অবাধ্য পিছুটান পর্ব-৩৪+৩৫

0
205

গল্প : #___অবাধ্য_পিছুটান
সাদিয়া_শওকত_বাবলি
পর্ব_৩৪

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

সাথে সাথেই আরেকজন বলল,

-“আরুশ শেখ তার ক্যারিয়ারের চতুর্থ এনকাউন্টারটা করে ফেলেছে আজ এখানে।”

আরুশ শেখ! চমকালো পৃথা এবং ইরা। নামটা সাথে সাথেই হানা দিল তাদের মস্তিষ্কে। গোল গোল চোখে তাকালো একে অপরের পানে। কিন্তু পরক্ষনেই দুজনই হেসে উঠলো হো হো করে। কি সব আজগুবি চিন্তা ভাবনা করছে তারা! তারা যে আরুশকে চিনে সে আর এন’কাউ’ন্টার অবিশ্বাস্য ব্যাপার। তুর্যের একটা ধমক খেয়ে প্যান্টে মু’তে দেওয়ার মতো অবস্থা হয় আরুশের আর সে কিনা করবে এন’কা’উ’ন্টার। মনে মনেই নিজেদের ভাবনাকে ধীক্কার জানালো দুজন। পৃথা হাসি থামিয়ে উঁকি ঝুঁকি মে’রে দেখতে চাইলো এন’কাউ’ন্টার হওয়া স্থানটাকে। তবে জনমানবের অতিরিক্ত ভীরে এখান থেকে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। পৃথা তাকালো ইরার পানে অতঃপর বলল,

-“চলো আমরাও ওখানে গিয়ে দেখে আসি। আমি আগে কখনও এত বড় অপ’রা’ধীও দেখিনি আর এন’কাউ’ন্টার হতেও দেখিনি।”

ইরা উৎসুক হলো। কৌতুহলী হয়ে বলল,

-“আমিও বাস্তবে দেখিনি কখনও। ঐ টিভিতে নাটক সিনেমায় একটু আধটু যা দেখেছি শুধু। নিশ্চই এই এন’কাউ’ন্টার করা অফিসারগুলো সুদর্শন হবে ভীষণ।”

ননদ ভাবী দুইজনই উৎসুক হয়ে পড়লো এন’কাউ’ন্টার, লাশ এবং অফিসারদের দেখার জন্য। নিজেদের মধ্যাকার কথপকথনের সমাপ্তি ঘটিয়ে তারা পা বাড়ালো সম্মুখের দিকে। কিন্তু এন’কাউ’ন্টারে’র ঘটনাস্থল পর্যন্ত আর যাওয়া হলো না তাদের। দু কদম এগুতেই হুট করে একটা কালো রঙের তেল চকচকে গাড়ি এসে ব্রেক কষলো সম্মুখে। হকচকিয়ে উঠলো পৃথা এবং ইরা। কিন্তু পরক্ষনেই নিজেদের সামলে নিল দু’জন। গাড়িটা কেমন পরিচিত পরিচিত মনে হচ্ছে। একটু এগিয়ে গাড়ির কাছে যেতেই গাড়ির পিছনের দরজাটা খুলে গেল। ভিতর থেকে দৃশ্যমান হলো তুর্যের মুখ খানা। পৃথার মেজাজ চটে গেল। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,

-“এভাবে কেউ গাড়ির ব্রেক কষে? আর একটু হলেই একটা দূর্ঘটনা ঘটে যেতে পারতো।”

তুর্য পাত্তা দিল না পৃথার কথায়। থমথমে কন্ঠে বলল,

-“বাড়ির গাড়ি আসবে না আজ। ড্রাইভার চাচার কি যেন কাজ আছে। তাই আমিই নিতে এসেছি। গাড়িতে উঠে এসো তোমরা।‌ ”

তুর্যের আদেশ মোতাবেক ইরা গাড়িতে উঠতে নিলেও পৃথা হাত টেনে থামিয়ে দিল তাকে। তুর্যের আদেশকে উপেক্ষা করে বলল,

-“আমরা এখন বাড়িতে যাব না। আপনি আমাদের জন্য একটু অপেক্ষা করলে করুন নয়তো চলে যান। আমি আর ইরা একটু পর ফিরবো।”

তুর্য ভ্রু কুঁচকালো। কপালে ভাঁজ ফেলে প্রশ্ন করলো,

-“বাড়ি যাবে না কেন? এখানে তোমাদের কাজ কি এখন?”

ইরা নিজের জ্বীহ্বা দ্বারা ওষ্ঠ ভেজালো। ইতস্তত করে বলল,

-“ওখানে নাকি এন’কাউ’ন্টার হয়েছে ভাইয়া। আমরা আসলে কখনও এত বড় দাগী অ’পরা’ধী কিংবা এন’কাউ’ন্টার অফিসারকে বাস্তবে দেখিনি তো তাই তাদের দেখতে চাইছিলাম একটু আর কি।”

তুর্যের দৃষ্টি তীক্ষ্ম হলো। থমথমে কন্ঠে প্রশ্ন করলো,

-“তাদের দেখে তোদের কি লাভ?”

আমতা আমতা শুরু করলো ইরা। ঢোক গিলে বলল,

-“না মানে দেখতে চাইছিলাম তারা ঠিক কি রকম, কেমন।”

তুর্য কপালে ভাঁজ ফেললো। গম্ভীর কন্ঠে বলল,

-“কি রকম, কেমন মানে কি? তাদের মানুষ মনে হয় না তোদের কাছে?”

ইরা অপ্রস্তুত হলো। জোরপূর্বক হেসে বলল,

-“না মানে…”

এই টুকু বলতেই তাকে থামিয়ে দিল পৃথা। তুর্যের পানে এক রাশ বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে বলল,

-“এত প্যাঁচাচ্ছেন কেন? এতক্ষনে ওখানে গিয়ে সবকিছু দেখে চলেও আসতাম।”

থামলো পৃথা। ইরার পানে তাকিয়ে বলল,

-“চলো তো। তাড়াতাড়ি দেখে চলে আসি আবার।”

বাক্যটা শেষ করেই ইরার হাত ধরে পৃথা আবারও পা বাড়ালো সম্মুখ পানে। অমনি তাদের ধমকে উঠলো তুর্য। ভর্ৎসনা করে বলল,

-“এন’কাউ’ন্টার করে অফিসাররা তোমাদের জন্য এখনও লা’শ নিয়ে সেখানে বসে আছে বুঝি? তাদের তো আর কোনো কাজ কর্ম নেই তাই না?”

পৃথা আর ইরা একটু চমকালো, তাকালো আশে পাশে। সত্যিই জনমানবের সমাগম আগের থেকে কমতে শুরু করেছে। ঘটনা স্থানের দিকে তেমন মানুষ নেই। তাহলে কি সত্যিই এন’কাউ’ন্টার অফিসাররা চলে গিয়েছে? হতাশ হলো দুই ননদ ভাবী। তাদের আর দাগী অপ’রা’ধী এবং সুদর্শন অফিসারদের দেখা হলো না। পৃথার তবুও মন মানলো না। বিষয়টাতে পুরোপুরি নিশ্চিত হতে আরেকবার তুর্যকে জিজ্ঞেস করল,

-“তারা সত্যিই লা’শ নিয়ে চলে গেছে?”

-“হুম, আমরা যখন এখানে এসেছি তখনই দেখেছি নিয়ে চলে যেতে।”

থামলো তুর্য। সম্মুখের ড্রাইভিং সিটে বসা আরুশের পানে তাকালো সে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

-“এরপরও যদি তোমাদের খুব বেশি এন’কাউ’ন্টার দেখার শখ হয় তাহলে আমাকে বলতে পারো। সামনে বসা যে ঐ আরুশ নামক একটা বল’দ দেখছো ওটাকে এখানে এই মুহূর্তে এন’কাউ’ন্টার করে দেখিয়ে দেই তোমাদের।”

আরুশ ফাঁকা ঢোক গিললো পরপর। আজ তুর্য তার কি করবে কে জানে। পৃথা আর ইরাও উঁকি দিয়ে তাকালো গাড়ির সম্মুখ পানে। এতক্ষন গাড়ির পিছনের অংশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তুর্যের সাথে বাক্যালাপের দরুন সামনে বসা আরুশকে খেয়ালই করেনি তারা। দুজনের দিকে তাকাতে তাকাতে ইরা হুট করেই ভ্রু কুঁচকালো। প্রশ্ন করলো,

-“একি ভাইয়া! আজ তোমরা দুজনেই একদম একই রং, একই ধরনের শার্ট পড়েছো যে?”

তুর্য কটমট করে তাকালো আরুশের পানে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

-“আমার শ্রা’দ্ধ করতে।”

পৃথা আর ইরা বার কথা বাড়ালো না। এই বান্দা যে কখনও কোনো প্রশ্নের ঠিক ঠাক উত্তর দিবে না তা তাদের জানা। তার উপর এখানে এই দুপুরের চড়া রোদে দাড়িয়ে থেকেও তো আর লাভ নেই কোনো। তাই দুজনেই চুপচাপ উঠে বসলো গাড়িতে। আরুশও দেরী করলো না। পৃথা এবং ইরা উঠে বসতেই গাড়ি চালনা শুরু করলো।

৩৮.
দুপুরের তপ্ত রৌদ্র। সূর্যটা খাঁ খাঁ করে প্রাকৃতিতে তার দাপট দেখাচ্ছে। চারদিক নীরব নিস্তব্ধতায় ঘেরা। আশেপাশে বাড়িঘর নেই কোনো। এই নীরব নিস্তব্ধ স্থানে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রয়েছে দুই পুরুষ, তুর্য এবং আরুশ। তুর্য বাঘের ন্যায় ধারালো দৃষ্টি নিক্ষেপ করে রয়েছে আরুশের পানে। আর বেচারা আরুশ কাঁচুমাচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার সম্মুখেই। বেশ কিছুটা সময় অতিবাহিত হলো দুজনের নীরবতাতেই। অতঃপর হুট করেই তুর্য বাজখাঁই কন্ঠে চেঁচিয়ে বলল,

-“তুই এন’কা’উন্টা’রটা করলি কেন বেয়াদব? এটা কোনো এন’কা’উন্টা’র করার সময় ছিল?”

আরুশ কেঁপে উঠলো তুর্যের ধমকে। এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে বলল,

-“একটু রাগ উঠে গিয়েছিল স্যার।”

তুর্য চোখ বড় বড় করে তাকালো আরুশের পানে। তেড়ে গিয়ে বলল,

-“একটু রাগ উঠেছে বলে তুই সোজা এন’কাউ’ন্টার করে দিবি? ওকে কতবার বলেছি নিজের রাগ সামলাতে।”

আরুশ মনে মনে ভেংচি কাটলো। তুর্যের সম্মুখে জোরে কিছু বলার সাহস না থাকলেও বিরবিরিয়ে বলল,

-“নিজের রাগ নিজে সমলাতে পারে না অথচ আমাকে বলছে রাগ সামলাতে। আপনারই তো চ্যালা তাই রাগটাও আপনার মতোই হবে। এতে আমার দোষ কি?”

আরুশের কপাল ভালো তুর্য শুনল না তার নিচু কন্ঠের কথাগুলো। সে নিজের ক্রোধ ধরে রেখেই আবার বলল,

-“তোকে আমি কতবার বলেছি রাগ উঠলেও সামলে রাখবি। এমনি শাহীন মির্জাকে নিয়ে ঝামেলায় আছি তার মধ্যে আবার রতন বাবুকে উড়িয়ে দিলি। বুঝতে পারছিস কতটা ভুগতে হবে এটা নিয়ে?”

আরুশ সময় নিল একটু। ঢোক গিলে বলল,

-“কিন্তু রতন বাবুর এন’কাউন্টা’রের অর্ডার তো স্যার আগে থেকেই ছিল আমাদের উপরে।”

তুর্য তেতে উঠলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

-“আদেশ থাকলেই এন’কাউ’ন্টার করতে হবে? শাহীন মির্জার লোকেরা আমাদের উপর ক্ষেপে আছে এমনিই। এখন রতন বাবুর লোকেরাও পিছনে লাগবে। এদিকে অপারেশনটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া রতন বাবুর থেকে এই কে’স সম্পর্কে কিছু তথ্য পাওয়া গেলেও যেতে পারতো। কিন্তু তুই কি করলি একদম এন’কাউন্টা’র করে রতন বাবুর মুখটাই বন্ধ করে দিলি।”

আরুশের ভিতরে কিঞ্চিৎ অনুতাপবোধ জাগলো। বুঝলো ক্রোধের বশে সে ভুল করে ফেলেছে একটা। কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বলল,

-“স্যরি স্যার, আমি বুঝতে পারিনি।”

তুর্য চোখ বন্ধ করে নিল। জোরে জোরে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে নিজের ক্রোধ দমনের ব্যর্থ চেষ্টা চালালো। অতঃপর চোখ খুলে বলল,

-“তোর মাথার উপর আগে থেকেই তিনটা এন’কাউ’ন্টার ঝুলছে আরুশ? সব দাগী আ’সা’মি’দে’র। তাদের চ্যালারা তোর নাগাল পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে তার মধ্যে তুই আবার আরেকটা এন’কাউ’ন্টার সেড়ে ফেলেছিস।”

আরুশ সাথে সাথেই জবাব দিল,

-“চারটা এন’কাউ’ন্টারে’র সব তো আমি করিনি স্যার। দুটো আমি করেছি, দুটো আপনি।”

-“তা আমি জানি, তুই জানিস আর কতৃপক্ষ জানে বাহিরের কেউ জানে না। তাই তাদের নজরটা শুধুমাত্র অফিসার আরুশ শেখের উপরে আমার উপরে নয়।”

থামলো তুর্য। আরুশের পানে আবার তেড়ে গিয়ে বলল,

-“তাছাড়া ওখানে পৃথা আর ইরার কলেজ ছিল। ওরা একবার ঘটনাস্থলে পৌছালে কি হতো জানিস তুই?”

আরুশ তুর্যের থেকে একটু দূরে সরে গেল। নিরাপত্তা দূরত্বে দাঁড়িয়ে বলল,

-“আপনার সাথে সাথে আমিও বউ হারাতাম স্যার। এর বেশি আর কি হতো?”

কটমট করলো তুর্য। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

-“এক থাপ্পরে তোর দাঁত কপাটি ফেলে দেব মীর জাফরের বংশধর। আবার বড় বড় কথা বলছিস।”

আরুশ দাঁত কেলিয়ে হাসলো। নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,

-“আপনার বোনকে আগে বিয়েটা করি তারপর এক থাপ্পরে না পারলে পাঁচ থাপ্পরে দাঁত সব ফেলে দিয়েন স্যার। এখন দাঁত ফেলে দিলে আপনার বোনও আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে। আর তার থেকেও বড় কথা হলো আমার বিয়েতে বরযাত্রী নিয়ে তখন আপনাদের বাড়িতে যাব তখন ঐ বড় বড় গরু, ছাগল, মুরগির পিছগুলো চিবিয়ে চিবিয়ে খেতে হবে না? দাঁত না থাকলে খাবো কি দিয়ে?”

-“আমার বোনকে তোর মতো একটা গর্দভের সাথে কখনও বিয়ে দেব না।”

আরুশের চোখে মুখে বিষন্ন ভাব নেমে এলো। কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,

-“আপনি আমার সাথে এমনটা করতে পারেন না স্যার। ট্রেনিং এর সময় আপনি আমাকে কথা দিয়েছিলেন যে আমি যদি আপনার এসিস্ট্যান্ট পদের যোগ্যতা অর্জন করি তবে আমার সাথে আপনার বোনকে বিয়ে দিবেন। যদিও এতদিন এ বিষয়ে আমার তেমন আগ্রহ ছিল না।”

কথাটা বলে থামলো আরুশ। লাজুক হেসে আবার বলল,

-“কিন্তু এখন আপনার বোনকে দেখার পর থে আমার হৃদয়ের ঘন্টি বেজে গিয়েছে, উথাল পাথাল ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়েছে। এখন আর তাকে ছাড়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”

তুর্য ক্রোধে দিশেহারা হলো। হিসহিসিয়ে বলল,

-“আর একটা আজে বাজে কথা বললে আমি তোর এন’কাউ’ন্টার করে দেব বেয়াদব।”

আরুশ পাত্তা দিল না তুর্যের কথায়। স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই বলল,

-“আমার সাথে সাথে আপনার বোনের এন’কাউ’ন্টারও করে দিয়েন স্যার। দুজন মিলে একসাথে উপরে গিয়ে হানিমুনে যাব ভাবছি।”

তুর্য এবার আর নিজের ক্রোধ দমন করতে পারলো না। ছেলেটার ইদানীং সাহস বেড়ে গেছে ব্যাপক। যদিও এর সাহস বরাবরই ছিল শুধুমাত্র জনসম্মুখে ভেজা বিড়াল। তলে তলে কেউ কারো থেকে কম যায় না। তুর্য হুট করেই চোখের পলকের মধ্যে নিজের শার্টের আড়ালে প্যান্টের ভিতরে গোজা ব’ন্দুক’টা বের করে হাতে নিল। আরুশের কপালের ঠিক মাঝ বরাবর বন্দু’কে’র নলটা ঠেকিয়ে বলল,

-“এখনই উপরে পাঠিয়ে দেই তাহলে।”

আরুশের চোখে মুখে বিচলিত ভাব দেখা গেল না মোটেই। তুর্যের কথা শেষ হতে না হতেই ঝড়ের গতিতে নিজের পা উঁচিয়ে গোড়ালিতে মোজার মধ্যে গাথা নিজের বন্দুকটাও বের করে আনলো সে। তুর্যের কপালে ঠেকিয়ে বলল,

-“আমি ম’র’লে আপনাকেও ম’র’তে হবে স্যার। আপনি আমাকে গু’লি করার পর ঠিক যে কয় সেকেন্ড আমার দেহে প্রাণ থাকবে ঐ কয় সেকেন্ড আপনিও শেষ।”

থামলো আরুশ। বাঁকা হেসে বলল,

-“আমি একা ম’রা’য় বিশ্বাসী নই স্যার। নিজের হত্যাকারীকে নিজ হাতে মে’রে তারপর ম’রা’য় বিশ্বাসী।”

চলবে…..

গল্প : #___অবাধ্য_পিছুটান
সাদিয়া_শওকত_বাবলি
পর্ব_৩৫

( অনুমতি ব্যতীত কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ )

থামলো আরুশ। বাঁকা হেসে বলল,

-“আমি একা ম’রা’য় বিশ্বাসী নই স্যার। নিজের হত্যাকারীকে নিজ হাতে মে’রে তারপর ম’রা’য় বিশ্বাসী।”

তুর্য আরুশের কপাল থেকে বন্দুক সরিয়ে নিল। ফিচেল হেসে বলল,

-“আ’ম ইমপ্রেসড।”

থামলো তুর্য। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

-“আজ শুধুমাত্র এই কথাটার জন্য বেঁচে গেলি তুই নয়তো এই মুহূর্তে তোর পা*ছা*য় লাথি মেরে অপারেশন থেকে বের করে দিতাম বেয়াদব।”

আরুশও তুর্যের কপাল থেকে বন্দুকটা সরিয়ে নিল। বুকে হাত দিয়ে বড় বড় কয়েকটা নিঃশ্বাস নিল। কত সাহস বুকে নিয়ে সে এতক্ষন তুর্যের সম্মুখে দাঁড়িয়ে ছিল তা একমাত্র সেই জানে। এই তুর্য ব্যাটাকে তো বিশ্বাস নেই। এ সত্যি সত্যিই তাকে গুলি করে দিতে পারতো। আরুশের তো এক সেকেন্ডের জন্য মনে হচ্ছিলো এই তার জীবনের অন্তিমক্ষন, তুর্যের বোনকে বোধহয় এই জন্মে আর বিয়ে করা হলো না। তারপর যেভাবেই হোক রতন বাবুকে মে’রে’ও এ যাত্রায় বেঁচে গেল বেচারা। আরুশ কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলো। কন্ঠ কিছুটা স্বাভাবিক করে বলল,

-“আমি যা করে ফেলেছি রাগের মাথায় স্যার। কিন্তু এই অপারেশনটা আমার স্বপ্ন।”

তুর্য তাকালো আরুশের পানে। সে নিজেও জানে এটা আরুশের স্বপ্ন। এই পেশায় আসার পর আরুশের প্রথম বড় কোনো কাজ এটা। তুর্য এবারে বেশ ঠান্ডা কন্ঠেই বলল,

-“স্বপ্ন হলে ধীর গতিতে মাথা খাটিয়ে সেই স্বপ্ন পূরণের পথে পা বাড়াতে হয়। আমরা এখন এমন অবস্থানে নেই যে হুট হাট মাথা গরম করে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেব।”

আরুশ মাথা নিচু করে ফেললো। কাঁচুমাচু হয়ে বলল,

-“স্যরি স্যার।”

-“এসব স্যরি তোর কাছেই রাখ আর ভাবতে থাক এই এন’কাউ’ন্টারের ব্যাপারে নাজিম স্যারকে কি জবাব দিবি।”

আরুশ ঢোক গিললো। ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,

-“এবারের মতো উনার হাত থেকে বাঁচিয়ে নিন স্যার। উনি আমাকে এমনিই সহ্য করতে পারেন না। এরপর যদি এন’কাউ’ন্টারে’র ব্যাপারে শোনে তাহলে সোজা আমারই এন’কাউ’ন্টার করে উপরে পাঠিয়ে দিবে। তারপর আপনার বোন বিয়ের আগেই বিধবা হবে স্যার।”

তুর্য একবার তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালো আরুশের পানে অতঃপর পাশেই তাদের দাঁড় করানো গাড়ির ড্রাইভিং সিটে উঠে বসলো। জানাল থেকে মুখ বাড়িয়ে আরুশকে বলল,

-“তুই এখান থেকে এখন হেঁটে হেঁটে বাড়িতে যাবি নয়তো আমার বোনকেও পাবি না আর উপর মহলের সাথেও তোর এই এন’কাউ’ন্টার নিয়ে কোনো সুপারিশও করতে পারবো না বলে দিলাম।”

আরুশ আঁতকে উঠলো। যে বাড়িতে সে থাকে তার দূরত্ব এখান থেকে কমপক্ষে দুই কিলোমিটার। এই পুরো পথটা হেঁটে যাবে সে? আরুশ ছুটে গেল গাড়ির পানে। ব্যস্ত হয়ে বলল,

-“আমি এতটা পথ কিভাবে হেঁটে যাব? আমার পা ফুলে যাবে। আমার উপর এত বড় জুলুম করবেন না স্যার। আমাকে প্লীজ গাড়িতে নিয়ে নিন। দরকার হয় অর্ধেক পথে গিয়ে নামিয়ে দিবেন।”

তুর্য চোখ ছোট ছোট করে তাকালো আরুশের পানে। ওষ্ঠ বাঁকিয়ে বলল,

-“এতটা পথ কোথায়? মাত্র দুই কিলোমিটার। ট্রেনিং এর সময় রোজ এর থেকেও তো বেশি দৌড়াতি। আর এখন দুই কিলোমিটারে ভয়? মহিলাদের মতো ঢং বাদ দে আরুশ। নয়তো টানা দশ কিলোমিটার দৌড়াতে হবে তোকে। আর হ্যা অবশ্যই হেঁটে হেঁটে আমার বাড়িতে যাবি তোর বাড়িতে না।”

আরুশ আরও কিছু বলবে তার আগেই তুর্য গাড়িতে স্টার্ট দিল। সাঁই সাঁই করে গাড়িটা নিয়ে চললো সম্মুখের দিকে। আরুশ হকচকিয়ে গেল। সময় ব্যয় না করে গাড়ির পিছনে ছুট লাগালো। চিৎকার করে বলল,

-“স্যার আমাকে ফেলে যাবেন না। আমাকে নিয়ে যান।”

তুর্য শুনলো না আরুশের কোনো কথা। গাড়ি থামালো না সে। আরুশের মেজাজ বিগড়ে গেলো। লোকটা সব সময় ওর সাথে এমন করে। বাড়িতে মায়ের সাথেও পারে না, বউয়ের সাথেও পারে না। পারে শুধুমাত্র ওর সাথে। আরুশ ক্রোধে দিশেহারা হলো। ব্যস্ত হয়ে তাকালো আশেপাশে। একটা অর্ধ খন্ড ইটের টুকরা চোখে পড়লো তার। তড়িঘড়ি করে ইটের খন্ডটা হাতে তুলে নিল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

-“আমি তোর বোনকে বিয়ে করবো। তারপর তুই হবি আমার শা’লা, শা’লা। অফিসে তোর চললেও বাড়িতে কার চলে আমিও দেখে ছাড়বো। সব প্রতিশোধ কড়ায় গন্ডায় উসুল করবো।”

কথাটা শেষ হতে না হতেই তুর্য গাড়ি ব্যাকে আনলো। থামালো ঠিক আরুশের পায়ের কাছে। থতমত খেয়ে গেল ছেলেটা। দ্রুত হাতের ইটটা পিছনে লুকিয়ে ফেললো। আমতা আমতা করে বলল,

-“আবার ফিরে এলেন যে! আমি হেঁটে হেঁটে বাড়িতে যাব না?”

তুর্য উত্তর দিল না আরুশের কথার। বরং বেশ আগ্রহ নিয়ে বলল,

-“আমার বোনকে বিয়ে করবি তুই?”

আরুশ নিজের ক্রোধ ভুলে গেল মুহুর্তেই। লাজুক হেসে বলল,

-“জ্বী স্যার।”

তুর্য হাসলো। টেনে টেনে বলল,

-“কিন্তু তোর মতো একটা আহাম্মকের সাথে আমি আমার বোনের বিয়ে দেবোওও না।”

আরুশ চমকালো তবে কিছু বলার আগেই তুর্য গাড়ির চালনা শুরু করলো আবার। মিনিট খানেকের মধ্যে দূরেও চলে গেল। আরুশ নিজের ক্রোধ আর ধরে রাখতে পারলো না। রেগেমেগে হাতের ইটের টুকরাটা ছুঁড়ে মা’র’লো তুর্যের গাড়ির পানে। কিন্তু বেচারা, শক্তি চালিয়ে ইটের টুকরাটা তুর্যের গাড়ি পর্যন্ত নিতে সক্ষম হলো না। অবশ্য এই অসক্ষমতায় লাভ বই লোকসান হয়নি তার। যদি সত্যি সত্যি আরুশের ক্রোধের বশে মা’রা ইটের টুকরা কোনোভাবে তুর্যের গাড়িতে লাগতো তবে আজ ঐ ইটের টুকরা দ্বারা তার শক্তপোক্ত মাথাটাও ফাটতো। আর তারপর হাসপাতাল।

৩৯.
সময় গড়ালো কিছুটা। আরুশকে ফেলে রেখে গাড়ি নিয়ে সোজা বাড়িতে গেল তুর্য। ফুরফুরে মেজাজে নিজ কক্ষে ঢুকতেই থমকে গেল সে। পৃথা কেবলই গোসল সেড়ে বেরিয়েছে। চুলগুলোও ভালোভাবে মোছেনি এখনও। লম্বা চুলের ডগা বেয়ে ঝড়ে পড়া টুপ টাপ পানির বিন্দুগুলো স্থান করে নিচ্ছে মেঝেতে। তুর্যের ঘোর লেগে যাচ্ছে। বুকের ভিতরটা কেমন ধুকপুক ধুকপুক করছে। শিরশির অনুভূতিতে আচ্ছাদিত হচ্ছে সম্পূর্ণ শরীর। তুর্য যেন এক মুহুর্তের জন্য ভুলে গেল তার জীবনের সব জটিলতা, সব বারন। সম্মোহিত ভঙ্গিতে দরজা খোলা রেখেই এগিয়ে গেল পৃথার পানে। হাত বাড়িয়ে আলতোভাবে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো মেয়েটাকে। কেঁপে উঠলো পৃথা। শিউরে উঠলো পুরো শরীর। হৃদস্পন্দন বাড়লো মেয়েটার। নিজেকে তাড়াতাড়ি সরিয়ে নিতে চাইলো তুর্যের বাঁধন থেকে কিন্তু পারলো না। তুর্য আরও শক্ত কন্ঠে নিজের সাথে জড়িয়ে নিল পৃথাকে। মেয়েটার ভেজা চুলে মুখ গুঁজে বলল,

-“আই ব্যাডলি নিড ইয়্যু জান।”

থামলো তুর্য। আবার বলল,

-“সরে যেও না প্লীজ। একটু সময় থাকো আমার কাছে, আমার সাথে মিশে। নিজেকে একটু শান্ত করতে দাও।”

তুর্যের কথায় কি ছিল জানা নেই পৃথার। কিন্তু মেয়েটা সরতে পারলো না তুর্যের থেকে। মস্তিষ্ক সরাতে বললেও হৃদয় বাঁধা দিল। সে তুর্যের এই স্পর্শকেই আপন করে চাইছে। আরও গাঢ় স্পর্শে নিজেকে বিলীন করতে চাইছে। এ কি তবে ভালোবাসা নাকি মায়া? পৃথা কি ধীরে ধীরে তবে তুর্যের মায়ায় বাঁধা পড়ে যাচ্ছে? এর কোনো প্রশ্নেরই উত্তর নেই পৃথার নিকট। সে শুধু এই মুহূর্তে তুর্যকে চাইছে।

তুর্য আলতোভাবে পৃথার ঘাড় থেকে ভেজা চুলগুলো সরিয়ে দিল। অতঃপর একটু ঝুঁকে ঘাড়ে কামড় বসালো একটা। পৃথা শিউরে উঠলো। চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে নিল। তুর্য আর একটু ঘনিষ্ট হলো মেয়েটার সাথে। ঘাড়ে ছোট ছোট চু’মু’তে সিক্ত করে তুললো মেয়েটাকে। পৃথা আর পারলো না নিজেকে ধরে রাখতে। তড়িৎ গতিতে পিছন ফিরে তাকালো তুর্যের পানে। অনূভুতির জোয়ারে ভেসে গিয়ে আছড়ে পড়লো তুর্যের বক্ষে। তুর্য হাসলো, দুই হাত বাড়িয়ে মেয়েটাকে জড়িয়ে নিল নিজের সাথে। ঠিক তখনই খোলা দরজা থেকে কক্ষের ভিতরে প্রবেশ করলো ইরা। সম্মুখ পানে না তাকিয়েই বলল,

-“ভাবী তোমাকে বড় চাচী….”

ব্যস এই টুকুতেই মুখ বন্ধ করতে হলো মেয়েটাকে। সম্মুখ পানে তাকিয়েই ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো সে। কি করতে এসে কি দেখে ফেললো ইরা। হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো মেয়েটা। দুই হাতে জলদি নিজের চোখ চেপে ধরে বলল,

-“আমি কিছু দেখিনি দেখিনি, আমি কিছু দেখিনি।”

পৃথা আর তুর্য চমকালো। মেয়েটা ছিটকে দূরে সরে যেতে চাইলো তুর্যের থেকে কিছু তুর্য যেতে দিল না। বরং আরও শক্ত করে নিজের সাথে জড়িয়ে নিল পৃথাকে। অতঃপর এক রাশ বিরক্তি নিয়ে সে তাকালো ইরার পানে। নাক মুখ কুঁচকে বলল,

-“আমার শান্তি সহ্য হয় না? আমার প্রেমে এলার্জি আছে তোদের? সব আহাম্মকের দল।”

ইরা অপ্রস্তুত হলো। এখানে এসে এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়বে জানলে কোনো দিনই আসতো না। সে তো জানতোই না তুর্য ঘরে ফিরেছে। ইরা আমতা আমতা শুরু করলো। ইতস্তত করে বলল,

-“না মানে বড় চাচী ভাবীকে খাবার খেতে ডাকছিলো তাই।”

তুর্য নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল,

-“তুই যা আমরা আমাদের কাজ শেষ করে আসছি।”

ইরা আর দাঁড়ালো না এক মুহুর্তেই। এক দৌড়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল সে। আর পৃথা! বেচারীর এই মুহূর্তে ইচ্ছে হচ্ছে লজ্জায় মাটির মধ্যে ঢুকে যেতে। কি নির্লজ্জ কথাবার্তা। তাও অন্য মানুষের সম্মুখে। “কাজ শেষ করে আসছি মানে কি?” পৃথার ভাবনার মধ্যেই তুর্য তাকালো তার পানে। আদুরে কন্ঠে বলল,

-“চলো বউ, আমরা আবার প্রথম থেকে শুরু করি।”

পৃথা ভরকে গেল পরক্ষনেই আবার তেতে উঠলো। তুর্যের বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়াতে উদ্যত হয়ে বলল,

-“চুপ করুন অ’স’ভ্য লোক। ছাড়ুন আমাকে।”

তু্র্য নিজের ঠোঁট দুটো গোল করলো। একটু উঁচিয়ে বলল,

-“আগে আঁটসাঁট বেঁধে তোমাকে একটা চু’মু’টা খেতে দাও। তারপর ছেঁড়ে দিচ্ছি।”

পৃথা অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো তুর্যের পানে। ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,

-“একটা মানুষ এতটা নি’র্ল’জ্জ কিভাবে হয়? একটু তো শরম করুন। ইরার সামনে ছিঃ ছিঃ কি ভাবলো ও।”

তুর্য চোখে হাসলো। চোখ মেরে বলল,

-“খোঁজ নিয়ে দেখো তুমি ঠিক যতটা লজ্জা পাচ্ছো না ওরা তোমার এই লজ্জার থেকেও অধিক আমাদের নিয়ে ভেবে ফেলেছে।”

পৃথা অপ্রস্তুত হলো। এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে বলল,

-“ছাড়ুন আমাকে।”

-“আগে একটা চু’মু খেতে দাও তারপর ছাড়ছি।”

চলবে…..