অন্য বসন্ত পর্ব-০৪

0
45

#অন্য_বসন্ত ( চতুর্থ পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
( দ্বিতীয় অধ্যায় )
এরপরের কয়েকটা দিন কেমন স্বপ্নের মতন ছিল যেন | অদ্ভুত একটা ভালো লাগা ছড়িয়ে ছিল চারিদিকে | কৃষ্ণেন্দু আর কিছুদিন বাদে দীপ্তিকে বিয়ে করবে | কথাটা ও নিজে গিয়ে আলোকে জানিয়েছে | এর মধ্যে নতুন বাড়িতে শিফ্ট করারও ব্যাপার ছিল | তাই সব মিলিয়ে দিনগুলো খুব সুন্দরভাবে এগোচ্ছিল ওদের | তবে এর মধ্যে কৃষ্ণেন্দু আর দীপ্তির রিলেশনে যাওয়ার খবরটা যখন তৃষা জানতে পেরেছিলো কৃষ্ণেন্দুর কাছ থেকে , তখন ওর মুখটা আচমকা যেন কেমন অন্ধকার হয়ে গিয়েছিলো | দিপ্তিও সেই সময় কৃষ্ণেন্দুর সঙ্গেই ছিল | খেয়াল করেছিল ব্যাপারটা | অদ্ভুত একটা রাগ যেন তৃষার মুখে এসে জড়ো হচ্ছিলো | তবে দীপ্তি এর কারণটা বুঝেও কিছু বলেনি আর | তৃষা যে কৃষ্ণেন্দুকে অন্য চোখে দেখে সেটা কৃষ্ণেন্দু না বুঝুক , দীপ্তি সেই প্রথম দিন থেকেই বুঝেছে | ওর তাকানো , ওর কথাবার্তা , ওর একটু একটু করে কৃষ্ণেন্দুর জীবনে আসার চেষ্টা দীপ্তি খুব ভালো করেই খেয়াল করেছিল শুরু থেকে | কিন্তু এই নিয়ে আলাদা করে ওর কাউকে কিছু বলার নেই | আর তৃষার বাবা যেইভাবে কৃষ্ণেন্দুর বিজনেসে ইনভেস্ট করেছে , সেখানে আরোও কিছু বলার নেই | এখন যদি কৃষ্ণেন্দু এই বিজনেস রিলেশনটা ভেঙে দেয় তাহলে ওর সত্যি অনেক বড়ো ক্ষতি হয়ে যাবে | দীপ্তি সেটা কখনোই চায় না | আর তৃষা আর ওদের কি এমন প্রব্লেম করবে ! তৃষা তো শুরুতেই এই অফিসে এসে চেষ্টা করেছিল , দীপ্তিকে একটা ছোট্ট ডেস্ক দেখিয়ে নিজের জায়গাটা বুঝিয়ে দেয়ার ! কিন্তু পারলো কি ! কৃষ্ণেন্দুর মনে যেই জায়গাটা ওর জন্য আছে সেটাকে বদলাতে ! আসলে এইভাবে হয় না | দীপ্তি জানে | যার মনে যে যতটুকু আছে , সে সেখানেই সযত্নে থাকবে , যদি সেই মানুষটা চায় তো | আর কেউ এইভাবে তার সেই জায়গাটা নষ্ট করে দিতে পারে না | কারোর মন থেকে কাউকে মুছে দেয়া অতো সহজ না | যাইহোক , এই ভাবনাগুলোকে মনে নিয়েই দীপ্তি কৃষ্ণেন্দু কোনোদিনই তৃষার ব্যাপারে ও কি ভাবে সেটা বলতে যায়নি | এর মধ্যে একদিন কৃষ্ণেন্দুর নতুন বাড়িতে গৃহপ্রবেশ হয়ে গেলো | যদিও দীপ্তির এই নতুন বাড়িটা প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশিই বড়ো লাগছিলো ! আসলে ছোটবেলা থেকে ওই ছোট্ট একতলা বাড়িতে থাকতে থাকতে অদ্ভুত একটা অভ্যাস তৈরী হয়ে গেছে নিজের | এই বিশাল বড়ো চোখ ধাঁধানো সুন্দর বাড়িটাকে দেখে তাই মাঝে মাঝে মনে হয় আজকাল , এইরকম ঠিকানা কি ও সত্যি চেয়েছিলো ! ও কি চেয়েছিলো কোনো অসাধারণ কিছু ! বরং ও তো সব সময় সাধারণের ভিড়েই থাকতে চেয়েছিলো | এই সব পেয়েছির দেশের কথা তো দীপ্তি ভাবেনি কখনো | ওর চাওয়া পাওয়ার লিস্টটা প্রথম থেকেই খুব ছোট | কিন্তু কৃষ্ণেন্দুর হাসি মুখটা দেখে ও কখনো নিজের কথাগুলো বলেনি আর| এই রকম একটা হাই প্রোফাইল লাইফস্টাইল কৃষ্ণেন্দুর চাওয়া | আর দীপ্তি তো ভালোবাসে কৃষ্ণেন্দুকে | তাই ওর চাওয়াগুলোর মধ্যে খুঁজে নেয়ার চেষ্টা করে নিজের ভালো লাগাগুলোকে |

কিন্তু এইসবের ভিড়ে আস্তে আস্তে আবার তালটা কাটতে শুরু করলো জীবনের | কৃষ্ণেন্দু আজকাল যেন একটু বেশি হিসাবি হয়ে যাচ্ছে | ওর মুখে ব্যবসা , ইনভেসমেন্ট , লাভ ক্ষতির হিসেব ছাড়া আর কোনো কথাই নেই ! আগের পুরোনো ছেলেটা যেন হারিয়ে যাচ্ছে কোথায় ! এই ছেলেটা তো সব সময়ই যেন রেস্ করছে সবার সাথে | ব্যবসাটা কেমন একটা নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে ওর | দীপ্তির এই নতুন কৃষ্ণেন্দুকে মাঝে মাঝে খুব অচেনা লাগে যেন | মনে হয় আগের ছেলেটাও কাজ পাগল ছিল , এম্বিশাস ছিল , কিন্তু জীবনে মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়াতেও জানতো | একটা ফোন কল পেলে সব কাজ ছেড়ে ছুটে আসতে জানতো | কিন্তু এই কৃষ্ণেন্দু আর থমকায় না | নিজের সময় নিয়ে ও এখন ভীষণ সচেতন | এই কথাটা দীপ্তি সেইদিন খুব বেশি ভালোভাবে বুঝলো একটা ঘটনার পর | ঘড়িতে সেইদিন বিকেল পাঁচটা বেজে গেছিলো | দীপ্তির তবে কাজের একটু চাপ ছিল , কিছু ড্রাফট লেখার ছিল , তাই অফিসেই ছিল ও | কিন্তু মোবাইলের রিংটা হঠাৎ বেজে ওঠায় কাজের ঘোরটা কাটলো | স্ক্রিনে মায়ের ফোন নাম্বার | কি ব্যাপার ! এই সময় মা তো ফোন করে না ! কথাটা ভেবেই ও ফোনটা তুললো , আর ওপার থেকে ভেসে এলো একটা অচেনা গলার স্বর | , ————- ” হ্যালো , দিদিমনি , আমি হরি বলছি | ”

হরি ! কৃষ্ণেন্দুর বাড়িতে এখন এই লোকটা চব্বিশ ঘন্টার কাজের লোক | কিন্তু হঠাৎ হরি ফোন করলো কেন ! কথাটা ভেবেই ও জিজ্ঞেস করে উঠলো ,

—— ” তুমি ফোন করলে ! কি হয়েছে ?”

হরি তখন একটু ঘাবড়েই যেন বললো এবার , —– ” আসলে দিদিমনি , আপনার মায়ের শরীরটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেছে ! অজ্ঞান মতন হয়ে গেছে | কি করবো বুঝতে পারছি না | আপনি তাড়াতাড়ি আসুন |”

কথাটা শেষ হতেই দীপ্তি যেন চুপ হয়ে গেলো কয়েক সেকেন্ডের জন্য | মা অজ্ঞান হয়ে গেছে ! সকালে তো ঠিকই ছিল ! হাসি মুখে ওর জন্য জলখাবার রান্না করলো ! এর মধ্যে তাহলে কি করে কি হলো ! কথাগুলো ভেবেই ও উঠে দাঁড়ালো , তারপর হরিকে একটু দৃঢ় গলায় বলে উঠলো , ——– ” তুমি মায়ের চোখে মুখে জল দাও | আর পা টা মালিশ করো | আমি আসছি এক্ষুণি |”

কথাটা শেষ করেই দীপ্তি ল্যাপটপটা বন্ধ করে বেড়িয়ে এলো ডেস্ক থেকে | কৃষ্ণেন্দুর কেবিনটা উল্টো দিকেই | ও প্রায় দৌড়েই এবার সেই কেবিনের দরজার সামনে এগিয়ে গেলো | কৃষ্ণেন্দুকে এখন খুব দরকার ওর | কথাটা ভেবেই ও দরজাটা খুলতে যাবে , তখনই দরজাটা নিজে থেকে খুলে কৃষ্ণেন্দু বেড়িয়ে এলো ওর সামনে | তবে এই মুহূর্তে দীপ্তিকে হঠাৎ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটু যেন অবাক হয়ে গেছিলো ও | তবে দীপ্তি আর অপেক্ষা না করেই বলে উঠলো , ———— ” কৃষ্ণেন্দু , এক্ষুণি বাড়ি যেতে হবে তোমাকে আমার সঙ্গে , আসলে মায়ের !”

না কথাটাকে ওর শেষ করতে না দিয়েই এবার তৃষা বেড়িয়ে এলো বন্ধ কেবিনের দরজা খুলে | তারপর কৃষ্ণেন্দুকে বলে উঠলো , ——- ” কি ব্যাপার ? দাঁড়িয়ে পড়লে যে ? নতুন ক্লাইন্টদের সাথে মিটিং আছে | দেরি করলে চলবে না , চলো তাড়াতাড়ি |” , কথাটা বলে ও কৃষ্ণেন্দুর হাতটা কেমন শক্ত করে ধরে নিলো দীপ্তির সামনে | এইবার দীপ্তির সত্যি একটু বেশিই বিরক্ত লাগলো| তাও ও কৃষ্ণেন্দুকে আটকানোর চেষ্টা করে বলে উঠলো , ——– ” প্লিজ , আমার কথাটা শোনো একবার কৃষ্ণেন্দু , বাড়িতে এখন যেতেই হবে | একটা প্রব্লেম হয়ে গেছে !”

কৃষ্ণেন্দু এবার দীপ্তিকে থামিয়ে নিজে থেকেই উত্তর দিলো , ———– ” এখন কিছুতেই আমি বাড়ি যেতে পারবো না ! অনেকদিন অপেক্ষার পর এই নতুন ক্লাইন্ট এপয়েন্টমেন্ট দিয়েছে আমাদের | প্লিজ তুই একটু বোঝ | আমি আটটার পর বাড়ি ফিরে যা প্রব্লেম আছে সব শুনবো | এখন আসি , বাই |”

কথাটা বলেই ও এবার তৃষার সঙ্গে পা মিলিয়ে এগিয়ে গেলো অফিসের করিডোরটা দিয়ে | দীপ্তি কেমন নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো বেশ কয়েক মুহূর্ত | কৃষ্ণেন্দু ওর কথাটা অব্দি শুনলো না ! এতো হিসাবি ও ! কথাটা ভেবেই আনমনে চোখটা ভিজে এলো হঠাৎ | এখন একা একা সবটা ম্যানেজ করবে কি করে ! চিন্তাগুলো কেমন উঁকি দিলো মনের মধ্যে , আর চারিদিকটা অন্ধকার হয়ে এলো এই সময়ে | তখনই আচমকা একজনের গলার আওয়াজ কানে এলো দীপ্তির |

———— ” কিছু প্রব্লেম হয়েছে ? আমি কি কিছু হেল্প করতে পারি ?”

অনিকেতের গলা না ! অন্ধকারটা ভেদ করে হঠাৎ যেন ওর সামনে এসে হাজির ছেলেটা | এই অফিসে কিছুদিন আগেই জয়েন করেছে | এতদিন যদিও হাই হ্যালোর বেশি কোনো কথা হয়নি ! তবে আজ আর দীপ্তি চুপ করে থাকতে পারলো না | ও এবার একটু ভাঙা গলায়ই বলে উঠলো , ———– ” আসলে বাড়িতে আমার মায়ের হঠাৎ খুব শরীর খারাপ হয়ে গেছে | আমি একা একা মা কে দেখবো , না ডাক্তার ডাকতে যাবো , না ওষুধ কিনতে , কিছু বুঝতে পারছি না ! আর যদি হসপিটালে নিয়ে যেতে হয় ! কিছু ভেবে পাচ্ছি না কি করবো !”

কথাটা শুনে অনিকেত এই সময় সাথে সাথেই বলে উঠলো , ———– ” আমি যাচ্ছি আপনার সঙ্গে চলুন | ডাক্তার ওষুধ যা লাগবে আমি দেখছি | আপনি আগে আপনার মায়ের কাছে চলুন | দেরি করবেন না |”

দীপ্তি যেন কথাটা শুনে ভরসা পেলো হঠাৎ | তারপর আর সময় নষ্ট না করে বাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো অনিকেতকে সঙ্গে নিয়ে | মা কে তখন হরিকাকা ড্রইংরুমের সোফাটায় এনে শুয়েছে কোনো মতে | দীপ্তি দেখলো চোখ মুখটা জলে ভেজা মায়ের | আধো আধো জ্ঞান এসেছে এখন | ট্যাক্সিতে আসার সময়ই ডাক্তার কাকার নাম্বারটায় অনেকক্ষণ ধরে ফোন করেছিল ও | ওর মা কে অনেকদিন ধরে উনিই দেখেন | কিন্তু আজই ডাক্তার কাকার ফোনটা বেজে গেলো ! মনে হয় কোনো কাজে ব্যস্ত তাই রিসিভ করেনি কলটা ! দীপ্তি এরপর কোন ডাক্তারের কাছে যাবে ঠিক বুঝতে পারছিলো না , তখনই অনিকেত নিজের ফোনে সেভ করা একজন ডাক্তারকে কল করলো | ওদের পাড়ায় থাকে না কি ! ওর কথায় দিপ্তিদের বাড়িতে আসতেও রাজি হয়ে গেলেন উনি | এরপর আর আধ ঘন্টার মধ্যেই ডাক্তার এসে হাজির | সুগার ফল হয়ে যাওয়ায়ই এই বিপত্তি | সঙ্গে প্রেসারটাও লো | চেকাপের পর ডাক্তার বলে উঠলো | সঙ্গে কিছু ওষুধের প্রেসকিপশন ধরিয়ে দিলো দীপ্তির হাতে | তবে এইবারও অনিকেত ওকে কিছু করতে না দিয়ে নিজে গিয়ে বাইরে থেকে ওষুধগুলো নিয়ে এলো | অবশেষে মা কে একটু সুস্থ দেখে দীপ্তির মুখে হাসি | এর মধ্যে যদিও ও একবার কৃষ্ণেন্দুকে ফোন করেছিল , কিন্তু ফোনটা তৃষা রিসিভ করেছিল , তারপর মুখের ওপর কিছু না শুনেই বলেছিলো , ——— ” এই রকম ইম্পর্টেন্ট একটা মিটিংয়ের মধ্যে ফোন করতে নেই এইটুকুও জানো না | কৃষ্ণেন্দু তাই আমাকে নিজের ফোনটা দিলো বাইরে এসে রিসিভ করার জন্য | ও এখন কথা বলতে পারবে না | তোমার যা দরকার পরে বোলো |”

কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেই তৃষা ফোনটা কেটে দিয়েছিলো | দীপ্তির অপমানে মুখটা লাল হয়ে গিয়েছিলো সেই মুহূর্তে | নিজেকে খুব ছোট লেগেছিলো আচমকা | ও কি গল্প করার জন্য ফোন করেছে কৃষ্ণেন্দুকে ! মায়ের এইরকম একটা ক্রাইসিস হয়েছে বলেই তো কলটা করেছিল ! ওদের চেনা ওষুধের দোকানের নম্বরটা কৃষ্ণেন্দুর ফোনে সেভ করা | ওই দোকানে ফোন করে বললেই ওরা বাড়িতে এসে ওষুধ দিয়ে যায় | তাই কৃষ্ণেন্দুকে না চাইতেও ফোনটা করতে হয়েছিল | কিন্তু আশা করেনি এইরকম সময়ে এতটা খারাপ ব্যবহার ফেরৎ পাবে !

যাইহোক , সেইদিন অনিকেত বাইরে থেকে ওষুধ এনে দেয়ার পর দেখতে দেখতে ঘড়ির কাঁটা নটায় এসে ছুঁয়েছিল | দীপ্তি এবার অনিকেতকে ঠিক কি বলবে বুঝতে পারছিলো না যেন ! তা ও কিছু কথা সাজিয়ে হাসি মুখে বললো , ———– ” সত্যি যদি আপনি না থাকতেন কি করতাম ? এতটা হেল্প করলেন ! আমি বুঝতে পারছি না কি বলবো এরপর !”

কথাগুলো শেষ হতেই অনিকেত এবার আলতো হেসে বলে উঠলো , ——— ” আমাকে তুমি বললেও চলে | একই অফিস তো | আমরা বন্ধুই | আর এমন কিছুই করিনি ! একটু ডাক্তার ডেকে আনা আর ওষুধ কিনে আনাকে অনেক কাজ বলে না | যাইহোক আসি আজ | কাল অফিসে দেখা হবে | টেক কেয়ার |”

কথাটা শুনে এই মুহূর্তে দীপ্তি এক কথায়ই উত্তর দিলো , ———- ” হ্যাঁ ,এস | কাল দেখা হবে অফিসে |”

সেইদিন এরপর অনিকেত কৃষ্ণেন্দুর বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পাশের ফুটপাথটা দিয়ে হাঁটতে শুরু করেছিল | তখনই কৃষ্ণেন্দুর গাড়িটা রাস্তা দিয়ে পাশ করলো | আইপ্যাডের মেল্ চেক করছিলো ও গাড়ির পেছনের সিটে বসে | হঠাৎ অফিসের ওই নতুন ছেলেটাকে ওর বাড়ির পাশের ফুটপাথে হাঁটতে দেখে একটু যেন অবাক হয়ে গেছিলো ও ! তাহলে কি ছেলেটা বাড়িতে এসেছিলো আজ! প্রশ্নটা মনে নিয়েই সেইদিন বাড়িতে এসেছিলো| কিন্তু অন্যদিনের তুলনায় বাড়িটাকে আজ যেন একটু অন্যরকম লাগলো কেমন | বাকিদিন তো ড্রইংরুমের টিভিটা চলে | সেখানে দীপ্তি আর আলো মা বসে থাকে , গল্প করে | কিন্তু আজ ড্রইং রুমটা ফাঁকা | তাই কৃষ্ণেন্দু ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে না পেরে ওপরে গেলো , ওর আলো মার্ ঘরে | কিন্তু সেখানে এসে থমকে গেলো হঠাৎ | আলো মা চোখ বন্ধ করে খাটে শুয়ে | আর দীপ্তি ওর মাথার কাছে বসে আছে চুপচাপ | কৃষ্ণেন্দু এবার খুব চিন্তা নিয়েই এগিয়ে এসেছিলো ওদের কাছে | কিন্তু দীপ্তির মুখটা আজ কৃষ্ণেন্দুকে দেখেও ভীষণ কঠিন ছিল | তবে কৃষ্ণেন্দু আর অপেক্ষা না করেই জিজ্ঞেস করে উঠলো দীপ্তিকে , —— ” কি হয়েছে আলো মার্ ? শরীর খারাপ না কি ?”

দীপ্তি এবার একটু কঠিন গলায়ই বললো , ———– ” সেটা তোমার না জানলেও চলবে | ঠিক আছে এখন মা | তুমি প্লিজ নিজের কাজ করো |”

কৃষ্ণেন্দু কথাগুলোর ঠিক কোনো মানে খুঁজে পেলো না | কিন্তু হঠাৎ যেন বিকেলের ঘটনাটা আচমকা মনে পড়ে গেলো | দীপ্তি তো ওর কাছে এসেছিলো তখন , কি একটা প্রব্লেমের কথা বলছিলো ! তাহলে কি মায়ের শরীর খারাপের কথাই ! , ভাবনাটা মনে আসতেই ও বলে উঠলো , ———– ” কি হয়েছে আলো মার্ ? প্লিজ বল | বিকেলে আমার ওই মিটিংয়ের চিন্তা মাথায় ছিল বলে আমি তোর কথাটা তখন না শুনেই বেড়িয়ে গিয়েছিলাম ! রিয়ারি সরি ! আমি সত্যি বুঝিনি |”

দীপ্তি এর উত্তরে আরেকবার সেই কঠিন স্বরেই বললো , ——–

” না, সরির কিছু হয়নি , বরং ভালোই হলো একদিকে । এরপর আমি আমার কোন প্রব্লেম আর কখনো তোমার সাথে শেয়ার করবো না । তোমার লাইফের প্রায়োরিটি লিস্টে কাজটাই যে সবার আগে , এটা আমি খুব ভালোভাবে বুঝে গিয়েছি আজ। আর প্লিজ এই নিয়ে এখানে আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই । মা ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমোচ্ছে এখন । আমাদের কথায় জেগে যেতে পারে।”

সেদিন এর উত্তরে কৃষ্ণেন্দু আর কিছু বলে উঠতে পারেনি এরপর। সত্যি ! কাজ মাথায় এলে ওর কি যে হয় ! যেন নেশা হয়ে যায় কোন । তখন কাজ ছাড়া ও আর কাউকেই চিনতে পারে না ! বুঝতে পারে না ! দীপ্তি তো আজ কত করে ওকে আটকাতে চেয়েছিলো । একবার ওর কথা শোনার জন্য রিকোয়েস্ট করেছিল ! কৃষ্ণেন্দু কি চাইলে পারতো না কয়েক সেকেন্ড সময় দিতে ! কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে অন্তত ওর কথা গুলো শুনতে ! ভেবেই নিজের ওপরই রাগ হলো ভীষণ এই মুহূর্তে।

সেদিন এরপর অনেকটা সময় কেটে গিয়েছিল ঘড়ির কাঁটায় । রাত দুটো এখন । দীপ্তি আজ মায়ের ঘরে বসেই খেয়েছে । মা কে যেন এক মুহুর্ত ও চোখহারা করতে ইচ্ছে করছে না আজ । ঘুমন্ত মায়ের দিকে বার বার তাকিয়ে মনে হচ্ছিল বেহিসেবী ভাবে, যদি আজ কিছু একটা হয়ে যেত মায়ের ! তাহলে কি করে বাঁচতো দীপ্তি ! কিভাবে সামলাতো নিজেকে ! যাইহোক , এইসব ভাবনার ভিড়েই সেইদিনের রাতটা নির্ঘুম ছিল যেন। এর মাঝে জল তেষ্টা পাওয়ায় দীপ্তি রান্নাঘরে এসেছিল , কিন্তু ফ্রিজটা খুলতেই দেখলো খাবারগুলো যেমনকার সেরকমভাবে সাজানো | কৃষ্ণেন্দু খেলে তো এতো খাবার ফ্রিজে থাকার কথা নয় ! তাহলে কি কৃষ্ণেন্দু ডিনার করেনি ! কথাটা ভেবেই ও হরির সিঁড়ির নিচের ছোট ঘরটার দিকে গেলো | এতো রাতে হরি এখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন | তাও দরজাটা ধাক্কা দিলো দীপ্তি | কিছুক্ষণ বাদে হরি এসে দরজা খুলতেই ও জিজ্ঞেস করে উঠলো , ———- ” কৃষ্ণেন্দুকে খাবার দাওনি তুমি ? খাবারগুলো যেমনকার সেরকমভাবে ফ্রিজে রাখা যে !”

হরি তখন ঘুমন্ত চোখেই উত্তর দিলো , ———– ” আমি কি করবো ! স্যারই তো বললো খাবে না আর আজ | তাই আমি ফ্রিজে সব গুছিয়ে তুলে রাখলাম |”

কথাটা শুনে দীপ্তি এবার একটু অবাক হলো ! কৃষ্ণেন্দু রাতে খায়নি কেন ! সারা রাত কি না খেয়েই কাটাবে ছেলেটা ! এটা তো ঠিক না | কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই ও আর নিজেকে আটকাতে পারলো না | কৃষ্ণেন্দুর ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো সেই মুহূর্তে | কিন্তু ও কি এখনো জেগে আছে ! ঘুমিয়ে পড়লে ডেকে তোলা টা কি ঠিক হবে ! এইসবই ভাবছিলো , কিন্তু ওর ঘরের সামনে এসেই পাটা থমকে গেলো | আজ কৃষ্ণেন্দুর ঘরের দরজা খোলা | অন্ধকার ঘরে ছায়ার শরীরের মতন ও যে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে জানলার পাশে , এটা দীপ্তি দরজার বাইরে থেকেই দেখতে পেলো | এখনো জেগে কৃষ্ণেন্দু ! ও আজ যা করেছে তারপর কি সব ভুলে দীপ্তির উচিত ওর সঙ্গে কথা বলতে যাওয়া ! প্রশ্নটা নিজের মনকেই করে উঠলো যেন আনমনে | তবে উত্তরে সেই কৃষ্ণেন্দুর মুখটাই ভেসে এলো চোখের সামনে | ইচ্ছে করে কি এই ছেলেটা এতো বড়ো ভুল করেছে ! হয়তো না বুঝেই ! কথাগুলো ভেবেই ও একটু এগিয়ে গেলো কৃষ্ণেন্দুর দিকে | তারপর অন্ধকার ঘরের নিঃস্তব্ধতা ভেঙে নিজে থেকেই বলে উঠলো , ———— ” তুমি খাওনি কেন রাতে ?”

কৃষ্ণেন্দুর এই চেনা গলার স্বরে যেন সম্ভিত ফিরলো হঠাৎ | ও ফিরে তাকালো দীপ্তির দিকে | কিন্তু কিছুতেই কোনো কথা বলতে পারলো না | শুধু নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে |

দীপ্তি এই দৃষ্টিটা চেনে খুব ভালোভাবে | খুব মন খারাপ হলে কৃষ্ণেন্দু কিছু বলতে পারে না কখনো | কেমন যেন নিঃস্তব্ধ হয়ে যায় ও | দীপ্তির খুব কষ্ট হয় ওর এই নিঃস্তব্ধতা দেখলে | তাই নিজে থেকেই ওর হাতটা শক্ত করে ধরে বললো , ———– ” কি হয়েছে ? কেন খাওনি তুমি ?”

কৃষ্ণেন্দু এই মুহূর্তে আস্তে গলায় একটা কথাই বললো , ——— ” আমার খুব বড়ো ভুল হয়ে গেছে আজ | আমার তোর কথাগুলো শোনা উচিত ছিল ! ”

দীপ্তি এর ঠিক কি উত্তর দেবে বুঝতে পারলো না | আসলে কৃষ্ণেন্দু নিজেও জানে না ও আস্তে আস্তে কিরকম বদলে যাচ্ছে ভেতরে ভেতরে | কতটা হিসাবি হয়ে যাচ্ছে ও দিন দিন ! আর আজ হঠাৎ হয়তো নিজের এই অচেনা রূপটা নিজের সামনে দেখতে পেলো! তাই এইরকম খারাপ লাগছে ! দীপ্তি তাই আর এই নিয়ে কোনো কথা না বলে অন্য কথা বললো এখন ,

————- ” খেতে চলো তুমি | অনেক দেরি হয়ে গেছে |” ……. কথাটা বলেই ও হাতটা টানলো জোরে কৃষেন্দুর | কিন্তু কৃষ্ণেন্দু তাও থমকে দাঁড়িয়ে রইলো এক জায়গায়| তারপর আস্তে গলায় ওকে জিজ্ঞাসা করে উঠলো , ————- ” তুই ভুলতে পারবি তো আজকের দিনটা ? আমার এই ভুল ?”

দীপ্তি এবার ওর চোখের দিকে তাকিয়েই এক কথায় উত্তর দিলো , ——— ” হ্যাঁ, ভুলে গেছি |”

কথাটা বলেই ও কৃষ্ণেন্দুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো নিজের মধ্যে। আসলে বড্ড মায়া হচ্ছিল এই মুহূর্তে ওর জন্য। না , এরপর আর বেশিক্ষণ না খেয়ে থাকতে দেয়নি দীপ্তি ছেলেটাকে | নিজে খাবারের থালা নিয়ে হাজির হয়েছিল ওর সামনে | তারপর একরকম জোর করেই ওর হাতটা ধরে ডাইনিং টেবিলে বসিয়েছিলো | কৃষ্ণেন্দু এতো জোরের পর ডিনার করতে বাধ্য হয়েছিল দীপ্তির সামনে | তবে এইসবের ভিড়েও আজকের সন্ধ্যেটা মাঝে মাঝে মনে পড়ছিলো দীপ্তির | যদিও কৃষ্ণেন্দুর সামনে ও আর এই নিয়ে কোনো কথা বলেনি ! কিন্তু আজকের ঘটনাটা ভোলা হয়তো অতোও সহজ না দীপ্তির কাছে | আজ ও একটা জিনিস ভীষণভাবে বুঝে গেছে , কৃষ্ণেন্দুর কাছ থেকে কোনো দরকারে অদরকারে যখন তখন আর সময় চাওয়া যাবে না ! সামনে বসে এখন যে খাচ্ছে , সে আর ওর সেই ছোটবেলার চেনা বন্ধু না ; এই মানুষটা একদম নতুন ! যার সময়ের আজকাল ভীষণ দাম | কথাগুলো ভাবলেই অদ্ভুত একটা মনের ভেতরে কিছু যেন ভাঙতে শুরু করেছে দীপ্তির | এই ভাঙ্গনটা সম্পর্কের ভাঙ্গন নয় তো ! যেই সম্পর্কটা ওর কৃষ্ণেন্দুর সঙ্গে আছে , সেটা কি তাহলে আজ থেকেই আস্তে আস্তে টুকরো হতে শুরু করেছে ! কিছু শেষ হয়ে যাচ্ছে কি দীপ্তির মধ্যে ! প্রশ্নটা যেন আনমনেই করে উঠলো ও নিজেকে হঠাৎ !

এর মধ্যে কাল যখন অফিসে গেলো দীপ্তি , প্রথমেই ওর চোখ অনিকেতকে খুঁজছিলো যেন | ছেলেটাকে আরেকবার থ্যাঙ্ক ইউ বলাটা উচিত | এইসবই ভাবছিলো , তখনই ওর দুটো ডেস্ক পরে যেই টেবিলটা , সেখানে চোখ চলে গেলো | অনিকেত খুব মন দিয়ে একটা ফাইল পড়ছিলো | দীপ্তি নিজে থেকেই গেলো আজ কথা বলতে | হাসি মুখে ওর সামনে এসে বললো ,

——– ” কাল মায়ের ওরকম অবস্থা ছিল বলে আমি এক কাপ কফিও খাওয়াতে পারিনি তোমাকে | কিন্তু আজকে আমাদের উল্টো দিকের কফি শপটায় যেতে হবে কিন্তু আমার সাথে |”

কথাটা শুনে অনিকেতের সম্ভিত ফিরলো | ও ফাইল থেকে মুখ তুলে এবার নিজেও হাসলো | তারপর একটু ভেবে জিজ্ঞেস করলো , ———– ” কাল কফির থেকেও বেশি ইম্পর্টেন্ট কাকিমার শরীর ছিল ! যাইহোক , আজকে কেমন আছেন উনি ? সব ঠিক তো ?”

দীপ্তি এবার একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেই বললো , ——– ” হ্যাঁ , আজ একদম ঠিক | তবে ঘুমের ওষুধটা আজও খেতে বলেছে ডাক্তার | রেস্টটা খুব দরকার এখন মায়ের | ”

অনিকেত এই মুহূর্তে একটু দৃঢ় গলায় উত্তর দিলো ওকে , ———- ” ডোন্ট ওরি , ঠিক হয়ে যাবেন উনি , খুব তাড়াতাড়ি |”

সেদিন ওদের এই টুকরো কথাগুলো কৃষ্ণেন্দু ওর কাঁচের কেবিনের ওপার থেকে আনমনে খেয়াল করেছিল | দীপ্তি এইভাবে নিজে থেকে এই ছেলেটার সাথে কথা বলছে কেন ঠিক বুঝতে পারছিলো না ! অফিসে তো ছেলেটা দু সপ্তাহ হলো জয়েন করেছে | কাল আবার ওকে কৃষ্ণেন্দু বাড়ির সামনেও দেখেছে ! কিন্তু দীপ্তি তো এইভাবে নিজে থেকে কারোর সাথে আলাপ জমায় না ! তাহলে কারণটা কি ! কাজের ভিড়ে কথাগুলো এসে জমা হলো হঠাৎ মনে | সেদিন এইসবের পর কৃষ্ণেন্দু আজ ইচ্ছে করেই একটু তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে ফেলেছিলো নিজের | তৃষা যদিও এসেছিলো ওর কাছে বিকেলবেলা , ফ্যাক্টারিতে কিছু মেটেরিয়ালস লাগবে , সেই নিয়ে আলোচনা করতে ; কিন্তু কৃষ্ণেন্দু আর কোনোভাবে দাঁড়ায়নি | একরকম তৃষাকে মুখের ওপর না বলেই বেরিয়ে এসেছিলো অফিস থেকে | দীপ্তিকে খেয়াল করেছিল ও | পাঁচ মিনিট আগে বেরিয়েছে নিজের ডেস্কটা খালি করে | নিশ্চয়ই এখন বাসস্টপে দাঁড়িয়ে | এই ভেবেই আর ড্রাইভারের অপেক্ষা না করে নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে পার্কিং এরিয়া থেকে বেড়িয়ে এসেছিলো ও মেন্ রোডের দিকে | কিন্তু এই অফিসের সামনের রাস্তাটায় এসেই আবার কৃষ্ণেন্দু থমকে গেছিলো কয়েক সেকেন্ডের জন্য | বাস স্টপে দীপ্তি একা নেই আজ | সঙ্গে সেই অফিসের নতুন ছেলেটা | দুজনে সেই সকালের মতন হেসে হেসে কত কি যেন কথা বলে যাচ্ছে ! কৃষ্ণেন্দুর দৃশ্যটা দেখে কেমন একটা হালকা জ্বালা শুরু হলো বুকের ভেতর | সঙ্গে একটু রাগই হলো ছেলেটার ওপর | অফিসে কাজ করতে আসে না গল্প করতে ! অদ্ভুত ! কথাটা ভাবতে ভাবতেই ও গাড়িটা নিয়ে এবার দীপ্তির দিকে এগিয়ে গেলো | তারপর আচমকা ওই বাস স্টপের সামনে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে কাঁচটা নামালো ও | দীপ্তি তো এই মুহূর্তে বেশ অবাক ! কাঁচের ওপারে কৃষ্ণেন্দুকে দেখে | ও সেই চমকে যাওয়া এক্সপ্রেশন নিয়েই বলে উঠলো , ————- ” কৃষ্ণেন্দু তুমি ! এখানে ? এতো তাড়াতাড়ি তো তুমি অফিস থেকে বেরোও না !”

কৃষ্ণেন্দু এবার একটু গম্ভীর মুখেই উত্তর দিলো ———- ” আজ কাজ কম ছিল | তুই গাড়িতে ওঠ | একসাথে ফিরবো |”

কথাটা শুনে দীপ্তি একটু ইতঃস্তত হয়ে অনিকেতের দিকে তাকালো | তারপর দু সেকেন্ড সময় নিয়ে বলে উঠলো , ——— ” সরি অনিকেত , আজ তাহলে তোমার সাথে কফি হাউজে যাওয়া হলো না | যাইহোক , এই উইকে আর একদিন নিশ্চয়ই যাবো | তুমি প্লিজ মাইন্ড করো না |”

অনিকেত এই মুহূর্তে অল্প হেসে উত্তর দিলো , ———– ” একদম না | পরে যাবো কোনোদিন | তুমি স্যারের সাথে যাও | কাল দেখা হবে | বাই |”

দীপ্তি এবার নিশ্চিন্ত হয়ে কৃষ্ণেন্দুর গাড়িতে উঠে পড়লো | কিন্তু এই কথার ভিড়ে কৃষ্ণেন্দুর ভ্রুটা একটু কুঁচকে উঠেছে হঠাৎ | ভেতরের জ্বালাটা যেন আরো বেশি বেড়ে যাচ্ছে | দীপ্তি এই ছেলেটার সাথে কফি হাউজ যাওয়ার প্ল্যান করেছিল ! বিশ্বাস হচ্ছিলো না ঠিক | কফিহাউজ তো ওরা দুজনে সব সময় একসাথে যেত | কলেজ লাইফে , কলেজ স্ট্রিটে কারণে অকারণে , কখনো বই কেনার জন্য , তো কখনো এমনি শুধু আড্ডা দিতে , অথবা অকারণে রাস্তাগুলোতে হেঁটে বেড়াতে দীপ্তি আর কৃষ্ণেন্দু চলে যেত একসঙ্গে | তারপর কফি হাউজে গিয়ে বসতো মাঝে মাঝেই | কত না বলা কথা , পুরোনো গল্প হতো ওদের মধ্যে ! কত মুহূর্ত লুকিয়ে ছিল সেইসব দিনগুলোতে ! সেই কফি হাউজে হঠাৎ এই ছেলেটাকে দীপ্তি নিয়ে যাবে কেন ! এইসবই ভাবছিলো কৃষ্ণেন্দু এক মনে গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে | আর ওর ভেতরে এই ভাবনা গুলোর সঙ্গে একটা অদ্ভুত রাগ এসে জড়ো হচ্ছিলো কেমন ! এই মুহূর্তেই দীপ্তি বলে উঠলো ,

———- ” তোমার তো এতো তাড়াতাড়ি কাজ শেষ হয় না কখনো আজকাল ! তাহলে অফিস থেকে এই বিকেল বিকেল চলে এলে যে ?”

কৃষ্ণেন্দুর এবার রাগটা আর কিছুতেই ভেতরে জমা থাকলো না | সেটা মুখে প্রকাশ করেই ফেললো ও | একটু কঠিনভাবেই বলে উঠলো .,

———– ” কেন ? তাড়াতাড়ি বেরিয়ে কি খুব অসুবিধা করে দিলাম তোর ? প্ল্যান নষ্ট হয়ে গেলো আমার জন্য !”

দীপ্তি এই কথাটা শুনে বেশ অবাক হয়েই বলে উঠলো , ———- ” এইভাবে কেন বলছো তুমি ? আর তুমি তো মনে হয় লাস্ট এক বছর প্রায় আমার সাথে বিকেলবেলা বাড়ি ফেরোনি কখনো | তাই জিজ্ঞেস করলাম |”

কৃষ্ণেন্দু এবারও রাগটা সঙ্গে নিয়েই উত্তর দিলো , ——— ” ফিরিনি বলে কখনো ফিরবো না এরকম তো কথা ছিল না ! আর এই অফিসের নতুন আসা ছেলেটার সাথে তো একেবারে কফি হাউজ অব্দি প্ল্যান করে নিলি | আমি সময় দিতে পারি না বলে তোর আড্ডার যে কোনোরকম অসুবিধা হয় সেটা তো মনে হচ্ছে না আজ |”

দীপ্তি এই মুহূর্তে সত্যি যেন আকাশ থেকে পড়লো | ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিলো না ওর সামনে যে বসে আছে সে সত্যি কৃষ্ণেন্দু কি না ! কৃষ্ণেন্দু যে এইভাবে ওর সাথে কথা বলতে পারে এটা যেন কিছুতেই মেলাতে পারছিলো না ঠিক | তাই মুখটা অন্ধকার হয়ে এসেছিলো হঠাৎ দীপ্তির | সেই অন্ধকার মুখেই উত্তর দিলো ,

————- ” তোমার যদি সেইরকমই মনে হয় , তাহলে এই ব্যাপারে আমার সত্যি কিছু বলার নেই ! আর অনিকেত কাল মার্ শরীর খারাপ শুনে আমার হেল্প করেছিল খুব | আমার সঙ্গে বাড়িতে এসেছিলো , ডাক্তারকে খবর দিয়েছিলো , এমন কি ওষুধগুলোও গুছিয়ে কিনে দিয়ে গিয়েছিলো | কিন্তু কাল টেনশনের মধ্যে ওকে এক কাপ চা কফিও খেতে বলতে পারেনি ! তাই আজ আমাদের অফিসের কফি শপে কফি খাবার কথা বলেছিলাম | কিন্তু বিকেলবেলা এসে দেখলাম দোকানটা বন্ধ | তাই কফি হাউজে ! যাইহোক , আর কিছুই বলার নেই আমার | ”

কথাগুলো বলতে বলতে সেদিন ভিড় রাস্তা পেরিয়ে ওরা বাড়ির একদম সামনে চলে এসেছিলো সেইদিন | কৃষ্ণেন্দুর এতকিছু শোনার পর রাগটা ঘুরে নিজের ওপরই ফিরে এসেছিলো কেমন ! কাল যে কেন ও দীপ্তির কথা শুনলো না একবারও কে জানে ! তাহলে এইভাবে ওকে একটা বাইরের লোকের হেল্প নিতে হতো না কখনো ! আর এইসবের মাঝে ও আজ রাগের মাথায় কি সব যে বলে ফেলেছে দীপ্তিকে ! ও কি খুব বেশি রুড ছিল আজ ! এইসবই ভাবছিলো আনমনে , তখনই বাড়ি এসে যাওয়ায় গাড়িটা দাঁড় করালো কৃষ্ণেন্দু গেটের সামনে , আর দীপ্তি এক সেকেন্ডও অপেক্ষা না করে কৃষ্ণেন্দুর চোখের পলকে গাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেলো কিছু না বলে | কেমন যেন দূরত্ব এসে জমা হলো হঠাৎ ওদের মাঝে | না বলা কথার দূরত্ব | কৃষ্ণেন্দু আজ প্রথম খেয়াল করলো এই দূরত্বটাকে ! আর হঠাৎ একটা অদ্ভুত ভয় করে উঠলো যেন মনে ! এই দূরত্বটা বেড়ে যাবে না তো কখনো ! একটা না পার করা রাস্তা তৈরী হয়ে যাবে না তো ওদের মধ্যে ! নিঃস্তব্ধতার দেয়াল এসে ঘিরে ধরবে না তো দুজনকে !
চলবে।