অপেক্ষারা পর্ব-৫৯+৬০+৬১

0
487

#অপেক্ষারা
৫৯
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

চায়ের কাপে তৃপ্তির চুমুক দিয়ে ওসি হানিফ সাহেব বললেন, “আপনার স্ত্রীর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন?”

বিরক্তির ঝড়ো হাওয়া বয়ে গেল সায়েমের সমস্ত শরীরজুড়ে। দুশ্চিন্তায় তার চঞ্চল হৃদয়টা অস্বাভাবিক গতিতে ধড়ফড় করছে। মাথার পেছনের দিকটাতেও সূক্ষ্ম ধরনের একটা ব্যাথা অনুভূত হচ্ছে। একটু পর পর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। নির্ঘাত ব্লাড প্রেসারও বেড়েছে। বিপদ যখন আসে, চারিদিক থেকে তড়িৎ গতিতে ছুটে আসে।

এত বিপদের ভীড়ে নতুন করে বিপদের দূত হয়ে এসেছেন ওসি সাহেব। সেই তখন থেকে অবান্তর সব প্রশ্ন আর সস্তা আলাপ করে সময়ের অপচয় করে যাচ্ছেন। সায়েম উঁচু গলায় ধমকও দিতে পারছে না, রেগেমেগে এখান থেকে চলেও যেতে পারছে না।

অবশেষে নীরবতা ভঙ্গ করে সায়েম শুকনো গলায় বলল, “ভালো।”

“কতোটা ভালো?”

সায়েম ভ্রু কুঁচকে তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, “বৈবাহিক সম্পর্ক কতোটা ভালো বা কতোটা খারাপ তা পরিমাপ করার কোনো স্কেল নেই তো। থাকলে আপনাকে মেপে বলতাম।”

ওসি হানিফ সরলভাবে হেসে বললেন, “এটা ভালো বলেছেন ভাই। তেমন কোনো স্কেল থাকলে আমাদের অর্ধেক কাজই তো কমে যেত। কী বলো শরীফ?”

ওসি সাহেবের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শরীফ নামক এসআই তার সুরে সুর মিলিয়ে বললেন, “একদম স্যার।”

হানিফ সাহেব বিজ্ঞের মতো বলতে শুরু করলেন, “আরে বাবা দুনিয়ার সব সমস্যা শুরু হয় এই বিয়ে থেকে। বিয়ের আসর থেকে কনে পালিয়ে যাওয়া, বিয়ের পর স্বামীর মারধর, ডিভোর্স! না জানি কত কী। এই বিয়ে করেই লোকে একটা না একটা ঝামেলা বাঁধায়, আর রাতের ঘুম হারাম করে এখানে বসে থাকতে হয় আমাদের। কী বলো শরীফ?”

“একটা জিনিস বাদ গেছে স্যার।”

“তাই? কোনটা বলতো?”

“পরকীয়া।”

হানিফ সাহেব হতবাক হয়ে বললেন, “আরে তাই তো! এত ইম্পর্ট্যান্ট একটা বিষয় বাদ পড়লো কী করে? ভালো কথা, সায়েম সাহেব! আপনার স্ত্রীর আবার অন্য কারোর সঙ্গে সম্পর্ক নেই তো?”

সায়েম এবার আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না। ভেতরে জমে থাকা সকল ক্রোধগুলোর প্রকাশস্বরূপ হুংকার দিয়ে বলল, “ওয়াট রাবিশ!”

ওসি হানিফ শান্ত গলায় বললেন, “কিছু মনে করবেন না ভাই। আপনারা ভদ্র সমাজের ভদ্র মানুষ। কিন্তু বাকিরা তো আপনাদের মতো না। স্বামী স্ত্রীর মিসিং কমপ্লেইন ফাইল করেছে, পরে দেখা গেছে স্ত্রী অন্য একটা ছেলের হাত ধরে পালিয়েছে। কম করে হলেও এমন পঞ্চাশটা কেস আমি নিজের হাতে হ্যান্ডেল করেছি।”

সায়েম বহুকষ্টে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করে বলল, “আমরা কী কাজের কথায় আসতে পারি?”

“অবশ্যই, অবশ্যই! আরে আপনাদেরকে সেবা দেওয়ার জন্যেই তো বসে আছি। কী যেন বললেন, আপনার স্ত্রী ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্রী?”

“জি।”

“তা উনি আজ সকাল সকাল বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেন কেন? ঝগড়াঝাঁটি করেছিলেন না-কি?”

“না। ঝগড়া করবো কেন?”

“করতেই তো পারেন। মেয়েদের এক বদভ্যাস হলো কথায় কথায় স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে বাপের বাড়ি চলে যাওয়া। ভালো কথা, উনার বাপের বাড়িতে খোঁজ নিয়েছেন?”

“ওর বাপের বাড়ি ময়মনসিংহে। আমি তো আপনাকে সবটাই বললাম। আমার চেনাজানা কোনো জায়গায় ও যাবে না। ও এমন কোথাও যাবে যে জায়গাটা আমি চিনি না।”

ওসি সাহেব কী যেন ভেবে বিজ্ঞ গলায় বললেন, “আমার মনে হয় কী এটা খুবই সাধারণ ব্যাপার। মন খারাপ করে বাড়ি থেকে চলে গেছে, দুদিন পর ফিরেও আসবে। হয়তো কোনো বান্ধবীর-টান্ধবীর বাড়িতে লুকিয়ে আছে। এই বান্ধবীগুলোই হলো যতসব কুবুদ্ধির দাতা। আপনি ভালোমত খোঁজ না নিয়েই চলে এসেছেন পুলিশের কাছে।”

সায়েম প্রতিবাদের সুরে বলল, “কিন্তু আমি ওর সব বান্ধবীদের ফোন করেছি। কোথাও যায়নি।”

“আরে ভাই ফোনে কোনো কাজ হয় না-কি? অন দ্যা স্পট গিয়ে প্রমাণ চাইতে হয়। বান্ধবীরা তাকে লুকিয়ে রাখার জন্যে মিথ্যাও তো বলতে পারে।”

সায়েম থমথমে গলায় বলল,“আপনি আমার কথাগুলোকে সিরিয়াসলি নেওয়ার চেষ্টা করুন। আমার ওয়াইফ অনেক অসুস্থ, ওর মানসিক অবস্থাও ভালো না। সে কোথায় গেছে নিজেও জানে না।”

“তার মানে আপনার ভাষ্য একটা চিঠি লিখে দিয়ে যেদিকে দুচোখ যায়, সেদিকে চলে গেছেন তাইতো?”

সায়েম চুপ করে রইলো। দ্বিতীয়দফায় বিরক্তির ঝড়ো হাওয়া বয়ে গেল তার ওপর দিয়ে।

ওসি হানিফ বললেন, “ঠিক আছে, নিলাম আপনার কথাগুলোকে সিরিয়াসলি। এবার আপনিও আমার কথাটা সিরিয়াসলি নিন। আপনার স্ত্রী চেনাজানা কারও বাড়িতেই লুকিয়ে আছে। আমার কথা বিশ্বাস না হলে শরীফকে বলি, কাগজ কলম আনুক। আমি সই করে লিখে দিচ্ছি, সে কারও বাড়িতেই লুকিয়ে আছে।”

ওসি সাহেব আরও কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনি একজন ব্যস্ত ভঙ্গিতে তার কেবিনে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “আসালামালাইকুম।”

ওসি সাহেব অনিশ্চিত ভঙ্গিতে বললেন, “ওয়ালাইকুমআসসালাম। আপনি?”

“আমি আশফাক, সায়েমের বন্ধু।”

“ও আচ্ছা বসুন।”

হানিফ সাহেব লক্ষ করলেন তার ফোনটা বেজে উঠেছে। স্ক্রিনের ওপর ভেসে ওঠা নামটা পড়তেই তিনি এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “আপনারা একটু বসুন, আমি কথা বলে আসছি।”

আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা না করে ওসি সাহেব ফোন নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

সায়েম বিরক্ত ভঙ্গিতে নিচু গলায় বলল, “এত দেরি করলি কেন?”

আশফাক অনুতপ্ত স্বরে বলল, “সরি দোস্ত, একটা জরুরি ফোন সারতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল।”

সায়েম দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “তোকে বারবার বলে দিলাম ইমারজেন্সি, তাড়াতাড়ি আয়! আর তুই পড়ে ছিলি তোর ফোন নিয়ে? কী এমন জরুরি ফোন?”

“একটু ওয়েট কর, এক্ষুনি টের পাবি।”

“মানে?”

দুজনের কথার মাঝেই পুনরায় ঘটলো ওসি সাহেবের আগমন। তবে এবার আর তার কণ্ঠস্বরে আগের মতো তাচ্ছিল্যের ভাবটা নেই।

আন্তরিকতায় বিগলিত হয়ে তিনি বললেন, “আরে কী আশ্চর্য! আপনারা যে ডিআইজি স্যারের এত কাছের মানুষ, আগে বলবেন না?”

সায়েম ভ্রুযুগল সামান্য কুঁচকে বলল, “ডিআইজি?”

আশফাক নিচু গলায় বলল, “আমার মামী। তার সঙ্গেই জরুরি ফোন সারছিলাম।”

“আরে একটাবার বললেই তো হতো, আমি কি তাহলে এতগুলো সময় নষ্ট করি?”

সায়েম দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “তাহলে আপনি আমার জিডি নিচ্ছেন?”

“নিচ্ছি মানে? জিডি তো অলরেডি হয়ে গেছে। আর দেরি করা যাবে না, এক্ষুনি কাজে নেমে পড়তে হবে। চলুন আপনদের বাড়িটা একবার ঘুরে আসি।”

আশফাক জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে সায়েমের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, “তুই গাড়ি এনেছিস?”

সায়েম গম্ভীরভাবে বলল, “হুঁ।”

“ওসি সাহেব, সায়েমের গাড়িটা আপনাদের গ্যারেজেই থাকুক? আসলে আমি বাইক এনেছি তো, আমার বাইকে করেই আমরা চলে যাবো।”

“নিশ্চয়ই! আবার জিজ্ঞেস করার কি আছে? আপনারা অ্যাড্রেসটা দিয়ে যান, আধ ঘন্টার মধ্যে আমরা চলে যাবো।”

ঢাকার ব্যস্ত সড়কে ছুটে চলছে আশফাকের বাইক। গন্তব্য সায়েমদের বাড়ি। এই ব্যস্ত নগরীতে প্রতিটা মানুষেরই তো রয়েছে নিজ নিজ গন্তব্য। এতগুলো মানুষের ভিড়ে নাজকে কোথায় খুঁজবে তারা?

সায়েম হঠাৎ কী যেন ভেবে বলল, “তোর মামীকে বিরক্ত করার কী দরকার ছিল?”

আশফাক বাইক চালাতে চালাতেই বলল, “না হলে এই ওসি কাজটাকে সিরিয়ালি নিতো? শোন সায়েম, দুনিয়ার সকলকে আমার চেনা আছে বুঝলি? মিসিং রিপোর্টের ফাইল দিনের পর দিন এদের টেবিলের কোণায় পড়ে থাকে, অথচ এরা একবার খুলেও দেখে না। ওপর থেকে একটু চাপ না পেলে পৃথিবীর কেউই উদ্যোগ নিয়ে কাজ করতে চায় না।”

সামনের লুকিং গ্লাস থেকে আশফাক লক্ষ করলো সায়েম অন্যমনস্ক হয়ে কী যেন ভাবছে। এতক্ষণ ধরে বলা কথাগুলো নিশ্চয়ই সায়েম শোনেনি। তার মস্তিকে কেবল একটা চিন্তারই বিচরণ, কোথায় খুঁজে পাবে নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে।

“সায়েম?”

“হুঁ?”

“একটা ব্যাপার আমার মাথায় ঢুকছে না।”

“কোন ব্যাপার?”

“ভাবিকে যতদূর চিনি, সে তো যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। জেদের বশে এমন একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার মানুষ তো সে নয়।”

সায়েম ক্লান্ত গলায় বলল, “জেদ না আশফাক। নাজ এখন স্বাভাবিক পর্যায়ে নেই। শি ইস হাইলি ডিপ্রেসড। একজন স্বাভাবিক মানুষের চিন্তাধারা আর একজন ডিপ্রেসড চিন্তাধারা কখনো এক রেখায় চলে না।”

“ডিপ্রেশন? তুই তো ছিলি পাশে, বোঝাতে পারলি না?”

সায়েম ব্যর্থ গলায় বলল, “হয়তো না। আমি ওকে বলেছিলাম, যা হবার আমরা একসাথে ফেস করবো। বিশ্বাস করলো না আমাকে। আমার প্রচন্ড টেনশন হচ্ছে জানিস? মেয়েটা একা একা রাস্তা পর্যন্ত পার হতে পারে না, সিঁড়ি বেয়ে নামতে গেলেই হোঁচট খায়। না জানি একা একা কী করছে!”

আশফাক আশ্বাস দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “চিন্তা করিস না দোস্ত। পুলিশের সাহায্য তো আছে আমাদের সাথে। দেখিস, ঘণ্টাখানেকের
মধ্যে ঠিকই খুঁজে পাবো ভাবিকে।”

ধানমন্ডি এলাকার নয়তলা বিশিষ্ট অভিজাত ভবন ‘রংধনু অ্যাপার্টমেন্টস’। বেজমেন্টে বিশাল গ্যারেজ, দুটো চকচকে লিফট, পার্টি এরিয়া, অডিটোরিয়াম – কোনো কিছুর অভাব নেই এখানে। মেইন গেট দিয়ে ঢুকতে বাম পাশেই ছোট্ট একটা কামরা। কামরার দেয়ালে একটা জানালা রয়েছে। জানালা দিয়ে কামরার ভেতর থেকে মেইন গেটটা দেখা যায়। মূলত এখানেই সিকিউরিটি গার্ড বসে বসে দেখে বাড়িতে কে আসছে-যাচ্ছে।

ওসি হানিফ প্রথমেই জেরা করলেন সিকিউরিটি গার্ড কালামকে। স্বল্প শিক্ষিত মানুষদের কাছে পুলিশ মানেই এক মহা আতঙ্কের নাম। পুলিশ জেরা করতে এসেছে এর অর্থ নির্ঘাত তাকে ভ্যানে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে থানায়। সে কোনো দোষ করে থাকুক, কিংবা নয়। পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যাবেই। কালাম বেচারাও তাই ভেবে ভয়ে তটস্থ হয়ে গেছে। ঘেমে-টেমে একাকার অবস্থা তার।

ওসি হানিফ হালকা গলায় বললেন, “এত বড় একটা বাড়ি, অথচ মাত্র একজন পাহারাদার? ঘটনা কী?”

কালাম ইতস্তত করে বলল, “স্যার দিনের বেলা আমি ডিউটি করি, আর রাত্রে করে
আরেকজন।”

“ও আচ্ছা। তাহলে নিশ্চয়ই তোমার নাজনীন ম্যাডামকে বাড়ি থেকে বের হতে দেখেছো?”

“জি স্যার। ম্যাডাম তো সেই ভোর বেলা তাড়াহুড়া কইরা বাইর হইয়া গেলেন।”

ওসি হানিফ ঘুরে ঘুরে কী যেন খুঁজে আবারও ফিরে এসে বললেন, “এখানে সিসি ক্যামেরা আছে না?”

“জি স্যার, আছে তো।”

“সকালের ফুটেজটা বের করো তো!”

ভোর পাঁচটা আটান্ন। সিসিটিভি ফুটেজে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে কালো সালোয়ার কামিজ পরিহিতা একটি মেয়ে ওড়না দিয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে ব্যস্ত পায়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছে।

হানিফ সাহেব সায়েমকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করলেন, “এটাই তো আপনার স্ত্রী, তাই না?”

প্রশ্নটা সম্ভব পৌঁছালো না সায়েমের কর্ণকুহরে। তার উদ্বিগ্ন দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে সিসিটিভি ফুটেজের দিকে। নাজের হাঁটার ভঙ্গি স্বাভাবিক নয়। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, কোনো এক প্রবল ঘোরে আচ্ছন্ন মেয়েটা। নাজ তো সেই ভোর বেলা বেরিয়েছে। এখন বাজে কাঁটায় কাঁটায় বারোটা। প্রায় ছয় ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। কোথায় গেছে মেয়েটা? ঠিক আছে তো সে? পরিচিত কোথাও গেলে দুশ্চিন্তায় তেমন কারণ নেই। তবে সায়েম নিশ্চিত, পরিচিত কোথাও নাজ যায়নি। নিজেকে লুকিয়ে রাখা তার উদ্দেশ্য নয়। নাজের উদ্দেশ্য নিজেকে কষ্ট দেওয়া।

হানিফ সাহেব সন্দেহের ভঙ্গিতে কালামকে বললেন, “একটা মানুষ সকাল সকালে বেরিয়ে গেল অথচ তুমি কিছুই জিজ্ঞেস করলে না?”

কলাম তো তো করে বলল, “আমার কোনো দোষ নাই স্যার। আগে সবাইরে জিগতাইম, কই যান, কখন আইবেন। পরে ফ্ল্যাট মালিকরা মিটিং কইরা কইল, আমি এইসব জিগাইলে তারার ডিস্টাব হয়। এহন আর জিগাই না।”

“ও কি সত্যি বলছে সায়েম সাহেব?”

সায়েম বিরক্ত গলায় বলল, “জানি না। এসব মিটিংয়ে কখনোই আমার যাওয়া হয়নি।”

ওসি হানিফ সরু গলায় বললেন, “অন্য সময়ে জিজ্ঞেস করা আর ভোর ছয়টায় জিজ্ঞেস করা তো এক কথা নয়। বিশেষ করে, যখন সে সচরার ওই সময়ে বের হয় না।”

ভয়ে কালামের হাত-পা থরথর করে কেঁপে উঠলো। ব্যাপারটা লক্ষ করে এসআই শরীফ শান্ত গলায় বললেন, “স্যার, আমার মনে হয় কী এই ছেলেটা জিজ্ঞেস করলেও মিসেস নাজনীন বলতেন না তিনি কোথায় যাচ্ছেন।”

“আরে তাই তো! তাহলে আমি এই গাধার সাথে কথা বলছি কেন? এই শরীফ, ফুটেজটা আরেকবার ভালো করে দেখো তো। কোনদিকে গেছে বোঝা যায় কি-না।”

শরীফ মনোযোগ দিয়ে আরও একবার ফুটেজটা দেখে অভিজ্ঞ গলায় বললেন, “মেইন রোডের দিকে স্যার।”

“শিওর তুমি?”

“জি স্যার।”

ওসি সাহেব নির্দেশ দেওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, “এখান থেকে মেইন রোড পর্যন্ত যতগুলো সিসিটিভি আছে সবগুলোর ফুটেজ আমার লাগবে। সময় সকাল ছয়টা থেকে সাতটা। পারবে না?”

“পারবো স্যার।”

“কতক্ষণ লাগতে পারে?”

“সর্বোচ্চ ঘন্টাখানেক।”

“ভেরি গুড। ফুটেজগুলো কালেন্ট করে আমাকে জানাও। আর সায়েম সাহেব, আপনি তখন বলছিলেন বছরে বেশ কয়েকবার আপনারা গ্রামের বাড়িতে যান। প্রতিবার নিশ্চয়ই একই বাস স্টেশন থেকে টিকিট কাটেন।”

“হ্যাঁ, মোহাম্মদপুর বাস স্টেশন থেকে।”

হানিফ সাহেব কিছু একটা বলতে যাবেন তখনই শরীফ চমকে উঠে বললেন, “স্যার মেইন রোড ধরে গেলেই তো মোহাম্মদপুর বাস স্টেশন!”

“তাই না-কি? তাহলে সায়েম সাহেব চলুন ওখান থেকে একটু ঢু মেরে আসি। বলা তো যায় না, হয়তো আপনার স্ত্রী আচমকা ঠিক করলেন তিনি গ্রামের বাড়িতে যাবেন। শরীফ?”

“জি স্যার?”

“তুমি ততক্ষণে সিসিটিভি ফুটেজগুলো জোগাড় করো, আমি ফিরে এসে দেখবো। ভালো কথা, সায়েম সাহেব আপনার স্ত্রী তো তার ফোনটা বাড়িতেই রেখে গেছে তাই না?”

সায়েম বলল, “হ্যাঁ।”

“ফোনটা আমার লাগবে। যদি পরিচিত কারোর বাড়িতে গিয়ে থাকেন তাহলে নিশ্চয়ই আগের দিন যোগাযোগ করবেন।”

সায়েম আশফাকে নিয়ে ওপরে উঠে এলো। বাড়িতেই তো নাজের ফোনটা। সদর দরজা খোলাই ছিল। বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতেই সায়েম দেখতে পেল তার মা-বাবা চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে আছেন বসার ঘরে। কনা অযথা পায়চারি করছে গোটা বাড়িজুরে।

সায়েম দেখেই হাসনা বেগম এক লাফে উঠে এলেন তার কাছে।

উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, “সায়েম? বৌমাকে পেলি?”

মায়ের ছুঁড়ে দেওয়া প্রশ্নটা একপ্রকার তাচ্ছিল্য করেই সায়েম পা বাড়ালো শোবার ঘরের দিকে।

হাসনা বেগম তার পিছু নিয়ে বললেন, “কী হলো কথা বলছিস না কেন? পেয়েছিস বৌমার কোনো খোঁজ।”

সায়েম সাইড টেবিল থেকে নাজের ফোন হাতে নিয়ে থমথমে গলায় বলল, “না।”

“কী সাংঘাতিক মেয়ে রে বাবা। একে তো আমাদের এত বড় একটা সর্বনাশ করলো তার ওপরে আবার পালিয়ে বেড়ানো হচ্ছে। ভেবেছে কী নিজেকে? অপয়া মেয়ে একটা!”

সায়েম কড়া গলায় বলল, “মা প্লিজ! সেই অপারেশন দিন থেকে মেয়েটাকে হেও করে কথা বলছো। এবার অন্তত ক্ষান্ত হও।”

হাসনা বেগম হতবাক গলায় বললেন, “তুই বউয়ের হয়ে ওকালতি করছিস?”

সায়েম নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “হ্যাঁ করছি। কাউকে না কাউকে তো ওর সাইডে থাকতে হবে।”

“কেন? থাকতে হবে কেন? ছি ছি, ভদ্র বাড়ির বৌ এভাবে বাড়ি ছেড়ে পালায়? কোনোদিন দেখেছিস না শুনেছিস এমন কথা? তার ওপরে আবার তুই পুলিশ ডেকে সবাইকে জানিয়ে বেরাচ্ছিস। লোকে কী বলবে?”

সায়েম কঠিন গলায় বলল, “আমার না কিছুই যায় আসে না মা। তোমার ওই সো কলড লোকেদের খুব ভালো করে চেনা আছে আমার। এরা সুখের দিনে পাশে থাকবে, সাফল্যে বাহবা দেবে কিন্তু জীবনে একটু ব্যাথর্তা এলেই এরা মুখ ফিরিয়ে নেয়।”

হাসনা বেগম কিছু বলতে যাবেন তার আগেই আশফাক শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “সায়েম চল, ওসি সাহেব অপেক্ষা করছেন তো।”

মোহাম্মদপুর বাস স্টেশনে প্রতিদিন হাজারো মানুষের আনাগোনা। প্রতিটা মানুষ ছুটে চলছে নিজে গন্তব্যের দিকে। কেউ বা কাজের স্বার্থে, আর কেউ প্রিয়জনের মুখে ফুটে ওঠা প্রচ্ছন্ন হাসিটা দেখার লোভে। এত এত ব্যস্ততা, এতগুলো ব্যস্ত মানুষ – সকলের মুখের আদল মনে রাখা কষ্টকর। তবুও স্টেশনের ম্যানেজার এক দেখাই চিনে ফেললেন সায়েমকে। না চেনার কারণও অবশ্য নেই। অনেকগুলো বছর ধরে তাদের বাসে করেই তো সায়েমের ময়মনসিংহে যাতায়াত।

ওসি সাহেব নাজের খোঁজ করতেই ম্যানেজার বিনয়ী গলায় বলল, “ম্যাডাম আসছিল তো। আজকে খুব সকাল সকাল। আমি তো অবাক, এই সকালে…”

ম্যানেজারকে থামিয়ে দিয়ে ওসি হানিফ ধমকের সুরে বললেন, “খেজুরে আলাপ বন্ধ করো। তোমার খেজুরে আলাপ শোনার সময় আমাদের নেই। যা জিজ্ঞেস করবো তার ঠিক ঠিক উত্তর দাও।”

“জি স্যার।”

“উনি কি কোনো বাসের টিকিট কেটেছিলেন?”

“জি স্যার। ম্যাডাম সকাল সাতটার ঢাকা টু ময়মনসিংহ বাসের একটা টিকিট কাটছিলেন।”

হানিফ সাহেব সায়েমের দিকে তাকিয়ে বিজয়ীর হাসি হেসে বললেন, “কী বলেছিলাম না? আমার কথা তো বিশ্বাস করলেন না!”

ওসি সাহেবের বিজয়ীর হাসি মোটেও বিগলিত করতে সক্ষম হলো না সায়েমকে। নাজ সকালের বাসে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছে, ব্যাপারটা তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হচ্ছে না। সায়েমের চোখেমুখে প্রগাঢ় চিন্তার ছাপ এখনো বিদ্যমান।

ম্যানেজার চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন, “কিন্তু স্যার!”

“আবার কিন্তু কী? বাসের নম্বর বের করো, এতক্ষণে তো পৌঁছে যাওয়ার কথা তাই না?”

“স্যার, ম্যাডাম তো বাসে উঠেন নাই।”

ওসি সাহেব হকচকিয়ে গিয়ে বললেন, “মানে?

“উনি টিকিট কাটছেন, কতক্ষণ বাসের জন্যে ওয়েটও করছেন। কিন্তু শেষমেশ আর বাসে উঠেন নাই।”

বিস্ময়ে কয়েক মুহূর্ত থমকে দাঁড়িয়ে রইলেন ওসি সাহেব। এতক্ষণ তার কাছে এই কেসটা সাধারণ কোনো মিসিং কেস বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু এবার মনে হচ্ছে এই কেসের জটিলতা অনেক বেশি।

(চলবে)

#অপেক্ষারা
৬০+৬১
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

শরীরে কোনো অসুখ এসে বাসা বাঁধলেই আমরা তৎক্ষণাৎ ছুটে যাই ডাক্তারের কাছে। ওষুধপত্র খেয়ে সুস্থ হওয়ার তাগিদে। কিন্তু মনের অসুখ? এই অসুখটার ধরন বড্ড জটিল। শরীরের অসুখ হলে মানুষ নিজেই তা উপলব্ধি করতে পারে এবং সেটা থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করে। তবে মনের অসুখ‌ হলে মানুষ তা নিজেই বুঝতে পারে না, মুক্তি পাবার চেষ্টাও করে না। প্রশয় পেয়ে অসুখটা ফুলে ফেঁপে বেড়ে ওঠে।

কিন্তু আশপাশের মানুষগুলো তো ঠিকই বোঝে মনের অসুখের গভীরতা। তারা কি পারে না, দুয়েকটা স্নেহের কথা বলে মানুষটাকে সুস্থ করে তুলতে? স্নেহের কথা বলতে না পারলে অন্তত এমন কিছু বলা উচিত নয় যাতে মানুষটার অসুখ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। নাজের প্রিয় মানুষগুলোই শেষমেশ তার মনের অসুখের কারণ হয়ে দাঁড়ালো। চাপা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাটির দিকে তাকিয়ে রইল সায়েম।

মানসিক স্বাস্থ্যকে আমরা বড্ড অবহেলা করি। হতাশাগ্রস্ত বিষন্ন একটা মানুষ যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা আমদের ধারণারও বাইরে। বাকিদের জন্যে সে ভয়াবহ নয়, ভয়াবহ নিজের জন্যে। হতাশাগ্রস্ত মানুষ নিজেকে নিয়ে ভাবে না, নিজের ক্ষতি করতেও কোনপ্রকার দ্বিধা বোধ করে না। আচ্ছা, নাজও যদি হতাশার বশে নিজের কোনো ক্ষতি করে বসে? বাকিটা আর ভাবতে পারলো না সায়েম। দুশ্চিন্তায় তার ব্রহ্মতালু অবদি ঝনঝন করছে।

পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে ওয়ালপেপারে ভেসে ওঠা নাজের ছবিটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সায়েম। কয়েক মুহূর্তের জন্যে মনে হলো ছবিটা যেন জীবন্ত হয়ে উঠছে। প্রচ্ছন্ন-প্রাণবন্ত এই হাসিটা যেন মেয়েটা তার দিকেই ছুঁড়ে দিচ্ছে। সায়েমের ইচ্ছা হলো অভিমানী স্বরে তাকে বলতে, “নাজ শোনো, তুমি আর কোনদিনও আমাকে চিঠি লিখবে না। যতবারই চিঠি লেখ, একরাশ দূরত্ব এসে বাসা বাঁধে আমাদের মাঝে।”

আশফাক এসে কোমল স্বরে বলল, “কী রে? যাবি না?”

সায়েম কণ্ঠে একরাশ ব্যর্থতা নিয়ে বলল, “কোথায় যাবো?”

আশফাক সায়েমের পাশে বসতে বসতে বলল, “তুই ভেঙে পড়ছিস কেন? তুই ভেঙে পড়লে আমরা ভাবিকে খুঁজে পাবো কী করে?”

সায়েম অসহায় গলায় বলল, “আমার মাথা কাজ করছে না দোস্ত। আমি কিছুই ভাবতে পারছি না। এত বড় একটা শহরে কোথায় খুঁজবো আমি নাজকে? তুই দেখলি না, ও টিকিট কেটেছিল কিন্তু বাসে ওঠেনি। তার মানে সে নিজেই জানে না কোথায় যাবে।”

“শুধু শুধু টেনশন করছিস তুই। দেখিস, আমরা ঠিকই ভাবিকে খুঁজে পাবো। পুলিশ তো আছে আমাদের সঙ্গে।”

পুলিশের কথা মনে পড়তেই সায়েম বলল, “ওসি সাহেব কোথায়?”

“কী একটা কাজে যেন বেরিয়ে গেলেন। আমাকে বললেন, যে হসপিটালে ভাবির অপারেশন হয়েছে সেখানে একবার খোঁজ নিতে।”

মহাসড়কের চিরচেনা যানজটে থেমে আছে আশফাকের বাইক। মাথার ওপরে চনমনে সূর্যটার তেজ কি আজ সত্যি সত্যিই বেশি, না-কি দুশ্চিন্তার কারণে সায়েমের কাছে বেশি বলে মনে হচ্ছে। শতশত মানুষের আনাগোনা এই সড়কে। তবুও সায়েমের চঞ্চল চোখদুটো খুঁজে বেড়াচ্ছে তার কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে। বলা তো যায় না, ভীড়ের মধ্যেও তো লুকিয়ে থাকতে পারে মেয়েটা।

সায়েমকে হতবাক করে দিয়ে তার চোখের সামনে ঘটে গেল এক সাংঘাতিক ঘটনা। রাস্তার ওপরে থেমে আছে কমলা রঙয়ের পুরোনো একটা বাস। কন্ডাক্টর কুৎসিত স্বরে হাক ডেকে যাত্রী ওঠাচ্ছে বাসে। সায়েম পরিষ্কার দেখতে পেল কালো সালোয়ার কামিজ পরিহিতা, মাথায় ওড়না দ্বারা ঘোমটা দেওয়া একটি মেয়ে তড়িঘড়ি করে বাসে উঠে গেছে। মেয়েটার মুখ দেখা না গেলেও তার পোশাকটা হুবহু নাজের পোশাকের মতো। কোথাও এক ফোঁটাও অমিল নেই।

সায়েম চাপা এক উত্তেজনা নিয়ে বলল, “নাজ! ওই বাসটায় নাজ উঠেছে।”

আশফাক হতবিহ্বল গলায় বলল, “বলিস কী? তুই শিওর?”

উত্তর দেওয়ার ইচ্ছা বা প্রয়োজন কোনোটাই সায়েমের মধ্যে দেখা যাচ্ছে না। তার চোখেমুখে কেবল একটাই তাগিদ। নাজের কাছে যাবার। সায়েম বাইক থেকে উঠে রাস্তার ওপারে যাবে ঠিক তখনই দু পারের রাস্তার ট্রাফিক একসঙ্গে ছেড়ে দিলো। কোনো মানে হয়? প্রায় বিশ মিনিট ধরে এ রাস্তায় বিচরণ, আর কয়েকটা সেকেন্ড থাকলে কী এমন ক্ষতি হতো?

সায়েম বিরক্ত, হতাশ এবং ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে আবারও বাইকে উঠে বসতে বসতে বলল, “আশফাক, তাড়াতাড়ি বাইক ঘোরা। ওই বাসটাকে ফলো করতে হবে?”

“নম্বরটা খেয়াল করেছিস?”

“হ্যাঁ করেছি, তাড়াতাড়ি ঘোরা তো।”

আশফাক ঘুরিয়ে চলে গেল রাস্তার ওপরপ্রান্তে। বাসের গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে তার বাইক। এভাবে চলতে থাকলে বাসটাকে ধরে ফেলতে খুব একটা বেগ পেতে হবে না তাদের। সায়েমের নিঃশ্বাস ঘন হয়ে আসছে। মনে মনে ক্রমশ প্রার্থনা করে যাচ্ছে, এবার যেন নাজকে ফিরে পেতে কোনো বিঘ্নের সম্মুখীন না হতে হয়।

এদিকে শহরের আরেক প্রান্তে ছুটে চলছে ধানমন্ডি থানার পুলিশদের নিজস্ব একটি জিপ। ড্রাইভ করছে এসআই শরীফ এবং তার পাশের সিটে সানগ্লাস চোখে জানালা থেকে মুখ বের করে আয়েশী ভঙ্গিতে রোদ উপভোগ করছেন ওসি হানিফ।

শরীফ হঠাৎ কী যেন মনে করে বলল, “স্যার, আপনি তো মাশাল্লাহ অনেকগুলো মিসিং কেসই হ্যান্ডেল করেছেন। কী মনে হয়, মিসেস নাজনীনকে খুঁজে পাওয়া যাবে?”

ওসি হানিফ চিন্তিত গলায় বললেন, “বুঝতে পারছি না শরীফ। পৃথিবীর জটিলতম কেসগুলোর মধ্যে মিসিং কেস অন্যতম। মাঝে মাঝে তো খুনের কেসের থেকেও বেশি জটিল।”

“সে কী স্যার?”

ওসি সাহেব বিজ্ঞের মতো বলে উঠলেন, “খুনের কেসে অনেকগুলো ক্লু থাকে। একটা ডেড বডি থাকে, খুনের কোনো না কোনো লক্ষণ থাকে। আমাদের কাজ খুনিকে খুঁজে বের করা। কিন্তু মিসিং কেসের বেলায় কোনো ক্লুই থাকে না। যে মানুষটা নিখোঁজ সে চাইলে যেকোনো জায়গায় লুকিয়ে থাকতে পারে। ঢাকায় আছে, না ঢাকায় বাইরে আছে না-কি আবার দেশের বাইরে আছে আমরা কিছুই জানি না। আন্দাজে ঢিল ছোড়ার মতো খুঁজে বেড়াই মানুষটাকে। তার থেকেও বড় ঝামেলা হলো নিখোঁজ মানুষটা নিজেই তার গন্তব্য জানে না। টিকিট কাটলো কিন্তু বাসে উঠলো না, আমার মনে হয় মেয়েটা একটা ঘোরের মধ্যে আছে। আপন মানুষদের দেওয়া আঘাতগুলো তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে।”

“টিকিট কেটেও বাসে না ওঠার একটা যুক্তি আমি বের করেছি স্যার।”

“কী যুক্তি?”

শরীফ গুছিয়ে বলল, “মিসেস নাজনীনের ফোনটা পাওয়ায় বেশ সুবিধাই হয়েছে স্যার। ওই নম্বর থেকে শেষ কলটা এসেছে তার মায়ের কাছ থেকে, গত রাতে। মায়ের সঙ্গে মেয়ের কথোপকথন তেমন সুবিধাজনক মনে হলো না। মেয়ে ডিপ্রেসড আর মা তার ডিপ্রেসন আরও বাড়িয়ে দিচ্ছেন। নাজনীন একটা সময়ে রেগেমেগে ফোন কেটে দেন। আজ সকালে বাড়িতে থেকে তাড়াহুড়ো করে বেড়িয়ে কিছু না ভেবেই তিনি চলে গেলেন বাস স্টেশনে। তাড়াহুড়োর মধ্যেই টিকিট কাটলেন। পরে মনে পড়লো, গ্রামের বাড়ি ফিরে গেলে তো নিজের মাকেও পাশে পাবেন না। তাই বাসে না উঠে বেরিয়ে এলেন।”

“হতে পারে। তোমার পর্যবেক্ষণ ভালো শরীফ।”

শরীফ প্রংশায় বিগলিত হয়ে বলল, “থ্যাংক ইউ স্যার।”

“আচ্ছা শরীফ, আমরা এখন যাচ্ছি কোথায়?”

“ইডেন কলেজে। নাজনীনের এক ঘনিষ্ট বান্ধবী এখানে পড়ে। গত মাসে তিনি এই বান্ধবীকে এসএমএস করে বলেন আজ মানে তেরোই মার্চ তার ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখা করবেন।”

“বলো কী? এই কথা এতক্ষণ বলোনি কেন? তার মানে ওখানে গেলে নাজনীনকে পাওয়া যেতেও পারে।”

“আবার নাও পারে স্যার।”

“কেন?”

“কারণ গত মাসে তার জীবনে কোনো সমস্যাই ছিল না। অথচ আজ এতশত সমস্যার ভীড়ে বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করার কথা মনে আছে কি-না কিংবা মনে থাকলেও সেই ইচ্ছাটা অবশিষ্ট আছে কি-না সেটাই চিন্তার বিষয়।”

ইডেন কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী তুষি। এই কয়েক বছরে অভাবনীয় পরিবর্তন লক্ষণীয় তার মাঝে। আগেকার সেই হ্যাংলামো, লেখাপড়ায় অবহেলা, ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ঘুরে বেড়ানো – সেসব কোথায় যে উধাও হয়ে গেছে কে জানে। তুষি এখন নাকের ডগায় চশমা লাগিয়ে ঘুরে বেড়ানো শিক্ষকদের প্রিয় ছাত্রীদের একজন সে কারণেই অধ্যক্ষের অফিসে পুলিশ তার খোঁজ করতেই ভড়কে গেলেন তিনি। নিতান্ত সাধারণ একজন ছাত্রীকে হঠাৎ পুলিশ খুঁজতে যাবে কেন?

ওসি সাহেব শান্ত ভঙ্গিতে সকাল থেকে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো পুঙ্খানপুঙ্খভাবে তুলে ধরলেন তুষির কাছে। তুষিও বিনা বাক্যব্যয়ে শুনলো পুরোটা।

ওসি হানিফ জিজ্ঞেস করলেন, “আজ তো আপনাদের দেখা করার কথা ছিল তাই না?”

তুষি নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “জি। নাজ বলেছিল আজ বারোটায় আমাদের ক্যাম্পাসে আসবে। কী একটা বিজনেস আইডিয়া ওর মাথায় এসেছে, সেটা নিয়েই আলাপ করবে।”

“আশ্চর্য ব্যাপার! বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করলে তার বাসায় যাবে, কিংবা একসঙ্গে ফুচকা খেতে যাবে, শপিং মলে ঘুরতে যাবে। বান্ধবীর ক্যাম্পাসে আসার লজিকটা কি?”

“আমাদের এই ক্যাম্পাস নাজের ভীষণ পছন্দের। মাসে দু মাসে একবার এসে এখানে ঘুরে বেড়ায়।”

ওসি সাহেব সন্দিহান গলায় বললেন, “সে মানুষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো চমৎকার একটা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে, তার আবার অন্য ক্যাম্পাস পছন্দের হবে কেন?”

সবকিছু বদলে গেলেও তুষির চিরচেনা ঠোঁটকাটা স্বভাবটা এখনো রয়ে গেছে। সেই স্বভাব ধরে রেখেই সে বলল, “কিছু মনে করবেন না স্যার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চমৎকার ইউনিভার্সিটি হলেও পৃথিবীর সেরা নয়। আমাদের এই ক্যাম্পাস অন্যান্য যেকোনো ক্যাম্পাসের তুলনায় কম কিছু নয়।”

“ঠিক, ঠিক। একদম ঠিক। আচ্ছা আপনাদের বন্ধুত্ব হয় কী করে?”

“আমরা একই কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছি। নাজ ঢাকায় এসে প্রথমে আমার কলেজেই ভর্তি হয়।”

“তা এত বছরের বন্ধুত্ব আপনাদের, আপনার কী মনে হয়? আপনার বান্ধবী হুট করে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার মতো একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন?”

তুষি ইতস্তত করে বলল, “নিতেও পারে। ডিপ্রেশনে চলে গেলে নাজের মাথা ঠিক থাকে না। ঝোঁকের বশে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে।”

“তার মানে এর আগেও তাকে ডিপ্রেশনে পড়তে দেখেছেন আপনি?”

“সেটা নাজের পার্সোনাল ব্যাপার। ওর অনুমতি ছাড়া ওই ব্যাপারে কথা বলা ঠিক হবে না।”

ওসি সাহেব মাথা নেড়ে বললেন, “তা তো বটেই। আচ্ছা, আপনার বান্ধবী কোথায় লুকিয়ে আছেন?”

তুষি অবাক গলায় বলল, “আমি কি করে বলবো?”

“এই শহরে আপনার থেকে ভালো বান্ধবী তার দ্বিতীয়টি নেই। তাছাড়াও আজ আপনার সঙ্গেই দেখা হওয়ার কথা ছিল।”

“কিন্তু আমি তো বললাম, নাজ আসেনি এখানে।”

“কে জানে? অন্য কোথায় আছে হয়তো! হয়তো আপনিই যত্ন করে নিজের প্রিয় বান্ধবীকে বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছেন।”

তুষি হকচকিয়ে গিয়ে প্রতিবাদের স্বরে বলল, “আমি শুধু শুধু ওকে লুকিয়ে রাখতে যাবো কেন?”

তুষি আরও কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওসি সাহেব নির্দেশের স্বরে বললেন, “শরীফ! উনার কথাবার্তা সন্দেহজনক। আমার ধারণা নাজনীন তার বাড়িতেই লুকিয়ে আছে।”

শরীফ বলল, “তাহলে কী করবো স্যার?”

“বোকার মতো প্রশ্ন করবে না। কী করবো মানে? এক্ষুনি এই মেয়েটার বাসায় যাবো।”

তুষি কিছু একটা বলতে গিয়েই থেমে গেল। হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তার সমানে দাঁড়িয়ে থাকা দুই পুলিশ অফিসারের দিকে। তুষির কথাবার্তায় সন্দেহজনকের কী ছিল কে জানে?

আশফাকের বাইক প্রায় ধরেই ফেলেছে বাসটিকে। মাত্র কয়েক সেন্টিমিটারের দূরত্ব। তবে এখন প্রধান সমস্যা হচ্ছে বাসকে কী করে থামানো যায়। আশফাক কী বাইকের স্পিড বাড়িয়ে বাসের সম্মুখে নিয়ে আড়াআড়িভাবে থামিয়ে দেবে? না-কি উচ্চস্বরে বাসের ড্রাইভারকে থামতে বলবে? মাথায় কিছুই কাজ করছে।

সায়েম আবার অতশত ভাবছে না। তার তৃষ্ণার্ত চোখদুটো স্থির হয়ে আটকে আছে বাসের দিকে। এই তৃষ্ণা তার কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে অন্তত একনজর দেখার।

বাসের ড্রাইভারের সিটের ঠিক পাশাপাশি এসে
আশফাক উঁচু গলায় বলল, “এই! গাড়ি থামাও।”

ড্রাইভার জানালা দিয়ে মাথা বাড়িয়ে পানের পিক ফেলতে ফেলতে তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল, “থামামু মানে? আপনে কেডা?”

আশফাক কড়া গলায় বলল, “ধানমন্ডি থানার ওসি সাহেব পাঠিয়েছে। থামাও নাহলে গাড়ি সহ হাজতে যেতে হবে।”

চলন্ত বাসটা থেমে গেল মহাসড়কের বুকে। সায়েম তড়িঘড়ি করে উঠে গেল তাতে, তার পিছু পিছু উঠল আশফাকও। দুই আগন্তুকের আকস্মিক আগমনে যাত্রীদের বিস্মিত চোখদুটো তাদের দিকেই আটকে আছে। সবাইকেই দেখতে পাচ্ছে, তবে দেখতে পাচ্ছে না নাজকে। কোথায় গেল মেয়েটা? কোনো এক ফাঁকে বাস থেকে নেমে যায়নি তো? তা তো হবার কথা নয়। সেই তখন থেকে এই বাস সায়েমের নজরবন্দি।

বিস্মিত মুখগুলোর মাঝে সায়েমের চোখ পড়লো সেই কালো সালোয়ার কামিজ পরিহিতা নারীর দিকে। চোখ পড়তেই একরাশ হতাশা ছেয়ে গেল তার মাঝে। এটা নাজ নয়! আশাভঙ্গের পর সৃষ্ট হতাশার তীব্রতা ভয়াবহ।
এত বড় একটা ভুল কী করে করলো সায়েম? তার সবথেকে প্রিয় মানুষটাকেই চিনতে ভুল করলো?

অবশ্য বেচারাকে দোষ দিয়েও লাভ নেই। প্রচন্ড দুশ্চিন্তায় দিশেহারা হয়ে মানুষের চোখে ভ্রান্তিরা খেলে বেড়ায়। কয়েক মুহূর্তের জন্যে সেই ভ্রান্তিকেই সত্য বলে মনে হয়।

ইডেন কলেজ থেকে তুষির বাড়ির দূরত্ব মাত্র কয়েক মিনিটের। দুই বেডরুমের এই ছোট্ট ফ্ল্যাটে কেবল তুষি এবং তার মায়ের বসবাস। বাবা বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন ব্যবসার তাগিদে। দুপুরের এই সময়টায় মেয়ের ভার্সিটি থাকার কথা। তাকে এই সময়ে বাড়িতে দেখে অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেলেন শিরিন সুলতানা। তার থেকেও বেশি অবাক হলেন তার সঙ্গে দুজন পুলিশ অফিসারকে দেখে। মধ্যবিত্তদের প্রতিদিনকার জীবনে যেখানে উল্লেখযোগ্য করার মতো তেমন কিছুই ঘটে না, সেখানে পুলিশের আকস্মিক আগমন যেন
উল্লেখযোগ্যেরও বেশি।

শিরিন সুলতানা অসহায় গলায় বললেন, “ওসি সাহেব? আমার মেয়ে কী করেছে?”

ওসি হানিফ হাই তুলতে তুলতে বললেন, “তেমন কিছু না। একজনকে লুকিয়ে রেখেছে, আমরা তাকেই খুঁজতে এসেছি।”

শিরিন সুলতানা মেয়ের দিকে তাকিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, “এই তুষি! উনারা কী বলেছেন এসব? কাকে লুকিয়ে রেখেছিস তুই?”

তুষি কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই ওসি সাহেব আশ্বাস দিয়ে বললেন, “আহা! আপনি এত ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? আপনার মেয়ে কোনো ক্রিমিনালকে লুকিয়ে রাখেনি। শরীফ! চিঠি লিখে নিজ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়া কী কোনো ক্রাইম?”

শরীফ ইতস্তত করে বলল, “এটা তো বলতে পারবো না স্যার।”

“মান-সম্মান কিছুই রাখলে না! দাঁড়িয়ে আছো কেন? যাও খোঁজা শুরু করো।”

বাড়ির ছাদের চিলেকোঠা, বারান্দার সঙ্গে থাকা ছোট্ট ঘর, রান্নাঘরের সঙ্গে থাকা বাথরুম – বলতে গেলে বাড়ির কোনো একটা কোণেও খুঁজতে বাকি রাখলো না শরীফ। এমনকি বাড়ির নিচতলার বাগানেও একদফা খোঁজাখুঁজি হলো। কোথাও নাজের বিন্দুমাত্র চিহ্ন পর্যন্ত নেই।

ওসি সাহেব মোটামুটিভাবে নিশ্চিত ছিলেন, আর কোথাও না হলেও তুষির বাড়িতে ঠিকই পাওয়া যাবে নাজকে। এসব কী হচ্ছে? একটা মানুষ নিশ্চয়ই হুট করে উধাও হয়ে যেতে পারে না। ওসি সাহেবের মাথায় হাজাররকম চিন্তারা আনাগোনা শুরু করেছে। চেনা পরিচিত কোথাও নাজ নেই। আচ্ছা, কোনো বদ লোকের পাল্লায় পড়লো না তো নাজ? তাহলে তো খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। আশেপাশের সবগুলো থানায় ইতোমধ্যে পৌঁছে গেছে নাজের ছবি। তাকে দেখা মাত্র জানিয়ে দেওয়া হবে। তবুও ঠিক ভরসা করতে পারছেন না ওসি হানিফ।

এতক্ষণ মনে হচ্ছিল ইচ্ছা করেই কোথাও একটা লুকিয়ে আছে নাজ। তবে হুট করে মনে কু ডাকের আগমন ঘটেছে। যে মানুষটা ইচ্ছা করে লুকিয়ে থাকে তাকে নাহয় হাজার চেষ্টা করে খুঁজে পাওয়া যায়। তবে যে মানুষটা কোনো বদ লোক দ্বারা লুকিয়ে রাখা হয়, তাকে খুঁজবে কী করে পুলিশ?

দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সময়টা ভয়ঙ্কর এক অস্থিরতায় কাটলো। বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, শপিং মল, বান্ধবীদের বাড়ি – প্রত্যেকটা জায়গা তন্নতন্ন করে খুঁজে বেড়ালো সায়েম। একেক জায়গায় যাচ্ছে, মনের ভেতর তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে যে আর কিছুক্ষণ বাদেই নাজকে দেখতে পাবে সে। পারবে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু নাজকে কোথাও পাওয়া গেল না।

তীব্র এক আর্তনাদ বেজে উঠেছে সায়েমের মনে – “কোথায় তুমি নাজ? প্লিজ ফিরে এসো আমার কাছে।” মানুষের মনের কথাগুলো তো আর দূর থেকে কেউ বুঝতে পারে না। পারলে নাজ যেখানেই থাকুক, ছুটে চলে আসতো সায়েমের কাছে।

আচ্ছা, মেয়েটা এত বোকা কেন? নাজ কি একবারের জন্যেও বুঝতে পারলো না, যে সে পাশে থাকলে সায়েমের আর কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই। তার জন্যে পৃথিবী সুদ্ধ সকলের সঙ্গে যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিতেও দ্বিধা বোধ করবে না সায়েম। নাজ কি করে ভাবতে পারলো, তার উপস্থিতি সায়েমের কষ্টের কারণ। তার অনুপস্থিতিতে ছেলেটা যে মরে যাবে, এটা একবারও মাথায় এলো না তার?

দুপুর পর্যন্ত মনের মাঝে একটা চাপা উত্তেজনা আর দুশ্চিন্তামিশ্রিত অনুভূতি কাজ করলেও এখন সেসবের কিছুই নেই। মনটা জুড়ে কেবল তীব্র সংশয়ের আনাগোনা। বারবার প্রশ্ন করছে সায়েম নিজেকে, আবার কখনো কি দেখতে পাবে তার ভালোবাসার মানুষটার দু চোখ ভরে? হাজারো স্মৃতিরা ঘুরে বেড়াচ্ছে মনে। সুখময় স্মৃতি, যেখানে রয়েছে কেবল সায়েম এবং নাজ। নেই কোনো ভয়, নেই কোনো দুশ্চিন্তা, নেই কোনো কিছু হারানোর আক্ষেপ। কী ভয়ঙ্কর সুন্দর মুহূর্ত ছিল সেগুলো। তখন যদি একবারও সায়েম বুঝতে পারতো, আজকের দিনটার মুখোমুখি হতে হবে, তাহলে হয়তো চিরকাল ধরে রাখতো মুহূর্তটাকে।

আচ্ছা, নাজের সঙ্গে তার শেষ কথোপকথনটা যেন কী ছিল? কিছুতেই মনে করতে পারছে সায়েম। পারবে কী করে? তখন কি আর সে জানে, ওটাই তাদের শেষ কথোপকথন?

বিয়ের পর তো অনেকটা দিন নিজেদের মাঝ অদৃশ্য এক দেয়াল তৈরি করে নাজকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল সায়েম। তবুও এই শূন্যতার অনুভূতি অনুভব হয়নি তখন। তখন তো চাইলেই দেখা যেত মেয়েটার ত্রি-কাল ভুলানি হাসি, কারণে অকারণে রাগিয়ে দেওয়া যেত। ভালোবাসার প্রকাশস্বরূপ দুয়েকটা ধমকও দেওয়া যেত। অথচ আজ?

সায়েমের বুকের মাঝে এক তীব্র ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। এই ব্যথার তীব্রতা পরিমাপ করার সাধ্য আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের নেই। তবে নিবারণের ক্ষমতা আছে, কেবল একজনেরই। সেই একজনটা না জানি কোথায় পালিয়ে বেড়াচ্ছে। সায়েম মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে ফেলল, একবার পেয়ে যাক নাজকে, এ জীবনে আর হারিয়ে যেতে দেবে না। শক্ত করে তার হাতদুটো ধরে কাটিয়ে দেবে বাকি জীবনটা।

রাত সাড়ে এগারোটা। থানায় ওসি হানিফ সাহেবের মুখোমুখি বসে আছে সায়েম এবং আশফাক। সকলের চোখেমুখেই দুশ্চিন্তা আর হতাশার প্রতিচ্ছবি।

ওসি সাহেব চিন্তিত গলায় বললেন, “সায়েম সাহেব?”

সায়েমের অন্তরাত্মা যেন এ জগতে নেই, বেড়াচ্ছে ভিন্ন এক ঘোরের জগতে। ওসি সাহেবের ডাক তার কর্ণকুহরে পৌঁছালো না। আনমনে ভেবে যাচ্ছে নাজের কথা।

ওসি সাহেব আবারও বললেন, “সায়েম সাহেব? শুনছেন?”

সায়েম সংবিৎ ফিরে পেয়ে বলল, “জি?”

ওসি সাহেব যথাসম্ভব নরম গলায় বললেন, “সারাটাদিন কম খোঁজাখুঁজি তো করলাম তো। আশেপাশের সব থানায় আপনার স্ত্রীর ছবি পাঠানো হয়েছে, ট্রাফিক পুলিশের কাছেও পাঠানো হয়। সন্দেজনক জায়গাগুলোতে আমি নিজে গিয়ে সার্চ করেছি। আপনারাও তো সারাদিন কম ছোটাছুটি করলেন না। খুঁজে পাওয়ার হলে তো এতক্ষণে পেয়েই যেতাম বলুন। আমি বলি কী, আজকের মতো আমরা রেস্ট নিই। কাল সকাল থেকে নতুন উদ্যমে খোঁজা শুরু করবো। কী বলেন?”

সায়েম চুপ করে রইল। পুলিশও শেষমেশ হাল ছেড়ে দিয়েছে। তবে সে তো হাল ছাড়ার মানুষ নয়। কেউ পাশে থাকুক কিংবা না থাকুক, নাজকে না নিয়ে সায়েম বাড়ি ফিরে যাবে না।

(চলবে)