#অপেক্ষার_বসন্ত
ফাহমিদা তানিশা
পর্ব ০৯
আরাফের কথায় অর্নি চোখ তুলে তাকালো তার দিকে।এতো বছর ধরে একতরফা ভালোবাসার পর যদি কেউ জিজ্ঞেস করে ভালোবাসে কিনা তাহলে তাকে কি জবাব দেওয়া যায়?তাই কোনো জবাব না দিয়ে অর্নি চুপ করে আছে।তার কাছ থেকে কোনো জবাব না পেয়ে আরাফ বললো:”ওকে ফাইন।তোর বলতে হবে না। আমিই বলি। তোকে ভালবাসি কিনা আমি জানি না কিন্তু এতটুকু জানি আজকাল তোকে দেখে ঘুম থেকে উঠা আমার ডেইলি রুটিনের অংশ হয়ে গেছে। আমার প্রতিটা মূহুর্তের ছোট-বড় সব অনুভূতি তোকে মনে করিয়ে দেয়।জুঁইয়ের সাথে ব্রেকআপ হওয়ার পর যতোটা কষ্ট পেয়েছিলাম তার চেয়েও বেশি কষ্ট লাগছে আজ। তোকে ছাড়া আমি সম্পূর্ণ অচল তা হয়তো তুই জানিস না। কিন্তু আমি জানি।ভালোবাসি কিনা না জানলেও এতটুকু জানি তোকে ছাড়া আমার চলবে না। আমি তোকে চাই।ভুল করে হলেও বা ঠিক করে হলেও তুই আমার সাথেই থাকবি। শুধু আমাকেই ভালোবাসবি।”
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামলো আরাফ। অর্নি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।কি বলবে বুঝতে পারছে না সে।আরাফ কথা শেষ করে অর্নির দিকে তাকালো।দেখলো সে তাকিয়ে আছে এখনো।তা দেখে আরাফ ভ্রু কুঁচকে বিড়বিড় করে বললো:সব তো ঠিকই বললাম। এভাবে তাকিয়ে আছিস কেনো তবু?
অর্নি এলোমেলো কণ্ঠে বললো:আমি হয়তো ভুল শুনেছি।
কথাটা শুনে আরাফ অবাক চোখে তাকিয়ে থাকলো। অর্নি এবার নিজেকে কন্ট্রোল করে বললো:এসব বলার জন্য ডেকেছেন?
_হুম।
_তাহলে কথা শেষ। এবার অফিসে দিয়ে আসুন।
_আরো বাকি আছে।
_বলুন তাহলে।
_তোকে এতো কথা বললাম আমাদের বাড়িতে চলে আসার জন্য। মনের সব কথা ধুয়ে মুছে বলে ফেললাম শুধু তোকে ফেরানোর জন্য। এখন তো চলে আসতে পারিস।
_না যেতে পারবো না।
_কেনো পারবি না?
_আপনি বুঝতে পারছেন না কেন? আমাকে এসব বলে কি হবে? আব্বু-আম্মু আমাকে নিয়ে এসেছে তাও খালামনি আর আংকেলের সামনে থেকে। এখন তো আর আমি আপনার কথায় ফেরত যেতে পারি না।
_তাহলে কি করবো?
_আমি কি জানি? আপনার যা খুশি তাই করেন।মন চাইলে জুঁইয়ের সাথে ঘুরেন আর মন চাইলে অন্য মেয়ের সাথে ঘুরেন।
কথাগুলো বলে অর্নি মনে মনে হাসছে।এতোদিন পর আরাফের নাগাল পেলো সে।এতো সহজে কি ছাড়া যায়? এখন তো তাকে একটু ভাব দেখাতেই হবে। আজীবন আরাফের পেছনে পেছনে ঘুরেছে। এখন তো আরাফকেও তার পেছনে ঘোরানো উচিত। এটাকেই বলে ঠাণ্ডা মাথার খেলা।
শেষের কথাটা শুনে আরাফ রাগে কটমট করছে। না পারছে সহ্য করতে আর না পারছে কিছু বলতে। একেবারে নাজেহাল অবস্থা তার। তবু শান্ত হয়ে বললো: তোকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটা প্ল্যান করতে হবে। বুদ্ধি দে।
_সারাজীবন তো আমাকে মাথামোটা বলতেন।আজ বুদ্ধি চাইছেন কেনো?
অর্নির কাণ্ডে আরাফ এবার বুঝতে পারলো সে মজা নিচ্ছে। রাগী গলায় বললো: আমাকে জালে ফেলে এখন মজা নিচ্ছিস?ভালো,মজা নে।সময় হলে আমিও মজা নিবো।
অর্নি এবার সিরিয়াসলি জবাব দিলো: মাত্র গতকাল আসলাম। আম্মু-আব্বুর মনটাও ঠিক নেই এসব ডিভোর্সের ব্যাপারটা শুনে। এখন তারা কিছুতেই এসব মেনে নিবে না।তাই কয়েকটা দিন যাক। তারপর ভাববো।
আরাফ কিছু বলতে যাবে তখনি তার ফোন বেজে উঠলো।সে ফোনটা হাতে নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছে। স্ক্রিনে জুঁই নামটা ভাসছে।অর্নি সামনে আছে তাই হয়তো এখনো ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে আছে সে। বুঝতে পারছে না কি করবে । ভাবতে ভাবতে ফোনটা কেটে গেলো। কিন্তু জুঁই থামার মেয়ে নয়।সে আবারো ফোন দিলো।এবারো আরাফ একইভাবে তাকিয়ে আছে ফোনের দিকে। অর্নি প্রথম থেকে পর্যবেক্ষণ করছিল সব। এবার আর চুপ থাকতে পারলো না সে। গম্ভীর গলায় বললো: ফোনটা রিসিভ করতে পারেন।
অর্নির কথায় আরাফ একবার চোখ তুলে তাকালো তার দিকে। তারপর ফোনটা রিসিভ না করে কেটে দিলো।
আরাফের কাণ্ড অর্নি চুপচাপ দেখে যাচ্ছে।সে বুঝতে পারছে না আরাফ আসলে কি করতে চাইছে? এদিকে বলছে তাকে ছাড়া থাকতে পারছে না অন্যদিকে জুঁই তাকে ফোন দিচ্ছে। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে সে।আরাফ আবারো তাকালো অর্নির দিকে।তার চোখেমুখে সন্দেহের ছাপ স্পষ্ট। সন্দেহ হওয়াটা স্বাভাবিক।তা দেখে আরাফ বললো: সন্দেহ করছিস বুঝি?
অর্নি রাগী দৃষ্টিতে তাকালো। রাগে ইচ্ছে করছে আরাফের মাথাটা ফেটে দিতে। সে তো সব ছেড়ে চলে এসেছিল। তখন আবার আরাফ নিজেই আসলো।এতোগুলো কথা বোঝালো। কিন্তু ঠিকই জুঁই এখনো আছে তাদের মাঝে।জোরে চিল্লিয়ে বললো: আপনি আসলে চাইছেন কি?আমি নিজে গিয়ে ডিভোর্সের জন্য আবেদন করলাম। আপনি জুঁইয়ের সাথে ঘুরছেন-ফিরছেন তাতেও কোনো প্রতিবাদ করলাম না।দেখেও না দেখার মতো করে ছিলাম। গতকাল আব্বু-আম্মুর সাথে আপনাদের বাড়ি থেকে চলে আসলাম। আসার সময়ও আপনার স্ত্রী বলে কোনো দাবি পর্যন্ত করলাম না।আমি তো আপনাদের মাঝ থেকে সরে যাচ্ছি তখন থেকে। যদি জুঁইয়ের সাথে সব ঠিক থাকে তাহলে আবার এসবে আমাকে জড়াতে আসলেন কেন?
আরাফ শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে। অর্নি কখনো এতো রেগে গিয়ে কথা বলেনি তার সাথে। হয়তো এবার সহ্যের সীমা অতিক্রম করেছে তাই রাগটা আর কন্ট্রোল করতে পারলো না সে। কিছু মানুষ আছে এমন। তারা সবসময় নিজেকে শান্ত রাখে।রেগে যায় কম। কিন্তু যখন একবার রাগ উঠে তখন পৃথিবীর কোনো কিছু তার রাগ আটকাতে পারে না।অর্নির মেজাজটাও এমন।সে সহজে রেগে যায় না। কিন্তু একবার রেগে গেলে কেউ তাকে থামাতে পারে না। এমনকি বাবা-মাও তাকে থামাতে গিয়ে হিমশিম খায় তখন।
মাঝে ঘটে গেলো আরেক ঘটনা।অর্নির জোর গলায় কথা বলছিল তখন রাস্তার কয়েকজন ছেলে ছিল। যেহেতু তারা গাড়ি থামিয়ে কথা বলছে ছেলেগুলো সব শুনতে পেলো।তারা মাষ্টারি করতে এসে বললো:আপা রাস্তায় এভাবে ঝগড়া করতাছেন কেন?
ছেলেগুলোর কথায় অর্নি এবং আরাফ দুজনেই বাইরে তাকালো। ছেলেটার কথা গরম তেলে পানির ছিটার মতো অর্নির গায়ে গিয়ে পড়লো। মেজাজ তো আরো চরম পর্যায়ে গেলো আজ। চিল্লিয়ে বললো:এই ব্যাটা, রাস্তা কি তোর না তোর বাপের? আমি সরকারের রাস্তায় চাইলে ঝগড়া নয় মারামারি করতে পারি।তোর বাপের কি?যদি বলতে হয় সরকাররে নিয়ে আয় বলার জন্য।
অর্নির কথা বলার ভঙ্গি দেখে আরাফ হো হো করে হেসে দিলো। ছেলেগুলো কথাটা শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো। একজন রেগে গিয়ে বললো:এই মেয়ে সাহস থাকলে গাড়ি থেকে নেমে কথা বল।
অর্নি তো এবার ছেলেটার কথায় গাড়ি থেকে নেমে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। আজকে আরাফের উপর যতো রাগ উঠেছে সব এদের থেকে উদ্ধার করবে সে।এই ছেলেগুলো না হলেও কেউ তো তার শিকার হবে আজ। গমগমে গলায় বললো:কি বললি? আমার সাহস দেখতে চাস?
এই বলে সে নামতে যাবে তখনি আরাফ তার হাত ধরে ফেললো। হঠাৎ আরাফের স্পর্শ পেয়ে সে হাতের দিকে তাকালো।আরাফ বুঝতে পারলো সে হাতটা ধরায় অর্নি কিছুটা একটু নার্ভাস হয়ে গেছে।সেই চান্সে সে গাড়িটা স্ট্রাট দিলো।গাড়িটা দ্রুত চালিয়ে এখান থেকে কেটে পড়তে পারলেই তার শান্তি।
অর্নি একটু পর কি ভেবে হাতটা দ্রুত ছাড়িয়ে নিলো। তারপর গম্ভীর কন্ঠে বললো: আপনি আমার হাত ধরলেন কেনো?
_ইচ্ছে হয়েছে তাই।
_ইচ্ছে হলেই হাত ধরতে পারবেন না।আমার হাতটা আপনার বাবার পৈতৃক সম্পত্তি নয়? জুঁইয়ের হাত ধরুন গিয়ে।
_আমার বাবার পৈতৃক সম্পত্তি না হলেও আমার নিজস্ব সম্পত্তি। তাই ধরলাম। জুঁইয়ের হাত ধরবো কেনো? জুঁই কি আমার বউ? তুই আমার বউ তাই তোর হাত ধরলাম।
কথাটা শুনে আরেক দফা রেগে গেলো সে। রাগে গজগজ করতে করতে বললো:এই কে আপনার বউ?বউ রেখে অন্য মেয়ের সাথে ঘুরেন তখন বউয়ের কথা মনে থাকে না? আজকে থেকে আমার নামটাও নিবেন না। আমিও আপনার নাম কখনো নিবো না।এই জুঁইয়ের সাথে আপনাকে মানায়। আপনি জুঁইয়ের সাথে থাকুন।গাড়ি থামান।আমি গেলাম।
আরাফ কথাগুলো শুনে রাগী দৃষ্টিতে তাকালো কিন্তু কিছু বললো না। পরিস্থিতি এমন যে এখন কিছু বলতে গেলে তাকে বেইজ্জতি করে উল্টিয়ে দিয়ে আসবে অর্নি।তাই রাগটাকে নিয়ন্ত্রণ করা এখন ফরজ।অন্য সময় বরং সে সব তুলে নিবে।গাড়িটাও থামালো না।
_কি হলো গাড়ি থামান।
_থামাবো না।
_এখন লাফ দিবো গাড়ি থেকে।
_এখনো তোর অফিস অনেক দূরে। এখানে নামলে আর কোনো গাড়িও পাবি না।
_সেটা আমি ভাববো। আপনাকে ভাবতে হবে না আমাকে নিয়ে। আপনি থাকুন আপনার মতো। আমাকেও শান্তি মতো বাঁচতে দিন।
আরাফ কথাটা শুনে গাড়ি থামালো। অর্নি সাথে সাথে নেমে গেলো।আরাফকে কোনো কথা বলার সুযোগ দিলো না।
গাড়ি থেকে নেমে সোজা হাঁটছে সে। হাঁটতে হাঁটতে নিজের উপর রাগ হচ্ছে।তেজটা একটু বেশি দেখিয়ে ফেললো।তেজ দেখিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে এখন এতো রাস্তা হাঁটতে হচ্ছে তাকে। একটু পর নামলে এতদূর হাঁটতে হতো না।কি আর করার আছে? এখন তো আর হাঁটা ছাড়া উপায় নেই। আচমকা একটা গাড়ি এসে থামলো তার পাশে। অর্নি সাথে সাথে সেই দিকটায় তাকালো। ছেলেটি তাকে দেখে মুচকি হেসে বললো:ম্যাম আমার গাড়িতে আসতে পারেন।
অর্নি অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। ছেলেটাকে আগে কোথায় যেনো সে দেখেছে।
চলবে….