#অপূর্ণতায়_পূর্ণতা
#তানজিলা_তিহা (লেখনীতে)
#পর্ব_১৫
‘রাস্তা শুকানোর পর বের হলে কি হতো ইশা? দেখেছিস কি কাঁদা জমেছে।’ মলিন মুখ করে বললো তনয়া।
‘তা তো জমবেই। দেখেছিস কাল বিকেলে কেমন বৃষ্টিটাই না হলো!’
‘তাই তো বলেছি বিকেলে বের হতাম। রাস্তা একটু শুকাতো।’
‘তরী অসুস্থ শুনেছিস? মেয়েটার কোন খোঁজ নেই তিন দিন ধরে। ওকে দেখে আসা প্রয়োজন। এই কাঁদা টাদায় কিছু হবে না।’
‘তরীর কি হয়েছে রে?’
‘শুনলাম হাড় কাঁপানো জ্বরে ভুগছে।’
‘ওহ্। কিন্তু একটা কথা বুঝতে পারছি না। পরশু তোর জ্বর আর আজ তরীর এরপর সিরিয়াল কার রে?’
তনয়ার কথায় হেসে ফেললাম। বললাম, ‘তোর। এখন তাড়াতাড়ি পা চালা।’
দুজনেই পা চালিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। কর্দমাক্ত রাস্তা ধরে হাঁটছি আমি আর তনয়া। বৃষ্টি শেষে রাস্তার যেই অবস্থা হয় ঠিক তেমনটাই হয়েছে। মাটির রাস্তায় বৃষ্টি কণা পড়ে সৃষ্টি হয়েছে কাঁদার সমাহার। শুকনো জায়গা খুঁজে চলার প্রচেষ্টায় আছি। দু হাতে প্লাজোটা একটু উঁচু করে নিয়েছি। তারপরও পায়ে কাঁদার ছড়াছড়ি। কিন্তু তার পরও কেন জানি ভালো লাগছে এই মুহূর্তটা। তনয়ার মুখটা মলিন হয়ে আছে। পা উঁচু করে হাঁটার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তনয়া। যাতে কাঁদা পা ছুঁতে না পারে তাই এই ব্যবস্থা। তনয়ার হাঁটা দেখে বেশ আশ্চর্য হচ্ছি। দুটো পাকেই উঁচু করে হাঁটছে। যেই কোন মুহুর্তেই পড়ে যাবে ও।
‘তনয়া এভাবে হাঁটিস না পড়ে যাবি। স্বাভাবিক ভাবে হাঁটতে থাক। সামনে ডোবা আছে কিন্তু। তরীদের বাড়ি গিয়ে পা ধুলেই হয়ে যাবে। এইতো চলে এসেছি আর একটু পথ।’
‘আমার কাঁদা ভালো লাগে না। আমি এভাবেই হাঁটবো। অনেক আনইজি লাগে।’
‘আরে পড়ে….’
আমি আর বলতে পারলাম না। ধপ করে পড়ে গেলো তনয়া। ডোবায় পড়ে গায়ে বয়ে গেলো জমানো কাঁদার ছড়াছড়ি। জামাকাপড়ে লেপ্টে গেলো কাঁদার সমাহার। ময়লা পানিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে ওর দেহটা। আমি জোরে জোরে হাসতে শুরু করলাম।
‘বলেছিলাম না পড়ে যাবি। আমার কথা কি আর শুনলি? অর্পণ থাকলে ভালো হতো। তোর এই মুহূর্তটাকে ও স্মরণীয় করতে খুব সাহায্য করতো।’
তনয়া মুখ ফুলিয়ে রইলো। নিজের অবস্থা বোঝার চেষ্টা করছে ও। চোখে মুখে কান্নার ভাব চলে এসেছে। চোখের চশমাটা কাঁদার সাথে লেপ্টে আছে। চশমাটা উঠিয়ে হাতে নিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো তনয়া। চশমার গ্লাস দুটো কাঁদার রঙ ধারণ করেছে। আমি তনয়ার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললাম,
‘উঠে আয় জলদি। কেউ এসে দেখলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। হাসির পাত্র হবি।’
মুখ ফুলিয়ে থাকা তনয়া এবার কেঁদে দিলো। বলতে লাগল, ‘তোর জন্য হয়েছে সব। তুই যদি না বলতিস তাহলে আমি পড়তাম না।’
‘আমার বলা শুনেই পড়ে গেলি?’ আমি আবার হাসতে লাগলাম। তনয়া রাগী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি কিছুটা দূরে সরে গেলাম।
‘আরে ইশারা! তুমি এখানে? এতো সকালে কোথায় যাচ্ছো?’
আকস্মিক কারো কণ্ঠস্বরে হকচকিয়ে গেলাম। পিছন ফিরে দেখলাম ফাহাদ ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে। আমি মিষ্টি হেসে বললাম, ‘কেমন আছেন ভাইয়া?’
‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি?’
‘আলহামদুলিল্লাহ।’
‘কোথায় যাচ্ছো? এই বৃষ্টিতে বের হয়েছো কেন?’
‘আমার বান্ধবী তরীর বাসায়। ও অসুস্থ।’
এর মাঝেই তনয়া বলে উঠলো, ‘ইশা আমাকে উঠা।’
তনয়ার কাছে চলে গেলাম। ফাহাদ ভাইয়াও আসলেন।
‘আরে এটা কে? এই পঁচা ডোবার মধ্যে কি করছেন উনি? ছিঃ গা থেকে বিশ্রি গন্ধ আসছে।’ বলে পকেট থেকে টিস্যু পেপার বের করে নাকে ধরলেন ফাহাদ ভাইয়া।
তনয়ার রাগের মাত্রা বেড়ে গেলো। ফর্সা মুখ লাল হয়ে গেলো।
‘ভাইয়া ও আমার বান্ধবী তনয়া।’
‘সরি। উনি এভাবে কাঁদায় নেমেছেন কেন?’
‘পা পিছলে পড়ে গেছে ভাইয়া।’
ওহ্। এরপর ভাইয়া তনয়ার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘এই মিস উঠে আসুন। আপনাকে আর কাঁদায় গড়াগড়ি খেতে হবে না।’
আরেক দফা মুখ ফুলিয়ে নিলো তনয়া। রাগে তার শিরা উপশিরা শক্ত হয়ে আসছে। নিঃশ্বাসের জোর শব্দ শোনা যাচ্ছে। আমি পিছন সরে গেলাম। যেকোন সময়ে এট্যাক হতে পারে।
‘ফাহাদ ভাইয়া! ওকে উঠতে একটু হেল্প করেন প্লিজ। আমি একা পারবো না।’
আমার কথা মতো ফাহাদ ভাইয়া তনয়ার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। তনয়া খিলখিলিয়ে হেসে হাত ধরলো। কিন্তু হঠাৎই আরেক দফা আওয়াজে ডোবার পানি চারপাশে ছিটকে পড়লো। আমি দূরে সরে গেলাম। দেখলাম ঠিকই তনয়া উপড়ে উঠে এসেছে কিন্তু ফাহাদ ভাইয়া নেই। ফাহাদ ভাইয়া ডোবার জলে গড়াগড়ি খাচ্ছেন। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। তনয়া হাত পরিষ্কার করে বললো,
‘আরে এটা কে? এই পঁচা ডোবার মধ্যে কি করছেন উনি? ছিঃ গা থেকে বিশ্রি গন্ধ আসছে।’
ফাহাদ ভাইয়া অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি তনয়ার রিভেঞ্জ নেওয়া দেখে হেসে ফেললাম। তনয়া আমার কাছে এসে বললো,
‘এখন বাড়ি যাবো। কি হাল হয়েছে দেখেছিস? বিকেলে না হয় তরীকে দেখতে যাবো।’
আমি মাথা নাড়িয়ে হাঁটা শুরু করলাম। ফাহাদ ভাইয়া অসহায় ভাবে তাকিয়ে আছেন এখনো। হয়তো তনয়ার কাণ্ড তার মস্তিষ্কে এখনো নিতে পারে নি।
____________________
‘এই যে মিস্টার! আপনার তো দেখাই পাওয়া যায় না! কোথায় থাকেন আপনি? হু! আপনাদের বাড়িতে আসলাম কোথায় একটু ঘুরিয়ে টুরিয়ে সব দেখাবেন তা না আপনাদের কোন খবরই নেই? কি আশ্চর্য!’
কিছু শব্দ কানে আসতেই থমকে দাঁড়ালো অরিদ্র। মাত্রই হাসপাতালে যাওয়ার জন্য বের হয়েছিলো সে। কিন্তু মাঝ পথে তাকে থামিয়ে দিলো কেউ। পিছন ফিরে অরুনিকে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। অরুনি প্রফুল্ল হয়ে তার কাছে এসে দাঁড়ালো। বললো,
‘কোথায় যাচ্ছেন আপনি?’
‘জ্বি, হাসপাতালে।’
‘ওহ্। কখন ফিরবেন?’
‘ঠিক নেই।’
‘ঠিক নেই কেন? আপনি বিকেলের মধ্যেই ফিরবেন। এরপর আপনাদের এড়িয়াটা আমাকে ঘুরে দেখবেন। অনেক মজা হবে।’
বেশ আশ্চর্য হলো অরিদ্র! মেয়েটা কি চাচ্ছে? তার হাব ভাব তো ভালো ঠেকছে না। কিছুক্ষণ চিন্তা ভাবনা শেষে অরিদ্র শান্ত ভাবেই বললো,
‘দেখুন অরুনি আমি বলতে পারবো না আমি কখন ফিরবো। প্লিজ জোর করবেন না। আমার অনেক কাজ থাকে।’
পকেট থেকে চশমাটা বের করে চোখে দিয়ে পা চালালো অরিদ্র। অরুনি বিষন্ন হয়ে গেলো। লোকটা কি তাকে বুঝে না? তার কথা গুলো শুনতে চায় না?
‘ওমন করে কি দেখছো অরুনি আপু?’ অবনীর কণ্ঠস্বরে ধ্যান ফিরলো অরুনির। বললো,
‘কিছু না। একটা কথা বলবে?’
‘বলে ফেলো।’
‘তোমার ভাইয়া এতো গম্ভীর কেন?’
‘অরিদ্র ভাইয়ার কথা বলছো? অরিদ্র ভাইয়া এমনই। গম্ভীর থাকাটা তার জন্মগত বৈশিষ্ট্য। বুঝেছো?’
অরুনি মাথা ঝুলালো।
___________________
‘এখন কেমন লাগছে তরী? এতো জ্বর কখন এলো?’ তরীকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করলাম।
ক্লান্ত তরী দু ঠোঁট প্রসারিত করে বললো, ‘জানি না হঠাৎই।’
‘বুঝতে পারছিস না কেন? নিশান ভাইয়ার আশার খবর শুনে বেচারির আগেই কাঁপা কাঁপি শুরু হয়ে গেছে।’ চোখ টিপ দিয়ে বললো রুম্পি।
ক্লান্ত শরীরে হেসে ফেললো তরী। বললো, ‘ইশা তোর ডাক্তার কই রে? সবার কাছে তাকে নিয়ে গল্প করছিস কিন্তু আমাকে বললি না?’
তরীর মুখে এ কথা শুনে বিস্মিত হলাম। সবাই কি শুরু করলো? আমি কখন তাকে নিয়ে গল্প করলাম? লোকটা তো অনেক অসহ্য! তার জন্য কত বিপাকে পড়তে হচ্ছে আমাকে!
রুম্পি বললো, ‘আরে সেই খবর আর কি বলবো! জানিস ইশার জ্বর হয়েছে শুনে তো বেচারা মরেই যাচ্ছিলো।’ বলেই রুম্পি, তনয়া আর তরী হাসতে লাগলো।
‘ফাজলামো করবি না রুম্পি। তার সাথে আমার এমন কোন সম্পর্ক নেই।’
‘ওহো। তো সম্পর্কটা কেমন ম্যাডাম?’ অসুস্থ তরীর মুখে এ কথা শুনে অবাক হলাম। অসুস্থ না হলে গালে পাঁচ আঙুলের দাগ বসিয়ে দেওয়াটা কোন ব্যাপার ছিলো না। মুখ ফুলিয়ে বললাম, ‘তুমি সুস্থ হ। তোর গালে পাঁচ আঙুলের দাগ বসিয়ে দিবো।’
রুম্পি বললো, ‘বা রে তুই দাগ বসাবি আর নিশান ভাইয়া দেখবে বুঝি? তার এতো সুন্দর বউটার তুলতুলে শরীরে তোর হাতের দাগ!! ভাইয়া তোকে আস্ত রাখবে?’
তরী লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে। গত মাসেই বিয়ের কথা পাকাপোক্ত হলো তার। আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে নিশান নামক যুবকের সাথে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হবে সে।
‘তা যা বলেছিস। আচ্ছা তোদের একটা কাহিনী শোনাই। একটা মজার কাহিনী। আজ সকালের কাহিনী। তনয়ার সাথে তোদের বাড়িতে…’
আমার মুখ চেপে ধরলো তনয়া। বললো, এই বলবি না বলেছি।
রুম্পি উৎসুক হয়ে বললো, এই তনয়া সর। বলতে দে না! একটু শুনি।
বেশ কিছুক্ষণ জোড়াজুড়িতে তনয়া আমায় ছেড়ে দিলো। আমার সকালের ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা দিলাম। সবাই অট্টোহাসিতে ফেটে পড়লাম তৎক্ষণাৎ। তনয়া মুখ ভার করে বসে থাকলো।
হঠাৎই ফোনের টুং টাং শব্দে সবাই চুপ হয়ে গেলাম। আমার ফোনটা বিকট শব্দে চিল্লাচিল্লি করছে। ফোন হাতে নিয়ে দেখলাম বাবা ফোন করেছে। ফোন রিসিভ করতেই বাবা যা বললো তাতে পাথর হয়ে গেলাম! হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেলো। আমি ব্যস্ত হয়ে বেড়িয়ে পড়লাম।
চলবে…..