অপেক্ষারা পর্ব-১৮+১৯

0
520

#অপেক্ষারা
১৮+১৯
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

রাস্তার এ পারে আতঙ্কে জমে দাঁড়িয়ে আছে নাজ। ওপারেই বিরাট শপিং মল, আজ তারা এসেছে ঈদের শপিং করতে। হাসনা বেগম, শওকত সাহেব, কনা আর সায়েম শপিং মলের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে নাজের জন্যে। কনা একগাল হেসে হাত নাড়ছে তার দিকে। রাগে শিউরে উঠলো নাজ। রাস্তা পার করেছিস ভালো কথা, হাত নাড়ানাড়ির কী আছে?

নাজ রাস্তা পার হবার জন্যে পা বাড়ালো, সঙ্গে সঙ্গে তড়িৎ গতিতে একটা গাড়ি তার সামনে দিয়ে চলে গেল। আবারও দুয়েক পা পিছিয়ে গেল নাজ। এই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি অনেকক্ষণ ধরেই হচ্ছে। নাজ লক্ষ করলো, সায়েম বিরক্তি নিয়ে আবারও রাস্তা পার করে তার কাছে আসছে।

“কী ব্যাপার নাজ? সামান্য রাস্তাটুকু পার হতে পারো না?”

নাজ অসহায় ভঙ্গিতে বলল, “আমার কী দোষ? আমি পা বাড়ালেই গাড়ি চলে আসে।”

“প্রত্যেকটা কথার উত্তর তো ঠিকই দিতে পারো!”

সায়েম সঙ্গে সঙ্গে নাজের হাতটা ধরে পা বাড়ালো। কী নির্লজ্জ একটা ছেলে! ওপারে বাবা-মা দাঁড়িয়ে আর সে এখানে নাজের হাত ধরছে। নাজ কেমন যেন ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে গেল। আবারও সে মানুষটার দুই মিটার রেডিয়াসের ভেতরে চলে এসেছে। এই রেডিয়াস তার সাজানো গোছানো অন্তরাত্মাকে কেমন যেন এলোমেলো করে দেয়। এই প্রথম সায়েম তার হাত ধরেছে। কেন জানি নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে সুখী মানুষ বলে মনে হচ্ছে।

ছোটোবেলা থেকেই রাস্তা পার হতে প্রচন্ড ভয় পায় নাজ। কেবলই মনে হয় এই বুঝি বড়সড় একটা গাড়ি তার ওপর দিয়ে চলে গেল। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। ভয়ে একাকার হয়ে নাজ সায়েমের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলো।

এই শপিং মলটায় আগেও একবার এসেছিল নাজ। তার পুরনো ফোনটা ভেঙে যাওয়ায় সায়েম নিয়ে এসেছিল নতুন ফোন কিনে দিতে। সে বার তাড়াহুড়োর কারণে জায়গা ভালো করে ঘুরে দেখা হয়নি। আজ নাজ আর কনা দোকানগুলো ঘুরে ঘুরে দেখছে আর মুগ্ধ হচ্ছে। প্রচন্ড সব দোকান আর চকচকে আলোকসজ্জার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে তার বিস্মিত চোখগুলোতে। বাকিরা সকলে একটা দোকানে ঘুরে কীসব যেন কিনছে।

কনা হুট করে বলে উঠলো, “দোস্ত! তোর কলেজে ছেলেরাও পড়ে?”

নাজ শুকনো গলায় বলল, “ভালো মুডে আছি, কলেজের কথা তুলে মুডটা নষ্ট করছিস কেন?”

“আহা বল না!”

নাজ ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আছে।”

“একটার সঙ্গে আমার সেটিং করিয়ে দিবি?”

“কী?”

“না মানে, তোর বিয়ে হয়ে গেল। ওদিকে শিউলিও প্রেম করছে। ভাবলাম আমি কেন শুধু শুধু সিঙ্গেল মরবো?”

“প্রথমত আমি কোনো সেটিং-টেটিং করাচ্ছি না। আর করালেও লাভটা কোথায়? ছেলে এখানে তুই ময়মনসিংহে, প্রেমটা হবে কী করে?”

“এটাই তো ভালো, ঝামেলাহীন প্রেম!”

“প্রেম করতে আবার কীসের ঝামেলা রে?”

“প্রতিদিন দেখা করার ঝামেলা। আর প্রতিদিন দেখা করা মানেই সাজগোজ করা, ভালো ভালো জামা পড়ে বসে থাকা। উফ অসহ্য! এর থেকে লং ডিসটেন্সই ভালো।”

“কাছাকাছিই জুটছে না, আবার লং ডিসটেন্স!”

কনা হতাশ গলায় বলল, “এটা অবশ্য ঠিক বলেছিস। আমি কী ভাবছি জানিস?”

“কী?”

“ভাবছি এখন থেকে বেশি বেশি বিয়ে খাবো, দাওয়াত না পেলেও পাড়া-প্রতিবেশীদের বিয়েতে হাজির হবো।”

“বিয়েতে হাজির হয়ে কী হবে?”

“মনে কর, দাওয়াত খেতে গিয়ে শুনি কনে ভেগে গেছে। তখন আমি নিজেই বিয়ে করতে বসে যাবো। তোর মতো আমার কপালও তো খুলতেই পারে।”

দুজনে খিলখিল করে হেসে উঠল।

“কনা?”

“হুঁ?”

“মনে আছে, বিয়ের পরদিন সকালে তুই আমাকে বলেছিলি তোর ভাইয়া কিছুটা অন্যরকম?”

কনা খানিকটা ভেবে বলল, “বলেছিলাম?”

“হ্যাঁ। কীভাবে অন্যরকম বল তো?”

কনা হেসে বলল, “এতগুলো দিন একসাথে থেকেও বুঝতে পারলি না?”

নাজ না-সূচক মাথা নাড়ল।

“ভাইয়া ওপরে ওপরে এমন একটা ভাব করবে যেন তোর ওপরে খুবই বিরক্ত, তোকে দেখতেই পারে এমন একটা অবস্থা। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ঠিকই তোকে নিয়ে ভাববে, তোর ভালো চাইবে।”

সকলের শপিং শেষ হয়ে গেলেও নাজ এখনো অনিশ্চিত ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সব জামাগুলো নেড়ছেড়ে দেখছে কিন্তু কোনোটাই মনে ধরছে না। অবশেষে হালকা বেগুনি রঙের একটা সালোয়ার কামিজ নাজের বেশ পছন্দ হয়ে গেল। পুরোটা সালোয়ার কামিজ জুড়ে সুনিপুণ কাজ করা, ওড়নাটা আবার নেটের। নিজেকে ঈদের দিন এই পোষাকে কল্পনা করে বেশ উৎফুল্ল হয়ে উঠল নাজ।

সায়েম ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল, “আর কত চুজ করবে?”

“করেছি তো!”

“তাহলে চুপ করে আছ কেন? কোনটা?”

নাজ আঙুল তাক করে বলল, “ওইযে, ওটা।”

সায়েম কিছু বলার আগেই হাসনা বেগম আঁতকে উঠে বলল, “বৌমা! এসব কী পছন্দ করেছ?”

“সালোয়ার কামিজ। কেন মা?”

“নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে, গা থেকে কাঁচা হলুদের গন্ধ পর্যন্ত যায়নি আর তুমি কিনা ঈদের দিন এসব সালোয়ার-টালোয়ার পরবে?”

“আমার তো গায়ে হলুদই হয়নি মা, কাঁচা হলুদের গন্ধ থাকবে কী করে?”

হাসনা বেগম শুকনো কেশে বললেন, “শোনো বৌমা, আমাদের পরিবারের বৌরা ঈদের দিন সালোয়ার কামিজ পরে ঘুরে বেড়ায় না।”

নাজ অসহায় গলায় বলল, “কিন্তু মা, আমি তো সবসময় সালোয়ার কামিজই পরি।”

“সবসময় পরো ভালো কথা, তবে ঈদের দিন আমাদের পরিবারের নিয়ম মেনেই চলতে হবে। ওই দোকানে সুন্দর একটা শাড়ি দেখে এসেছি, ওটা কিনবে চলো।”

“শাড়ি? আমি তো শাড়ি পরতেই পারি না।”

হাসনা বেগম হতাশ কণ্ঠে বলল, “তাহলে এটা তোমার আরেকটা অপরাধ বৌমা। বিবাহিত একটা মেয়ে শাড়ি পরতে পারবে না, এ কেমন কথা! এবারই তোমাকে শাড়ি পরা শিখিয়ে যাবো।”

নাজ অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো সায়েমের দিকে। যে দৃষ্টি স্পষ্ট জানান দিচ্ছে, “বাঁচান আমাকে!”

সায়েম বলল, “মা থাক না, বেচারি এটাই পছন্দ করেছে…”

সায়েমকে থামিয়ে দিয়ে হাসনা বেগম গম্ভীর গলায় বললেন, “সায়েম শোন, বউকে বেশি আস্কারা দিতে নেই। স্বামীর আস্কারাতেই মেয়েরা বিগড়ে যায়।”

শেষমেষ নাজের জন্যে যে শাড়িটা কেনা হলো, সেটাও যে কম সুন্দর তা নয়। তবে জিনিসটা নাজের মোটেও পছন্দ হলো না রাগে-বিরক্তিতে মাথা ভনভন করছে তার। বিয়ের পর ঈদে না-কি শুধুই শাড়ি পরতে হয়। এসব নিয়ম যে শাশুড়ি মা কোথা থেকে কোন দেশ থেকে আমদানি করেছেন কে জানে!

মেঝেজুরে রাজ্যের শপিং ব্যাগ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে আছে। আজ তারা এত কেনাকাটা করেছে যে কোন ব্যাগে কী আছে তাই মনে নেই নাজের। মেয়েটা একটা একটা ব্যাগ খুলছে আর জিনিসগুলো গুছিয়ে রাখছে যথাস্থানে। এতক্ষণ কনা তাকে সাহায্য করছিল, কয়েক মিনিট আগে ক্লান্ত হয়ে চলে গেছে।

ব্যস্ত ভঙ্গিতে ব্যাগগুলো খুলছে, হঠাৎ নীল রঙের একটা ব্যাগটা খুলতেই চমকে উঠলো সে। সেই বেগুনী সালোয়ার কামিজটা! জিনিসটা ব্যাগ থেকে বের করে ভালো করে চোখের সামনে মেলে ধরলো নাজ। হ্যাঁ! সেই জামাটাই তো! এটা এখানে এলো কী করে?

নাজের বুঝতে বাকি রইল না কী করে এসেছে। আনমনেই তার ঠোঁট জুড়ে প্রচ্ছন্ন এক হাসি ফুটে উঠলো। সায়েম সকলের চোখের আড়ালে কোন ফাঁকে এটা কিনে ফেলেছে কে জানে? নাজের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পছন্দগুলোও চোখ এড়ায় না তার। কনা ঠিকই বলেছিল, মানুষটা কেবল ওপরে ওপরেই গাম্ভীর্যের ভাব করে। ভেতরে কী বয়ে চলে যায়, তা একমাত্র তারই জানা।

নাজের ভীষণ ইচ্ছা করছে তার কাছে ছুটে গিয়ে রিনরিনে গলায় বলতে, “আপনি এত ভালো কেন?” সাহসের অভাবে বলতে পারছে না। নাজ চিরকালই প্রচন্ড ভীতু একটা মেয়ে। তবুও মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় চোখ দুটো বন্ধ করে এক নিঃশ্বাসে মনের সব কথাগুলো তাকে বলে দিতে। যা হবার পরে দেখা যাবে। মানুষটা কীই বা করবে? হয়তো ধমক দিয়ে বলবে, “তোমার এখন এসব ভাবার বয়স? পড়াশুনোর নামে নেই শুধু আজগুবি চিন্তা!”
বলুক! সে তো এমনই। মুখে এ কথা বললেও মনে মনে নিশ্চয়ই তার হৃদয়ও আদ্রিত হবে।

পরদিন সকাল সকাল বসার ঘরের সোফায় বসে বিরক্তমুখে খবরের কাগজ পড়ছে সায়েম। আজ তাদের গরু কেনার দিন। এখান থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরেই বসেছে শহরের সবথেকে বড় গরুর হাট। দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন এই হাটে ছুটে আসে। ঈদের আর বেশি দিন বাকিও নেই, গরুর হাট যেন পুরোপুরি জমে উঠেছে। কথা ছিল সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই সায়েম আর তার বাবা যাবে গরুর হাটে। কিন্তু শওকত সাহেব এখনো ঘুমে আচ্ছন্ন। হাসনা বেগম এবং কনা এক ঘন্টা যাবত তাকে ডাকাডাকির চেষ্টা করছে, তবে খুব একটা লাভ হচ্ছে না।

নাজ আচমকা সায়েমের পাশের সোফাটায় বসতে বসতে বলল, “শুনুন! একটা কথা আছে।”

সায়েম খবরের কাগজ থেকে দৃষ্টি না ফিরিয়েই বলল, “কী কথা?”

“সাদা চামড়ার ওপর কালো ছোপ ছোপ – এমন একটা গরু আনবেন কিন্তু!”

“ওয়াট?”

“বুঝতে পারেননি? দাঁড়ান দেখাচ্ছি।”

নাজ সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল থেকে তেমন একটা গরুর ছবি বের করে দেখালো।

সায়েম গম্ভীর গলায় বলল, “গরু বাইরে থেকে দেখতে কেমন তা দিয়ে কী হবে?”

“কী যে বলেন না আপনি! লুকের একটা ব্যাপার আছে না? খেয়াল করে দেখবেন, দেখতে সুন্দর বলে এ ধরনের গরুদেরই গরুর দুধের অ্যাডে দেখানো হয়।”

“তুমি নিশ্চয়ই এখন গরু নিয়ে অ্যাড করতে বসবে না!”

“অ্যাড করবো কী করে? কিন্তু ফেসবুকে পোস্ট তো করতে পারবো। জানেন আমি না ক্যাপশনও ঠিক করে রেখেছি। লিখবো সেলফি উইথ মাই কাউ!”

সায়েম বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে বলল, “ওয়াট রাবিশ! গরুর ছবি আবার ফেসবুকে কে পোস্ট দেয়?”

নাজ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “আমি দিই, আপনার সমস্যা কোথায়? আপনাকে তো আর ছবি তুলে দিতে বলিনি, বলেছি সুন্দর একটা গরু আনতে।”

“সকাল সকাল তোমার এফএম রেডিওটা বন্ধ করো তো। দেখো গিয়ে বাবা উঠেছে কিনা।”

“যাচ্ছি, আগে বলুন আমার পছন্দমতো গরুই আনবেন।”

“উফ তুমি না ভীষণ জ্বালাও!”

“জ্বলুন না একটু!”

“আচ্ছা ঠিক আছে দেখা যাবে, যাও এখন।”

বহু কষ্টে ঘুম থেকে তোলা হলো শওকত সাহেবকে। বেচারার ঘুম এখনো ভাঙেনি। সায়েমের সঙ্গে যখন রিকশায় উঠলেন তখন মনে হচ্ছিল যেন যেকোনো সময়ে পড়ে যাবেন।

জরিনা মাছ কুটতে বসেছে। ঈদের মধ্যে গোস্তের তালে পরে সকলে যেন মাছ খাওয়া ভুলেই যাবেই। তাই এই কয়েকটা দিন এক নাগাড়ে মাছ রাঁধছেন হাসনা বেগম। তিনি এই মুহূর্তে চেয়ারে বসে মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখছেন জরিনার মাছ কুটার দৃশ্য। ওদিকে তার থেকে কিছুটা দূরেই লুডু নিয়ে বসেছে কনা আর নাজ।

হাসনা বেগম আন্তরিক কণ্ঠে বললেন, “এই জরিনা! তোমার বিয়ে হয়েছে?”

জরিনা লজ্জিত গলায় বলল, “জি খালাম্মা। আফনেগো দোয়ায় গত বৎসর মাঘ মাসেই আমার বিয়া হইছে।”

হাসনা বেগম মোহিত গলায় বললেন, “তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে জরিনা। বিয়ে না হলে আমি নিজ খরচে তোমাকে বিয়ে দিতাম।”

আগের কালের মহিলার এই এক অভ্যাস। কোনো অবিবাহিত মেয়ের ওপর খুশি হলেই পুরষ্কারস্বরূপ তার বিয়ে দিয়ে দেওয়ার প্রচলনটা বেশ পুরাতন।

জরিনা বিগলিত হাসি হেসে বলল, “কী যে কন খালাম্মা!”

“সত্যি বলছি। বিয়ে দেওয়াটা তো হলো না, তোমার বাচ্চা-কাচ্চা হলে তাকে সুন্দর দেখে একটা সোনার বালা বাঁধিয়ে দেবো।”

“ও আল্লা গো! বালা দিয়া আমি করমু কী খালাম্মা?”

“বাচ্চাকে পরিয়ে রাখবে! সত্যিই, তোমার মতো গুণে পারদর্শী মেয়ে আমি জীবনেও দেখিনি। এখানে এসেছি পর থেকে এমন একবারও হয়নি যে তোমাকে একটা কাজ দিয়েছি আর তুমি পারোনি। আহারে! আমার মেয়েটা যদি এমন হতো। তা নয়, সারাদিন শুধু গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াবে!”

“শিখখ্যা যাইবো খালাম্মা, বিয়াটা হইতে দেন।”

কনা ওদিক থেকে তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল, “বিয়ে হওয়ার সঙ্গে এসব কাজ-টাজ শেখার সম্পর্ক কী? একটা কাগজে সাইন করলেই মানুষ বদলে যায় না-কি? এই নাজ, তুই গেছিস বদলে?”

নাজ না-সূচক মাথা নাড়লো।

হাসনা বেগম অভিজ্ঞ গলায় বললেন, “বিয়ের এক সেকেন্ডের মাথায় কেউ বদলায় না। কয়েকটা দিন যেতে দে, দেখবি তোর বান্ধবীকে চিনতেই পারছিস না!”

মধ্যদুপুরে অলস ভঙ্গিতে টিভির সামনে বসে রয়েছে নাজ এবং হাসনা বেগম। রান্নাবান্না সেই কখন শেষ হয়েছে, অপেক্ষা শুধু সায়েম আর তার বাবার। একটা গরু কিনতে এতক্ষণ লাগে না-কি? নাজের বাবা জীবিত থাকতে আধ ঘন্টার মধ্যে হাট থেকে গরু কিনে বাড়ি ফিরতেন। কনা যেন অপেক্ষা করতে করতে অস্থির হয়ে উঠেছিল। তাই ব্যাকুল হয়ে বাড়ির নিচে গিয়েই অপেক্ষা করছে তাদের জন্যে। কোরবানির পশুকে প্রথমবারের মতো দেখার মধ্যে সত্যিই অন্যরকম এক অনুভূতি কাজ করে।

হুট করে কনা এসে বলল, “দোস্ত! গরু চলে এসেছে। তাড়াতাড়ি আয়!”

নাজ এক লাফে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, “মা, আপনি যাবেন না?”

“তোমরা ছেলেমেয়েরা আগে দেখো, আমি তো আছিই।”

নাজ ধড়মড় করে সিড়ি দিয়ে নামছে। প্রবল উত্তেজনায় তার বুক ধরফর করছে। দীর্ঘ সময় ধরে গরুর সঙ্গে সেলফি তোলার জন্যে বেচারি অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছে। অবশেষে অপেক্ষার অবসান ঘটতে চলেছে ভেবেই শিউরে উঠলো নাজ।

গরুটা এনে রাখা হয়েছে বাড়ির গ্যারেজে। বিল্ডিংয়ের অন্যান্যরাও এখানেই রেখেছে নিজেদের কোরবানির পশু। এই গ্যারেজটাই যেন এখন মনে হচ্ছে ছোটখাটো গরুর হাট। ব্যস্ত পায়ে গ্যারেজে পৌঁছাতেই গা বেয়ে প্রবল স্রোত বয়ে গেল নাজের।

সায়েম যে গরুটা এনেছে সেটা তো সাদাকালো নয়। বরং হালকা বাদামি রঙের একটা গরু। কোনো মানে হয়? নাজ এ করে বলে দেওয়ার পরও ছেলেটা শুনলো না।

কীসের সেলফি আর কিসের উদযাপন! নাজ শুকনো মুখে ঘরে ফিরে এল। ততক্ষণে বাকিরাও সকলে ফিরে এসেছে। সায়েম ক্লান্ত ভঙ্গিতে সোফার ওপরে গা এলিয়ে দিল। একে তো মাথার ওপরে কড়া রোদ তার ওপরে দিনভর হাটে ঘোরাঘুরি আর দর কষাকষি, বেচারা বেশ ক্লান্ত।

নাজ ব্যথিত কণ্ঠে বলল, “আপনাকে কী বললাম আর আপনি কী নিয়ে এলেন!”

সায়েম সোজাসাপ্টা উত্তর দিয়ে বলল, “ওরকম কোনো গরু আমার চোখে পড়েনি।”

“কী যে বলেন আপনি! এত বড় একটা হাট আর একটাও সাদাকালো গরু নেই?”

সায়েম কিছু বুঝে ওঠার আগেই শওকত সাহেব হড়বড় করে বলে উঠলেন, “এই সায়েম, আমরা যেখান থেকে গরু কিনলাম তার পাশেই তো কতগুলো সাদাকালো গরু ছিল। তুই খেয়াল করিসনি?”

সায়েম ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো বাবার দিকে। তাকে এখনই মুখটা খুলতে হলো!

নাজ আঁতকে উঠে বলল, “তার মানে আপনি ইচ্ছা করে আমার পছন্দমতো গরু আনেননি!”

সায়েম শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “ইচ্ছা করে না, আমার পছন্দ হয়নি।”

“পছন্দ না হওয়ার কী আছে?”

সায়েম বিরক্ত গলায় শওকত সাহেবের উদ্দেশ্যে বলল, “এখন চুপ করে আছ কেন বাবা? বলো, ওই গরুগুলো বাছুরের থেকে একটু বড় ছিল।”

শওকত সাহেব ইতস্তত করে বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ বৌমা, ওই গরুগুলোর গায়ে তো মাংসই নেই। একটা মোটাসোটা অবশ্য ছিল, কিন্তু সেটা আবার বুড়ো। তাই…”

নাজ ব্যথিত কণ্ঠে বলল, “আমি সব বুঝতে পেরেছি। আপনি ইচ্ছা করেই আনেননি।”

“এক কথা বারবার বলছো কেন ড্যামইট! একবার তো বললাম ওই গরু আমার পছন্দ হয়নি তাই কিনিনি।”

“আরেকটু খুঁজে দেখলে কী হতো? আমি এত করে বলে দিলাম। আমার কথার যদি কোনো মূল্যই না থাকে…”

নাজকে থামিয়ে দিয়ে সায়েম প্রচন্ড এক দমক দিয়ে বলল, “শাট আপ নাজ! সব সময় ছেলেমানুষী ভালো লাগে না।”

পুরোটা ঘর জুড়ে যেন নিস্তব্ধ এক হওয়া বয়ে গেল। শান্ত-শিষ্ট এই ছেলেটা সাধারণত খুব একটা রেগে যায় না। কিন্তু একবার রেগে গেলে আশেপাশের সকলে তার ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকে। তার বলতে তার রাগের।

নাজের চোখের কোণে সূক্ষ্ম জলকণা এসে জমেছে। বহু চেষ্টা করছে ধরে রাখতে। মানুষটা কী করে পারলো সকলের সামনে তাকে এভাবে ধমকাতে।

(চলবে)