অবাধ্য বাঁধনে পর্ব-২৯+৩০

0
332

#অবাধ্য_বাঁধনে
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ২৯]
____________________
৬৪.
” সব তো ঠিক ঠাক হলো এবার ঈশার বাবা যে তোমার বাবার সাথে কথা বলতে চায় এবার কি করবে তুমি?”

ভারী চিন্তায় পড়লো ঈশান কি করে কি করবে ভেবেও কুল কিনারা খুঁজে পেলো না।তার বাবাকে যদি বিয়ের কথা বলা হয় তবে নিশ্চয়ই তুলকালাম কান্ড বাঁধাবে এই বিয়েতে কিছুতেই সম্মতি দেবেন না তিনি।মায়ের চোখেমুখে চিন্তার ছাপ সেন্টার টেবিলে থাকা পানির গ্লাসটা এক ঢোকে সাবাড় করেলেন তিনি।ক্ষনে ক্ষনে গলদেশের উত্তাল পাতাল সবটাই পরখ করলো ঈশান।তার কপালে চরণ করা দুই আঙুল থামালো কিয়ৎক্ষণের জন্য।

” বাবা এখন কোথায় থাকবেন?”

দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালেন মাহমুদা।বাংলাদেশ সময়ের সাথে সেই দেশের সময়ের মিল থাকবে না স্বাভাবিক।সময়ের হিসেব নিকেশ করে চটপট বললেন,

” এখন তার অফিস শেষ নিশ্চয়ই শাওয়ারে আছে।”

ঈশান মাথা দুলালো ল্যাপটপ বের করে দ্রুত ফোন করলো তার বাবাকে।বুকের ভেতরের হৃদ যন্ত্রটা কেমন লাফাচ্ছে।দ্রিম দ্রিম শব্দে শুকিয়ে এলো ঈশানের গলদেশ।দেশে আসার পর বাবাকে কখনো সে ফোন করেনি জানতে চায়নি মানুষটা কেমন আছে।নিজ স্বার্থে আজ প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করতেই হলো।

মাত্র শাওয়ার ছেড়ে বেরিয়েছেন আবিদ।বারান্দার গাছগুলো দেখছিলেন খুটিয়ে খুটিয়ে।এখানে বেশি গাছ নেই, টবে রাখা তিন চারটে গাছ।এই গাছগুলো মাহমুদার ভীষণ যত্নের,দেশে যাওয়ার আগে বারবার বলে গেছে গাছের যত্ন নিতে।আজকে আকাশটা ভালো নেই চারিদিকে ঘুটঘুটে কালো মেঘ।টব টেনে কক্ষে আনলেন আবিদ।না হয় প্রচন্ড বাতাসে গাছগুলোর বেহাল দশা হবে।হঠাৎ ফোন বেজে উঠতে কিছুটা বিরক্ত হলেন এই সময়ে আবার কে ফোন করলো।স্কিনে ঈশানের নাম্বারটা দেখে অচেনা আতঙ্কে বুকটা ভারী হয়ে এলো।ঈশান কখনো ফোন করবে না তাকে হঠাৎ কি এমন হলো ছেলেটা ফোন করেছে।কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন তুললেন আবিদ।একটু দম ছাড়ার ফুসরত না করে অতি সত্বর বলেন,

” হঠাৎ কেন ফোন করেছো?আমার মাহমুদা ঠিক আছে?প্রেশার কি বেড়েছে?এক্ষুনি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও বাড়িতে বসে থেকো না।”

ঈশান নিশ্চুপ হয়ে শুনলো বাবার বলা প্রতিটা বাক্য।মায়ের প্রতি বাবার এই অস্থিরতা দেখে ভীষণ ভালো লাগলো ঈশানের। আচ্ছা তবে সে কি তার বাবার মতো হয়েছে?এমন অস্থির মানব।

” কি হলো কথা বলছো না কেন?এই মাহমুদা ঠিক আছে।আমি আসছি আস… ”

” রিল্যাক্স এত অস্থির হচ্ছেন কেন?আমাকে কথা বলতে দিন।”

আবিদ থমকালেন।গলা ঝেরে বসলেন কাউচে।কণ্ঠে আনলেন সেই চিরচেনা গম্ভীরতা।

” কেন ফোন করেছো?”

” আপনার ছেলে যে বড় হয়েছে সেদিকে তো আপনার খেয়াল নেই।যাজ্ঞে ছাড়ুন সেসব কথা মূল কথায় আসি,আমি বিয়ে করতে চলেছি মেয়ে দেখা শেষ।”

” বিয়ে করতে চলেছো তো আমায় এখন ফোন করেছো কেন?দাওয়াত করতে?আমায় ছাড়া মেয়ে দেখলে আর এখন….”

” কথাটা শুনুন।”

” কি শুনবো?আমি বাবা হই তোমার।বাবা হয়ে ছেলের বিয়ের খবরটুকু জানি না।”

” জানাতে ফোন করেছি আমি।মেয়ে দেখা শেষ মেয়ের বাবা চায় আপনার সাথে কথা বলতে।”

” এই বিয়ে তো তুমি করতে পারবে না ঈশান।”

” কেন?”

” কারণটা তোমার অজানা নয়।আমি আমার কথার খেলাপ করি না।”

” নিজের ছেলের জীবন ধ্বংস করতে উঠে পড়ে লেগেছেন দেখছি।”

” শুধুই কি আমার ছেলের জীবন ধ্বংস আর কারো না?”

” এসব আমি শুনতে চাই না। ”

” আমি যা বলছি তাই হবে।আমিও দেখবো আমায় ছাড়া তোমার বিয়ে কি করে হয়।”

মাহমুদা চিন্তায় পড়লেন ভয়ে পুনরায় গলা শুকিয়ে এলো তার।বুকের ভেতরটা কেমন করছে।বাবা ছেলের এই মনোমালিন্য কবে থামবে?

“আম্মুকে আর কোনদিন আপনার কাছে ফিরতে দেবো না।যে পুরুষ ঘরকে পর করে তার প্রয়োজন নেই স্ত্রী সন্তানের।”

ঈশানের কথায় ঈশানের বাবা আবিদ শব্দ করে হেসে উঠলেন।বাইরে মৃদু বাতাস শুরু হয়েছে রুমটা প্রচন্ড ঠান্ডায় ঘিরে গেছে।দ্রুত উঠে গিয়ে রুম হিটার অন করলেন তিনি।ঈশানের বড়বড় নিশ্বাসের শব্দ তার কানে আসছে ছেলেটা নিশ্চিয়ই উত্তেজিত হয়ে গেছে।

” তুমি তোমার মাকে আমার কাছে পাঠাবে না এই একই সংলাপ তোমার নানা ভাইয়ো দিয়েছেন।তিনি বিয়ের আগে বলেছেন, তোমার মতো ছেলের সাথে আমি আমার মেয়ের জীবন জুড়ে দিতে পারিনা।আমার মেয়েকে নিয়ে যে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে তোমার পরিবার তা ফিরিয়ে দিচ্ছি। এরপর তোমার নানীর চাপে বিয়েটা হলো, এরপর তার ডায়ালগ ছিল
আবিদ আমার মেয়েকে কোনদিন তোমার কাছে পাঠাবো না, বিয়ে হয়েছে তো কি হয়েছে সব ভেঙে যাবে সময় দাও।আর এখন দেখো পরিস্থিতি সময় কতটা বদলে গেছে।মৃত্যুর আগে তিনি আমার মাথা ছুঁয়ে বলেছেন,তুমি আমার শেষ ভরসার হাত আমার পরিবারকে দেখো। আমি যা বলছি তাই শুনো ঈশান বিয়েটা হচ্ছে না এতদিন যা জেদ দেখানোর দেখিয়েছো এখন সঠিক পথে আসো আর পাগলামি করার সময় নেই।আমি একবার যদি রেগে যাই কি হবে তা ভেবে তুমি কুল পাবে না।”

” নানা ভাই ঠিকই বলতেন আপনি একগুঁয়ে,জেদি,নিজের স্বার্থে সব করতে প্রস্তুত একজন পাষাণ মানব।”

“ভুলে যেও না তোমার নানা ভাই আমাকে এটাও বলেছেন, আবিদ তোমার ছেলে ঈশান একদম তোমার মতো হয়েছে এক কিসিমের।যার রাগ,জেদ,গর্জন, ঈর্ষা সবটা তোমার মতো প্রখর।”

” আমি আপনার ছেলে আশা করি আমার জেদ সম্পর্কে আপনি অবগত।তাই ঝামেলা না পাকিয়ে যা বলছি করুন।”

” আমি তোমার বাবা তুমিও আমার সম্পর্কে জানো তাই এসব চিন্তা মাথা থেকে সরাও।”

বাবা ছেলের তর্কে দিশাহীন হয়ে উঠলেন মাহমুদা।ঈশান বড়বড় শ্বাস ছাড়লো।এই বিয়ে করা তার দশ মিনিটের কাজ কিন্তু ঝামেলা বাঁধিয়ে কোন সম্পর্ক শুরু করতে চায় না ঈশান।সবচেয়ে বড় কথা বাবা ছেলের এই রেষারেষির প্রভাব যদি ঈশাদের পরিবারে পড়ে তবে সবটা ভেস্তে যাবে।

” আমার জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্তটা আমার নয় কি?”

” হুম তোমার নিশ্চয়ই কিন্তু অতীত ভুলে গেলে চলবে না।আচ্ছা বাদ দাও সে সব এখন বলো তোমার পছন্দ করা মেয়ের বংশ পরিচয় কি?মেয়েদের অর্থবিত্ত সম্পর্কে আমাকে জানাও।”

” আমি মেয়ের বাবার অর্থ বিত্ত বিয়ে করছি না আমি মেয়েটাকে বিয়ে করছি তাই আপনাকে অন্যদিকে ফোকাস না করলেও চলবে।”

” আমার রক্তের একমাত্র ছেলে তুমি।
আমি এমন পরিবার চাই যারা আমার পায়ে পা মিলিয়ে চলতে পারবে যাদের নিয়ে আমার জড়তা থাকবে না।তাই আমি চাই মেয়ের পরিবার হতে হবে নামি-দামি অর্থ বিত্তে কোন অংশে ত্রুটি থাকবে না এমন কাউকে।”

” কিন্তু আমি চাই ঈশাকে।”

” ঈশা কে?”

ভ্রু কুচকে এলো ঈশানের বাবার।তার সন্দিহান কণ্ঠে ঠোঁট বাকালো ঈশান
দ্রুত ফোন কেটে ফোনটা ছুড়লো বিছানায়।

” আমি জানতাম তোমার বাবা এমন করবে এবার কি করবে তুমি?”

” বাবাকে তুমি মানাবে সেটা যে করে হোক।”

” আ..আমি।”

” ইমোশনাল কথা বার্তা বলে যেভাবে পারো ব্যবস্থা করো।”

” আমি পারবো না তুমি তোমারটা সামলে নাও।”

ঈশান তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো তার মায়ের দিকে।তার চাহনিতে ভড়কে গেলেন মাহমুদা।বাপ ছেলে হয়েছে এক যার রাগ থাকবে ঊর্ধ্বে।

” তুমি আমায় ভালোবাসো না আম্মু?”

” তুমি আমার ছেলে তোমাকে ভালোবাসবো না কেন?”

” তুমি ঈশাকে পছন্দ করো না?”

” হীরের টুকরো মেয়ে ওঁকে তো ভীষণ ভালোবাসি।”

” তাহলে তুমি আমার দলে যা বলছি তাই করবে।”

” তুমি ঠান্ডা মাথায় ধমক দাও আমায়?তোমার ধমকে আমি নড়বো না আমার সাথে বেশি রাগারাগি দেখালে রুমার বাসায় চলে যাবো মনে থাকে যেনো।”

৬৫.
কানে হাত দিয়ে নত মস্তকে রাসেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে অনু।মেয়েটার দু’চোখ টলমল করছে, তিরতির কাপছে দু’ঠোঁট।রাসেলের ক্রোধ দেখে মনে ঝাপটানো সব প্রজাপতিরা বিলীন হয়ে গেছে।রাসেল এতটা রুক্ষ ব্যবহার করতে পারে ভাবনায় ছিল না অনুর।আকস্মিক হেঁচকি তুললো মেয়েটা নিরবতার মাঝে শব্দ পেয়ে মাথা তুলে তাকায় রাসেল।মেয়েটা কান্না আটকানোর বৃথা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে দু’চোখ জলে টইটম্বুর এসব দেখে মন গললো না রাসেলের বরং রুক্ষ স্বরে হুকুম করে,

” দাঁড়িয়ে আছো কেন?আরো বিশবার উঠবস করা বাকি।”

” রাসেল আপনার অনুরূপীকে ক্ষমা করা যায় না?”

” তুমি বসবে নাকি আমি…

রাসেল উঠতে নিলে দ্রুত বসে পড়ে অনু একে একে বিশবার কানে ধরে উঠবস করে সে।নিরিবিলি রাস্তায় তেমন মানুষজন নেই আর যারা আছে তারা অনুকে খেয়াল করেনি।গাড়ির দরজা খুলে সিটে বসে আছে ছেলেটা মাথাটা প্রচন্ড গরম আশেপাশে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে দম ছাড়লো।বিশ বার শেষে অনু চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো এক কোনে মেয়েটা নিশব্দে কাদছে।রাসেল উঠে দাঁড়ালো এবং অনুকে উদ্দেশ্য করে বলল,

” যাও বসো পানির বোতল রেখেছি একটু পানি খাও।”

অনু বসলো না সে রাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো আগের মতো।রাসেল ছুঁয়ে দিতে ঝটকায় সরিয়ে দিলো তার হাত।

“রাসেল তুমি ভিষণ খারাপ লোক।তুমি আমাকে ভালোবাসো না।তোমার সাথে আমি আর এই সম্পর্ক রাখবো না।”

” আচ্ছা তো কার সাথে রাখবে?”

” কয়েকদিন আগে সে বিয়ের প্রস্তাব এসেছিলো সেখানে হ্যা বলে দিব।একমাত্র তোমার কারনে করিনি কিন্তু এখন আমি আমার ভুল বুঝতে পারছি।আমি বিয়ে করে ফেলবো।”

” তারপর?”

” স্বামী নিয়ে তোমার নাকের ডগায় ঘুরবো।”

” তারপর?”

” ওরা আমাকে পড়াশোনার জন্য জোরাজোরি করবে না ওরাই ভালো।কয়েক মাস যেতে বাচ্চা নিবো।”

” তারপর?”

” তারপর বছর ফুরালে তোমার চোখের সামনে আমি আমার বাচ্চা নিয়ে ঘুরবো।ওদের দেখিয়ে বলবো দেখ দেখ তোদের না হওয়া বাবা।আমার বাচ্চাদের দেখে আপনি শোকে দুঃখে বাপ্পা রাজের মতো বলবেন না আমি বিশ্বাস করি না। ”

রাসেল পানির বোতল এগিয়ে এনে অনুর হাতে রাখলো এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে দিয়ে টিস্যুর সাহায্যে চোখটা মুছে দিলো।মেয়েটা একটু পরপর নাক টানছে কান্নার শ্রোতটা ধীরে ধীরে লোপ পেয়েছে।

” তারপর কি হবে বললে না তো।”

” আর কি হবে হয় তুমি বাপ্পা রাজ হবে না হয় প্রতারক হবে আমাকে ভুলে যাবে।আর আমি আমার বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকিয়ে তোমাকে ভুলে যাব হুহ।”

” তোমার বাচ্চাদের দিকে তাকিয়েও তুমি আমায় ভুলতে পারবে না।”

” কিন্তু কেন?”

” কারণ তোমার বাচ্চাদের চেহারা হবে আমার মতো।”

” আমার বাচ্চার চেহারা আপনার মতো হবে কেন?তাদের বাবা তো ভিন্ন কেউ।”

রাসেল জবাব দিলো না সে চুপচাপ তাকিয়ে রইলো অনুর পানে।মেয়েটা হিসাব কষাতে ব্যস্ত।এখানে আসার অনেকটা সময় ফুরিয়ে গেছে মেয়েটা নিশ্চয়ই দুপুরের খাবার খায়নি।

” গাড়িতে উঠো।”

” আমি যাব না তোমার সাথে।তুমি আমার সাথে আজ যা করলে…

” আমি কি করেছি?দোষটা কি তোমার ছিল না?তুমি একটা মেয়ের সাথে ঝগড়া করছিলে সবচেয়ে বড় কথা তোমাদের মাঝে হাতাহাতি হয়েছে চুলাচুলি করার আগেই তো আমি হাজির হয়েছি।তুমি এমন কেন অনু?এখন তো বড় হয়েছো এসব এখন মানায়?”

” মেয়েটা আমাকে এক্সামে দেখালো না ওর কারণে আমি ফেল করেছি স্যার আমাকে অনেক অনেক অপমান করেছেন।তাই তো…”

” সে কেন তোমাকে দেখাবে?নিজের পড়া নিজে পড়তে পারনা?লজ্জা লাগে না দেখে লিখতে।তোমার মতো একটা গবেট হবে আমার বউ!”

ফুঁপিয়ে উঠলো অনু।গায়ের ওড়না ভাজ করে হাটা ধরলো সরু পিচ ঢালা রাস্তায়।তার আচরণে বড্ড অবাক হলো রাসেল গাড়ির দরজা লাগিয়ে ছুটলো তার পিছু।

” এই কি সমস্যা তোমার?চলে এলে কেন?”

” আমি বাড়ি যাব ভালো লাগছে না।”

” আসো আমি পৌঁছে দিব।”

“আমার বাবা আমাকে যথেষ্ট ভাড়া দেয় আমি চলে যেতে পারবো।আর যদি বলেন আপনার এসি গাড়িতে যেতে তবে বলবো আমার বাবা ভাইয়ের যথেষ্ট ভালো ইনকাম আছে আপনার মতো একটা ড্রাইভার আর এমন একটা গাড়ি আমাকে কিনে দেওয়ার।এই কাজ তাদের কয়েক ঘন্টার ব্যপার।”

অনুর ব্যবহারে অবাক হলো রাসেল মেয়েটা তাকে অপমান করেছে।শেষ-মেষ তাকে ড্রাইভার বানিয়ে ছাড়লো।

” আশ্চর্য আমি তোমার ড্রাইভার?”

” তা নয় তো কি প্রতিদিন ভার্সিটি থেকে বের হতেই গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন আমায় নিয়ে যান।আমার ক্লাসমেটরা তো ভেবেও নিয়েছে আপনি আমার ড্রাইভার।”

” ভালোর জন্য তোমায় আমি শাসন করেছি আর তুমি আমার সাথে এখন এমন আচরণ করছো।”

” সবটা না জেনে কথা বলবেন কেন?ওই পক্ষের কথা শুনেছেন আমার কথা তো শুনলেন না।আগের এক্সামে আমি না লিখে মেয়েটাকে দেখিয়েছি তার কোন প্রিপারেশন ছিল না।যতটুকু পারা যায় খাতা উলটে পালটে সব ভাবে সাহায্য করেছি আর আমার সময় এসে সে তার রূপ পালটে নিলো।ফেইল তো করেইছি মেয়েটা আজ স্যারের কাছে নালিশ করলো আমি নাকি তাকে বিরক্ত করি এক্সামে।এমনি এমনি তর্কাতর্কি করিনি মনের দুঃখে তর্ক লেগেছিলাম হাতাহাতি করতে চাইনি ওটা রাগের দরুনে হয়ে গেছে।”

রাসেল অনুর হাত ধরলো মেয়েটা এবারেও ছাড়াতে চাইলো তবে তাকে প্রশ্রয় দিলো না সে।শক্ত হাতে হাটা শুরু করলো পেছন দিকে।রাসেলের শক্ত বন্ধনীতে ছাড়া পেলো না অনু তীব্র কষ্ট মনে বিড়বিড় করে বলে,

” আমার সুখ আমায় দুঃখ দিয়েছে।”

” ভালোবাসা এখনো বাকি তোমার সুখ সবটা পুষিয়ে দেবে।”
৬৫.

ঈশানের শেষ ভরসা ছিলো তার মা মাহমুদা কিন্তু গত দুইদিনেও তিনি সিদ্ধান্ত পাল্টালেন না।নিজের সিদ্ধান্তে অটল রইলেন তিনি।যেখানে ঈশান ফোন করা সত্ত্বেও তার বাবা আবিদ মত ফিরালেন না সেখানে মাহমুদা বলা মানে ঝামেলা কমার চেয়েও উল্টো বেশি বাড়া।তবুও আবিদকে কথার ছলে একবার বলেছেন তিনি কিন্তু মানুষটা এসব ব্যপারে শুনতে রাজি নয়।মাহমুদার এড়িয়ে যাওয়াটা মেনে নিতে পারছে না ঈশান চিন্তায় সবটা তার এলোমেলো হয়ে গেছে।রাত বাজে দুইটা মাহমুদা অপেক্ষায় আছেন ঈশান কখন বাড়ি ফিরবে কিন্তু ছেলেটা বাড়ি ফিরলো না।রাসেল সবার সাথে যোগাযোগ করেও ঈশানের কোন হদিস পেলো না।সব মিলিয়ে বড্ড চিন্তায় পড়লেন মাহমুদা এবং রাসেল।ঘড়ির কাটা তিনটা পেরিয়ে যখন চারটায় পৌঁছালো তখনি বাড়ি দেখা শোনার লোক কাসেম ছুটে এসে খবর দিলেন ঈশান ফিরেছে।ছেলের খোঁজ পেয়ে কিছুটা চিন্তা মুক্ত হলেন মাহমুদা কিন্তু মাতাল অবস্থায় ঈশানকে দেখে তার পায়ের তলার মাটি সরে গেলো।রাসেল কস্মিনকালেও ভাবেনি মাহমুদা থাকাকালীন ঈশান ড্রিংকস করে বাড়ি ফিরবে সে ছুটে গেলো ঈশানের কাছে।

” ত..তুই ড্রিংকস করেছিস ঈশান মাথা তোর ঠিক আছে?”

” হুহ।”

” ড্রাইভিং তুই করেছিস?”

” হুহ।”

” যদি এক্সিডেন হয়ে যেত তবে?”

” হুহ।”

” কি হুহ হুহ করছিস একটা চড় খাবি।ড্রিংকস কেন করেছিস আগে সেটা বল।”

” আমার কথা কেউ ভাবে না কেউ না।”

ঈশান মাতাল অবস্থায় কেঁদে ফেললো লুটিয়ে পড়লো মাহমুদার চরণে।মাহমুদা সরে দাঁড়ালো, ছেলের এত অধঃপতন দেখে বুক ফেটে কান্না আসছে।

” তুমি আমার ছেলে?তুমি আমার ঈশান তো?”

” আমার কথা কেন কেউ ভাবে না?”

” তুমি যা ইচ্ছে তাই করো এসব কেন করেছো কি ভেবেছো আমি বুঝি না?তোমার বাবাকে আমি রাজি করাতে পারবো না।শুনছো তুমি পারবো না।”

” আমি শেষ হয়ে যাব।”

ঈশানের ভ্যা ভ্যা শব্দে তেতে উঠলেন মাহমুদা।বাইরে থেকে নিজেকে শক্ত রাখলেও ভেতরে ভেতরে তিনি ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছেন ছেলের এই হাল তার চোখে সয় না।রাসেলের হতবাক চাহনী উপেক্ষা করে তিনি বলেন,

” রাসেল এই আবর্জনার বস্তাটাকে তার রুমে ফেলে আসো।”

মাহমুদা চলে গেলেন।রাসেল টেনে হেঁচড়ে ঈশানকে তার রুমে নিয়ে গেলো।শরীরের ভার ছেড়ে দেওয়া ঈশান নিজের রুমে ফিরে সটান দাঁড়িয়ে পড়লো দুই হাত দুই দিকে ছড়িয়ে হাই তুলে বলে,

” এত রাতে গোসল করতে কেমন লাগে বলতো।”

রাসেল আশ্চর্যান্বিত হলো তার মাথা কেমন করছে।

“তার মানে তুই মাতাল না।”

” নাহ।”

” তাহলে তোর গায়ে মদের গন্ধ কেন?”

” ওটা নাটক ছিল গায়ে মদ ঢেলেছি ব্যস এইটুকুই।”

“তুই ছিলি কোথায়?”

” দুইটা পর্যন্ত শ্বশুরের সাথে ছিলাম বাকিটা সময় গাড়ি নিয়ে এদিক সেদিক ঘুরেছি।”

” শ্বশুর মানে?ঈশার বাবার সাথে তোর এত রাতে কি?”

” ঈশাদের পাড়ায় যে ক্লাব আছে ওখানে দাবা খেলেছি।উনি এত ভালো পারে আমি বারবার হেরেছি।আগামীকাল অফিস বন্ধ তাই আর কি রাত জেগে এসব একটু দাবার আসর বসালাম।”

” মাতালের অভিনয় করলি কেন?”

” আম্মুর শক্ত সিদ্ধন্তটাকে নরম করতে এবার দেখবি বাবাকে কিভাবে রাজি করায়।”

ঈশান গায়ের শার্টটা খুলে ঝুড়িতে রাখে রাসেল এখনো তার দিকে হতবাক চাহনিতে তাকিয়ে আছে।তার এই চাহনি পালটে দিলো ঈশানের বলা প্রতিটা বাক্যে।

“অনু আজকে আমায় ফোন করেছে তোর নামে অনেক্ষণ নালিশ করেছে। সবচেয়ে বড় কথা তোর অনুরূপী তো বিয়েতে হ্যা বলে দিয়েছে।তোর সাথে নাকি সম্পর্ক রাখবে না।
#চলবে__

#অবাধ্য_বাঁধনে
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ৩০ ক]
_____________________
৬৭.
সকাল সকাল মাহমুদা নাস্তা তৈরি করে ঈশানের অপেক্ষায় ছিলো ছেলেরা নামলে তিনজন একসাথে নাস্তা করবে এটা তাদের প্রতিদিনের রুটিন।ঘড়িতে সকাল নয়টা বাজে ঈশান এখনো আসেনি রাসেল অফিসের উদ্দেশ্যে তৈরি হয়ে নিচে নামলো মাহমুদাকে মনমরা একা বসতে দেখে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।গালে গাল ছুঁইয়ে বলে,

” আমার মিষ্টি সকাল এবার পরিপূর্ণ।”

” নবাবের উঠার সময় এখন হলো তবে আরেক নবাব কোথায়?

” আমি ওর রুম চেক করে এসেছি সে তো নেই?”

” ঈশান তো নিচে নামেনি ঈশান কোথায়?”

” দাঁড়াও ফোন করে দেখি।”

রাসেল ফোন করলো ঈশানকে কয়েকবার রিং হতে ফোন তুললো সে।

” তুই কোথায় ঈশান?”

” অফিসে।”

” মানে কি নাস্তা করবি না?”

” না।না খেয়ে ম রার পরিকল্পনা করেছি।”

” কেন?হঠাৎ তোর এই অনশন।”

” যতদিন না বাবাকে রাজি করানো হচ্ছে সবটা এমনি চলবে।”

ঈশান ফোন রাখলো রাসেল আড় চোখে তাকালো মাহমুদার দিকে।তিনি ভীষণ ক্ষেপে গেছেন।দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে বসলেন চেয়ারে।

“গত তিনদিন রাতে মাতাল হয়ে বাড়ি ফেরা,আজ নাস্তা না করে চলে যাওয়া কি ভেবেছে সে আমি সহ্য করবো?আমি আজকেই রুমার বাড়ি চলে যাবো আজকেই।কি পেয়েছে সে?সে তার বাবার খবর জানে না?বাপ ছেলে হয়েছে এক দুজনেই জেদি এদের নিয়ে আমি আর পারবো না।”

” সব ঠিক ঠাক আঙ্কেলের অযথা যুক্তিতে ঈশানের জীবন কেন শেষ হবে? ”

” তোমার আঙ্কেল কখনো ঠিক হবেন না।আমি জানি আমার ছেলে কেমন প্রতিটা সংসারে বিষ ঢালার জন্য একটা না একটা মানুষ রূপধারী বিষের কৌটা আছেই।”
.
ঝমঝম বৃষ্টি পড়ছে আকাশের কালো মেঘে সবটা অন্ধকার।মানুষের আনাগোনা বেশ কম।গাড়ির দেখাও পাওয়া গেলো না ঈশার আজ দিনটা বোধহয় বৃথা।অনুকে বার বার বলেছিলো চল ভার্সিটি যাই কিন্তু মেয়েটা জেদ ধরে বসে আছে সে নাকি যাবে না স্যার তাকে অপমান করেছে বাধ্য হয়ে ঈশা একাই চললো।গাড়ি না পেয়ে যতটুকু পারা যায় হাটছে ঈশা।মাঝামাঝি পথে এসে দ্বিধায় ভুগছে সে কোন দিকে যাবে?ভিজে ভার্সিটি নাকি বাসায়।এই বৃষ্টির মাঝে ঈশার মনে হচ্ছে কেউ তার পিছু নিয়েছে কিন্তু কে?আশেপাশে তাকিয়ে কারো হদিস পেলো না।ভয়ে ধুরু ধুরু বুক নিয়ে ছুটে চললো ঈশা।কিছুটা পথ যেতেই কেউ তার মুখ চেপে ধরে।অন্য হাতে দুই হাত পেছন থেকে আকড়ে ধরে।আকস্মিক আক্রমণে ছাতাটা ছিটকে পড়লো রাস্তায়।হাত পা ছিটিয়ে ঈশার তড়পাতে থাকে।সেই আগন্তুক তাকে কিছুতেই ছাড়লো না।ঈশার ছোটাছুটির মাঝে বেঁধে দিলো চোখ,হাত,মুখ ক্রমশ টেনে নিয়ে গেলো গাড়ির কাছে।বৃষ্টিতে এতক্ষণে কিছুটা ভিজে গেছে ঈশা অপরদিকে ব্যক্তির দৈহিক শক্তির কাছে পেরে উঠলো না সে।ছোটাছুটির মাঝে ঈশাকে তোলা হলো গাড়িতে।ভয়ে জমে গেলো মেয়েটা বড় শ্বাস নিয়ে নিজকে ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করলো।শরীরের ঝাঁকুনি দিতে বুঝতে পারলো গাড়ি চলতে শুরু করেছে।ঈশার তড়পানো ক্রমশ বাড়লো।আগন্তুক কিয়ৎক্ষণ বাদে গাড়ি থামালো পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো ঈশার পানে।এগিয়ে এসে মেয়েটার ভেজা গালে নিজের নাক ঘষে দিল।লহমায় ঈশার হৃদস্পন্দন বাড়লো।সেদিন রাজিবের হাতে এন্টিকাটারে অসাবধান বশত গলার নিম্ন ভাগে কেটে যাওয়া সেই দাগ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।এই দাগ এখনো বিলীন হয়নি আর হয়তো হবেও না।আগন্তুক বৃদ্ধা আঙুলের সাহায্যে ছুঁয়ে দিলো সেই দাগ ঈশা কেঁদে ফেললো মুখ দিয়ে গোঙানির শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ পাওয়া গেলো না।আগন্তুক পুনরায় গাড়ি চালাতে শুরু করেছে বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি আকাশের গর্জনে কেঁপে উঠছে ধরণি।কিছুটা দূর যাওয়ার পর আগন্তুক ঈশার হাতের বাঁধন খুলে দিলো ছাড়া পেয়ে ঈশা দ্রুত তার চোখ মুখ খুলে পাশে তাকায়।কিন্তু পাশে ঈশানকে দেখতে পেয়ে স্তব্ধ হয়ে যায়।বড় বড় শ্বাস ছেড়ে পুনরায় চারদিকে চোখ বুলালো সে,ঈশান নিশ্চিন্ত মনে ড্রাইভ করছে ঈশার দিকে ঘুরে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করলো না।না তাকিয়ে ঈশার দিকে বাড়িয়ে দিলো পানির বোতল।পানি পেয়ে এক নাগাড়ে ঢকঢক করে পুরো পানিটা সাবাড় করলো ঈশা।

ঈশান গাড়ি থামালো কিঞ্চিৎ হেসে তাকালো ঈশার দিকে।মেয়েটা এখনো কাঁপছে,তিরতির কাঁপছে দু’ঠোঁট।

“ঈশান..”

” হুম।”

ঈশা ফুঁপিয়ে উঠলো ধীরে ধীরে তার কান্নার গতি বাড়লো ভয়ে এখনো কাঁপছে সে ঈশান কিছুটা এগিয়ে এলো ঈশা তার হাত ধরে কিছুটা সময় কাঁদলো কান্না গতি থামলো না এই কান্না ধীরে ধীরে বাড়ছে হেঁচকি তুলতে ঈশা জড়িয়ে ধরলো ঈশানকে।ঈশান হাসছিলো মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে তাকিয়ে রইলো বাইরের দিকে।জানলার কাঁচ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে বৃষ্টির পানি এই দৃশ্য বড্ড সুন্দর।

” ভয় পেয়েছো?”

” হুম।”

” আমি ছিলাম আমি..”

ঈশা মাথা তুলে তাকালো ঈশানের পানে কান্নাটা থেমে এসেছে।হঠাৎ ঈশানের এই অদ্ভুত কাজ করার মানে কি?

” এমন কেন করলেন ঈশান?আপনি জানতেন আমি ভয় পাবো ইচ্ছে করে এমনটা করেছেন তাই না?”

” মাঝে মাঝে ভয় পাওয়া ভালো।”

” পা গ ল আপনি এমন কেউ করে?এমন কেন করেছেন?”

” তোমায় একটু দেখালাম বুঝালাম অনুভব করালাম যদি আমাদের বিয়েটা না হয় এভাবে নিয়ে আসবো।”

কান্নার মাঝেও শব্দ করে হেসে দিলো ঈশা।তার হাসিতে হাসলো ঈশান।

” আমাদের পরিবার রাজি আপনারা দেরি করছেন কেন?”

” তুমি জানো বাবার সাথে আমার একটু ঝামেলা আছে তাই উনি সহজে মানছেন না।”

ঈশার মনটা খারাপ হয়ে এলো তা বুঝতে পারলো ঈশান।ঈশার হাত ধরে টেনে এনে মেয়েটার পিঠ ঠেকিয়ে দিলো তার বুকে।

” মন খারাপ করার কিছু নেই সব ঠিক হয়ে যাবে এবং খুব শীঘ্র।তুমি একা কোথায় যাচ্ছিলে?”

” ক্লাস ছিল।”

“অনু কোথায়?”

” সেদিনের পর আর ক্লাসে যাচ্ছে না।রাসেল ভাইয়ার সাথেও কোন যোগাযোগ রাখেনি।ভাইয়া শুধু শুধু তাকে এতগুলা কথা শুনিয়ে দিলো দোষটা ওই মেয়ের ছিল।”

” আমাকে সব অনু বলেছে।আমি রাসেলকে বলেছি অনু বিয়েতে হ্যাঁ বলে দিয়েছে তাই তো এখন রাসেলের মেজাজ অত্যাধিক গরম থাকে এদিকে অনুর সাথেও যোগাযোগ করা যাচ্ছে না।”

ঈশা চুপ হয়ে যায় বাইরের বৃষ্টি দেখায় মগ্ন সে।ঈশানের হাত আরো শক্ত হয় ঈশার কটিদেশে।ঘাড়ে নিশ্বাসের উথাল-পাতাল আভাসে চুপ হয়ে রয় ঈশা।ঈশান তার হাত টেনে শব্দ করে ঠোঁট ছোঁয়ায়।

” আপনার অফিস নেই?”

” যাব না।”

” ওহ।”

” ঈশা একটা কথা বলি?”

” বলুন।”

” চলো আমরা বিয়ে করে ফেলি আমার রিক্স নিতে ভালো লাগছে না।”

” কিসের রিক্স?কি বলছেন আপনি?”

” পরে যদি পরিবারের মত পালটে যায় আমার ভালো লাগছে না ঈশা প্লিজ চলো আমরা বিয়ে করে ফেলি কেউ জানবে না।একদম কেউ না।”

ঈশা নড়ে চড়ে সরে বসে ঈশানের পাশ থেকে।ঈশার দূরত্বে হতাশা দ্বিগুণ হলো ঈশানের নিরুপায় চোখে ঈশার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ সে কিছু বলেও বলতে পারবে না।অদ্ভুত এক অনুভূতি,দূরত্বের আভাস সব মিলিয়ে ক্রমশ বেসামাল হয়ে উঠছে ঈশান।

” যা হবার তা হবে ঈশান।আমাদের পরিবারে বাঁধা নেই।আপনি শুধু শুধু চিন্তা করছেন।”

“তুমি আমার দিকটা বুঝতে পারছো না ঈশা।”

” কি বুঝবো আমি?এখন যদি আপনি জোরাজোরি করেন তবে আমি ভেবে নিবো আপনাদের মাঝে কিছু একটা ঝামেলা আছে।”

” ঝামেলা?”

” আপনার বাবার সাথে আপনার কি সমস্যা ঈশান?আমাকে এখনো সেসব কিছুই বলেননি।”

” একটু সময় দাও আমি সবটা বলবো।তুমি প্লিজ আমার কথায় রাজি হও ঈশা।গত তিন চারদিন আমার চোখে ঘুম নেই একটুও না।আমি উন্মাদ হয়ে যাচ্ছি”

ঈশানের কাতর চাহনিতে কিছুটা স্থির হলো ঈশা।হাত বাড়িয়ে ঝাকিয়ে দিলো ঈশানের আধা ভেজা চুল।

” কিসের চিন্তা সব ঠিকঠাক হবে।”

” যদি না হয়?”

” তবে একটু আগে যা করেছেন তাই হবে।”

শেষোক্ত বাক্যটি বলে খিলখিলিয়ে হাসলো ঈশা।ঈশা মজার ছলে কথাটি বললেও ঈশানের মুখে এখনো হাসির রেশ নেই।
৬৮.
বৃষ্টির মাঝে কাথা মুড়িয়ে ঘুমন্ত অনুর দিকে চেয়ে রইলো তার মা দোলন।এতটা বেলা হয়েছে অথচ মেয়েটা পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে ওদিকে ডেলিভারি ম্যান এসে দাঁড়িয়ে আছে অনু নাকি কি অর্ডার করেছে অনলাইনে।অনলাইন কেনাকাটা বড্ড বিরক্ত লাগে দোলনের কাছে তার ভাষ্যমতে দোকান থেকে স্বচক্ষে যা ভালো লাগবে তাই কিনবে কিন্তু এই মেয়েটা তার উলটো।অনুকে দুই তিনবার ভদ্র ভাবে ডাকলো তার মা কিন্তু মেয়েটার ঘুম না ভাঙলে ভীষণ বিরক্তবোধ করেন তিনি না পারতে গায়ের কাঁথা টেনে সরিয়ে ফেলেন।গ্লাসে রাখা একটুখানি পানি ছিটিয়ে দেন মেয়েটার মুখে।ঠান্ডা অনুভবে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে অনু।কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মায়ের দিকে তাকিয়ে সবটা রাগ আড়াল করলো।

” আম্মু কি করছো তুমি?”

” তুমি কি করেছো আগে তার জবাব দাও অনলাইনে কি অর্ডার করেছো ডেলিভারি দিতে ছেলেটা এসে দাঁড়িয়ে আছে।”

” আ..আমি?কই আমি কোন অর্ডার করিনি।”

“তোমার নাম বললো ছেলেটা যাও গিয়ে দেখো।”

অনু প্রচন্ড বিরক্ত হলো এলোমেলো পায়ে দ্রুত নামলো বিছানা ছেড়ে।আশেপাশে নজর বুলিয়ে ওড়নার হদিস পেলো না বাধ্য হয়ে চেয়ারে থাকা লাল রঙের সুতির গামছাটা নিয়ে এগিয়ে গেলো দরজার দিকে।মাটিতে লেগে থাকা প্লাজু,ঢিলে ঢালা লম্বা টি-শার্ট,গায়ে লাল রঙের গামছা দেখে ভীষণ হাসি পেলো রাসেলের।মেয়েটার সাথে যোগাযোগ করার এত চেষ্টা করেও লাভ হলো না, রাসেল বুঝে নিলো অনুর অভিমান।তাই তো কুল না পেয়ে ডেলিভারি ম্যান সাজতে হলো তাকে।

ঘুম ঘুম চোখে রাসেলকে চিনতে কিছুটা দেরি হলো অনুর।তবে রাসেলের কণ্ঠ শুনে মুহূর্তে ঘুম উবে গেলো আশেপাশে তাকিয়ে দেখতে পেলো মা এদিকেই আসছে দ্রুত রাসেলের হাত থেকে প্যাকেটটা নিয়ে স্বল্প স্বরে বলে,

” যাও এখান থেকে।”

” যাব না আগে বলো প্যাকেটটা দেখবে।”

” হুম দেখবো যাও।”

রাসেল দ্রুত চলে গেলো অনু হাতের প্যাকেটটি আড়াল করে নিজের রুমে প্রবেশ করতে ডেকে উঠলো তার মা।

” কিরে কি এনেছিস?”

“মেকাপ প্রডাক্টস আম্মু এখন আমায় ডিস্টার্ব করবে না আমি আবার ঘুমাবো।”

অনু কক্ষে ফিরে দ্রুত দরজায় খিল দিলো।প্যাকেট বিছানায় উপড় করতে একে একে বেরিয়ে এলো কয়েকটি প্লাস্টিকের তেলাপোকা এবং ব্যাঙ।প্রথম দেখায় অনু ঘাবড়ে গেলেও পরক্ষণে বুঝতে পারলো এগুলো নকল।ভাজ করা সাদা কাগজটি দেখে হাতে তুললো অনু।দ্রুত ভাজ খুলে পড়তে শুরু করলো সে,

” কি ভেবেছিলে রাগ করে বসে থাকবে আর আমি মিষ্টি মিষ্টি সারপ্রাইজ গিফট পাঠাবো?ওসব হচ্ছে না তিন ঘন্টা সময় দিলাম এই তিন ঘন্টার মাঝে যদি আমায় ফোন না দাও তবে সশরীরে তোমার বাসায় গিয়ে উঠবো এবং সবার কাছে সবটা বলবো।একবার যেহেতু তোমার বাসায় আসার সাহস করেছি তখন বুঝতেই পারছো কাজটা আমার জন্য কতটা সহজ।তেলাপোকা গুলো কিউট না?রুদবার জন্য খেলনা কিনতে গিয়ে ভালো লেগেছিলো ভাবলার তোমার জন্য ঠিক হবে।যাই হোক আমার দিক থেকে আমি সরি না বুঝে এমন আচরণ করা আমার ঠিক হয়নি সেটা বুঝতে পারছি।আমার কানে একটা খবর এসেছে তুমি নাকি বিয়েতে হ্যা বলেছো?ভালো করেছো তোমার বিয়ের দাওয়াত খেতে আসছি।কি গিফট দেওয়া যায় বলতো?তোমার পছন্দ কি সাজেস্ট করো।”

অনু চিঠিটা হাতে রেখে থ বনে তাকিয়ে রইলো।ভেবেছিলো মিষ্টি করে সরি জানাবে অথচ উলটো কতগুলো কথা শুনিয়ে দিলো।উদ্ভট লোক একটা।
.
ঈশাকে নিয়ে রুমার বাসায় এসেছে ঈশান অবশ্য সে আসতে চায়নি ঈশানের কাছ থেকে যখন রুমা জানতে পারে ঈশা তার সাথে আছে তখন এক প্রকার বাধ্য করলো তাদের আসতে।দুপুরের খাওয়ার শেষ মাত্র রুদবার সাথে টুকটাক গল্প করছে ঈশা।মেয়েটা তার ড্রয়িং খাতাটা বের করে ঈশাকে দেখাচ্ছে ঈশাও হাসি মুখে মেয়েটার প্রশংসা করছে তাদের দুজনের কান্ড ড্রাইনিং টেবিলে বসে দেখছে ঈশান।হাতে তার কোল্ড ড্রিংস।তাদের দেখতে দেখতে গ্লাসটা ঠোঁটে নিয়ে একটু একটু চুমুক দিচ্ছে সে।আকস্মিক ফোন আসায় তার ধ্যান ভঙ্গ হয় ফোনের স্কিনে তার বাবা আবিদের নাম্বারটা দেখে কিছুটা উত্তেজিত হয় হঠাৎ বাবা কেন ফোন করলো?

” হঠাৎ আমাকে স্মরণ করলেন?”

” তুমি আমার স্মরণে প্রতিদিন থাকো।”

” কেন ফোন করেছেন?”

” কতটুকু এগিয়ে গেলো তোমার বিয়ে?না মানে বিয়ের ভূত কি মাথা থেকে নেমেছে?”

” এটা আপনার কাছে ভূত মনে হয়?এত ফানি ভাবে নিচ্ছেন এই বিয়ে?”

” না তোমার বিয়ে ফানি নয় তবে যাকে বিয়ে করবে বলছো…”

” এসব ব্যপারে আমি কোন কথা শুনতে চাই না।”

” আমি যা বলছি তাই শুনো নিজের ভবিষ্যৎ ভালো হবে।আমি আমার সিদ্ধান্ত কখনো বদলাই না সেটা তুমি জানো।”

” আমি কখনো আমার চাওয়া পাওয়া অপূর্ণ রাখিনা সেটাও আপনি জানেন।”

” তুমি উন্মাদ হয়ে গেছো ঈশান।এখানে আসো ধুমধাম করে বিয়ে দেবো তোমার।মেয়ে তৈরি আছে এখন শুধু তোমার আসার অপেক্ষা।”

সহসা উত্তেজিত হয়ে পড়লো ঈশান।হাতের গ্লাসটা চেপে ধরে আছাড় দিলো চেয়ারের সাথে।কয়েক টুকরো ভাঙা কাঁচ মাংস গলিয়ে ঢুকে গেলো ঈশানের হাতে।রক্তের শ্রোতধারা বইছে ছেলেটার হাতে।কাঁচ ভাঙার শব্দে উত্তেজিত হয়ে পড়লেন আবিদ তিনি অনেকবার ঈশানকে ডাকলেও সাড়া শব্দ মিললো না বরং একটা সময় ফোন কেটে দিলো।ভাঙার শব্দে এগিয়ে এলো রুমা ঈশানের হাতে রক্ত দেখে কিছু বলার আগে কানে এলো রুদবার কান্না।ঈশানের হাতে রক্ত দেখে মেয়েটা ভীষণ ভয় পেয়েছে।রুদবার কান্নায় স্থির হয় ঈশান রুমাকে উদ্দেশ্যে করে বলে,

” রুদবাকে নিয়ে ভেতরে যাও।”

” ঈশান…”

” যেতে বলেছি আমি।”

শেষোক্ত বাক্যটি ধমক সুরে বললো ঈশান।শান্ত ছেলেটার হঠাৎ কি হলো ভেবে পেলো না রুমা।সে দ্রুত রুদবাকে নিয়ে ভেতরে চলে যায়।ঈশা ততক্ষণে এক কোণে ভয়ে কুঁকড়ে দাঁড়িয়ে আছে।

” ঈশান..”

ঈশার কণ্ঠে এগিয়ে গেলো ঈশান।হাতের সব কাঁচ ঝরলেও একটি বড় কাঁচ সরেনি সেটি উপড়ে ফেললো ঈশান। ঈশার কাতর চাহনি দেখে মুচকি হেসে রক্তাক্ত হাতে ছুঁয়ে দিলো ঈশার গাল ঈশানের রক্তে ঈশার গালের একপাশ রঞ্জিত।

” এমনটা কেন করেছেন?”

” যা করেছি বেশ করেছি।”

” চলুন হাসপাতাল যাই।”

” কোথাও যাব না।তুমি একা বাসায় যেতে পারবে না?একা রিক্সা দিয়ে বাসায় চলে যেও।”

” হুম।”

” আমি এখন বাড়ি ফিরবো।”

ঈশানের রক্ত ক্রমশ গড়িয়ে পড়ছে ঈশার গাল বেয়ে গলায়।ঈশা ভয়ে ঠকঠক কাঁপছে কেমন যেন সবটা এলোমেলো লাগছে।ঈশাদ অবস্থা দেখে ঈশার কপালে মাথা ঠেকায় ঈশান স্বল্প স্বরে বলে,

” তুমি ভয় পেও না এই ভীতু মেয়েটাকে আমি ভালোবাসিনি আর কোন দিন বাসবো না।আমি ভালোবেসেছি সূর্যের মতো প্রখর উদ্দীপ্ত সেই মেয়েটিকে।”
#চলবে___

#অবাধ্য_বাঁধনে
#পলি_আনান
[পর্ব সংখ্যা ৩০খ]
_____________________
বিকাল বেলায় বৃষ্টিটা বেশ কমে এসেছে ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে মেঘলা আকাশটা দেখতে ভীষণ ভালো লাগছে মাহমুদার কাছে।এত বড় বাড়িতে তারা অল্প কয়েকজন ছেলেরা বাড়ির বাইরে থাকলে সবটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে।পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখে মাত্র বসার ঘরে ফিরলেন মাহমুদা।তখনি সদর দরজায় উপস্থিত হয় ঈশান ছেলেটার হাত রক্তে জবুথুবু।বুকের ভেতরটা মুষড়ে উঠলো মাহমুদার চপল পায়ে এগিয়ে গেলেন ছেলের কাছে।

” ঈশান কি হয়েছে তোমার?”

” বাবার সাথে কথা হয়েছে তোমার?সত্যিটা বলবে।”

” না হয়নি।কেন কি হয়েছে আগে বলো তোমার হাত কাটলো কি করে।”

” তোমার স্বামী কি পেয়েছে যা বলবে আমি তাই করবো?আজকে আমাকে বললো মেয়ে ঠিক করেছে আমি যেন সে দেশে যাই।এতই সোজা আম্মু?আমি যদি সবটা মেনে নিতাম তবে আমার বসবাস আজ এদেশে হতো না।আজ হাত কেটেছি আগামীকাল পা কা ট বো।আমার জেদ সম্পর্কে তুমি অবগত হেরফের হলে নিজের গলা কা টতেও দ্বিধা করবো না।

” ঈশান এসব কথা পরে হবে আগে তুমি….”

” আমি শেষ বারের মতো বলছি আম্মু আগামী এক সাপ্তাহের মধ্যে তোমরা ঈশার বাবার সাথে কথা বলবে।সব ফাইনাল করবে যদি না হয় এর ফল বেশি ভালো হবে না।”

ঈশান উপরে চলে গেলো।মাহমুদার শরীর কাঁপছে ছেলের এই হাল তিনি কিছুতেই সহ্য করতে পারছেন না।ছেলেটার হাতে ব্যান্ডেজ করা দরকার তিনি ছুটলেন ঈশানের রুমে।বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে আছে ঈশান হাত থেকে অনবরত রক্ত ঝরছে সফেদ টাইলসে সেই রক্তের প্রতিটা ফোঁটা মাহমুদার বুকে তীরের ন্যায় বিঁধছে।

“এত গোঁ তোমার হাত কাটলে কিভাবে?”

” রুমার বাসায় ছিলাম ক্লাস চেপে ভেঙে দিয়েছি।”

“চলো ডাক্তারের কাছে যাই অনেকটা ক্ষত হয়েছে।”

” যাব কিন্তু আগে কথা দাও আমি যা বলেছি তাই হবে।”

” অবশ্যই হবে তোমার কথা শেষ কথা।বাবারে তোমার মায়ের আর এসব সহ্য হচ্ছে না।এবার তোমার হাতের কিছু একটা কর।”

ঈশান উঠে দাঁড়ালো টিস্যুর বক্স থেকে কয়েকটা টিস্যু নিয়ে চেপে ধরলো হাতে।তাতেও লাভ হলো না নরম টিস্যুটি তরলের সংস্পর্শে এসে নুইয়ে যাচ্ছে।সঙ্গে দুইজন গার্ড নিয়ে হাসপাতালে রওনা হয় ঈশান।হাতে কেমন ঝিম ধরে গেছে অনুভব হচ্ছে কা টার যন্ত্রণার।অবশ্য রাগের দরুনে এতক্ষণ ব্যথা অনুভব হয়নি তার কিন্তু এখন রাগ পড়ায় প্রচন্ড অস্থির লাগছে।
৬৯.
সেই সময়ের পর ঈশানের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো ঈশা।ঈশান সেচ্ছায় ঈশার ফোন তুলেনি।রাত যত গভীর হলো ঈশার চিন্তা তত বাড়লো।রাসেল বলেছে ঈশান এখন ঠিক আছে কিন্তু মানুষটার সাথে কথা না বলা পর্যন্ত মনে যে শান্তি হবে না।মুজাহিদ হাসান আর সুলতানা মিলে মুভি দেখছিলেন তাদের সাথে যুক্ত হতে ডাকা হয় ঈশাকে কিন্তু তার এখন মুভি দেখার মন নেই মন তো পড়ে আছে প্রেমিক পুরুষটার কাছে।বৃষ্টি নেই তবে রাতের আকাশ কি এখন স্বচ্ছ?হয়তো।জানলার সাহায্যে আকাশ দেখার চেষ্টা চালালো ঈশা কিন্তু বুঝতে পারলো না আকাশে মেঘ আছে কি না।ফোন বেজে উঠতে ছুটে গেলো সে।হ্যাঁ ঈশান ফোন করেছে এতক্ষণে তবে তার সময় হলো।

” ঈশান কেমন আছেন?”

” বেশ ভালো।তুমি জানলায় দাঁড়িয়ে কি খুঁজো?আমাকে?”

ঈশা কিঞ্চিৎ অবাক হলো সরু চোখে তাকালো রাস্তার বাঁকে।ল্যাম্পপোস্টের আলোতে ঈশানের গাড়ি দেখা যাচ্ছে ছেলেটা গাড়ির সামনে দাঁড়ানো।

” আপনি এখানে কেন?”

” নিচে নামবে?”

” না বাবা মা বসার ঘরে সম্ভব না।”

” আর অনু তোমার নাম করে বেরিয়েছে জানো?রাসেলের সাথে কথা বলছে আর তুমি আসবে না।”

ফিক করে হেসে ফেললো ঈশা।হেই হাসি দূর থেকে স্পষ্ট দেখলো ঈশান।কানে বেজে উঠলো ঈশার হাসির ঝংকার।

” মেয়েটা আমাকে ফাঁসিয়ে দিচ্ছে প্রতিটা জায়গায়।ওদের দেখা করা জরুরি ঈশান।আগে বলুন আপনার হাতের কি অবস্থা?”

” পাঁচটা স্টিচ লেগেছে।”

” হঠাৎ কি এমন হলো যে এমন তুফান করলেন জানেন রুদবা রুমা আপু কতটা ভয় পেয়েছে।আমার তো দম বন্ধ হয়ে আসছিলো।”

” মাঝে মাঝে সবাইকে ভয় পাইয়ে দেওয়া ভালো এতে করে এটেনশন পাওয়া যায়।”

” অদ্ভুত আপনি।হাত ব্যথা করছে তাই না?”

” তোমার অধর স্পর্শে ঠিক হয়ে যাবে সব।আসবে তুমি?”

” এসব আবেগী কথা রাখুন আপনার এসব আমি সহ্য করতে পারবো না ঈশান।একটা মানুষ এতটা রুক্ষ কি ভাবে হয় যে নিজের যত্ন করে না।”

” তোমার যত্ন করলে তো হবে আর কি চাই?”

ঈশা নিশ্চুপ রইলো।বাইরে আকাশ ডাকছে আচমকা বিজলি চমকাচ্ছে।রুমের পর্দা টেনে বিছানায় বসলো ঈশা তার কণ্ঠে মিশে গেলো ভয়ের আদল।

” আকাশ ডাকছে ঈশান আপনি ফিরে যান।”

” তুমি জানলা থেকে সরলে কেন ভয় পাও?”

” হুম।”

” আমি আসবো?এসে ভয় দূর করে দেবো।”

” আপনি পাশে থাকাটাই আরেক ভয়।”

” তা কেনো?”

ঈশার প্রত্যুত্তত করার আগে আকস্মিক বাজ পড়লো কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠলো ঈশা।উঠে গিয়ে দ্রুত জানলা বন্ধ করে বিছানায় ফিরলো সে।ঈশান ঈশার কান্ডকারখানা বুঝতে পারলো।তাই মেয়েটার মন ঘুরাতে রসিয়ে বলে,

” ঈশা।”

” হুম।”

” বউকে চোখ টিপ দিয়ে রুমে ডাকার মতো ওয়েদার।”

” এই যে একটু আগে বলেছিলাম আপনি পাশে থাকাটাই আরেক ভয়।”

” আমাকে ভয়?”

“বুঝতে পারছি তো জনসংখ্যা বৃদ্ধি করার মতো ওয়েদার আর আপনি বৃদ্ধি করেই ছাড়বেন”

ঈশা চট করে ফোন রাখলো।ঈশান স্তব্ধ, নিশ্চুপ, সে ভেবেছিলো ঈশাকে লজ্জা দেবে মেয়েটার কান গরম করে ছাড়বে আর এই মেয়েতো তার থেকে এক ধাপ উপরে।
.
আকাশের ডাকে ভয়ে কুঁকড়ে উঠলো অনু কিন্তু রাসেলের সামনে তা প্রকাশ করা যাবে না।আজ সে রাসেলের সাথে অভিমান করেছে ভাব দেখিয়ে তাকিয়ে আছে অন্যদিকে।তার ভাব দেখে মনে মনে হাসছে রাসেল এই ভাব কতক্ষণ থাকবে সেও দেখবে।

” পড়তে বসেছো আজ?”

” আপনি আমার টিচার লাগেন?দেখা হলে সারাদিন পড়া পড়া করেন কেন?”

” ভালো কথা তোমার ভালো লাগে না তাই না?।”

” না লাগে না।আপনি হলেন আমার প্রণয় সংঘটিত শিক্ষক আর আপনি কি না সারাদিন পড়া নিয়ে পড়ে আছেন।একটু প্রেম প্রেম বুলি কি মুখে ফুটে না?”

” না ফুটে না। আমি কথায় নয় কাজে বিশ্বাসী।”

অনু আড় চোখে তাকালো রাসেলের দিকে।ছেলেটার সহজ সরল কথার বাঁক উলটো ধরে বসলো অনু।সে এগিয়ে এলো রাসেলের কাছে ডান হাতের সাহায্যে চুলে হাত বুলিয়ে স্বল্প স্বরে বলে,

” তুমি এত দুষ্টু কেন?”

” মানে?”

” কচি খোকা কিচ্ছু বুঝে না।”

রাসেল স্তব্ধ হয়ে রইলো।অনুর কথার মানে বুঝতে পেরে কান টেনে ধরলো তার।

” অল্প বয়সে পেঁকে গেছো।এতটা না পাঁকলেও হতো।”

_
ছেলের জেদের কাছে হারলেন মাহমুদা আর মাহমুদার জেদে হারলেন আবিদ।বিয়ের পর থেকে মাহমুদা এতটা অভিমান অভিযোগ করেনি যতটা না গত দু’এক দিনে করেছেন।ঈশান যেদিন বাড়ি ছেড়েছে এই মানুষটা শুধু কেঁদেছে প্রতিটা আর্তনাদে বলেছে, ” আমার ছেলে চলে গিয়ে ভালো করেছে এখানে তার জীবন জাহান্নাম হয়ে যেত।” ছেলের দূরত্বটাও হজম করলেন এই নারী কিন্তু দিনের পর দিন ছেলে বিগড়ে যাওয়াটা সহ্য করতে পারলেন না।আবিদের উপর একের পর এক চাপ পড়লে তিনি বাধ্য হন ঈশানের বিয়েতে সম্মতি জানাতে।নিজের স্ত্রীকে মোটেও কষ্ট দিতে চান না আবিদ গত দুইদিনে স্ত্রীর পা গ লামোতে মন মেজাজ সবটা ভোঁতা হয়ে গেছে তাই না চাইতেও নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছেন।ঈশার বাবার সাথে কথা বলে ঈশা এবং ঈশানের এঙ্গেজমেন্টের তারিখ নির্ধারণ করা হয়।ঈশার বাবার শর্ত অনুযায়ী যেদিন ঈশানের বাবা দেশে ফিরবেন সেদিন সব আলাপ আলোচনা সেরে বিয়ের আয়োজন করা হবে।ঈশান তাতে সম্মতি জানায় অন্তত যে করে হোক প্রেয়সীকে নিজের বলে দাবি করার মাধ্যম তো আছে।
৭০.
সিদুর রাঙা লাল জামদানি শাড়ি মানানই স্বর্ণের মোটা চেইন।ঠোঁটে চকচক করছে মেরুন রঙের লিপস্টিক।দুই হাতে লাল কাচের চুড়ি।লম্বা কেশ ছেড়ে দিয়েছে বাধাহীন।কপাল ছুয়ে গালে নেমেছে ক’গাচি চুল।রুমা আগাগোড়া পরখ করলো মেয়েটাকে।বিশেষ ভাবে তাকে কখনো পরখ করেনি রুমা কিন্তু আজ মেয়েটাকে দেখে চোখে মুখে ফুটে উঠলো তৃপ্তির হাসি।ভাই বুঝি এই মেয়ের চোখে সুখ দেখেছে?
নাকি পূর্ণতার ইঙ্গিত পেয়েছে?চোখে হাসলো রুমা।ঈশার কানে দুল নেই ড্রেসিং টেবিলের উপর পড়ে আছে গোল্ডেন রঙের এক জোড়া ঝুমকা।এই ঝুমকা পড়লে মেয়েটাকে পরিপূর্ণ লাগবে।

” ঝুমকা পরবে না ঈশা?কান তো খালি।”

ঈশা মাথা দুলালো রুদবাকে চুল আচড়ে দিচ্ছিলো সে।মেয়েটা বাসা থেকে তৈরি হয়ে এলেও বায়না ধরে বসলো তার ঈশামনির কাছে চুল বাঁধবে।

” পরবো আপু।রুদবারটা শেষ করি আগে।”

রুদবার চুল বাঁধা শেষে কানে দুল পরলো ঈশা।নিজেকে একবার আয়নায় দেখে বসে পড়লো রুমার পাশে।রুদবা এগিয়ে এসে থুতনিতে হাত রাখলো ঈশার।আদুরে সুরে হাসি মুখে বলে,

” জানো আম্মুর ফোনে আমি একটা কার্টুন দেখেছিলাম।সেখানে বউটা দেখতে তোমার মতো।না না তুমি সেই বউটার মতো।”

খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো রুদবা।তার হাসিতে হাসলো ঈশা।মেয়েটার নাক টেনে বলে,

” জানো আমি ফেইরি টেলসের একটা কার্টুন দেখেছিলাম হোয়াইট গাউনে একটা প্রিন্সেস ছিলো সেই প্রিন্সেটা দেখতে একদম তোমার মতো।একদম মিষ্টি মিষ্টি।”

দুজনের খুনশুটিতে হেসে উঠলো অনু।ঈশার পুরো রুমটা গুছিয়ে রাখছিলো সে।এবার পালা নিজেকে সাজানোর গোল্ডেন রঙের একটি থ্রিপস নিয়ে প্রবেশ করলো ওয়াশরুমে।আজ ঈশার এঙ্গেজমেন্ট অনুষ্ঠান।স্বল্প আয়োজনে পুরো ঘরটা সাজানো হয়েছে।বর পক্ষে আসার আগে রুমা বেশ তাড়াতাড়ি এসে বসে আছে এর পেছনেও অবশ্য একটা কারণ আছে আর সেটা হলো রুদবা।মেয়েটা বায়না ধরেছে ঈশামনিকে দেখবে।না পেরে সবার আগে মেয়েকে নিয়ে হাজির হলো রুমা।

নিজেকে পরিপাটি করে আয়নায় তাকালো ঈশা।আজ সারাটা দিন বোধহয় তার অস্থিরতায় কাটবে।বার বার চোখে ভেসে উঠছে সেদিনের স্মৃতি যেদিন ঈশানের সাথে প্রথম দেখা। প্রথম আলাপনটা ছিল তাদের ঝগড়ার মাধ্যমে।এই মানুষটাকে যতটা অপছন্দ করতো তার থেকেও বেশি এখন ভালোবেসে ফেলেছে।মেসেজের টোনে ধ্যান ভাঙে ঈশার।ঈশান মেসেজ পাঠিয়েছে,

” বেশি সাজসজ্জার প্রয়োজন নেই।যদি আমার মন ঘুরে যায় মেয়ে তবে মনে রেখো আজকে বাপের বাড়িতে তোমার শেষ দিন হবে।”

এই কথার মানে ঈশা কি বুঝেছে?হয়তো হ্যাঁ।তাই তো মেয়েটার চোখে মুখে লজ্জার হাসি।
#চলবে__