#অপেক্ষার_বসন্ত
ফাহমিদা তানিশা
পর্ব ১১
আরাফ কি জানে এসব? তাকে তো একবার বলা উচিত জুঁই তার সাথে টাইম পাস করেছে সেটা। সামনে থাকা ফোনটা হাতে নিলো অর্নি। ভাবলো আরাফকে ফোন দিয়ে বলবে কিন্তু কি মনে করে আবার ফোনটা রেখে দিলো। তারপর পারভেজকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো:আপনিই জুঁইকে আরাফের পেছনে লেলিয়ে দিয়েছেন? কেনো করলেন এমন? নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে কেনো অন্যের কাছে পাঠালেন?
অর্নির প্রশ্নে পারভেজ একটু দম নিলো। তারপর বললো:এসব না বললে কি হয় না?
_একজন মানুষের মন নিয়ে খেলার মতো জঘন্য একটা কাজ করলেন আপনি আর জুঁই। এখন এসব বলতে ইচ্ছে করছে না? আপনাকে তো বলতেই হবে।
শান্ত চোখে সে অর্নির দিকে তাকালো। তারপর বললো:সরি ম্যাম। মানুষ মাত্রই ভুল।আসলে তখন বুঝতে পারিনি। এখন জুঁই আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার পর বুঝতে পারছি প্রিয় মানুষটাকে ভুলে থাকা কতো কষ্টের। কিন্তু দেখুন, প্রকৃতির কি প্রতিশোধ! আমার জন্য আরাফ যেমন কষ্ট পেয়েছে এখন আমিও সেইম কষ্ট পাচ্ছি।
পারভেজ একটু থেমে বললো:জানেন ম্যাম? আমার আর জুঁইয়ের স্কুল জীবন থেকে সম্পর্ক ছিল। দুজনেই এক স্কুলে পড়তাম।একই গ্রামে দুজনের বাড়ি।কলেজ পেরিয়ে মেডিকেলে চান্স পাওয়ার পর জুঁইকে এবং পরিবারকে ছেড়ে এই শহরে চলে আসি। শহরে নতুন এবং একা। তখন থেকে জুঁইকে মোটিভেট করা শুরু করলাম যাতে সেও আমার মেডিকেলে চান্স পায় আর একসাথে থাকতে পারি। সত্যি সত্যি সে চান্স পেলো আর একসাথে থাকতে থাকতে টানটা আরো বেড়ে গেলো। দু’জন মানুষ এক হয়ে পথ চলতে শুরু করলাম। বেশ মেধাবী ছিলাম আমি।স্কুল-কলেজে ফার্স্ট বয় ছিলাম। কিন্তু মেডিকেলে এসে আর ফার্স্ট হওয়া হয় না। সবসময় আরাফ আমার আগে চলে আসে। একটা বিষয় কি জানেন? সবসময় সবাই প্রথমকে চিনে, প্রথমকে মূল্যায়ন করে।দ্বিতীয়কে কেউ চিনতে চায় না, মূল্যায়ন করে না। হোক শিক্ষকেরা বা ক্লাসমেটরা। তখন আমার পরিস্থিতিও এমন।সবাই আরাফকে নিয়ে পড়ে থাকতো।তা দেখে আমার মনে তখন হিংসার আগুন উত্তপ্ত হয়ে ছিল। ভাবলাম আরাফকে হারাতে হবে।
পারভেজ আবারো থেমে একটু দম নিলো। সামনে থাকা গ্লাস থেকে এক চুমুক পানি খেলো। একটু হেসে বলা শুরু করলো আবার:আরাফ যদি জুঁইকে সময় দেয় তাহলে ও পড়ার সুযোগ কম পাবে এই ভেবে জুঁই আর আমি পরিকল্পনা করলাম। জুঁই আরাফকে পটিয়ে ছাড়লো।তাও এমনভাবে পটালো যে আরাফ জুঁই ছাড়া কিছু বুঝতো না। জুঁইকে সে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করতো।তার সব নোটস, প্রেজেন্টেশন দিতো। আমি সেসব পড়তাম। তবু কি জানেন? শুধু থার্ড ইয়ারে একবার আরাফকে ফেলতে পেরেছিলাম।”
এই বলে সে খিল খিল করে হাসলো। তারপর বললো:সে আসলেই অনেক মেধাবী।আর আমি একজন সফল ডাক্তার হওয়ার পেছনে তার অনেক অবদান আছে।
অর্নি চুপচাপ কথাগুলো শুনছে।সে কি হাসবে নাকি কাঁদবে বুঝতে পারছে না। আপাতত কি প্রতিক্রিয়া করতে হবে তাও তার জানা নেই। তাই শুধু শুনেই চলেছে।
_তারপর
_তারপর আরাফ ডিগ্রি নিতে বিদেশ গেলে আমি আর জুঁই দ্রুত বিয়ে করে নিই আর জুঁইয়ের পড়া শেষ হলে দুজনেই আমাদের গ্রামের হাসপাতালে জয়েন করি।ভয় ছিল একটাই।যদি আরাফ দেশে এসে জুঁইকে নিয়ে যায়?সে তো বড়লোকের ছেলে।তার তো জুঁইকে পেলে ঠিকই তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করার মতো পাওয়ার আছে।তাই মূলত গ্রামে পালিয়ে যাওয়া।
অর্নির মাথায় হুট করে একটা প্রশ্ন আসলো।এতো ভালোবাসা থাকলে দুজনের মধ্যে ডিভোর্স হলো কেনো? সাথে সাথে সে পারভেজকে প্রশ্নটা করে ফেললো।”তাহলে ডিভোর্স হলো কেনো?”
_ম্যাম গ্রামের হাসপাতালে ছিলাম। খুব একটা বেশি আয় ছিল না। জুঁইয়ের চাওয়াগুলো পূরণ করতে হিমশিম খাচ্ছিলাম। তাকে হয়তো আমি ঠিকমতো সবকিছু দিতে পারিনি।পরে বুঝলাম এসবের মাঝে তার লাইফে নতুন কেউ এসেছে। আমি তার যেই চাওয়াগুলো পূরণ করতে পারছিলাম না সেই চাওয়াগুলো নতুন মানুষটা পূরণ করছে।আমি মাঝখানে থেকে তার স্বপ্নগুলো পূরণ হতে দিচ্ছি না।তাই সে বিচ্ছেদ চায়।
কথাগুলো বলতে গিয়ে পারভেজের গলা ধরে আসছে।সে থামলো।অর্নি একবার পারভেজের দিকে তাকালো।তার চোখ দুটি ছলছল করছে।এই বুঝি টুপ করে জল গড়িয়ে পড়বে। অর্নি তার অবস্থা বুঝে সামনে থাকা গ্লাসটা এগিয়ে দিলো।সে আরেক চুমুক পানি খেলো। তারপর আরেকটু থামলো। তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো:যে ছেড়ে যেতে চায় তাকে কি জোর করে রাখা যায়? যেখানে মনের বিচ্ছেদ হয়ে গেছে সেখানে কাগজে-কলমে বিচ্ছেদ কি কঠিন কিছু? তার মনটা আমার মাঝে নেই মানে আমি হেরে গেছি। তখন বিচ্ছেদ কঠিন কিছু নয়।তাই ছেড়ে দিলাম।
অর্নি পারভেজের কথায় হাসলো। আসলেই যৌক্তিক কথা।এই কথাটা ভেবে সেও এডভোকেট শাহানার কাছে গিয়েছিল। বিচ্ছেদ যদি অপর পক্ষের মানুষটাকে শান্তি দিতে পারে তাহলে তারা কেনো কষ্ট পাবে?তাদেরও পৃথিবীটা উপভোগ করার ইচ্ছা আছে, অধিকার আছে। শুধু স্বার্থপররা জিতে যাবে।তা কি হয় কখনো? আসলেই হয় না। প্রকৃতির প্রতিশোধ নামে একটা কথা আছে। জীবনের কোনো এক ধাপে এই কথাটা সত্যি হয়ে তাদের থামিয়ে দেয়। এটাই এখন সবচেয়ে বড় সান্ত্বনা।
অর্নির মাথায় হুট করে আরেকটা প্রশ্ন আসলো। পারভেজকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে বললো: আপনি আমাকে মিথ্যা বলছেন না তো?
কথাটা শুনে পারভেজ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো: এতোগুলো কথা আপনার মিথ্যা মনে হলো কেনো?
_কারণ জুঁইয়ের সাথে আপনার বিচ্ছেদের পরও জুঁই কেনো আপনার গাড়ি ব্যবহার করছে এখনো?
পারভেজ কথাটা শুনে তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো। তারপর বললো:ম্যাম আমি মধ্যবিত্ত একজন ছেলে। আমার নিজের কোনো গাড়ি নেই তার মধ্যে জুঁই আমার গাড়ি কোথায় পাবে? আপনাকে যেই গাড়ি করে লিফট দিলাম ওটা আমার অফিসের গাড়ি।
পারভেজের কথা শুনে অর্নি দ্রুত তার ফোনটা হাতে নিলো। ফোনের গ্যালারিতে গিয়ে গাড়ির ছবিটা পারভেজকে দেখালো। জুঁইকে ফলো করতে গিয়েছিল তখন সে গাড়ির ছবিটা তুলেছিল। পারভেজ গাড়িটা দেখে বললো:এটা আমাকে কেনো দেখাচ্ছেন ম্যাম?
_এই গাড়িটা জুঁই ব্যবহার করে কিন্তু আপনার নামে রেজিষ্ট্রেশন করা আছে।
_আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। আমি কখনো গাড়ি কিনতে যায় নাই। এছাড়া আমার কোনো গাড়ি নেই। বলা যায়,আমি এককথায় ফকির মানুষ।
অর্নি এবার রুমানাকে ডাক দিলো। রুমানা তাকে এই ইনফরমেশন দিয়েছিল। হয়তো তার কাছে এখনো রেকর্ডটা আছে।তাই সে আসলে পারভেজ আর মিথ্যা বলার সুযোগ পাবে না।অর্নির এই মূহুর্তে পারভেজকে মিথ্যাবাদী মনে হচ্ছে। অর্নির ডাক পেয়ে রুমানা দ্রুত আসলো।
_ম্যাম ডেকেছেন আমাকে?
_হুম এদিকে আসো।
রুমানা অর্নির কাছে আসলে সে ছবিতে থাকা গাড়িটা দেখালো। তারপর বললো:এই গাড়িটার ইনফরমেশন তুমি আমাকে দিয়েছিলে।ওটা আছে তোমার কাছে?
_হুম ম্যাম। আমার ডেস্কে আছে।
_একটু নিয়ে আসো।
_ওকে ম্যাম।
এই বলে রুমানা প্রস্থান করলো।
একটু পর রুমানা হাতে একটা ফাইল নিয়ে ফিরে আসলো।এসেই হাতে থাকা ফাইলটা অর্নিকে দিলো। অর্নি ফাইলটা পারভেজকে দেখালো। রাগী গলায় বললো:এই দেখুন। আমার কাছে এভিডেন্স আছে। আপনি মিথ্যা বললেন কেনো?
পারভেজ অর্নির হাত থেকে ফাইলটা নিয়ে খুব সুক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। তারপর বললো:ম্যাম আমি বুঝতে পারছি না এই গাড়ি আমার নামে রেজিষ্ট্রেশন করা কেনো?আমি সত্যি এসব জানি না। আমাকে বিশ্বাস করুন প্লিজ ম্যাম।
অর্নি হাসলো। রাগী গলায় বললো:কতো সুন্দর করে আমাকে নাটকের স্ক্রিপ্ট শোনালেন। আপনাকে বিশ্বাস না করলে মস্ত বড়ো অপরাধ হয়ে যাবে আমার।
পারভেজ বুঝতে পারলো অর্নি তাকে অপমান করে কথাগুলো বলেছে। শান্ত কন্ঠে বললো: ম্যাম আমাকে বিশ্বাস করে যদি কিভাবে এই গাড়ি আমার নামে রেজিষ্ট্রেশন হলো সেটা বের করার চেষ্টা করেন তাহলে আপনার উপকার হবে। একবার তো বিশ্বাস করতেই পারেন।
অর্নি ভাবলো পারভেজের কথাটা। ভুল বলেনি সে। একবার তদন্ত করা যায় বিষয়টা। একটু শান্ত হয়ে বললো: আপনি বলেছেন জুঁইয়ের লাইফে নতুন কেউ আশায় আপনাকে ছেড়ে চলে গেছে। সেই নতুন মানুষটা কি আরাফ?
_না।আরাফ হবে কেনো?আরাফের সাথে তো জুঁইয়ের ছয় বছর আগে ব্রেকাপ হয়েছে।
_হয়তো আবার ফিরে এসেছে নতুন করে।
_না। আমার জানা মতে ছেলেটা পেশায় ব্যবসায়ী। ডাক্তার নয়। তাছাড়া আমাদের ডিভোর্সের তিন বছর হলো।আরাফ তো তিন বছর আগে বিদেশে ছিলো।
_তাহলে ছেলেটা কে?
_আমি জানি না।
_খোঁজ নিতে পারবেন কারো কাছ থেকে?
_হুম পারবো। জুঁইয়ের এক ফ্রেন্ড আছে।সে হয়তো জানবে সব।
_ওকে দ্রুত খোঁজ করে আমাকে জানাবেন। এখন আসতে পারেন আপনি।বাই দ্যা ওয়ে, ধন্যবাদ এতো ইনফরমেশন দেওয়ার জন্য।
_আসি ম্যাম।
এই বলে পারভেজ উঠলো।অর্নি উঠে গিয়ে তাকে এগিয়ে দিলো। পারভেজের উপর ছেড়ে দিলে তো হবে না।তাকেও তো খোঁজ করতে হবে।তাই সিদ্ধান্ত নিলো রুমানাকে জুঁইয়ের চেম্বারে পাঠাবে। তারপর তার ফোন নম্বরটা নিবে রুমানার মাধ্যমে।ভাবনা অনুযায়ী রুমানাকে বললো।দুজনে মিলে ঠিক করলো আজ রাতে রুমানা জুঁইয়ের কাছে যাবে।
হাতে কিছু কাজ ছিলো। সেগুলো শেষ করতে হবে।তাই আপাতত কাজে লেগে পড়লো সে।
কিছুক্ষণ পর, ঠিক কতোক্ষণ হয়েছে তা অর্নি বুঝতে পারলো না।তার ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনের আওয়াজ শুনে সে তাকালো সেদিকে।আরাফ ফোন করেছে। সকালে এতো কাণ্ড হলো তারপরও আরাফ ফোন করলো?বেশ অবাক হওয়ার বিষয়।কারণ আরাফের আবেগের চেয়েও ইগো বেশ কাজ করে। এমন কিছু মানুষ আছে। তাদের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। এমন মানুষকে আর যায় হোক,কেউ বুঝতে পারে না। খুব কাছ থেকে অনুভব না করলে এমন মানুষকে বোঝা বেশ মুশকিল। কিন্তু অর্নি আরাফকে বুঝে। হয়তো খুব কাছ থেকে অনুভব করে তাই। কিন্তু আজ বুঝতে চায় না সে। রাগ হচ্ছে ভীষণ। এমন কি কথা হয় জুঁইয়ের সাথে?যার জন্য তার সামনে আরাফ ফোনটা রিসিভ করতে পারলো না। ভাবতেই গাঁ শিউরে উঠে।তাই ফোনটা রিসিভ করবে না সে।
ফোনটা রিং হতে হতে কেটে গেলো। কিন্তু আরাফ থামলো না।সে আবারো ব্যাক করলো। এবারো অর্নি ফোনটা তুললো না।আরাফ কি দমে যাওয়ার ছেলে।সে দিতেই আছে ফোন। থামছে না কিছুতেই। অর্নি এবার এক প্রকার বিরক্ত হয়ে গেলো। ফোনটা রিসিভ করে রাগী কন্ঠে বললো:এই সমস্যা কি? ফোন দিয়ে দিয়ে বারবার বিরক্ত করছেন কেন? সামনে পেলে আপনার ফোনটা আছাড় দিতাম।
চলবে…