গল্প : #___অবাধ্য_পিছুটান
সাদিয়া_শওকত_বাবলি
পর্ব_২৬
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
তুর্য ক্রোধে দিশেহারা হলো। শক্ত কন্ঠে বলল,
-“আমার বউ আমার সাথে আমার কক্ষেই থাকবে দেখি কে আটকায়।”
তাহমিনা বেগম দাঁতে দাঁত চাপলেন। কটমট করে বললেন,
-“বাবা-মা, চাচা-চাচিদের সম্মুখে তোমার এসব কথা বলতে একটুও লজ্জা করছে না তুর্য? নির্লজ্জ ছেলে একটা।”
তুর্য মুখ বাঁকালো। ভাবলেশহীন ভাবে বলল,
-“ঘষেটি বেগমের ছেলে তো তাই লাজ লজ্জা একটু ছোট বেলা থেকেই কম আমার।”
তাহমিনা বেগম ছেলেকে চোখ রাঙালেন। শাসিয়ে বললেন,
-“একদম আজে বাজে কথা বলবে না বেয়াদব ছেলে। এত বছর বিদেশের মাটিতে থেকে লাজ লজ্জা, ছোট বড় সব জ্ঞান কি গুলিয়ে খেয়ে ফেলেছো নাকি?”
তুর্য পাত্তা দিল না মায়ের কথায়। এগিয়ে গিয়ে সে পৃথার এক হাত চেপে ধরলো নিজের হাত দ্বারা। স্বাভাবিক কন্ঠেই বলল,
-“রুমে চলো তো বউ। কতটা পথ জার্নি করে এসেছি। এখন তোমাকে নিয়ে আমার একটু বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন।”
তুর্যের এহেন বেলাজ কথায় হতবাক হলেন উপস্থিত সবাই। তাহমিনা বেগম বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকালেন ছেলের পানে। পরক্ষনেই নাক মুখ কুঁচকে বললেন,
-“বেলাজ, নির্লজ্জ ছেলে। এতক্ষন কি বললাম তোমার কানে যায়নি? পৃথা তোমার সাথে তোমার রুমে থাকবে না। ওর জন্য আমি অন্য রুমের ব্যবস্থা করছি ও সেখানেই থাকবে।”
তুর্য তাকালো মায়ের পানে। নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল,
-“আমি নির্লজ্জ হতে পারি মা কিন্তু শরমহীন নই। তাই এখনও বউকে সবার সম্মুখে কোলে তুলে নিয়ে নিজের রুমে ঢুকে যাইনি। দয়া করে তুমিও আমাকে তেমন কিছু করতে উস্কে দিও না।”
তাহমিনা বেগম আর কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেলেন না। এতক্ষন ধরে তো কম বললেন না তবুও তার বেলাজ ছেলেকে শোনাতে পারলেন না কিছুই। তার এক কথা বউয়ের আলাদা থাকবে না। এরপর আর কিই বা বলার থাকতে পারে? তুর্যের হয়তো লাজ লজ্জা নাও থাকতে পারে কিন্তু তার তো আছে। তারপরও এতক্ষন কম যু’দ্ধ চালালেন না তিনি। তাহমিনা বেগমের ভাবনার মধ্যেই তুর্যের ছোট ভাই তারেক এগিয়ে এলো ভাইয়ের পানে। এতক্ষন সে দাঁড়িয়ে ছিল এখানেই। গোলগোল চোখে দেখছিল পরিস্থিতি। কিন্তু ভাইয়ের শেষ কথাটায় আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না তারেক, এগিয়ে এসে দাঁড়ালো তুর্যের মুখোমুখি। মাথা চুলকে প্রশ্ন করলো,
-“নির্লজ্জ আর শরমহীন কি অলাদা ভাই?এই শব্দ দুইটার মধ্যে পার্থক্য কি?”
তুর্য সরু দৃষ্টিতে তাকালো ভাইয়ের পানে। ঠান্ডা কন্ঠে বলল,
-“নির্লজ্জ শব্দটা চারটা অক্ষর দ্বারা গঠিত এবং শব্দের শেষে যুক্তবর্ণের ব্যবহার রয়েছে। আর শরমহীন শব্দটা পাঁচটা অক্ষর দ্বারা গঠিত এবং পুরো শব্দটাতে কোনো যুক্তবর্ণ নেই।”
ভাইয়ের কথা শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল তারেক। পৃথার থেকে বছরে খানেকের বড় হবে সে। এবারে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে ছেলেটা। শ্রেনীতেও মেধাবী হিসেবে বেশ নাম ডাক আছে তার। কিন্তু এত পড়াশোনা এবং এত বইয়ের মধ্যেও “নির্লজ্জ আর শরমহীন” শব্দের এমন কোনো পার্থক্য কখনও খুঁজে পায়নি। ছেলেটা গভীর চিন্তায় নিমগ্ন হলো এতদিন তার পড়াশোনায় ভুল ছিল নাকি তার বিলেত পাশ করা ভাই ভুল বলছে? তুর্য এর মধ্যেই পৃথার হাত ধরে টান লাগালো। আবার বলল,
-“রুমে চলো বউ।”
পৃথা হাঁসফাঁস করছে। লজ্জা লাগছে তার। তাহমিনা বেগম এত করে বললেন দু’জনের আলাদা রুমে থাকার কথা সেখানে কিভাবে সে ড্যাং ড্যাং করে তুর্যের রুমে গিয়ে থাকবে? তাছাড়া তুর্যকে চিনেই বা কয়দিন সে। যতই বিয়ে হোক এভাবে হঠাৎ এক পুরুষের সাথে এক কক্ষে এক সাথে থাকতে যেকোনো মেয়েরই ইতস্তত লাগবে। তার উপর যদি হয় আবার আলাদা রুমে থাকা নিয়ে এত ঘটনা। পৃথা ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো। তুর্যের টানাটানিকে উপেক্ষা করে এক পাও এগুলো না সে। তুর্যের ভ্রুদ্বয় কুঁচকে এলো। তীক্ষ্ম কন্ঠে সে পৃথাকে বলল,
-“তুমি আমার সাথে আমার রুমে যাবে নাকি আমি এবার সত্যি সত্যি কোলে নিবো তোমায়?”
পৃথা শিউরে উঠলো। সে বেশ জানে এই পুরুষ বিদেশ ফেরত নির্লজ্জ। তার কথা অমান্য করলে যখন বলেছে কোলে নিবে তখন সে কথা তুর্য রাখবেই। স্থান কাল পাত্র কোনো কিছুই বিবেচনা করবে না। পৃথা আড়চোখে একবার তাকালো উপস্থিত সবার পানে। এতগুলো মানুষের মধ্যে কোলে নিলে তাকে হয়তো আরও বিশ্রী একটা পরিস্থিতিতে পড়তে হবে। প্রথম দিন শ্বশুর বাড়িতে ঢুকেই মান ইজ্জতের দফা রফা হয়ে যাবে নির্ঘাত। তার থেকে এই মুহূর্তে তুর্যের কথা শোনাই শ্রেয় বলে মনে হলো পৃথার। মেয়েটা তুর্যের পিছু পিছু পা বাড়ালো। তুর্যের ওষ্ঠে বিশ্ব জয়ের হাসি ফুটে উঠলো। সে পৃথার এক হাত বগলদাবা করে তাকালো মায়ের পানে। ওষ্ঠে হাসি বজায় রেখেই বলল,
-“দোয়া করো মা বিশাল এক যুদ্ধ শেষে তোমার ছেলে তার বউকে নিয়ে রুমে যাচ্ছে।”
তাহমিনা বেগম তেতে উঠলেন। তুর্যের পানে তেড়ে গিয়ে বললেন,
-“হ’ত’চ্ছা’ড়া দাঁড়া তুই। এক চড়ে তোর হাসি আমি বের করে দিচ্ছি বেয়াদব।”
মায়ের কথা শুনে তুর্য নিজের পায়ের গতি বাড়ালো। বলা তো যায় না কখন এসে পিছন থেকে তার বউকে টেনে ধরে। ব্যস্ত হয়ে ছেলেটা পৃথাকে নিয়ে কেটে পড়লো। দ্রুত নিজের কক্ষে ঢুকে ঠাস করে দরজাটা আটকে দিল। তাহমিনা বেগম গর্জে উঠলেন আরও। ছেলের সাথে না পেরে তাকালেন স্বামীর পানে। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,
-“দেখলে, দেখলে তোমার কীর্তিকলাপ।”
মোজাম্মেল হক এগিয়ে এলেন স্ত্রীর পানে। তাকে শান্তনা দিয়ে বললেন,
-“আহা রাগ করো না তাহমিনা। অতিরিক্ত রাগ তোমার শরীরের পক্ষে ভালো না। প্রেসার ফল করতে পারে।”
তাহমিনা বেগম অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালেন স্বামীর পানে। দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
-“এই তোমার লাই পেয়ে পেয়েই ছেলেটা এমন বখে গেছে। যেমন বাপ তেমন তার ছেলে।”
মোজাম্মেল হক মনে মনে ভেংচি কাটলেন। চিৎকার করে বলতে চাইলেন,
-“ওখানে যেমন বাপ তেমন তার ছেলে হবে না, হবে যেমন মা তেমন তার ছেলে। এই ছেলে মোটেও আমার মতো হয়নি হয়েছে একদম তোমার মতো। যেন মায়ের কার্বন কপি।”
মনে মনে এত কথা বললেও মুখে কিছুই বলতে পারলেন না মোজাম্মেল হক। পুরুষ মানুষ বাইরে যতই বাঘ হোক না কেন স্ত্রীর সম্মুখে তারা সর্বদাই বিড়াল। মোজাম্মেল হকও তার ব্যতিক্রম নয়। বাইরে কত বড় ব্যবসা সামলায়, বড় বড় জনমানবের সাথে ওঠা বসা তার অথচ বাড়িতে বউয়ের সম্মুখে কন্ঠে কথা বের হতে চায় না। তার উপর এখন তার বউ যে পরিমাণ রেগে আছে তাতে কিছু বললে ছেলেকে রেখে তাকেই গরম তেলে ভাজা ভাজা শুরু করবে। মোজাম্মেল হক মনের কথা মনেই চেপে রাখলেন। ব্যস্ত হলেন স্ত্রীকে শান্ত করতে।
২৮.
কক্ষে ঢুকেই হাঁপাতে লাগলো তুর্য। যেন কত বড় লড়াই করে ফিরেছে সে। কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে নিজেকে ঠিক করলো ছেলেটা অতঃপর স্বাভাবিক কন্ঠেই পৃথাকে বলল,
-“যাও ফ্রেশ হয়ে এসো তাড়াতাড়ি।”
পৃথা শুনলো তুর্যের কথা কিন্তু গেল না সে ফ্রেশ হতে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উসখুস করছে মেয়েটা। তখন পরিবারের উপরে অভিমান করে এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল পৃথা। মোবাইলটা পর্যন্ত আনা হয়নি। এই শাড়ি ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে একটু কোমল পোশাক তো তারও পড়তে ইচ্ছে করছে। কিন্তু শাড়ি ছেড়ে পড়বে কি? কিছুই তো আনা হয়নি। মুখ ফুটে তুর্যকেও বলতে পারছে না কিছু। লোকটা আবার কি না মনে করে তাছাড়া এখনও অব্দি ততটাও তো তুর্যের সাথে ফ্রী নয় সে। সাধারণ কিছু বলতে গেলেও অস্বস্তি লাগে। পৃথাকে ফ্রেশ হতে যেতে না দেখে তার পানে তাকালো তুর্য। হয়তো বুঝলো মেয়েটার উসখুসের মানে। তুর্য পকেট থেকে মোবাইল বের করলো। কাউকে কল করে শুধুমাত্র বলল,
-“লাগেজগুলো রুমে দিয়ে যা।”
ক্ষানিক সময় অতিবাহিত হতেই বন্ধ দরজায় টোকা পড়লো। তুর্য দরজাটা খুলে দিতেই আরুশ দুটো বড় বড় লাগেজ নিয়ে ঢুকলো ভিতরে। লাগেজ দুটো দিয়েই নিঃশব্দে আবার বেরিয়ে গেল। তুর্য একটা লাগেজ এগিয়ে দিল পৃথার পানে। ঠান্ডা কন্ঠে বলল,
-“এখানে তোমার জামা কাপড় পেয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও।”
পৃথা অবাক হলো। এই লোক তার জামা কাপড় কখন আনলো? আর তুর্য জামা কাপড় চাইলেই যে তার পরিবার লাগেজ ভরে দিয়ে দিবে তেমনটাও তো নয়। পৃথা অবাক হয়েই খুললো লাগেজটা। সাথে সাথেই চমকে উঠলো। এগুলো তার আগের কোনো জামা কাপড় নয় সব নতুন। শাড়ি, থ্রী পিস, প্লাজো, টিশার্টে ভরপুর লাগেজটা। পৃথা বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালো তুর্যের পানে। কন্ঠে অবকতার রেশ নিয়েই বলল,
-“এসব আপনি কোথায় পেলেন?”
তুর্য হাসলো। মোহনীয় কন্ঠে বলল,
-“তোমার জন্য কিনেছি।”
পৃথা কিছু বলার ভাষা পেল না। কেমন যেন ভালো লাগলো তার বিষয়টা। এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো তুর্যের পানে। তুর্য দুষ্ট হাসলো। পৃথার পানে একটু এগিয়ে বলল,
-“তোমারই বর, সারাদিন রাত দেখতে পারবে আপাতত ফ্রেশ হয়ে এসো।”
পৃথা লজ্জা পেল। ঝট করে মাথাটা নুইয়ে ফেললো সে। লাগেজ থেকে একটা থ্রী পিস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ঢুকে গেল ওয়াশ রুমে।
ক্ষানিক সময় নিয়ে একদম গোসল সেড়ে বেড়িয়ে এলো পৃথা। তুর্যও ততক্ষণে বাড়ির অন্য ওয়াশ রুম থেকে গোসল টোসল সেড়ে খাবার নিয়ে আবার নিজের কক্ষে ফিরে এলো। দরজা খুলে ভিতরে ঢুকতেই থমকে গেল ছেলেটা। এ কি রূপ পৃথার! গোসল সেড়ে মাথায় তোয়ালে পেঁচিয়েছে মেয়েটা, মুখটাও ভীষন স্নিগ্ধ লাগছে। চোখ মুখে এখনও মুক্ত দানার ন্যায় ছিটে ফোটা পানির দেখা মিলছে। তুর্যের কেমন ঘোর লেগে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে একটু ছুঁয়ে দিতে। গোসলের পর কোনো নারীকে এতটা স্নিগ্ধ লাগতে পারে আগে জানা ছিল না তুর্যের। যদি জানা থাকতো তবে ঐ বিদেশের মাটিতে এত বছর সে পড়ে থাকতো না। পড়াশোনা চাঙ্গে তুলে ঠিক ছুটে আসতো বউয়ের কাছে। তুর্যের ঘোরের মধ্যেই তার পানে এগিয়ে এলো পৃথা। ইতস্তত করে বলল,
-“আপনি ফ্রেশ হয়েছেন?”
তুর্যের ঘোর কাটলো। পৃথার পানে এক পলক তাকিয়ে বলল,
-“হুম।”
থামলো তুর্য। একটু এগিয়ে তার হাতে ধরে রাখা খাবারগুলো টেবিলের উপরে রেখে বলল,
-“খেতে এসো তাড়াতাড়ি।”
পৃথার ক্ষিদে পেয়েছিল এমনিও। খাবার দেখে ক্ষিদে যেন আরও বেড়ে গেল। সেই কখন খেয়েছে। তারপর যদিও গাড়িতে তুর্যের জোরাজুরিতে গাড়িতে একটু খেয়েছিল তাও হঠাৎ পরিবার ছেড়ে আসা, নতুন মানুষের সাথে নতুন স্থানে গমন, অপরিচিত স্থান বিভিন্ন চিন্তা ভাবনায় ভালোভাবে খেতে পারেনি। পৃথা দ্বিরুক্তি করলো না। চুপচাপ খেয়ে নিল তুর্যর সাথে।
তবে বিপত্তি বাঁধলো খাওয়া দাওয়া শেষে ঘুমানো নিয়ে। এখন পৃথা ঘুমাবে কোথায়? তুর্যের সাথে ঘুমাবে? কখনও না। একে তো অপরিচিত এক পুরুষের সাথে এক বিছানায় ভাবতেই শরীর শিউরে উঠেছে পৃথার। বুকের মধ্যে হাঁসফাঁস অনুভব হচ্ছে। তার উপর তুর্য তাকে সাত বছর আগে বিয়ের আসরে ত্যাগ করেছিল। ঐ বিয়েটায় যেমন তুর্যের কোনো দোষ ছিল না তেমনি পৃথারও তো দোষ ছিল না তাহলে তাকে কেন শাস্তি পেতে হয়েছিল? মানুষজন কেন তাকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করেছিল? শুধুমাত্র তুর্যের ছেড়ে যাওয়ার জন্য।পৃথা চোখ ঘুরিয়ে দেখলো কক্ষের চারদিকে। বিছানা ছাড়াও সোফা রয়েছে কক্ষে। আচ্ছা এখন সে কি বাংলা সিনেমার মতো ঐ সোফায় ঘুমাবে? আর তুর্য বিছানায়। পৃথার হৃদয় তীব্র বিরোধিতা করলো তার এ ভাবনার। সে কেন সোফায় ঘুমাবে? সোফায় ঘুমালে তুর্য ঘুমাবে। তাহমিনা বেগম তো বলেছিলেন আলাদা কক্ষে থাকার জন্য। আলাদা থাকলে আর এত ঝামেলা হতো না এখন। দুজনেই দুই কক্ষে বিছানায় ঘুমাতে পরতো। পৃথার ভাবনার মধ্যেই তুর্য বেশ আঁটসাট বেঁধে বসলো বিছানায়। সাথে সাথে পৃথা চেঁচিয়ে উঠলো। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,
-“সাবধান বিছানায় আমার পাশে আসার চেষ্টাও করবেন না। সাত বছর আমাকে ছেড়ে ছিলেন না? এখন আরও সাত বছর আমাকে ছেড়ে থাকার প্রস্তুতি নিন।”
চলবে…..
______
গল্প : #__অবাধ্য_পিছুটান
সাদিয়া_শওকত_বাবলি
পর্ব_২৭
( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )
সাথে সাথে পৃথা চেঁচিয়ে উঠলো। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,
-“সাবধান বিছানায় আমার পাশে আসার চেষ্টাও করবেন না। সাত বছর আমাকে ছেড়ে ছিলেন না? এখন আরও সাত বছর আমাকে ছেড়ে থাকার প্রস্তুতি নিন।”
তুর্য যেন আকাশ থেকে মাত্রই টুপ করে পড়লো ধরনীর বুকে। বিস্মিত নয়নে তাকালো তার মুরগির বাচ্চার মতো বউটার দিকে। এসব কি বলছে পৃথা? বিছানায় আসতে পারবে না! আরও সাত বছর বউ ছেড়ে দূরে থাকতে হবে? তুর্যের মাথায় চক্কর দিয়ে উঠলো। পরক্ষনেই সে নিজের হাত উঁচিয়ে হাতের কড়গুলো এক এক করে গুনতে শুরু করলো। এখন যদি তুর্যের বয়স সাতাশ বছর হয় তবে সাত বছর পর কত হবে? এক এক করে গুনলো। আটাশ, ঊনত্রিশ, ত্রিশ, একত্রিশ, বত্রিশ, তেত্রিশ, চৌত্রিশ। তুর্যের চোখ গুলো বড় বড় হলো। সাত বছর পর তার বয়স চৌত্রিশ হবে! তুর্য তাকালো বউয়ের পানে। চোখ বড় বড় রেখেই শুধালো,
-“তুমি কি আমাকে আমার বাচ্চাদের থেকে আব্বা ডাক শোনানোর বদলে দাদা ডাক শোনানোর পরিকল্পনা করছো বউ?”
পৃথা ভরকালো। এ পুরুষ এসব কি বলছে? এখনও অব্দি বিয়েটাই ঠিকভাবে মানা হলো না। এর মধ্যে বাচ্চা কাচ্চা কোথা থেকে এলো? বেলাজ , বেশরম পুরুষ কোথাকার। কতদূর অব্দি চিন্তা করে ফেলেছে ভাবতেই শিউরে উঠলো মেয়েটা। পৃথা কটমট করে তাকালো তুর্যের পানে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-“আপনি বিছানা থেকে উঠুন তাড়াতাড়ি। এখানে আমি একা ঘুমাবো।”
তুর্য বিছানা ছেড়ে উঠলো না। বরং সরু দৃষ্টিতে তাকালো পৃথার পানে। কপাল কুঁচকে শুধালো,
-“তাহলে আমি কোথায় ঘুমাবো?”
পৃথা নিজের ডান হাত উঁচালো। এক আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করলো সোফার পানে। অতঃপর পরিস্কার কন্ঠে বলল,
-“সোফায়।”
তুর্য ডানে বামে মাথা ঝাঁকিয়ে না বুঝালো তৎক্ষণাৎ। জোরালো কন্ঠে বলল,
-“এত যু’দ্ধ বিগ্রহ করে করে বউ এনেছি আলাদা ঘুমানোর জন্য নাকি? আশ্চর্য!”
পৃথা তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালো তুর্যের পানে। শক্ত কন্ঠে বলল,
-“হ্যা আলাদা ঘুমানোর জন্যই এনেছেন। সাত বছর তো খুব ছেড়ে থেকেছিলেন আমাকে। এখন আরও সাত বছর দূরে থাকবেন।”
তুর্য ভ্রু কুঁচকে কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো পৃথার পানে। অতঃপর হুট করেই একটু একটু এগিয়ে গেল মেয়েটার নিকট। মৃদু কন্ঠে বলল,
-“এখনই তো প্রাপ্তবয়স্ক নয় তুমি। তারপর যদি আবার ফিরতাম ঐ সাতবছরের মধ্যে, সামলাতে পারতে তো আমাকে?”
পৃথার ভ্রু দ্বয় কুঁচকে এলো। মেয়েটা কয়েক সেকেন্ড সময় নিল তুর্যের কথার মানেটা বুঝতে। তবে সম্পূর্ণভাবে পৃথার মস্তিষ্কে কথাটা পৌঁছাতেই কান গরম হয়ে উঠলো। বিষ্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকালো সে তুর্যের পানে। ছিঃ কি নির্লজ্জ কথা বার্তা। সামলাতে পারতো মানে কি? পৃথা জ্বলে উঠলো। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,
-“অসভ্য, বেশরম বিছানা থেকে উঠুন আপনি। আমি আপনার সাথে এক বিছানায় ঘুমাবো না, কিছুতেই না। বিয়ের আসরে না হয় ক্রোধের বশে আমাকে ত্যাগ করেছিলেন আমিও তার জন্য আপনাকে মাফ করে দিয়েছি। কিন্তু এর পরবর্তী সাত বছর কি হয়েছিল? কেন একটাবারও আমার খোঁজ খবর নেননি। এর জন্য আমি আপনাকে মাফ করবো না।”
তুর্য অস্থির হলো। ব্যগ্র কন্ঠে বলল,
-“তোমার সাথে আমার জোর করে বিয়ে দেওয়া এবং আমার ক্রোধে বিয়ের আসর ত্যাগ কোনোটাই তোমার অজানা নয়। বিয়ের আসর ত্যাগের এক মাসের মাথাতেই আমি দেশ ছেড়েছিলাম পাড়ি জমিয়েছিলাম ইংল্যান্ডে। কিন্তু সেখানে গিয়েও আমি শান্তি পাইনি। প্রতিটি মুহূর্তে তোমার অবাধ্য পিছুটান আমাকে তাড়া করে বেরিয়েছে। বারবার মনে হয়েছে আমি ভুল করেছি। যতই জোর করে বিয়ে হোক না কেন বিয়েটা তো হয়েছে। আবার তোমার আর আমার বয়সের পার্থক্য ভেবে বার বার পিছিয়ে গিয়েছি। বিশ্বাস করো আমি তোমাকে অনেক ভোলার চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। তোমাকে ভুলতে আমি অন্য মেয়েদের সান্নিধ্যে পর্যন্ত যাওয়ার চেষ্টা করেছি কিন্তু….”
এই টুকু বলেই থামতে হলো তুর্যকে। পৃথা জ্বলে উঠলো। ক্রোধিত কন্ঠে বলল,
-“আমাকে ভোলার জন্য আপনি অন্য মেয়েদের সান্নিধ্যে গিয়েছিলেন? লু’চ্চা ব্যাডা। এতক্ষন তো আপনাকে যাও মাফ করতাম। এখন তো মাফ করার প্রশ্নই ওঠে না। দূর হন আপনি আমার চোখের সম্মুখ থেকে, আমার বিছানা থেকে।”
তুর্য ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল পৃথার কথায়। সে বেশ ভালোই বুঝলো আবেগের বশে ভুল স্থানে ভুল কথার বলে ফেলেছে। এখন কি হবে? বউ যে তার রেখে গেছে ভীষনভাবে। আগে তো শুধুমাত্র বিছানা ছাড়ার কথা বলেছিল। এখন তো চোখের সামনে থেকেও দূর হতে বলছে। তুর্য ব্যস্ত হলো। পৃথাকে ঠান্ডা করতে বলল,
-“কোনো মেয়েদের সান্নিধ্যে যাইনি তো আমি। শুধুমাত্র যাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম।”
পৃথা ঠান্ডা হলো না। বরং দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-“চেষ্টা তো করেছেন।”
থামলো পৃথা। তুর্যের পানে আঙ্গুল তুলে বলল,
-“এই! এই আপনি এখনও বিছানায় কি করছেন? আপনাকে আমার সহ্য হচ্ছে না। বিছানা ছাড়ুন দ্রুত।”
তুর্য নিজের জালে নিজেই ফেঁ’সে’ছে। বেচারার এখন ইচ্ছে করছে নিজের চুলগুলো নিজে টেনে টেনে ছিঁড়তে। কে বলেছিল আবেগের বশে তাকে অন্য মেয়েদের কথা বলতে। ঐটা ছাড়া তো বাকি সব বলতে পারতো তাহলেই হতো। তুর্য ঢোক গিললো। করুন কন্ঠে বলল,
-“তোমাকে ছাড়া আমি কোনো মেয়েদের সান্নিধ্যে যাইনি বউ। ওটা শুধুমাত্র একটু খানি চেষ্টা করেছিলাম। যে চেষ্টায় আমি কখনওই সফল হইনি।”
পৃথা মানলো না তুর্যের কথা। চেঁচিয়ে উঠলো সে। হুমকি দিয়ে বলল,
-“আপনার কোনো কথা আর আমি শুনতে চাইছি না। আপনি বিছানা থেকে উঠবেন নাকি আমি নিজে রুম থেকে বেরিয়ে যাব?”
কথাটা বলেই পৃথা রেগেমেগে উঠে দাঁড়ালো বিছানা থেকে। পা বাড়ালো দরজার দিকে। তুর্য ভরকালো। তড়িঘড়ি করে সে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো। ব্যস্ত হয়ে বলল,
-“আমি উঠছি তো বিছানা ছেড়ে। সোফায় যাচ্ছি আমি তবুও তুমি বাইরে যেও না।”
পৃথা থমকে দাঁড়ালো। তুর্যের পানে একবার ধারালো দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বিছানায় বসলো আবার। তুর্য স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেললো এবারের মতো। যাক বউ তো তবুও বাইরে যায়নি রুমেই আছে। বাইরে গেলেই আবার আরেক ঝামেলা বাঁধতো। এমনিই তাদের আলাদা করার জন্য ঘষেটি বেগমের বংশধর তাহমিনা বেগম ওত পেতে রয়েছেন। তার উপর যদি শুনতেন পৃথাও তার সাথে থাকতে চায় না তাহলে তো হয়েছেই। সাত বছরে আর সত্যি সত্যি বউয়ের মুখ দেখা লাগতো না। বাচ্চা কাচ্চা তো বহুদূরের ব্যাপার। এখন তবুও এক রুমে আছে দু’জন। আসবে যাবে দেখা হবে দুজন দুজনের সাথে। আর পৃথার রাগ! ওটাও খুব দ্রুতই ভেঙে গুঁড়িয়ে দিবে তুর্য। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই তুর্য তাকালো বউয়ের পানে। মেয়েটা ইতমধ্যে শুয়েও পড়েছে। হতাশ হলো তুর্য। কি নিষ্ঠুর বউ তার। তাকে সোফায় ঘুমাতে দিয়ে বিছানা দখল করে কি আরামে শুয়ে পড়েছে। এর মনে কি একটুও দয়া মায়া নেই?
তুর্য অসহায় ভঙ্গিতে এগিয়ে গেলো সোফার পানে। কোনো রকমে আঁটসাঁট বেঁধে শুয়ে পড়লো সোফায়। কিন্তু বউ থাকতেও এভাবে কি একা শোয়া যায়? মন যে মানতে চায় না। তুর্যের মনের মধ্যেও আনচান আনচান শুরু করছে। মুরগির বাচ্চার মতো বউটার সান্নিধ্য পেতে ইচ্ছে করছে ভীষন। ক্রমেই অধৈর্য্য হয়ে উঠছে মন মস্তিষ্ক। তবুও ছেলেটা নিজেকে দমিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা চালালো। অনেকটা পথ জার্নি করে এসেছে। এখন তার একটু ঘুমের প্রয়োজন। কিন্তু বেশ কিছুটা সময় অতিবাহিত হলেও ঘুম আর ধরা দিল না তুর্যের চোখে। শরীর ক্লান্ত, চোখেও ঘুম আছে কিন্তু হৃদয়ের অস্থিরতা ঘুমাতে দিচ্ছে না। বউয়ের সান্নিধ্য না পেলে এই অস্থিরতা কাটবে বলেও মনে হয় না। তুর্য সোফা থেকে মাথা উঁচিয়ে তাকালো বিছানার পানে। মৃদু কন্ঠে ডাকলো,
-“বউ! ও বউ!”
পৃথা কোনো সাড়া দিল না। হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে মেয়েটা। তুর্য একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে নিল। আগের তুলনায় গলা উঁচিয়ে কন্ঠে সুর তুলে ডাকলো,
-“বউ গোওওও, ওওওও বউ।”
কেবলই চোখ দুটো লেগে এসেছিল পৃথার। এর মধ্যেই আবার এর এমন স্বরে ডাকাডাকি। প্রথমবার গান শুনে কোনো সাড়া শব্দ না দিলেও। এবার আর চুপ থাকতে পারলো না মেয়েটা। বিরক্তিভরা কন্ঠে বলল,
-“কি হয়েছে। এমন ছাগলের মতো সুর তুলেছেন কেন?”
পৃথা অপমান করলেও সে অপমান বিন্দু পরিমাণ গায়ে লাগলো না তুর্যের। বউয়ের অপমান গায়ে লাগালে বাচ্চা কাচ্চা আর পয়দা হওয়ার সুযোগ পাবে না। তুর্য ভেংচি কাটলো। ঠোঁট উল্টে দিয়ে বলল,
-“এই টুকু ছোট সোফায় আমার এত বড় শরীরটা আটাচ্ছে না বউ।”
থামলো তুর্য পরপর নিজের পয়ের দিকে ইশারা করে বলল,
-“পা দুটো বাইরে পড়ে আছে দেখো।”
পৃথা বিছানায় উঠে বসলো। কপালে ভাঁজ ফেলে তাকালো তুর্যের পানে। ভারী কন্ঠে বলল,
-“তো আমি কি করবো?”
গলা খাঁকারি দিল তুর্য। আমতা আমতা করে বলল,
-“আমাকে একটু বিছানায় নাও না।”
-“না”
পৃথার কাঠ কাঠ কন্ঠস্বর। তবে হাল ছাড়লো না তুর্য। মলিন কন্ঠে বলল,
-“সারাটা রাত কতটা পথ জার্নি করে এসেছি। শরীরটাও ক্লান্ত লাগছে ভীষন। এখন যদি একটু ঠিকভাবে ঘুমাতেও না পারি। যাক কি আর করার বউ যখন বিছানায় স্থান দিবে না বাধ্য হয়ে এখানেই থাকতে হবে।”
পৃথা এবার পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো তুর্যের পানে। মায়া হলো মেয়েটার। যত যাই হোক না কেন এটা তুর্যের রুম। সেখানে তুর্য ঠিকভাবে ঘুমাতে পারবে না আর পৃথা আরামে ঘুমাবে। বিষয়টা মোটেই ভালো দেখায় না। যদিও পৃথার বেশ ইতস্তত লাগছে এভাবে এক বিছানায় তুর্যের সাথে ঘুমাতে। কিন্তু উপায় তো নেই। এখন বাইরে গিয়ে আলাদা থাকার কথাও বলা যাচ্ছে না। নতুন বউ সে। লাজ লজ্জারও তো একটা ব্যাপার আছে। চাইলেই কি শ্বশুর শাশুড়ির কাছে গিয়ে বলা যায়,
-“আমি আলাদা ঘুমাবো।”
তারাও বা কি ভাববে। তাছাড়া তুর্য তার স্বামী। যতই মান অভিমান থাকুক না কেন সারাজীবন তো আর আলাদা থাকতে পারবে না। এক সাথে একদিন না একদিন থাকতেই হবে তা এখন হোক আর তখন। ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো পৃথা অতঃপর বলল,
-“বিছানায় আসুন।”
তুর্যের ওষ্ঠ প্রসারিত করে হাসলো। যাক তার পরিকল্পনা কাজে দিয়েছে। বউ তাকে বিছানায় ডেকেছে এর থেকে শান্তি আর আছে নাকি? তুর্য আনন্দে গদগদ হয়ে বিছানায় গেল। সাথে সাথেই পৃথা একটা কোলবালিশ ফেলে দিল বিছানার মধ্য বরাবর। তুর্যের পানে তাকিয়ে কাঠ কাঠ কন্ঠে বলল,
-“আপনি এই কোলবালিশের ওপাশে ঘুমাবেন আর আমি এপাশে। ভুলেও এই কোলবালিশ সরিয়ে এপাশে আসার চেষ্টা করবেন না। মনে করবেন এটা ভারত চীনের বর্ডার।”
তুর্যের মুখ খানা চুপসে গেল। কত আশা নিয়ে সে বিছানায় এসেছিল আর শেষে কি হলো। তাদের মধ্য বরাবর আগাছা হয়ে উদয় হলো এই কোলবালিশের। তুর্য হতাশ দৃষ্টিতে তাকালো পৃথার পানে। অসহায় কন্ঠে বলল,
-“এর নাম ভারত চীন বর্ডার না রেখে ভারত বাংলাদেশ বর্ডার রাখা যায় না বউ? ভারত বাংলাদেশ বর্ডার হলে মাঝে মধ্যে তাও দুই চার পয়সা ঘুস দিয়েও বর্ডার পেরুনোর সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু ভারত চীন বর্ডারে নো নো চান্স। সোজা গু’লি করে খুলি উড়িয়ে দিবে।”
চলবে…..