অপরাজিতা পর্ব-১১+১২

0
306

#অপরাজিতা
#১১তম_পর্ব
#স্নিগ্ধতা_প্রিয়তা

আনান ক্লাস থেকে বের হয়ে যেতেই সবাই রাজিতাকে ‘সরি’ বলতে লাগলো। রাজিতা মুখে এক আকাশ মেঘ জমিয়ে বসে আছে, যেন একটু দমকা হাওয়াতেই ঝড়-তুফান আর কান্নার বৃষ্টি শুরু হয়ে যাবে! চোখের পানিগুলো যেন টুস করে পড়ার অপেক্ষায় আছে৷
সিনান সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,
–“আরে, ওকে পরেও সরি বলা যাবে। আগে স্যারকে সরি বলতে হবে৷ স্যার আসার সাথে-সাথেই যদি আমাদের সাথে বন্ডিংটা খারাপ হয়, তাহলে বাকি বছর কীভাবে ক্লাস করব? আর আইডিয়াটা কার যেন ছিলো! নেহা, চল। তুই আর দুই-তিনজন আমার সাথে চল, স্যারকে সরি বলতে হবে। ”
নেহা মুখটা কাচুমাচু করে বলল,
–“আমাকে যেতেই হবে? না গেলে হয়না? তোরাই যা! স্যারের যা রাগ দেখলাম! আমারতো এখন স্যারের সামনে যেতেই ভয় লাগছে!”
মালিহা বলে উঠল,
–“আইডিয়াটা দেওয়ার সময় মনে ছিলো না?”
ওর কথা শুনে নেহা কিছুটা রেগে গিয়ে বলল,
–“এখনতো সব দোষ আমার! তোমরা আমার সাথে তাল না মিলালে কি আমি একা-একা পারতাম। তখনতো নিজেরাও খুব নাঁচছিলে। আর এখন এসে ‘যত দোষ, নন্দঘোষ’। ”
ওদের আরেকফ্রেন্ড বলল,
–“আরে ভাই তোরা গেলে চল। স্যারের আবার ক্লাস থাকতে পারে। এখানে সময় নষ্ট না করে চল।”

এরপর নেহা, মালিহা, সিনান আর ওদের আরো দুইটা ফ্রেন্ড গেলো আনানের সাথে দেখা করতে।বাকি সবাই ওদের ফেরার অপেক্ষা করতে লাগলো।
রাজিতা অনেক কষ্টে নিজের কান্নাগুলো চেপে রেখেছে। ক্লাসে সবার সামনেতো আর কান্না করা যাবে না! ওর নিজেকে খুব অসহায় লাগছে, এতকিছু হয়ে যাবে ও ভাবতেও পারেনি! ও নিজেও বুঝতে পারেনি যে, এই কাজটা করে বসবে!

মিনিট পাঁচেক পরে নেহারা থমথমে মুখ নিয়ে ফিরে আসলো আনানের অফিসরুম থেকে। ওরা আসতেই সবাই ঘিরে ধরল কি হয়েছে তা শুনার জন্য।
সিনান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
–“কি আর হবে! সেই লেকচার।”
আরেকটা ছেলে আবার বলে উঠল,
–“বইন! তোরা আর যাই করিস, জীবনে কখনো টিচারকে বিয়ে করিস না। ছাত্রী ভেবে সারাজীবন জ্ঞান দিতে-দিতে মেরে ফেলবে!”
নেহা রাজিতার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,
–“সরিরে দোস্ত! আমি বুঝতে পারিনি এতকিছু হয়ে যাবে! ”
রাজিতা আর কারো সাথেই একটা কথাও বলল না। পরের ক্লাসটা চুপচাপ শেষ করল।

রাজিতার ক্লাস শেষ হতে একটু দেরি হলো। ও গাড়ির কাছে গিয়ে দেখে যে, আনান গাড়িতেই বসে আছে। কতক্ষণ বসে আছে কে জানে।
রাজিতা গাড়িতে বসতে বসতে বলল,
–“কতক্ষণ বসে আছেন?”
আনান কোনো উত্তর না দিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো।
সারারাস্তা কেউ কোনো কথা বলল না। প্রথমদিকে রাজিতা কয়েকবার, ‘সরি’ বলল। কিন্তু আনানের কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে পরে ও নিজেও চুপ করে গেলো।

রাজিতাদের বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় তিনটা বেজে গেলো। ক্ষুধায় রাজিতার পেটে ছুঁচো দৌড়াচ্ছে। সেই সকালে দু’টো রুটি আর একটা ডিম খেয়ে বেড়িয়েছে, এরমধ্যে আর কিছুই খায়নি। ওর ফ্রেন্ডরা সবাই ক্যান্টিনে গিয়েছিলো খেতে, কিন্তু ও ক্লাসেই বসে ছিল, তখন খেতে মন চাচ্ছিলো না, কিন্তু এখন আর থাকতে পারছে না।কিন্তু বাইরে থেকে এসে গোসল না করেই যদি খেতে বসে ওর শাশুড়ী আর আনান কি ভাববে! তাই ভাবল যে, আগে গোসল করে নিবে।

কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে বাথরুমের দরজা খুলতে গিয়েই বুঝতে পারলো যে, আনান ভেতরে আছে। ও টলতে টলতে কাপড়চোপড় নিয়ে অন্যরুমের বাথরুমে চলে গেলো।
কোনোমতে গোসলটা সেরে বের হতেই দেখলো যে, আনান খেতে বসে গেছে। ওর শাশুড়ী আগেই খেয়ে নিয়েছে, এ সময়টা উনি রেস্ট নিচ্ছে। আনানও খেয়ে নিচ্ছে, তারমানে রাজিতাকে এখন একা-একাই খেতে হবে। রেগে আছে বলে কি একসাথে খাওয়াও যাবে না! রাজিতা রাগে ফুসছে শুধু। সেই তখন থেকে কথা বলার চেষ্টা করে যাচ্ছে, আর উনি ভাব নিয়ে বসে আছে! এসব ভাবতে ভাবতে ভেজা কাপড়গুলো নিয়ে ছাদে চলে গেলো রাজিতা।
অনেকক্ষণ পর ছাদ থেকে এসে দেখল যে, আনান রুমে নেই। পেটে ক্ষুধা থাকলেও রাজিতার এখন আর খাওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই, ঘুমও চোখে টলমল করছে৷ তাই ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিতেই ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলো রাজিতা।

সন্ধ্যার দিকে ওর শাশুড়ীর ডাকে ঘুম ভাঙল। এতক্ষণ ঘুমিয়েছে! ওর শাশুড়ী কি ভাবছে কে জানে!
রাজিতা তাড়াতাড়ি উঠে বসল। ওর শাশুড়ী ওর কপালে হাত দিয়ে বলল,
–“শরীর খারাপ নাকি রে মা? অনেকক্ষণ দেখলাম শুয়ে আছিস। একটু আগে আনান এসেছিল রুমে, আমি ভাবলাম যে তুই হয়ত জেগে আছিস। সন্ধ্যায় ঘুমাতে হয় না। উঠে একটু হাটাহাটি কর।”
রাজিতা বলল,
–“না মা, আমি ঠিক আছি। ক্লাস থেকে এসে একটু ক্লান্ত লাগছিলো, তাই আর কি!”
–“এতদূর থেকে ক্লাসে যেতে তোর খুব কষ্ট হয়ে যায়৷ তাই না?”
–“না মা, আপনার ছেলেওতো যায়। কষ্ট হবে কেন!”
–“আমার ছেলের দূর-দূরান্তে যাতায়াত করে অভ্যাস আছে। তোরতো নেই।”
–“আস্তে আস্তে অভ্যাস হয়ে যাবে।”
–“তাই হলেই ভালো। তুই দুপুরে খাসনি মনে হয়?”
রাজিতা শুকনো হেসে বলল,
–“ফ্রেন্ডদের সাথে খেয়েছিলামতো আর খেতে মন চাচ্ছিলো না।”
রাজিতা সত্য বললে হয়ত ওর শাশুড়ী রাগ করতো, তাই মিথ্যে বলল। মানুষটা ওকে কত ভালবাসে! আচ্ছা ওর মা থাকলেও কি এভাবে খেয়াল রাখত সবকিছু? ও কখন কি করল না করল! কখন কি খেলো না খেলো! ওর চাচার বাসায়তো ক্ষুধা লাগলেই খেয়ে নিতো, কারো বলার আশাই রাখত না। কারণ ওখানে এভাবে কেউ ওর খেয়াল রাখতই না।কিন্তু এত ভালবাসা কি ওর কপালে সইবে!

রাজিতা সারাদিন না খেয়ে থাকার কারণে মাথাটা ভারি হয়ে আছে, তুলতে পারছে না। বমি-বমিও পাচ্ছে, কিন্তু ওর শাশুড়ীকে কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না।
সারাদিন না খেয়ে থেকে সন্ধ্যার দিকে চা মুখে দেওয়ার সাথে-সাথেই রাজিতা বমি আর আটকে রাখতে না পেরে বাথরুমে গিয়ে বমি করে দিলো। ওর শাশুড়ী পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো। তারপর রাজিতাকে ধরে রুমে নিয়ে শুইয়ে দিলো। আনানকে কল করে তাড়াতাড়ি বাসায় আসতে বলল।উনিতো অন্যকিছু ভেবে বসে আছেন!

আনান এসে দেখলো যে, রাজিতা বিছানায় শুয়ে আছে। ওকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে, ও কতটা ক্লান্ত। একদিনেই চোখমুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না।আনানকে আসতে দেখেই আনানের মা বলল,
–“তোর ডাক্তার আঙ্কেলকে খবর দিবি কি?”
আনান রাজিতার পাশে বসে বলল,
–“আচ্ছা, আগে আমি দেখছি।”
–“আচ্ছা।”
বলেই উনি রুম থেকে চলে গেলেন। রাজিতা বুঝতে পারলো যে, না খেয়ে থাকার কারণে ওর এমনটা হয়েছে৷ এর আগেও যখন অনেকক্ষণ না খেয়ে থেকেছে তখন এমনটা হয়েছে। ওর শাশুড়ী চলে যেতেই রাজিতা আনানকে বলল,
–“মাকে বলুন চিন্তা না করতে। আমার আসলে কিছুই হয়নি। না খেয়ে থাকার কারণেই..”
শেষের কথাগুলো রাজিতা আস্তে-আস্তে বলল।তারপর আবার বলতে লাগলো,
–“সরি! আর কতক্ষণ কথা না বলে থাকবেন? এবার অন্তত কিছু বলুন।”
আনান ওর হাত আর কপাল খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে বলল,
–“না খেয়ে থাকার মানে টা কি? আমি তোমার উপর রাগ করব কি তুমিই আমার উপর জিদ দেখিয়ে না খেয়ে বসে আছো? এইটা কোনো কথা!”
রাজিতা আমতা-আমতা করে বলল,
–“আমি মোটেও রাগ করিনি! আমি কেন রাগ করব, আমিতো জানি ভুলটা আমার। আমিতো আপনার রাগ ভাঙাতে চাচ্ছিলাম। আপনিইতো…”
আনান ধমকের সুরে বলল,
–“আমি কি বলেছিলাম যে, না খেয়ে থেকে আমার রাগ ভাঙাও?”
–“খেতে মন না চাইলে আমি কি করব!”
আনান রাজিতার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেলো।রাজিতা কিছুই বুঝতে পারলো না। চুপচাপ মরার মতো পড়ে রইলো।

কিছুক্ষণ পরেই আনান একটা ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকল।তাতে একটা গ্লাসে করে ফলের জুস আর আরেকটা বাটিতে করে পানিসহ চিড়া ভেজানো আছে।
ওগুলো দেখে রাজিতা বলল,
–“আরে আপনি এতকষ্ট করে এগুলা আনতে গেলেন কেন! কিছু একটা খেলেইতো সব ঠিক হয়ে যেতো!”
আনান টেবিলের একপাশে ওগুলো নামাতে নামাতে বলল,
–“এতে খুশি হওয়ার কিছু নেই। এগুলো কষ্ট করে আমি করিনি। নিয়তি আন্টি করেছে, আমি শুধু নিয়ে এসেছি। এবার সুন্দর করে এগুলো খেয়ে নাও।”

নিয়তি আন্টি হচ্ছে ওদের বাসায় কাজ করে। আনান যখন ছোট ছিলো তখন থেকেই উনি আছেন। উনার একটা ছেলে আছে, আর ওই ছেলেটাই আনানদের গাড়ির ড্রাইভার। বউ-বাচ্চা নিয়ে আনানদের ফ্ল্যাটের নিচ-তলাতে ছোট্ট রুমটাতেই থাকে।

চিড়া রাজিতার একদম অপছন্দ। কিন্তু এখন না খেয়ে উপায় নেই। ও পেট ভরে খেলেই সব ঠিক হয়ে যেতো, আনান শুধু-শুধু এসব করতে গেলো। এসব ভাবতে ভাবতে উঠে বসে রাজিতা। ওর মনে হচ্ছে যে, ও কোনো মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয়েছে!
ফলের জুসটা এক চুমুকে শেষ করে নাক কুঁচকে চিড়ার বাটিটা হাতে নিয়ে আনানের দিকে একবার তাকালো। তারপর বলল,
–“আমার এই অপছন্দের জিনিসটা খেতে পারি, তবে একটা শর্তে!”
–“রাগ করে আছি আমি, আর শর্ত দিচ্ছো তুমি! আজব মেয়ে কপালে জুটেছেরে বাবা!”
–“আগে বলুন আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন?”
–“আচ্ছা বাবা দিয়েছি৷ তবে নেক্সট টাইম আবার যদি ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া না করে অসুস্থ হয়ে যাও, তাহলে আর ক্ষমা নেই।”
রাজিতা চোখমুখ বুজে চিড়া-পানি খেতে লাগলো। আনান কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলল,
–“আমি কি এমনি এমনি রাগ করেছি? তোমার আর তোমার ফ্রেন্ডদের আক্কেল দেখে আমি অবাক হয়ে গেছি! কোনো কমনসেন্স নেই একটারও! এই খবরটা কোনোভাবে ক্যাম্পাসে বা ক্যাম্পাসের বাইরে ছড়িয়ে পড়লে কি হবে জানো? প্রথমে বদনাম হবে ভার্সিটির, তারপর ডিপার্টমেন্টের, তারপর তোমার! আমার এখানে কিছুই হবে না, কারণ আমি মাত্র জয়েন করেছি, আমাকে কেউ ওভাবে চেনেই না।সবাই এটাই রটিয়ে দিবে যে ‘স্টুডেন্ড হয়ে ক্লাসের মধ্যে স্যারকে প্রপোজ’ বুঝতে পারছো ব্যাপারটা! অন্যসব বাদ-ই দিলাম, অন্তত নিজের কথাটাতো ভাবতে!”
রাজিতা অপলক দৃষ্টিতে আনানকে দেখছে আর ওর কথা শুনছে৷ আনানও রাজিতার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলল। রাজিতাকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আনান আবার বলল,
–“ওভাবে তাকিয়ে কি দেখছো?”
–“সরি বলেছিতো!”
–“সবকিছু সরি দিয়ে হয়!”
–“তাহলে কি করতে হবে? আপনিই বলুন।”
–“আপাতত একটু রেস্ট নাও। মা চিন্তা করছে, কি হলো! আমি যাই মাকে বলে আসি যে, তার আদরের বউমা না খেয়ে থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ”

বলেই আনান রুম থেকে বের হয়ে গেলো। রাজিতা একটু শুয়ে থাকার পর যখন একটু ভালো লাগলো উঠে ওর শাশুড়ীর রুমে চলে গেলো। সেখানে ওর শশুর আর আনানও ছিলো।

রাতে খাওয়ার সময় আনানের মা রাজিতার প্লেটে মাছ, তরকারি, ভাত, এটা-সেটা তুলে তুলে দিতে দিতে বলল,
–“আমি বলছিলাম কি আনান টিচার্স কোয়ার্টার পেলে তোরা দুজন ওখানে উঠে যা। ”
আনানের মা একথা বলার সাথে-সাথেই আনান আর রাজিতা দুজনেই একসাথে বলে উঠল,
–“কেন?”
বলেই দুজনে দুজনের মুখের দিকে তাকালো।
ওদের প্রতিক্রিয়া দেখে আনানের মা আনানকে উদ্দেশ্য করে বলল,
–“দেখছিস না, রাজিতার জন্য এতদূর থেকে ক্লাস করা কষ্ট হয়ে যাচ্ছে!”
আনান খাওয়া থামিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
–“কেন? আমিওতো এখান থেকেই রোজ যাবো৷ তাহলে সমস্যাটা কোথায়? আর দুইদিন না যেতেই তোমার কেন মনে হচ্ছে যে, ওর জন্য কষ্ট হয়ে যাচ্ছে? ও তোমাকে বলেছে কিছু?”
কথাগুলো বলেই রাজিতার দিকে তাকালো আনান। আনানের ইঙ্গিত বুঝতে পেরে রাজিতা মাথা ঝাঁকালো।
রাজিতার দিকে ওভাবে তাকাতে দেখে আনানের মা বলল,
–“তুই ওর দিকে ওভাবে তাকাচ্ছিস কেন? ও কিছু বলেনি। আমি নিজেই বলছি। সামনের মাসেইতো কোয়ার্টার দিতে চেয়েছে, নিয়ে নে।”
রাজিতা এবার মুখ খুলল,
–“না মা! এসব আপনি কি বলছেন! আপনারা থাকতে আমরা আলাদা বাসায় কেন উঠব? আর আমার কোনো সমস্যা হবেনা৷ আজ প্রথমতো তাই একটু সমস্যা হয়েছে৷ দুয়েকদিন গেলেই অভ্যাস হয়ে যাবে।”
তারপর আনান বলল,
–“মা তুমিও ইদানীং বেশি বোঝা শুরু করে দিয়েছো৷ তোমাদের কাছ থেকে দূরে যেতে দিবে না বলে আমাকে বিদেশে পড়তে যেতে দিলে না! আর এখন নিজেরাই দূতে যেতে বলছো! আজব!”
আনানের মা হাসতে হাসতে বলল,
–“এই দূর কি সেই দূর রে বাবা! ও তুই বুঝবি না। তখন ভয় ছিলো যে, বিদেশে পড়তে দিলে কোন বিদেশিনীর খপ্পড়ে পড়বি, শেষে আমাদের ভুলেই যাবি! এখনতো আর সেই ভয় নেই। আর তাছাড়া বেশি দূরেতো নয়৷ ছুটির দুইদিন আমাদের সাথে থাকবি, আমি আর তোর বাবাও গেলাম। ”
আনান খাবার খেতে খেতে বলল,
–“মা! তোমাদের মাথায় এসব আজগুবি লজিক কে ঢুকায় বলোতো! আজ যা বললে বললে, নেক্সট যেন এমন কথা আর না শুনি।”
আনানের মা এবার রাজিতার দিকে তাকিয়ে বলল,
–“রাজিতা! তুই-ই একটু বোঝাতো!”
রাজিতা এক ঢোক পানি খেয়ে নিয়ে বলল,
–“উনিতো ঠিক-ই বলেছেন। আমি আপনাদের কাছে আসতে না আসতেই আমাকে দূরে ঠেলে দিতে চাচ্ছেন। আমি কি আপনাদের জ্বালাচ্ছি খুব? আমিতো ভাবছি যে, আমি আমার বাবা-মাকে ফিরে পেয়েছি৷ আর আপনারা আমাকে তাড়ানোর ধান্ধায় আছেন।”
আনানের মা এবার হাসতে হাসতে বলল,
–“আচ্ছা তোদের কথাই থাকবে৷ কোয়ার্টারে উঠতে হবেনা। তবে আমার একটা কথা শুনতে হবে।”
আনানের খাওয়া শেষ। ও টেবিল থেকে উঠতে যাচ্ছিলো, ওর মায়ের কথা শুনে আবার বসতে বসতে বলল,
–“বলো, কি বলতে চাও?”
–“কোয়ার্টারে তোদের থাকতে হবে না। কিন্তু নিয়ে নে।”
আনান এবার রেগে গিয়ে বলল,
–“এ আবার কি ধরনের কথা! থাকতে হবে না, তাহলে কোয়ার্টার নেবো কেন?”
–“নিবি কারণ তোদের যার যখন ক্লাস আগে শেষ হয়ে যাবে সে তখন ওখানে গিয়ে বিশ্রাম করতে পারবি। বেশি ক্লান্ত থাকলে ওখান থেকে বিশ্রাম নিয়ে ধীরে-সুস্থে বাসায় আসবি। আমিও গেলাম তোদের ভার্সিটি দেখতে, তখন ওখানে গেলাম।”
আনান হাসতে হাসতে বলল,
–“মা, কিছু সময় কাটানোর জন্য ওখানে আমার রুম আছে। আর রাজিতার জন্য ক্যান্টিন, লাইব্রেরি, ক্লাস সব পড়ে আছে। এসব নিয়ে তোমায় ভাবতে হবেনা।”
–“আমি বলেছি কোয়ার্টার নিবি। ব্যস! থাকিস আর না থাকিস কোয়ার্টার নিবি, এটাই আমার শেষ কথা! ”
বলেই উনি টেবিল থেকে উঠে গেলেন। উনার খাওয়া আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিলো। আনান ওর বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
–“বাবা! তুমি কিছু একটা বলো!”
ওর বাবার খাওয়া তখনও শেষ হয়নি। উনি আরাম করে খেতে-খেতে বললেন,
–“আমি আর কি বলব! তোর মা ঠিক-ই বলেছে। কোয়ার্টার নিয়ে রাখতে ক্ষতি কি! যেকোনো সময় কাজে লাগতে পারে।”
–“বাবা! তুমিও না!”
বলেই আনান হাত ধুয়ে সোজা রুমে চলে গেলো।
রাজিতাও হাত ধুয়ে আনানের পিছু-পিছু রুমে চলে গেলো।

চলবে……

#অপরাজিতা
#১২তম_পর্ব
#স্নিগ্ধতা_প্রিয়তা

আনান রুমে এসে রাগটাকে একটু কন্ট্রোল করার চেষ্টা করল। ও বুঝতে পারছে না যে ওর মা হঠাৎ বাসা কেন নিতে বলছে। রাজিতা আবার কিছু বলেনিতো! রাজিতার কথা ভাবতে না ভাবতেই রাজিতা রুমে এসে উপস্তিত।
আনান বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে বালিশ ঠিক করতে করতে রাজিতাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
–“তুমি কি মাকে কিছু বলেছো?”
রাজিতা আনানকে পাশ কাটিয়ে বিছানার উপরে উঠে বসতে বসতে বলল,
–“কোন ব্যাপারে? ”
–“কোন ব্যাপারে এখনো বুঝতে পারছো না?”
–“বাসার ব্যাপারে? ”
–“হুম।”
–“আপনার কি মনে হয় আমি কিছু বলেছি?”
আনান রাজিতার পাশে বসে বলল,
–“না। আমি জানি তুমি কিছু বলোনি। কিন্তু মায়ের মাথায় বাসা নেওয়ার কথা কে ঢুকাতে পারে সেটাইতো বুঝছি না।”
–“আচ্ছা ওসব বাদ দিন। মা যখন বলছে, নিবেন। বাসা নিলেই যে ওখানে গিয়ে থাকতে হবে তাতো নয়।”
–“তুমি বলছো তাহলে?”
–“হুম। মা রাগ করবেন না হলে৷ একটা সিম্পল বিষয় নিয়ে এভাবে রাগারাগি করাটা ঠিক নয়। আপনিই বলেছেন।”
–“আচ্ছা।”

আনান রাজিতার কোলের উপরে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ল, রাজিতা বাধা দিতে গিয়েও দিলো না। দুইহাত দিয়ে আনানের মাথাটা টিপে দিতে লাগলো।আনান রাজিতাকে বলল,
–“মাথা টিপে দিতে হবেনা। একটু বউয়ের কোলে মাথা রাখার ইচ্ছে হলো, তাই রাখলাম। তুমি ঘুমাবে না?”
–“সারাদিন অনেক ঘুমিয়েছি৷ সহজে কি আর ঘুম আসবে নাকি! আপনি বরং ঘুমান। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি, দেখবেন তাড়াতাড়ি ঘুম চলে আসবে।”
–“তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লে তোমার স্পর্শগুলো অনুভব করব কি করে! তোমার মুখ থেকে যে কথাটা শুনব বলে অপেক্ষায় আছি, তা তুমি এভাবে বলে দিবে বুঝতেই পারিনি। আরেকবার বলতে পারবে?”
রাজিতা লজ্জায় আনানের মাথা থেকে হাত সরিয়ে নিচ্ছিলো আনান তা টেনে ওর হাতের মুঠোয় বন্দী করল। রাজিতা বলল,
–“কি?”
–“থ্রি ম্যাজিক্যাল ওয়ার্ড!”
রাজিতা আনানের শক্ত মুঠো থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে বলল,
–“আপনি কি আমাকে সত্যিই ভালবাসেন?”
–“নিজের বউকে ভালবাসার প্রমাণ দিতে মরতেও রাজি!”
–“এমন কথা আপনার মুখে শোভা পায়না!”
–“কেন? আমি কি একটু রোমান্টিক হতে পারি না বউয়ের সাথে!”
রাজিতা লজ্জায় এইটুকুন হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে ও ভরহীন হয়ে শূন্যে ভাসছে। আনান যে এমন কথা বলতে পারে ওর ভাবতেই কেমন লাগছে। ওকে চুপ থাকতে দেখে আনান বলল,
–“তুমি চাইলে আমি তোমাকে সারাজীবন ও সময় দিতে পারি। ”
–“কিসের জন্য?”
–“আমাকে জানার জন্য।”
–“আমি জানিনা একজন মানুষকে জানতে ঠিক কতটা সময় লাগে৷ তবে আপনাকে জানার জন্য আমার কাছে এই কয়টা দিনই যথেষ্ট ছিল।”
–“তারমানে বলতে চাইছো, তুমি আমাকে জেনে গেছো? ”
–“হয়তোবা!”
–“এখন কি এই অধমকে বিশ্বাস করা যেতে পারে?”
–“হুম! আল্লাহ নিজে যেখানে আমাদের এই পবিত্র বন্ধনে বেধে দিয়েছেন, সেখানে আমি কে তা ছিন্ন করার!”
–“তাহলে একবার বলো ‘ভালবাসি’!”
আনানের মুখে ভালবাসি কথাটা শুনেই রাজিতা এবার নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিলো। আনান এখনো ওর কোলে মাথা দিয়ে রেখেছে। আনান এবার উঠে রাজিতার কাঁধে হাত রেখে বলল,
–“বলবেনা?”
রাজিতা কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। সবার এত ভালবাসা উপেক্ষা করার শক্তি যে ওর নেই। যে খাঁচায় অলরেডি বন্দী হয়ে গেছে সে খাঁচা থেকে পালানোর থেকে মানিয়ে নেওয়াটাই ভালো। রাজিতা সাহস করে আনানের চোখে চোখ রেখে বলল,
–“ভালবাসি!”
আনানের কানদুটো যেন প্রশান্তিতে ডুবে গেলো। রাজিতার বলা কথাটা বারবার কানে বাঁজতে লাগলো। রাজিতাকে দেখার পর থেকে আনান এই দিনটার আশাতেই ছিলো। আজ ও ওর ভালবাসাকে পূর্ণতা দিবে। আল্লাহ ছাড়া কেউ হয়ত ওদেরকে আলাদা করতে পারবে না।
রাজিতাও যেন এতদিনে ওর বেঁচে থাকার আসল মানে খুঁজে পেলো৷ এই দিনটার জন্য, এই ভালবাসাগুলোর জন্যই হয়ত আল্লাহ ওকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। ভালবাসা পাওয়ার চেয়ে নাকি ধরে রাখাটা কঠিন! আনান আর রাজিতা কি পারবে চিরদিন এভাবে ওদের ভালবাসাটাকে ধরে রাখতে! নাকি কোনো ঠুনকো ঝড় এসে ওদের জীবনটাকে তছনছ করে দিবে! সেটা কেউ জানেনা!

সকালে উঠে আনান দেখল যে রাজিতা নেই। ও উঠে ফ্রেস হয়ে নাস্তা করতে গেলো। দেখলো রাজিতা ওর মায়ের সাথে বসে গল্প করছে৷ রাজিতা আজ এত সকাল সকাল উঠেছে দেখে আনানের ভালো লাগলো। হাসিমুখে ওর মায়ের সাথে গল্প করছে দেখে ওর আরো ভালো লাগলো।

ভার্সিটি যাওয়ার জন্য বের হতে যাবে তখন আনানের মা আনানকে উদ্দেশ্য করে বললো,
–“আজ আসার সময় রাজিতাকে নিয়ে একটু ওর চাচার ওখান থেকে ঘুরে আসিস। মাঝেমধ্যে ওখানে গেলে একটু মনটাও ভালো লাগবে।”
–“আচ্ছা। ”
বলেই আনান আর রাজিতা বের হয়ে গেলো।

রাজিতার বন্ধুরা আনানকে অনেক সম্মান দিয়ে চলছে। আনানকে দেখলেই সবাই কাচুমাচু হয়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটা আনানের কাছে কেমন যেন বেমানান লাগছে৷ আনান ভাবলো যে, ওদের প্রোগ্রামে রাজিতার ফ্রেন্ডদেরকেও ইনভাইট করবে৷ ওখানে একটু ফ্রিলি কথা বললে হয়ত এই অস্বস্তিটা কাটবে।

সেদিন ক্যাম্পাস থেকে ফেরার সময় আনান আর রাজিতা ওর চাচার বাসায় গেলো। আনান নিশাদের ব্যাপারে উনাদের জানালে উনারা রাজি হয়ে গেলো। সামনের সপ্তাহেই নিশাদ চাইলে নিলাকে দেখতে যেতে পারে।

ভালই চলছে আনান আর রাজিতার খুনসুটিময় ভালবাসা!

আজ নিলাকে দেখতে আসবে নিশাদের বাসা থেকে। নিশাদের বাবা একজন কলেজের শিক্ষক ছিলেন। এখন অবসর নিয়েছেন। নিশাদের বড় একবোন ছিলো বিয়ে হয়ে একটা মেয়ে হয়েছে। আর ওর ছোটবোন এইবার কলেজে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে।

রাজিতা আর আনান ও ওর চাচার বাসায় যাবে। নিশাদ বারবার করে ফোন করে ওদের যেতে বলেছে। বিকেল হতে চলল এখনো রাজিতা রেডি হয়নি দেখে আনান ওকে তাড়াতাড়ি করতে বলার জন্য রুমে ঢুকল। কিন্তু রুমে ঢুকেতো আনান পুরাই অবাক! ও যেন এক নতুন রাজিতাকে দেখছে৷ কালো রঙের শাড়িতে রাজিতার মুখটা চাঁদের মতো জ্বলজ্বল করছে। আনান এই প্রথম রাজিতাকে শাড়ী পড়ে দেখছে,তাও আবার কালো শাড়ী!
শিমলা ভাবি শাড়ীটা পড়িয়ে দিয়েছে৷ তাছাড়া রাজিতার সাধ্য নেই যে, শাড়ী পড়বে৷ ওর শাশুড়ী বলছিলো শাড়ী পড়ে যাওয়ার কথা। হাজারহোক নতুন বউ। নিশাদের বাবা-মা আসবে৷
আনান রাজিতার উপর থেকে যেন চোখ সরাতেই পারছে না।

রাজিতা ঠোঁটের লিপস্টিকটা ঠিক করছিলো, ঠিক করে পেছনে তাকাতেই দেখলো আনান ওর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রাজিতা ওর সামনে থেকে দরজার দিকে যেতে যেতে বলল,
–“চলুন। আপনি না বলছিলেন যে, দেরি হয়ে যাচ্ছে৷ এখন আবার দাঁড়িয়ে পড়লেন কেন?”
আনান ওর দিক থেকে চোখ না সরিয়েই বলল,
–“অপূর্ব! ”
–“কি?”
–“তোমার মাথা। এতসুন্দর মুডটাই নষ্ট করে দিলে। ”
–“আমি আবার কি করলাম? আপনিইতো বললেন যে…”
–“দেখতেই পাচ্ছো যে, আমি আমার দশটা না! পাঁচটা না! একটামাত্র বউকে মুগ্ধ নয়নে দেখছি! সেখানে তোমার নাকটা না গলালে হতো না!”
রাজিতা আনানের কাছে এগিয়ে এসে ওর চোখে চোখ রেখে বলল,
–“তাই নাকি! আচ্ছা, এই নিন দেখুন! বউকে দেখার সময় বুঝি আপনার সময় থমকে যায়! নাকি ৬০০ সেকেন্ডে মিনিট হয় তখন!”
–“তুমি পাশে থাকলে সময় যেন সত্যিই থমকে যায়।”
আনান কথাটা বলে রাজিতার আরো কাছে এগিয়ে যেতে থাকে। এমন সময় ওর মায়ের গলা শুনতে পায়,
–“আনান! রাজিতা! তোদের হয়নি এখনো? এই না বললি দেরি হয়ে যাচ্ছে! তোদের ব্যাপার-স্যাপার কিছু বুঝি না বাপু৷ ”

ওর মায়ের তাড়া দেখে দুজনেই তাড়াতাড়ি বের হয়ে গেলো। ওদিক থেকে নিশাদরাও রওয়ানা দিয়েছে।

গাড়িতে উঠেই আনান রাজিতার কানে ফিসফিস করে বলতে লাগলো,
–“আজ হঠাৎ শাড়ী কেন?”
রাজিতাও আনানের মতো ফিসফিসিয়ে বলল,
–“মা বলেছিলো। কেন?”
–“না! ওখানে কত লোকজন থাকবে, যদি আমার মিষ্টি বউটার নজর লেগে যায়!”
রাজিতা হাসতে হাসতে বলল,
–“আপনি আবার এসবে বিশ্বাস করা শুরু করলেন কবে থেকে!”
–“কোনসব?”
–“এই যে, নজর লাগা!”
–“আরে বুদ্ধু! আমিতো কথার কথা বললাম! তুমি এত সুন্দর করে শাড়ী পড়তে পারো আগে বলোনি কেন?”
–“আগে বললে কি করতেন?”
–“তোমার এই মোহনীয় রূপটা অনেক আগেই দেখতাম!”
–“আপনাকে কে বললো যে, এই শাড়ী আমি নিজে পড়েছি!”
–“তাহলে?”
–“শিমলা ভাবি পড়িয়ে দিয়েছে। ”
–“তাহলেতো শিমলা ভাবিকে মাঝেমধ্যেই ঘুষ দিতে হবে।”
–“কেন?”
–“তোমার এই অপরূপ রূপ দেখার জন্য একটু-আধটু ঘুষ দেওয়া যেতেই পারে।”

ওরা দুজন গল্প করতে করতে গন্তব্যে পৌঁছে যায়।
নিশাদরা ওদের আগেই এসে পড়েছে। রাজিতারা বাসায় ঢুকতেই নিশাদ সেদিনের মতই হাঁ করে তাকিয়ে আছে রাজিতার দিকে। রাজিতা বুঝতে পারল যে, সুবহার মতো দেখতে বলেই নিশাদ ওর দিকে ওভাবে তাকিয়ে আছে। তাই আর কিছু না বলে নিলার রুমে চলে গেলো।

নিলাকে আজ অনেক সুন্দর লাগছে৷ খয়েরী রঙের একটা ড্রেস পড়েছে, যা ওকে অনেক সুন্দর মানিয়েছে। রাজিতা নিলাকে দেখে বলতে লাগলো,
–“বিশ্বাস করো আপু, আজ তোমাকে দেখে নিশাদ ভাইয়ার যদি পছন্দ না হয়, তাহলে পৃথিবীর কোনো মেয়েকেই তার পছন্দ হবে না!”
নিলা লজ্জা পেলো।রাজিতা আবার বলল ,
–“আমি কিন্তু একটুও বানিয়ে বলছি না! সত্যিই বলছি। তাই না রিমি?”
বলেই রিমির দিকে তাকালো রাজিতা। রিমিও রাজিতার সাথে তাল মিলিয়ে বলল,
–“রাজি একদম ঠিক বলেছে। দেখা যাবে শুধু নিশাদ ভাইয়াই না, অন্যকোন ভাইয়াও পাগল হয়ে যেতে পারে!”
কথাটা যে আনানকে উদ্দেশ্য করে বলল তা বুঝতে পেরে রাজিতা বলল,
–“খুব কথা শিখেছিস। তাই না! দাড়া নিলা আপুর পালা শেষ হলেই চাচ্চুকে বলব তোর একটা ব্যবস্থা করার জন্য।”
রিমি হাসতে হাসতে বলল,
–“আমিতো এক-পায়ে রাজি, ডেকে আনো কাজি!”
বলেই রাজিতাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ওখান থেকে চলে গেলো রিমি।

নিলা আজ একটু চুপচাপ আছে। সেদিন নিশাদকে দেখে ওরও পছন্দ হয়েছিলো কিছুটা। তাই ও ব্যাপারটা নিয়ে খুব এক্সাইটেড! নিশাদের বাবা-মা ওকে পছন্দ করবে কিনা!
কিছুক্ষণ পর নিলার মা এসে ওকে নিশাদের পরিবারের সামনে নিয়ে গেলো।

নিলা কথাবার্তায় একটু বেখাপ্পা হলেও মেয়ে হিসেবে ততটাও খারাপ নয়! এটা রাজিতার কথা। আনান কনফিউজড ছিলো যে, নিশাদের জন্য নিলা পারফেক্ট হবে কিনা! কিন্তু রাজিতা ওকে আস্বস্ত করেছে৷ রাজিতা বলেছে,নিলা অতটাও খারাপ নয় যতটা আনান ভাবে! যত যাইহোক না কেন, রাজিতাকে উনারাই পেলে-পুষে এত বড় করেছেন। তাদের প্রতি অকৃতজ্ঞতো আর হওয়া যাবে না। উনারা না থাকলে হয়ত রাজিতার আশ্রয় কোথায় হতো তা ও নিজেও জানেনা। কেননা ওর নাকি একটা মামা আছে, রাজিতার বাবা-মা মারা যাওয়ার পর কোনদিন খোঁজও নেয়নি এই ভয়ে যে, যদি ভাগ্নির ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে হয়! আর সেখানে এরা এতবছর ধরে ওর দেখাশোনা যেভাবেই হোক করেছেতো। একটা মেয়েকে ভার্সিটি পর্যন্ত আনতে কত কাঠকয়লা পোড়াতে হয় তা সেই বাবা-মাই জানে! রাজিতার মুখে এসব শুনেই আনান রাজি হয়ে গেছে। আল্লাহ যদি নিশাদ আর নিলার জুড়ি লিখে রাখেতো হবে৷ আর না রাখলে না হবে। চেষ্টা করতেতো ক্ষতি নেই!

নিলাকে দেখে নিশাদের বাবা-মা খুব পছন্দ করেছেন। উনারা চাচ্ছিলেন যে, তাড়াতাড়িই বিয়ের পার্টটা সেরে নিতে। কিন্তু নিলার বাবা বললেন,
–“আমাদের কোনো সমস্যা নেই, তবে আমার ছেলেটা এখন দেশের বাইরে আছে। সামনের মাসেই ফিরবে, তাই চাচ্ছিলাম যে, ও আসার পরেই পাকা কথা বলি, নাকি?”
একথা শুনে নিশাদের বাবা হাসতে হাসতে বললেন,
–“হ্যাঁ, সেটাইতো ভালো হবে৷ বোনের বিয়ে আর ভাই থাকবে না! এটাতো মেনে নেওয়া যায়না। আমি নিজে হলেওতো তাই করতাম।”
–“আর কিছু মনে করবেন না কিন্তু!”
–“আরে ভাই কি মনে করব! এখনতো আমরা এক পরিবার হতে চলেছি। আল্লাহ আমাদের মিলিয়ে দিয়েছেন!”
নিলার বাবা আর নিশাদের বাবার গল্প ভালই জমে উঠেছে। নিশাদ আর নিলাকে আলাদা কথা বলতে পাঠিয়েছে। ওরা ছাদে গেছে, ওখান থেকে ফিরলেই উনারা চলে যাবেন।

একটু পরেই রিমি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে রাজিতার হাত ধরে টানতে টানতে ওর রুমে নিয়ে গেলো। রিমির ব্যবহারে রাজিতা অবাক হয়ে বলল,
–“কিরে, বড়দের সামনে থেকে আমাকে ওভাবে গরুর মতো টানতে টানতে আনলি কেন?”
রিমি এতক্ষণ অনেক কষ্টে হাসি চাপিয়ে রেখেছিলো। এইবার জোরে হেসে উঠল।
রাজিতা বলল,
–“তুই কিছু বলবি? নাকি হাসি থামাবি?”
রিমি হাসি কিছুটা থামিয়ে বলল,
–“আমি কি সাধে হাসছি! নিলা আপু আর নিশাদ ভাইয়ার কথা শুনে হাসি আটকে রাখতে পারছিলাম না।”
–“কেন? কি হয়েছে? আর তুই লুকিয়ে লুকিয়ে ওদের কথা শুনছিলি? ”
–“তো কি হয়েছে! তুই না শুনলে যা।”
বলেই আবার হাসতে লাগলো রিমি। রাজিতার নিজেরও শুনতে মন চাচ্ছিলো, কি এমন কথা হয়েছে নিলা আর নিশাদের মধ্যে যে, রিমি হাসিই থামাতে পারছে না।
–“বল, কি শুনলি?”
–“নিশাদ ভাইয়া প্রথমেই নিলা আপুকে কি জিজ্ঞেস করেছে জানিস?”
–“তুই না বললে কি করে জানবো! আমি কি জ্যোতিষী নাকি!”
–“তাহলে শোন! নিশাদ ভাইয়া নিলা আপুকে কাঁপা-কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করছিলো,’আমাকে কি আপনার পছন্দ হয়েছে?'”
–“ধুর! এতে এতো হাসির কি হলো! এটা কোনো হাসির কথা হলো!”
–“তারপর নিলা আপু লাজুক হেসে বলল,’আমার বাবা-মায়ের পছন্দ হলেই আমার পছন্দ!'”
–“এতে হাসির কি হলো আমিতো কিছুই বুঝলাম না। আমার সময় নষ্ট না করে সর এখান থেকে। শুধু-শুধু আমাকে টেনে আনলো!”
বলেই রাজিতা হনহন করে রুম থেকে বের হয়ে এলো।রিমি তখন বলতে লাগলো,
–“আরে আসল কথাটাইতো শুনলি না!”
–“তোর আসল কথা তুই-ই শোন।”
বলতে বলতে রিমির চোখের আড়াল হয়ে গেলো রাজিতা।

চলবে……