অপেক্ষারা পর্ব-৪৪+৪৫+৪৬

0
501

#অপেক্ষারা
৪৪
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

ঘুটঘুটে অন্ধকারে এক খন্ড আলোর বার্তা নিয়ে এসেছে চাঁদটা। আকাশে চাঁদ, আর মাটিতে তার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা দুই নর-নারী। সায়েম আর নাজের অদ্ভুত সুন্দর এই ছবিটা তুলেছিল কনা। গতবার যখন তারা বাড়িতে গিয়েছিল, বেশ কিছু চমৎকার ছবি তুলে দিয়েছিল। সব ছবিগুলোই বিশাল ফ্রেমে বাঁধাই করিয়ে ঘরের নানান দেয়ালজুড়ে টানিয়ে রেখেছে তারা।

নতুন এই বাড়িটা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আপন হয়ে উঠেছে নাজের কাছে। চার বেডরুমের এই বিশাল ফ্ল্যাটে মাঝেমধ্যে নিজেকেই হারিয়ে ফেলার উপক্রম হয়। সবথেকে সুন্দর ঘরটা পশ্চিম দিকে। দিনভর সূর্যালোকের আনাগোনা সেখানে। সন্ধ্যা গড়িয়ে পড়ার আগেই সূর্যাস্তের লাল আভা ছেয়ে যায় ঘর জুড়ে। এই ঘরটাই নাজ আর সায়েমের। ঘরের সঙ্গে লাগোয়া বারান্দাটাও বিশাল।

ঢাকা শহরের বেশির ভাগ বাড়ির বারান্দা থেকে দেখতে পাওয়া দৃশ্যগুলো সাধারণত খুব একটা সুখকর হয় না। একটা বিল্ডিংয়ের গায়ের সঙ্গেই আরেকটা বিল্ডিং থাকায় বারান্দা থেকে পাশের বাড়ির মেলে রাখা কাপড় ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। তবে এই বাড়িটা ব্যতিক্রম। এর গায়ের সঙ্গেই আরেকটা বিল্ডিং নেই। আছে একটা সবুজঘেরা পার্ক। বিকেল হলেই বাচ্চাকাচ্চাদের কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে ওঠে জায়গাটা। প্রায় প্রতিটি বিকেলেই নাজের কাটে বাচ্চাগুলোর আনন্দে আত্মহারা চেহারাগুলো দেখে।

তবে আজ সেসব কিছুই করছে না। অলস ভঙ্গিতে গা এলিয়ে দিয়েছে বিছানার ওপরে। মনটা কেমন যেন অবশ হয়ে আছে। আশেপাশের সবকিছুই অসহ্য লাগছে। এই মন খারাপের মুহূর্তের জন্যে দায়ী সায়েম। না, দুজনের মধ্যে ঝগড়া-টগড়া বাঁধেনি। সায়েমের সঙ্গে ঝগড়া করার মতো ক্ষমতা প্রকৃতি নাজকে দেয়নি।

সায়েম আগামীকাল সকালে খুলনায় যাচ্ছে, বিজনেস ট্রিপের উদ্দেশ্যে। কোম্পানির নতুন ব্রাঞ্চ খোলা হচ্ছে খুলনায়। উপযুক্ত পরিচর্যা আর যত্ন পেলে ছোট্ট একটি নড়বড়ে চারাগাছও নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখে। একবার তার গোড়া মজবুত হয়ে গেলে কোনপ্রকার সাহায্য ছাড়া একাই সগৌরবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। তেমনি প্রথমদিকে সঠিক নির্দেশনা পেলে নতুন ব্রাঞ্চটা বেশ ভালোই উন্নতি করবে, যা কোম্পানির জন্যেই হবে লাভজনক। তাই কয়েকটা দিন সায়েমকে সেখানেই থাকতে হবে। কারণ ‘সঠিক নির্দেশনা’ দেওয়াটা কেবলমাত্র তার পক্ষেই সম্ভব।

নাজ সবসময় চেষ্টা করে সায়েমের কাজে কোনো ব্যাঘাত না ঘটাতে। প্রতিটা সফল পুরুষের পেছনে না-কি একজন নারীর অবদান থাকে। অবদান না রেখে উল্টো বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে চায় না সে। তবুও, এতগুলো দিন তাকে ছাড়া থাকতে হবে ভাবতেই একরাশ মলিনতা ছেয়ে যাচ্ছে মনে। আগামী কয়েক দিন ইচ্ছে হলেই সায়েমকে বিরক্ত করতে পারবে না। ইচ্ছে হলেই তার পরিপাটি আচড়ানো চুলগুলোকে এলোমেলো করে দিতে পারবে না। ইচ্ছে হলেই তার কাঁধে মাথা রাখতে পারবে না। ক্ষণিকের দূরত্বগুলোও মাঝে মাঝে অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায়।

হঠাৎই নাজের ফোনটা বেজে উঠলো। বিরক্তিতে গা জ্বলে গেল তার। এই অসময়ে আবার কে ফোন করেছে? ফোনে কথা বলতেও ধৈর্যের প্রয়োজন হয়। এই মুহূর্তে কোনো কিছুর ওপরেই নাজ ধৈর্য ধরে রাখতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না।

ক্লান্ত ভঙ্গিতে ফোন হাতে নিতেই স্ক্রিনের ওপর ভেসে ওঠা নামটা পড়ে মনে মনে বেশ ভালোই চমকে উঠলো নাজ। ফোন করেছে শিউলি। তাও আবার এতদিন পর? নাজ বহুবার চেষ্টা করেছে মেয়েটার সঙ্গে যোগাযোগ করার। কিন্তু কোনোবারই সে ফোন তোলেনি। তবে আজ হঠাৎ কী মনে করে? প্রচন্ড অভিমানে না একবার ভাবলো ফোনটা রিসিভ করবে না। আবার পরমুহূর্তেই মনে হলো, আহারে! কতদিন মেয়েটার সঙ্গে কথা হয় না।

নাজ ফোন রিসিভ করেই কঠিন গলায় কিছু একটা বলতে যাবে, তার আগেই অপরপ্রান্ত থেকে শোনা গেল শিউলির আতঙ্কিত কণ্ঠস্বর।

“নাজ! আমাকে বাঁচা!”

নাজ কিছুটা ভড়কে গিয়ে বলল, “শিউলি? কী হয়েছে তোর? তুই ঠিক আছিস?”

শিউলি অসহায় গলায় বলল, “না, আমি ঠিক নেই। তোর আমাকে বাঁচাতেই হবে। আর এক মুহূর্তও এখানে থাকলে আমি মরেই যাবো?”

নাজ উঠে বসতে বসতে উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “এখানে মানে? কোথায় তুই? কী হয়েছে তোর?”

“আমার শাশুড়ি এক সপ্তাহ হলো মারা গেছেন। সেই থেকে শিহাব আমাকে জীবনটাকে অতিষ্ট করে রেখেছে। বলছে, আমি অপারেশনের টাকা যোগাড় করে দিতে পারিনি বলেই না-কি ওর মা মারা গেছে।”

শিউলি ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। নাজ কী বলবে বুঝতে পারছে না। কী হচ্ছে এসব?

শিউলি কাঁদতে কাঁদতেই বলল, “আমি তো একবার টাকা দিয়েছিলাম। মা সব গয়না বিক্রি করে টাকা পাঠিয়েছিল। একবার অপারেশন করানোও হয়েছিল। তারপর ডাক্তার বলে আবারও অপারেশন করাতে হবে, কী যেন সমস্যা রয়ে গেছে। আমি এত টাকা কোথা থেকে জোগাড় করি বল তো? মা তো তার যা ছিল, সবটুকুই দিয়েছে।”

নাজ আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “তুই শান্ত থাক শিউলি। তোর হাসব্যান্ড অতিরিক্ত শোকে পাথর হয়ে এমন কান্ড করছে। আসলে যে শাশুড়ির মৃত্যুতে তোর কোনো দোষ নেই সেটা সেও জানে।”

“না রে দোস্ত। তুই ওকে চিনিস না, আমি চিনি। এতকাল ধরে সহ্য করে আসছি।”

“কী সহ্য করে আসছিস?”

“বিয়ের পরদিন থেকে আমাকে উঠতে বসতে খোঁটা দিচ্ছে। কথায় কথায় বলে বাপের বাড়ি ফিরে যেতে। নিজের পছন্দে বিয়ে করে এসেছি, চাইলেই তো বাবা-মায়ের কাছে ফিরে যেতে পারি না। তোকে মিথ্যা বলেছিলাম, আমি এইচএসসি পরীক্ষা দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু শিহাব দিতে দেয়নি। শাশুড়ির অসুস্থতার অজুহাতে আমার লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়েছে। এমনকি বাড়ির কাজের লোককে বিদায় করে দিয়েছে। তবুও মুখ বুজে সহ্য করে ছিলাম, কিন্তু এখন…”

নাজ কম্পিত স্বরে বলল, “এখন কী শিউলি?”

“দ্বিতীয়দফায় অপারেশন টাকা যোগাড় করতে না পারার পর থেকে ও ক্রমাগত আমার গায়ে হাত তোলে। আমার শরীরের একটা জায়গাও অবশিষ্ট নেই যেখানে ওর দেওয়া আঘাতের চিহ্ন নেই। আমি আর সহ্য করতে পারছি না নাজ। কোনদিন দেখবি ওর হাতে মরে গেছি।”

কথাগুলো শোনার সঙ্গে সঙ্গেই নাজের চোখমুখ রক্তশূন্য হয়ে উঠলো। হাত-পা তার থরথর করে কাঁপছে। প্রকৃতি দুহাত উজাড় করে মায়া-মমতার মতো শক্তিশালী অনুভূতিগুলো দিয়ে শিউলিকে তৈরি করেছে। মেয়েটা তার আশপাশের সকলকে ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রাখতে জানে। এমন একটা মেয়ের তো কোনো রাজপ্রাসাদের রাণী হয়ে থাকার কথা। আর তার কিনা হয়েছে এমন করুণ পরিণতি? তাও আবার যে মানুষটাকে ভালোবাসে বিয়ে করলো তার হাতে?

নাজ নিচু গলায় বলল, “আমাকে আগে বলিসনি কেন?”

শিউলি কান্নাজড়ানো কণ্ঠে বলল, “ভেবেছিলাম তাতে শিহাবের অপমান হবে। কী করবো বল? ভালোবেসেছিলাম তো!”

ভালোবাসা জিনিসটা এমন কেন? ভালোবাসার মানুষটা যতই কষ্ট দিক না কেন, এই অনুভূতি তার প্রতি একবার জন্মালে এই জীবনে ছেড়ে যায় না।

নাজ কিছু একটা ভেবে দৃঢ় গলায় বলল, “তুই চিন্তা করিস না, আরেকটু সহ্য কর। ওই শিহাবের শেষ আমি দেখে ছাড়বো।”

শিউলিকে চিন্তা করতে না বলে নাজ নিজেই দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে যাচ্ছে। অনিশ্চিত ভঙ্গিতে ঘরজুড়ে পায়চারি করছে মেয়েটা। কোনোকালেই অন্যায়ের প্রতিবাদ করার মতো সাহস বা ইচ্ছা দেখা যায়নি শিউলির মাঝে। তাই অন্যায় কিছু ঘটলে সেই অন্যায়ের প্রতিবাদ তার প্রাণের বান্ধবীরাই করে এসেছে। সেই সময়ে সকলে ছিল একই এলাকাই। বাড়ির জানালা থেকে মুখ বাড়িয়ে চিৎকার করলেই যেন কয়েক মিনিটের মাঝে জড়ো হয়ে যেত সকল বান্ধবীরা। কিন্তু এবার কী হবে? আজ তো আর সকলে একই এলাকায় নেই। একেকজনের বসবাস একেক শহরে। চাইলেই তো একজন আরেকজনের বিপদে ছুটে যেতে পারে না। নাজ কী করে উদ্ধার করবে শিউলিকে? মাথায় কিছুই কাজ করছে না। সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে আসছে।

মনের অজান্তেই নাজের হাতটা চলে গেল মোবাইলের ওপরে। কনাকে ফোন করে ব্যাপারটা জানাতে হবে। অতিরিক্ত দুশ্চিন্তায় ভাবনা-চিন্তার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে নাজ। কনাকে ফোন করেই একটা বুদ্ধি চাইতে হবে।

একটা রিং বাজতেই অপরপ্রান্ত থেকে শোনা গেল কনার উৎফুল্ল কণ্ঠ, “আরে ভাবি সাহেবা! হঠাৎ আমাকে পড়লো যে?”

নাজ থেমে থেমে বলল, “কনা? তোর মনে আছে বিয়ের পর প্রথম যেবার আমি বাড়ি গিয়েছিলাম, সেবার শিউলির হাজবেন্ডকে শিক্ষা দেওয়ার জন্যে ওর বাড়ির সামনে ময়লা ফেলে রাখার প্ল্যান করেছিলাম।”

“করেছিলি তো! কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর গেলি না। তুই যাবি না দেখে আমরাও আর যাইনি। কত কষ্ট করে দুই বালতি দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা জোগাড় করেছিলাম, সব কষ্ট তোর জন্যে জলে গেল।”

নাজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “শিহাবকে শিক্ষা দেওয়াটা বাকি রয়ে গেছে বুঝলি? এবার দিতে হবে।”

“মানে?”

নাজ পুরো ঘটনার খুঁটি-নাটি খুলে বলল কনাকে। পরবর্তী কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল নিস্তব্ধ নিরবতায়। কনা কিছু একটা বলতে চাইছে, তবে বলার ভাষা হারিয়ে ফেলছে বারবার। শিউলির মতো চমৎকার একটা মেয়ের সঙ্গে এমন নির্মম ঘটনা ঘটতে পারে তা যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না।

অবশেষে নিরবতা ভঙ্গ করে কনা বিভ্রান্ত ভঙ্গিতে বলল, “এটা কী করে সম্ভব? তুই তো কখনো ওদের প্রেমটা দেখিসনি, আমি আর মালা দেখেছি। শিহাবভাই তো এমন মানুষ ছিল না। প্রতিটা মুহূর্ত শিউলির জন্যে পাগল হয়ে থাকতো। ওর গায়ে সামান্য একটা আঁচড় পড়লেও দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে পড়তো। সেই একই মানুষটা কী করে শিউলির গায়ে হাত পর্যন্ত তুলতে পারে?”

“হয়তো তার তরফ থেকে কেবল প্রেম ছিল বলেই পারে। ভালোবাসাটা কোনোদিন ছিল না।”

“আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না নাজ। আমরা এখন কী করবো?”

নাজ অসহায় গলায় বলল, “আমি জানি না। আমার মাথা কাজ করছে না।”

“নাজ? আমরা বরং শিউলির বাবা-মাকে বিষয়টা জানিয়ে দিই। উনারা চিটাগংয়ে গিয়ে শিউলিকে নিয়ে আসুক।”

“আমার মনে হয় না তাতে কাজের কাজ কিছু হবে।”

“কেন?”

“ওর বাবা-মা জানতে পারলে বিষয়টা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করবে। অন্যায়ের প্রতিবাদ তো করবেই না, বরং মেয়েকে বলবে মানিয়ে চলতে।”

কনা প্রায় অনেকটা সময় কী যেন ভেবে বলল, “তাহলে চল আমরা সেখানে যাই।”

“আমরা? তুই ময়মনসিংহে আমি ঢাকায়, আমরা কী করে যাবো? তাছাড়া তোর ভাইয়া কাল বিজনেস ট্রিপে যাচ্ছে। ফিরতে ফিরতে এক সপ্তাহ। আমি তো আর একা একা অত দূর যেতে পারবো না।”

“তাহলে বরং এক কাজ করি। আমি আর মালা ঢাকায় চলে যাই, সেখান থেকে সকলে আবার চিটাগংয়ে যাবো।”

“ব্যাপারটা যতটা সহজ ভাবছিস, ততটা সহজ কিন্তু না। মাকে কী বলবি? আর তোর ভাইয়াকে? তোর ভাইয়া জীবনেও আমাদের একা একা অন্য একটা শহরে যেতে দেবে না। আর যেখানে এমন পারিবারিক ঝামেলা আছে সেখানে তো একেবারেই। সে নিজে সবসময় ঝামেলা এড়িয়ে চলে, আমকেও ঝামেলার ধারের কাছে ঘেঁষতে দেয় না।”

“ভাইয়াকে বুঝিয়ে বল। আমরা না গেলে মেয়েটা তো মরে যাবে।”

“বললেও লাভ হবে না। উনিও বলবে শিউলির বাবা-মাকে জানাতে। যাদের মেয়ে তারা বুঝবে।”

“তাহলে আর কী করা? সত্যি কথায় কাজ না হলে মিথ্যার আশ্রয়ই নিতে হবে।”

“মানে?”

“ভাইয়া তো কাল বিজনেস ট্রিপে যাচ্ছে তাই না?”

“হুঁ।”

“আমি এখন ভাইয়াকে ফোন করে বলি, এতগুলো দিন একা একা থাকতে তোর কষ্ট হবে তাই আমরা গিয়ে তোর সঙ্গে থাকবো। এতে ভাইয়া বরং খুশিই হবে, মায়েরও কোনো আপত্তি থাকবে না। তারপর ঢাকা থেকে আমরা চিটাগংয়ে চলে যাবো, কেউ জানতেও পারবে না।”

নাজ শুকনো মুখে বলল, “উনাকে মিথ্যা বলবো?”

“উফ নাজ! জীবনে দুয়েকটা মিথ্যা বললে ক্ষতি হয় না।”

“কিন্তু আরও একটা সমস্যা আছে।”

“আবার কী সমস্যা?”

“এতটা পথ আমরা একা একা যাবো?”

“একা কোথায়? আমি, তুই আর মালা – আমরা তিনজন মানুষ!”

“তবুও… আমরা ভয় করছে। একে তো অচেনা একটা শহর, তার ওপরে আবার অমন আবুসিভ একটা ছেলে।”

“এক কাজ করি, পাহারাদার হিসেবে বাবাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসি।”

“বাবাকে সঙ্গে নিয়ে চিটাগংয়ে যাবো? উনাকে কী বলবি?”

“বলবো যে একদিনের জন্যে আমরা চিটাগংয়ে যাচ্ছি শিউলির সঙ্গে দেখা করতে। বাবা যেন পাহারাদার হিসেবে আমাদের সেখানে নিয়ে যায়। ভাইয়া রাগ করবে, এজন্যে তাকে যেন কিছু না বলে। বাবা সহজ-সরল মানুষ। তাকে যদি একবার বারণ করি, সে কিছুতেই ভাইয়াকে বলবে না।”

কনার কথায় তেমন একটা ভরসা পেল না নাজ। তবুও এই মুহূর্তে ভরসা করা ছাড়া কোনো উপায় খুঁজে পেল না। সবকিছুর ঊর্ধ্বে আগে শিউলিকে বিপদ থেকে রক্ষা করতে হবে।

রাত দশটা সতেরো মিনিট। ব্যস্ত ভঙ্গিতে সায়েমের সুটকেস গোছাচ্ছে নাজ। সকাল সকাল তার ফ্লাইট, নাজ বারবার দেখছে কোনো কিছু বাদ পড়লো কি-না। ছেলেটা সাতদিন সেখানে থাকবে, কিছু একটা বাদ পড়লে তারই কষ্ট হবে। সায়েম বিছানার ওপরে বসে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নাজের ব্যস্ততামাখা মুখটার দিকে।

নাজ সুটকেস গোছাতে গোছাতে বলল, “শুনুন! একদম সিগারেট-টিগারেট খাবেন না। আর যেখানেই যাবেন সাথে করে পাওয়ার ব্যাংক নিয়ে যাবেন। চার্জ ফুরিয়ে গেলে আমি আবার ফোন পাবো না। আর সময়মতো খাওয়া-দাওয়া করবেন। আমাকে যেন বারবার ফোন করে মনে করিয়ে দিতে না নয়।”

সায়েম অন্যরকম গলায় বলল, “এসব না বলে একবার থেকে যেতে বললেই তো পারো।”

“বললেই বুঝি আপনি থেকে যাবেন?”

“থেকে যেতেও তো পারি।”

“মোটেও না। কাজে ফাঁকি দেওয়া আমার একদম পছন্দ নয়। ভালোবাসা ভালোবাসার জায়গায় আর কাজ কাজের জায়গায়। কোনো একটার জন্যে আরেকটা অবহেলা করা ঠিক নয়।”

সায়েম অবাক গলায় বলল, “ইউ সাউন্ড লাইক মি।”

নাজ তার স্নিগ্ধ হাসিটা ছুঁড়ে দিয়ে বলল, “কী আর করা? তোমার সঙ্গে থেকে থেকে অভ্যাস হয়ে গেছে।”

“আমার তো তোমার সঙ্গে থাকাটাই অভ্যাস হয়ে গেছে। এই কয়টা দিন কী করে থাকবো বলো তো? এক কাজ করো, নিজেকেও এই সুটকেসে ভরে দাও।”

“অভ্যাস তো আমারও হয়ে গেছে। বিয়ের পর তোমাকে ছেড়ে এতগুলো দিন থেকেছি কখনো? আগে যখন আমরা আলাদা আলাদা ঘরে থাকতাম, তখন নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিতাম যে দুজনে একই ছাদের নিচে তো আছি। ইচ্ছে হলেই তোমার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখতাম, মানুষটা কী করছে। জেগে আছে না ঘুমিয়ে পড়েছে।”

সায়েম লক্ষ করলো নাজ একদৃষ্টিতে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখদুটো জলে টলমল করছে, যেকোনো সময় গড়িয়ে পড়বে গাল বেয়ে। নাজ প্রাণপণ চেষ্টা করছে চোখের জল ধরে রাখতে, কিন্তু সেই চেষ্টা বেশিক্ষণ সফল হবে বলে মনে হচ্ছে না।

সায়েম তড়িৎ গতিতে উঠে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো তার প্রেয়সীকে। ছেলেটার বুকে মাথা রাখতেই কানে ভেসে এলো তার অস্থির গতিতে স্পন্দিত হতে থাকা হৃদয়ের ধ্বনি। নিজেকে ধরে রাখা আর সম্ভব হলো না নাজের পক্ষে। দুয়েক ফোঁটা অবাধ্য অশ্রু টুপটাপ করে গড়িয়ে পড়লো তার গাল বেয়ে।

সায়েম কোমল স্বরে বলল, “কান্না চেপে রাখার দরকার নেই। আমি তো চাই আমার জন্যে কাঁদো, আমার অ্যাবসেন্সে অস্থির হয়ে থাকো, আমাকে মিস করো।”

সকাল সকাল ফ্লাইটের জন্যে তৈরি হচ্ছে সায়েম। অফিস থেকে একটু পর পরই ফোন আসছে। সকলে ইতোমধ্যেই এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেছে। বাদ রয়ে গেছে কেবল সায়েম। সায়েম যথেষ্ট সময় সচেতন একটা মানুষ। কোথাও নির্ধারিত সময়ের পর গিয়েছে, এমন দৃশ্য বিরল। আজও যে দেরি হয়েছে তা নয়। অফিসের অন্যান্যরা আগে আগেই এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেছে। নিজেরা আগে আগে পৌঁছে সায়েমকে তাড়া দেওয়ার অর্থ কী কে জানে?

সায়েম ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হাতঘড়িটা পড়ছে, তখনই আবার বেজে উঠলো মোবাইলটা। নিতান্ত অনিচ্ছায় মোবাইলটা তুলে কানের কাছে ধরলো সায়েম। এক হাতে হাতঘড়ি পড়ার চেষ্টা করার কোনো অর্থ নেই। তবুও সায়েম ফোনে কথা বলতে বলতে সে চেষ্টা করছে যাচ্ছে।

ব্যাপারটা খেয়াল করে নাজ তার কাছে এগিয়ে গেল। সায়েমের হাতটা সরিয়ে দিয়ে সে নিজেই অতি যত্নে ঘড়িটা পড়িয়ে দিল তার হাতে।

সায়েমের কথা শেষ হতেই নাজ নিচু গলায় বলল, “আমি আপনাকে ছেড়ে দিতে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত যাই?”

“উহুঁ। পরে এয়ারপোর্ট থেকে এতটা পথ একা এক বাসায় ফিরবে কী করে?”

মুহূর্তেই একরাশ অপরাধবোধ জেঁকে ধরলো নাজকে। যে মানুষটা সামান্য এয়ারপোর্ট থেকেই নাজকে একা ছাড়তে ভরসা পায় না, তাকে না জানিয়ে সম্পূর্ণ অচেনা একটা শহরে যাওয়াটা অন্যায়। জানালে যে সায়েম তাকে কিছুতেই সেখানে যেতে দেবে না খুব ভালো করেই জানে নাজ। সেজন্যেই তো এমন লুকোছাপা।

কিন্তু একবার সেখান থেকে ফিরে এসেই মানুষটাকে সবকিছু বুঝিয়ে বলবে নাজ। সায়েমের কাছ থেকে সে অতি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কিছুও লুকিয়ে রাখতে পারে না। আচ্ছা এসব ঘটনা শোনার পর সায়েম কি তাকে বকবে? রাগ করে কথা বলা বন্ধ করে দেবে? যা হবার দেখা যাবে। একবার ওই নরক থেকে শিউলিকে উদ্ধার করে আনুক, বাকিটা শক্ত হাতে সামাল দেওয়া যাবে।

(চলবে)

#অপেক্ষারা
৪৫+৪৬
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

ঢাকা এবং চট্টগ্রাম, পাশাপাশি দুটো শহরের দূরত্ব এমন অসহনীয় পর্যায়ে চলে যাবে কেন? অসহনীয় আসলে দূরত্বটা নয়, ঢাকা শহরের যানজট। দীর্ঘ চার ঘণ্টা ধরে জ্যামে আটকে আছে বাসটা। একটু এগোচ্ছে, আবার মিনিট দশেকের জন্যে থেমে যাচ্ছে। নাজের মাথায় সেই তখন থেকে ভোঁতা ধরনের একটা যন্ত্রণা। বাসে যাতায়াতের অভ্যাস যে তার নেই, তা নয়। বছরে কয়েকবার বাসে করেই তো সে সায়েমের সঙ্গে ময়মনসিংহে যায়। তবে কখনোই এমন যানজটের মুখোমুখি হতে হয়নি।

বাসটা এই মুহূর্তে থেমে আছে একটা রেস্টুরেন্টের সামনে। নাজ তড়িঘড়ি করে বাস থেকে নেমে গেল, তার পিছু পিছু নেমে গেল মালাও। রেস্টুরেন্টের বাথরুমে গিয়ে হড়বড় করে বমি করলো নাজ। মনে মনে, এ যাত্রায় বেঁচে আর কোনোদিন বাসে করে চিটাগংয়ে যাবে না এমন প্রতিজ্ঞাও করে ফেলল।

নাজ চোখেমুখে পানি দিলো, মাথায় পানি দিলো। এবার কিছুটা ভালো লাগছে। মালা সবসময় ব্যাগে করে আস্ত একটা ফার্মেসি নিয়ে ঘোরে। কখন কোন ওষুধের প্রয়োজন পড়ে যায়, বলা তো যায় না। তার কাছে বমি ভাব দূর করার ওষুধ চাইতে হবে।

নাজ বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসতেই মালা তার দিকে একটা রুমাল বাড়িয়ে দিলো।

নাজ মুখ মুছতে মুছতে বলল, “জ্যাম আমার একদম সহ্য হয় না বুঝলি? ইঞ্জিনের শব্দ, কালো ধোঁয়া এসব সবকিছুর কারণে মাথাটা এমন বাজেভাবে ঘুরে উঠলো!”

“এখন ভালো লাগছে?”

“হুঁ। তোর কাছে বমি ভাব দূর করার ট্যাবলেট আছে?”

মালা আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “আছে। বাসে চল, দিচ্ছি।”

“কনা কী করছে?”

“খালুজানকে লেকচার দিচ্ছে যেন ভুল করেও খালাম্মা আর সায়েমভাইকে ফোন করে না বলে আমরা চিটাগং যাচ্ছি।”

নাজ ক্ষীণ গলায় বলল, “ও।”

“তোরা সায়েমভাইকে এত ভয় পাস কেন কে জানে! এত ভালো একটা মানুষ উনি!”

নাজ ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “ভালো মানুষের ধমক তো খাসনি কখনো।”

“ধমক তো তোর ভালোর জন্যেই দেয় নাজ। যে বিচ্ছু তুই! এমন কখনো হয়েছে, সায়েমভাই কোনো কারণ ছাড়া তোকে বকাঝকা করছে?”

“কখনো না।”

মালা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে শুকনো মুখে বলল, “তোর গায়ে হাত তুলেছে কখনো?”

নাজ আঁতকে উঠে বলল, “কী যে বলিস? আমার সামান্য হাত কেটে গেলেই যে মানুষটা ব্যস্ত হয়ে পড়ে, যে আমার গায়ে হাত তুলবে কী করে?”

“কী অদ্ভুত ব্যাপার দেখ! আমরা একই সঙ্গে বেড়ে উঠলাম। একজনের ভাগ্য হলো রাজরানীর মতো, আরেকজনের…”

কথাটা শেষ করতে পারলো না মালা। গলা ভারী হয়ে এলো তার। ছোটোবেলা থেকেই শিউলির প্রতি একটু বেশিই সচেতন সে। মেয়েটা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শেখেনি। তার প্রতি যতই অন্যায় করা হোক না কেন, মুখ বুজে মেনে নেবে সবটা।

নাজ দৃঢ় গলায় বলল, “মানুষ নিজের ভাগ্য নিজেই লেখে মালা। একটা মানুষ তো আর হুট করে বিয়ের পর বদলে যেতে পারে না। ভালো মানুষের মুখোশের আড়ালে শিহাব যে একটা নোংরা মনের মানুষ তার লক্ষণ বিয়ের আগে একবারের জন্যে হলেও নিশ্চয়ই প্রকাশ পেয়েছে। শিউলি প্রেমে এতটাই অন্ধ ছিল যে একবারও দেখতে পায়নি।”

মালা আক্ষেপের স্বরে বলল, “মেয়েটাকে বিয়ের দিন পর্যন্ত আমি বারবার বলেছি, আরেকবার ভেবে দেখ। আমার কথাটা যেন কানেই তুলল না। একপ্রকার তাচ্ছিল্য করেই বলল, শিহাবের সঙ্গেই আমি ভালো থাকবো, আর কারও সঙ্গে নয়।”

বাসে মালা আর নাজ বসেছে পাশাপাশি। তাদের ঠিক সামনের দুটো সিটেই শওকত সাহেব আর কনা। শওকত সাহেব মালা আর কনাকে নিয়ে দুদিন আগেই ঢাকায় এসেছেন। কিন্তু চিটাগংয়ের টিকিট জোগাড় করতে করতে দেরি হয়ে গেল।

শওকত সাহেব ধরে নিয়েছিলেন তারা ঢাকায় বেড়াতে যাচ্ছে। সায়েম যে কদিন ঢাকার বাইরে থাকবে সেই কদিন তিন বান্ধবী একসঙ্গে আনন্দ করবে। তার কাজ হলো মেয়েদুটোকে নিয়ে সাবধানে ঢাকার পৌঁছানো, আবার ঢাকা থেকে সাবধানে বাড়ি ফিরে যাওয়া।

কিন্তু হুট করে এরা চিটাগংয়ে যাচ্ছে কেন এটাই মাথায় ঢুকছে না। যদিও কনা সকাল সকাল কয়েক হাজারবার বুঝিয়েছে, তারা যাচ্ছে শিউলির শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে। তবুও মনে হচ্ছে, বোঝার কিছু একটা বাকি রয়ে গেছে। কনা আবার বারবার বলছে সায়েম অথবা মা ফোন করলে তিনি কিছুতেই যেন না বলেন যে তারা চিটাগংয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করছেন। এত করে নিষেধ করার কী আছে কে জানে? কী এমন ক্ষতি হবে ওদের বললে?

নাজ আর মালা বাসে ফিরে এসে দেখলো শওকত সাহেব হা করে মুখটা খুলে রেখে ঘুমোচ্ছেন। তার পাশে কনা চিন্তিত ভঙ্গিতে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে।

নাজ বলল, “বাবা ঘুমিয়ে পড়লো কখন?”

কনা চিন্তিত গলায় বলল, “এইতো, কিছুক্ষণ আগে। নাজ শোন, বাবার ফোনটা কেড়ে নিলে কেমন হয় বল তো?”

“ফোন কেড়ে নিতে হবে কেন?”

“বাবাকে ভরসা নেই। দেখা গেল ভুল করে মাকে ফোন করে বলে দিয়েছে, সায়েমের মা আমরা চিটাগংয়ে এসেছি। কী যে সুন্দর একটা জায়গা!”

নাজ হেসে বলল, “তুই শুধু চিন্তা করছিস। শিউলিকে নিয়ে যখন তোরা বাড়ি ফিরে যাবি তখন তো না জানতেই পারবে যে আমরা চিটাগংয়ে গিয়েছিলাম।”

“তখন না হয় সামাল দেওয়া যাবে। কিন্তু এই মুহুর্তে জেনে গেলে সাড়ে সর্বনাশ। মা জেনে গেলে, ভাইয়াকেও জানিয়ে দেবে। দুই দিক থেকে দুই ডায়নোসর আমার জীবনটাকে অতিষ্ট করে দেবে।”

কনার কথায় ক্ষীণ হেসে নাজ নিজের জায়গায় এসে বসলো। বাস আবারও চলতে শুরু করেছে তার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। টানা পাঁচ মিনিট ধরে কোনো বিঘ্ন ছাড়াই ছুটে চলছে বাসটা। এমন দৃশ্য গত কয়েক ঘন্টায় দেখা যায়নি।

নাজের ফোনটা বেজে উঠলো। হ্যান্ডব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে স্ক্রিনে ভেসে ওঠা নামটা পড়তেই নাজের ঠোঁটে প্রচ্ছন্ন এক হাসি ফুঁটে উঠলো। সায়েম ফোন করেছে। হাসির সঙ্গে সঙ্গে মলিনতাও ছেয়ে গেল তার চোখেমুখে। আজ পাঁচদিন হয়ে গেল মানুষটাকে দেখে না সে। একটা মানুষের অভাব যে এতটা অসহনীয় পর্যায়ে চলে যেতে পারে, কে জানত?

ফোন রিসিভ করে নাজ হাসিমুখে বলল, “হ্যালো?”

অপরপ্রান্ত থেকে সায়েম স্বাভাবিক গলায় বলল, “কোথায় তুমি?”

“বাইরে। ইউনিভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরছি। হুট করে একটা ক্লাস পড়ে গেল।”

“শুক্রবারে ক্লাস?”

ঢোক গিললো নাজ। জীবনে কখনো সায়েমকে মিথ্যা বলেনি। সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কোনো ব্যাপারও লুকিয়ে রাখেনি। এই প্রথম লুকোচ্ছে। বারবার মনে হচ্ছে যেন তার কথা বলার ভঙ্গিতেই সায়েম ধরে ফেলবে মিথ্যাগুলো।

নাজ গলার স্বর যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে বলল, “এটা আবার কেমন প্রশ্ন? তুমি তো জানোই যে মাঝে মধ্যে শুক্রবারে ক্লাস পড়ে যায়।”

“ওহ সরি! ভুলে গিয়েছিলাম। কনারা ভালো আছে?”

মিথ্যাটা বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্যে নাজ বলল, “হুঁ। আমি তো ওদের বাসায় রেখে ক্লাসে আসতেই চাইনি। কনা জোর করে পাঠিয়ে দিলো। বলল, ভালো ছাত্রীদের না-কি একটাও ক্লাস মিস করতে নেই।”

“ঠিকই তো বলেছে।”

“তুমি খেয়েছ?”

“হুঁ।”

“ওখানে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো?”

সায়েম অন্যরকম গলায় বলল, “হচ্ছে তো! অসুবিধা এতই বেশি হচ্ছে যে কাজে এক ফোঁটাও মন বসছে না।”

“কী অসুবিধা?”

“তোমাকে আশেপাশে না পাওয়ার অসুবিধা। ইচ্ছা হলেই তোমাকে দেখতে না পারার অসুবিধা, তোমার খিলখিল হাসির শব্দ শুনতে না পারার অসুবিধা। আই ব্যাডলি মিস ইউ নাজ।”

মুহূর্তেই নাজের চোখদুটো ছলছল করে উঠলো। কথা বলার ক্ষমতা যেন কয়েক মুহূর্তের জন্যে হারিয়ে ফেলল মেয়েটা। ইশ! মানুষ যদি উড়তে পারতো! তাহলে তড়িৎ গতিতে উড়ে গিয়ে মানুষটার সামনে উপস্থিত হতো নাজ।

নাজ অস্পষ্ট গলায় বলল, “আই মিস ইউ টু।”

চট্টগ্রামে শিউলির শ্বশুরবাড়ি খুঁজতে খুব একটা বেগ পেতে হলো না। জংলা ধরনের এক এলাকায় একতলা বাড়ি। বাড়ির ছাদের একাংশ ভেঙে পড়ার উপক্রম। দেয়ালজুড়ে শ্যাওলা জমে গেছে।

কনা হতবাক গলায় বলল, “তুই শিওর এটা শিউলির বাড়ি? আমি তো শুনেছিলাম ওদের বাড়ির অবস্থা বেশ সচ্ছল।”

নাজ থমথমে গলায় বলল, “অনেক কথাই তো শুনেছিলাম কনা। সব তো আর সত্যি হয় না।”

দরজায় কোনো কলিংবেলের দেখা মিলল না। তাই বাধ্য হয়েই কড়া নাড়তে হলো। কয়েকবার কড়া নাড়তেই ব্যস্ত ভঙ্গিতে দরজা খুলল শিহাব। শিউলির বান্ধবীদের মোটামুটি সে চেনে। হুট করে অনাগত অতিথিদের দেখে ভালোই চমকে উঠলো শিহাব। তার চোখমুখ বিস্ময়ে চকচক করছে।

কণ্ঠে বিস্ময় ভাবটা ধরে রেখেই শিহাব বলল, “আরে কনা, শিউলি তোমরা!”

কনা কৃত্রিম হাসি হেসে বলল, “আপনাকে না জানিয়ে বিরক্ত করতে চলে এলাম শিহাবভাই।”

“বিরক্ত মানে? আমি খুব খুশি হয়েছি তোমাদের দেখে। এসো, ভেতরে এসো। আঙ্কেল স্লামালাইকুম। ভালো আছেন?”

শওকত সাহেব বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতে করতে বলল, “এই তো বাবা, চলছে। তোমার কী খবর?”

শিহাব ফিকে গলায় বলল, “ভালো আর থাকি কী করে আঙ্কেল? দুই সপ্তাহ হলো আম্মা মারা গেছেন। অনেক চেষ্টা করেছিলাম, বাঁচাতে পারলাম না।”

“শুনেছি খবরটা। মনে খুবই কষ্ট পেয়েছি। তোমার আম্মা ছিলেন অতি ভদ্রমহিলা। কী হয়েছিল উনার?”

“লিভার সিরোসিস। ডাক্তারের কথামত একবার অপারেশন করলাম আঙ্কেল, কিন্তু লাভ হলো না। বলল, আরেকবার অপারেশন করাতে হবে। কিন্তু আরেকবার অপারেশনের আগেই…”

“আহারে। ঢাকায় নিয়ে অপারেশন করাওনি কেন?”

শিহাব দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “চিকিৎসা তো সব জায়গায় একই আঙ্কেল। আসল কথা হলো কপালে মৃত্যু লেখা থাকলে কেউ আটকাতে পারে না। আম্মাকে বাঁচানোর চেষ্টা তো কম করলাম না। ডাক পড়ে গিয়েছিল, তাই মৃত্যু ছাড়া কোনো গতি নেই।”

“এটা ভালো বলেছ বাবা।”

শিহাব আন্তরিক গলায় বলল, “আপনারা দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আঙ্কেল বসুন।”

শওকত সাহেব বসতে বসতে বললেন, “তোমার আব্বা কোথায়?”

“উনি একটু বাইরে গেছেন, এখনই চলে আসবে।”

কনা বিনয়ী গলায় বলল, “শিহাব ভাই! এই হলো নাজনীন, আমাদের নাজমণি।”

শিহাব আন্তরিক ভঙ্গিতে বলল, “ও! তুমিই তাহলে নাজ? তোমার কত কথা শুনেছি শিউলির মুখে! কেমন আছ নাজ?”

“আপনি।”

শিহাব বিভ্রান্ত গলায় বলল, “হুঁ?”

নাজ নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “আমি হুট করে কারও মুখে তুমি ডাকটা শুনতে পারি না। কষ্ট করে আমাকে আপনি ডাকলেই খুশি হবো।”

কথাটায় শিহাব বেশ ভালোই অপ্রস্তুত হয়ে গেল। কোনোদিন যার সঙ্গে দেখাই হয়নি তার কাছ থেকে এমন কথা আশা করেনি। তবে শিহাব ছেলেটা বুদ্ধিমান বলতে হবে। বুদ্ধিমান বলেই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্যে দ্রুত নিজেকে সামলে নিলো। তার এমন একটা ভাব যেন কিছুই হয়নি।

মুখে হাসি টেনে বলল, “আচ্ছা আচ্ছা, কোনো সমস্যা নেই।”

কনা বলল, “শিউলি কোথায় শিহাবভাই?”

“আছে, ভেতরেই আছে। তোমরা বসো, আমি ডেকে আনছি।”

শিহাব ঘরের ভেতরে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মালা চোখমুখ বিকৃত করে বলল, “ভাবটা দেখেছিস, মনে হয় যেন পৃথিবীর শুদ্ধতম মানুষ।”

কনা চিন্তিত গলায় ফিসফিস করে বলল, “একে ফাঁকি দিয়ে শিউলিকে কী করে নিয়ে যায় বল তো?”

নাজ কঠিন গলায় বলল, “ফাঁকি দিতে হবে কেন? চোখের সামনে দিয়ে নিয়ে যাবো।”

“মানে? তোর মাথায় কী চলছে নাজ?”

“ঝিম মেরে বসে থাক তো।”

প্রায় অনেকটা সময় পার হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও কারোরই দেখা মিলল না। শিহাব কী কোনোভাবে টের পেয়ে গেল যে শিউলিই তাদের সকলকে ফোন করে ডেকে এনেছে? চিন্তিত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালো নাজ।

মালা অবাক গলায় বলল, “কী রে? কোথায় যাচ্ছিস?”

“দাঁড়া, আমি দেখে আসি এতক্ষণ ভেতরে কী করছে।”

“পাগল হয়েছিস গাধা! তুই একা একা ভেতরে যাবি?”

“হুঁ! কী আর হবে? তোরা বস, আমি আসছি।”

বাড়ির ভেতরটা বেশ ছিমছাম গোছানো। ডাইনিং রুমের দেয়ালজুড়ে শিহাব আর শিউলির বিয়ের ছবি। বাইরে থেকে কেউ দেখলে বুঝতেই পারবে মেয়েটার ওপর কেমন অত্যাচার হচ্ছে। বারান্দায় একবার উঁকি দিলো নাজ। এখানেও কেউ নেই। হঠাৎ চাপা এক আর্তনাদ ভেসে এলো তার কানে। শব্দটার উৎসের দিকে পা বাড়াতেই রান্নাঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো নাজ। এখানেই দেখা মিলল তাদের।

প্রথম দর্শনে নাজের বুক ধক করে উঠলো। শিহাব নামের ভালো মানুষের মুখোশধারী ছেলেটা নির্মমভাবে টেনে ধরেছে শিউলির চুলের মুঠি। শিউলি ছাড়া পেতে ছটফট করছে কিন্তু পেরে উঠছে না তার সঙ্গে। ভাগ্যিস তারা কেউই নাজকে দেখতে পায়নি।

নাজ ছোট ছোট পা ফেলে এমন এক জায়গায় দাঁড়ালো যেখান থেকে তারা নাজকে দেখতে পাবে কিন্তু নাজ ঠিকই তাদের দেখবে। ফোনটা তার হাতের ছিল, ক্যামেরা অন করে ভিডিও করতে শুরু করলো দৃশ্যটা। এই মুহূর্তে ভিডিও করাটা তার জন্যে উপযুক্ত নয়। নাজের উচিত আদর্শ বান্ধবীর মতো ছুটে গিয়ে শিউলিকে বিপদ থেকে রক্ষা করা। কিন্তু নাজ তা করছে না।

এতকাল ধরে এমন অত্যাচার তো শিউলি সহ্য করেই আসছে। আর কয়েকটা মিনিট সহ্য করলে তেমন বড় কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু এই কয়েক মিনিটে যে ভিডিও নাজ পাবে তা কাজ করবে শিহাবের বিরুদ্ধে সবথেকে বড় প্রমাণ হিসেবে।

শিহাব দাঁতে দাঁতে চেপে বলল, “ফোন করে গোয়েন্দা বান্ধবীদের ডেকে এনেছিস বান্দির বাচ্চা! ভেবেছিস আমি কিছুই বুঝি না।”

শিউলি কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “শিহাব! চুল ছাড়ো প্লিজ!”

“কীসের প্লিজ? তোকে কতবার বলেছি আমাকে প্লিজ বলবি না? তোর মুখে প্লিজ শুনলে আমার গায়ে আগুন ধরে যায়।”

প্রতিবাদ করার কোনো শক্তিই শিউলির মধ্যে অবশিষ্ট রইল না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলো বেচারি। বিয়ের পর থেকে এই চোখের জলই হয়ে উঠেছে তার একমাত্র সঙ্গী।

শিহাব হুংকার দিয়ে বলল, “কাঁদবি না, খবরদার কাঁদবি না। বল, কেন ডেকে এনেছিস বান্ধবীদের?”

“আমি ওদের ডাকিনি।”

“তুই না ডাকলে ওরা উড়ে উড়ে এসে হাজির হয়েছে। দশ মিনিটের মধ্যে এদের বিদায় করবি।”

“এসব তুমি কী বলছো শিহাব? চাইলেই এতগুলো মানুষকে বিদায় করা যায়?”

“বিদায় করবি না তাই তো?”

“ছাড়ো আমাকে শিহাব!”

“চিৎকার করছিস কেন হারামজাদি? চিৎকার করে লোকজন জড়ো করতে চাস? আমাকে ধরিয়ে দিতে চাস তোর গোয়েন্দা বান্ধবীদের হাতে? তুই কী ধরিয়ে দিবি? তার আগে আমি তোকে ধরিয়ে দেবো। সবাইকে বলে দেব তুই ইচ্ছা করে আম্মাকে মেরেছিস।”

শিউলি হকচকিয়ে গিয়ে বলল, “এসব কী বলছো তুমি শিহাব?”

“শুধু তাই না, তোর বাবা-মায়ের নামে আমি মামলা করবো। তাদের কাছ থেকে পাওনা টাকা না পেয়েই তো আম্মার অপারেশন করাতে পারলাম না।”

শিউলি কাঁদতে কাঁদতে অস্পষ্টস্বরে বলল, “পাওনা টাকা? যৌতুকের টাকাকে তুমি পাওনা বলো কী করে শিহাব?”

শিহাব তুঙ্গস্পর্শী রাগ নিয়ে বলল, “যৌতুক? তোর এত বড় সাহস?”

চোখের পলকে ফুটন্ত গরম তেলে খুন্তিটা ডুবিয়ে দিয়ে সেই খুন্তি সজোরে চেপে ধরলো শিউলির হাতে। ব্যথায় কুকড়ে উঠলো মেয়েটা। অবাধ্য অশ্রুগুলো যেন তার শুকিয়ে গেছে। শিউলি আর কাঁদতে পারলো না, কাতর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল শিহাবের দিকে। এটাই কি সেই মানুষ যাকে ভালোবাসে নিজের সব ছেড়ে এসেছিল এই অচেনা শহরে?

নাজের পক্ষে এই দৃশ্য সহ্য করা আর সম্ভব হলো না। তড়িৎ গতিতে রান্নাঘরে প্রবেশ করলো সে। নাজকে আচমকা দেখে দুজনেই বেশ হকচকিয়ে গেল।

নাজ ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল, “শিউলি! আর এক সেকেন্ডও তুই এখানে থাকবি না। চল আমার সঙ্গে।”

শিহাব যথাসম্ভব শান্ত গলায় বলল, “ও কোথাও যাবে না। আমাদের পারিবারিক ব্যাপারে আপনি প্লিজ ইন্টারফেয়ার করবেন না।”

“পারিবারিক ব্যাপার? একটা মেয়েকে দিনের পর দিন অত্যাচার করাটা পারিবারিক ব্যাপার তাই না?”

“শিউলি উনাকে বলে দাও যে তুমি কোথাও যাবে না।”

শিউলি কিছুই বলল না। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল শিহাবের দিকে।

শিহাব রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল, “কী হলো বলো?”

নাজ বলল, “ও কিছুই বলবে না, কারণ ও আমার সঙ্গে যাবে।”

“দেখুন, এটা ভদ্র পরিবার। এই পরিবারের বৌরা একা একা বাড়ির বাইরে পা রাখে না।”

“বাড়ির বৌ হওয়ার আগে শিউলি একজন মানুষ। প্রতিটা মানুষের নিজের সিন্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আছে। কীরে বল, তুই এখানে থাকবি না।”

“আপনাকে আমি শেষবারের মতো সাবধান করে দিচ্ছি আমাদের পারিবারিক ব্যাপারে নাক গলাবেন না। যেভাবে এসেছেন, ঠিক সেভাবেই চলে যান প্লিজ।”

নাজ বাঁকা হাসি হেসে বলল, “যদি না যাই?”

“তাহলে আমি পুলিশ ডাকতে বাধ্য হবো।”

“তাই না-কি? তা পুলিশকে ডেকে কী বলবেন, আমি আপনাকে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সে বাঁধা দিচ্ছি?”

“কীসের ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স? শিউলি আমার বিয়ে করা বউ। ওর সঙ্গে যা খুশি তাই করার অধিকার আমার আছে। আমাকে বাঁধা দেওয়ার আপনি কে?”

“যা খুশি তাই করার অধিকার থাকতো, যদি শিউলি আপনার টাকা দিয়ে কেনা পণ্য হতো। কিন্তু সেটা তো সে না। শুধুমাত্র বিয়ে করেছেন বলে একটা রক্ত মাংসে গড়া মানুষের সঙ্গে যা খুশি তাই করার অধিকার তো আপনি পেয়ে যাচ্ছেন না।”

“আমাকে জ্ঞান দিতে হবে না। আমি ওকে কোথাও যেতে দেব না, আপনারা প্লিজ এবার আসুন।”

নাজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে শিউলির দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল, “প্রতিবাদ করার সাহস কি তোর কোনোকালেই হবে না শিউলি?”

শিউলি দৃষ্টি নামিয়ে নিলো মেঝের দিকে। প্রতিবাদ করার সাহস আসলেই তার নেই।

নাজ দৃঢ় গলায় বলল, “ঠিক আছে, আমরা চলে যাচ্ছি। কিন্তু ভাববেন না আপনি পাড় পেয়ে যাবেন।”

(চলবে)