#অন্তহীন_বসন্ত ~২৯
লিখা- Sidratul Muntaz
আজকের বিকেলটা অসম্ভব মিষ্টি। তারা দু’জন বারান্দায় দাঁড়িয়ে কফি খেল, একসাথে হাঁটতে বের হলো, আইসক্রিম খেল, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দেখে মুগ্ধ হলো। মুহূর্তেই যেন সময়টা ফুঁরিয়ে গেল। এতো দ্রুত সন্ধ্যা নেমে গেল যে অবন্তীর মনে হলো চোখের পলকেই শেষ। এবার তার যাওয়ার পালা। মনটা বিষণ্ণ হয়ে উঠল। ঘরে এসে পোশাক বদলে নিল। নিশান্ত বাইরে ট্যাক্সি নিয়ে অপেক্ষা করছে। অবন্তী নেমে এসে বলল,” তুমি আর কয়দিন আছো?”
নিশান্ত মুচকি হেসে বলল,” পরশু দিনই চলে যাচ্ছি।”
অবন্তী আহত হলো। গোমরা মুখে বলল,” আর মাত্র একদিন! তাহলে তো শুধু কাল দেখা হবে, না? ”
” শুধু কাল কেন? পরশুও তো দেখা হবে। আমি তোমার কলেজে আসব!”
” তাহলে মাত্র দুইদিন। আবার তুমি কবে আসবে ঠিক নেই। এতো অল্প সময়ের জন্য কেন আসো বলোতো?”
নিশান্ত অবন্তীর মুখটা আঁজলায় নিয়ে নরম স্বরে বলল,” এই সময়টুকু ম্যানেজ করতেই কত কষ্ট হয়েছে জানো? তবুও আমি এসেছি। কারণ তোমাকে না দেখে থাকতে পারছিলাম না।”
অবন্তী হাসার চেষ্টা করল। কিন্তু হাসি এলো না। কান্না পেয়ে গেল। নিশান্ত আঙুল দিয়ে চোখের জল মুছে দিয়ে বলল,” শশশ, তুমি যদি এরকম করো তাহলে আমি কি করব?”
” কিছু করতে হবে না। শুধু আমাকে জড়িয়ে ধরো।”
নিশান্ত শক্ত করে অবন্তীকে জড়িয়ে ধরল। এভাবে বেশ কিছুক্ষণ তারা একে-অপরকে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। একটু পর নিশান্ত বলল,” দেরি হয়ে যাচ্ছে। চলো গাড়িতে উঠি?”
অবন্তী অবাক হয়ে জানতে চাইল,” উঠি মানে? তুমি আমার সাথে যাচ্ছো নাকি?”
” হ্যাঁ। অবশ্যই। তোমাকে একা ছাড়ব নাকি?”
” কোনো দরকার নেই এতোদূর যাওয়ার। আমি একা চলে যেতে পারব। ট্যাক্সিওয়ালা তো আমাকে বাসার সামনেই নামাবে তাই না?”
নিশান্ত অবন্তীর হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলল,” হ্যাঁ। কিন্তু এই বাহানায় আরও কিছুটা সময় আমরা একসাথে থাকলাম। প্রবলেম কি?”
অবন্তী এবার হেসে বলল,” ঠিকাছে, চলো।”
পৌঁছাতে রাত আটটা বেজে গেল। অবন্তী দেখল তাদের বাড়ির সদর দরজা খোলা। ভেতরে আলো জ্বলছে। ভয় পেয়ে গেল অবন্তী। বাবা চলে এসেছে নাকি? নিশান্ত গাড়ি থেকে নামতে নিলেই অবন্তী তার হাত ধরে বলল,” থামো, আমার মনে হয় বাবা ভেতরে আছে। তুমি নামলে যদি দেখে ফেলে?”
নিশান্ত সতর্ক হয়ে বলল,” ওকে, ওকে, আমি নামছি না। তুমি সাবধানে যাও।”
” আমি আগে ভেতরে গিয়ে দেখি বাবা আছে নাকি। যদি না থাকে তাহলে আবার আসব।”
” ঠিকাছে।”
অবন্তী নিশান্তকে জড়িয়ে ধরে বিদায় জানাল। তারপর গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। আবারও হাত নেড়ে বিদায় দিল। তারপর বাড়ির ভেতরে ঢুকল। ঘরে বাবাকে পাওয়া গেল না। পাশের বাড়ির লাবনী আন্টি বসে টিভি দেখছিলেন। অবন্তীকে দেখেই বললেন,”,আরে অবন্তী, কোথায় ছিলে?”
অবন্তী অপ্রস্তুত হলো। তার গায়ে কলেজ ড্রেস নেই। নিশান্তর কিনে দেওয়া পোশাক পরে আছে। কাঁধে কলেজের ব্যাগ। আমতা-আমতা করে বলল,” আমার ফ্রেন্ডের বাসায়।”
” তোমার বাবা এসেছিলেন। আমাকে বললেন ঘরের খেয়াল রাখতে আর তোমাকে এই টাকাটা দিতে। তুমি এখনি তোমার নানুবাড়ি চলে যাও।”
অবন্তী অবাক হয়ে বলল,” নানুবাড়ি কেন? মায়ের কিছু হয়েছে?”
” আরে না, না, তোমার বাবা অফিসের কাজ বাইরে গেছে। ফিরবে কাল সন্ধ্যায়। তুমি তো বাসায় একা থাকতে পারবে না। তাই তোমাকে নানুবাড়িতে তোমার মার কাছে চলে যেতে বলেছে।”
অবন্তী হাঁফ ছেড়ে বলল,” ও আচ্ছা। থ্যাঙ্কিউ আন্টি।”
” আমি তাহলে আসি। বাসায় কাজ আছে। তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।”
” আচ্ছা আন্টি, আসুন।”
লাবনী আন্টি চলে যাওয়ার সাথে সাথেই অবন্তী নিশান্তকে ফোন করে ঘরে ডাকল। নিশান্ত এলেই সে দরজা আটকে উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল,” গেস দ্যা সারপ্রাইজ।”
নিশান্ত কিছু বুঝতে না পেরে বলল,” মানে? কিসের সারপ্রাইজ? ”
” বাবা অফিসের কাজে বাইরে গেছে। আজকে রাতে ফিরবে না। আমাকে টাকা দিয়ে গেছে। যেন মায়ের কাছে নানুবাড়ি চলে যাই।”
” ও আচ্ছা। এটা আগে বলবে না? আমি আরও ট্যাক্সিটা বিদায় করে এলাম।”
অবন্তী বিরক্ত হয়ে তাকাল। দিন দিন নিশান্ত এতো হাঁদা হয়ে যাচ্ছে কেন?
” উফ, হাঁদারাম! আমি কি নানুবাড়ি যাওয়ার কথা একবারও বলেছি?”
” তাহলে? কোথায় যাবে?”
অবন্তী নিশান্তর গলা জড়িয়ে ধরে বলল,” আমি তো ভাবছি তোমার সাথে তোমার রিসোর্টে যাব।”
নিশান্তর মুখ চিমসে গেল। অবন্তীর হাত ঘাড় থেকে নামিয়ে কাঁচুমাচু হয়ে বলল,” এটা ঠিক হবে না। আন্টি জেনে গেলে?”
অবন্তী বিস্মিত হয়ে বলল,” আমার মাকে তুমি এতো ভয় পাও?”
” বিষয়টা ভয়ের না, বিশ্বাসের। আন্টি যদি জানতে পারে তাহলে আমার উপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলবে না?”
অবন্তী রাশভারী কণ্ঠে বলল,” আমার কি তাহলে নানুবাড়ি চলে যাওয়া উচিৎ?”
নিশান্ত খানিক ভেবে বলল,” না…. কিন্তু এমন কিছু করা উচিৎ যেন আন্টি একটুও সন্দেহ না করে।”
নিশান্ত অবন্তীর দিকে চেয়ে চোখ টিপল। অবন্তী হেসে ফেলল। সাথে সাথেই ফোন বাজল। অবন্তী ভীত গলায় বলল,” মা।”
নিশান্ত ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলল,”বলতে না বলতেই…”
অবন্তী একটু দূরে গিয়ে ফোন রিসিভ করল,” হ্যালো, মা।”
ওই পাশ থেকে বিলকিস দরাজ গলায় বলল,” তুই কোথায় গিয়েছিলি অবন্তী? তোর বাবা অফিস থেকে এসে তোকে পেল না কেন? আবার ফোনও ধরছিস না।”
ধমক শুনে অবন্তী ভ্যাবাচেকা খেল৷ গাড়িতে ছিল বলে সে এতোক্ষণ কারো ফোন ধরেনি। মিথ্যা করে বলল,” ফোন সাইলেন্ট ছিল তাই দেখিনি মা। মিতুদের বাসায় গিয়েছিলাম। কাল এক্সাম তো। পড়া দাগাতে গিয়েছিলাম।”
” তোর যে কাল এক্সাম এটা আমাকে আগে বললি না কেন?”
” বলতে মনে ছিল না।”
” তাহলে তো তুই আর আসতে পারবি না এখানে। আমিই কি চলে আসব তোর কাছে?”
” তুমি কেন আসবে আবার? বেড়াতে গিয়েছো, কিছুদিন বেড়াও। আমার একা থাকতে কোনো অসুবিধা নেই।”
বিলকিস গম্ভীর গলায় বলল,” তুই শিউর?”
” একদম শিউর।”
” ঠিকাছে সাবধানে থাকিস। আর মোবাইল হাতের কাছে রাখিস। আমি কিন্তু বার-বার ফোন করব।”
” আচ্ছা।”
” রাতে খেয়ে নিস।”
” আচ্ছা।”
” পরীক্ষার জন্য আবার রাত জেগে পড়তে লাগিস না। সকালে উঠে পড়বি৷ রাতটা ঘুমাবি।”
” ঠিকাছে মা। আমিও তাই ভাবছি৷ আজকে আমি দ্রুত শুয়ে পড়ব। ফোন না ধরলে বুঝে নিও আমিও ঘুমিয়ে পড়েছি।”
” মানে? তুই ঘুমানোর আগে আমাকে ফোন করে জানিয়ে ঘুমাবি। নাহলে আমার টেনশন লাগবে না? ”
“ও আচ্ছা। ঠিকাছে আমি শোয়ার আগে ফোন করব।”
ফোন রেখে অবন্তী দেখল নিশান্ত সোফায় বসে কি যেন চিন্তা করছে। সে গিয়ে নিশান্তর পাশে বসে বলল,” কি ভাবছো?”
” তোমার কি কাল সত্যিই এক্সাম?”
” আরে নাহ। মায়ের সাথে মিথ্যা বলেছি। যেন নানুবাড়ি যেতে না হয়।”
নিশান্ত ফট করে বলে উঠল,” চলো তাহলে আমরা কক্সবাজার ঘুরে আসি?
অবন্তী বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকাল। হতবাক চিত্তে বলল,” তোমার কি মাথা খারাপ? এখন কক্সবাজার রওনা হলে তো পৌঁছাতে পৌঁছাতে সকাল হয়ে যাবে। আমরা ফিরব কখন?”
” কাল সন্ধ্যার মধ্যেই ফিরে আসব। কোনো ব্যাপার না। আমরা ফ্লাইটে করে যাবো। মাত্র আধঘণ্টা সময় লাগবে।”
অবন্তী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ভাবল। তারপর বলল,” কিন্তু টিকিট? টিকিট কি এতো সহজে পাওয়া যাবে?”
” তুমি যাবে কি-না সেটা আগে বলো। তারপর দেখছি।”
অবন্তী নিরাসক্ত কণ্ঠে বলল,” টিকিট যদি পাওয়া যায় তাহলে আমার যেতে আপত্তি নেই।”
নিশান্ত উত্তেজিত হয়ে বলল,” ডান?”
” হুম, ডান।” হাসল অবন্তী। অনলাইনে টিকিট পাওয়া গেল। রাত এগারোটার ফ্লাইট। তারা প্রথমে রিসোর্টে গেল। সেখান থেকে তৈরী হয়ে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে বের হলো। গাড়িতে ওঠার পর থেকেই অবন্তী কেমন একটা উশখুশ করতে লাগল। নিশান্ত বিষয়টা খেয়াল করে বলল,” এ্যানি প্রবলেম?”
অবন্তীর এতোক্ষণে বুক ধুকপুকানি শুরু হয়ে গেছে। সে বলল,” আমার ভয় লাগছে নিশান্ত। আমি যাব না।”
নিশান্ত ত্যাড়া গলায় বলল,” এখন এসব পল্টিবাজি চলবে না। যেতেই হবে।”
” প্লিজ, বিমানে উঠতে আমার ভয় লাগবে। আমি এর আগে কখনও বিমান ভ্রমণ করিনি । আর মা আমাকে ফোনে না পেলে বাড়িতে চলে যাবে। আর গিয়ে যদি দেখে আমি ঘরে নেই তাহলে তো কেলেংকারী হয়ে যাবে।”
অবন্তী ছটফট শুরু করল। নিশান্ত রেগে বলল,” এসব কথা আগে মনে ছিল না?”
অবন্তী কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,” এখন আমি কি করব?”
” থাক, চলো তোমাকে তোমার নানুবাড়িতে দিয়ে আসি। এই মামা, গাড়ি থামান। আমরা ব্যাক করব।”
অবন্তী চুপসানো গলায় বলল,” আরে, রাগ করছো কেন?”
” রাগ করিনি।”
অবন্তী মিনমিনিয়ে বলল,” আচ্ছা চলো যাব।”
নিশান্ত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নরম স্বরে বলল,” তুমি অনেক কনফিউজড অবন্তী। এতো কনফিউশন থাকলে যাওয়ার দরকার নেই। আনন্দটাই নষ্ট হয়ে যাবে।”
অবন্তী নিশান্তর গলা জড়িয়ে ধরে আহ্লাদী স্বরে বলল,” স্যরি। আর বলবো না। আমি সত্যিই যাব। ”
বিমানে ওঠার ঠিক আগ মুহূর্তে বিলকিসের ফোন এলো। নিশান্ত বলল,” একটু পরেই তো ফোন সুইচড অফ করতে হবে। তুমি কথা শেষ করে আসো।”
অবন্তী বলল,”ঠিকাছে।”
অবন্তী বাথরুমে গিয়ে বিলকিসের ফোন রিসিভ করল,” হ্যালো মা।”
” কি করছিস অবন্তী? খেয়েছিস?”
” হুম। তুমি খেয়েছো?”
” হ্যাঁ মাত্র খেলাম। তোর কথা এরকম শোনাচ্ছে কেন? বাথরুমে বসে আছিস নাকি?”
অবন্তী থতমত খেয়ে বলল,” তুমি কিভাবে বুঝলে?”
বিলকিস হাসল,” বোঝা যায়। তুই বাথরুমেও মোবাইল নিয়ে ঢুকেছিস কেন?
” তুমি ফোন দিলে বলেই তো…”
” আচ্ছা শোন, কাল তো তোর পরীক্ষা না? আমি ভাবছি সকালের মধ্যেই চলে আসব।”
অবন্তী আৎকে উঠল,” কেন?”
” পরীক্ষার মধ্যে তুই রান্না-বান্না করবি কিভাবে? একা থাকতে সমস্যা হবে না?”
” তুমি শুধু শুধুই চিন্তা করো মা। আমার কালকেই একটা পরীক্ষা। আর নেই। আমি সামলে নিতে পারব। তোমার আসার দরকার নেই।”
বিলকিস সন্দিহান কণ্ঠে বলল,” তুই এমন করছিস কেন? আমি এলে কি তোর কোনো প্রবলেম আছে?”
” একদমই না। আমি শুধু চাইছি তুমি খুশি মনে বেড়াতে গেছো, কিছুদিন বেড়িয়ে আসো। কি দরকার চলে আসার?”
” তোর কথা-বার্তায় কিন্তু আমার সন্দেহ হচ্ছে অবন্তী। আমাকে নিয়ে এতো চিন্তা তো তোর কখনও ছিল না।”
এতোক্ষণে নিশান্তও বাথরুমে চলে এসেছে। ঘড়ি দেখিয়ে অবন্তীকে বোঝালো দেরি হচ্ছে। বিমান ছেড়ে দিবে। অবন্তী দ্রুত কথা শেষ করতে চাইল,” আচ্ছা মা, এখন রাখি?”
” এতো তাড়া কিসের? পড়তে বসেছিস?”
” না। আমি এখন ঘুমাব মা। তুমি প্লিজ আমাকে আর ফোন দিও না। গুড নাইট।”
মোবাইল রেখে অবন্তী দ্রুত ছুটে এলো।তারা দৌড়ে গিয়ে বিমানে উঠল। অবন্তী হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,” আমার খুব নর্ভাস লাগছে।”
তারপর হাসতে লাগল। নিশান্ত অবাক হয়ে বলল,” এতো হাসছো কেন?”
” জানি না। আমার অনেক মজাও লাগছে।”
নিশান্ত হেসে বলল,” তাহলে এক কাজ করো। আমার হাতটা শক্ত করে ধরে রাখো।”
অবন্তী লজ্জিত হয়ে বলল,” পাগল নাকি? মানুষ দেখবে।”
ঠিক সেই সময় বিমান উড্ডয়ন করল। অবন্তী জড়োসড়ো ভয়ে নিশান্তর একটা হাত জড়িয়ে ধরল। নিশান্ত হাসতে হাসতে বলল,” এজন্যই বলেছিলাম।”
অবন্তী ভয়ার্ত কণ্ঠে বলল,” নড়ো না প্লিজ। আমার মনে হচ্ছে আমরা পড়ে যাব।”
অবন্তীর জীবনের প্রথম বিমান ভ্রমণের স্থায়িত্বকাল মাত্র পয়ত্রিশ মিনিট। তারা কক্সবাজার পৌঁছালো রাত পৌনে বারোটায়। নিশান্ত আগেই রুম বুক করে ফেলেছিল। অবন্তী ঘরে ঢুকে খুব অপ্রস্তুত হয়ে গেল। দুশ্চিন্তা আরও বেড়ে গেল। তাদের রুমটা বড় হলেও বিছানা মাত্র একটা। নিশান্ত দুই রুম বুক না করে একরুম নিল কেন? অবন্তীর ভয় করতে লাগল৷ এখানে আসার আগে তার মাথায় এসব চিন্তা আসেনি। কিন্তু এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, ভুল হয়ে গেল না তো? তারা এখন বিবাহিত। নিশান্ত যদি তাকে শারীরিক সম্পর্কের জন্য জোর করে তাহলে নিষেধ করতে পারবে না। আবার বাড়ি ফিরে গেলে মায়ের চোখে চোখ রেখেও মিথ্যা বলতে পারবে না। তখন কি হবে? নিশান্ত বিদেশ চলে গেলে আবার কবে না কবে দেখা হয় তাই নিশান্তর সাথে কিছু সুন্দর সময় কাটানোর সুযোগ অবন্তী মিস করতে চায়নি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ভুল হয়ে গেছে। হুট করে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হয়নি। অবন্তী পায়চারী করতে করতে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। ভালো ব্যাপার হচ্ছে, তাদের ঘরের বারান্দা থেকে সরাসরি সমুদ্র দেখা যায়। সমুদ্রের ফেনীল ঢেউ আছড়ে পড়ছে বালুতটে। অসম্ভব মায়াবী দৃশ্য। স্পষ্ট ঢেউয়ের শব্দ কানে আসছে। নিশান্ত বাথরুম থেকে বের হয়ে দেখল অবন্তী বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। সেও অবন্তীর পাশে এসে দাঁড়াল। ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল,” কি ব্যাপার? এখনও দাঁড়িয়ে আছো যে? চেঞ্জ করবে না?”
অবন্তী ইতস্তত করে বলল,” আমরা কি এখানেই থাকব?”
” হ্যাঁ। কেন? তোমার রুম পছন্দ হয়নি?”
” হয়েছে। কিন্তু আমরা কি এক রুমেই থাকব?”
নিশান্ত কিঞ্চিৎ বিব্রত হয়ে বলল,” আসলে আমার কাছে যত টাকা ছিল তার মধ্যে এর চেয়ে ভালো রুম খুঁজে পাইনি। সেজন্য এক রুমই নিতে হয়েছে। ”
” ও।”
” কিন্তু সমস্যা নেই। আমরা তো আর রাতে ঘুমাবো না।”
অবন্তী চমকানো কণ্ঠে বলল,” ঘুমাবো না মানে? তাহলে কি করব?”
” কক্সবাজারে কি ঘুমাতে এসেছি? বারান্দাওয়ালা রুম কেন বুক করেছি বলোতো? সারারাত যেন এইখানে বসে সমুদ্র দেখতে পারি। তবে তোমার ঘুম পেলে তুমি গিয়ে শুয়ে পড়বে। রাত জাগার অভ্যাস আছে আমার।”
অবন্তীর বুক থেকে পাথর সরে গেল। এতো ভালো লাগল যে চোখে পানি এসে গেল। হাসার চেষ্টা করে বলল,” আমারও রাত জাগার অভ্যাস আছে। আমিও জেগে থাকব তোমার সাথে। এতো সুন্দর সময় ঘুমিয়ে নষ্ট করতে চাই না।”
” ঠিকাছে।”
নিশান্ত যেতে নিলেই অবন্তী ডাকল,” নিশান্ত শোনো।”
” হুম?” নিশান্ত মিষ্টি করে হাসল। অবন্তী এসে তাকে জড়িয়ে ধরল। আসক্ত কণ্ঠে বলল,” জানো আমি তোমাকে ভালোবেসে জীবনের সবচেয়ে ভালো কাজ করেছি।”
চলবে
#অন্তহীন_বসন্ত~৩০
লিখা- Sidratul Muntaz
চারদিকে শা শা ঠান্ডা বাতাস, লোনাপানির গর্জন, নিঝুম রাত্রি আর পাশে প্রিয় মানুষের উপস্থিতি। অবন্তীর মনে হচ্ছে সুখী হওয়ার জন্য এর চেয়ে বেশি কিছুর প্রয়োজন নেই, থাকতে পারে না। গভীর রাত হওয়ায় এখানে ভীর অনেকটাই কম। একটা বন্ধুদের দল আছে, তারা গান বাজনা করছে। হৈ-হুল্লোড় করছে। আরেকদল ছবি তোলায় ব্যস্ত। অবন্তী আর নিশান্ত ব্যস্ত একে-অপরের হাত ধরে খালি পায়ে বালুচরে বিভোর হয়ে হাঁটায়। হাঁটতে হাঁটতে নিশান্ত বলল,” তুমি সাতার জানো অবন্তী?”
” উহুম কখনও শেখা হয়নি৷ তুমি জানো?”
” হ্যাঁ। ”
অবন্তী দুষ্টমি করে এক মুঠো ভেজা বালু নিয়ে নিশান্তর গায়ে ছুঁড়ে মারল। নিশান্ত হকচকিয়ে গেল। তার টি-শার্ট মাখামাখি হলো। অবন্তী হাসতে হাসতে ছুট লাগালো দূরে। নিশান্ত এক পশলা পানি নিয়ে ছুঁড়ে মারতে গেলেই অবন্তী সরে দাঁড়াল। পানি তার গায়েই লাগল না। নিশান্ত এবার এক মুঠো বালু নিয়ে অবন্তীর দিকে তেড়ে এলো। অবন্তী স্কার্টের সাথে পা আটকে উল্টে পড়ে যেতেই নিশান্ত তাকে ধরে ফেলল। তারপর যত্ন করে অবন্তীর গালে বালু মেখে দিল। তারপর দু’জনই খিলখিল করে হেসে উঠল। তাদের ছেলেমানুষী দেখে অন্যরাও হাসছিল। তারা বেশ কিছুক্ষণ পানির মধ্যে দাপাদাপি করল। ছবিও তুলল। একসময় ভীড় কমে আসতে লাগল। সবাই হোটেলে ফিরে যাচ্ছে। নিশান্ত বলল,” এবার চলো আমরাও যাই।”
অবন্তী ছেলেমানুষী গলায় বলল,” উহুম। আমার এখানেই অনেক ভালো লাগছে। আরও কিছুক্ষণ থাকি প্লিজ।”
” দেখছো না মানুষ কমে যাচ্ছে? এখন এই জায়গাটা সেইফ না। ”
অবন্তী মনখারাপ করে বলল,” ঠিকাছে, চলো।”
তাদের পুরো শরীর বালু আর পানিতে মাখামাখি হয়ে আছে৷ তাই হোটেলে ফিরেই গোসল করে নিতে হলো। ফ্রেশ হওয়ার পর থেকেই অবন্তীর চোখ জড়িয়ে ঘুম আসছে। শুধু নিশান্তর মন রাখার জন্য সে জেগে রইল। তারা বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে গল্প করছিল। হঠাৎ অবন্তী তার মাথাটা নিশান্তর কাঁধে এলিয়ে দিল। নিশান্ত দেখল অবন্তীর গা মাত্রাতিরিক্ত গরম। সে অস্থিরচিত্তে বলল,” আরে, তোমার দেখি জ্বর।”
অবন্তী জড়ানো কণ্ঠে বলল,” কই? নাতো।”
” গা এতো গরম লাগছে কেন? “নিশান্ত তার ঠান্ডা হাত অবন্তীর কপালে ছোঁয়ালো। তারপর গলায় রাখল। অবন্তী সাথে সাথে হাতটা চেপে ধরে বলল,” এভাবেই রাখো প্লিজ। তোমার হাতটা ঠান্ডা। আমার ভালো লাগছে।”
নিশান্ত কোমল গলায় বলল,” বিছানায় চলো। একটু ঘুমাবে।”
” না। ঘুমিয়ে গেলেই তো রাতটা শেষ হয়ে যাবে। এতো সুন্দর রাত আবার কোথায় পাব?”
নিশান্ত হাসল। অবন্তী গোমরা মুখে বলল,” তুমি জানো? এই রাত আমার জীবনের সেরা রাত। আমি কখনও ভুলব না।”
নিশান্ত অবন্তীকে কোলে করে বিছানায় আনতে আনতে বলল,” এমন সেরা রাত আমাদের জীবনে আরও অনেক আসবে অবন্তী। কিন্তু সবার আগে তোমার সুস্থতা। এখন একটু না ঘুমালে তোমার জ্বরটা সারবে না। আর তোমাকে অসুস্থ রেখে আমি ফিরে যেতেও পারব না।”
অবন্তী মিষ্টি করে হেসে ঘাড় হেলিয়ে বলল,” তাহলে তো আমি কখনোই সুস্থ হতে চাই না।”
অবন্তীর বাচ্চামি দেখে মুচকি হাসল নিশান্ত। অবন্তীর কপালে আলতো চুমু দিয়ে বলল,” এখন একটু ঘুমাও প্লিজ। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি, ওকে?”
নিশান্ত বাতি নিভিয়ে এসে অবন্তীর চুলে হাত বুলাতে লাগল। অবন্তী তাকে থামিয়ে বলল,” আর না, আমার ঘুম এসে যাচ্ছে।”
” ঘুম আসার জন্যই তো করছি।”
” কিন্তু আমি ঘুমাতে চাই না। ”
” তাহলে কি চাও?”
অবন্তী একহাতে নিশান্তর টি-শার্ট মুঠো করে ধরল। কাছে টেনে বলল,” তোমাকে।”
” আমি তো সবসময় থাকব। তুমি ঘুমালেও থাকব।”
” প্রমিস?”
” প্রমিস!”
অবন্তী অবুঝ কিশোরীর মতো হাসল। নিশান্ত হাত দিয়ে তার চোখ দু’টো বন্ধ করে দিল। মাত্র কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানেই ঘুমিয়ে পড়ল সে। তার হাতের মুষ্টিতে তখনও নিশান্তর টি-শার্ট। অবন্তীর ঘুমন্ত মুখটা অবলোকন করতে করতে নিশান্তর ঘোর লেগে এলো। কখন যেন সে নিজেও ঘুমিয়ে পড়ল। তাদের ঘুম ভাঙল ভোরের নরম আলোয়। অবন্তী চোখ মেলে দেখল নিশান্তকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছিল সে। লজ্জা পেয়ে গেল খুব। ঘুমন্ত অবস্থায় নিশান্তকে এই প্রথমবার দেখছে সে। এতো মায়া লাগছে দেখতে! এই মানুষটিকে কাল থেকে আর দেখবে না ভেবেই বুকের ভেতর হাহাকার শুরু হলো। আবার কবে না কবে দেখা হয় কে জানে? সে কিভাবে থাকবে? সময়টাকে যদি কোনোভাবে এখানেই আটকে ফেলা যেতো! কতই না ভালো হতো। অবন্তী পরম আদর নিয়ে নিশান্তর কপালে চুমু দিল। নিশান্ত সামান্য নড়ে উঠল। অবন্তী ধীরে ধীরে তার গালে, গলায়, নাকে চুমু দিতে দিতে হঠাৎ কেঁদে ফেলল। কান্নার শব্দে ঘুম ছুটে গেল নিশান্তর। বিস্মিত গলায় বলল,” অবন্তী, কি হয়েছে?”
অবন্তী চোখের জল মুছতে মুছতে বলল,” কিছু না।”
সে উঠে চলে যেতে নিলেই নিশান্ত হাত চেপে ধরল তার। ঘুমো ঘুমো কণ্ঠে শুধালো,” কি হয়েছে বলো?”
অবন্তী শক্ত হয়ে বলল,” বললাম তো, কিছু না।”
নিশান্ত হেচকা টানে অবন্তীকে কাছে আনল। সদ্য ঘুম থেকে জাগার কারণে অবন্তীর চোখ ফুলে আছে৷ মুখ তৈলাক্ত, এলোমেলো চুল। দেখতে ভালো লাগছে। নিশান্ত কোমল কণ্ঠে বলল,” কাঁদছিলে কেন?”
অবন্তী কাতর স্বরে বলল,” আবার কবে দেখা হবে আমাদের? যদি আর কোনোদিন দেখা না হয়?”
” হঠাৎ এইসব কথা কেন ভাবছো তুমি?”
” জানি না। হঠাৎ মনে হচ্ছে তুমি যদি কানাডা থেকে আর ফিরে না আসো?”
” কেন আসব না? আমার উপর বিশ্বাস নেই তোমার?”
” খুব বিশ্বাস আছে।”
” তাহলে?”
অবন্তী কিছু বলল না। তার চেহারার কোথায় যেন একটা স্নিগ্ধ আভা৷ নিশান্ত ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তার কেমন নেশা লেগে যাচ্ছে অবন্তীকে দেখতে দেখতে। তাকে এভাবে তাকানো দেখে অবন্তীর আরও লজ্জা লাগছে। ক্ষীণ স্বরে বলল,” ছাড়ো।”
নিশান্ত অবন্তীর হাত দু’টো বালিশের সাথে চেপে ধরল। নেশাক্ত গলায় বলল,” এখন না।”
বলেই অবন্তীর ঠোঁটে গাঢ়, প্রলম্বিত, তৃষ্ণার্ত চুমু এঁকে দিল। অবন্তীর নিশ্বাস এলোমেলো হয়ে উঠল। নিশান্ত হাত রাখল অবন্তীর কামিজের বোতামে। তারপর কিছু একটা ভেবে মুহূর্তেই হাত সরিয়ে উঠে যেতে চাইল। অবন্তী সঙ্গে সঙ্গে নিশান্তকে জাপটে ধরল। প্রশ্রয় পেয়ে আবারও উন্মত্ত হয়ে উঠল নিশান্ত। যতটা ভুল হওয়ার কথা ছিল তার চেয়েও অনেক বেশি ভুল হয়ে গেল!
________________
অবন্তীরা কক্সবাজার থেকে ফিরল দুপুরের পর। সন্ধ্যার মধ্যেই মিরাজ উদ্দিন ফিরে এলেন। এর আগেই অবন্তী বাসায় আসতে পেরেছিল৷ তারপর সবকিছু স্বাভাবিক নিয়মে চলতে লাগল। অবন্তী নিজের সাহস দেখে নিজেই অবাক। এক রাতের মধ্যে তারা ঢাকা থেকে কক্সবাজার ঘুরে চলে এলো অথচ কেউই কিছু টের পেল না। ব্যাপারটা ভেবেই তার মজা লাগছিল। পরদিন কলেজ ছুটির পর আবার নিশান্তর সঙ্গে দেখা হলো। যেহেতু মা বাড়িতে নেই আর বাবাও একদম রাত করে অফিস থেকে ফিরবে তাই অবন্তী নিশান্তর সাথে একেবারে তার রিসোর্টেই চলে এলো। দুপুরে তারা একসঙ্গে লাঞ্চ করবে। নিশান্ত বাইরে থেকে খাবার কিনে আনতে গেল। ফিরে এসে দেখল অবন্তী গোসল সেরে নিয়েছে। গতকালকের মতোই লাল শার্ট আর লুঙ্গী পরেছে। নিশান্ত তাকে দেখে হাঁ করে তাকিয়ে রইল। অবন্তী কোমরে এক হাত গুঁজে বলল,” আমাকে কেমন লাগছে?”
নিশান্ত কোনো উত্তর দিল না। খাবারের প্যাকেটগুলো টেবিলে রেখেই অবন্তীর কাছে এসে চুমু দিতে শুরু করল। অবন্তী লজ্জিত গলায় বলল,” এখন না প্লিজ। খাবার ঠান্ডা হয়ে যাবে।”
নিশান্ত শুনল না। তাকে কোলে তুলে বিছানায় এনে বলল,” হোক ঠান্ডা। দরকার হলে পরে গরম করে নিবো।”
ঘড়িতে তিনটা বাজছে। নিশান্তর ফ্লাইট কাল ভোররাতে। অবন্তী হিসেব করে দেখল আর মাত্র চারঘণ্টা তারা একসঙ্গে থাকতে পারবে। তার খুব মনখারাপ লাগছে। সে মনমরা হয়ে বলল,” তুমি আর একটা দিন থাকো প্লিজ।”
নিশান্ত মুচকি হেসে বলল,” উহুম। আমি আর থাকতে চাইছি না।”
” চাইছো না কেন?”
” পরে যদি যেতেই ইচ্ছা না করে? তুমি আমার অভ্যাস খারাপ করে দিচ্ছো। তারপর দেখা যাবে বউ ছাড়া ঘুমই আসবে না।”
“ইশ, মাত্র দুইদিনেই অভ্যাস খারাপ হয়ে যায়?”
নিশান্ত ফিসফিস করে বলল,” অভ্যাস খারাপ হওয়ার জন্য এক মুহূর্তও যথেষ্ট। ”
অবন্তী খিলখিল করে হাসতে লাগল। তারা বাড়ি ফিরল সন্ধ্যায়। নিশান্ত অবন্তীর সঙ্গে বাসা পর্যন্ত এলেও ভেতরে ঢুকল না। গলির মোড় থেকেই বিদায় নিল। অবন্তী অনুনয় করে বলল,” একটু ভেতরে এসে বসো প্লিজ। বাবা তো এখনও আসেনি।”
” না অবন্তী। তোমার আশেপাশের কেউ দেখলে ঝামেলা হতে পারে। যদি আন্টিকে বলে দেয়?”
” তাও ঠিক বলেছো। আচ্ছা, আবার কবে দেখা হবে আমাদের?”
নিশান্ত শ্রাগ করে বলল,” জানি না। তুমি কবে দেখা করতে চাও বলো।”
” ঈদে আসবে?”
” তুমি বললে আসব।”
” ঠিকাছে। রাতে ফোনে কথা হবে। এখন আসি।”
” বায়।”
অবন্তী যেতে নিয়েও আবার ফিরে এসে বলল,” আর শোনো, সাবধানে যেও। আই লভ ইউ।”
এই বলেই অবন্তী টুক করে নিশান্তর গালে চুমু দিয়ে ফেলল। নিশান্ত কিছু বলার সুযোগটুকুও পেল না। অবন্তী দৌড়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে গেল। একবারও পেছনে তাকাল না। নিশান্ত স্থানুর মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মৃদু হাসল। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কানাডায় ফিরে যাওয়ার পর অবন্তীকে খুব মিস করবে সে।
ঘরে ঢুকেই অবন্তীর আত্মা ছলাৎ করে উঠল। ঘরে তালা নেই। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ। এর মানে কি বাবা ফিরে এসেছে? অবন্তী কলিংবেল চাপল। বিলকিস কোমরে আঁচল বেঁধে রান্নাঘরে রান্না করছিল। কলিংবেলের শব্দ পেয়েই দরজা খুলে দিল৷ মাকে বাড়িতে দেখে ভয়ে অবন্তীর কলিজা এতোটুকু হয়ে এলো। বিলকিস থমথমে গলায় প্রশ্ন করল,” এতোক্ষণ কোথায় ছিলি? তোর কলেজ তো ১টার মধ্যেই ছুটি হয়ে যায়।”
অবন্তী উত্তর দিতে পারল না। মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। বিলকিস দরজা থেকে সরে বলল,”ভেতরে আয়।”
অবন্তী মনে মনে মিথ্যা কথার পসরা সাজাতে লাগল। মা এতো সহজে ছাড় দেবে না সে জানে৷ এমন কিছু বলতে হবে যাতে সহজেই মাকে বিশ্বাস করানো যায়। অবন্তী ফ্রীজ থেকে ঠান্ডা পানি বের করে গলায় ঢালতে লাগল। বড্ড শুকিয়ে আছে গলাটা। বিলকিস রান্নাঘর থেকে পুনরায় প্রশ্ন করল,” জবাব দিচ্ছিস না কেন? কোথায় ছিলি?”
অবন্তী নিভু নিভু স্বরে বলল,” জান্নাতদের বাসায় গিয়েছিলাম।”
” কে জান্নাত?”
” আরে আমাদের ক্লাসের জান্নাত। কিছুদিন আগে যে আমার থেকে বই নিতে এলো…”
বিলকিস ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলল,” ওর বাসায় তোর কি কাজ?”
” বাড়িতে কেউ নেই। একা থাকতে ভালো লাগে না। ও বলল, আমার বাড়ি চল। তাই আমিও গেলাম।”
” ও আচ্ছা। তাই বল।”
বিলকিস চুপ করে গেল। অবন্তী স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজের রুমে ঢুকতে যাবে ঠিক তখনি আত্মা কাঁপিয়ে দেওয়া স্বরে বিলকিস বলে উঠল,” নিশান্ত ভেতরে এলো না কেন?”
অবন্তীর পা স্তব্ধ হয়ে গেল। হৃৎপিন্ড কাঁপতে লাগল। অপ্রস্তুত কণ্ঠে বলল,” মানে?”
বিলকিস কপট হেসে বলল,” ও যে বাংলাদেশে এসেছে সেই খবর তুই না বললেও আমি জানি।”
অবন্তীর হাত-পা ছেড়ে মেঝেতে বসে পড়তে ইচ্ছে করল৷ এর মানে কি মা সব বুঝে ফেলেছে? কাঁদতে মন চাইল অবন্তীর। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে মাথা নিচু করে ফেলল একদম।
বিলকিস কাছে এসে নরম গলায় বলল,” লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা করতে নিষেধ করেছিলাম। সেটা কিন্তু তোদের ভালোর জন্যই। কিন্তু আমার কথা তোরা শুনলি না। অবশ্য এটাই স্বাভাবিক! তোদের এই বয়স কথা শোনার নয়, শুধু ভুল করার। আমি যতই নজরে রাখি, তোরা ঠিকই আমাকে ধোঁকা দিবি সেটা আমি জানি।”
অবন্তী অপরাধী কণ্ঠে বলল,” আই এম স্যরি মা। ভুল হয়ে গেছে৷ এবার থেকে তোমার অনুমতি ছাড়া আমি আর কখনও ওর সাথে দেখা করব না।”
বিলকিস অবন্তীর কাঁধে হাত রেখে বলল,” কাঁদার মতো কিছু হয়নি৷ আমি এবারের মতো মাফ করলাম৷ তোদের যতবার ইচ্ছে হয়, দেখা করিস। কিন্তু আমাকে না জানিয়ে নয়। আমার আড়ালে দেখা করার চেয়ে ভালো আমার সামনেই তোরা দেখা করবি।”
” মা তুমি সত্যি বলছো? ” অবন্তী ভীষণ অবাক হয়ে গেল।
বিলকিস বলল,” হ্যাঁ সত্যি বলছি। তুই তো আমার একমাত্র মেয়ে। আমি কি কখনও তোর খারাপ চাইতে পারি? নিশান্ত যতই ভালো ছেলে হোক, শতভাগ বিশ্বাস করা যাবে না ওকে। এমনও তো হতে পারে যে হঠাৎ নিশান্ত কানাডা গিয়ে আর ফিরে এলো না। সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিল। তখন তুই কি করবি? খুঁজে বের করতে পারবি ওকে?”
অবন্তী মলিন কণ্ঠে বলল,” এসব কি বলছো মা? ও এরকম কেন করবে?”
“আমি তো বলছি না যে করবেই। কিন্তু করতেও তো পারে! যদি করে তখন তোর কি হবে সেটা আগে থেকেই ভেবে রাখা উচিৎ না?”
অবন্তী মাথা নাড়ল। বিলকিস বলল,” আমি কি বলছি তুই নিশ্চয়ই বুঝতে পারছিস। তোরা দেখা করলেও দূরত্ব বজায় রাখবি৷ এমন কিছু করিস না যেন পরে তোকে নিয়ে আমার আফসোস করতে হয়। আমি তোদের দু’জনকেই বিশ্বাস করেছি। তোরা আমার বিশ্বাসটা ভাঙবি না আশা করি।”
মায়ের কথার অর্থ বুঝতে পেরে অবন্তী নিশ্চুপ হয়ে গেল। মা যেই ভুলের আশঙ্কা করে এসব বলছে সেটা অনেক আগেই হয়ে গেছে। কিন্তু অবন্তীর একবারও নিজের ভুলের জন্য আফসোস হয়নি। সে নিশান্তকে বিশ্বাস করে। নিশান্ত প্রাণ থাকতে তাকে ধোঁকা দিবে না সে এটাও জানে। কিন্তু তবুও মায়ের কথাগুলো শুনে ভেতর থেকে অনেকটা ভেঙে পড়ল অবন্তী। সারাক্ষণ মনে হতে লাগল, সে একটা বিরাট ভুল করে ফেলেছে। মায়ের চোখের দিকে চোখ রেখে কথা বলার সাহসটাই হারিয়ে ফেলেছে। মা সবকিছু জানতে পারলে কি তাকে ক্ষমা করতে পারবে?
রাতে নিশান্তর ফোন এলে অবন্তী ধরল না। নিশান্ত এয়ারপোর্টে যাওয়ার জন্য সব গুছিয়ে বের হয়েছে। এই ফাঁকে অবন্তীকে ফোন দিল। কিন্তু অবন্তী ধরছে না। অনেকবার ডায়াল করার পর অবশেষে ধরল। নিশান্ত ‘হ্যালো’ বলার সাথে সাথে অবন্তী প্রথম যে কথাটি বলল তা হচ্ছে-” তুমি আমাকে কখনও ধোঁকা দিবে না তো?”
নিশান্ত এমন প্রশ্ন চমকিত হলো। হতভম্ব গলায় বলল,” এটা আবার কেমন কথা?”
” আগে উত্তর দাও।”
” অফকোর্স না অবন্তী৷ তোমার কি হয়েছে?”
অবন্তী শান্ত গলায় বলল,” মা সব জেনে গেছে।”
” হোয়াট? আন্টি?”
নিশান্ত এবার আরও অবাক হলো। অবন্তীর নির্লিপ্ত উত্তর,” হুম।”
” কিভাবে জানল?”
” রাস্তায় তোমাকে আর আমাকে একসাথে দেখেছে। তারপরই সব বুঝে গেছে। নিশান্ত, আমি চাই এবার সবাইকে সবকিছু জানাতে৷ আমাদের বিয়ের ব্যাপারটা আর কতদিন গোপন থাকবে বলোতো? আমি এভাবে লুকোচুরি করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছি। প্লিজ, তুমি কিছু করো।”
অবন্তী কাঁদছে। নিশান্ত অস্থির হয়ে উঠল। বড় করে শ্বাস টেনে বলল,” অবন্তী কাম ডাউন। আমি তো চেষ্টা করছি তাই না? এভাবে থাকতে আমারও ভালো লাগছে না৷ আমিও চাই তোমাকে দ্রুত নিজের কাছে আনতে। কিন্তু কি করব? বিয়ের কথা বলার মতো পরিস্থিতি এখনও তৈরী হয়নি। আমাকে আর কিছুদিন সময় দাও।”
অবন্তী কিছু বলল না। অবুঝের মতো শুধু কাঁদতে লাগল।
চলবে