অন্তহীন সন্ধ্যা পর্ব-২৪+২৫+২৬

0
5
অন্তহীন_সন্ধ্যা #সূচনা_পর্ব #মাকামে_মারিয়া

#অন্তহীন_সন্ধ্যা
#পর্ব ২৪
#মাকামে_মারিয়া

সরকার বাড়ির মানসম্মান যতটুকু ছিল তার কানাকড়িও এখন আর অবশিষ্ট নেই। সবার মুখে একটাই কথা বাপ দাদার কাল থেকেই এই বাড়ির এমন ঘোলাটে ইতিহাস। একেকজন দুই তিনটা বিয়া না করলে যেন এদের বিয়া পরিপূর্ণ হয় না। এখন আবার মেঝো ব্যাটার পোলায় বড় ভাইয়ের তালাক দেওয়া বউরেই বিয়া করছে! কেমন নির্লজ্জ! দুনিয়ায় কি মাইয়ার অভাব পড়ছিলো!

কেউই বা বলছে” এদের মনে হয় আগে থাইকাই তলে তলে পিরিতি চলছিলো, এ জন্যেই এতো কাহিনি কইরা রাফসানরে তালাক দিয়া ওই জমিদারের বেটি ছোট্ট পোলাডারে বিয়া করছে। পাশ থেকে সকিনা বিবি আয়েশি ভঙ্গিতে বলে যা হয় ভালার জন্যই হয় গো, রাফসান আছিলো ভালা পোলা, ওর লগে ওই জমিদারের বেটির কোনো মিলমিশ ছিল না। এইটার লগে তাহসিনই ঠিক আছে। আর রাফসান একখান হিরের টুকরা পাইছে এহন। যে যেমন তার লগে তেমন সঙ্গী।

বাড়ির ভিতরে শুনশান নীরবতা, বাহিরের সবাই গুনগুন করলেও ভিতরে চলছে নীরব যুদ্ধ। ড্রয়িং জুড়ে সবাই বসেছে। আজকে একটা কিছু হবেই। এসব আর মানা যাচ্ছে না। ফারিন আর তাহসিনের গার্ডিয়ান বলতে কেউ নেই এখানে কারণ মজিবুর রহমান তার স্ত্রী সহ ঢাকায় আর ফারিনের বাবা বাহিরের দেশে।।

বদিউর আতিকুর রহমান গ্রামে দুজন গন্যমান্য ব্যক্তি সহ সবাই উপস্থিত। জুহাইরা চুলার ধারে আনমনে চা বসিয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে। জুহার কি তবে মন খারাপ? ঠিক কি ভাবে নিয়েছে সে ব্যাপারটা?

না জুহার মন খারাপ না, আবার ভালোও না। মনটা যেন কেমন উদাস। খুব বেশি কষ্ট পেলে মানুষ যেমন নীরব পাথর হয়ে যায়,কান্না করতে ভুলে যায় ঠিক সেই অবস্থা হয়েছে মেয়েটার। ফারিন বাড়িতে এসেছে খবরটা শুনে যতটা অবাক হওয়ার কথা ছিল ততটা অবাক সে হয় নাই। কারণ এই সন্দেহটা আগে থেকেই করা, সন্দেহ গুলো যখন সত্যি হয় তখন কষ্ট আর অবাক হওয়ার মাত্রাটাও কিছুটা কমই হয়।

রাফসান এক ফাঁকে কিচেনে এসে শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো ” অসুস্থ শরীর নিয়ে তুমি আসতে গেলে কেনো? কাকী আছে, আম্মা আছে উনারা করে দিতো।

চায়ের কাপে চা ঢেলে দিতে দিতে জুহা তাচ্ছিল্য হেঁসে বললো ” সুস্থ হয়ে গেছি।

রাফসান জুহাইরার গালে কপালে হাত দিয়ে দেখলো সত্যিই জ্বর নেই। শরীর একেবারে ঠান্ডা। রাফসান ব্রু কুঁচকে বললো ” শরীর এতো ঠান্ডা কেন?

” পরিবেশ পরিস্থিতি এতো ঠান্ডা হলে শরীর মন সবই ঠান্ডা থাকে।

জুহার এমন কথাবার্তার মানে বুঝতে ব্যর্থ হয় সে। সেদিকে মেয়েটার খেয়ালও নেই তেমন। কেমন জানি মনে হচ্ছে কিছু একটা হবে। মানুষের পাপ যখন বেশি হয়ে যায় ঠিক তখনই সৃষ্টিকর্তা তাকে ধরে। জুহার মনে হচ্ছে এদের সাথেও বোধহয় এবার কিছু হবে।

চা পানি খেয়ে আতিকুর রহমানের তাড়ায় একজন মুরব্বি গোছের লোক গলা খাঁকারি দিয়ে বললো ” তোমরা বিয়ে করছো ভালো কথা। কিন্তু একটু বুঝে শুনে করবে না? আর মেয়ে তুমি যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে সে-ই বাড়িতে আবার ঢুকলে? তোমার লজ্জা শরম কিছু আছে?

ফারিন রাগী চোখে তাকালো কিন্তু কিছু বললো না। তাহসিন তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললো ” চাচা! কি সব বলছেন? আমাদের আগে থেকেই সম্পর্ক। দুজন দুজনকে ভালোবাসি। তাই বিয়ে করেছি।।এতে সমস্যাটা কোথায়?

” ভালোবাসা বাসী কবে থেকে? রাফসান এই মেয়েকে বিয়ে করার আগে থেকেই নাকি পরে?

” নাহ।ভাইয়া বিয়ে করার পরেই ফারিনের সাথে আমার সম্পর্ক তৈরি হয়। ফারিন ভাইয়াকে স্বামী হিসেবে মেনে নিতে পারেনি আমার সাথে সেসব সেয়ার করতো তারপর আমরা সম্পর্কে যা-ই।

মুরব্বি গোছের লোক দুটো ফিসফিস করে আস্তাগফিরুল্লাহ পড়লো। একজন নিম্ন স্বরে বললো ” কেমন বেলাজ পোলাপান!

তালাক প্রাপ্ত হওয়ার তিনমাস পর ইদ্দত পূর্ণ হলেই তুমি অন্য কোথাও বিয়ে করতে পারবা। তা না হলে তোমার জন্য বিয়ে করা জায়েজ না। জানো সেটা?

ফারিন চোখ উল্টে তাকালেও কিছু বলতে পারলো না। জুহা পাশ থেকে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে চায়ের কাপ তুলতে তুলতে মুচকি হেঁসে বললো ” কি যে বলেন চাচা! এনারা এসব হাদিস কালাম জানবে কোথা থেকে! এনারা হচ্ছে মর্ডান মানুষ। চিন্তা করবেন না ইদ্দত পূর্ণ হয়েছে। তালাক হয়েছে প্রায় চার মাস নয় দিন চলে। সমস্যা একটাই এই মেয়ে আমার স্বামীর জন্য হারাম তাই দুজনে একই বাড়িতে থাকাটা বেমানান। বাকিটা দেখেন আপনারা যা ভালো মনে করেন।

জুহার কথাগুলো নিস্তব্ধ রুমের এক দেয়াল থেকে অন্য দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে প্রতিটা মানুষের কানে বাজতেছিলো। রাফসান অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে মেয়েটার দিকে। সহজ সরল প্রানবন্ত লাগছে। চোখে মুখে সে কি সহজাত আকৃতি। মনে হচ্ছে হৃদয়ে কোনো কষ্ট নেই দুঃখ নেই।

কিন্তু তাহসিনের এই সহজ সরল কথাগুলো হজম হলো না। তার মাথা এমনি গরম, কি থেকে কি করে বসেছে। আবার বিয়ে করে বাড়িতে নিয়ে এসেছে যাতে ঝামেলা পাকানো যায়। সেখানে জুহার কথা তার হজম হওয়ার কথাও নয়। সে উচ্চস্বরে চেচিয়ে বললো ” এই তোকে কে বলছে কথা বলতে?? তোর কথা বলার সাহস কি করে হয় আমাদের মাঝে? নিজের স্টাটাস ভুলে যাস কেন সব সময়? আমার স্ত্রীর দিকে আঙুল তুলিস?? তুই তো তার নখের যোগ্যও না।

কথাগুলো শেষ করতে পারেনি তাহসিন। ওমনি গালের মধ্যে ঠাস করে একটা থাপ্পড় পড়লো। থাপ্পড় খেয়ে হুঁশ ফিরতেই দেখলো রাফসান সামনে অগ্নি দৃষ্টি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কঠিন স্বরে বললো ” তোরটা স্ত্রী! যার দিকে আঙুল তুলা যাবে না। আর আমার টা বুঝি স্ত্রী নয়?? গাঙের জলে ভেসে এসেছে? তোর স্ত্রীর স্টাটাস আমার স্ত্রী না জানলেও পুরো মহল্লা জানে। আর তুই আমার স্ত্রীর স্টাটাস জানিস? কার দিকে শকুনের নজর দিয়েছিস ভুলে যাচ্ছিস না? আবার তুই তোকারি করছিস? সম্মান দিতে শিখ! তোর বড় ভাবি লাগে,বেয়াইন নয়। আমার স্ত্রী আমার ফুল, এই ফুলে হাত দিতে চাইলে হাত ভেঙে রেখে দিবো বলে দিচ্ছি।

পরিবেশ পরিস্থিতি ভিষন রকমের গরম উপস্থিতি সবার চোখে মুখে আতংক সবাই রাফসানের দিকে তাকিয়ে আছে। এই ছেলে ছোট কাল থেকেই শান্ত স্বভাবের কিন্তু যখন রেগে যায় তখন কেউ সামলাতে পারে না। কিন্তু রাগেও না সহজে, একবার রাগলেই আগুন লেগে যায়। সবাই ভয়ে ভয়ে তাকালেও জুহা স্বাভাবিক, যেন সে জানতো এমনটাই হওয়ার। উপস্থিত কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রাফসান সবার উদ্দেশ্যে ফের বলতে শুরু করলো

এই ছেলেকে কেন মেরেছি সেটা নিয়ে কি কারো কোনো প্রশ্ন আছে আমার কাছে??

সবাই চুপচাপ বসে আছে। আতিকুর রহমানের মাথা নিচু করে রাখা। মূলত উনি আর রাফসান একই স্বভাবের পুরুষ। ভিষন শান্ত প্রকৃতির মানুষ। কাউকে কিছু বলতে না দেখে রাফসান আবার বললো ” জানি কারো কিছু বলার থাকবেও না। আর আমি তাকে মেরে অন্যায় করেছি বলে আমার মনে হচ্ছে না। একে তো আমি তার বড়, আর দ্বিতীয়ত সে অন্যায় করেছে। আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আমার স্ত্রীকে অপমান করেছে। দোষটা আমি আপনাদেরকেই দিবো। আপনারা গার্ডিয়ানরা যদি ছোট থেকেই তাকে মাথায় না চড়িয়ে পিঠে দুই চারটে দিতেন তাহলে বোধহয় এতো বিগড়ে যেতো না। শত অন্যায় করার পরেও, দুই দিন পর পর গ্রামে এসে মেয়েদের উত্যক্ত করার পরেও যখন বিচার গুলো আসতো তখন মানুষদের দমিয়ে দিয়ে, তাকে কিছু না বলে ঠিক তখন থেকেই সে লাই পেয়ে পেয়ে মাথায় চড়ে বসেছে।

আশেপাশের দুই তিন গ্রামের মেয়েদেরকে নিজের রুপ লাবণ্য দেখিয়ে বেড়াতো, ইভেন আমার স্ত্রীকে পর্যন্ত উত্ত্যক্ত করেছে।

জুহা এবার একটু নড়েচড়ে উঠলো। তাহসিন আড়চোখে জুহার দিকে তাকাতেই রাফসান কণ্ঠস্বর উঁচু করে বললো ” এইই একদম আমার স্ত্রীর দিকে তোর শকুনের দৃষ্টি দিবি না। কি ভাবছিস আমি জানলাম কি ভাবে? তোদের মতো পাপীদের পাপ লুকানো থাকে না। দুই একজনের চোখে পড়েই যায়। আমার কান অব্দি এসেছে সেসব। যেই রুপ লাবণ্য পোলাপানকে পশু বানিয়ে রাখে সে-ই রুপ লাবণ্যে থুথু ফেলি আমি।

আতিকুর রহমান শান্ত কন্ঠে বললো ” থামো রাফসান। শান্ত হও! আমরা বসেছি তো দেখি কি করা যায়।

” মাফ করবেন আব্বা। আপনারা কি করতে পারেন সেসব আমার জানা হয়ে গিয়েছে। এতো বছরে কি কি করছেন সেটাও আমার জানা।

কোহিনূর বেগম এগিয়ে এসে বললেন ” শান্ত হ!

রাফসান শান্ত হলো তবে রুক্ষ কন্ঠে বললো ” আমি শান্ত হলাম কিন্তু আমার শেষ কথা জেনে রাখেন। এই মেয়ে ফারিন আমার জন্য হারাম। তাদের সাথে কোনো রকম সম্পর্ক রাখতে আমি রাজি না আর এ বাড়িতে তো তাদেরকে আমি একেবারেই এলাউ করবো না। এখন আপনারা সিদ্ধান্ত নেন কি করবেন? যদি এদের সাথে সম্পর্ক থাকে তাহলে এই হারাম মেয়ের সঙ্গে আমার দেখা সাক্ষাৎ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তাই আমি এটা মেনে নিবো না এবং বাড়ি থেকে চলে যাবো আমার স্ত্রীকে নিয়ে।

শেষ কথায় সবাই হতাশ আর অবাক হলো। ছেলেটা রাগ করলে এমন গোঁড়ামি করে সবাই সেটা জানে। কিন্তু তাই বলে নিজের বাড়ি ছেড়ে দিবে অন্যজনের জন্য এটা তো নেহাৎ বোকামি।

চলবে………

#অন্তহীন_সন্ধ্যা
#পর্ব ২৫
#মাকামে_মারিয়া

পরিবেশ ঠান্ডা হলো না। তাহসিন চপে বসেছে। সে কেন বাড়ি থেকে বের হবে? বাড়িটা তো তার বাপেরও! এক কথা দুই কথা থেকে বিরাট বড় ঝামেলা বেধে গেলো। এখন ঝগড়াঝাটির বিরতি চলছে।

বাহিরে কড়া রোদ, আজকে ঝগড়ার চক্করে কোনো পুরুষ লোক দোকানে যেতে পারেনি। দুপুরের খাওয়া দাওয়া করে ঝগড়ার একটা সমাধান করে তবেই দোকানে যাওয়া যাবে।
চুলায় ভাত তরকারি বসিয়েছে জুহাইরা। হাতে হাতে সাহায্য করছে ফুলমতি। ফুলির রুপ লাবণ্য বেড়েছে কয়েকগুণ। মনে হচ্ছে মেয়েটাকে আর-ও বেশি উজ্জ্বল লাগছে। এটা বুঝি সুখী হওয়ার চিহ্ন? বিবাহিত মেয়েদের সৌন্দর্য বৃদ্ধির এই একটাই কারণ তারা স্বামী সংসারে সুখী হলে চোখে মুখে আলাদা একটা সুখী ভাব ফুটে ওঠে যেটা এই মূহুর্তে ফুলির চোখে মুখে ফুটে আছে। জুহার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটলো। না চাইতেও মনটা ভালো হলো হালকা। সুখী মানুষ দেখতেও ভালো লাগে।

” কাকী ফিরে আসার পর আপনার সাথে তো আলাপ হলো না।

ডালে ধনিয়াপাতা ছিটিয়ে দিতে দিতে ফুলি মুচকি হেঁসে বললো ” আলাপের সময় আছে গো? দেখলে না কোন ঝঞ্ঝাট নিয়ে ঘরে ফিরলাম।

জুহা আর কিছু বলার মতো পেলো না। চুপটি করে হাতের কাজে তাড়া দিলো। বাড়ির পুরুষ লোক গুলো এখনো না খাওয়া।ঝামেলার চক্করে রান্নারও দেরি হয়ে গিয়েছে।

বাড়িরটা বিশাল বড় হওয়াতে আগে ফারিন যে রুমে থাকতো সেটা এখনো ফাঁকাই আছে। ফারিন আর তাহসিন সেই রুমে বসে ফুসফুস করছে। তাহসিনের চোখ লাল টকটকে। একটু পর পর বসা থেকে ওঠে এদিক সেদিক করে আর সিগারেট এ টান দেয়। ফারিন বিরক্তিতে কপালে হাত দিয়ে বসে আছে। কি বলবে ভেবে না পেয়ে দাঁত খিঁচে বললো ” বিয়ে করেছি ঠিক আছে কিন্তু তুমি এখানে আমাকে কেনো নিয়ে আসলে সেটা আমি এখনো বুঝতে পারলাম না তাহসিন! আমাকে কি একটু বুঝাবা?

” সেটআপ! চুপচাপ বসে থাকো বলে দিলাম।

ফারিন তেড়ে এসে বললো ” হোয়াট? আমাকে ধমকাচ্ছো? তোমার হাতের পুতুল আমি? যে ভাবে খুশি নাচাবে? ভুলে যেও না আমি ফারিন চৌধুরী! গ্রামের আলাভোলা জুহাইরা নই।

তাহসিন প্রচন্ড রেগেমেগে ফারিনের গাল চেপে ধরে চোখ মুখ লাল করে কিছু বলতে নিবে ওমনি দরজায় টুকা পড়লে সেদিকে আঁতকে তাকিয়ে দেখে জুহা দাঁড়িয়ে দরজায়।

গায়ে নীল রঙা শাড়ি, ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি, চোখে মুখে সহজাত আকৃতি একটুও হতাশা নেই। কিন্তু কেনো নেই? ওর মুখের হতাশা বিষাদ অসহায়ত্ব এই সব, সব কিছু দেখতে চায় তাহসিন কিন্তু মেয়েটা এতো হাসি খুশি থাকে কি ভাবে? কষ্ট হয় না ওর? মন নেই নাকি? এই যে কেমন হ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে আছে। তাহসিন আর ফারিনকে এমন অবস্থায় দেখে জুহা ঠোঁটের কোণের হাসি আরেকটু প্রশস্ত করে আয়েশি ভঙ্গিতে বললো ” একি! দেবরজী আমার জায়ের সাথে কি ঝগড়া করছো? এতো মিষ্টি মেয়েটার সাথে ঝগড়া করতে তোমার হৃদয় কাঁপে না!

ফারিনের গালে চেপে রাখা হাতটা তাহসিন দ্রুত সরিয়ে নিতেই ফারিন ছিটকে দূরে চলে গেলো। কিন্তু ফর্সা গাল দুটো লাল টকটকে হয়ে গিয়েছে। মনে হচ্ছে মেয়েটা খুব ব্যথা পেয়েছে তাতে আমার কি? ভেবেই জুহা চোখ উল্টে বললো ” পেটে খিদে থাকলে খেতে আসুন! আর মনে লজ্জা থাকলে আসার দরকার নাই।

তাহসিন প্রচন্ড অবাক হলো! এই মেয়ে এতো চতুর হলো কবে? কি ভাবে? যে মেয়ে তাহসিনকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে ভয়ে হাঁটতে পারতো না। নিচু হতে হতে মাটির সাথে মিশে যাবে যাবে অবস্থা হতো তখন এসব দেখতে তাহসিনের যে কি মজা লাগতো। আর সেই জুহাইরা কি না আজকে চোখে চোখ রেখে কথা বলছে! তাও সহজ কথা নয় খুব কঠোর কথা-ই!

খাওয়া দাওয়া শেষ হলো। সমাবেশ আবারও বসলো। ফারিন তাহসিন সবাই বসে আছে। এবার একটা সমাধান হবে। ফারিনের মাথা ধরেছে। এ বাড়িতে আসার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না তার। কিন্তু তাহসিন কেন এখানে নিয়ে আসলো সেটাই বুঝতে পারছে না। তাহসিনের মনের মধ্যে কি চলে বা চলছে ফারিন সেটা আজ অব্দি বুঝতে পারেনি। তাহলে কি ফারিন ঠকে যাচ্ছে তাহসিনের কাছে? ওর মতলবটা আসলে কি?

ভাবনার মাঝেই ডাক পড়লো ফারিনের। একটু দূর থেকেই তার উদ্দেশ্যে মুজিবুর রহমান বললেন ” বেড়াতে এসেছো নাকি থেকে যাওয়ার জন্য?

” আমার মাথা খারাপ আঙ্কেল? আমি এ বাড়িতে থেকে যাবো মানে! থেকে যাওয়ার হলে কি বের হতাম এখান থেকে।

ফারিনের কথা সবার মনপুত হলেও তাহসিনের হলো না। সে প্রচন্ড রুক্ষ কন্ঠে বললো ” কে কোথায় থাকবে সেটা আমি বুঝবো। সিদ্ধান্ত নেওয়ার তুমি কে?

ফারিন যথেষ্ট অবাক হলো। এই তাহসিনকে তো সে চিনে না। যে ছেলে রাত নেই দিন নেই চব্বিশ ঘণ্টা ফারিনের মন রক্ষা করতে জীবন দিয়ে দিতেও রাজি ছিল আজ সে কি না বলছে সিদ্ধান্ত সে একা নিবে! ফারিনের মাথা ধরে আসলো। কি হচ্ছে না হচ্ছে কোনো কিছুই বুঝতে পারছে না।

রাফসান চুপ করে বসে আছে। তার এই চুপ থাকা ভয়ংকর। কারণ সবার দিকে তাকিয়ে শুধু দেখছে সমাধান আর সিদ্ধান্ত কি হয়! তারপর রাফসান তার যা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো সেটা পূর্ণ করবে আর না হয় সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবে। কিন্তু গার্ডিয়ানরা এখনো কোনো সিদ্ধান্তেই আসতে পারলো না। আসবে কি ভাবে? ছেলে মেয়ে গুলোর মনে কি চলছে সেটাই তো ক্লিয়ার নয়।

শ্যামলা বানু ভাঙা গলায় বললেন ” আইচ্ছা বাড়ির পোলা বাড়ি আইছোছ দুই তিন দিন থাইকা তারপর চলে যা। এতো ঝামেলার কিছু হয় নাই।

রাফসান রাগী লুকে শ্যামলার দিকে তাকাতেই সে একটু ঢোগ গিলে বললো ” সেও তো বাড়িরই পোলা ভাই! থাকুক দুই দিন বউ নিয়া আইছে। বেড়ানি শেষ হইলে যাইবোগা।

রাফসানের চোখ মুখ শক্ত হয়ে আসলো। সে জানতো এইটুকু সমাধানই দিবে সবাই। এটা আজকে নয় শুধু । সেই ছোট কাল থেকে হয়ে আসছে। তাহসিন যখনই গ্রামে বেড়াতে এসে এ বাড়ি ও বাড়ির হাসঁ মুরগী গাছের আম জাম কাঠাল চুরি করা থেকে মেয়েদের বিরক্ত করতো, তারপর বাড়িতে বিচার আসতো। প্রথম প্রথম সবাই এতো ভাব দেখাইতো যে মনে হতো কেটে-কুটে ফেলবে অথচ একটু পরেই বলতো থাক ছোট মানুষ বেড়াতে আসছে একটু এদিক সেদিক করবেই। মেহমানকে কি শাসন করা যায় নাকি! অথচ একই বাড়ির ছেলে ছিল রাফসান নিজেও। যাকে ছোট কাল থেকেই শাসনে রাখা হতো। উনিশ বিশ করলেই তার শান্ত বাবা হয়ে যেতো অশান্ত তারপর বেদম পিটাতো। এমনকি বিয়ের মতো এতো বড় একটা সিদ্ধান্তেও বাবার মুখের ওপর কথা বলার সাহস পায়নি। বাবার এক কথায় তার বন্ধুর মেয়েকে বিয়ে করে ডিভোর্সের তকমা গায়ে লাগিয়েছে।

” আব্বা আপনারও কি একই কথা?

আতিকুর রহমান নড়েচড়ে বসে একটু রয়েসয়ে বললো ” আমরা তো অনৈতিক কিছু করতে পারি না রে। বাড়িতে এসেছে এখন কি তাড়িয়ে দিতে পারি? এতো নির্দয়া তো ছিলাম না কখনো। আসছে যেহেতু মেহমান হয়ে বেড়াক কয়েকদিন তারপর না হয় চলে যাবে।

” আমি জানতাম আব্বা! আমি জানতাম আপনারা কি সিদ্ধান্ত নিবেন। আপনারা বরং থাকেন হৃদয় নিয়ে। খুব বড় হৃদয় তো আপনাদের। আমার শেষ সিদ্ধান্ত এটাই যে মেঝো কাকা কাকী এবং তিন্নি তাহসিন এ বাড়িতে আসতে পারলেও ওই মেয়েকে যেন বাড়ি নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ব্যস! এবার আপনারা যতদিন এই সিদ্ধান্ত মেনে না নিবেন ততদিন আমার জন্য এই বাড়ি নিষিদ্ধ। বেয়াদবি মাফ করবেন আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে বের হয়ে যাচ্ছি। আপনারা চাইলে আবার ফিরবো। আর না চাইলে ফিরবো না।

সবাই অবাক হলো। তাহসিনও নড়েচড়ে বসলো। মনে হচ্ছে সে এমনটা চায় না এতে তার পরিকল্পনা ঠিকঠাক কাজে আসবে না। সে বোধহয় চেয়েছে ওরা সহ সবাই বাড়িতে থেকেই ঝামেলা পাকাতে। তার মানে কি রাফসান তাহসিনের মনের কুবুদ্ধি কোনো ভাবে টের পেয়ে গেলো? আর এ কারনেই চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো? আর যাইহোক রাফসান বোকা তো নয় যে নিজের বাড়ি ছেড়ে দিবে অন্যের জন্য।

কোহিনূর বেগম ছেলের কাছে এসে কড়া স্বরে বললো ” কি শুরু করলি! বউ নিয়ে চলে যাবি খুব সহজে বলে দিলি আমার কথা একবারও তো মনে পড়লো না। যার দিকে তাকিয়ে জীবনের কঠিন মূহুর্ত গুলো কাটিয়ে দিলাম আজ সে আমার কথা মনেও করলো না।

রাফসান কি বলে মা’কে শান্তনা দিবে জানে না। শুধু জানে বাড়িতে থাকা যাবে না। বাড়িতে থাকা মানে ফারিনকে এ বাড়িতে আসা যাওয়ার টিকিট কেটে দেওয়া। আর বাড়ি থেকে চলে গেলে আজ হোক বা কাল ফারিনের আসা যাওয়া চিরতরে নিষিদ্ধ হবে।আর এটা অবশ্যই দরকার, খুব দরকার। সারাজীবন এ মেয়ের সাথে আত্নীয়তার সম্পর্ক রেখে চলাফেরা সম্ভব নয়। মহল্লার মানুষজনও মজা নিবে এতে।

জুহাকে সাথে নিয়ে রাফসান সত্যি সত্যি বের হয়ে গেলো। সাথে দুটো ব্যগ ছাড়া আর কিছু নেই। ব্যাগে কি আছে সেটাও জুহাইরা জানে না। মেয়েটা ছিল কিচেনে। এক ফাঁকে কিচেনে এসেছে ওমনি কি হলো না হলো রাফসান এসে হাত ধরে হনহন করে বেরিয়ে পড়লো। সব যেন মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। কাঁচা মাটির রাস্তায় হাঁটতে হাটঁতে জুহা রাফসানের দিকে তাকিয়ে বললো ” সত্যি সত্যি বাড়ি ছেড়ে দিবেন বুঝতে পারিনি।

রাফসান নিশ্চুপ, ধীর গতিতে জুহার একটা হাত শক্ত করে ধরে হাঁটছে। যেন হাত ছাড়লেই সে পালিয়ে যাবে। কিছু দূর যেতেই জুহা ফের বললো ” বেরিয়ে আসলেন,অথচ বাড়ির কেউই আটকানোর চেষ্টাও করলো না কেনো বুঝতে পারছি না।

” তোমার মাথা ঘিলু নেই।

রাফসানের কথায় ব্রু কুঁচকে আসলো জুহার। এটা কি অপমান নাকি ইয়ার্কি?

” অপমান করে যদি বলে বুঝিয়ে দিতে হয় যে সম্মানিত মহারানী আমি আপনাকে অপমান করেছি দয়া করে অপমান গ্রহণ করুন। তবে এমন অপমান করে অপমানকে অপমান করার কোনো মানে হয় না জুহা।

এতো সিরিয়াস মূহুর্তে এই লোক জুহার সাথে ইর্য়াকি কি ভাবে করছে ভেবে পেলো না মেয়েটা। দুপুরের কড়া রোদ তেজহীন হয়ে সূর্যের এক সোনালী রশ্মি রাফসানের শ্যাম বর্ণ গালে পড়তেই চোখ মুখ লালচে হয়ে আসছে। লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে হাঁটছে জুহা,আর মনে মনে বহু কিছুর হিসাব মিলানোর চেষ্টা করছে। যখনই মনে পড়লো এখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি কোথায় যাচ্ছি আমরা” যেই জিজ্ঞেস করতে যাবে ওমনি রাফসান হাঁটতে হাটঁতেই জুহার হাতে হেঁচকা টানে মৃদু স্বরে বললো ” এতো কি দেখো? লজ্জা লাগে তো! কালাচান জামাইয়ের দিকে এমনে তাকিয়ে থাকো জামাই যদি শাহরুখ খানের মতো চকচকা হতো তাহলে যে কি করতা।

” আমার জামাই-ই আমার শাহরুখ খান।

কথাটা বলেই জুহা লজ্জা পেলো। অতঃপর দুজনেই খিলখিল করে হাসতে লাগলো। এ যেন এক সুখকর মূহুর্ত। জুহা একটা মানুষের হাত ধরে নির্দ্বিধায় হাঁটছে। কোথায় যাচ্ছে জানে না, জানতে চায়ও না। সে বিশ্বাস করে ভরসা করে মানুষটাকে। এই মানুষের সাথে যেকোনো পরিস্থিতি যেকোনো পরিবেশে থাকতে রাজি সে। মানুষটা থাকলেই চলবে। এই মানুষের সাথেই একটা সংসার হোক, টানাপোড়েনের সংসার, যে সংসারে দুঃখ থাকবে। দুঃখ না থাকলে সুখটাকে ঠিকঠাক উপভোগ করা যায় না। তাই দুঃখ থাকা দরকার। সুখ তো অতীত কেবল আর দুঃখ সে তো চীর সঙ্গী।

চলবে………

#অন্তহীন_সন্ধ্যা
#পর্ব ২৬
#মাকামে_মারিয়া

গ্রাম আর শহরের শেষ সীমানায়, এক সরু নদীর ধারে দাঁড়িয়ে আছে লাল-সাদা রঙের এক ছোট্ট ছবির মতো সুন্দর বাড়ি। আশপাশে নির্জনতা, মাঝে মাঝে শুধু পাখির ডাকে নীরবতা ভেঙে যায়। সদ্য বাড়িটিতে পা রেখেছে জুহাইরা আর রাফসান। জুহা বিস্ময়ে ভরা চোখে চারপাশটা ঘুরে ঘুরে দেখছে।দেয়ালের গা বেয়ে ওঠা ফুলের লতা, খোলা জানালা দিয়ে ভেসে আসা নদীর গন্ধ, আর বাতাসে মিশে থাকা এক অদ্ভুত শান্তি যেন তাকে মোহিত করে তুলছে। বাড়িটার মধ্যে কেমন একটা সুখ সুখ গন্ধ।

দুপুরে সবাই খেলেও রাফসান খেতে বসেনি। আর জুহা সে তো আরও আগেই না খাওয়া। এ অবস্থায় তো বাড়ি থেকে বের হয়ে আসছিলো।

নতুন বাড়িটির নাম স্বর্ণলতা। নামের মতোই এক আর্কষনীয় সুখ মহল মনে হচ্ছে। জুহার ভালো লাগছে। কখন এদিক কখনো বা ওদিক ঘুরে ঘুরে দেখছে। মনে হচ্ছে তারা আসবে সেটা কেউ আগে থেকেই জানতো। একদম গুছিয়ে পরিপাটি করে রেখেছে। অবশ্য এতো সুন্দর একটা বাড়ি নোংরা থাকার কথা নয়।

রাফসান কিচেনে টুকটুক করছে। এপাশ ওপাশ করতে করতে জুহাইরা কিচেনে এসে ভারী আশ্চর্য হলো। রান্না ঘর এতো সুন্দর! মেয়েদের আলাদা এক ইমোশন জড়িয়ে থাকে রান্নাঘরে। জানালা দিয়ে তাকালেই বিশাল নদীর সচ্ছ পানি চোখে পড়ে। যতদূর চোখ যায় পানি আর পানি আর মৃদু বাতাস তো আসছে। এই সুন্দর রান্নাঘরে রাফসান কড়াইয়ে তেল গরম করছে। উদ্দেশ্য ডিম ভাজবে। দুপুরে খায়নি পেটের মধ্যে ইদুর দৌড়াচ্ছে যেন। ভাত হতে একটু সময় নিলো।

প্লেটে ভাত ডিম ভাজা নিয়ে জুহার সামনে দিয়ে নিজেও খেতে খেতে বললো ” খেয়ে নেও জুহা! আমার প্রচুর খিদে পেয়েছে না হয় তোমাকে খাইয়ে দিতাম।

জুহাইরার বিস্ময় ভাব তখনও সম্পূর্ণ কাটেনি। ভাতের প্লেট নিজের দিকে টেনে নিয়ে ছোট করে লোকমা তুললো মুখে। মনে কত-শত প্রশ্ন কিন্তু রাফসানের মধ্যে জবাব দেওয়ার তাড়া নেই। আর না আছে কোনো প্রকার বিস্ময় ভাব। তার মানে এই সব কিছু উনি আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছেন।

” বাড়িটা খুব সুন্দর!

রাফসান খাবার খেতেই ব্যস্ত। যেন সে জুহার কথাটা শুনতেই পেলো না। জুহাও আর কথা না বাড়িয়ে খাওয়ায় মনোযোগী হলো। বাড়িতে সবার কি অবস্থা, কি হচ্ছে সেসব ভেবেই অস্থির লাগছে মেয়েটার।

ফারিন আর তাহসিন বেশ হতাশ। মনে হচ্ছে প্ল্যান সব মাটি হয়ে গিয়েছে রাফসান বাড়ি থেকে বের হওয়াতে। কিন্তু এতে কি ওদের লাভ হওয়ার কথা ছিল না? হয়তো না। ফারিন বিরক্তি প্রকাশ করে বললো ” চলো আমরা ঢাকায় চলে যাই।

” তুই যাহ! তোরে আটকায়ছে কে? যা চলে যা।

ফারিন থমকালো। শেষে কি না তাহসিন তুই তোকারি করছে! কিন্তু এটা তো তাহসিন নয়। তার স্বভাব চরিত্র এমন নয়। তার মানে কি তার মধ্যে একাধিক সত্তা কাজ করে? সে একেক সময় একেক রুপ প্রকাশ করে। ফারিনের এবার অসহায়বোধ লাগছে। কান্নাও পাচ্ছে কিছুটা। যার জন্য এতো কিছু করা,সে নিজেই যদি সব শেষে অবহেলা অবজ্ঞা করে তাতে কষ্ট লাগাটা অস্বাভাবিক নয়। ফারিন অস্থির হলো তাহসিনকে জাপ্টে ধরে বিধ্বস্ত অবস্থায় জানতে চাইলো ” তাহসিন তুমি আমাকে ঠকাচ্ছো? তোমার মতলবটা কি আমাকে বলো? আমি জানতে চাই! তুমি কি চাও বলো?

তাহসিন প্রচন্ড ধাক্কায় ফারিনকে দূরে সরিয়ে দেয়। মনে হচ্ছে মেয়েটাকে সে এক মূহুর্তের জন্যও সহ্য করতে পারছে না। কিন্তু কেনো? এমন তো সে ছিল না। রাফসানের সাথে যখন ফারিনের বিয়ে হয় তখন তাহসিন এসেছিলো বিয়েতে। তখনও তার মনে অন্য কিছু ছিল কি না বুঝতে পারা যায়নি কিন্তু ফারিনের বড়ই পছন্দ হলো তাকে। এক দিকে বিয়ে করা হাসবেন্ড অপছন্দ অন্য দিকে তার ভাইকেই পছন্দ হয়ে গেলো যে কারণে ফারিন দ্বিধায় পড়লো কি করবে! তাহসিনের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলো এবং তাহসিন খুব সহজেই তাকে সঙ্গ দিলো মনেই হচ্ছিল এতে তাহসিনেরও মত আছে। কিন্তু কে জানতো এই ছেলের চরিত্রই এমন।

ফারিনের ইগো হার্ড হলো। ভালোবাসার জন্য এতোক্ষণ নরম কোমলতার স্পর্শ দেখালেও এবার ভিষন কঠোরভাবে জিজ্ঞেস করলো ” তুই আমাকে অপমান করছিস আর আমি তোকে সম্মান করে মাথায় তুলে রাখবো সেটা ভাবলে খুব ভুল করেছিস। আমাকে যে যতটা দিবে সে ঠিক ততটাই ফিরে পাবে।

তাহসিন প্রচন্ড শব্দ করে হেসে বললো ” ওহ আচ্ছা তাই নাকি? তোহ রাফসান কি তোকে ভালোবাসে নাই? তাকে তো ভালোবাসার বদলে ভালোবাসা ফেরত দেস নাই। পরপুরুষের জন্য ছটফট করতে করতে সংসার ছেড়ে চলে আসলি আমার ঘাড়ে। এরপরও যে তুই আমাকে ছেড়ে অন্য কোথায় যাবি না তার সিউরিটি কি ডার্লিং? তোদের মতো মেয়েদের সাথে মজা মাস্তি অব্দি-ই ঠিক আছে। সংসার করা সম্ভব নয়।

ফারিন ধাক্কা খেলো। তাহসিনের মনে এসব ছিল! শুধু মাত্র ব্যবহার করলো এতোদিন! কিন্তু কেনো?? শুধুই আমাকে পাওয়ার আশায়? এতো নোংরা মনোভাব তার। ফারিনের ঘৃণা লাগলো, রাগ চড়া দিয়ে ওঠলো দাঁত কিড়মিড় করে বললো ” জানো-য়ার! আমার টাকাগুলো ফেরত দে। তুইও কতো ভালো চরিত্রের ছেলে সেটা আমারও জানা হয়েছে। তোকে আমি সত্যি ভালোবাসছিলাম। সংসারটাও করতাম কিন্তু তোর আদোও কোনো ঘর সংসার হবে না। তুই তো ক্যারেক্টারলেস একটা। আমার টাকাগুলো ফেরত দে। শুধু মাত্র তোর কারণে আমি রাফসানের কাছ থেকে দশ লক্ষ টাকা জোরপূর্বক নিয়েছি। তা না হলে সে আমাকে টাকা দেওয়ার দায় রাখেনি। তুই তাড়াহুড়ো করে আমাকে টাকা সমেত আত্মসাৎ করেছিস।আমাকেও শেষ করলি আমার টাকাও শেষ করলি। আমি যা পাপ করছি এটার শাস্তি তো আমি পেলামই তোকে বিশ্বাস করে। এবার তোর পালা তোর পাপের শাস্তিও তুই খুব তাড়াতাড়ি পাবি।

টাকার ব্যাপার আসতেই তাহসিন একটু চুপসে আসলো। ফারিনের দেনমোহরের দশ লক্ষ টাকা সম্পূর্ণটাই তাহসিন আত্মসাৎ করেছে। ফারিনসহ অন্যান্য মেয়েদের পিছনে ঢেলেছে, নাইট ক্লাব পার্টি, লং ড্রাইভ,শপিং উড়াউড়ি ঘুরাঘুরি করে সে বাবার সম্পত্তির অর্ধ শতাংশ নষ্ট করছে সাথে ফারিন ও তার টাকাও নষ্ট করলো।

ফারিন জানে তাহসিন এক টাকাও ফেরত দিতে পারবে না। চুপটি করে বসে পড়লো খাটে। কপালে হাত ঠেকিয়ে বসে রইলো ভিষন কান্না পাচ্ছে। মাঝে মাঝে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি তুচ্ছ প্রাণী মনে হয় যেটা এই মূহুর্তে ফারিনের লাগছে। খুব করে মনে হচ্ছে আজ মা থাকলে মায়ের বুকে মুখ গুঁজে ইচ্ছে মতো কেঁদে নেওয়া যেতো। মায়ের কাছে সন্তানের ভুল গুলোও তো ফুলের ন্যায়। ফারিনের করা সমস্ত ভুল গুলোও হয়তো তার মায়ের কাছে ফুলের মতোই হতো। সন্তান শত অন্যায় করলেও মায়েরা বকুনি শেষে ঠিকই বুকে টেনে নেয়। ফারিনের ফর্সা গাল বেয়ে টপটপ করে চোখ থেকে পানি পড়তে লাগলো। সেই ছোট থেকে সব সিদ্ধান্ত একা একা নিয়ে এসেছে যে কারণে বিয়ের মতো একটা সিদ্ধান্ত তার বাবা কেন নিলো এটা মানতে পারেনি। নিজের জিদ ইগো ঠিক রাখতে সে রাফসানকে ত্যাগ করলো। এখন মনে হচ্ছে এই জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল এটাই। যেটার কারণে ফারিন নিজের জীবন নিজেই ধ্বংস করলো। যদি পারতো জুহার কাছে একটা বারের জন্য হলেও রাফসানকে চেয়ে নিতো। কিন্তু সেই ইচ্ছে কিংবা সাহস কোনোটাই যে নেই। ফারিন জানে এবং দেখেছে রাফসান কি ভিষন ভালোবাসে জুহাকে। ফারিনের হৃদয় ছিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো এই ভালোবাসা আজ ফারিনের জন্য হতো কিন্তু নিজের পায়ে অতলে পিষে ফেললো সমস্ত ভালোবাসা।

ক্লান্ত মন নিয়ে ফারিন বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো। নিজেকে শক্ত করলো। নিজের সমস্ত ভুল অকপট মেনে নিলো। তাহসিনের সুন্দর মুখটার দিকে আজকে আর তাকাতে মন চাইলো না। এই সুন্দর মুখের আড়ালটা এতো কুৎসিত জানলে বহুরাত এই মুখের মায়ায় লেপ্টে নিজেকে সঁপে দিতো না। আজ ভিষন ভাবে আফসোস হচ্ছে ইশ একটা দিন একটা রাত যদি রাফসানকে তার অধিকার তার হক টা দিতাম। বড্ড অন্যায় করা হয়েছে লোকটার সাথে।

গভীর থেকে গভীর শোক নিয়ে ফারিন তাহসিনের দিকে না তাকিয়েই বললো ” রাফসান আমাকে ভালোবাসতে চেয়েছে এবং আমাকেও তাকে ভালোবাসার সুযোগ দিয়েছে কিন্তু আমি চিরতরে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলাম। এরপর তোমাকে ভালোবেসে ফেলছিলাম। জানো তো ভালোবাসার না কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই যে তোমাকে নিয়মের বেড়াজালে ফেঁসে গিয়ে ভালোবাসতে হবে। ভালোবাসা হয়ে যায়, কোনো এক ভাবে হয়ে যায়। যেটা আমার হয়েছিল তোমার মতো একটা ভুল মানুষের জন্য।
কিন্তু তুমি আমাকে ভালোবাসো নাই! এতে আমার বিন্দু পরিমাণ আফসোস নেই তোমার মতো একটা নোংরা মানুষ আমাকে ভালোবাসে নাই এতে আমার আফসোস থাকারও কথা নয়। আমার আজীবনের আফসোস থাকবে আমি কেনো রাফসানকে ভালোবাসতে পারলাম না।

তুমি টাকা ফেরত দিতে পারবে না সেটা আমি জানি। আর আমিও টাকা ফেরত চাইবো না। আমার টাকাকড়ির অভাব নেই। হয়তো বা এই টাকা-কড়ির মায়ায় তুমি পড়েছিলে। তাও মিথ্যে করে হলেও থেকে যেতে পারতে অভিনয় টা চালিয়ে যেতে।।অন্তত আমার একটা ভুলভাল মানুষ তো থাকতো।

ফারিন বেরিয়ে গেলো। সমস্ত দায় দাবী নিজের কাঁধে নিয়ে গেলো। রুম থেকে বের হতে হতেই কান্নাভেজা কন্ঠে বাবার কাছে ফোন দিয়ে জানালো ” আব্বু আমি আর এখানে থাকতে চাই না। আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করো যতদ্রুত সম্ভব।

ফারিনের বাবা ভিষন খুশি হলো।মেয়েটা এবার নিজের কাছে আসবে। কত করে বুঝিয়েও তাকে আসার জন্য রাজি করানো যায়নি।

ফারিন সরকার বাড়ির দরজার চৌকাঠে পা রেখে একবার পিছন ফিরে তাকালো। কি ভিষন মায়া লাগছে। আজ হঠাৎ এতো মায়া লাগছে কেন?? রাফসানকে ডিভোর্স দিয়ে তাহসিনের উদ্দেশ্যে যখন বের হয়ে গেলো তখনও তো এতো মায়া লাগেনি। এলোমেলো পায়ে একটু ফিরে এগিয়ে আসলো। ড্রয়িং রুম তখন ফাঁকা। একটু আগেই ফারিন সবার কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে জানিয়ে দিয়েছে সে চলে যাচ্ছে একেবারেই।

ফিরে এসে ড্রয়িং এ অসহায়র মতো দাঁড়িয়ে রইলো কিছু সেকেন্ড। মনে পড়লো সেই প্রথম দিনের কথা যেদিন রাফসান তাকে বউ করে এ বাড়িতে পা রাখলো। সেদিন মানুষের মুখে সে কি খুশি, শুধু খুশি হতে পারেনি ফারিন নিজে। সবার আনন্দ গুলো তার কাছে বিষাক্ত মনে হচ্ছিল।

কোহিনূর বেগম রুম থেকে কোনো একটা প্রয়োজনে বের হতেই দেখলো ফারিন এখনো দাঁড়িয়ে। মেয়েটা এখনো যায়নি? কিছু হলো নাকি? কোহিনূর এগিয়ে এসে বিধ্বস্ত ফারিনের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো ” কিছু হয়েছে? কোনো কিছু ফেলে যাচ্ছো নাকি?

ফারিনের কান্নার গতি বেড়ে গেলো। কান্নার সময় কেউ যখন কোনো কিছু জিজ্ঞেস করে তখন কান্নারা আরও বেড়ে যায়। কোহিনূর বেগমকে বলতে ইচ্ছে করছে ” হ্যাঁ আমার সুখ ফেলে যাচ্ছি। কিন্তু বলা হলো না। মাথা নিচু করে চোখের পানি মুছলো বাম হাতের তালুতে। কোহিনূর বেগম দুই সেকেন্ড থেমে থেকে আবারও ডাকলো ” ফারিন?

ফারিনের হৃদয় কেঁপে উঠল। মনে হলো আজ মা থাকলে বোধহয় এ ভাবেই ডাকতো।কি জানি হয়তো! কখনো মায়ের কন্ঠে নিজের নাম শুনেনি তো। নিজের ভুলের জন্য যখন নিজেকে ধরা খেতে হয় তখন বোধহয় আফসোসটা বেশিই হয়। একটা মা পাবে বলেই তো বাবা বিয়ে দিয়েছিলো কিন্তু ফারিনের শয়তানি মন সেটা তখন বুঝতে পারেনি আজ সময় ফুরিয়ে এসেছে আজই বুঝতে পারছে। চোখে মুখে কান্নার ঢেকুর ওঠে গেলো। সব কিছু বাদ দিয়ে ভাঙা গলায় বললো ” আন্টি আপনাকে একটু জড়িয়ে ধরতে পারি?

কোহিনূর বেগম দুইহাতে প্রসারিত করে দিলেন। এই মেয়েটাকে মেয়ে ভেবে ঘরে তু্লেছিলো। একটা মাত্র ছেলের বউ। কখনো বউ হিসেবে ভাবেনি কারণ উনার মেয়ে নেই। ফারিনকে মেয়ের স্থান দিয়েছিলো কিন্তু কি করার! মানুষ সময় থাকতে বুঝে না যে। সেই স্থানও ফাঁকা নেই যে আবারও স্থানটা দিবে। স্থানটা অধিকার করে নিয়েছে জুহা। সমস্তটা নিজের করে নিয়েছে এককানা কড়িও ফাঁকা রাখেনি।

কোহিনূর বেগমের বুকে মুখ গুঁজে ফারিন ইচ্ছে মতো কাঁদল। মনের সকল দুঃখ দূর্দশা হতাশা অসহায়ত্ব সব কিছু কান্নার সাথে ঝেড়ে ফেলে দিলো। কোহিনূর বেগম মুখে কিছু বলেনি কেবল মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়েছেন। ফারিনের অনেক হালকা লাগছে। এ যাবৎ সে বহুদিন কান্না করেছে জীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতিতে পড়ে কিন্তু ঘরকোনায় চুপটি করে কান্না করছে। এই প্রথম কারো সঙ্গ পেয়ে নিজেকে বড়ই হালকা লাগছে। চোখ মুখ মুছে শান্ত কন্ঠে বললো ” আমার জন্য দোয়া করবেন।

” ফি আমানিল্লাহ! যেখানেই থাকো মায়ের দোয়া সন্তানের জন্য থাকেই। ভালো থেকো।

ফারিন চিরতরে বিদায় নিচ্ছে। বড্ড আফসোস নিয়ে এ বাড়ি তাকে ছাড়তে হবে এটা সে স্বপ্নেও ভাবেনি। তাহসিনের জন্যই ভুল করলো এবং তার উছিলায় ভুল ভেঙে গেলো। এ দিক থেকে তাহসিন একটা ধন্যবাদ পাপ্য। ফারিন শেষ বারের মতো বাড়ির দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবলো ” একটা সময় যে মানুষটা আমার চোখের সামনে ঘুরঘুর করতো যেন আমি তাকে একটু সুযোগ দেই নিজেকে সহজ করার জন্য আজ সেই মানুষটাকে শেষ দেখাটাও দেখতে পারলাম না। এটাই বুঝি নিয়তি!

চলবে……