অবেলায় এলে তুমি পর্ব-০৬

0
190

#অবেলায়_এলে_তুমি🍁
#পর্ব:৬
#লেখনীতে: তামান্না_ইসলাম_কথা

সারাদিনের ক্লান্তি শেষ করে করে মাত্রই বাড়ি ফিরেছে নিহান। এখনো গলায় টাই আর হাতের ঘড়ি পড়ে আছে সে। অফিসে জরুরী মিটিং থাকায় আজকের চাপ ছিলো দিগুন। আর যেই প্রজেক্ট নিয়ে মিটিং ছিল সেটা ছিলো অরিত্রির রেখে যাওয়া শেষ প্রজেক্ট। বেশ কয়েক মাস ধরে মিটিং পেন্ডিং ছিলো বিভিন্ন কারণে। কিন্তু আজকে মিটিং সম্পূর্ণ করে যেনো একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পেরেছে সে। এবার যেনো অরিত্রির স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করা সময়ের অপেক্ষা। এতো দিনের এতো কাঠখড় পুড়িয়ে আবারো সেই পুরনো কাজে ফিরে আসা। এইবার সম্পূর্ণ কাজ নিহান নিজে দাঁড়িয়ে থেকে একটু একটু করে শেষ করবে। নিহান অরিত্রির কোনো স্বপ্নকে অসম্পূর্ণ রাখবে না। অরিত্রির প্রতিটি স্বপ্ন সে নিজে সম্পূর্ণ করবে। ‌মানুষ নেই তো কি হয়েছে? মানুষের রেখে যাওয়া স্বপ্ন আর ভালোবাসা তো আছে! এই দু’টো থাকলেই যে কোনো স্বপ্ন সম্পূর্ণ করা যায়। হোক সেটা দেরিতে কিন্তু সম্পূর্ণ হয়তো! নিহান অরিত্রির স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে পারবে ভেবে মনে মনে অনেক খুশি। সে ঠিক করেছে আজ অনেক গুলো দিন পর সেই ঘরটাতে যাবে যেখানে অরিত্রির প্রতিটি স্পর্শ মিশে আছে।

“আম্মা আমাকে এক….”

” তরী সেই সকালে বাড়ি থেকে বের হয়েছে এখনো বাসায় ফিরেনি। আমি তরীকে ফোন করেছিলাম কিন্তু ফোন বন্ধ বলছে বারবার। আমি তরীর মামা বাড়ি ফোন করেছিলাম কিন্তু সেখানে নেই। তরীকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না নিহান।”

সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে গলার টাই খুলতে খুলতে মায়ের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে যাচ্ছিল নিহান কিন্তু তার সেই কথা শেষ করার আগেই মায়ের কথা শুনে তড়িৎ গতিতে বোঝে যাওয়া চোখ দুটি খুলে নিলো। এখন সময় রাত নয়টা। আর এখনো তরী বাসায় ফেরেনি। মূহুর্তের মাঝেই যেনো খুশির যেই রেশ ছিল সেটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো।

“তরী সকাল থেকে বাসায় নেয় আর তুমি আমাকে এখন জানাচ্ছো আম্মা? এখন কয়টা বাজে দেখেছো তুমি? সারাদিন চলে গেলো আর তুমি আমাকে এখন বলছো তরী বাসায় নেই?”

মায়ের কথা শুনে রেগে কথা গুলো বললো নিহান।

“আমি ভেবেছিলাম হয়তো সময় মতো চলে আসবে। কিন্তু এখনো এলো না। আমি তরীকে ফোন করে না পেয়ে তোকেও কল করেছিলাম কিন্তু তুই ফোন ধরিসনি।”

মিটিং থাকায় ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছিল নিহান। মিটিং শেষ করার পর ফোন সাইলেন্ট অফ করেনি আর ফোনও চেক করেনি।

“তরী বাসা থেকে কখন বের হয়েছে?”

“সকাল দশটায় ভার্সিটির জন্য বের হয়েছে।”

মায়ের থেকে কথাটা শুনে আর কালবিলম্ব না করে বসা থেকে উঠে গাড়ি চাবি নিয়ে বের হয়ে যায় নিহান। এই রাতের বেলা কোথায় খুঁজবে সে এখন।
বারবার খুশি গুলো এসেও যেনো হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। যত বার একটু সুখের দেখা মিলে সুখ গুলো ছুঁয়ে দেখার চেষ্টা করে ততবারই যেনো কোনো অজানা কিছু সেই সুখ কেড়ে নিয়েছে।

🍁🍁🍁🍁

অজ্ঞান অবস্থায় এক অন্ধকার রুমে চেয়ারে হাত,পা বাঁধা অবস্থায় বসে আছে তরী। মুখে কালো কাপড় বেঁধে তার সামনে বসে আছে কেউ একজন। বারবার হাতে থাকা সিগারেটে সুখটান দিয়ে যাচ্ছে সে। সিগারেটের শেষ বারের মতো ফুঁক দিয়ে টেবিলের উপর রাখা পানির গ্লাস নিয়ে সেটা মুখে ছুড়ে মারে।
চোখে মুখে পানি পড়তেই দড়ফড়িয়ে সোজা হয়ে বসতে গেলাম। কিন্তু সেটা আর সম্ভব হলো না। সোজা তো হতে পারলাম না সাথে মাথা ব্যথা শুরু হলো। চোখ দুটো যত বার মেলে দেওয়ার চেষ্টা করছি ততবারই আমি অন্ধকার ছাড়া অন্য কিছু দেখতে পারছি না। হাত নাড়াচাড়া করতেই অনুভব করলাম আমি হাত নাড়াতে পারছি না। হাত ব্যাথা হয়ে আছে। শুধু হাত বা মাথা নয় সম্পূর্ণ শরীর কেমন ঝিমঝিম করছে। কাউকে একটু ডেকে নিবো সেই শক্তি টুকুও যেনো শরীরে অবশিষ্ট নেই। তবে এতটুকু বুঝতে পারলাম আমার সামনে কেউ একজন আছে। ঘরের মাঝে সিগারেটের গন্ধ বিদ্যমান।

“তরী! তরী! তরী!”

কথাটা বলে কেউ একজন আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে অবচেতন অবস্থায় বুঝতে পারলাম। তার পায়ের জুতোর শব্দ তার প্রমাণ দিচ্ছে, সাথে তার থেকে সিগারেটের তীব্র গন্ধ নাকে বাঁধছে।

“তোর অনেক পাখা গজিয়েছে তাই না? আমার অবর্তমানে তুই যা খুশি তাই করে যেতে পারবি ভেবেছিলি? চারটা বছর ধরে তোকে আমি ভালোবেসে গেছি আড়ালে থেকে।‌ আর তুই শেষ পর্যন্ত একটা ব্লা*ডি ফুলকে বিয়ে করে নিলি ঢ্যাং ঢ্যাং করতে করতে? আমার ভালোবাসা কিছুই না? তোর কাছে? আর কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতে পারলি না তুই? আর আজকাল নাকি তুই অনেক কথা বলতে শিখেছিস? তাহলে এখন কথা বলছিস না কেনো? যখন তোর কথা বলার দরকার তখন কথা বলিস না আর অসময়ে মুখে খই ফুটে? তোকে তো আমি! আর তোর ওই মামীর খুব লোভ তাই না? ঐ মহিলাকে তো আমি শেষ করে দিবো। আমাকে দেওয়া কথার অবাধ্য হয়েছে।”

কথাটা বলার পর পরই গালে তীব্র জ্বালা অনুভব করলাম। ঠোঁটের পাশেও জ্বালা করতে শুরু করেছে। লোকটা এতেই যেনো শান্ত হলো না। আবারো চুলে টান দিয়ে গালে সজোরে একটা থাপ্পড় দিলো।
সারাদিন অভুক্ত তার উপর অ*ত্যাচার নিতে না পেরে আবারো অজ্ঞান হয়ে গেলাম।

“এই তরী! তরী! কথা বলো। আমি তোমার গায়ে আর হাত তুলবো না। তুমি আমার সাথে কথা বলো। তরী! এই তরী! আমার দিকে তাকাও। আমাকে কেনো তোমরা এভাবে রাগিয়ে দেও? আমি তো তোমার গায়ে হাত তুলতে চাইনি। আমার ভুল হয়ে গিয়েছে। আর এমন করবো না। তুমি শুধু একটু তাকাও।”

লোকটা পাগলের মতো কথা গুলো বলতে বলতে আবারো চোখে মুখে পানির ছিটা দিতে লাগলো। কিন্তু আর কোনো নড়াচড়া না দেখে লোকটা অস্থির হয়ে পড়লো। বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকা গার্ডদের তাড়াতাড়ি গাড়ি বের করতে বলে তরীকে কোলে তুলে নেয়।

🍁🍁🍁🍁

জানালার কাঁচ ভেদ করে সূর্যের তীব্র আলো এসে চোখে মুখে লাগছে, সাথে হসপিটালের ফিনাইলের গন্ধ। হাতে স্যালাইন চলমান। চোখে এসে রোদ লাগতেই ঘুম ভেঙ্গে গেলো‌। পিটপিট করে তাকিয়ে নিজের অবস্থান দেখার চেষ্টা করতেই দেখি হাতের কাছেই নিহান মাথা ঠেকিয়ে শুয়ে আছে। গায়ে সেই গতকাল সকালের পোশাক, চুল গুলো এলোমেলো হয়ে আছে। ভদ্রলোকটা কি একটু নিজের দিকে খেয়াল করেনি? ভদ্রলোককে দেখতে কেমন বিধ্বস্ত লাগছে। এই এক সপ্তাহে আমি লোকটাকে এমন এলোমেলো অবস্থায় দেখিনি। সে সবসময় পরিপাটি হয়ে থাকেন। ধীরে ধীরে হাত উঁচু করতে গেলেই হাতে আবারো ব্যাথা কেঁকিয়ে উঠি।

“তরী তুমি ঠিক আছো তো? কোথায় ব্যাথা করছে? ডাক্তার ডাকবো?”

আমার কেঁকিয়া উঠার শব্দ শুনে নিহানের ঘুম ভেঙ্গে যায় আর ঘুম ভাঙতেই আমাকে প্রশ্ন করে বসলেন। লোকটা এতো প্রশ্ন করতে পারে যে, মাঝে মাঝে মনে হয় লোকটা বিজনেসম্যান না বরং আমার ভার্সিটির টিচার। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের যেমন কাজ স্টুডেন্টদের প্রশ্ন করা এই ভদ্রলোকের কাজ আমাকে প্রশ্ন করা।

“কি হলো তরী কথা বলছো না কেনো? কোথায় সমস্যা হচ্ছে বলো।”

কোনো কিছু না বলতেই ভদ্রলোক আবারোও প্রশ্ন করলেন এবার কিছু না বলে মাথা নাড়িয়ে না করে দিলাম।
কিন্তু আমি তো গতকাল ভার্সিটি শেষ করে তিথির বাসায় যাচ্ছিলাম কিন্তু তারপর!

“আমার আপনাকে কিছু বলার ছি….”

“ভাবী তাড়াতাড়ি করে সুস্থ হয়ে উঠুন। এতো গুলো মাস পর দেশে ফিরেছি আর আমার ভাই বিয়ে করেছে কোনো কিছু না জানিয়ে। এইটা আমি এমনি এমনি মেনে নিবো না কি? তাড়াতাড়ি করে সুস্থ হয়ে উঠুন আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে আবারো আপনাদের বিয়ে দেখতে চাই।”

নিহানকে কিছু বলতে যাবো কিন্তু আমার কথা শেষ করার আগেই অপরিচিত কেউ একজন দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতে করতে কথা গুলো বললো। লোকটা দেখে আমি ব্রু জোগলে ভাঁজ ফেলে লোকটার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

“আরে আয়ান! থ্যাংকস্ ভাই। তুই যদি তরীকে খুঁজে পেতে সাহায্য না করতি তাহলে আমি জানতাম না আমি ওকে কি ভাবে খুঁজে পেতাম। তুই বরাবর আমার বিপদে পাশে থেকেছিস। তোকে যত ধন্যবাদ দিবো ততই যেনো কম হয়ে যাবে। তরী এই হচ্ছে আমার বেস্টফ্রেন্ড আয়ান। আজকে সে তোমাকে রাস্তা থেকে বিধ্বস্ত অবস্থায় খুঁজে পেয়েছে। আজ যদি আয়ান না থাকতো তাহলে হয়তো আমি তোমাকে খুঁজে পেতাম না।”

প্রথম কথা গুলো নিহান আয়ান বলা লোকটাকে বললেও শেষ কথা গুলো আমাকে বলে তাঁরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরলো।

“তুই আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করে দিচ্ছিস নিহান। তুই তো সব সময়ই বলতি বন্ধুত্বের মাঝে কোনো স্যরি,থ্যাংকস্ নেই। কিন্তু ভাই তুই যে আমাকে না জানিয়ে এভাবে একা একা বিয়ে করে নিলি এইটা একদম ঠিক কাজ না। তবে আমি খুশি হয়েছি অরিত্রিকে ভুলে নতুন করে সব কিছু শুরু করেছিস এই ভাবে। কিন্তু আমি আন্টির থেকে শুনেছি তোর বিয়ের রিসেপশন এখনো হয়নি। আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তোদের আবার বিয়ে দেখতে চাই।”

আমি যে এখানে উপস্থিত লোক দুটো সম্পূর্ণ ভুলে বসে আছে। আর বিয়ে দেখতে চাই মানে কি? আমাদের বিয়ে তো হয়েছে তাহলে আবার বিয়ের এক সপ্তাহ পর বিয়ে করতে যাবো পাগল টাগল হলে না কি? কোথাকার কোন উটকো ঝামেলা। এমন উটকো বন্ধু কই থেকে আসে জনাবের? মাঝখানে আমার কথা শেষ করার আগেই চলে এসেছে।

“আবার বিয়ে মানে?”

চোখ দুটো ছোট ছোট করে দুইজনের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম।

“মানে হচ্ছে, আমি চাচ্ছি আপনাদের বিয়ের রিসেপশন করে নিতে এবং সেই দিন কাজী ডেকে আবারো বিয়ে করবেন আপনারা।”

আমি প্রশ্ন করতেই লোকটা নিহানে পাশ থেকে আমার বেডের পাশে এসে দাঁড়িয়ে কথা গুলো বললো। কিন্তু লোকটার কথা গুলো আমার কানে বিঁধছে।

“সে পরে দেখা যাবে আগে তরী সুস্থ হয়ে বাসায় ফেরুক।”

কথাটা বলেই ভদ্রলোক আমার পাশে এসে বসে ঠোঁটের কেটে যাওয়া অংশে একটা অয়েলমেন্ট লাগিয়ে দিলেন। গালে এবং হাতের বেঁধে রাখা স্থানেও লাগিয়ে দিলেন। ইশ্! ভদ্রলোকটা এখন কি সুন্দর করে আমার সেবা করছে। কে বলবে এই লোক দুইদিন আগেও আমাকে বকাঝকা করেছে।

🍁🍁🍁🍁

“তোমার কৃতকর্মের জন্য সবাইকে ভুগতে হবে। তৈরি হয়ে থেকো আমার সাথে আন্যায় করার শা*স্তির জন্য। সর্ব প্রথম তোমার স্বামী যাবে।”

হসপিটাল থেকে আসার পর নিরাত্রিকে আম্মা নিজের কাছেই রেখেছে। নিরাত্রি আম্মার কাছে বিধায় আমি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কফির পাশাপাশি ব্যস্ত নগরীর দেখছিলাম। কিন্তু কে যেনো ছোট একটা কাগজে কথা গুলো লিখে কাগজটা সুন্দর করে পাথরে পেঁচিয়ে আমার সামনে ফেলে দিলো। আশেপাশে খোঁজার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। হাতে নিয়ে কাগজ খুলতেই গুটা অক্ষরে কথা গুলো লেখা দেখে হাত থেকে কাগজটা সেখানেই পড়ে গেলো। কাগজটা সেখানেই রেখে দৌড়ে ব্যালকনি থেকে রুমে এসে ভদ্রলোককে কল করে যাচ্ছি। কিন্তু ভদ্রলোক ফোন রিসিভ করছে না। এবার যেনো ভয় পেয়ে বসলো আমাকে। কি করবো কিছু বুঝতে উঠতে পারছি না।

” এই ফোনের মানুষ তো এক্সিডেন্ট করে গুরুতর আহত হয়ে রাস্তায় পড়ে আছে।”

এতো সময় কেউ ফোন রিসিভ করছিলো না যাও রিসিভ করলো অপর পাশের লোকটির কথা শুনে সেখানেই আবারো সেন্সলেস হয়ে পড়ে গেলাম।

#চলবে