অপূর্ণতায় পূর্ণতা পর্ব-১৯

0
502

#অপূর্ণতায়_পূর্ণতা
#তানজিলা_তিহা (লেখনীতে)
#পর্ব_১৯

সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে। এক্ষুনি সূর্য অস্ত গেলে শুরু হবে সন্ধ্যা। খুব সুন্দর একটা মুহূর্ত। নদীর পাড় ঘেঁষে বসে আছি। সাথে তনয়া, তরী, রুম্পি আর নির্ঝর। পা দু’টো বিছিয়ে দিলাম ঝকঝকে পরিষ্কার নদীর পানিতে। ভীষণ মন খারাপ আমাকে চেপে ধরেছে। সেদিনের পর থেকে আর কথা হয় নি অরিদ্রের সাথে। একটা বারও তাকে দেখি নি। আমাদের বাড়ি থেকে সেদিনই চলে গিয়েছেন তিনি। তাকে ভীষণ বিষন্ন লেগেছে। কিন্তু আমার তো কিছু করার নেই! দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।

‘বিকেল বেলা এই জায়গাটা একদম অন্যরকম লাগে। একদম অপূর্ব।’ তনয়া বেশ উৎসুক ভাবেই বললো।

‘ঠিক বলেছিস সন্ধ্যা হওয়ায় আরো অন্যরকম লাগছে।’ (তরী)

‘মনে হচ্ছে নদীর বুকে ডুববে সূর্যটা। একদম ডুবে যাবে।’ (রুম্পি)

আমি চুপচাপ বসে আছি। কিছুতেই মন নেই আমার।

‘ইশা চুপ করে আছিস কেন?’ তরীর কথায় হকচকিয়ে গেলাম।

‘ক্ কই?’

‘কি হয়েছে বলবি?’ (তরী)

‘কিছু হয় নি।’

‘ইশা মিথ্যা বলবি না কি হয়েছে বলতে বলেছি।’ (তরী)

‘আমার ভালো লাগছে না রে। আমার সাথেই কেন এমন হলো একটু বল তো? কেন এমন হলো? আর পারছি না আমি!’

‘ডাক্তারকে ভালোবাসিস?’ (তনয়া)

তনয়ার কথায় হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমি কি তাকে ভালোবাসি? না! এটা কখনোই সম্ভব না। আমি কখনো কাউকে ভালোবাসতে পারি না। আমি কাউকে ভালোবাসতে পারি না!

‘না! আমি কাউকে ভালোবাসি না!’

‘ইশা অনেক সময় অজান্তেই অনেক কিছু হয়ে যায়। আমরা যা চাই না তাও হয়ে যায়। ভালোবাসা এমন একটা জিনিস বসন্তের মতো মনে আসে আবার অতলে হারিয়ে যায়। যে ধরে রাখতে পারে সেই সুখী হতে পারে। ভেবে দেখ! এখনো সময় আছে!’ (তরী)

আমি নিশ্চুপ তাকিয়ে থাকলাম। কিছু বলার শক্তি আমার নেই। কি বা বলবো আমি?

___________________

ভার্সিটির গেটে দাঁড়িয়ে রিক্সার জন্য অপেক্ষা করছি। আশেপাশে কোনো খালি রিক্সা নজরে পড়ছে না। আজ রিক্সা পাবো বলে মনে হচ্ছে না। হতাশ হয়ে রুম্পিকে বললাম,

‘চল হাঁটা শুরু কর। আজ আর রিক্সা পাবো না।’

‘তাই মনে হচ্ছে রে। যেটার দিকে চোখ দেই সেটাতেই কাপল বসা। এগুলো আসলো কোথা থেকে?’

‘আমি কি করে জানবো?’

‘দোস্ত, শোন একটা কথা আছে।’

‘বলে ফেল।’

‘আজকাল সবাই তো নিজেদের সিঙ্গেল দাবি করে‌। তাইলে এই কাপল গুলো আসে কই থেকে রে? এগুলো কি ছাগলের বাচ্চা?’

রুম্পির কথায় জোরে হেসে ফেললাম। যুক্তি আছে মেয়েটার কথায়।

‘রুম্পি খুব সুন্দর একটা কথা বলেছিস। এটা তো ভেবে দেখি নি।’

‘কারণ তোর এগুলো রুম্পির মাথায় থাকে। তোর মাথায় না।’

আমি হেসে ফেললাম। এরপর দুজনেই নিরবে হাঁটা শুরু করলাম।

‘ইশারা একটু দাঁড়াও তো।’

কারো শব্দ পেয়ে পিছন ফিরে তাকালাম। আমাদের দিকেই আসছেন রুদ্র স্যার। তাকে দেখে অবাক হলাম। রুদ্র স্যার হাতের ইশারায় আবারও দাঁড়াতে বললেন।

‘ওই ইশা স্যার আমাদের ডাকে কেন? আল্লাহ!! পরীক্ষায় ফেল টেল করলাম নাকি? আল্লাহ! এখন কি হবে?’
ব্যস্ত হয়ে বললো রুম্পি।

‘আরে ফেল করবো কেন? ফেল টেল করবো না ইনশাআল্লাহ।’

স্যার আমাদের কাছে চলে এলেন।

‘কেমন আছো ইশা?’

‘জ্বি স্যার ভালো। আপনি?’

‘এই তো আছি। দিনকাল কেমন চলছে?’

‘এইতো ভালো স্যার।’

‘বাসার সবাই কেমন আছে?’

‘জ্বি ভালো স্যার।’

হঠাৎ রুম্পি আমার কানে কানে বললো, ‘ওই স্যার রাস্তায় এমনে দাঁড়া করাইছে এগুলা জিজ্ঞেস করতে? আমি তো ভাবলাম কি না কি?’

‘আপনি এতকিছু ভাবেন কি করে ম্যাডাম?’

রুদ্র স্যারের কথায় দু’জনেই সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। স্যার শুনে ফেলেছেন! দুজনে চুপ হয়ে গেলাম।

‘ইশারা সামনের ক্যাফে যাও। তোমার জন্য একজন অপেক্ষা করছে।’

বেশ অবাক হলাম। কে হতে পারে?

‘মানে? কে?’

রুদ্র স্যার হেসেই বললেন, ‘যেয়েই দেখো।’

আমায় হাজারো প্রশ্ন নিয়ে এগোতে শুরু করলাম। অরিদ্র নাতো? মনে হচ্ছে তো সেই।

‘এই যে মিস! আপনি কোথায় যাচ্ছেন?’
রুদ্রের কথায় থেমে গেলো রুম্পি। পিছন ফিরে দেখলো রুদ্র সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। রুদ্র দু পা এগিয়ে এসে বললো, ‘আপনি কোথায় যাচ্ছেন?’

‘কেন? ইশার সাথে যাচ্ছি।’

‘ইশা কার কাছে গেছে আপনি জানেন?’

‘সেটা জানি না দেখেতেই তো যাচ্ছি স্যার। দেখতে হবে না কে ইশার জন্য অপেক্ষা করছে!’

‘সবকিছু দেখা লাগে না ম্যাডাম। আপনি এখানেই দাঁড়ান। আর এক পা এগোবেন না। এখানেই থাকবেন।’

‘কেন? কেন? আমার বান্ধবী ওখানে একা যাবে আর আমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকবো? ইমপসিবল।’

‘নো, পসিবল। যা বলেছি তা করো। তুমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে তো এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে। ডোন্ট মুভ।’

রুদ্রের দেওয়া ধমকিতে ভদ্র মেয়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকলো রুম্পি। কিন্তু মনে মনে তাকে শ খানেক গালি দিয়ে নিলো।

যা ভেবেছিলাম তাই হলো! অরিদ্র বসে আছেন আমার সামনে। বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে তাকে। কিছুক্ষণ যাবৎ বসে আছি। কিন্তু উনি কিছুই বলছেন না। বেশ বিরক্ত লাগছে। নিরবতা কাটিয়ে বললাম,

‘অরিদ্র আপনি কি কিছু বলবেন? এভাবে আর কতক্ষণ? আমি বাসায় যাবো।’

আমার কথায় নেড়েচেড়ে বসলেন তিনি। বললেন,

‘ইশারা আপনার জন্য একটা গিফট আছে। সেটা দিতেই এসেছি।’

‘গিফট! কি গিফট?’

আমার হাতে মাঝারি সাইজের রঙিন পেপারে মোড়ানো একটা বক্স ধরিয়ে দিলেন অরিদ্র। এরপর বললেন,

‘এই ছোট্ট একটা গিফট ইশারা। আমি আসি।’

বলেই চলে গেলেন অরিদ্র। আমি চুপ করেই বসে থাকলাম!

বাসায় এসেই বক্সটা খোলার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। কি হতে পারে এটার মধ্যে? ভাবতেই পারছি না আর! চটজলদি বক্সটা খুলে ফেললাম। বক্সটা খুলে বেশ অবাক হলাম। বক্সটা খুলতেই চোখে পড়লো একটা ওড়না। ওড়নাটা বেশ পরিচিত লাগছে। এটা তো আমারই! তার কাছে কি করে গেলো? উৎসুক হয়ে আবার বক্সে হাত দিলাম। আমার এক জোড়া কানের দুল আর একটা পায়েল। থমকে গেলাম আমি। এগুলো তার কাছে কিভাবে? চোখ বুলিয়ে দেখলাম আরো কিছু চকলেট আছে‌। এর নিচেই আছে আমার বেশ কিছু ছবি।আর সাথে একটা চিরকুট। জিনিসগুলো দেখে বেশ অবাক হলাম। অরিদ্র এগুলো কোথায় পেলেন!! উৎসুক হয়েই চিরকুটটা হাতে নিলাম।

প্রিয়,

তোমার আমানত তোমাকে ফিরিয়ে দিলাম। দেখো তো সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা? আর তো থাকবো না ঠিক না থাকলেও অভিযোগ করতে পারবে না। জিনিস গুলো তোমার অজান্তেই তোমার কাছ থেকে নিয়েছি। লুকিয়ে নিয়েছি বলতে পারো চুরি করে নিয়েছি। যেমনটা তুমি করেছো! আমার মন চুরি করেছো! ভাইয়ার বিয়ের সময় থেকে তোমায় ভালোবাসি। সেদিনই তোমাকে খুব মনে ধরেছিলো আমার। এরপর আর কোনদিন মন থেকে সরাতে পারি নি। হয়তো কোন দিন পারবোও না!হৃদয়ে তোমার নাম লেখা হয়ে গেছে। আচ্ছা আমার ভালোবাসা কখনো তোমার চোখে পড়ে নি?

বিয়েতে বরযাত্রী যায় বউ আনতে কিন্তু আমি কি করেছি জানো? আমি এক ছোট্ট মেয়ের ওড়না চুরি করে এনেছি। তোমার বারান্দা থেকে একটা ওড়না নিয়ে এসেছিলাম। সেদিন আমার কি হয়েছিলো আমি জানি না। সেদিন শুধু তোমাকেই ভেবেছি। এরপর তো আমার প্রতিটির ক্ষণেই তুমি!

লন্ডনে থাকা সময় কালীন প্রতিটা মুহূর্তই এটাকে সাথী করে নিয়েছি। তোমাকে আমার খুব প্রয়োজন। যখনই অবসর তখনই তুমি!

জানো সময়টা তখন শীতকাল ছিলো। তখন আমি লন্ডনে। একদিন আমার প্রচুর জ্বর হয়েছিলো। জ্বরে অবস্থা নাজেহাল ছিলো আমার‌। অদ্ভুত কাণ্ড কি ছিলো জানো? তোমার ওড়না বুকে রাখলেই মনে হতো তুমি আমার কাছে। আমি ভালো হয়ে যেতাম।

আর এই পায়েলটা আর দুল জোড়া নিয়েছি কিছুদিন আগে যখন তুমি আমাদের বাড়িতে ছিলে। ভেবেছিলাম তুমি খুঁজবে কিন্তু কিছুই করো নি তুমি। মজার ছলেই নিয়েছিলাম। আজ ফিরিয়ে দিচ্ছি।

আমার অজান্তেই আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। জানি না এটা আমার ঠিক হয়েছে কিনা। হয়তো ঠিক হয় নি! তাই তো ফিরিয়ে দিলে। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। কিন্তু যখন জানতে পেরেছি তুমি অন্য কাউকে ভালোবাসো তখন তোমায় ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। তোমাকে মন থেকে তাড়িয়ে দিতে চেয়েছিলাম।

তোমাকে কখনোই বলি নি ভালোবাসি। কারণ তুমি অন্যকাউকে চাও। সবসময় চেয়েছি তুমি ভালো থাকো। আমি যেমনই থাকি তুমি তোমার ভালোবাসার মানুষটার সাথে ভালো থাকো। আমার অপূর্ণ ভালোবাসায় তোমার ভালোবাসা পূর্ণতা পাক।

আমি নিজের ভালোবাসা কখনো প্রকাশ করতে চাই নি ইশারা। নিজের ভালোবাসা নিজের কাছেই রাখতে চেয়েছি। একাই পুষতে চেয়েছি। একা একাই বয়ে বেড়াতে চেয়েছি। কিন্তু যখন আরুনির সাথে বিয়ে ঠিক হলো তখন মনে হলো তোমাকে হারিয়ে ফেলবো। আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলবো! তোমাকে পাবো না আমি! ভাবতেই শ্বাস আটকে আসে আমার। আমি তোমাকে ছাড়া কার কাউকে ভাবতেই পারি না যে!

কখনো বলতে চাই নি এসব। আজ কেন জানি এসব বলতে ইচ্ছে হলো। হয়তো আর কখনো বলতে পারবো না তাই! তোমার সাথে থাকা মুহূর্তগুলো আমায় ব্যাথায় কাতর করে দিচ্ছে। বলো তো কেন আমায় ভালোবাসলে না? এতোটা খারাপ আমি? আমাকে একটুও ভালোবাসা যায় নি?

তোমার কাছে থেকে এই দহন যন্ত্রনা আমি সহ্য করতে পারছি না ইশারা। তাই দূরে সরে যাচ্ছি। অনেক দূরে সরে যাবো। হয়তো আর কখনো দেখা হবে না। আর কোন দিন তোমায় বলতে পারবো না ভালোবাসি। তাই কাগজে কলমে লিখে গেলাম ভালোবাসি ইশুবতী। অনেক ভালোবাসি।

ভালো থেকো ইশুবতী।

ইতি,
তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী।

থমকে গেলাম আমি! কলমের কালিতে ফুটে ওঠা শব্দগুলোকে বিশ্বাস করতে পারছি না। অরিদ্র আমায় তখন থেকে ভালোবাসেন? কই কখনোই তো শুনি নি! এগুলো কি বললেন তিনি? তাকে ফিরিয়ে দিলাম আমি? তার অনুভূতিগুলোকে এড়িয়ে দিলাম? কোথায় যাচ্ছেন উনি?

চটজলদি ওনার নাম্বারে ডায়াল করতেই সুইচ অফ! আমার মস্তিষ্ক শূন্য প্রায়। চোখ দুটো ছলছল করছে। বার বার মনে হচ্ছে তাকে ফিরিয়ে দিলাম কেন?

চলবে….

(রিচেক হয় নি। অনুগ্রহ করে ভুলত্রুটি গুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)