অন্য বসন্ত পর্ব-০২

0
51

#অন্য_বসন্ত ( দ্বিতীয় পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
এরপরের দিনের সকাল একটা নতুন শুরু নিয়ে এলো ওদের জীবনে | কৃষ্ণেন্দুর কাছে এই দিনটা আসলে খুবই ইম্পর্টেন্ট| আগারওয়ালদের কাছ থেকে ওই হলদিয়ার প্রজেক্টটা পেতেই হবে ওকে | তাহলে হয়তো নিজের অনেকদিনের দেখা স্বপ্নগুলোর কাছে আরো একটা স্টেপ এগিয়ে যাবে ও ! এইসব ভেবেই সকাল সকাল উঠে রেডি হয়েছিল সেইদিন | কিন্তু ডাইনিং টেবিলে পৌঁছেই অবাক ! ওর আলো মা জলখাবারে এলাহী ব্যাপার স্যাপার করে ফেলেছে যাকে বলে ! লুচি , আলুর দম , মিষ্টি ! এমনিতেই টেনশনে গলা দিয়ে এক গ্লাস জল অব্দি নামছে না | সেখানে এতো কিছু খাবে কি করে ! এইসবই ভাবছিলো তখনই আলো বলে উঠলো , ———– ” আমি কিন্তু কোনো কথা শুনবো না আজ | অন্তত দুটো লুচি শেষ করেই যেতে হবে ! খাবারটা ঠিকঠাক ভাবে খা, তারপর যত খুশি কাজ কর |”

কৃষ্ণেন্দু কথাটা শুনে একটু জোর দিয়ে বললো এবার , ———- ” তুমি বুঝতে পারছো না ! যতক্ষণ না মিটিংটা কমপ্লিট হচ্ছে ততক্ষণ আমার দ্বারা খাওয়া পসিবল না ! আমি ফিরে এসে যা দেবে তাই খাবো | এখন প্লিজ আমাকে ছেড়ে দাও |”

ওর এক নিঃশ্বাসে বলা কথাগুলো শেষ হতেই এবার দীপ্তি এসে হাজির ডাইনিং টেবিলে রেডি হয়ে | তবে এই মুহূর্তে এই মেয়েটাও একটা অন্য কথা বলে উঠলো , ——— ” ঠিকই তো বলেছে কৃষ্ণেন্দু | টেনশন হলে , কাজের চাপ থাকলে কেউ কি খেতে পারে ! তাই আমি ঠিক করেছি , আমিও আজ খাবো না |”

ব্যাস, এই কথার পর সব তর্ক শেষ | কৃষ্ণেন্দু ঠিক কোন ওষুধে অস্ত্র ত্যাগ করবে এটা দীপ্তির ভীষণ ভালোভাবে জানা | আর এই বারও ব্যাপারটা মিলে গেলো কেমন | কৃষ্ণেন্দু আর কোনো তর্ক বিতর্কে না জড়িয়ে নিজের খাবার থালাটা এগিয়ে নিয়ে দীপ্তির দিকে এক পলক তাকিয়ে বলে উঠলো , ———– ” চুপচাপ বোস , আর খেয়ে নে |”

না , দীপ্তিও এরপর আর না করেনি | হাই কম্যান্ড এর অর্ডার ! পালন তো করতেই হবে |

কিন্তু যাইহোক , জলখাবার পর্ব মিটে যাওয়ার পর অবশেষে ওরা যখন রওনা দেবে তখনই হঠাৎ দীপ্তি দরজার সামনে এসে থমকে গেলো | কৃষ্ণেন্দু দৃশ্যটা দেখে এবার বেশ অধৈর্য্য হয়েই বললো ,

———– ” কি রে ! কি হলো আবার ? তাড়াতাড়ি চল ! দেরি হয়ে যাচ্ছে তো !”

দীপ্তি কথাটা শুনে এখন বেশ জোর দিয়ে বললো , ——— ” ইম্পসিবল | তুমি তোমার জুতোর অবস্থাটা দেখেছো ? এরকম ধুলো লাগা জুতো পরে কেউ একটা কর্পোরেট সেক্টারের মিটিং এটেন্ড করতে যায় ! ওরা দেখে কি ভাববে ?”

কৃষ্ণেন্দু এবার কিছু না ভেবেই উত্তর দিলো , ———– ” যা ভাবার ভাববে | এখন আর কিছু করার নেই | রাস্তায় বেরিয়ে নতুন জুতো কিনে মিটিং এটেন্ড করতে যাবো না কি ! তাহলে আজকে প্রজেক্টের আশা ছেড়ে দিতে হবে |”

দীপ্তি কথাটা শুনে আর কোনো কথা না বাড়িয়ে কৃষ্ণেন্দুর চোখের পলকে একটা কাজ করতে শুরু করে দিলো ! জুতোর শো কেস থেকে কালী আর ব্রাশটা বার করে সোজা কৃষ্ণেন্দুর জুতোটা হাতে নিয়ে পালিশ করতে স্টার্ট করলো | কৃষ্ণেন্দু এবার বেশ চেঁচিয়েই বললো , ———— ” এই থাম তুই ! কি করছিস ? আমার জুতোতে হাত দিচ্ছিস কেন ? রাখ বলছি | প্লিজ দীপ্তি | একদিন একটু নোংরা জুতো পড়ে গেলে কিছু হবে না | প্লিজ তুই এইসব করিস না !”

কিন্তু কে শোনে কার কথা ! দীপ্তি ওর এতো কথার উত্তরে হাসি মুখে অন্য কথাই বলে উঠলো এবার , ———- ” আরে , একটা জুতো পালিশ করছি এতে এতো হাইপার হওয়ার কি আছে ! স্কুল লাইফে এরকম অনেক করেছি | দু মিনিট টাইম দাও | তোমার জুতো পুরো নতুনের মতন করে দেব |”

না , কৃষ্ণেন্দুর অনেক বারণ সত্ত্বেও দীপ্তি এরপর নিজের কাজ একেবারে থামায়নি | জুতো দুটোকে চকচকে করে তবেই ও ছেড়েছে | কিভাবে পারে এই মেয়েটা কে জানে ! এতো সহজে এতো কিছু করে দিতে ! তবে এই মুহূর্তে কৃষ্ণেন্দুর মুখটা সত্যি অন্ধকার হয়ে গেছে | যে এতো মন থেকে ভাবে ওর জন্য তাকে যে কি বলবে অবশেষে ! কি ফেরত দেবে এই মেয়েটাকে ! কিছুতেই ভেবে পায় না কখনো | তবে দীপ্তি ওর এই নিস্পলক দৃষ্টির মাঝেই বলে উঠলো হঠাৎ , ———-

” কি হলো ? কি গভীর ভাবনায় ডুবে গেলে আবার ? এখন দেরি হচ্ছে না ! চলো |”

না , কৃষ্ণেন্দু এরপরও ঠিক সাজিয়ে কোনো উত্তর দিতে পারেনি ওকে | কি ভাবনায় ডুবে আছে এটা বলতে পারেনি আজও | তাই আলতো হেসে আস্তে গলায় বললো , ——–

” নিশ্চয়ই , চলুন ম্যাডাম | আপনাকে অনুসরণ করে আমি যাবো |”

সেদিন এরপর ঠিক এগারোটার মধ্যেই কৃষ্ণেন্দু আর দীপ্তি পৌঁছেছিল আগারওয়ালদের অফিসে | আধঘন্টা রিসেপশনে অপেক্ষা করার পর প্রজেক্ট ম্যানেজার ডেকে নিয়েছিল ওদের | এই সময়টা কৃষ্ণেন্দুর একটু টেনশন হচ্ছিলো না চাইতেও | এসি বন্ধ ঘরেও বিন্দু বিন্দু ঘাম এসে জড়ো হচ্ছিলো কপালে | দীপ্তি আনমনে খেয়াল করেছিল ব্যাপারটা , তাই প্রজেক্ট রিপোর্টটা এক্সপ্লেন করার পর শক্ত করে হাতটা ধরে রেখেছিলো ওর | তবে এই সময় প্রজেক্ট ম্যানেজার ওদের টেনশনটাকে কিছুটা কমিয়েই বলে উঠলো ,

——- ” দেখুন মিস্টার কৃষ্ণেন্দু , আপনাদের কাজ খুবই ভালো | যেই দু হাজার শার্টের অর্ডার আপনারা নিয়েছিলেন, তার কোয়ালিটিও ভীষণ স্যাটিসফাইং | কোম্পানি আপনাদের কাজে খুব ইম্প্রেজড | আর আমিও | আমি আপনাদের সেন টেক্সটাইলকে হলদিয়ার দশ হাজার শার্টের অর্ডারটা দিতেই পারি !”

কথাটা শুনেই এবার কৃষ্ণেন্দু আর দীপ্তির মুখে হাসি | যাক , এতো পরিশ্রম তাহলে স্বার্থক | যা চেয়েছিলো সেটাই তাহলে পাচ্ছে ওরা | এসবই ভাবছিলো , কিন্তু প্রজেক্ট ম্যানেজার অলোকেশবাবুর আরেকটা কথায় মুহূর্তের মধ্যে ওদের হাসিটা যেন মিলিয়ে গেলো কেমন ! অলোকেশবাবু একটু হিসাব করেই এবার ওদের বললো হঠাৎ ,

———- ” কিন্তু একটা কথা বলুন তো মিস্টার কৃষ্ণেন্দু , এই অর্ডারটা আপনাদের দিলে আমার লাভ কি ?”

কৃষ্ণেন্দু প্রশ্নটা শুনে ঠিক মানে খুঁজে পেলো না ! এসব লোকটা কি বলছে আবার ! এইসব ভাবনার ভিড়েই অলোকেশবাবু বলে উঠলেন একটু পরিষ্কারভাবে ,

———— ” আপনারা এতো সহজ মানেটা বুঝতে পারছেন না ! আসলে কি বলুন তো , এই ফিল্ডে কাজ দেখিয়ে সব কিছু হয় না | অন্য কিছুও ম্যাটার করে | আপনি আমাকে এক লাখ দিলেই হবে | আর আপনাকে কম লাভ রেখে কিছু করতে বলছি না | কাপড়ের কোয়ালিটি একটু লো হলেও তো কোনো ব্যাপার না ! খুব সহজ হিসাব |”

কথাগুলো শুনে কৃষ্ণেন্দুর মুখটা এবার অন্ধকার হয়ে গেলো | কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে এবার ও বেশ দৃঢ় গলায় উত্তর দিলো ,

——— ” দেখুন , আমি ওপরে উঠতে চাই | তবে সেটা নিচে নেমে না | থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ ..”

কথাটা শেষ করেই আর অলোকেশবাবুকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ও দীপ্তিকে নিয়ে বেড়িয়ে এলো অফিসটা থেকে | রাগে এখন মুখটা লাল হয়ে গেছে ওর | তবে দীপ্তি এই মুহূর্তে কেমন অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছেলেটার দিকে | ওর কৃষ্ণেন্দুকে এতটা ভালোবাসার কারণ হয়তো এটাই ! হাজার ভিড়েও মধ্যেও সব থেকে আলাদা একটা মানুষ কৃষ্ণেন্দু তাই | কত সহজে ও ঠিক আর ভুলের মধ্যে তফাৎ করতে জানে ! রাতের পর রাত জেগে কাজ করেছিল ছেলেটা এই নেক্সট প্রজেক্টা পাওয়ার আশায় ! কিন্তু এক মুহূর্তেই সবটা ছেড়ে দিলো , শুধু ঠিকটার সঙ্গে থাকবে বলে | এইসবই ভাবছিলো গাড়িতে বসেও আনমনে | পার্কিং এরিয়াতে এসেও চুপচাপ বসে আছে ছেলেটা ড্রাইভিং সিটে | কিছুতেই গাড়িটা স্টার্ট দিচ্ছে না | দীপ্তি বুঝতে পারছে কতটা খারাপ লাগছে এখন ওর ! তবে বেশিক্ষণ তো এইভাবে একজনকে খারাপ থাকতে দেয়া যায় না ! তাই দীপ্তি একটু ভেবে মুডটাকে হালকা করার জন্য বলে উঠলো ,

———– ” সত্যি ! আজকে যে কার মুখ দেখে সকালে উঠেছিলাম ! নইলে অলোকেশবাবুর মতন একজনের সঙ্গে দেখা হয় | আস্ত একটা হনুমান লোকটা |”

কথাটা শুনে কৃষ্ণেন্দুর মুখে এবার হালকা হাসি | ও দীপ্তির দিকে এক পলক তাকিয়ে বললো , ——– ” সকালে উঠে রোজ তুই আমার আর নিজের মায়ের মুখটাই দেখিস ! এর সঙ্গে অলোকেশবাবুর হনুমান হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই |”

দীপ্তিও এবার হেসে ফেললো আলতো | তারপর একটু ভেবে বলে উঠলো , ——– ” যাক , অনেকক্ষণ বাদে একজন অল্প একটু হেসেছে ! চারিদিকের পরিবেশটা নইলে কেমন লেভেলের গম্ভীর হয়েছিল | আমি তো ভাবলাম তুমি এইরকম অ্যাংরি ইয়ংম্যান হয়েই আজকের দিনটা কাটিয়ে দেবে | কোনো কথাই বলবে না আর |”

না , কথাগুলো শুনে এবার কৃষ্ণেন্দু একটু বেশিই ভালোভাবে হেসে উঠলো | ও সিরিয়াস হয়ে গেলে দীপ্তি যে সেটা বেশিক্ষণ নিতে পারে না , এটা কৃষ্ণেন্দু ভীষণ ভালো করে জানে | তবে এই মুহূর্তে দীপ্তি হঠাৎ শক্ত করে কৃষ্ণেন্দুর হাতটা ধরে ফেললো আবার | তারপর বেশ দৃঢ় গলায় বললো , ——– ” একদম মন খারাপ করবে না | এরকম অনেক প্রজেক্ট আসবে | আর আজকে যেটা করেছো , একদম ঠিক কাজ করেছো | এইভাবে টাকা খাইয়ে , ঘুষ দিয়ে ওপরে ওঠার কোনো মানেই হয় না !”

কৃষ্ণেন্দুর এই সময় যেন খুব দরকার ছিল এই কথাগুলোর ! ও যে ঠিক , এটা আরেকজনের কাছ থেকে শোনার খুব দরকার ছিল | কারণ এই অর্ডারটা ছাড়ার ডিসিশনটা আসলে খুব বড়ো | ওদের কোম্পানি আবার সেই পুরোনো জায়গায় আটকে গেলো আজ | কিন্তু এই মুহূর্তে আর সেটা ভেবে খারাপ লাগছে না | বরং মনে একটা শান্তি হচ্ছে | একটা ঠিক কাজ করার শান্তি | এইসব ভেবেই সেদিন গাড়িটা স্টার্ট দিতে যাচ্ছিলো , তবে হঠাৎ পেছন থেকে খুব জোর একটা ধাক্কা লাগলো যেন ওদের গাড়িতে | গাড়ির পেছনের হেডলাইটটা ভাঙার স্পষ্ট আওয়াজ শুনতে পেলো ওরা ভেতরে বসে | গেলো ! আজ সব গেলো ! কৃষ্ণেন্দু কথাটা মনে মনে ভেবেই গাড়ির দরজা খুলে সঙ্গে সঙ্গে বাইরে বেড়িয়ে এলো , তবে পা টা থমকে গেলো হঠাৎ খুব চেনা একজনকে সামনে দেখে ! তৃষা ! ও এখানে কি করছে !

কৃষ্ণেন্দুর বাবার খুব পুরোনো একজন বিজনেস পার্টনারের মেয়ে তৃষা | স্কুল লাইফে অনেক কথা হতো এই মেয়েটার সাথে ওর | তারপর এম.বি.এ পড়ার সময়ও দেখা হয়েছিল | ওর থেকে এক বছরের জুনিয়র ছিল তৃষা | যাইহোক , সেই কলেজ লাইফের পর আজ দেখা | কিন্তু এইভাবে ! এইসব কথাগুলোই আনমনে ভাবতে ভাবতে এগিয়ে গেলো ও | ততক্ষনে তৃষাও নিজের কিছু কথা সাজিয়ে একটু ইতঃস্তত হয়ে বলে উঠেছে , ————- ” আই এম রিয়ালি সরি কৃষ্ণেন্দু , রিয়ালি সরি … আসলে নতুন নতুন ড্রাইভিং শিখেছি | তার জন্যই গাড়িটা পার্ক করার সময় কন্ট্রোল করতে পারিনি ঠিক ! আমি তোমার গাড়ির যে ড্যামেজ হয়েছে সব টাকা দিয়ে দেব | প্লিজ কিছু মাইন্ড কোরো না |”

কৃষ্ণেন্দু এর উত্তরে কি আর বলবে বুঝতে পারলো না ! চেনা কারোর কাছ থেকে এইভাবে টাকা নেয়া যায় না কি ! এইসবই ভেবে উত্তর দিলো ,

———- ” না না , ইট’স ওকে ….. তুমি তো ইচ্ছে করে করোনি | কিছু লাগবে না | এনিওয়েজ , কেমন আছো তুমি ? অনেকদিন পর দেখা !”

এই মুহূর্তে দীপ্তিও ওদের কথার মাঝে এসে হাজির | কৃষ্ণেন্দুর এক্সপ্রেশনটা দেখে ও বুঝতে পারছে মেয়েটা চেনা | তাই নিজেও আর কোনো রিয়্যাক্ট করলো না | সেই সময়েই তৃষা বলে উঠলো ,

———- ” আমি ভালো আছি | তুমি কেমন আছো ? আর এই অফিসে কি করছো ?”

প্রশ্নটা শুনে কৃষ্ণেন্দু এবার দু সেকেন্ড থমকে গেলো | তারপর একটু কথা সাজিয়ে বললো , ——— ” এসেছিলাম একটা অর্ডারের আশায় | কিন্তু আর হবে না | এই অফিসে ভালো কাজ ছাড়াও অর্ডার পেতে গেলে অন্য অনেক কিছু লাগে ! যাইহোক , ছাড়ো | আসছি আমরা |”

কথাটা শেষ করেই কৃষ্ণেন্দু এবার দীপ্তির দিকে তাকিয়ে চোখের ঈশারা করলো গাড়িতে উঠে বসার জন্য | কিন্তু তৃষা এর মধ্যেই আরেকটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে উঠলো ,

———— ” আচ্ছা কি হয়েছে আমি কি জানতে পারি ? এটা আসলে আমার বাবার বন্ধুর কোম্পানি …আগারওয়াল আংকেলকে আমি পার্সোনালি খুব ভালোভাবে চিনি | তোমার কি প্রব্লেম হয়েছে এটা আমাকে বলতে পারো | আই ক্যান হেল্প ..”

তৃষার এতগুলো কথা শুনেও এখন কৃষ্ণেন্দু চুপ ছিল | আসলে নিজের অসুবিধা প্রব্লেমের কথা নিজে থেকে এইভাবে বলতে পারে না ও | তবে দীপ্তি আর এক সেকেন্ডও সময় নষ্ট না করে বলে উঠলো , ———— ” হ্যালো ম্যাম , আমি দীপ্তি | কৃষ্ণেন্দুদের কোম্পানিতেই আছি | আসলে প্রব্লেমটা হচ্ছে এখানকার প্রজেক্ট ম্যানেজার | উনি আমাদের আগের অর্ডারের কাজে স্যাটিসফায়েড , কিন্তু তা ও নতুন অর্ডার দিতে চাইছেন না | মানে এক লাখ টাকা উনি ডিম্যান্ড করেছেন , নতুন এই অর্ডারটা পাইয়ে দেয়ার জন্য | যেটা আমাদের পক্ষে দেয়া পসিবল না |”

দীপ্তির কথাগুলো শুনে তৃষা এবার একটু ভেবে বলে উঠলো , ———— ” ওকে , আমি নিজে এই ব্যাপারে কথা বলবো আগারওয়াল আঙ্কেলের সঙ্গে | তোমরা আরেকবার আমার সঙ্গে এস | আমি ডিরেক্ট দেখা করিয়ে দেব ওনার সঙ্গে |”

তৃষার কথাগুলো শেষ হতে এই মুহূর্তে কৃষ্ণেন্দু আর দীপ্তির মুখে হাসি | কৃষ্ণেন্দু যেন আবার একটু আশা করতে শুরু করলো | তাহলে কি অর্ডারটা পাবে ওরা ! প্রশ্নটা যেন আবার মনের মধ্যে এসে জমা হলো |

না, এরপর আর সেইদিন খালি হাতে ফিরতে হয়নি ওদের | তৃষা ডিরেক্ট মিস্টার আগারওয়ালের সাথে ওদের মিট করিয়ে দিয়েছিলো | ওদের আগের প্রজেক্টটার রিপোর্ট দেখে উনি সঙ্গে সঙ্গেই হলদিয়ার ফ্যাক্টারীর দশ হাজার শার্টের অর্ডারটা ‘সেন টেক্সটাইল’ কে এপ্রুভ করে দিলেন | কৃষ্ণেন্দু তো সেইদিন অফিস থেকে বেরিয়ে আনন্দে তৃষাকে কি করে থ্যাঙ্ক ইউ বলবে বুঝতেই পারছিলো না ! এতো সহজে এই মেয়েটার জন্য কাজটা হয়ে গেলো ওদের ! কথাটা ভেবেই বলেছিলো ও হাসি মুখে , ———- ” সিরিয়াসলি .. তুমি না থাকলে আজকে এই অর্ডারটা পেতাম না আমরা | সব ক্রেডিট তোমার | আমি জানি না কি করে থাঙ্কস দেব তোমাকে ! সত্যি !”

তৃষা কথাটা শুনেই এবার বলে উঠেছিল , ———- ” একটা ডিনার ট্রিট দিয়ে | খুব সহজ |”

কৃষ্ণেন্দু এর উত্তরে সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠলো , ———— ” হ্যাঁ নিশ্চয়ই | যেখানে তুমি বলবে | এনিটাইম … ”

তৃষা এবার আলতো হেসে বললো , ———- ” কাল রাত আটটা | রেস্টুরেন্টটা রাস্তায় যেতে যেতে ঠিক করবো | কিন্তু এটা কোনো অফিশিয়াল ডিনার না | একটা ফ্রেন্ডলি ডিনার | তাই অনলি তুমি আর আমি যাবো | আই হোপ তাতে কোনো প্রব্লেম নেই |”

কৃষ্ণেন্দু কথাটা শুনে দু সেকেন্ড ভেবে বললো , ———- ” না না | প্রব্লেমের কি আছে ! আমরা দুজনই যাবো |”

কথাটা শেষ করেই এবার ওরা এগিয়ে গিয়েছিলো | তবে দীপ্তি সেইদিন এই অর্ডারটা পাওয়ার জন্য ভীষণ খুশি হলেও মনে মনে অদ্ভুত একটা খারাপ লাগা এসে জমছিল যেন ! ওই মেয়েটার চোখে কি কৃষ্ণেন্দুর জন্য অন্য কিছু দেখলো ও ! অদ্ভুত একটা ভালো লাগা ! সেই জন্যই কি নিজে থেকে ওদের হেল্প করলো ! আর হঠাৎ ডিনারে যাওয়ার কথা কেন বললো ! কৃষ্ণেন্দুর সাথে তার মানে আলাদা করে সময় কাটাতে চায় ও | আর আজ কৃষ্ণেন্দুর চোখেও তো কেমন একটা ভালো লাগা ছিল মেয়েটার জন্য | এইভাবে নইলে এক কথায় কেউ কি ডিনারে যেতে রাজি হয় ! এইসবই ভাবছিলো আনমনে গাড়িতে বসে চুপচাপ | সারা রাস্তা জুড়েই যেন কেমন হারিয়ে ছিল দীপ্তি নিজের মধ্যে | কৃষ্ণেন্দু কিছুক্ষণ বাদেই যেন ব্যাপারটা খেয়াল করলো | এইভাবে তো এই মেয়েটা চুপ থাকার কথা নয় ! কি হলো হঠাৎ ! এইসব ভেবেই ও ভিড় রাস্তায় গাড়ি চালাতে চালাতেই জিজ্ঞেস করলো ওকে ,

———— ” কি হয়েছে তোর ? এই অর্ডারটা পেয়ে খুশি না বলে মনে হচ্ছে ? না কি অন্য কোনো ব্যাপারে খারাপ লেগেছে ?”

দীপ্তি আচমকা এরকম প্রশ্ন শুনে ঠিক কি বলবে ভেবে পেলো না ! তাই একটু জোর করে হাসার চেষ্টা করে উত্তর দিলো ,

————— ” না তো | খুশি কেন হবো না ! ভীষণ ভালো লাগছে অর্ডারটা আমরা পেয়েছি তাই |”

কৃষ্ণেন্দু দীপ্তির উত্তরটা শুনেও ঠিক যেন কনভেন্সড না হয়ে বলে উঠলো , ——— ” না ! কিছু তো একটা নিয়ে ভাবছিস তুই ! নইলে এতো চুপ করে কখনো থাকিস না | কি হয়েছে ? আচ্ছা আমি কি তৃষাকে নিয়ে কাল ডিনারে যাবো এটা ভেবে খারাপ লাগছে তোর ? আরে ! তুই কি ভাবলি , ওকে ট্রিট দেব , আর তোকে দেব না ! হ্যাঁ , কাল যেহেতু অনলি আমাকে যেতে বলেছে ওর সঙ্গে , তাই কাল হয়তো পসিবল হবে না | কিন্তু পরশু বা এই উইকে অন্য যে কোনো দিন তুই, আলো মা , আর আমি যাবো একসঙ্গে রেস্টুরেন্টে , খেতে | এবার তো হাস |”

কথাটা শুনে দীপ্তি এই মুহূর্তে আরেকবার একটু জোর করে হাসলো কৃষ্ণেন্দুর সামনে | কিন্তু তা ও মন থেকে যেন হাসিটা এলো না ওর ! বরং একটা প্রশ্ন এসে উঁকি দিলো মনে , কৃষ্ণেন্দু কি এটা ভাবতে পারে না যে ওর সঙ্গে আলাদা করেও সময় কাটানো যায় ! একান্তে কিছু মুহূর্ত ভাগ করে নেয়া যায় ! না কি এইভাবে দীপ্তির জন্য ভাবা যায় না কখনো ! না চাইতেও ভাবনাগুলো এসে জড়ো হলো মনে |

তবে পরের দিন বেশ রাত করেই বাড়ি ফিরেছিল কৃষ্ণেন্দু ডিনার শেষ করে | রাত এগারোটা বেজে গেছিলো ওর | এর মাঝে দীপ্তি দুবার ফোন করেছিল ওকে | কিন্তু সেটা রিং হয়ে হয়েই থেমে গেছিলো | ওপার থেকে নিঃস্তব্ধতা ছাড়া আর কিছুই ফেরত পায়নি দীপ্তি | তবে সেই নিঃস্তব্ধতা ভেঙে হঠাৎ যে এতো হাসিখুশি হয়ে কৃষ্ণেন্দু ফিরবে এরপর , সেটা দীপ্তি ভাবেনি যদিও | সেদিন দরজা খুলে একটু অবাকই হয়ে গিয়েছিলো তাই | তবে কৃষ্ণেন্দু ওকে আরো অবাক করে দিয়ে এবার বলে উঠলো ,

—————- ” জানিস কি হয়েছে ? ভাবতে পারবি না জাস্ট ! তৃষা আমাকে ওর বাবার সাথে আলাপ করাতে নিয়ে গিয়েছিলো ডিনারের পর | অরিন্দম কাকুকে আমি ছোটবেলায় চিনতাম | তবে তারপর আর একদমই যোগাযোগ ছিল না | যাইহোক , উনি কি বললেন জানিস ? উনি আমাদের কোম্পানির একজন ইনভেস্টর হতে চান | আমি ভাবতে পারছি না এখনো ! ঠিক এই রকমই একটা অপর্চুনিটির অপেক্ষা করছিলাম !এতদিন ধরে ! তৃষা আমাকে এতো বড়ো একটা সারপ্রাইজ দেবে আজ, সিরিয়াসলি এক্সপেক্ট করিনি | ”

কথাটা বলেই ও হাসি মুখে জড়িয়ে ধরলো দীপ্তিকে | তবে দীপ্তি এই সময়ে কেমন নির্বাক হয়েছিল | কৃষ্ণেন্দুর জন্য আনন্দ হচ্ছিলো খুব মনে | তবে কেন জানে না , অদ্ভুত একটা কষ্ট এসে জমা হচ্ছিলো ভেতরে | এতো বড়ো একজন ইনভেস্টর আসলে কোম্পানিতে সব কিছু আগের মতন থাকবে তো ! এতদিন যেই কাজের জায়গাটাকে নিজের করে ভাবতো ও , সেই জায়গাটা ওর নিজের থাকবে তো ! এতো নতুন লোকের ভিড়ে পুরোনো মানুষগুলো , পুরোনো সময়টা হারিয়ে যাবে না তো !প্রশ্নগুলো না চাইতেও এসে ভিড় করছিলো আনমনে |
চলবে।