী সাথে সাথেই বলল,” এতোদূর যখন এসেছি, আর ফিরে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। আমরা যাবো।”

নিশান্ত মলিন কণ্ঠে বলল,” পরে আফসোস করবে না তো? আরেকবার ভেবে দেখো।”

অবন্তী চোখের জল মুছতে মুছতে বলল,” আফসোস করতে চাই না বলেই তো যেতে চাইছি। এখন গেলে হয়তো একটু আফসোস হবে কিন্তু না গেলে তার চেয়েও দশগুণ বেশি আফসোস হবে।”

নিশান্ত মৃদু হেসে বলল,” তাহলে চলো।”

অবন্তী নিশান্তর হাত ধরে ট্যাক্সিতে উঠল। তারা রাত আড়াইটায় পৌঁছালো গন্তব্যে৷ রাতের রাস্তা ফাঁকা ছিল৷ তাই যেতে সময় বেশি লাগেনি। প্রীতমদের বাড়িতে শুধু সে আর তার বাবা ছিল। তারা গভীর রাতেও জেগেই ছিল। প্রীতমের মা আর বোন তার খালার বাড়ি বেড়াতে গেছে। তাই বাবা-ছেলে ফাঁকা বাড়িতে রাত জেগে সিনেমা দেখছিল। অবন্তী-নিশান্তকে তারা সাদরে আমন্ত্রণ জানাল। প্রীতমের বাবা সিদ্দিক সাহেব বললেন,” তোমরা কি বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছো?”

অবন্তী মিথ্যে করে বলল,” বাড়িতে আমাকে বিয়ের জন্য প্রেশার দিচ্ছিল। কিন্তু আমি অন্যকাউকে বিয়ে করতে চাই না।”

সিদ্দিক সাহেব বললেন,” ভেরি ইন্টারেস্টিং। কিন্তু তোমাদের বয়স এতো কম!”

প্রীতম বলল,” কম কোথায় বাবা? নিশান্তর বাইশ হয়ে গেছে।”

সিদ্দিক সাহেব ঠোঁট উল্টে বললেন,” অবশ্য বাইশ বছর বিয়ের জন্য এমন কিছু বেশি না। আমি নিজেই বিয়ে করেছিলাম যখন আমার বয়স বাইশ বছর চারমাস।”

তাঁর কথায় সবাই হেসে ফেলল। নিশান্ত জিজ্ঞেস করল,” লভ ম্যারেজ ছিল আঙ্কেল?”

সিদ্দিক সাহেব বললেন,” একদমই না। পিউর এরেঞ্জ ম্যারেজ ছিল।”

প্রায় সারারাত গল্প করে বেশ হাসি-আনন্দেই কা-টল। প্রীতমের বাবাকে দেখে অবন্তী প্রথমে ভয় পেয়েছিল। কিন্তু পরে দেখা গেল তিনি যথেষ্ট ফ্রেন্ডলি। অবন্তী খেয়াল করল, তার এখন একদম টেনশন হচ্ছে না। বরং খুশি আর আনন্দে মনে একটা উথাল-পাথাল ঢেউ খেলা করছে। আর কিছুক্ষণ পরেই সে আর নিশান্ত সারাজীবনের জন্য এক হয়ে যাবে। এমন কথা ভাবতেও আনন্দ। সকালে প্রীতমের মা আর বড়বোন এলো। তারা অবন্তীকে যত্ন করে বউ সাজালো। এই বাড়ির মানুষগুলো সবাই অত্যন্ত ভালো৷ অন্যকোনো পরিবার হলে নিশ্চয়ই এভাবে সাহায্য করতো না। বাড়িতে ফোন করে একটা ঝামেলা পাকানোর চেষ্টা করতো। নিজেরা সেই ঝামেলা এড়িয়ে চলতো। কিন্তু প্রীতমরা অবন্তীদের এমনভাবে ট্রীট করল যেন তারা এই পরিবারের অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রীতমের মা অবন্তীর চিবুকে হাত রেখে বললেন,” এই রকম একটা মিষ্টি মেয়ে আমরা প্রীতমের জন্যেও আনবো। নিশান্ত খুব ভাগ্যবান। কত সুন্দর বউ পেয়েছে।”

প্রীতমের বড়বোন হাসতে হাসতে বলল,” আমিও তাই বলি।”
অবন্তী লজ্জায় আরক্ত হয়ে উঠল। সকাল সাতটার মধ্যেই কাজী চলে এলো। তাদের বিয়ে হয়ে গেল সাড়ে সাতটায়। আটটার মধ্যে তারা প্রীতমদের থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো। অবন্তীর বুক ঢিপঢিপ করছে। অজানা শঙ্কায় কাঁপছে হাত-পা। তবুও একটা সাহস মনের মধ্যে প্রতাপ নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তা হলো- এখন তারা বিবাহিত। নিশান্ত তার স্বামী। কেউ চাইলেও আর তাদের আলাদা করতে পারবে না। গাড়িতে বসে নিশান্ত প্রশ্ন করল,” ভয় লাগছে?”

অবন্তী হাসিমুখে বলল,” একটু নর্ভাস লাগছে। কিন্তু অনেক বেশি আনন্দ হচ্ছে।”

নিশান্ত হাসল। তারও একই অনুভূতি। অবন্তীর দুই হাত শক্ত করে ধরে চুমু দিয়ে বলল,” এখন থেকে আর কোনো ভয় নেই। আমরা সবসময় একসাথে থাকব।”

অবন্তী সজোরে মাথা নেড়ে বলল,” হ্যাঁ। এটাই তো সবচেয়ে আনন্দের বিষয়।”

তারা যখন বাড়িতে পৌঁছালো, তখন বাড়ির পরিবেশ একদম অন্যরকম। সবকিছু অত্যন্ত গুমোট। নিশ্চয়ই এতোক্ষণে সব জানাজানি হয়ে গেছে! ভয়ে অবন্তী নিশান্তর হাত শক্ত করে চেপে ধরে ভেতরে প্রবেশ করল।

চলবে

#অন্তহীন_বসন্ত ~২২
লিখা- Sidratul Muntaz

উঠোনে এসে দাঁড়াতেই দেখা হলো ঈশিতার সঙ্গে। তার চোখেমুখে উদভ্রান্ত ভাব। মনে হয় বাড়ির ভেতরকার ঝামেলা নিয়ে সে ব্যাপক বিচলিত। কিছুক্ষণ অবন্তী আর নিশান্তর হাত-বন্ধনের দিকে তাকিয়ে থেকে সে হতবাক কণ্ঠে বলল,” শান্ত ভাইয়া, তোমরা সকাল সকাল কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছিলে? বিলকিস আন্টি তো অবন্তীকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান!”

নিশান্ত অবিচল কণ্ঠে বলল,” ভেতরে চল। সব বলছি। আম্মু কোথায়?”

ঈশিতা তাড়াহুড়ো স্বরে জবাব দিল,” সবাই ড্রয়িংরুমেই আছে। কত যে হুলুস্থুল হচ্ছে তোমরা তো কিছুই জানো না। আমার বাসা থেকে পালাতে মন চাইছে। এতো অশান্তি আর ভালো লাগে না। কাল থেকে লেগেই আছে একটার পর একটা।”

অবন্তীর মুখ-চোখ শুকিয়ে লাল। অবিরাম ঢোক গিলছে সে। বুকের কাঁপনের সাথে যুক্ত হয়েছে হাতের আঙুলের অস্বাভাবিক কাঁপন। নিশান্তর মুঠিতে ধরে থাকা অবন্তীর আঙুলগুলো ক্রমাগত কাঁপছে। এই অবস্থা লক্ষ্য করে নিশান্ত অবন্তীর দিকে চাইল। অবন্তীর চেহারা ফ্যাকাশে। মনে হচ্ছে যে-কোনো সময় সে কেঁদে ফেলবে। নিশান্ত চোখের পলকে তাকে ইশারা করল। এই ইশারার অর্থ একটাই- ‘ভয় পেও না৷ আমি আছি।’

তারা ঈশিতাকে অনুসরণ করে ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করল। সেখানে সবাই শুকনো মুখে বসে আছে। প্রত্যেকের কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ। চেহারা অত্যন্ত গম্ভীর এবং সিরিয়াস। অবন্তীর আরও ভয় করছে। নিজেকে নিশান্তর পেছনে গুটিয়ে নিতে ইচ্ছে করছে। ঠিক এই অবস্থায় এসে তার মনে হলো, ভয়ানক অন্যায় হয়ে গেছে। এতোবড় অন্যায় শুধরানোর কোনো উপায় নেই।

বসার ঘরে কেউ কোনো কথা বলছে না। কেবল সানভী তারস্বরে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। নিশান্ত ভ্রু কুচকে সেদিকে চেয়ে রইল একদৃষ্টিতে। এই লোক এমন ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছে কেন? তার প্রবলেম কি? একটু পর রাত্রীকেও দেখা গেল। সে গতকালকের ঝামেলায় উপস্থিত ছিল না। সে ছিল বাপের বাড়ি। এসেছে হয়তো আজ সকালে। ডাইনিং রুম থেকে এক গ্লাস পানি এনে ফট করে সানভীর মাথায় ঢেলে দিল রাত্রী। তার এহেন আচরণে যারা বসেছিল তাদের মধ্যে অনেকেই দাঁড়িয়ে গেল। আবার যারা দাঁড়িয়ে ছিল, তাদের মধ্যে কেউ কেউ বিস্ময়ে বসে পড়ল। মিসেস দিলারা হতভম্ব গলায় বললেন,” এটা তুমি কি করলে রাত্রী?”

রাত্রী ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলল,” স্যরি মা। বেয়াদবি হলে ক্ষমা চাইছি। কিন্তু আপনার ছেলে এর চেয়ে ভালো ব্যবহার ডিজার্ভ করে না। আমার মন চাইছে গরম পানি এনে ওর মাথায় ঢেলে দেই। তাহলে যদি ওর নিম্ন মানের মস্তিষ্কের আবর্জনাগুলো একটু পরিষ্কার হয়।”

সানভী রাগে রাত্রীর হাত থেকে কাঁচের গ্লাসটি কেঁড়ে নিয়ে ছুঁড়ে মারল। কাঁচ টুকরোগুলো ঝনঝন করে ভেঙে সোফার নিচে ঢুকে গেল। সবাই আরও আতঙ্কিত হলো। তবে পরিবেশের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে সকাল থেকেই এইরকম ঝামেলা চলছে। তাই প্রত্যেকে অনেকটাই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। কেউ তেমন কিছু বলছে না। পলি, সানজিদাদের মুখ হাসি হাসি। তারা হয়তো এসব ঘটনায় মজা পাচ্ছে। ছোট বাচ্চারা ভয়ে কাতর হয়ে উঠেছে।

অবন্তী আর নিশান্ত একবার চোখাচোখি করল। তারপর একে-অন্যের হাত ছেড়ে দূরে সরে দাঁড়ালো। সানভী আর রাত্রীর মাঝে তখন তুমুল ঝগড়া। তারা ডিভোর্স পর্যন্ত চলে গেছে। দেখে মনে হচ্ছে যে-কোনো সময় তাদের ডিভোর্স হয়ে যেতেই পারে। রিমা শান্ত গলায় বলল,” আহা সানভী, এসব ফালতু কথা মুখে আনিস না। কিসের ডিভোর্স আবার? সব ঠিক হয়ে যাবে।”

রাত্রী কাঁদতে কাঁদতে বলল,” কিচ্ছু ঠিক হবে না রিমা আপা। আপনি জানেন, আমার পেটের বাচ্চাটা কেন নষ্ট হয়েছিল? আপনার ভাই সেজন্য দায়ী। ও যদি দায়িত্বশীল হতো তাহলে কখনও আমি এমন স্টেপ নিতাম না। ও আমাদের সম্পর্কটাকে কখনও গুরুত্বই দেয়নি।”

সানভী অবজ্ঞার স্বরে বলল,” হয়েছে যাও। এখন আমাকে সবার চোখে খারপ বানানোর জন্য আরও কত বাহানা তৈরী করবা করো! আসল কথা হচ্ছে তোমার ডিভোর্স লাগবে। সরাসরি বললেই তো হয়। আমার ঠেকা লাগে নাই যে জোর করে তোমার সাথে সংসার করব। তুমি তো দুই নাম্বার মহিলা। আমি শিউর বাপের বাড়িতে তোমার কোনো কাহিনী আছে। ওখান থেকে ফিরলেই এমন করো।”

রাত্রী আঙুল উঁচিয়ে বলল,” মুখ সামলে কথা বলো নয়তো আমি মুখ খুলতে বাধ্য হবো।”

” আরে যাও, কি মুখ খুলবা তুমি?”

” কি মুখ খুলব? সত্যি শুনতে চাও? রাত-বিরাতে তুমি কয়বার আমার কাছে ধরা খেয়েছো মনে আছে? কয়বার কুলসুমের ঘর থেকে তোমাকে ধরে এনেছি তা কি সব বলব আমি বাড়ির সবাইকে? একবার মুখ ছুটে গেলে কিন্তু আর থামব না আমি।”

প্রত্যেকের কান গরম হয়ে উঠল। রিমা চাপা স্বরে বলল,” ছি রাত্রী, বাচ্চাদের সামনে এসব কি বলছো? এই, সব ছোটরা এখান থেকে যাও। শুধু বড়রা থাকবে। বাচ্চারা বাইরে যাও।”

রিমা সবাইকে তাড়িয়ে দিল। ঈশিতা, পলি, সানজিদা বাইরে এসেই এই প্রসঙ্গে আলাপ শুরু করল। সবার মধ্যে একটা হৈ-চৈ বেঁধে গেল। তারা চূড়ান্ত অবাক। শুধু অবাক হলো না অবন্তী। সে সানভীর চরিত্র সম্পর্কে খুব ভালো-মতোই জানে। নিশান্ত দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। রিমাকে দেখে তো মনে হলো না যে সে বিয়ের ব্যাপারে কিছু জানে। তাহলে কি চিরকুটটা এখনও তার হাতে পড়েনি? বিলকিস ডেকে পাঠাল অবন্তীকে। তামীম এসে বলল,” অবন্তী আপু, তোমাকে ডাকে।”

অবন্তী মায়ের কাছে গেল। বিলকিস সজোরে একটা থাপ্পড় মেরে জিজ্ঞেস করল,” কই গেছিলি সকাল-সকাল? তোকে সারা বাড়ি খুঁজেও পাওয়া গেল না কেন?”

অবন্তী নিশ্চুপ। কি উত্তর দিবে? নিশান্তও তার পাশে নেই।

নিশান্ত ছুটে এসেছে নিজের ঘরে। গতরাতে বের হওয়ার সময় স্টাডি টেবিলে যে ভাঁজ করা চিরকুট রেখে গেছিল সেটা এখনও ওভাবেই আছে। গোলকের নিচে চাপা দেওয়া। দেখে বোঝাই যাচ্ছে যে এটা এখনও কেউ খোলেনি। নিশান্ত চিরকুটটা হাতে নিল। তখনি দরজায় কড়া নাড়ল রিমা। সাথে সাথে চিরকুটটা পেছনে লুকিয়ে ফেলল নিশান্ত। রিমা বিষণ্ণ মুখে বিছানায় এসে বসল। ঘাড়ে ব্যথা করছে তার। ঘাড়ে মালিশ করতে করতে জানতে চাইল,” সকালে কোথায় ছিলি শান্ত? বাড়িতে এতোকিছু ঘটে যাচ্ছে আর তোর কোনো খবরই নেই?”

ধীরপায়ে রিমার পাশে এসে বসল নিশান্ত। রিমা ভারাক্রান্ত গলায় বলল,” যা ভেবেছিলাম তাই হবে মনে হচ্ছে। সানভীর ডিভোর্স হয়ে যাবে।”

নিশান্ত বিব্রতস্বরে বলল,” রাত্রী মামী যা বলছিল তা কি ঠিক আম্মু? কুলসুমের সাথে মামা…”

” এসব নিয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাইছি না বাবা, প্লিজ।”

রিমা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বিড়বিড় করে বলল,” বাড়িভর্তি গেস্ট। বিলকিস, মিরাজ ভাই, সবার সামনে ইজ্জতের ফালুদা হয়ে গেল। ছি, ছি, ছি! ”

হঠাৎ মনে পড়ায় রিমা বলল,” আচ্ছা নিশান্ত, সকাল থেকে তো অবন্তীকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না৷ তোরা দু’জন মিলে কি কোথাও গিয়েছিলি?”

” হুম। এই বিষয়ে আমি তোমার সাথে একটু কথা বলতে চাই।”

” বল, কি কথা?”

নিশান্ত চিরকুট এগিয়ে দিল৷ রিমা অবাক হয়ে বলল,” কি এটা আবার?”

” পড়ো।”

রিমা যেই মাত্র চিরকুট খুলতে যাবে ঠিক তখনি ঈশিতা হন্তদন্ত পায়ে ছুটে এসে বলল,” রিমা ফুপি, মামা আর মামীর মধ্যে আবার লেগেছে। তুমি জলদি আসো।”

” আবার! উফ!”

রিমা কাগজটি ফেলেই উঠে গেল। ঈশিতা যেভাবে এসেছিল সেভাবেই চলে যাচ্ছে। রিমা যাওয়ার আগে বলল,” আমি পাঁচমিনিটে আসছি। তারপর শুনবো সব।”

রিমা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিশান্ত চিরকুটটা হাতে নিয়ে ছিঁড়ে কুটি-কুটি করে ফেলে দিল। মায়ের কাছে যা বলার মুখোমুখিই বলতে হবে। চিরকুটের কোনো প্রয়োজন নেই।

দুপুরের মধ্যে রাত্রী ব্যাগ-পত্র গুছিয়ে পুনরায় বাপের বাড়ি রওনা হলো। সিদ্ধান্ত হলো সামনের শুক্রবারেই তাদের ডিভোর্স হবে। মুখে মুখে তারা একে-অন্যকে অসংখ্যবার তালাক দিল। এতে কারোই কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। বরং একটা অসুস্থ সম্পর্কের হাত থেকে নিস্তার পেয়ে দু’জনেই যেন স্বস্তিবোধ করছিল। তাদের অবস্থা নিয়ে বাড়ির সকলের মন-মেজাজ এতো খারাপ ছিল যে অবন্তী আর নিশান্ত সাহস করে নিজেদের ব্যাপারে কিছু বলেই উঠতে পারল না।

বিকেলে অবন্তীরা চলে যাবে। সিএনজি গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। বিলকিস সবার থেকে বিদায় নিচ্ছে। সেই সময় অবন্তী লুকোচুরি করে নিশান্তর সঙ্গে দেখা করতে এলো। নিশান্ত বলল,” কিছু বলেছো আন্টিকে?”

অবন্তী নিরাশ গলায় বলল,” আমার পক্ষে সম্ভব না। মা আমাকে মেরে ফেলবে।”

নিশান্ত চুপ করে রইল। এবার অবন্তী প্রশ্ন করল,” আর তুমি? রিমা আন্টিকে বলেছো কিছু?”

দুই পাশে মাথা নাড়ল নিশান্ত। সেও বলতে পারেনি। অবন্তী অধৈর্য্যের মতো বলল,” কি হবে এখন? বাড়ি গিয়ে তো আমি কিছুতেই এই কথা বলতে পারব না। মা আমাকে মেরে লাশ বানিয়ে ফেলবে। আবার তোমরাও যদি এখান থেকে চলে যাও তাহলে আর কখনও দেখা হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না। কিছুই তো বদলালো না তাহলে। সব আগের মতোই হচ্ছে।”

” কিছুই আগের মতো হচ্ছে না অবন্তী। বিয়ে যেহেতু করতে পেরেছি, বলতেও পারব। তুমি কান্নাকাটি কোরো না। আপাতত বাসায় যাও৷ আমি অপেক্ষা করছি আম্মুর মেজাজ ঠিক হওয়ার। তারপর আমিই আম্মুকে নিয়ে তোমাদের বাড়িতে আসব। তোমাকে নিয়ে যেতে।”

অবন্তী আশান্বিত কণ্ঠে শুধাল,” সত্যি আসবে তো?”

নিশান্ত অবন্তীর কপালে চুমু দিয়ে বলল,” নিশ্চয়ই আসব৷ ট্রাস্ট মি।”

অবন্তী চোখের পানি মুখে হাসার চেষ্টা করল। নিশান্ত দ্রুত গলায় বলল,” তোমার একটা ফোন নাম্বার আমাকে দিয়ে যাও যাতে প্রয়োজনে কন্টাক্ট করতে পারি।”

” কিন্তু আমার তো ফোন নেই। মায়ের নাম্বারটা রাখো।”

” আমি কি তোমার মায়ের নাম্বারে ফোন দিয়ে তোমাকে চাইব?” অবন্তী চোখ বড় করে বলল,” একদম না।”

নিশান্ত হেসে ফেলল। অবন্তী বলল,” আচ্ছা, তুমি মেয়েদের গলায় কথা বলতে পারো না?”

” প্র্যাকটিস করলে হয়তো পারব। কিন্তু যদি ধরা খেয়ে যাই?”

” তাহলে আমি মার খাবো।”

” আহারে, থাক আমি আন্টির গলা শুনলেই ফোন কেটে দিব। ঠিকাছে? আর তুমিও আমার নাম্বারটা নিয়ে যাও৷”

অবন্তী দুষ্ট হেসে বলল,”তোমার নাম্বার লাগবে না। আমার কাছে আছে।”

” কিভাবে?”

” হেলেন আন্টির মোবাইল থেকে চুরি করেছিলাম আরও একবছর আগে।”

নিশান্ত বিস্মিত গলায় বলল,” তাহলে আমাকে কখনও ফোন করোনি কেন?”

” কে বলেছে করিনি? কখনও কি রং নাম্বার থেকে তোমাকে কেউ বিরক্ত করেছে? মনে করে দেখো!”

অবন্তী হাসতে হাসতে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। নিশান্ত বোকার মতো তাকিয়ে রইল। হ্যাঁ, বাংলাদেশী নাম্বার থেকে প্রায়ই তাকে একটা মেয়ে ফোন দিয়ে বিরক্ত করতো। কিন্তু কখনও নিশান্ত তাকে চিনতে পারেনি। ও মাই গড! সে তাহলে অবন্তী ছিল! নিশান্ত ভীষণ চমক খেল। অবন্তী চলে যাওয়ার মিনিট পাঁচেক পরেই রিমা ঘরে ঢুকল। ক্রোধসিক্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,” এই মেয়ে এখানে কেন এসেছিল?”

নিশান্ত ভ্যাবাচেকা খেল। তৎক্ষণাৎ কিছু বলে উঠতে পারল না। রিমা কাছে এসে নিশান্তর কাঁধে হাত রাখল। ধৈর্য্য নিয়ে বলল,” দ্যাখ শান্ত, তোর মামা আর মামীর মধ্যে এই সব ঝামেলা কিন্তু তোর জন্যই হচ্ছে। আমি আমার প্রমিস রাখতে গিয়ে সানভীকে রাগিয়ে দিয়েছি। তাই ও রাত্রীর সাথে এইভাবে ঝগড়া করেছে। তোর জন্য আমি এতোকিছু করলাম, এতো রিস্ক নিলাম, আশা করি তুইও এর মূল্য বুঝবি। তুই তোর প্রমিস ভুলবি না। তাহলে কিন্তু আমি খুব কষ্ট পাবো, বাবা।”

নিশান্ত নিশ্চুপ। রিমা গম্ভীর কণ্ঠে বলল,” আর কখনও যেন ওই মেয়ের সাথে তোকে মিশতে না দেখি। তাহলে আমি এখন যতটা ভালো মা আছি, তার চেয়েও অনেক বেশি খারাপ মা হতে বাধ্য হবো কিন্তু। মনে থাকবে?”

নিশান্ত মাথা নাড়ল। বলল,” মনে থাকবে।”

চলবে