অন্তহীন বসন্ত পর্ব-৩৩ এবং শেষ পর্ব

0
465

#অন্তহীন_বসন্ত~ শেষ পর্ব

রাত বারোটা বাজতে চলেছে। বিলকিস অবন্তীর সঙ্গে সারাদিনে একবারও কথা বলেনি। মায়ের সামনে দাঁড়াতেও অস্বস্তিতে দম বন্ধ হয়ে আসছে অবন্তীর। মা তাকে কখনও ক্ষমা করতে পারবে না এমন একটা চিন্তায় মন সংকীর্ণ হয়ে আছে। আচ্ছা, নিশান্ত হঠাৎ এমন কেন করছে? আগে তো সে অবন্তীর সাথে কথা না বলে কয়েক ঘণ্টাও টিকতে পারতো না। আর আজ পুরো চব্বিশটা ঘণ্টা কেটে গেল। নিশান্তর হদিশ নেই। অবন্তী কয়েকবার ফোন দিয়েছিল। নিশান্ত ধরছে না। অবন্তীও ঠিক করল সে আর ফোন দেবে না। তার কিসের এতো গরজ? সেই কেন বার-বার ফোন করবে?যতক্ষণ নিশান্ত নিজে থেকে ফোন না করবে ততক্ষণ অবন্তীও আর করবে না। এটাই উচিৎ।

কিন্তু নিজের সাথে করা এই প্রতিজ্ঞায় বেশিক্ষণ স্থির থাকতে পারল না অবন্তী। অভিমানও পুষে রাখতে পারল না মনে। পুনরায় ফোন করতে লাগল নিশান্তকে। তার খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে যে!নিশান্তর কোনো বিপদ হয়নি তো? নাহলে সে অনলাইনে কেন আসছে না? তার ফোন কেন বন্ধ দেখাচ্ছে? অবন্তীর রীতিমতো কান্না পেতে লাগল। মনে মনে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করল যাতে নিশান্ত ভালো থাকে। তার যেন কোনো ক্ষতি না হয়।

কানাডায় তখন বিকেল চারটা বাজছে। নিশান্ত বসে আছে একটা স্ট্রিট ক্যাফেতে। ক্ষুধায় পেট চো চো করছে। মেজাজ বিক্ষিপ্ত। হোটেল থেকে বেরিয়ে স্ট্রিট বেঞ্চে শুয়ে থাকার সময় আচমকা একটা পারভার্ট এসে তার ব্যাগটা নিয়ে দিল ভো দৌড়। সেই ব্যাগে ছিল তার পাসপোর্ট, ভিসা, মোবাইল ফোনসহ আরও অনেক প্রয়োজনীয় জিনিস। প্রথমে ক্রেডিট কার্ড ব্লক হওয়া তারপর আবার এই কান্ড। নিশান্তর বুঝতে অসুবিধা হলো না যে সবই তার বাবার পরিকল্পনা। আচ্ছা বাবা কি তার পেছনে গোয়েন্দা লাগিয়েছে? এসব ভেবে চূড়ান্ত অসহ্য বোধ হচ্ছে নিশান্তর। টেবিলে হেলান দিয়ে বসে ক্লান্ত ভঙ্গিতে ঝিমাতে লাগল যে। তার শরীর ভালো নেই। গতরাত থেকে সে না খেয়ে আছে। ক্যাফের একজন ওয়েটার এগিয়ে এসে ইংরেজিতে বলল,” স্যার কি কিছু অর্ডার করবেন? অনেকক্ষণ ধরে বসে আছেন।”

নিশান্ত ঠান্ডা গলায় বলল,” আপনাদের এইখানে ফ্রী কি পাওয়া যায়?”

“স্যরি স্যার.. কিন্তু ফ্রী?”

” জ্বী। ফ্রী কিছু থাকলে দিন। আমার কাছে টাকা নেই।”

ওয়েটার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,” আমাদের এখানে পানি ফ্রী আছে। আপনি চাইলে পানি খেতে পারেন।”

” ওকে। থ্যাঙ্কিউ। ”

নিশান্ত এই কথা বলেই সাথে সাথে এক বোতল পানি লুফে নিল। ঢকঢক করে খেয়ে নিল পুরোটাই। তৃপ্ত গলায় বলল,” থ্যাংকস এগেইন।”

ওয়েটার আপ্লুত হয়ে বলল,” ইউর ওয়েলকাম স্যার। হ্যাভ আ নাইস ডে।”

নিশান্ত তাচ্ছিল্য হাসল। আনমনে আওড়াল,” দ্যাট ইজ দ্যা ওর্স্ট ডে ইন মাই ইন্টায়্যার লাইফ।”

সন্ধ্যায় নিশান্ত তার বন্ধু জ্যাকের বাড়ি গিয়ে উঠল। আর কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিল না তার। রাস্তায় আর কত ঘুরে-বেড়াবে? কিন্তু জ্যাকের বাড়ি গিয়ে তাকে খুব বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হলো। জ্যাকের গার্লফ্রেন্ড স্টেইসিও সেখানে ছিল। তারা ব্যক্তিগত মুহূর্ত কাটাচ্ছিল। নিশান্ত চলে যেতে চাইলে জ্যাক তাকে অন্যঘরে বসতে বলল। আসলে নিশান্তকে এই অবস্থায় দেখে জ্যাক হতবাক। বুঝতে পারল যে নিশান্তর কোনো বিপদ হয়েছে। নিশান্ত জ্যাকের কথামতো একটা খালি ঘরে গিয়ে বসল। কিছুক্ষণ পর জ্যাক এলো দুই কাপ ব্ল্যাক কফি নিয়ে। ইংরেজিতে প্রশ্ন করল,” হেই বাডি, হোয়াটস গোয়িং অন?”

নিশান্ত হতাশ সুরে বলল,” আমি খুব খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি জ্যাক। আই নিড ইউর হেল্প।”

সোফায় বসে পায়ের উপর পা তুলে কফিতে চুমুক দিল জ্যাক। তারপর বলল,” সেটা তোমাকে দেখেই আমি বুঝেছি। এবার বলো কি হয়েছে?”

নিশান্ত তার সারাদিনের দূর্ভাগ্যের ঘটনা জ্যাককে জানাল। জ্যাক এসব শুনে খুবই দুঃখিত হলো। নিশান্তর বাবা-মা এতো ডমিনেটিং কেন? বেচারা নিশান্ত! জ্যাক বলল,” ভেরি স্যাড। বাট ডন্ট ওরি। আই উইল হেল্প ইউ বাডি।”

নিশান্ত সৌজন্যতার হাসি হেসে বলল,” থ্যাংকস জ্যাক।”

জ্যাকের সাথে নিশান্তর খুব ভালো বন্ধুত্ব আর সে খুব সাহায্যপরায়ণ। এতো বিনয়ী ছেলে নিশান্ত আগে দেখেনি। তাই নিজের এই দুঃসময়ে সে জ্যাকের কাছেই এসেছে। ক্ষুধার্ত নিশান্তর জন্য খাবার তৈরী করতে জ্যাক রান্নাঘরে ঢুকল। নিশান্ত এই ফাঁকে জ্যাকের মোবাইল থেকে নিজের আইডি লগইন করে অবন্তীকে ফোন করল। বাংলাদেশে এখন মধ্যরাত হওয়ার কথা। কিন্তু সারাদিন নিশান্তর হদিশ না পেয়ে অবন্তী নিশ্চয়ই এখনও অপেক্ষায় আছে! নিশান্তর ধারণাই সঠিক হলো। অবন্তী প্রায় সাথে সাথেই ফোন রিসিভ করে উদ্বিগ্ন গলায় বলল,

” হ্যালো, নিশান্ত তুমি কোথায়? তোমার ফোন বন্ধ ছিল কেন? জানো আমি কতবার ট্রাই করেছি? উফ তুমি কি আমাকে টেনশন দিয়ে মেরে ফেলতে চাও?”

নিশান্ত সোফায় মাথা ঠেঁকিয়ে বলল,” রিল্যাক্স। আমি একদম ঠিকাছি।”

” আল্লাহর কাছে শুকরিয়া। আমি অনেক ভয় পেয়ে গেছিলাম জানো?” অবন্তী এতোক্ষণে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। নিশান্ত মৃদু হেসে বলল,” তোমার কি খবর? খাওয়া-দাওয়া করেছো?”

” হ্যাঁ। আচ্ছা তুমি এতোক্ষণ ফোন ধরছিলে না কেন?”

নিশান্ত খারাপ ঘটনাগুলো বলে অবন্তীকে বিব্রত করতে চাইল না। অবন্তী যদি জানতে পারে তার কাছে যেতে না দেওয়ার জন্য নিশান্তর বাবা তার থেকে সবকিছু ছিনিয়ে নিয়েছে; তাহলে কি ভাববে অবন্তী? নিশান্ত আমতা-আমতা করে বলল,” ব্যস্ত ছিলাম একটু।”

অবন্তী মনখারাপ করা কণ্ঠে বলল,” কি এমন ব্যস্ততা যে সারাদিনে একবারও আমার খোঁজ নেওয়ার সময় হলো না? আমি তোমার ফোনের অপেক্ষায় ছিলাম।”

” স্যরি…”

নিশান্ত এতো সুন্দর করে ‘স্যরি’ বলল যে অবন্তী সাথে সাথেই গলে গেল। সারাদিনের সব অভিমান ভুলে হাসিমুখে বলল,” ইটস ওকে।” তারপর একটু ইতস্তত করে জানতে চাইল,” আচ্ছা, তুমি কি বাসায় আমার ব্যাপারে কথা বলেছিলে?”

নিশান্ত মিথ্যা কথা বলল,” বাবা জরুরী কাজে কিছুদিন বাড়ির বাইরে আছেন। ফিরে এলেই বলব। আমাকে কয়েকটা দিন সময় দাও অবন্তী, প্লিজ।”

অবন্তী মৃদু হেসে বলল,”ঠিকাছে। কিন্তু বেশি দেরি কোরো না কিন্তু। মায়ের হাব-ভাব আমি কিছু বুঝতে পারছি না। আজকে সারাদিন মা আমার সাথে একবারও কথা বলেনি, জানো? যদি আবার হসপিটালে নিয়ে জোর করে এবোর্শন করিয়ে দেয়? আমি কি করব তখন?”

অবন্তী আতঙ্কিত বোধ করছে। জ্যাক খাবার এনে নিশান্তর সামনে রাখল। তখনি স্টেইসি অন্যঘর থেকে এসে জ্যাককে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে কিস করল। জড়ানো কণ্ঠে ইংরেজিতে কিছু বলতে লাগল। মেয়েলী কণ্ঠ শুনে অবন্তী একটু হকচকিয়ে গেল। নিশান্তও কিছুটা বিব্রত হলো। ছোট থেকে বিদেশী কালচার দেখে এলেও সে এসবে অভ্যস্ত হতে পারেনি। তার সামনে একটা মেয়ে আর একটা ছেলে অবাধে অন্তরঙ্গ হচ্ছে এই দৃশ্য দেখতেই তার লজ্জা লাগছিল। নিশান্ত সাথে সাথে উঠে অন্যঘরে চলে এলো। ওইপাশ থেকে অবন্তী ‘হ্যালো-হ্যালো’ করেই যাচ্ছে। নিশান্ত অন্যঘরে পৌঁছে জবাব দিল,” হ্যাঁ বলো অবন্তী।”

” নিশান্ত তুমি কোথায় আছো?”

” কোথায় আবার? আমার বাসায়!”

“কিন্তু আমার মনে হলো আমি কোনো মেয়ের কণ্ঠ শুনেছি।”

” আম্মু আমাকে কফি খাবো কি-না জিজ্ঞেস করতে এসেছিল। সেটাই হয়তো শুনেছো। আর আমি টিভি দেখছিলাম। সেটার শব্দও হতে পারে।”

অবন্তীর খটকা লাগছে। ওইটা অবশ্যই রিমা আন্টির কণ্ঠ ছিল না। আর টিভির শব্দ তো মোটেও না। কোনো যুবতী মেয়ের স্পষ্ট কণ্ঠ শুনতে পেয়েছে সে। নিশান্ত মিথ্যা বলছে কেন? হঠাৎ করেই কেমন একটা ইনসিকিউরড ফীল করল অবন্তী। যা এর আগে কখনও হয়নি। নিশান্তর শরীরটা খুব ক্লান্ত লাগছে। সে হঠাৎ হামি তুলে বলল,” আমি এখন ডিনার করব। তারপর ঘুমিয়ে যাব। তুমিও ঘুমিয়ে যাও অবন্তী। এই অবস্থায় বেশি রাত জাগা ঠিক না। ওকে? টেইক কেয়ার।”

” তুমি তো কখনও এতো দ্রুত ঘুমাও না নিশান্ত।”

” কিন্তু আজকে আমি অনেক টায়ার্ড। ”

” ঠিকাছে। তাহলে রাখছি।”

” ওকে। বাই।”

আবার যদি স্টেইসি চলে আসে তাহলে অবন্তীকে ম্যানেজ করতে কষ্ট হবে। তাই নিশান্ত তাড়াহুড়ো করে ফোনটা রেখে দিল। কিন্তু এতে অবন্তীর সন্দেহ আরও বেড়ে গেল। প্রথমত নিশান্ত তাকে আজ সারাদিনে একবারও ফোন করেনি। আর যখন ফোন করল, তখন খুব মেপে মেপে কথা বলল। তার প্রতিটি কথাই মিথ্যা মনে হলো অবন্তীর। আর মেয়েলী কণ্ঠের ব্যাপারেও সে মিথ্যা বলল। ঘটনা কি? এসব কি হচ্ছে? অবন্তীর সারা রাতে আর একটুও ঘুম এলো না। ভোর সাতটা বাজে উঠে সে আবার নিশান্তকে ফোন করল। কানাডায় তখন রাত নয়টা বাজছিল। নিশান্ত খেয়ে-দেয়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়েছে। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তখন সে। জ্যাকের মোবাইলটা জ্যাকের বেডরুমেই ছিল। সেখানে স্টেইসি আর জ্যাক একসঙ্গে ঘুমাচ্ছিল। ফোনের আওয়াজ শুনে ঘুম ছুটে গেল স্টেইসির। জ্যাককে না ডেকে সে নিজেই রিসিভ করল ফোনটা। রিনরিনে কণ্ঠে ইংরেজিতে বলল,” হ্যালো, গুড ইভনিং।”

মেয়েলী কণ্ঠটা আবারও শুনতে পেয়ে এবার বুক ধ্বক করে কেঁপে উঠল অবন্তীর। চোখ ছাপিয়ে জল নামল। তবুও নিজের মনকে সান্ত্বনা দিল এই বলে যে হয়তো মেয়েটি নিশান্তর বন্ধু। অন্যকিছু নয়। অবন্তী শুদ্ধ বাংলায় কথা বলল,” আচ্ছা, নিশান্ত আছে?”

জ্যাক নিশান্তকে ‘বাডি’ বলে ডাকে। তাই স্টেইসি নিশান্তর নামটা জানে না। আর জানলেও এমন কঠিন বাংলা নাম তার পক্ষে মনে রাখা সম্ভব নয়। সে ভ্রু কুচকে বলল,” স্যরি?”

” আমি অবন্তী বলছি। নিশান্তকে একটু ফোনটা দেওয়া যাবে প্লিজ?”

স্টেইসি বাংলা কথা বুঝল না। তবে এতোটুকু বুঝল যে মোবাইলটা যেহেতু জ্যাকের তাই মেয়েটা নিশ্চয়ই জ্যাকের কথাই জিজ্ঞেস করছে। স্টেইসি বলল,” হি ইজ স্লিপিং বিসাইড মি। ইজ এনিথিং আর্জেন্ট?”

অবন্তীও স্টেইসির মতো করে ইংরেজিতে বলল,” না। কোনো ইমারজেন্সী নেই। ও যেহেতু ঘুমাচ্ছে তাহলে ঘুমাক। আমি পরে ফোন করব।”

“ওকে। এজ ইউর উইশ।”

অবন্তী মনের খচখচানিটা কমাতে জিজ্ঞেস করেই ফেলল,” আচ্ছা, হু আর ইউ?”

স্টেইসি উৎসাহের সাথে উত্তর দিল,” আই এম হিজ ফিয়্যান্সে।”

অবন্তীর মাথায় বাজ পড়ল এবার। ফিয়্যান্সে মানে তো হবু বউ! দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি ক্ষয়ে এলো। অবন্তী বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। তাই শক্ত করে গ্রিলটা চেপে ধরে নিজেকে সামলালো। তার বাম চোখ থেকে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। আর একটা কথাও বলতে পারল না অবন্তী। ওদিকে স্টেইসি ‘হ্যালো-হ্যালো’ করেই যাচ্ছে। অবন্তী ফোনটা রেখে কান্নায় ভেঙে পড়ল।

________
প্রতিদিনের মতো আজও ভোরে ঘুম থেকে জেগেই নিশান্তর সর্বপ্রথম মনে পড়ল অবন্তীর কথা। জ্যাকের থেকে মোবাইল এনে অবন্তীকে ফোন করল সে। ততক্ষণে কাঁদতে কাঁদতে অবন্তীর অজ্ঞান হওয়ার দশা। নিশান্তর ফোন পেয়ে কথা বলার রুচি জন্মাল না। সে খট করে লাইনটা কেটে দিল। নিশান্ত একটু অবাক হলো। তারপর আবার ফোন করল। এবারও ফোন কেটে দিল অবন্তী। আর মেসেজ লিখল,” ডন্ট ডেয়ার টু কল মি এগেইন।”

কি আশ্চর্য! মেসেজটা দেখে নিশান্ত হতভম্ব হয়ে গেল। অবন্তীর কি হয়েছে হঠাৎ? অবশ্য সে নাছোড়বান্দা। ঠিকই আবার ফোন করল। যতক্ষণ অবন্তী না ধরবে ততক্ষণ করতেই থাকবে। অবশেষে বিরক্ত হয়ে অবন্তী ফোন ধরল। রাগে উন্মত্ত কণ্ঠে বলল,” কি সমস্যা তোমার? বলছি না বার-বার আমাকে ফোন করবে না? তোমার মতো মিথ্যাবাদী আর বিশ্বাসঘাতকের সঙ্গে কথা নেই আমার।”

নিশান্ত হতবাক হয়ে বলল,” হঠাৎ তোমার কি হয়েছে অবন্তী? এমন কেন করছো?”

” আমার আবার কি হবে? হয়েছে তো তোমার। সত্যি করে বলো এমন আর কয়টা ফিয়্যান্সে আছে তোমার? তুমি কয়জনকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছো?”

এমন উদ্ভট প্রশ্ন শুনে চোখমুখ বিকৃত হয়ে এলো নিশান্তর। সরু কণ্ঠে বলল,” হোয়াট? মানে কি?”

” খবরদার নাটক করবে না। কালরাতে যে মেয়ের কণ্ঠ আমি শুনেছি সে তোমার কে হয় আমি জানি।”

নিশান্ত ধৈর্য্য নিয়ে বলল,”আচ্ছা বুঝেছি। এইজন্য এতো রেগে আছো? আমি স্যরি। কিন্তু ইচ্ছে করে তোমাকে মিথ্যা বলিনি। আমি আসলে কালরাত থেকে আমার ফ্রেন্ডের বাড়িতে আছি। তুমি যার কণ্ঠ শুনেছো সে স্টেইসি। জ্যাকের গার্লফ্রেন্ড।”

অবন্তী বিভ্রান্ত হলো। তার মাথায় রাগ চিড়বিড় করছিল। তাই ক্রোধসিক্ত কণ্ঠে শুধাল,” জ্যাকের গার্লফ্রেন্ড নাকি তোমার?”

নিশান্ত ভ্যাবাচেকা খেয়ে বলল,” কি আশ্চর্য! ও আমার গার্লফ্রেন্ড হবে কেন? অবন্তী তুমি আমাকে কি মনে করো? একজনের ঝামেলাতেই বাঁচি না আবার আরেকজন!”

” তুমি কি আমাকে ঝামেলা বললে? এর মানে আমি তোমার জীবনের ঝামেলা?”

নিশান্ত শান্ত হওয়ার চেষ্টা করল। নরম সুরে বলল,” না, আমি এটা বোঝাতে চাইনি। শোনো আমার কথা। আসলে…”

অবন্তী তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠল,” আমি কিচ্ছু শুনতে চাই না। আমি কোনো অবুঝ শিশু না যে যা বলবে তাই বিশ্বাস করব। ওই মেয়ে যদি তোমার গার্লফ্রেন্ড না হতো তাহলে সে তোমার ফোন কেন রিসিভ করল? কালরাতে তোমরা একসাথে ছিলে তাই না?”

” ছি, অবন্তী ছি! এসব কি বলছো? তুমি এতো ন্যারো-মাইন্ডেড কবে থেকে হয়ে গেলে?”

” এখন আমি ন্যারো-মাইন্ডেড? আর তুমি কি মহান? ফেরেশতা? দুধে ধোঁয়া তুলসীপাতা?”

মাথায় হাত রাখল নিশান্ত। অবন্তীর চিকন কণ্ঠের চিৎকারে তার মাথা ধরে আসছে। নিচু গলায় বলল,” ডন্ট শাউট অবন্তী প্লিজ। লেট মি এক্সপ্লেইন। আমার মোবাইলটা চুরি হয়ে গেছিল৷ তাই আমি গতকাল সারাদিন তোমাকে ফোন করতে পারিনি। সন্ধ্যায় জ্যাকের মোবাইল থেকে তোমাকে ফোন করেছিলাম৷ তারপর আমি ঘুমিয়ে পড়ি। আর এটা যেহেতু জ্যাকের মোবাইল তাই পরে তুমি যখন আবার ফোন করলে তখন স্টেইসি রিসিভ করেছিল। এবার বুঝতে পারছো?”

” আমি তোমার কথা বিশ্বাস করি না।”

” কেন বিশ্বাস করো না?” এবার নিশান্তও রেগে গেল। অবন্তী তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল,” কারণ তুমি মিথ্যাবাদী। কালরাতেও একবার মিথ্যা বলেছো। তাহলে এখন যে সত্যি বলছো তার গ্যারান্টি কি?”

” উফ, অবন্তী! তুমি আমাকে এই চিনলে?”

” হ্যাঁ চিনলাম। এতোদিন চিনতে ভুল করেছিলাম আর এখন ঠিক চিনলাম।”

নিশান্তর খুব মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। সে চাইলেই স্টেইসিকে ডেকে এনে ব্যাপারটা পরিষ্কার করতে পারতো। কিন্তু ইচ্ছে করল না। অবন্তী কেন তার কথা বিশ্বাস করবে না? সে নিজে এতো স্ট্রাগল করছে অবন্তীর জন্য। নিজের ঘর-বাড়ি ছেড়ে পর্যন্ত চলে এসেছে আর ওদিকে অবন্তী শান্তিতে নিজের ঘরে বসে বসে নিশান্তকে সন্দেহ করছে। কি অদ্ভুত! এই নিয়ে নিশান্তও অবন্তীকে কড়া কথা শোনাতে লাগল। তাদের মধ্যে প্রচন্ড রকম ঝগড়া হয়ে গেল। ফলশ্রুতিতে অবন্তী সব জায়গা থেকে নিশান্তকে ব্লক মেরে দিল। বলে রাখল, যাতে আর কখনও তাকে ফোন না দেয়। নিশান্তও বলল,” আমার বয়েই গেছে তোমাকে ফোন করতে। জাস্ট ফা*ক আপ।”

অবন্তী কাঁদতে কাঁদতে ফোন রেখে দিল। নিশান্তও আর তার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করল না। দু’জনই জেদ করে দূরে সরে রইল দীর্ঘসময়। রাতে বিলকিস অবন্তীকে খেতে ডাকছিল। কিন্তু অবন্তীর ঘর থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। সকাল থেকেই মেয়েটা ঘরবন্দী হয়ে আছে। দুশ্চিন্তা ভর করল বিলকিসের মনে। একাধিকবার দরজা নক করেও যখন কোনো সাড়া পাওয়া গেল না তখন বাধ্য হয়েই দরজা ভাঙতে হলো। বিলকিস হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকে দেখল রক্তে ভেসে যাচ্ছে সাদা ফ্লোর। অবন্তীর নিথর দেহ মেঝেতে লুটিয়ে আছে। বিলকিস উচ্চশব্দে একটা চিৎকার দিল। পরবর্তী ঘটনাগুলো ঘটল খুব দ্রুত। পনেরো মিনিটের মাথায় এম্বুলেন্স এলো। মিরাজ উদ্দিন দিশেহারার মতো মেয়েকে কোলে নিয়ে এম্বুলেন্সে উঠলেন। বিলকিস তখন একেবারে অচেতন। সে যখন জ্ঞান ফিরে পেল তখন অবন্তীকে ইমারজেন্সী কেবিনে ভর্তি করা হয়েছে। তার শরীর থেকে অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছে। রক্ত সরবরাহ করা হচ্ছে। বিলকিস কাঁদতে লাগল অসহায়ের মতো। মিরাজ উদ্দিন স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিলেন,” আমাদের মেয়ের কিচ্ছু হবে না। শান্ত হও বিলকিস, শান্ত হও।”

______________
কাজে মন বসছিল না নিশান্তর। সে একটা গাড়ির দোকানে সেলসম্যানের কাজ করে। এটা অবশ্য তার বাড়ির কেউ জানে না। আজকে অযথাই কাস্টমারের সাথে ঝগড়া লেগে গেল সে। তারপর দোকানের মালিক নিশান্তকে বের হয়ে যেতে বলল। নিশান্তও এগ্রেসিভ হয়ে বলল, সে আর কাজ করবে না। শূন্যে লাথি মেরে বের হয়ে এলো। তারপর হঠাৎ তার মনে হলো, সে ভুল করেছে। এই বিপদের সময় চাকরিটা তার অনেক দরকার ছিল। জ্যাকের থেকে কিছু টাকা ধার নিয়েছে সে। জ্যাক অবশ্য নিজে থেকেই তাকে দিয়েছে। নিশান্ত নিতে চায়নি প্রথমে। এখন টাকাগুলো কাজে লাগবে। অবন্তীর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে। নিশান্তর হঠাৎ করেই অপরাধবোধ জন্মালো। সে কি অবন্তীর সাথে তখন একটু বেশি রুড ব্যবহার করে ফেলেছিল? শত হলেও অবন্তী অসুস্থ। ওই অবস্থায় মেয়েদের মেজাজ বিক্ষিপ্ত থাকে। নিশান্তর উচিৎ ছিল ঠান্ডা মাথায় ব্যাপারটা হ্যান্ডেল করা। সেটা না করে উল্টো সে নিজেই ট্রিগারড হয়ে গিয়েছিল। এখন কি অবন্তীকে ফোন করে একটা স্যরি বলবে?

নিশান্ত ধীরপায়ে হেঁটে একটা ফোন বুথের সামনে দাঁড়ালো। তারপর ঝটপট অবন্তীর নাম্বার ডায়াল করল। কিছুক্ষণ রিং হতেই ওই পাশ থেকে কথা বলল বিলকিস,” হ্যালো।”

” আন্টি আসসালামু আলাইকুম। আমি নিশান্ত বলছি।”

বিলকিস কোনো জবাব দিল না। নিশান্ত আড়ষ্ট গলায় বলল,” অবন্তী কোথায় আন্টি? ও মনে হয় এখনও আমার উপর রেগে আছে তাই আপনাকে দিয়ে ফোন ধরিয়েছে। আসলে আমাদের মধ্যে একটু ঝগড়া হয়ে গেছিল। আন্টি প্লিজ ওকে একটু দিন। আমি স্যরি বলার জন্যই ফোন করেছি।”

বিলকিস মুখে আঁচল চেপে হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠল আচমকা। নিশান্ত থতমত খেল। আত্মাটা ধড়াস করে কেঁপে উঠল তার। এরপর বিলকিস যেটা বলল তা শোনার পর অনেকক্ষণ নিশান্ত কোনো শব্দ করতে পারল না। এমনকি… আশেপাশে কোনো শব্দও শুনতে পেল না। ফোন বুথ থেকে কথা বলার জন্য আরও কিছু মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল৷ তারা তাগাদা দিচ্ছিল। কিন্তু নিশান্তর কানে ওসব কিছুই ঢুকল না। তার পৃথিবীটা শব্দহীন, নিশ্চুপ হয়ে গেল যেন খুব হঠাৎ করেই।

______________
দীর্ঘসময় অবজারভেশনে থাকার পর জ্ঞান ফিরে এলো অবন্তীর। সে চোখ খুলে সর্বপ্রথম যে মুখটি দেখল তাতে মনে হলো এ কোনো স্বপ্ন নয়তো? নিশান্ত বসে আছে তার সামনে। তার দুই চোখ টলমল করছে। তৃষ্ণার্ত দৃষ্টি মেলে অপলক চেয়ে আছে সে অবন্তীর দিকে। অবন্তীর একহাতে ব্যান্ডেজ। সেই হাত নাড়াতে কষ্ট হচ্ছে। শরীরও কেমন যেন অবশ অবশ লাগছে। অবন্তী উঠে বসতে চেয়েও পারল না। নিশান্ত কাছে এসে অবন্তীর কপালে চুমু দিল। আবেশে চোখ বুজে এলো অবন্তীর। তারপর হঠাৎ করেই অভিমানী হয়ে উঠল মন। ঝগড়ার কথা মনে পড়তেই অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল সে। নিশান্তর দিকে সে একদম তাকাবে না। আর কথা বলার তো প্রশ্নই আসে না।

নিশান্ত অবশ্য কিছু বলল না তাকে। একটু পর নার্স এসে বলল,” দেখি…পেশেন্টকে ঔষধ খাওয়াবো এখন।”

নিশান্ত কোমল স্বরে বলল,” আমি ঔষধ খাওয়াই?”

নার্স কিছু বলার আগেই অবন্তী ফোঁস করে বলে উঠল,” আমি নিজের ঔষধ নিজেই খেতে পারি। কাউকে আমার জন্য ঝামেলা পোহাতে হবে না।”

নিশান্ত একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” আমি তাহলে বাহিরে অপেক্ষা করছি। আপনি ওকে ঔষধ খাওয়ান।”

এই বলে সে বের হয়ে গেল। অবন্তীর এখনও মনে হচ্ছে সে স্বপ্ন দেখছে। নিশান্ত কি সত্যি এসেছে? সে বেরিয়ে যেতেই অবন্তী নার্সকে প্রশ্ন করল,” আচ্ছা, আমি কয়ঘণ্টা ধরে এখানে শুয়ে আছি?”

” গতকাল রাত থেকে।”

অবন্তী ঘড়িতে তাকিয়ে দেখল এখন সন্ধ্যা সাতটা বাজছে। অর্থাৎ প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা কেটে গেছে। কানাডা থেকে বাংলাদেশে আসার জন্য এটুকু সময় যথেষ্ট। এর মানে নিশান্ত সত্যি এসেছে! এটা কোনো স্বপ্ন নয়। অবন্তীর মন ব্যাকুল হয়ে উঠল। একটু পর বিলকিস এসে অবন্তীকে দু’টা চড় মা-রল। অবন্তী হতবিহ্বল হয়ে মায়ের দিকে তাকাল। বিলকিস কড়া গলায় বলল,” তোর সাহস কিভাবে এতো বেড়ে গেল যে আত্ম-হত্যা করতে যাস? ম-রার এতো শখ থাকলে আমাকে বলতি। যেভাবে তোকে জন্ম দিয়েছি সেভাবেই গলা টিপে মেরে ফেলতাম।”

অবন্তী ফ্যাল-ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। কিছু বলতে পারল না। বিলকিস আরও একগাদা কথা শোনালো। তারপর নিশান্তর প্রসঙ্গ টেনে বলল,” ছেলেটা কত ভয় পেয়েছিল জানিস? তোর কোনো অধিকার নেই আমাদের সবাইকে এভাবে হয়রানি করার।”

অবন্তী প্রশ্ন করল,” নিশান্ত কি কেঁদেছিল মা?”

বিলকিস এই প্রশ্নের উত্তর দিল না। উল্টা অবন্তীর গালে আরও একটা চড় পড়ল। অবন্তী গালে হাত দিয়ে চুপচাপ বসে রইল।

কিছুক্ষণ পর জাবির এলেন অবন্তীর কেবিনে। তাকে দেখে জড়সড় হয়ে উঠে বসতে চাইল অবন্তী। জাবির সতর্ক কণ্ঠে বললেন,” থাক, থাক, উঠতে হবে না। শুয়ে থাকো মা।”

অবন্তী একটু অপ্রস্তুত হলো। এই প্রথম নিশান্তর বাবার সাথে সে সরাসরি কথা বলছে। তিনি নিশ্চয়ই সব জেনে গেছেন। অস্বস্তির পাশাপাশি লজ্জাও লাগছে অবন্তীর। জাবির সাহেব মুখোমুখি বসলেন। অবন্তী মাথা নিচু করে রইল। সে কোনো কথাই বলতে পারছে না। আসলে কি বলবে তাও বুঝতে পারছে না। কি কঠিন পরিস্থিতি! জাবির সাহেবই শুরু করলেন। মোলায়েম গলায় বললেন,” মা, এইযে তুমি কাজটা করলে সেটা কি ঠিক হয়েছে বলো?”

অবন্তী অপ্রস্তুত দৃষ্টিতে তাকাল। হাসার চেষ্টা করল। জাবির একটু ঝুঁকে এসে স্নেহার্দ্র কণ্ঠে বললেন,” তুমি আমার মেয়ের মতো। না, আজকে থেকে তুমি আমার মেয়েই। তাই মেয়ে হিসেবে বাবাকে কথা দাও। এইরকম তুমি আর কখনও করবে না৷ ”

অবন্তী আড়ষ্টতা নিয়ে তাকিয়ে রইল। জাবির বললেন,” সৃষ্টিকর্তা আমাদের জীবন দিয়েছেন। সেই জীবন শেষ করার অধিকার কিন্তু দেননি। তাই তোমার কাজটি খুব নিকৃষ্ট অন্যায়। আমাকে কথা দাও আর কখনও এমন অন্যায় তুমি করবে না।”

অবন্তী ইতস্তত করে বলল,” ঠিকাছে। কথা দিলাম।”

জাবির এবার অমায়িক হেসে বললেন,” আমাকে তোমার খুব খারাপ মানুষ মনে হয় তাই না?”

” ছি আঙ্কেল, এসব কি বলছেন? এরকম কেন মনে হবে?”

” কারণ আমি মানুষটা আসলেই খারাপ।” জাবির সাহেব মাথা নিচু করে কি যেন একটা ভাবতে লাগলেন। তারপর হঠাৎ মাথা তুলে খুব তীব্র আবেগভরা কণ্ঠে বললেন,” আমার ছেলেকে আমি কখনও এভাবে কাঁদতে দেখিনি।”

অবন্তী একটু চমকে উঠল। জিজ্ঞেস করল,” নিশান্তর কথা বলছেন?”

” আর কার কথা বলব? আমার তো একটাই ছেলে। তোমাকে যখন আমরা মেনে নেইনি তখন সে রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। আমি ধরেই নিলাম কিছুদিন পর হার মেনে ঠিক ফিরে আসবে। তোমাকেও ভুলে যাবে। পুরো ব্যাপারটা হয়তো সাময়িক। কিন্তু যখন ও তোমার সুইসাইড এটেম্পটের খবরটা জানতে পারল, কেমন পাগলের মতো ছুটে এসে আমার কাছে অবুঝ শিশুটির মতো কাঁদছিল তা যদি তোমাকে দেখাতে পারতাম!”

জাবির সাহেব আঙুল দিয়ে চোখ দু’টো মুছলেন। অবন্তী বুকের বামপাশে চিনচিনে ব্যথা টের পেল। জাবির ধাতস্থ হয়ে বললেন,” নিশান্তকে শেষবার আমি ওভাবে কাঁদতে দেখেছি কখন জানো? ছোটবেলায়। যখন তার মাত্র পাঁচবছর বয়স। আমরা চেরি গার্ডেনে গিয়েছিলাম। ও সেখানে হারিয়ে গেল। কাউকে খুঁজে না পেয়ে অসহায় বাচ্চারা যেভাবে কাঁদে সেভাবেই কাঁদছিল। কাল নিশান্তকে কাঁদতে দেখে আবার বিশ বছর আগের কথাটা আবার মনে পড়ে গেল। আমি একটা ব্যাপার বুঝলাম। আমার ছেলে তোমাকে ছাড়া অনেক নিঃসঙ্গ, অনেক অসহায়, একদম দিশেহারা অবুঝ বাচ্চার মতো।”

অবন্তী তার চোখের পানি সামলাতে পারল না। মুখে হাত দিয়ে হুঁ হুঁ করে কেঁদে ফেলল। জাবির কাছে এসে অবন্তীর কাঁধে হাত রেখে বললেন,” আমার ছেলে সবকিছুর বিনিময়ে তোমাকে চেয়েছে। আমি যদি ওকে তোমাকে না দিতে পারতাম তাহলে নিজেকে দুনিয়ার সবচেয়ে হতভাগা বাপ মনে হতো।”

জাবির এবার অবন্তীর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,” আমাকে আরেকটা কথা দিতে হবে কিন্তু।”

অবন্তী কিছু না বলে প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকাল। সে তখনও কাঁদছে।

জাবির হাসিমুখে বললেন,” আমার ছেলেকে কখনও কষ্ট দিও না। ওকে সবসময় খুশি রেখো। আমার ছেলেটা তোমাকে অবুঝের মতো ভালোবাসে মা।”

অবন্তীর কান্নার বেগ আরও বৃদ্ধি পেল। মনে মনে স্বগতোক্তি করল, ” আমি পাপী, পাপী, খুব বড় পাপী।” জাবির সাহেব আর বেশি কিছু বললেন না। অবন্তীকে বিশ্রাম করতে বলে চলে গেলেন। অবন্তীর মনে হলো সে অনেক বড় অন্যায় করেছে। নিশান্ত যখন ঝগড়ার সময় তার সাথে কঠোর ব্যবহার করছিল তখন অবন্তীর মনে হচ্ছিল তার পুরো পৃথিবীটা ভেঙে গেছে। রাগে, জেদে, অভিমানে মাথা কাজ করছিল না একদম।উত্তেজনায় উন্মাদ হয়ে ছেলেমানুষী কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছে। আর তার এই ছেলেমানুষীর জন্য নিশান্ত কতই না কষ্ট পেয়েছে! অবন্তীর খুব রাগ হলো নিজের উপর। সে কেন এতো খারাপ? অবন্তী বিছানা ছেড়ে উঠতে নিলেই মাথাটা ঘুরে উঠল। শরীর এখনও খুব দূর্বল তার। নার্স ছুটে এসে বলল,” আরে কি হয়েছে? উঠছেন কেন আপনি? বাথরুমে যাবেন?”

অবন্তী দুইপাশে মাথা নেড়ে বলল,” না। একটু আগে এখানে যে কমলা টি-শার্ট পরা ছেলেটি বসেছিল তার কাছে যাবো।”

” তিনি তো এখানে নেই। আচ্ছা আমি খুঁজে আনছি। আপনি বসুন।”

অবন্তী কথা শুনল না। নার্সের হাত ছাড়িয়ে নিজেই যেতে রাখল৷ নার্স তাকে দমিয়ে রাখতে পারল না। কেবিন থেকে বের হতেই বিলকিস প্রশ্ন করল,” কি ব্যাপার?”

অবন্তী ব্যাকুলচিত্তে বলল,” মা, নিশান্ত কোথায়?”

রিমা গম্ভীর মুখে বলল,” ছাদে আছে। তুমিই নাকি ওকে বলেছো তোমার কেবিনের আশেপাশে না আসতে!”

অবন্তী চোখের জল মুছতে মুছতে বলল,” আমি ছাদে যাব।”

বিলকিস অবন্তীকে ধরে বলল,” আরে পাগল নাকি? এই অবস্থায় ছাদে কিভাবে যাবি? তুই থাম আমি নিশান্তকে ডাকছি।”

অবন্তী মানল না। কোনোকিছু অগ্রাহ্য না করে সে লিফটের দিকে পা বাড়াল। বিলকিসও পেছন পেছন এলো। নার্সও এলো।

ছাদের এক কোণে বিষণ্ণ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিল নিশান্ত। তাকে দেখতে পেয়েই ঠোঁটে হাসি ফুটল অবন্তীর। চপল পায়ে ছুটে যেতে লাগল। পায়ের শব্দ পেয়ে পেছন ফিরে তাকাল নিশান্ত। অবন্তীকে দেখে চমকে উঠল। অবন্তী হোচট খেয়ে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হতেই নিশান্ত জাপটে ধরল তাকে। নার্স ভেতরে ঢুকতে গেলেই বিলকিস বাঁধা দিয়ে বলল,” ওরা থাকুক এখানে একা। আমরা চলে যাই।”

নার্স মৃদু হেসে বিলকিসের সাথে চলে গেল।

অবন্তী কানে হাত রেখে কাঁদো কাঁদো মুখে বলল,” আই এম স্যরি।”

নিশান্তর চোখ দু’টি ফুলে আছে। সামান্য রক্তলাল। অবন্তীর আরও মায়া লাগল। নিশান্তর গালে হাত ছুঁয়ে বলল,” আমি আর কখনও তোমাকে অবিশ্বাস করব না। কথা দিলাম।”

নিশান্ত শীতল স্বরে বলল,” তুমি ভেবেছিলে আমি তোমাকে ধোঁকা দিব। আর কখনও বাংলাদেশে ফিরে আসব না। তাই না?”

অবন্তী অপরাধী ভঙ্গিতে মাথা নিচু করল। স্টেইসির কথা শুনে সে সত্যিই সে তাই ভেবেছিল৷ তাই তো অনায়াসে নিজের জীবন শেষ করে দিতেও দ্বিধাবোধ করেনি। নিশান্ত অবন্তীর চিবুক উপরে তুলে শক্ত গলায় বলল,” শোনো, আর কখনও যদি আমার ভালোবাসার উপর সন্দেহ করো তাহলে কিন্তু কঠিন শাস্তি পেতে হবে। মনে থাকবে?”

অবন্তী মাথা নাড়ল। নিশান্ত ভ্রু কুচকে অবন্তীর ব্যন্ডেজ করা হাতটির দিকে তাকাল। তারপর হাতটি ধরে উপরে তুলে বলল,” আর এইযে তুমি এটা করেছো, এটার শাস্তি তো তোমাকে পেতেই হবে। এতো সহজে মাফ করব না আমি।”

অবন্তী কাঁদতে কাঁদতে বলল,” কোরো না। আমাকে তুমি একদম মাফ কোরো না নিশান্ত। তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। তাই আমাকে যত ইচ্ছা শাস্তি দাও প্লিজ।”

নিশান্ত শক্ত করে অবন্তীকে জড়িয়ে ধরল নিজের সাথে। অবন্তী আবেশে চোখ বুজে ফেলল। নিশান্ত বিভোর কণ্ঠে বলল,” তোমার শাস্তি হলো এখন থেকে সবসময় আমার কাছাকাছি থাকতে হবে। ভুল করেও দূরে যেতে পারবে না। বুঝতে পেরেছো?”

অবন্তী কান্নারত অবস্থাতেই হাসল। বলল,” এটা তো পুরষ্কার হয়ে গেল।”

তারপর দু’জনই হেসে উঠল একসাথে। নিশান্ত আবেগমিশ্রিত কণ্ঠে বলল,” তুমি কি জানো অবন্তী? তুমি আমার জীবনে কি?”

অবন্তী লাজুক হেসে জানতে চাইল, “কি?”

নিশান্ত অবন্তীর কপালে উষ্ণ চুমু দিল। ফিসফিস করে বলল,” তুমি আমার জীবনের বসন্তকাল।সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে রঙিন, সবচেয়ে প্রিয়। আমার অন্তহীন বসন্ত।”

অবন্তী ঝলমল করে হেসে উঠল। নিশান্ত দুষ্টুমিপূর্ণ কণ্ঠে বলল,” একটা ব্যাপার ভাবতে আমার খুব মজা লাগছে।”

” কি ব্যাপার?”

” আমাদের এখন আবার বিয়ে হবে। অথচ কেউ জানতেও পারবে না যে এটা আমাদের দ্বিতীয় বিয়ে ছিল।”

” আসলেই তো!”

অবন্তী চোখ বড় করে তাকাতেই চোখ টিপে হাসল নিশান্ত। ইশ, জীবন অস্বাভাবিক সুন্দর মনে হচ্ছে। ঠিক নিশান্তর হাসিটার মতোই।যে আশ্চর্য সুন্দর হাসির দিকে অবন্তী বিভোর হয়ে চেয়ে থাকতে পারবে জনম-জনম!

_____________সমাপ্ত