#অবেলায়_এলে_তুমি🍁
#পর্ব:১৮
#লেখনীতে: তামান্না_ইসলাম_কথা
ধরনীর বুকে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। রাস্তায় থাকা সোডিয়ামের আলোয় আলোকিত করে তুলেছে চারপাশ সাথে আছে রাস্তার পাশে থাকা দালান কোঠার আলো। রাস্তার কিনারে থাকা হকার গুলো নিজের জিনিস পত্র গুছিয়ে নিজের বাসস্থানের দিকে ছুটে চলেছে তো কিছু পথ শিশু রাস্তার কিনারে শুয়ে আছে। কিছু মানুষজন রিকশা নিয়ে এই সময়ে ঘুরে ফিরছে তো আবার কেউ কেউ নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে ছুটে চলেছে।
” আরে দেখে চলতে পারেন না? এভাবে কেউ রাস্তা দিয়ে হাঁটে? ঠিক ভাবে হাঁটতে না পারলে রাস্তায় বের হয়ে আসেন কেন? আমার এতো দামি জামায় ময়লার দাগ পড়ে গেছে। কেনো যে এরা রাস্তায় বের হয়ে আসে। যত্তসব!”
রাস্তায় কিনারে দাঁড়িয়ে আইসক্রিম খেতে খেতে নিহানের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। হঠাৎ কারো সাথে ধাক্কা লেগে নিচে পড়ে গেল আর সেখানে বসে বসেই রেগে গিয়ে আমার উদ্দেশ্যে কথা গুলো বললো।
” আমি স্যরি! আমি আসলে বুঝতে পারিনি। স্যরি!”
“স্যরি মাই ফুট! স্যরি বললেই কি সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে না কি? আমার এই জামার দাগ গুলো উঠে যাবে কি আপনার স্যরিতে?”
এখনো মেয়েটি নিজের জামাকাপড়ের ধুলো ছাড়তে ছাড়তে আবারো কথা গুলো বললো। কিন্তু মেয়েটির মুখ এখনো দেখতে পারলাম না। আর মেয়েটি নিজেও এখনো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কথা গুলো বললো না।
” আমি তো আপনাকে স্যরি বলেছি তাহলে এমন ব্যবহার করছেন কেনো? যারা নিজের ভুলের জন্য ক্ষমা চাই তাদের ক্ষমা করতে হয়।”
আমার কথা শুনে এবার সামনে থাকা মেয়েটি আমার দিকে পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টিতে তাকায়। মেয়েটিকে দেখে কিছু সময় স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। সে-ই একই রকমের চোখ, একই জায়গায় তিল, মুখের আদল বেশ পরিচিত পরিচিত। কিন্তু এইটা কি করে হতে পারে। যদিও আমি তাকে দেখিনি কিন্তু সেম একই জিনিস একই স্থানে।
” সবাইকে ক্ষমা করা যায় না বিশেষ করে আপনাদের মতো মে…. ঠিক আছে নেক্সট টাইম দেখে শুনে হাঁটবেন।”
এতো সময় মেয়েটি রাগি ভাবে কথা গুলো বললেও শেষ কথা গুলো তাড়াহুড়ো করে বলে সেখান থেকে চলে গেলো। এমন ব্যবহার দেখে মনে হলো, কিছু থেকে পালানোর চেষ্টা করলো। এই দিকে আমাকেও আর কিছু বলার সুযোগ দিলো না।
” কি হয়েছে? তুমি ঐ দিকে তাকিয়ে কি দেখছো?”
পিছন থেকে কেউ কথা গুলো বলতেই এক কদম পিছনে গিয়ে দেখি দুই হাতে হাওয়ায় মিঠায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিহান। হঠাৎ করে হাওয়ায় মিঠায় দেখে নিহানের কাছে আবদার করতেই সে হাওয়ায় মিঠায় নিয়ে আসতে গিয়েছে। গাড়িতে বসে থাকতে বিরক্ত লাগছিলো বলেই গাড়ি থেকে বের হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে ভাবতে পারিনি। নিহান এখনো প্রশ্নের উত্তরের আশায় আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
” একটা মেয়ের সাথে ধাক্কা লেগে পড়ে গিয়েছিল স্যরি বললাম কিন্তু হঠাৎ করে কি জানি হলো তাড়াতাড়ি করে এখান থেকে চলে গেলো। মনে হলো, কোনো কিছু নিয়ে ভয় পেয়ে পালিয়ে গিয়েছে।”
” সবাই তোমার মতো বোকা না যে সামান্য একটু ধাক্কায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করে কথা বলবে। হয়তো কোনো তাড়াহুড়ো ছিলো তাই কিছু না বলে চলে গেছে। আর তোমাদের মানে মেয়েদের স্বভাব হচ্ছে, বেশি ভাবা এবং তিল থেকে তাল তৈরি করা।”
নিজের হাতে থাকা হাওয়ায় মিঠায় আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে কথা গুলো বললো নিহান। নিহানের কথা সত্যি যে, আমি আজকাল একটু বেশি ভাবতে শুরু করেছি। কিন্তু তাই বলে তিল থেকে তাল তৈরি করি না। মেয়েটির ব্যবহার যেমন অদ্ভুত ছিলো তার থেকেও বেশি অদ্ভুত ছিলো, মেয়েটির মুখে আদল। যেটা আমাকে না চাইতেও বেশি ভাবতে বাধ্য করেছে।
” ম্যাডাম চলুন এবার! এমনিতেই প্রচুর গরম পড়েছে সাথে আবার আপনার এই রূপের আগুনে আরো গরমে সিদ্ধ হয়ে গেলাম। সে-ই বিকেল থেকে আমাকে পাগল করে রেখেছেন। এবার চলুন আমার আপনাকে আদর করতে ইচ্ছে করছে।”
কথাটা কানে পৌঁছতেই চোখ বড়ো বড়ো করে নিহানের দিকে তাকালাম। ছিঃ! কথা বলার ছিরি। রাস্তাঘাটে দাঁড়িয়ে কোন মানুষ এমন সব কথা বলে? দিনকে দিন ভদ্রলোক থেকে অভদ্র এবং লজ্জাহীন লোকে পরিণত হচ্ছে। আমাকে এভাবে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে থাকতে দেখে ক্যাবলা কান্তের মতো সামনে দাঁতকপাটি বের করে দাঁড়িয়ে রইলো।
” দিন দিন কি আপনার বয়স বাড়ছে না কি কমছে? একে তো রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি তার উপর আবার বুইড়া বয়সে এসে একটা কচি মেয়ে বিয়ে করে এখন নিজেও বুড়ো থেকে ইয়াং হয়ে যাওয়ার পায়তারা করছেন? লজ্জা করে না আপনার আমার মতো নিরীহ মেয়ের সামনে এইসব কথা বলতে?”
দাঁতে দাঁত চেপে আগের ন্যায় মুখের ভারসাম্য রেখে কথা গুলো বললাম। কিন্তু এতে যেনো নিহানের কান পর্যন্ত সম্পূর্ণ কথা পৌঁছিয়েও পৌঁছাল না। যা তার কথা শুনে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম। কথাটা ছিল এমন-
” কি করবো বলো বুড়ো বয়সে এমন কচি মেয়ে পেলে তো নিজেকে ঠিক রাখা সম্ভব না। তার উপর যদি এমন সুন্দর বউ হয়ে থাকে তাহলে তো সোনায় সোহাগা তাই না। এমন কচি মেয়ে পাশে থাকলে যে কেউ বুড়ো থেকে ইয়াং হয়ে যাবে। এন্ড ইউ নো হোয়াট বুড়ো মানুষের মনে ভালোবাসা থাকে বেশি এবং এরা বউকে আদর করে বেশি বেশি। আর আমি তো রাস্তায় দাঁড়িয়ে আদর করার কথা বলিনি। আমারও তো লজ্জা শরম আছে না কি? তাই বললাম তাড়াতাড়ি বাড়ি চলো যেনো আমাকে এই মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছু করতে না হয়।”
মানুষটার কথা শুনে ইচ্ছে করছে নিজের কপাল নিজেই দেয়ালের সাথে ঠুকে দেয়। আমি যে একটা নির্লজ্জ মানুষের সাথে সংসার করছি এতে বিন্দু পরিমানে সন্দেহ নেই। মানুষটা কতটা নির্লজ্জ হলে এভাবে মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এইসব কথা বলে। এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লোকটার এমন ক্যাবলা কান্তের হাসি এবং এমন নির্লজ্জ মার্কা কথা শোনার ইচ্ছে না থাকায় আর কিছু না বলে চুপচাপ গাড়িতে গিয়ে বসে পড়লাম। আল্লাহ যে বেছে বেছে আমার কপালেই এমন নির্লজ্জ মার্কা জামাই দিছে ভাবতেই অবাক লাগে।
🍁🍁🍁🍁
রাত এগারোটা। ধুলো বালি এবং মাকরোশা দিয়ে ঘেরা রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক তরুণী। রুমের প্রতিটি দেয়ালে থাকা ছবি গুলোতে মাকরোশার বসবাস চলছে। যে কেউ দেখলে বলবে এই রুমে কত বছর ধরে না জানি কারো পদচারণা হয় না। অথচ এই বাড়ির বাকি রুমে গুলো সুন্দর পরিষ্কার করে রাখা হয়েছে শুধু এই রুমটা এমন বেহাল অবস্থায় পড়ে আছে। রুমের সামনে থাকা মাকরোশার জ্বাল একটু একটু ছিঁড়ে রুমের মাঝ বরাবর গিয়ে দাঁড়ায় ঘরের প্রতিটি কোনায় চোখ বুলাতে লাগল। কিন্তু রুমের প্রতিটি কোনায় কোনায় শুধু মাকরোশার জ্বাল ছাড়া আর কিছুই নজরে পড়লো না। মাকরোশার জ্বাল ছিঁড়ে একটা ছবির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। ছবিতে পর্দা থাকায় শুধু ছবিটা এখনো সুন্দর ভাবে আছে। কোনো ধুলোবালি বা মাকরোশা জ্বাল বুনতে পারেনি।
“আজকে আবারো সে-ই মানুষটির সাথে দেখা হয়েছিল মা। সে-ই মানুষ যার জন্য তোমার আদরের মেয়ের করুণ দশা হয়েছিল। একটা হাসিখুশি পরিবার মূহুর্তের মাঝেই শেষ হয়ে গিয়েছে। আমার থেকে তোমরাও মুখ ফিরিয়ে চলে গেলে না ফেরার দেশে।। আমাকে এভাবে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার একটা সুযোগ তুমি না দিয়ে এভাবে অভিমান করে চলে গেলে মা। আমাকে অপরাধী করে দিয়ে কেনো চলে গেলে তোমরা? বাবা তো আমাকে সে-ই কবেই একা করে চলে গেলো তারপর তো তোমরাই আমার সব কিছু জুড়ে ছিলে তাহলে তোমরাও আমাকে কেন একা করে চলে গেলে? দেখো মা! আমাকে তোমাদের চোখে অপরাধী করে দিয়ে কি সুন্দর করে দ্বিতীয় স্ত্রী নিয়ে লোকটা সুন্দর ভাবে সুখে সংসার করছে। আমি তো লোকটাকে এতো সুন্দর করে সংসার করতে দিতে পারি না মা। যেই লোকটা আমার থেকে তোমাদের কেড়ে নিয়েছে, আমাকে করেছে তোমাদের চোখে অপরাধী তাকে তো আমি কিছুতেই সুখের সংসার করতে দিবো না। আমার সাথে, আমাদের সাথে করা প্রতিটি অন্যায়ের প্রতিশোধ আমি নিয়েই ছাড়বো। তোমাদের সাথে হওয়া অন্যায়ের ন্যায় বিচার আমি তোমাদের পাইয়ে দিবো।”
ছবিতে থাকা পর্দা সরিয়ে ছবির সামনে দাঁড়িয়ে কথা গুলো বললো তরুণী। ছবিতে থাকা হাস্যোজ্জ্বল একটি পরিবারের ছবি। বাবা মায়ের দুই পাশে দুই তরুণী তাদের জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু সময় ছবির দিকে তাকিয়ে থেকে ছবিতে হাত বুলিয়ে রুম থেকে বের হয়ে আসে তরুণী। এখন গন্তব্য “সুখবিন্দর নিবাস।” সময় হলেই নিজের উদ্দেশ্যের দিকে পা বাড়াবে।
একটা সময় যেই বাড়ির প্রতিটি কোনায় কোনায় হাসির কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে থাকতো সেই বাড়িতে এখন আর হাসির শব্দ শুনতে পাওয়া যায় না। মাঝে মাঝে কারো চিৎকার করে কান্না করার শব্দ ভেসে আসে। প্রতিটি শব্দে প্রিয় মানুষদের হারানোর হাহাকার ভেসে আসে।
#চলবে