অপূর্ণতায় পূর্ণতা পর্ব-১৬

0
487

#অপূর্ণতায়_পূর্ণতা
#তানজিলা_তিহা (লেখনীতে)
#পর্ব_১৬

রাত এগারোটা বেজে বিশ মিনিট। হাসপাতালের করিডোরে দাঁড়িয়ে আছি। দেয়ালে টাঙানো বড় সাইজের ঘড়িটার দিকে তাকাচ্ছি আর পায়চারী করে চলেছি। ভয় ছেয়ে গেছে আমার সর্বাঙ্গে। ঠাণ্ডা হয়ে গেছে সমস্ত শরীর। বাবা যখন ফোন করে বললেন আপু অসুস্থ ঠিক তখনই আমার মন কু ডাকতে শুরু করেছিলো। শেষে আমার ধারণা সত্যি হলো। ওয়াশরুম থেকে বের হতে গিয়ে পা পিছলে গেছে আপুর। এ ঘটনায় পড়ে না গেলেও দেয়ালের সাথে পেট ঠেকে পেটে প্রচুর ব্যাথা পেয়েছে আপু। আপুকে হাসপাতালে আনা হয়েছে বিকেলেই। ডাক্তার বলেছেন অসাবধানতাবশত এই অবস্থা হয়েছে। একটুর জন্য বেবি মিসক্যারেজ হয় নি। ডাক্তার বেশি বেশি রেস্ট নিতে বলেছেন। আপুকে ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে চার মাসের প্রেগন্যান্ট আপু। এই অবস্থায় যদি কিছু একটা হয়ে যেতো? আমাদের ছোট পুঁচকেটার যদি কিছু হয়ে যেতো? আর ভাবতে পারছি না। পাশেই থাকা বেঞ্চিতে গিয়ে বসে পড়লাম।

‘ভয় পাবেন না ইশারা। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।’
পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে সামনে তাকালাম। অরিদ্র দাঁড়িয়ে আছেন। তাকে ব্যস্ত দেখাচ্ছে।

‘এমন হলো কি করে? আপু ঠিক আছে তো?’

‘সব ঠিক আছে। আপনি চিন্তা করবেন না।’

কিন্তু এতে কি আর আতঙ্ক সরে? আমি চুপ করে রইলাম।

‘ইশারা আপনি বসুন। আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলে আসছি।’

আমি মাথা নাড়িয়ে হুম বললাম। অরিদ্র চলে গেলেন।

কিছু সময় একাই চুপ করে বসে রইলাম। হঠাৎই আপুর শাশুড়ি এসে আমার পাশে বসলেন। ভদ্র মহিলার মুখেও আতঙ্কের ছাপ। থাকবেই না কেন? প্রথম দাদি হতে চললেন এর মাঝেই একটা ভয়ংকর পরিস্থিতিতে পড়তে হলো। মহিলা বেশ চিন্তিত! ভদ্র মহিলা একবার আমার দিকে তাকালেন কিন্তু কিছু বললেন না। পাশের অপর বেঞ্চিতে বসে আছে মা বাবা।

সাদা এপ্রোন পরিহিত নারীটিকে এদিকে আসতে দেখে উঠে দাঁড়ালাম। অরিদ্রও সাথে আছেন। সাদা এপ্রোন পড়া নারীটি বললেন, ‘ভয়ের কারণ নেই। এখন মা বাচ্চা দুজনেই সুস্থ আছে‌। এখন থেকে সাবধানে চলাফেরা করতে বলবেন। এমন অসতর্ক হলে কিন্তু যেই কোন মুহুর্তে একটা বিপদ হতে পারে। আপনারা এখন ওনার সাথে কথা বলতে পারেন।’

ডাক্তার চলে গেলেন। আমি ব্যস্ত হয়ে কেবিনে ঢুকে পড়লাম। আপুকে বেশ ক্লান্ত লাগছে। আমি আপুর পাশে বসে পড়লাম। আপুর দিকে হাত বাড়িয়ে মাথায় হাত বুলাতে লাগলাম। আপু ক্লান্ত হাসলো। ভদ্র মহিলাসহ বাবা মাও কেবিনে। ভদ্র মহিলা ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখন কেমন লাগছে বউ মা?’

আপু হাসলো। বললো, ‘আমি ঠিক আছি মা।’

ভদ্র মহিলাও হালকা হাসলেন। বললেন, ‘এখন থেকে দেখে চলাফেরা করবে।’

আম্মু আপুকে বললো,

‘ঠিকমতো চলাফেরাটাও শিখলি না সিহা! যদি কিছু একটা হয়ে যেতো?’মায়ের ব্যস্ত স্বর।

‘ওহ্ মা আমি ঠিক আছি চিন্তা করো না।’

‘চিন্তা কি আর সাধে করি? কি হাল করলি নিজের?’

‘আমার কিছু হবে না দেখো। আমি ঠিক আছি মা।’

‘মা আপুকে রেস্ট নিতে দাও তো। আর কথা বলো না। এমনিতেই শরীর খারাপ।’

আমার কথায় চুপ হয়ে গেলো সবাই। আপু হেসে চোখ বন্ধ করে নিলো।

‘রাত অনেক হলো এবার বাসায় ফিরতে হবে। ভাবিকে সকালে রিলাইজ দিবে। ভাবির সাথে একজন থাকতে পারবে।’ হন্তদন্ত হয়ে বললেন অরিদ্র।
তার কথা শুনে আমি বলে উঠলাম, ‘আমি থাকবো আপুর সাথে!’

মা বললেন, তুই বাড়ি যা আমি থাকি। তুই কি রাত জাগতে পারবি নাকি?

‘অবশ্যই পারবো। তুমি যাও আমিই আপুর সাথে থাকবো।’
আমার জোর কণ্ঠে মা নিরাশ হলেন। আপুর শাশুড়ি আড় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। জানি না কেন এভাবে দেখছেন তিনি। কিন্তু তার তাকিয়ে থাকাটা ভালো লাগলো না বেশ অস্বস্তি বোধ হচ্ছে।

ভদ্রমহিলা বললেন, তোমরা সবাই বাড়ি যাও বউ মার জন্য আমি আছি। মুহূর্তেই মুখটা আমার কালো হয়ে গেলো। তার উপর কথা বলার সাহস পেলাম না। চুপ করে বসে থাকলাম।

অরিদ্র হয়তো ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছেন। তিনি হালকা হেসে বললেন, ‘থাক না মা। ইশারা যেহেতু থাকতে চাচ্ছে উনিই থাকুক। তুমি এমনিতেই অসুস্থ। আজ যা ধকল গেছে। বাড়ি গিয়ে রেস্ট নাও। আপনি একা থাকতে পারবেন তো ইশারা?’

‘অবশ্যই পারবো!’

ভদ্রমহিলা আরেক বার আমার দিকে তাকালেন। কিন্তু কিছু বললেন না। ধীর পায়ে প্রস্থান করলেন।

____________________

ফযরের আযানে সদ্য লেগে আসা চোখের পাতা খুলে ফেললাম। আপু বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। হাত মুখ ধুতে কেবিন থেকে বের হলাম। বাহিরে এসে অবাক হলাম। সামনের বেঞ্চিতে বসে আছেন অরিদ্র। চোখে তার রাজ্যের ঘুম। বার বার ঘুমে ঢলে পড়ছেন উনি।

‘আপনি যান নি অরিদ্র?’

তিনি হকচকিয়ে গেলেন। চোখ মুছতে বললেন, ‘না। আপনাকে একা রেখে যেতে ইচ্ছে হয় নি।’

‘আশ্চর্য তো!’

‘আপনাকে অনেক দিন পর দেখলাম ইশারা। এই সুযোগ আমি হাতছাড়া করি কি করে?’ বিড়বিড় করে বলতে লাগলো অরিদ্র।

‘কিছু বললেন আমাকে?’

‘না তো।’

.

বেলা হয়ে এসেছে। বাড়িতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। জিনিসপত্র যা ছিলো তা ব্যাগে তুলে নিলেন অরিদ্র। অতি সাবধানে আপুকে নিয়ে গাড়িতে চড়ে রওয়ানা দিলাম তাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে।

প্রায় এক ঘন্টা পর বাড়িতে এসে পৌঁছালাম। ঢাকা শহরের ট্রাফিকে আটকে পড়ে চলে গেছে অনেকটা সময়। আপুকে নিয়ে ভিতরে এলাম। কিন্তু ভিতরে এসে চোখ কপালে উঠে গেলো। অরুনি এখানে কি করছে? অরুনি দৌড়ে এসে বললো,

‘সিহা আপু তুমি ঠিক আছো তো?’

ভদ্র মহিলা আর মাও এগিয়ে এলেন। আপুকে নিয়ে রুমে শুইয়ে দিলাম। আপুর বিশ্রামের প্রয়োজন। সেখান থেকে সবাইকে সরিয়ে দিলাম। আপুর শরীর দুর্বল আপাতত আপুকে ঘুমোতে দেই।

.

‘ইশারা আপনি নিজেও এখন রেস্ট নিন। সারারাত তো ঘুমালেন না এখন একটু ঘুমিয়ে নিন।’

আমি সৌজন্য মূলক হাসলাম। বললাম, আমি ঠিক আছি।

আমি কি বলেছি আপনি ঠিক নন?

না।

তাহলে?

তার ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি। হতাশ হলাম। লোকটা পারেও বটে!

‘অভ্র ভাইয়া দেশে ফিরবে কবে অরিদ্র?’

‘সামনের সপ্তাহে। ভাইয়াকে এখনো গতকালের ঘটনা বলি না। টেনশন করবে।’

‘হুম ঠিক আছে। কিন্তু বলা উচিত ছিলো। যদি কিছু একটা হয়ে যেতো?’

‘হতো কিন্তু হয় নি ইশারা।’

‘আমার আপুকে এখানে ফেলে আপনার ভাইয়া বিদেশে কি করে? তার উপর আপু প্রেগন্যান্ট। এই সময়ে আপুর তাকে প্রয়োজন তা কি সে বুঝে না?’

‘প্রয়োজন তো! চলে আসবে ভাইয়া।’

আমি ব্যঙ্গ করে বললাম, ‘চলে আসবে কিন্তু আসে নি তো।’

‘আস…’

অরিদ্র তার কথা শেষ করতে পারলেন না। এর মধ্যেই আরেক কণ্ঠে তার নাম উচ্চারিত হলো।

‘অরিদ্র! আপনি কোথায়? এদিকে আসুন।’ বলতে বলতে আমাদের দিকে এগোচ্ছে অরুনি।

অরিদ্র আরুনির দিকে শান্ত ভাবে তাকালেন। শান্ত ভাবে বললেন, ‘কি হয়েছে অরুনি?’

অরুনি একবার আমার দিকে তাকালো। ‘আপনার সাথে কিছু কথা ছিলো অরিদ্র। প্লিজ এদিকে আসুন।’

অরুনির কথায় তাজ্জব বনে গেলাম। আমাকে দেখে এগুলো বললো না তো মেয়েটা? অরুনির কথাগুলো আমার প্রচণ্ড গায়ে লাগলো। আমার আত্মসম্মানে লাগলো। আমি এখানে তাই ও কথা বলতে পারছে না নাকি? পার্সোনাল কথা হয়তো। আমার এখানে থাকাটা শোভা পায় না।

‘তোমরা কথা বলো আমি আসি।’

আমি চুপচাপ সেখান থেকে সরে গেলাম। মনটা খারাপ হয়ে গেলো। আমাকে দেখে এভাবে বললো অরুনি? এই মেয়ে কি চাচ্ছে? হতাশ হলাম। একবার অরিদ্রের দিকে তাকিয়ে নিলাম। তার ফর্সা মুখশ্রীতে লাল আভা দেখতে পেলাম। জানি না এর কারণ কি! আমি নিরবে প্রস্থান করলাম।

___________________

মাথাটা বেশ ঝিম ধরে আছে। মাথায় হাত দিয়ে ড্রইং রুমে এসে বসলাম। তীব্র যন্ত্রনা অনুভব করছি মাথায়। এক কাপ চা প্রয়োজন। মাকে চা দিতে বললাম। বাবা বাড়িতে নেই।

কিছুক্ষণ পর মা চা হাতে আমার কাছে এলেন। আমি চায়ের কাপে চুমুক বসালাম। কিন্তু বাবার কণ্ঠ পেয়ে পিছন ফিরলাম। বাবা জোরে জোরে কথা বলতে বলতে ঘরে আসলেন। সাথে ফাহাদ ভাইয়া। বাবা মাকে ডেকে নিলেন। আমি হেসে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম কেমন আছেন। সাধারণ কথাবার্তা বলেই নিজের রুমে চলে গেলাম।

কিছুক্ষণ পর‌ ফাহাদ ভাইয়াকে আমার রুমে দেখে অবাক হলাম। ফাহাদ ভাইয়া আমাকে বললেন,

‘ইশারা তোমার সাথে কিছু কথা ছিলো। অনুমতি দিলে বলতে পারি।’

চলবে…..

(অনুগ্রহ করে ভুলত্রুটি গুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)