#অন্তহীন_বসন্ত~২৭
লিখা- Sidratul Muntaz
দুপুরে বিলকিস খাবার-দাবারের মহা আয়োজন করেও দ্বিধান্বিত গলায় বলল,” ভালো কিছুই রান্না করতে পারলাম না। গরীবের বাড়িতে এসেছো। কি আর করবে? কোনোমতে খেয়ে নাও।”
অথচ খেতে খেতে নিশান্তর পেটে জায়গা নেই বললেই চলে। সব রান্না খুবই সুস্বাদু হয়েছে! রিমা কখনও এতো তেল-মশলা দিয়ে রান্না করে না। তাই নানুবাড়ির খাবার নিশান্তর বিশেষ পছন্দ। বিলকিসও সেভাবেই রান্না করেছে। বিকালে অবন্তী আর নিশান্ত বের হলো। বিলকিস বলে রাখল তারা যেন সন্ধ্যার মধ্যেই ফিরে আসে। আকাশে মেঘের গর্জন। রিকশায় ওঠার মিনিট পাঁচেক পরেই টিপটিপ করে বৃষ্টি নামতে শুরু করল। হুড তোলা রিকশার ফাঁকে মেঘাচ্ছন্ন আকাশ, ভেজা রাস্তা, স্নিগ্ধ বাতাস, সব মিলিয়ে দারুণ লাগছিল অবন্তীর। রাস্তার পাশে রিকশা থামিয়ে সে বলল,” চলো ফুচকা খাবো।” তারা নামল ফুচকা খেতে। নিশান্ত শক্ত করে অবন্তীর হাত ধরল। অবন্তীর মনে হলো খুব দ্রুত সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। তার খুব কান্না পাচ্ছিল। এই সুন্দর সময় এতো দ্রুত কেন শেষ হয়ে যাচ্ছে! মিরাজ উদ্দিন পুরো ঘটনার কিছুই জানতে পারলেন না। রাতে নিশান্ত অবন্তীদের বাড়িতেই থাকবে। মিরাজ উদ্দিন অফিস থেকে ফিরে নিশান্তকে দেখে বেশ অবাক হলেন। বিলকিস বলল,” ও কি একটা কাজে আমাদের এখানে এসেছিল। কালই নাকি চলে যাবে। আমি আমাদের এখানেই থাকতে বলেছি।”
মিরাজ বললেন,” ভালো করেছো। কিন্তু অবন্তী আর নিশান্তর সম্পর্ক জানার পরেও তুমি এই রিস্ক নিলে… আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।”
বিলকিস মিথ্যা করে বলল,” ওদের মধ্যে এখন আর কিছু নেই। আমি অনেক বুঝিয়েছি। ওরা মেনে নিয়েছে। বলতে গেলে সব ঠিক হয়ে গেছে। তুমি চিন্তা কোরো না।”
” ঠিক হলে তো ভালোই। তাও তুমি একটু খেয়াল রেখো। বলা তো যায় না… আজকালকের ছেলে-মেয়ে ওরা।”
” আমি নিশ্চয়ই খেয়াল রাখব। বললাম তো চিন্তার কিছু নেই।”
অবন্তীদের বাড়িতে মাত্র দুইটা রুম। মিরাজ সাহেব আর বিলকিসের বেডরুমে নিশান্তকে থাকতে দেওয়া হলো। মিরাজ সাহেব থাকলেন ড্রয়িংরুমের সোফায়। অবন্তীর রুমে অবন্তী আর বিলকিস একত্রে শুয়ে পড়ল। সকাল হতেই নিশান্ত চলে যাবে। এই বিরহে ঘুম আসছিল না অবন্তীর। বেশ কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করল। ঘড়িতে তখন রাত দুইটা বাজে। বিলকিস বিভোর হয়ে ঘুমাচ্ছে। এই সুযোগে অবন্তী বিছানা ছেড়ে নেমে গেল। তার কেন জানি মনে হচ্ছে নিশান্তও ঘুমায়নি। অবন্তী ড্রয়িংরুমে এসে দেখল বাবাও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সে খুব সাবধানে ড্রয়িংরুম পেরিয়ে মাস্টার বেডরুমে ঢুকে পড়ল; সেখানে নিশান্ত শুয়ে ছিল। অবন্তী ঢুকেই দরজাটা চাপিয়ে দিল কিন্তু লাগানোর সাহস হলো না। মা যদি জেগে যায় কোনোভাবে…মায়ের ঘুম খুব পাতলা। অবন্তী ধীরপায়ে হেঁটে নিশান্তর বিছানায় বসল। নিশান্ত তখনি চোখ মেলে তাকাল। সে ঘুমায়নি। শুধু একটু তন্দ্রার ঘোরে ছিল। অবন্তীকে দেখে প্রচন্ড চমকে উঠল। হতভম্ব কণ্ঠে বলল,” কি ব্যাপার তুমি?”
অবন্তী ঠোঁটে আঙুল চেপে বলল,” শশশ, মা আর বাবা দু’জনেই ঘুমাচ্ছে।”
” তাই তুমি এখানে চলে এসেছো? যদি কেউ জেগে যায়? দরজা বন্ধ করে আসো।”
অবন্তী চোখ বড় করে বলল,” দরজা বন্ধ কেন করব?”
” নয়তো কেউ দেখে ফেলবে তো।”
” পাগল হয়েছে? এমনি দেখলে কিছু হবে না। কিন্তু দরজা বন্ধ অবস্থায় দেখলে সর্বনাশ।”
” হ্যাঁ ঠিক বলেছো। থাক, দরজা খোলাই থাক। ”
অবন্তী দুইহাতে গাল চেপে ধরে বসল। মনখারাপ করে বলল,” কালকে তুমি চলে যাচ্ছো তাই না? আর আমাদের দেখা হবে না।”
” দেখা হবে না কে বলল?”
” হলেও তো সেই পাঁচবছর পর। তখন তুমিও অনেক বদলে যাবে আর আমিও বড় হয়ে যাব… আচ্ছা তখন যদি আমাকে তোমার পছন্দ না হয়? ধরো আমি অনেক মোটা হয়ে গেলাম। তখন কি হবে?”
নিশান্ত একটু ঠাট্টা করে বলল,” কি আর হবে? কানাডার কোনো স্লিম ফিগারকে পটিয়ে বিয়ে করে ফেলব।”
অবন্তী বিস্ফারিত দৃষ্টিতে বলল,” খবরদার, একদম জানে মে-রে ফেলব।”
এই কথা বলেই নিশান্তর গলা চেপে ধরল সে। নিশান্ত হাসতে লাগল। অবন্তী মুখ গোমরা করে বলল,” তোমার তো কোনো টেনশনই নেই। মনে হচ্ছে খুব খুশিতে আছো। একটুও কি খারাপ লাগছে না? তুমি আমাকে মিস করবে না?”
নিশান্ত আদুরে কণ্ঠে বলল,” অনেক বেশি মিস করব।”
” সত্যি? তাহলে প্লিজ মার সাথে আরেকবার কথা বলো।”
” কথা বলে লাভ নেই। আন্টি শর্ত বদলাবে না।”
” তাহলে কি হবে? আমরা এতোবছর দেখা না করে থাকব?”
” উহুম। আমরা অবশ্যই দেখা করব।”
” কিভাবে? স্বপ্নে?”
” না, আমরা দেখা করব। কিন্তু সেটা আন্টি না জানলেই তো হলো।”
নিশান্ত চোখ মারল। অবন্তী উত্তেজিত গলায় বলল,” তাইতো। মাকে না জানিয়ে আমরা দেখা করতেই পারি।”
তারপর আবার চুপসে গিয়ে বলল,” কিন্তু সমস্যা হলো মা আমাকে ঘর থেকেই বের হতে দেয় না। তাহলে দেখাটা কিভাবে হবে?”
” তুমি কলেজে ভর্তি হলে এমনিই প্রতিদিন বাইরে বের হতে হবে। তখন ইজিলি দেখা হবে।”
“ইয়েস!”
” এখনি এতো খুশি হওয়ার কিছু নেই। অনেক সাবধানে থাকতে হবে। আর হ্যাঁ, তোমাকে যেই ফোনটা গিফট করেছিলাম সেটা আন্টি আমাকে আজকে ফেরত দিয়ে গেছে। আমি আবার তোমাকে দিচ্ছি। খুব লুকিয়ে রাখবে কিন্তু। ভুলেও যাতে আন্টির হাতে না পড়ে। তাহলে সবশেষ। ”
নিশান্ত তার ব্যাগ থেকে ফোন বের করে অবন্তীকে দিল। অবন্তীর হাত কাঁপতে লাগল। এই এতোবড় জিনিসটা সে কিভাবে লুকিয়ে রাখবে মায়ের থেকে? মায়ের যা বুদ্ধি! অবন্তী বলল,” না, এটা আমি রাখতে পারব না ”
” এক চড় দিব।”
ধমক খেয়ে অবন্তী চমকে উঠল। ভ্রু কুচকে বলল,” তুমি আমাকে বকলে কেন?”
” অদ্ভুত কথা বললে বকবো না? রাখতে পারবে না আবার কি? এটা ছাড়া তোমার সাথে কথা বলব কিভাবে? নাকি চাও আন্টির সামনে বসে তোমার সাথে প্রতিদিন কথা বলি?”
অবন্তী দুইপাশে মাথা নাড়ল। সে চায় না এমনকিছু। নিশান্ত বলল,” তাহলে যা বলছি তাই করো। রাখো এটা।”
অবন্তী আর উচ্চবাচ্য করল না৷ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,” ঠিকাছে।”
সে চলে যেতে নিলেই নিশান্ত হাত ধরে বলল,” আরে, যাচ্ছো কোথায়? বসো প্লিজ।”
” মা উঠে যেতে পারে। ”
” উঠবে না। একটু বসো।”
অবন্তী মাথা নিচু করে বসল। নিশান্ত তার কাঁধে হাত রেখে বলল,” স্যরি।”
অবন্তী কিছু বলল না। ড্রয়িংরুম থেকে মিরাজ উদ্দিনের কাশির আওয়াজ পাওয়া গেল। অবন্তীর ছোট্ট আত্মা তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। সে ফিসফিস করে বলল,” বাবা মনে হয় জেগে গেছে। এখন আমি বের হই কিভাবে?”
” কি বললে? শুনতে পাচ্ছি না। জোরে বলো।”
অবন্তী নিশান্তর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল,” বলছি বাবা জেগে গেছে। এখন বাইরে কিভাবে যাব?”
নিশান্ত চট করে অবন্তীর গলায় চুমু দিয়ে বলল,” যেতে হবে না। এখানেই বসে থাকো।”
অবন্তী একটু কেঁপে উঠল। তারপর লাজুক মুখে বলল,” পাগল? আমাকে পাশে না দেখলে মা উঠে এইখানে চলে আসবে তো।”
নিশান্ত একহাতে অবন্তীর কোমর জড়িয়ে ধরে প্রশ্ন করল,” আসলে কি হবে?”
” কি হবে তুমি জানো না?”
” জানি না তো। আন্টি উঠবে না। তুমি আরও কিছুক্ষণ এখানেই থাকো।”
” থাকলে কি হবে?”
” দেখব।”
” ইশ!অন্ধকারে তো ঠিক করে দেখাই যাচ্ছে না আমাকে। কি দেখছ তুমি?”
” দেখছি না তো, ফীল করছি। তুমি আরও কাছে আসো। আর কিছু লাগবে না।”
অবন্তী আরক্ত হয়ে বলল,” আজকের রাতটা অনেক সুন্দর। আমার সারাজীবন মনে থাকবে।”
” তাই?”
নিশান্ত নেশাতুর হয়ে অবন্তীর গলায় মুখ গুজল। অবন্তী শিউরে উঠল। কানের লতি লাল হয়ে গেল। নিশ্বাসে উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ল। হঠাৎ দরজায় শব্দ হতেই দু’জনের সম্বিৎ ফিরল। অবন্তী দ্রুত বিছানা ছেড়ে নেমে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। বিলকিস কিছুই দেখেনি এমন ভাণ করে বলল,” তোমাকে কয়েল জ্বেলে দিবো নিশান্ত?”
নিশান্ত দুইপাশে মাথা নেড়ে হতভম্ব গলায় বলল,” না।”
বিলকিস অবন্তীর দিকে চেয়ে বলল,” ঘরে আয়।”
অবন্তী টু-শব্দটি না করে দ্রুত নিজের ঘরে চলে গেল। বিলকিস কিছুক্ষণ পরেই এলো। অবন্তী অনবরত পায়চারী করছিল। বিলকিস ঘরে ঢুকতেই সে কৈফিয়ৎ দেওয়ার উদ্দেশ্যে কিছু বলতে যাবে তার আগেই বিলকিস ফট করে অবন্তীর গালে একটা চড় মারল। অবন্তীর জবান বন্ধ হয়ে গেল। বিলকিস আর কিছুই বলল না। চুপচাপ বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল৷ অবন্তী গালে হাত রেখে বোকার মতো ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। তারপর নিজেও মায়ের পাশে এসে শুয়ে পড়ল। সাথে সাথেই বিলকিস শীতল গলায় বলল,” ফোনটা আবার নিয়েছিস কোন সাহসে? কাল নিশান্ত যাওয়ার সময় ওকে ফিরিয়ে দিবি। নয়তো তুইও ওর সঙ্গে চলে যাবি। বুঝতে পেরেছিস আমার কথা?”
অবন্তী কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল,” পেরেছি।”
বিলকিস বলল,” ভেরি গুড। এবার ঘুমা।”
অবন্তী ত্বরিতে চোখ বন্ধ করল। কিন্তু ঘুম এলো না।
চলবে
চলবে
#অন্তহীন_বসন্ত~২৮
লিখা- Sidratul Muntaz
ছয়মাস পরের কথা। একটি মেঘাচ্ছন্ন দুপুরে অবন্তী কলেজ শেষ করে ফিরছিল। যেকোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে। রিকশায় উঠেই মামার উদ্দেশ্য বলল,” হুডটা নামিয়ে দিন মামা।”
আকাশে গুড়গুড় শব্দ। ক্রমশ কালো অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছে প্রকৃতি। দুপুর দেড়টা বাজে কিন্তু মনে হচ্ছে সন্ধ্যা নেমে গেছে। মেঘের আস্তরণে সূর্য লুকায়িত। শীতল আবহাওয়ায় সব অস্বাভাবিক শান্ত। ঝড় আসার পূর্বাভাস। এমন সময় দমকা হাওয়ার মতো কেউ একজন রিকশায় উঠে এলো। বসল অবন্তীর গা ঘেঁষে। পুরো রিকশা কেঁপে উঠল। অবন্তী প্রায় পড়েই যেতে নিচ্ছিল কিন্তু মানুষটি তাকে একহাতে আগলে ধরল। বড় বড় চোখে আগন্তুকের মুখের দিকে তাকাতেই থমকে গেল অবন্তীর হৃৎস্পন্দন। পুরো ছয়মাস সতেরো দিন পর আবারও চোখের শান্তি মিলল। তৃষ্ণার্ত মন তৃপ্ত হলো। সেই তৃপ্তি অশ্রু হয়ে ঝরে পড়ল চোখের কার্ণিশ বেয়ে। অনেকটাই বদলে গেছে নিশান্ত। আগের চেয়ে তাকে কালো দেখাচ্ছে। মনে হয় শুকিয়েছে কিছুটা। তবুও তাকে সুন্দর লাগছে। যেমনটা সবসময় লাগে। অবন্তী খুশিতে বাক্যহারা হয়ে কিছু বলতেই ভুলে গেল। নিশান্ত হাসিমুখে জানতে চাইল,” সারপ্রাইজটা কেমন দিলাম?”
অবন্তী দুইহাতে মুখ চেপে ধরে আনন্দে কেঁদে ফেলল। নিশান্ত আলগোছে অবন্তীর মাথাটা বুকে চেপে ধরল। গভীর গলায় বলল,” আই মিসড ইউ সো মাচ।”
অবন্তী কাঁপা কাঁপা স্বরে আওড়াল,” আমি ভাবতেই পারিনি যে তুমি আসবে।”
নিশান্ত হেসে ফেলল। গতরাতেই নিশান্তর সাথে কথা হয়েছিল অবন্তীর। নিশান্ত ইনিয়ে-বিনিয়ে অনেক জিজ্ঞেস করছিল অবন্তী কখন কলেজে যায়, কয়টায় ফেরে, কোন গেইট দিয়ে বের হয়, ছুটির পর কোন জায়গা থেকে রিকশা নেয়… অবন্তী ভেবেছিল এমনি। কিন্তু সে যে এমন স্ব-শরীরে হাজির হয়ে সারপ্রাইজ দিবে তা অবন্তী কল্পনাও করেনি। তার কান্না দেখে নিশান্ত এবার ক্লান্ত গলায় বলল,” আরে পাগলি, কি শুরু করেছো? আমার শার্ট ভিজিয়ে ফেলবে নাকি? এতো কাঁদছো কেন?”
অবন্তী অভিমান করে বলল,” আমি কষ্টে কাঁদছি আর তুমি চিন্তা করছো শার্ট নিয়ে? হার্টলেস!”
” আহারে, কিন্তু এখন এতো কষ্ট কিসের? আমি তো এসে গেছি তাই না?”
” এটা আনন্দের কষ্ট। তুমি বুঝবে না।”
” আনন্দেরও আবার কষ্ট হয় নাকি?”
ঠিক সেই মুহূর্তে আকাশ কাঁপিয়ে ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। অবন্তী হাত বাড়িয়ে বলল,” দেখেছো, আমার দুঃখে আকাশও আজ কাঁদছে।”
” আগে যদি জানতাম আমাকে দেখে তুমি এভাবে কাঁদতে বসবে তাহলে জীবনেও আসতাম না। আমার ভুল হয়েছে। থাক আমি চলে যাচ্ছি।”
” একটা চড় দিবো। এত্তোদিন পর এসে এখন আবার চলে যাওয়ার কথা বলছো,এতোবড় সাহস তোমার? ঘুঁষি মেরে নাক ফাটিয়ে দিবো কিন্তু।”
নিশান্ত হাসতে হাসতে রিকশাওয়ালার উদ্দেশ্যে বলল,” মামা, বাসস্ট্যান্ডে চলুন তো।”
অবন্তী প্রশ্ন করল, ” বাসস্ট্যান্ডে কেন?”
” গাজীপুরে যাব।”
” সেখানে কেন?”
” আমি রিসোর্ট ভাড়া করেছি।”
” তুমি কি আমাকে তোমার রিসোর্টে নিয়ে যেতে এসেছো?” অবন্তীর দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে এলো। নিশান্ত ঝেরে গলা পরিষ্কার করে বলল,” প্রবলেম কি? আন্টি তো বাসায় নেই। আর আঙ্কেল অফিস থেকে ফিরবে রাতে। তুমি সারাদিন আমার সাথে কাটালেও কেউ টের পাবে না।”
অবন্তী অবাক হয়ে তাকাল৷ গতকাল সে নিশান্তকে এটাও বলেছিল যে তার মা দুই-তিনদিনের জন্য নানুবাড়ি গেছে। এই সুযোগটিই নিশান্ত কাজে লাগাতে চাইছে। অবন্তী কোমরে হাত রেখে বলল,” চালাকি, তাই না? আমি তোমার সাথে কোথাও যাব না। যাও।”
” কেন?” নিশান্তর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। অবন্তী বলল,” কেন আবার কি? তুমি কি আসার আগে আমাকে জানিয়েছো? আমার একটা প্রিপারেশন লাগবে না? হুট করে এসে বললেই আমি তোমার সাথে চলে যাব কেন?”
নিশান্ত ফিসফিস করে বলল,” বিকজ আই এম ইউর হাসব্যান্ড!”
অবন্তী কান পরিষ্কার করার ভং ধরে বলল,” কি? শুনতে পেলাম না!”
নিশান্ত মৃদু হেসে উচ্চস্বরে বলল,” আমি তোমার হাসব্যান্ড হই ডার্লিং৷ আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে তুমি কি ভুলে গেছো?”
অবন্তী সবেগে নিশান্তর মুখ চেপে ধরে বলল,” আস্তে কথা বল। রাস্তার সব মানুষ ঘুরে তাকাচ্ছে।”
” প্রথমে আস্তেই বলেছিলাম। তখন তো তুমি শুনতেই পাওনি।”
” তাই বলে তুমি এমন চেঁচিয়ে বলবে? নির্লজ্জ!”
” আচ্ছা এখন আমি নির্লজ্জ?”
” তাহলে কি?”
” এতোদিন পর দেখা হলো কিন্তু আমরা এমন ঝগড়া করছি কেন? ”
” সেটাও তোমার দোষ। এতোদিন পরে মনে পড়ল যে দেশে একটা বউ আছে। তাকে দেখে আসা দরকার। এদিকে আমি যে অপেক্ষা করতে করতে শুকিয়ে যাচ্ছিলাম সেই খেয়াল কার আছে?”
নিশান্ত অবন্তীর কাঁধে হাত জড়িয়ে বলল,” এখন আমি ব্যস্ত থাকি তো, কি করে আসব বলো? তোমার দায়িত্ব নিতে হবে তার আগে আমাকে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। আমার এখন অনেক কাজ অবন্তী।”
” এজন্যই তো শুকিয়ে এমন অবস্থা হয়েছে তোমার। কি করো সারাদিন? পার্ট টাইম জব?”
” হ্যাঁ। জব করে আগে কিছু টাকা জমিয়ে নিচ্ছি। তারপর একটা বিজনেস শুরু করব। ”
” কি বিজনেস করবে?”
” এখনও ঠিক করিনি।”
” তুমি চাইলে আমি তোমাকে বিজনেস আইডিয়া দিতে পারি।”
” ঠিকাছে দিবে। কিন্তু এখন বলো, তুমি কি আসলেই গাজীপুর যাচ্ছো না আমার সাথে?”
অবন্তী একটু ভাব নিয়ে বলল,” যাব। কিন্তু শুধু একঘণ্টার জন্য৷ এখন পৌনে দুইটা বাজছে। তিনটার মধ্যে আমি বাসায় পৌছাতে চাই।”
নিশান্ত হতাশ গলায় বলল,” দিন দিন তুমিও বিলকিস আন্টির মতো স্ট্রিক্ট হয়ে যাচ্ছো অবন্তী।”
তারা রিসোর্টে পৌঁছালো কাকভেজা হয়ে। আসার পথে অনেকবার বৃষ্টিতে ভিজতে হয়েছে। নিশান্ত ছাতা কিনতে নিয়েছিল। কিন্তু অবন্তী কিনতে দিল না। তার নাকি বৃষ্টিতে ভিজতেই ভালো লাগছে। অনেকদিন বৃষ্টিতে ভেজা হয় না। অবন্তীর কলেজ ড্রেস একদম ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। নিশান্ত বলল,” তুমি গোসলে যাও। পাশেই একটা সুপার শপ দেখেছিলাম। আমি তোমার জন্য ওখান থেকে কিছু কিনে আনি।”
অবন্তী মাথা নাড়ল। নিশান্ত বের হয়ে যেতেই সে নিশান্তর লাগেজ খুলে বসল। কয়েকটা টি-শার্ট, ট্রাউজার আর একটা লুঙ্গী পাওয়া গেল। নিশান্তকে লুঙ্গী পরতে কখনও দেখেনি সে। তাই একটু অবাকই হলো। অবন্তী একটা লাল শার্ট আর লুঙ্গীটা নিয়ে গোসলে ঢুকল। নিশান্ত অবন্তীর জন্য কিছু জামা-কাপড় কিনে এনেছিল। কিন্তু ঘরে এসে সে যা দেখল, তাতে তার চক্ষু চড়কগাছ। অবন্তী লাল শার্ট আর লুঙ্গী পরে বসে আছে। পেটে দুইহাত চেপে ধরে অসহায় ভঙ্গিতে বলল,” আচ্ছা, লুঙ্গী কিভাবে বাঁধতে হয় তুমি জানো? আমি অনেক চেষ্টা করেও পারছি না। বার-বার খুলে যাচ্ছে।”
নিশান্ত স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকল। ভেজা চুল, অসহায় মুখ, ঢোলা শার্ট একদম হাঁটু ছুয়ে ফেলেছে, নিচে আবার লুঙ্গী যেটা আঁটসাঁট করে দুইহাতে আগলে রেখেছে অবন্তী। নিশান্ত হঠাৎ হেসে ফেলল। লজ্জায় অবন্তীর মাথা নিচু হয়ে গেল। গাল হলো লাল। রাগী কণ্ঠে বলল,” তুমি খুব খারাপ।”
নিশান্ত হাসি থামিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করল। অবন্তীর কাছে এসে যত্ন করে লুঙ্গীর গিঁট লাগিয়ে দিল,” এবার ঠিকাছে?”
অবন্তী বলল,”হুম।”
নিশান্তর এখনও হাসি পাচ্ছে। সে খুব কষ্টে হাসি দমিয়ে রাখতে চাইছে। চেষ্টা সফল হচ্ছে না। অবন্তী গরম চোখে বলল,” খবরদার হাসবে না।”
নিশান্ত এবার জোরে হেসে ফেলল। অবন্তী বলল,” আমাকে কি জোকার লাগছে?”
” উহুম। খুব সুন্দর লাগছে। কিন্তু হঠাৎ লুঙ্গী পরার আইডিয়া মাথায় এলো কেন?”
অবন্তী লজ্জিত হেসে বলল,” জানি না। তোমার ট্রাউজার তো আমার হবে না। তাই ভাবলাম লুঙ্গীটাই নেই৷ এটা সেইফ অপশন। কিন্তু এখন দেখি এটা সবচেয়ে ডেঞ্জারাস। তোমরা কিভাবে হ্যান্ডেল করো বলোতো?”
নিশান্ত শব্দ করে হেসে উঠল,” এটা বাবার লুঙ্গী অবন্তী। আমি ভুল করে নিয়ে চলে এসেছি।”
” কি?” এবার অবন্তীও হেসে ফেলল। তারপর হঠাৎ পেটে হাত চেপে ধরল। তার মনে হচ্ছে লুঙ্গী খুলে পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেরকম কিছু হলো না।
দুপুরে খাওয়ার সময় বিলকিস ফোন করল। ঘরেই খাবার অর্ডার করা হয়েছিল। নিশান্ত আর অবন্তী একসাথে খেতে বসেছে। বিলকিসের ফোন দেখেই অবন্তী ভয়ার্ত গলায় বলল,” এই, চুপ করো৷ মা ফোন করেছে। আমি একটু কথা বলি।”
” ওকে।” নিশান্ত খাওয়া বন্ধ করে বসে রইল।
অবন্তী ফোন রিসিভ করে সংকীর্ণ গলায় বলল,” হ্যালো মা, আসসালামু আলাইকুম। ”
” ওয়া আলাইকুম আসসালাম। কলেজ থেকে কখন এসেছিস?”
” এইতো…. দেড়টার দিকে!”
” তোর কলেজ ছুটিই তো হয় দেড়টায়। এতো দ্রুত চলে এলি?”
অবন্তী থতমত খেয়ে বলল,” হ্যাঁ আজকে একটু দ্রুত ছুটি হয়ে গেছে।”
” খেয়েছিস?”
” খাচ্ছি।”
” এতো দেরিতে খাওয়া কেন? ঘরে কি খাবার ছিল না? এসে কি আবার রান্না করেছিস?”
” হ্যাঁ। ভাত রান্না করেছি।”
” আর কি?”
” আর ডিমভাজি!”
” ঠিকাছে। খেয়ে ঘুমিয়ে থাকিস। তোর বাবাকে ফোন করে বলে দিচ্ছি যেন তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে।”
অবন্তী সাথে সাথে বলল,” কোনো অসুবিধা নেই মা। বাবার যখন কাজ শেষ হবে তখনই ফিরুক।”
” একা থাকতে বোর লাগবে না?”
” না মা। বোর কেন লাগবে? আমি টিভি দেখব, পড়াশুনা করব। একদম বোর লাগবে না।”
” ঠিকাছে। রাখি তাহলে। ভালোভাবে থাকিস।”
” আচ্ছা মা। তুমিও ভালো থেকো। আল্লাহ হাফেজ!”!”
ফোন রেখে অবন্তী হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। নিশান্ত বলল,” কি বলে আন্টি?”
” বলছিল বাবাকে ফোন করে দ্রুত আসতে বলবে। কিন্তু আমি নিষেধ করলাম।”
নিশান্ত ভ্রু কুচকালো,” নিষেধ করলে কেন? তুমি তো এমনিও এখানে এক ঘণ্টার বেশি থাকবে না। তাই না?”
অবন্তী কনুই দিয়ে নিশান্তর পেটে খোচা মেরে বলল,” কেন থাকব না? আমার যতক্ষণ ইচ্ছা আমি থাকব। তুমি কি আমাকে তাড়াতে চাও?”
নিশান্ত অবন্তীর হাত দু’টো পেছনে চেপে ধরল। দাঁতে দাঁত পিষে বলল,” আমি তো তোমাকে বেঁধে রাখতে চাই।”
অবন্তী খিলখিল করে হেসে উঠে বলল,”আচ্ছা তাই?”
নিশান্ত মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,” হুম।”
চলবে