#অন্তহীন_সন্ধ্যা
#পর্ব ০৩
#মাকামে_মারিয়া
বিয়ে হয়েছে আজকে তিনদিন। কিন্তু এখনো পর্যন্ত ফারিনের দেখা সাক্ষাৎ পায়নি জুহাইরা। মনে মনে মেয়েটাকে দেখার আলাদা এক তৃষ্ণা কাজ করছে। একই বাড়িতে থেকেও একটা মানুষের দেখা না পাওয়ার বিষয়টা খুবই বিব্রতকর। সে নিজেও নতুন মানুষ যে কারনে যেকোনো ইচ্ছে দমিয়ে রাখতে হচ্ছে।
ফারিন বাসায় থাকলে রুম থেকে বের হয় না। মাঝে মাঝে খাবারটাও ওর রুমে পাঠানো হয়। হয় বাসা নয়তো বাহিরে আড্ডা দিতে যাওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ তার জীবন।
তখন সকাল, বাড়িতে হালকা আয়োজন হচ্ছে। জুহাইরা আজকে নতুন জামাইসহ বাপের বাড়ি যাবে। মনে মনে আলাদা এক আনন্দ কাজ করছে। আগেও তো কোথাও বেড়াতে গেলে নিজের বাড়িতে ফিরে এসেছে অথচ এবার নিজের বাড়ির যাওয়ার আনন্দটা যেন অন্য রকম।
রাফসান বাজারে গিয়েছিল প্রয়োজনীয় জিনিস পত্র আনতে। বাজার- সদাই রান্নাঘরে রেখে নিজের রুমে এসে দেখলো জুহাইরা মাথায় লম্বা ঘোমটা টেনে কোলে একটা বই নিয়ে আনমনে পৃষ্ঠা উল্টাচ্ছে। কিন্তু চোখে মুখে অন্য ভাবনা, বই যে পড়ছে না সেটা বুঝাই যাচ্ছে।
অনেক গুলো চকলেট এনে জুহাইরার বইয়ের উপর রাখতেই সে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলো রাফসান পিছন ফিরে আয়নায় কিছু করছে। সামনে চকলেট গুলো দেখে জুহাইরার মুখ উজ্জ্বল হলো। সব চকলেট হাতে নিয়ে উঠে এসে গুছিয়ে রাখা লাগেজটার মধ্যে রাখলো।
রেখে দিচ্ছো যে? পরে খাবে? নাকি খাবেই না?
জুহাইরা ভেবেছে রাফসান হয়তো এতো খেয়াল করে না তাকে। অথচ এখন দেখলো না সে ভুল ভেবেছে, লোকটার তো চার চোখ। জুহাইরা যা করে সব কিছুই নোটিশ করে সে। হঠাৎ রাফসানের কথায় জুহাইরা তাৎক্ষণিক কোনো জবাব দিতে পারলো না বলে রাফসান আবারো স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললো ” মুখ এমন চোরের মতো করে রাখার কি হলো? মনে হচ্ছে চুরিতে ধরা পড়ছো! তুমি তো আস্ত বলদ! দেখা যাবে চুরি না করেও চোর হয়ে বসে আছো আর আমি চুন্নির জামাই!
কথাটা শেষ হতেই রাফসানের ঠোঁটের কোণে অল্প হাসির রেখা দেখা দিলো। এদিকে জুহাইরা ফিক করে হেঁসে দিলো। নিজেকে স্বাভাবিক করে খাটে থাকা রাফসানের কাপড় গুছাতে গুছাতে বললো ” চকলেট খায় না এমনও মেয়ে মানুষ আছে নাকি দুনিয়ায়? আমিও খাই তবে রেখে দিয়েছি কারন সব সময় টিউশনি থেকে বাড়ি ফেরার পর বড় ভাইয়ের মেয়েটা হাতের দিকে তাকাই থাকতো। কখনো খুচরো থাকলে চিপস চকলেট নিয়ে আসতে পারতাম কখনো পারতাম না। এতোগুলো চকলেট দেখলে পুচকো টা যা খুশি হবে।
জুহাইরার চোখ মুখ চিকচিক করতে লাগলো। এমন সহজ সরল স্বীকারোক্তিতে রাফসান যেন তার সহধর্মিণীকে আরো একবার নতুন করে জানলো। মেয়েটার মধ্যে একটা অন্য রকম মায়া রয়েছে। যা বার বার রাফসানকে মুগ্ধ করে। রাফসান মনে মনে খোদার দরবারে লক্ষ্য কোটি শুকরিয়া জ্ঞ্যাপন করে আর ভাবে নিশ্চয়ই কষ্টের পর সুখ আসে, ধৈর্যের ফল আসলেই মিষ্টি হয়।
রাফসানকে অনেকটা সহজ লাগছে এই মূহুর্তে। জুহাইরা মনে মনে প্রস্তুতি নিলো কিছু প্রশ্ন করার, যে প্রশ্ন গুলো প্রথম থেকেই করতে চেয়েও করতে পারেনি সে। জুহাইরা গলা পরিষ্কার করে মিনমিনে কন্ঠে বলতে লাগলো ” ইয়ে মানে…!
” কিছু বলবে? আমি স্পষ্টবাদীতা পছন্দ করি। তাই আমার কাছে সব কিছু খোলাসা করে রাখবে।
” আসলে একটা প্রশ্ন ছিল!
” হ্যাঁ বলো?
” আপনার প্রথম স্ত্রী! না মানে উনাকে তো দেখলাম না আর উনার সম্পর্কে জানিও না কিছু!
রাফসান দুই সেকেন্ড চুপ করে থেকে মোহনীয় কন্ঠে জুাহইরাকে ডেকে বললো ” জুহা! এতোটা সহজ সরল হলে জীবন কঠিন হয়ে যায়। একটু শক্ত পোক্ত হওয়ার চেষ্টা করো।
” কি করলাম?
” কিছুই না।
জুহাইরা বোকা বনে গেলো আবারও। রাফসান আড়চোখে জুহাইরার দিকে তাকিয়ে বললো ” এতোক্ষণে এসব জিজ্ঞেস করতে মন চাইলো তোমার?
” না মানে সময় সুযোগ পাইনি তো তাই।
” আহা জুহা! পরিস্থিতি সব সময় সুযোগ করে দিবে না। তোমাকে সুযোগ করে নিতে হবে। এতোটা বোকা হলে জীবন তোমাকে বিষাদ ছাড়া কিছু দিবে না।
” আপনি আছেন তো! কথাটা বলেই জুহাইরা মুখ লুকিয়ে হাসলো। লজ্জাও পেলো একটু।
রাফসান বিদ্রুপের হাসি হেঁসে বললো ” আমি আছি এটা ভেবে বোকা সেজে থাকলে চলবে না জুহা। টু বি স্ট্রং!
” আচ্ছা আচ্ছা প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার জন্য এতো কিছু বলছেন বুঝতে পারছি।” নাক ফুলিয়ে কথাটা বলেই চলে যেতে নিবে জুহাইরা ওমনি রাফসান তাকে থামিয়ে দিলো হাতটা ধরে। জুহাইরা থামলো। পিছন ফিরে রাফসানের দিকে তাকাতেই সে মাথাটা নিচু করে নিয়ে ব্যস্ত কন্ঠে বললো ” বুঝেছি আপনি বড্ড ঝগড়ুটে! বলেন দেখি কি প্রশ্ন যে করেছিলেন?
জুহাইরা স্মিথ হেঁসে বললো ” আপনার প্রানপ্রিয় প্রথম সহধর্মিণী, আমার সতীন তার সম্পর্কে জানতে চাইছিলাম। সতীন শব্দটা উচ্চারণ করতেই জুহাইরার কেমন লাগলো। অস্বস্তিতে পড়ে গেলো নিজেই। মনে মনে নিজেকে শাসালো, মজা করতে গিয়ে বেয়াদবি না হয়ে গেলো।
” তিন কবুল করা স্ত্রী কেবল! তাছাড়া আর কিছুই নয়।
” কেনো কেনো?
” সব কিছু একেবারে বুঝে নিতে নেই জুহা রানী! ধীরে ধীরে বুঝবে।
কথাটা বলতে বলতে জুহাইরার কপালের পাশের চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে দিয়েই রাফসান বের হয়ে গেলো রুম থেকে।
____________
টিশার্ট প্যান্ট গায়ে,পায়ে হাই হিল, ঘাড় অব্দি চুলগুলো এলোমেলো ভাবে ছেড়ে রাখা। কাঁধে পার্টি ব্যাগ, ঠোঁটে ডার্ক লিপস্টিক। ড্রয়িং রুম ভর্তি মানুষের সামনে দিয়ে যখন ফারিন এমন বেশভূষ নিয়ে বের হচ্ছিল উপস্থিত সবাই বিস্মিত হলো। রাফসানের বাবা আতিকুর রহমান নম্র স্বরে ডেকে জিজ্ঞেস করলো ” কোথাও বের হচ্ছো ফারিন?
এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়াটাও ফারিনের নিকট জবাবদিহি পর্যায়ে পড়ে। তাকে কেউ এমন প্রশ্ন করুক এটাও সে সহ্য করে না। তবে অন্য সময় হলে পা চালিয়ে চলে যেতো। আজকে তা করলো না, বরং নাক মুখ কুঁচকে জানালো সে বের হচ্ছে বন্ধুদের নিয়ে আজকে কোনো এক প্রোগ্রাম এ যাবে।
কেউ কথা এড়িয়ে গেলে একটা সময় পর তার প্রতি আগ্রহ কমে আসে। তেমনি বাড়ির প্রতিটা মানুষের ফারিনের প্রতি আগ্রহ নেই বললেই চলে। কেননা প্রথম প্রথম ফারিনের সাথে সবাই ভাব করতে চাইলেও ফারিন নিজ থেকে কখনো সায় দেয়নি। এখন আর কেউ ফারিনের সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে যায় না। আজকেও আতিকুর রহমান কিছু জিজ্ঞেস করতেন না তবে মেহমানদের সামনে দিয়ে এ ভাবে চলে যাচ্ছে ভেবেই সৌজন্যমূলক জিজ্ঞেস করলো।
ফারিন নিজের কথা শেষ করে আর এক সেকেন্ডও থামতে চাইলো না তবে শ্যামলা বানু তাকে থামিয়ে দিয়ে কিছুটা রাগ নিয়ে বললো ” আজকালকার মাইয়াগো বুঝবার পারি না। দিন নাই রাইত নাই ভরদুপুরেও নাকি মাইয়া পোলা আড্ডা দিতে হইবো। আতি মান ইজ্জত থাকতে থাকতে এই মাইয়ারে বাইর কর এই বাড়িত থাইক্কা।
শ্যামলা বানু বরাবরই স্পষ্টবাদী। যেই হোক না কেনো সে কখনো কাউকেই ছেড়ে কথা বলে না। উনার কথায় ফারিন থেমে গেলো। চোখে মুখে ক্রোধ, প্রচন্ড হিংস্র কন্ঠে বলে উঠলো ” বয়স্ক মানুষ কিছুটা নরম হোন এবার, আর কতোকাল বাঘিনী হয়ে থাকতে চান? ভুলে যাবেন না আপনাদের বাড়িতে আমি নিজের ইচ্ছেই বসে নেই। আমার পাওনা মিটিয়ে দেন আমি ঠ্যাং দেখিয়ে চলে যাবো। পাওনা মিটানোর তো মুরোদ নেই আবার বড় বড় কথা!
ফারিন হলো মৌচাক, তাকে খোঁচা মারা মানেই সে সমস্ত বিষ ঢেলে দেয়। পরিস্থিতি বিগড়ে যাবে ভেবেও অনেকে অনেক সময় তাকে উচিৎ টাও বলতে ভয় পায়।
সবার সামনে দাদীকে এ ভাবে কটুকথা বলতে শুনেও চুপ করে রইলো রাফসান। সে অপারগ, ফারিনের সাথে মুখ লাগিয়ে অযুক্তিক তর্ক করাটাকে সে আপাতত বোকামি মনে করে। ফারিন নূন্যতম সম্মান দেখিয়ে কারো সাথে কথা বলে না, আর রাফসানের সাথে তো আরো আগেই না।
জুহাইরার বাবা সুলাইমান গ্রামের দুই তিনজন গন্যমান্য ব্যক্তি নিয়ে এসেছিলো নতুন আত্মীয়ের বাসায়। ফারিনের আচরণে তিনি ততটাও অবাক হলেন না কারণ আতিকুর রহমান আগেই উনাকে একটু আকটু জানিয়ে রেখেছেন ফারিন সম্পর্কে।
ফারিনের করা আচরণে সবাই বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলো। বসার ঘরের এক কোণে রাফসানের ঠিক পিছনে জুহাইরা নতজানু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঘোমটা টেনে একদৃষ্টিতে ফারিনকে দেখতে লাগলো, তার বেশভূষা, আচরণ, রক্ত চাহনি, মুখাবয়ের বিরক্তি সব কিছু জুহাইরা দেখছে আর অবাক হচ্ছে সাথে কেমন ভয়ও লাগছে। জুহাইরা ভাবেনি এতোটা বিগড়ে যাওয়া মেয়ে ফারিন।
জুহাইরার চোরাচাহনি ধরা পড়ে গেলো ফারিনের চোখে। ফারিন হাঁটতে গিয়েও থেমে গেলো। দুজনের চোখাচোখি হতেই জুহাইরার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। কেমন ভয় ভয় লাগে ফারিনকে। মনে হয় এখুনি অনেক গুলো কথা শুনিয়ে দিবে।
হলোও তাই, বোকাসোকা দেখতে জুহাইরা শ্যামবর্ণ গায়ে লাল টকটকে শাড়ি পড়েছে, চোখে গাঢ় করে টানা কাজল। নাকে বড়সড় একটা নাক ফুল,দুহাতে বুঝাই করা চুড়ি, গলায় আবারোও নেকলেস, লম্বা চুলের খোঁপাটাও বড্ড বড়, সেখানটায় দুটো ফুল গুঁজে রাখা।অন্যদের চোখে বাঙালি বধূ লাগলেও ফারিনের কাছে জগন্য আর ক্ষ্যত লাগলো। সে নাক কুঁচকালো। একটু এগিয়ে এসে রাফসানের দিকে একবার, জুহাইরার দিকে একবার তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের সাথে হেঁসে বললো ” বাহ! ইট’স পারফেক্ট ম্যাচ! দুইটাই একই কালারে হুহ।
এক লাইনের দগ্ধ করা কথাটা বললেই ফারিন বেড়িয়ে গেলো। রাফসানের খুব রাগ লাগছে। সাথে লজ্জাও। ফারিন আজ অব্দি স্বামী হিসেবে তো দূর একজন ছেলে হিসেবেও তাকে সম্মান দেয়নি কারণ রাফসান দেখতে আহামরি নয়, ফারিন যেমন স্মার্ট চায় রাফসান তেমন ওভার স্মার্ট নয়। গায়ের রংটা হালকা চাপা। এদিকে জুহাইরাও তেমনি। তাই তো ফারিন দুজনকে সরাসরি অপমান করে চলে গেলো।
দক্ষিণের জানালা টার পাশে অশ্রুসিক্ত নয়নে বসে আছে জুহাইরা। ছোট কাল থেকে নিজের জন্য তাকে কথা শুনতে হয়েছে। সেসব তো সহ্য হয়ে গিয়েছে। অথচ আজ কি না ফারিন এ ভাবে বললো?! রাফসানকে সহ বলাতে জুহাইরার হৃদয় পুড়ছে। মানুষটা দেখতে কতো স্নিগ্ধ অথচ কেমন বাজে কথা বললো ফারিন আপু!
এই একটা কথায় বার বার মাথায় ঘুরছে। খুব খারাপও লাগছে। রাফসান ফট করে রুমে ঢুকেই দেখলো জুহাইরা বাহিরে দৃষ্টি দিয়ে আনমনে তাকিয়ে আছে। রাফসানের বুঝতে বাকি রইলো না মেয়েটার মন খারাপ হয়েছে।
” জুহা? মন খারাপ?
রাফসানের কন্ঠে সে নড়েচড়ে বসলো। শাড়ির আঁচলটা মাথায় ভালো করে টেনে হাসার চেষ্টা করে রাফসানের দিকে তাকালো। বসে থাকা জুহাইরার দিকে এগিয়ে এসে রাফসান তার হাতটা জুহাইরার মাথায় রেখে একটু ভরসা আর শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করলো। সামনে ইয়া লম্বাচৌড়া একটা পুরুষ লোকের নিকট বসে থাকা জুহাইরাকে পিচ্চি লাগছিলো। সে মাথা উঁচু করে রাফসানের দিকে তাকালো। দু’জনের চোখে মুখে বিষাদের সাথে ভরসার আভা। এ ভাবেই কয়েক সেকেন্ড চোখে চোখে ভরসা আদান-প্রদান হলো। মুখ ফুটে কেউ কাউকে কিছু বলতে পারলো না। রাফসান কেবল তার হাতটা জুহাইরার মাথায় রেখে হালকা করে বুলাতে লাগলো।
চলবে……………