অপেক্ষারা পর্ব-১৪+১৫

0
560

#অপেক্ষারা
১৪+১৫
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

ফুটন্ত পানিতে চা পাতা ছেড়ে দিয়ে চিন্তিতমুখে দাঁড়িয়ে আছে নাজ। এই চা এবার কতক্ষন ফোটাতে হবে কে জানে? সায়েম কোনমতে রান্নাঘরে এসে তাকে সাহায্য করলেও তো পারে! তা নয়, বরং হালকা মেজাজে খোশগল্প শুরু করে করেছে।

সায়েম আহ্লাদী পুত্রের মতো মায়ের কাছে আবদার করলো, “মা! কতদিন তোমার হাতের খিচুড়ি খাই না। আজ রাতে তুমি খিচুড়ি রান্না করবে প্লিজ?”

হাসনা বেগম কোমল স্বরে বললেন, “তুই না বললেও করতাম। আহা বেচারা! ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া না করে চেহারার কী হাল করেছিস। বৌমা?”

নাজ রান্নাঘরের দরজা থেকে উকি দিয়ে বলল, “জি মা?”

“রান্নাবান্না ঠিকমতো করো না না-কি? আমার ছেলেটা তো দেখছি না খেতে খেতে শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।”

বিরক্তিতে গা জ্বলে উঠলো নাজের। শাশুড়ি শ্রেণির মানুষদের অন্যতম দায়িত্ব হলো আদিখ্যেতা করা। এরা ছেলের বিয়ের আগে যতটা না আদিখ্যেতা করতো, তার থেকে ঢের বেশি করে বিয়ের পর বউয়ের সামনে। ছোটবেলায় প্রতিবছর গ্রীষ্মের ছুটিতে নাজ দাদার বাড়িতে বেড়াতে যেত। বহুদিন পর তার বাবাকে দেখে দাদিও কিছুটা এমন ভঙ্গিতেই আদিখ্যেতার সুর তুলতেন। আর বিরক্তিতে শিউরে উঠতেন তার মা। নাজ কি কোনদিনও ভাবতে পেরেছিল, এমন দিন তার জীবনেও আসবে?

নাজ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “মা শুনুন রান্না ঠিকমতোই করা হয়। আপনার ছেলে যদি ঢং করে কম কম খায়, সাত সকালে উঠে ঘন্টার পর ঘন্টা জগিং করে – তাহলে তো শুকিয়ে যাবেই।”

কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে সায়েম চোখ রাঙিয়ে তাকালো নাজের দিকে। নাজ ভয়ে সঙ্গে সঙ্গে রান্নাঘরের ভেতরে চলে গেল।

হাসনা বেগম বললেন, “বৌমার এই কথাটা আমি বিশ্বাস করি। হ্যাঁ রে বাবা, তোর এসব জগিং-টগিং করার কী দরকার?”

সায়েম বিরক্ত গলায় বলল, “আহ্ মা! কী শুরু করলে? কেবল এসেছ, যাও গিয়ে ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নাও। ওই যে, ওই রুমটা তোমাদের। চলো আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।”

কনা অসহায় গলায় বলল, “আর ভাইয়া আমার রুম?”

“তোর কোনো রুম নেই। তুই এতিম।”

“মানে?”

“মানে আবার কী? তোকে যে ফ্যামিলিতে জায়গা দিয়েছি এই তো অনেক। সেইদিন ডাস্টবিনে কুড়িয়ে না পেলে আজ তো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতি। আবার রুমও লাগবে!”

কনা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “বাবা শুনলে!”

শওকত সাহেব প্রচ্ছন্ন হাসি হেসে বললেন, “সায়েম! কী যে পাশ মেয়েটা ক্ষেপিয়ে!”

নিজেদের ঘরের দিকে যাওয়ার পথে হাসনা বেগম হুট করে রান্নাঘরে ঢুকলেন, পিছে পিছে সায়েমও এল।

হাসনা বেগম উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, “বৌমা শোনো, আমি যে কয়দিন আছি তোমাকে আর রান্নাঘরে আসতে হবে না। এমনিতেও এই বয়সে ঘন ঘন চুলার কাছে আসতে নেই। গায়ের রং পুড়ে যায়।”

নাজের প্রচন্ড হাসি আসছে। ইচ্ছা করছে গলা ফাটিয়ে হাসিতে গড়িয়ে পড়তে।

তবুও গলায় স্বর যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে বলল, “সে কী মা! কেন?”

“ছেলেটা এমনিতেই আমার কাছে থাকে না। সারা বছর কী খায়, না খায় তার কোনো ঠিক নেই। তার ওপরে আবার এত শখ করে আমার হাতের খিচুড়ি খেতে চেয়েছে। আমি যে কয়দিন আছি, নিজেই ভালোমন্দ রেঁধে খাওয়াবো।”

সায়েম এবং নাজ – দুজনের দৃষ্টি এক মুহূর্তের জন্যে একে অপরের ওপর পড়লো। যেন চোখে চোখে দুজনে একসঙ্গে বলে উঠলো, “মিশন সাকসেসফুল!”

আসলে এসবের পুরোটাই সায়েমের মাস্টারপ্ল্যান। নাজ যে রান্নাবান্নার ‘র’ পর্যন্ত জানে না, এ বাড়ির রান্নার সকল দায়িত্ব জরিনা নামের এক গৃহপরিচারিকার হাতে – এ কথা হাসনা বেগম জানতে পারলে বিস্ময়ে আঁতকে উঠবেন। মানুষের মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়ে আর তার আকাশের ওপর মাথা ভেঙে পড়বে। তাই সায়েম ঠিক করলো ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করে রান্নার পুরো দায়িত্বটাই মায়ের কাঁধে চাপিয়ে দেবে।

সকলে হাতমুখ ধুতে চলে গেলে সায়েম আবারও ফিরে এল রান্নাঘরে।

নাজ হালকা গলায় বলল, “আপনার একটা কাজ কমিয়ে রেখেছি।”

“কোন কাজ?”

“পানিতে চা পাতা দিয়েছি।”

সায়েম ব্যঙ্গাত্মক স্বরে বলল, “ওয়াও! এত কঠিন কাজ তুমি করলে কী করে বলো তো? আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না।”

নাজ আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সায়েমের দিকে। এই ছেলেটাকে সে কিছুতেই বুঝতে পারে না। এই হালকা মেজাজে ফাজলামো করছে তো এই কঠিন স্বরে ধমক দিচ্ছে।

সায়েম গভীর মনোযোগ দিয়ে ফুটন্ত চায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “একী? চায়ে রং আসছে না কেন?”

“কে জানে কোন দেশি চা পাতা বাজার থেকে ধরে এনেছেন আপনি।”

“স্ট্রেঞ্জ! যত খারাপ চা পাতাই হোক না কেন, রং তো আসবেই! কোন কৌটা থেকে চা পাতা নিয়েছ বলো তো?”

নাজ নীল রংয়ের একটা কৌটা দেখিয়ে বলল,
“এই যে, এটা থেকে!”

সায়েম কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে শান্ত গলায় বলল, “নাজ?”

“হুঁ?”

“এটাকে কালো জিরা বলে।”

নাজ চোখ বড় বড় করে কালো জিরার দিকে তাকিয়ে বলল, “ওহ! আমি তো বুঝতেই পারিনি।”

“ছি ছি! এত বয়স হয়ে গেল, এখনো চা পাতা চিনলে না? হোয়াট আ শেম।”

“বয়স হয়ে গেল মানে? আমাকে দেখে কি আশি বছরের বুড়ি মনে হয়?”

“একদমই না। কোথাও আশি বছরের বুড়ি আর কোথায় তুমি। আশি বছরের বুড়িরা জগৎ সম্পর্কে জ্ঞান রাখে, বিচার বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়। আর তার থেকেও বড় কথা তারা এক দেখায় বলে দিতে পারে কোনটা কালো জিরা আর কোনটা চা।”

“দেখুন, আপনি কিন্তু পদে পদে আমাকে অপমান করে আসছেন। এবার আপনার মায়ের কাছে এর একটা বিচার দিতেই হবে।”

“সেই কাজ ভুলেও করতে যেও না, উল্টো নিজেই বিপদে পড়বে। মা যদি জানতে পারে তুমি সামান্য চায়ের পাতা চেনো না, তাহলে কুরুক্ষেত্র বেধে যাবে।”

নাজ মুগ্ধ হয়ে দেখল সায়েমের চা বানানোর দৃশ্য। চায়ের রংটা বিস্মিত করে দেওয়ার মতো। কী আশচর্য! কোনো মেয়েমানুষকেও নাজ এত ভালো চা বানাতে দেখেনি।

সৃষ্টিকর্তা এই মানুষটার মাঝে কোনো খুঁত রাখেননি, না রেখেছেন গুণের অভাব। মানুষটার মুখের দিকে একবার তাকালে ইচ্ছে হয় অনন্তকাল ধরে তাকিয়েই থাকতে। তার কপালের ওপর কটা চুল অগোছালোভাবে পড়ে আছে। খুব ইচ্ছা করছে কোনো একটা অজুহাতে সেই চুলগুলোকে ছুঁয়ে দিতে।

সায়েম চায়ের কাপে চামচ নাড়তে নাড়তে অন্যরকম গলায় বলল, “কী ব্যাপার? হা করে দেখছো?”

ভয়ঙ্কর লজ্জা পেয়ে গেল নাজ। সে যে এতক্ষণ ধরে সায়েমের দিকে তাকিয়ে আছে, ছেলেটা বুঝলো কী করে।

নাজ তৎক্ষণাৎ বিব্রত গলায় বলল, “কই! কিছু না তো?”

সায়েম সন্দিহান কণ্ঠে বলল, “সত্যি?”

“হুঁ!”

“আচ্ছা, যাও চা দিয়ে এসো। আমি রেডি হতে গেলাম।”

“আজকের দিনেও আপনাকে অফিসে যেতে হবে?”

“কেন? আজকে কী?”

“আপনার বাবা-মা এতদিন পর এলো!”

“তাতে কী হয়েছে? শোনো পৃথিবীতে যাই ঘটে যাক না কেন, আমি কাজে ফাঁকি দিতে পছন্দ করি না। আর যে কাজ ফাঁকি দেয়, তাকেও পছন্দ করি না। বাবা-মা এসেছে এই খুশিতে তুমি আবার না পড়ে থাকবে না কিন্তু। তারা দুপুরে ঘুমাতে গেলে পড়তে বসবে।”

নাজ শুকনো মুখে “আচ্ছা।” বললেও মনে মনে বলল, “কচু বসবো!”

হাসনা বেগম আয়োজন করে রান্নায় নেমেছেন। রান্নার সকল সরঞ্জাম চারিদিকে সুন্দর করে সাজিয়ে নিয়েছেন। রান্না হলো অনেকটা শিল্পের মতো। শিল্পকর্ম তৈরির সময় প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো হাতের কাছে না থাকলে কাজে ব্যাঘাত ঘটে। ওদিকে জরিনা তাকে সাহায্য করছে তরকারি কুটতে।

নাজ উৎফুল্ল গলায় বলল, “মা! আমি আপনাকে সাহায্য করি।”

“না, বৌমা আমাকে সাহায্য করতে হবে না। তুমি বরং গিয়ে তোমার বাবাকে উদ্ধার করো।”

“উদ্ধার করবো মানে?”

“গিয়ে দেখোই না কী কান্ড বাঁধিয়েছে সে।”

সায়েমের বাবা-মায়ের জন্যে নাজের ঘরটা বরাদ্দ করা হয়েছে। এ বাড়ির সবথেকে চমৎকার ঘর এটি। পূর্ব দিকে বিশাল এক জানালা। খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গেলে, এই জানালাটা দিয়ে সূর্যোদয় দেখা যায়।

ঘরটার সঙ্গে লাগোয়া এক চিলতে বারান্দাও আছে। বারান্দা থেকে পাশের বাড়ির বারান্দা দেখা যায়। সেই বারান্দায় সারাক্ষণ ছোটাছুটি করে বেড়ায় ছোট্ট একটি মেয়ে। সায়েম অফিসে গেলে একা একা থাকতে থাকতে নাজ যখন হাপিয়ে ওঠে, এই এখানে এসে মেয়েটার কর্মকান্ড দেখে।

বর্তমানে এই ঘরজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নানান জিনিসপত্র। পুরনো কতগুলো আইস্ক্রিমের বক্স, একগাদা খবরের কাগজ আর স্যান্ডেল, চশমার খাপ, মুড়ির প্যাকেট, রাজ্যের ওষুধপত্র, পানের বাটা – না জানি কত কী। শওকত সাহেব অসহায় দৃষ্টিতে জিনিসগুলোর দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। যেন কী করবেন তার দিশা খুঁজে পাচ্ছেন না।

নাজ খানিকটা হেসে বলল, “একী বাবা! আপনি দেখি আস্ত একটা দোকান খুলে বসেছেন।”

শওকত সাহেব মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, “আসলে সব তোমাদের দোষ বুঝলে বৌমা। এত জিনিসপত্র নিয়ে কেউ বেড়াতে আসে। এখন এগুলো নিয়ে যে কোথায় যাই!”

“কোথাও যেতে হবে না বাবা। আপনি বরং ড্রয়িং রুমে গিয়ে টিভি দেখুন আমি সবকিছু গুছিয়ে রাখছি।”

“সে-ই ভালো!”

শওকত সাহেব উঠে এলেন। কনা মুগ্ধ দৃষ্টিতে নাজদের বসার ঘরটা ঘুরে ঘুরে দেখছিল। টিভির অন করার পর তার মুগ্ধতা যেন কয়েক গুণ বেড়ে গেল।

কনা বিস্মিত গলায় বলল, “কী সর্বনাশ! এত বড় টিভি দিয়ে কী করিস তোরা!”

“তোর ভাইয়ার শখের জিনিস। কী সব হাবিজাবি গেম খেলে এটাতে।”

“টিভিতে আবার গেমও খেলা যায় না-কি?”

“যায় তো। খেলবি?”

“খেলবো মানে, অবশ্যই খেলবো। কীভাবে খেলতে হয় দেখিয়ে দে তো!”

“আমি এসব পারি না-কি? তোর ভাইয়া অফিস থেকে আসুক, তাকে বলিস।”

শওকত সাহেব গভীর আগ্রহ নিয়ে টক শো দেখছেন। একটা বয়সের পর দেশ-রাজনীতি নিয়ে এসব গম্ভীর আলোচনা শুনতে ভালোই লাগে। সেই হিসাবে কনার এই জাতীয় আলোচনা ভালো লাগার প্রশ্নই ওঠে না। তবে তার ভীষণ ভালো লাগে। দুই আধবুড়ো বিরস মুখে কী সব আলোচনা করছে আর কনা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে।

নাজ বলল, “এই কনা! এসব বোরিং টক শো
শুনে কী করবি? আয় তো আমার সঙ্গে। কতদিন গল্প করি না!”

রান্নাবান্নার আপাতদৃষ্টিতে অপারদর্শী হলেও ঘর গোছানোর কাজটা নাজ বেশ ভালোই পারে। হাসনা বেগমের ছোট ছোট জিনিসগুলো সুন্দর করে আলমারিতে তুলে গুছিয়ে রাখছে। কনা বিছানার ওপরে পা ভাজ করে বসে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছে বান্ধবীর কর্মকান্ড। এ বাড়িতে আসার পর থেকে যাই দেখছে, তাতেই সে মুগ্ধ হচ্ছে।

কনা হতভম্ব কণ্ঠে বলল, “তুই দেখি এই কয়েকদিনেই সংসারী হয়ে গেছিস!”

নাজ হেসে বলল, “আর তোর ভাইয়া কী বলে জানিস? বলে আমার মতো আনাড়ি মেয়ে সে না-কি তার জীবনে দেখেনি।”

নাজ লক্ষ করলো কনা মুখ টিপে হাসবে। এই কথাটায় হাসার যথাযথ কারণ আছে তবে কনার হাসির মধ্যে লুকিয়ে আছে অন্য কোনো কারণ। সেই কারণটাই বুঝতে চেষ্টা করছে নাজ।

নাজ কিছু বলার আগেই কনা হাসি থামিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল, “এই ঘরটা বুঝি তোর আর ভাইয়ার?”

নাজ শুকনো স্বরে বলল, “হুঁ।”

মিথ্যাটা বলতে তার বেশ খারাপ লাগলো। নিজের সবথেকে প্রিয় বান্ধবীকে কখনো মিথ্যা বলেনি, কোনো সত্যও গোপন করেনি। তবে কি আর করা? কিছু কিছু কথা থাকে যা সবথেকে কাছের মানুষটাকেও বলা যায় না।

“আমরা চলে আসায় তোদের খুব কষ্ট হলো তাই না?”

“ওমা! কষ্ট কীসের?”

“এই যেমন, ঘরটা ছেড়ে দিতে হলো! তোর তো আবার হুট করে নতুন জায়গায় ঘুম আসে না।”

“এসে যাবে। তুই চিন্তা করিস না তো।”

“নাজ?”

“হুঁ?”

“তোর সব কসমেটিকস দেখছি এ ঘরে। আবার পাশের ঘরে দেখলাম ভাইয়ার পারফিউম-টারফিউম। ব্যাপারটা কী?”

মনে একরাশ বিরক্তি নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে ধরলো নাজ। যদিও চোখেমুখে তা প্রকাশ করলো না। কনার এই এক বিশ্রী স্বভাব। ছোট থেকে ছোট বিষয়গুলোও তার চোখ এড়িয়ে যায় না।

নাজ হড়বড় করে বলল, “ওই, সকালবেলা কলেজে যাওয়ার সময় আমার রেডি হতে একটু বেশি সময় লাগে তো। এরজন্যে উনি উনার জিনিসগুলো পাশের ঘরে রেখে দিয়েছেন। যাতে দুজনেই একসঙ্গে রেডি হয়ে পারি।”

“ও!”, উত্তরটা যেন কনার মনমতো হলো না।
কনা আবারও বলল, “তোর নতুন কলেজটা কেমন রে ?”

নাজ হাই তুলতে তুলতে বলল, “আছে এক রকম।”

“খুব কড়া তাই না?”

“বুঝলি কী করে?”

“যেভাবে তোকে সাসপেন্ড করলো, কড়া তো হওয়ারই কথা!”

নাজের বিস্ময়ের সীমা করলো না। সায়েম কি তার সাসপেনশনের সেই লজ্জাজনক গল্প সকলের কাছে বলে বেরিয়েছে?

নাজ লজ্জিত গলায় বলল, “আরে বাবা আমি কি নিজের দোষে সাসপেন্ড হয়েছিলাম না-কি? ওই আমার এক বিচ্ছু বান্ধবীর পাল্লায় পড়ে…”

নাজকে থামিয়ে দিয়ে কনা বলল, “খুব ভালো হয়েছে! এটা হলো আমাদের ছেড়ে নতুন বান্ধবী পাতানোর ফল।”

নাজ আক্ষেপজড়িত স্বরে বলল, “নতুন বান্ধবী না পাতিয়ে কী করবো শুনি? তোরা তো আমাকে ছাড়া ভালোই আছিস। একটা মানুষ যে তোদের মনের মধ্যে নেই তার কোনো খেয়াল আছে?”

কনা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে অদ্ভুত হাসি হেসে বলল, “তোর তা-ই মনে হয়?”

“হুঁ।”

“শোন তাহলে, আমি, শিউলি আর মালা – আমরা তিনজনে গত ছয় মাসে একটা সিনেমাও দেখিনি, এমনকি একবারও চাইনিজ খেতে যাইনি।”

“কেন?”

“ওই কালো ব্যাগটা দে, বলছি।”

নাজ চেয়ারের ওপর থেকে কালো রঙের একটা ব্যাগ এনে কনার সামনে রাখলো। কনা ব্যাগের ভেতর থেকে ছোট্ট একটা লাল বাক্স বের করলো। আপাতদৃষ্টিতে দেখে মনে হচ্ছে কোনো গয়নার বাক্স। কোনটা বাক্সের ঢাকনাটা খুলতেই চোখে পড়লো চমৎকার এক জোড়া কানের দুল। সোনার গয়না নাজের খুব একটা পছন্দের নয়, তবে এই কানের দুল থেকে সে যেন চোখই ফেরাতে পারছে না।

কনা মধুর কণ্ঠে বলল, “এটা তোর।”

নাজের বিস্ময়ের যেন সীমা রইল না। বিস্ময়ে সে অভিভূত হয়ে বলল, “আমার মানে? এই কানের দুল কোথায় পেলি?”

“বললাম না, ছয়মাস ধরে আমরা তিনজন শুধু টাকা জমিয়েছি। বিয়ের সময় তো তোকে কিছু দিতে পারিনি, এখন দিচ্ছি।”

“আমাকে আবার কিছু দিতে হবে কেন? আমি কি তোদের দূরের কেউ?”

“কাছের কেউ বলেই তো দিতে হবে। তাছাড়া বিয়ে তো মানুষের জীবনে একবারই আসে।”

আনন্দে নাজের চোখে জল চলে এল। কাছের এই মানুষগুলোর জন্যে তার জীবনটা এত সুন্দর।

কনা নাজের অশ্রু মুছিয়ে দিতে দিতে বলল, “কী আশ্চর্য! এতটুকুতে কাঁদতে হয় না-কি? আমার মহারাগী ভাইটা যে কী করে তোকে সহ্য করে!”

আজ সকলে একসঙ্গে রাতের খাবার খেতে বসলো। খাবার টেবিলে হাসনা বেগম এবং শওকত সাহেব তাদের দুই ছেলেমেয়ের শৈশবের মজার মজার গল্প করছেন। এতদিন পর আর এই বাড়িটাকে পরিপূর্ন বলে মনে হচ্ছে। খিচুড়ি, গরুর কালা ভুনা, চিংড়ি মাছের মালাইকারি, বেগুন ভাজা – এসবই না-কি সায়েমের পছন্দের। হাসনা বেগম অত্যন্ত যত্ন নিয়ে রেঁধেছেন আজ, ছেলে এতদিন পর তার হাতের রান্না খাবে বলে কথা।

আজ সায়েমকেও লাগছে অন্যরকম। অন্যান্য দিনে অফিস থেকে ফিরেই গম্ভীর ভঙ্গিতে ল্যাপটপ নিয়ে বসে থাকে। ভ্রু কুঁচকে নাজের পড়াশোনার তদারকি করে। আজ সেসব কিছুই করেনি। ফুরফুরে মেজাজে খাবার টেবিলের গল্পে অংশগ্রহণ করছে।

নাজের অস্থির চোখদুটো বারবার গিয়ে পড়ছে ওই মানুষটার ওপরে। বিষয়টা কারও চোখে পড়লে লজ্জার শেষ থাকবে না। তবুও নিজেকে আটকে রাখতে পারছে না নাজ। নেশার মতো টানছে ওই মানুষটা তাকে।

খাবার শেষে শওকত সাহেব বাদে সকলে এসে বসলো বসার ঘরে। শওকত সাহেব আবার রাতে খাওয়ার পর এক মুহুর্তও চোখ মেলে রাখতে পারেন না। সায়েম বোনকে টিভিতে গেম খেলা শেখাচ্ছে। গেমটা খেলতে হয় কনসোল দিয়ে। ফুটবলের প্রতি কনার তেমন কোনো আগ্রহ না থাকলে, ফুটবলের এই গেলে তার ঢের আগ্রহ রয়েছে।

এরই মাঝে নাজ বলে উঠলো, “কনা! আজ কিন্তু দুই আমার সঙ্গে ঘুমোবি। দুজন মিলে সারারাত জেগে গল্প করবো।”

কনা উৎফুল্ল গলায় বলল, “বাহ্! ফাইন হবে।”

নাজ এবার সায়েমের দিকে তাকিয়ে বলল, “শুনুন। আজ আপনি এ ঘরের ডিভানে ঘুমাতে পারবেন না?”

সায়েম স্বাভাবিক গলায় বলল, “পারবো।”

আগে থেকে করা সায়েমের অসংখ্য মাস্টারপ্ল্যানের এটি একটি। রাতে ঘুমাবার ঠিক আগে আগেই নাজ সকলের সামনে আবদার করবে কনার সঙ্গে ঘুমানোর। সায়েমও কোনো আপত্তি ছাড়াই মেনে নেবে তার আবদার। এই প্যানটা মূলত করা হয়েছিল যাতে তাদের দুজনকে এক ঘরে না ঘুমাতে হয়।

হাসনা বেগম আঁতকে উঠে বললেন, “সে-কী বৌমা! সায়েম এ ঘরে ঘুমাবে কেন?”

সায়েম বলল, “আমার কোনো সমস্যা হবে না মা।”

“তোর সমস্যার জন্যে বলছি না বাবা। নতুন নতুন বিয়ের পর স্বামী স্ত্রীকে আলাদা ঘরে থাকতে নেই। এতে সংসারে অকল্যাণ বাড়ে, শয়তান বাসা বাঁধে।”

নাজ অসহায় গলায় বলল, “নতুন নতুন বিয়ে কোথায় মা? ছয় মাস হয়ে গেল!”

“তোমরা আজকালকার ছেলেমেয়েরা ওসব বুঝবে না বৌমা। আমি যা বলছি, তাই করো।”

কনা বলল, “কিন্তু মা, আমাদের গল্প! কত শখ করলাম, সারারাত জেগে গল্প করবো!”

“সারাদিন রাত জেগে গল্প করতে হবে কেন? আমরা কি কালই চলে যাচ্ছি, এতগুলো দিন পড়ে আছে – যত খুশি গল্প করিস! বৌমা তোমরা যাও তো, ঘুমিয়ে পড়ো। অনেক রাত হয়ে গেছে।”

সায়েম এবং নাজ মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। ছয় মাসের বিবাহিত জীবনে কখনো একই ঘরে ঘুমায়নি তারা। এবার কী হবে?

(চলবে)